বিভিন্ন হাদিস দেখিয়ে দাবি করা হয়, যে আয়েশাহর (রা.) বয়স যখন ৯ বছর ছিল তখন নবী (ﷺ) তাঁর সাথে সহবাস করেছিলেন। এহেন দাবি করে ইসলামের শত্রুরা নবী করিম (ﷺ)কে শিশুকামী (Pedophile) বলার স্পর্ধা দেখায় (নাউযুবিল্লাহ)। এই লেখাটিতে একটি ভাষাগত আলোচনার মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিশ্লেষণ করা হবে যে উক্ত হাদিসগুলোতে আসলেই এমন কিছু বলা হয়েছে, নাকি অন্য কিছু বোঝানো হয়েছে।
এই মর্মে যেই হাদিসগুলো দেখানো হয়, তার প্রায় সবগুলোরই মূল রূপ কিছুটা এমনঃ
"আয়েশাহ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন আমি যখন ৬ বছর বয়সী ছিলাম তখন রাসুল (ﷺ) আমাকে বিয়ে করেন, এবং আমি যখন ৯ বছর বয়সী ছিলাম তখন তিনি (ﷺ) আমার সাথে সহবাস (যেই অর্থটা প্রচার করা হয়) করেন। " _ [1] [2]
বর্ণনাটির কিছু রেওয়ায়েতে আয়েশাহ (রা.) "তৃতীয় ব্যাক্তি" (Third person) হিসেবে এসেছেন, এবং বাচনভঙ্গী ও শব্দের ছোটখাটো পার্থক্যের বিবেচনায় এই হাদিসটির একাধিক ধরণের রেওয়ায়েত রয়েছে … । [3] [4]
আবার এ সংক্রান্ত হাদিসের ইংরেজি অনুবাদে 'Consumate' শব্দটি দেখেও অনেকে ধারণা করেন এখানে মূল আরবিতে সহবাসের কথা বলা হয়েছে।
হাদিসটির যে সমস্ত রেওয়ায়েত হতে দাবি করা হয় যে তিনি (রা.) এখানে 'সহবাস' এর কথা উল্লেখ করেছেন, সেসব রেওয়ায়েতে 'البناء بِ' (আল-বানায়ু বি)এবং 'الدخول ب' (আদ-দুখুলু বি), এ দুইটি কথা ব্যবহৃত হয়েছে।
উল্লেখিত البناء بِ কথাটির অর্থ যা, الدخول ب কথাটির অর্থ তাই, অর্থাৎ এ দু’টি কথা একে অপরের সমার্থক।
জামালুদ্দিন ইবনুল-যাওযি (রহ.) তাঁর 'কাশফুল মুশকিল মিন হাদিসিস সাহিহাইন' গ্রন্থে লিখেছেন :
"وَالْبناء بِالْمَرْأَةِ: الدُّخُول بهَا" _ [5]
অর্থ: "একজন মহিলার সহিত আল-বানায়ু বি হওয়া মানে হলো উক্ত মহিলার সহিত আদ-দুখুলু বি হওয়া। "
এই 'الدخول ب' কথাটির দু’টি অর্থ হয়, একটা হলো বিয়ে করে সহবাস করা, এবং আরেকটা হলো 'নির্জনে সাক্ষাত করা'।
ড. আহমদ মুখতার আব্দুল-হামিদ উমার তাঁর অভিধান 'মুজামূল লুগাতিল আরাবীয়াতিল মুয়াসিরাহ' তে লিখেছেন :
"دخَل الزَّوجُ بفلانة/دخَل الزَّوجُ على فلانة: اختلى بها، تزوّجها وجامعها"_ [6]
অর্থ - স্বামী তার স্ত্রীর সহিত আদ-দুখুল বি করলো / আদ-দুখুল আলা করলো : সে তার (স্ত্রীর) সহিত নির্জনে সাক্ষাত করলো (প্রথম অর্থ), তাকে বিয়ে করে তার সাথে সহবাস করলো (দ্বিতীয় অর্থ)।
আর পুর্বেই স্পষ্ট করা হয়েছে, যে الدخول ب ও البناء بِ একই অর্থবিশিষ্ট একে অপরের সমার্থক।
সুতরাং, الدخول ب ও البناء بِ কথা দু’টিসহ বর্ণিত রেওয়ায়েতগুলো দ্বারা দু’টি বিষয় বুঝানো হয়ে থাকতে পারে, হয় এর দ্বারা নিছক 'নির্জনে সাক্ষাত করা' বোঝানো হয়েছে, আর নাহয় এরদ্বারা 'সহবাস করা' করা বোঝানো হয়েছে। এই কথা দু’টিসহ বর্ণিত রেওয়ায়েতগুলো নিজেরা এটা স্পষ্ট করছে না যে হাদিসে 'সহবাস' বোঝানো হয়েছে, নাকি 'নির্জনে সাক্ষাত করা' বোঝানো হয়েছে। এখানে উভয় অর্থের যেকোনটি সঠিক হবার সম্ভাবনা থাকে। তবে অন্যান্য কিছু রেওয়ায়েতের সাহায্যে এটির স্পষ্টকরণ পাওয়া যায়, সুনির্দিষ্টভাবে বোঝা যায় যে এখানে কোন অর্থ প্রযোজ্য হবে।
আলোচ্য হাদিসটির অন্যান্য বিভিন্ন রেওয়ায়েতে الدخول ب ও البناء بِ এর বদলে বিকল্প হিসেবে ভিন্ন কিছু কথা বর্ণিত হয়েছে, নিম্নে সেগুলো উল্লেখ করা হলো।
এক.
আন-নাসাঈর বর্ণিত একটি, আল-বুখারীর বর্ণিত একটি, আবু-আওয়ানাহর বর্ণিত একটি, আত-তাবারানীর বর্ণিত চারটি, ইবন হাযমের বর্ণিত একটি, ইবন হিব্বানের বর্ণিত একটি অর্থাৎ সর্বমোট ৯ টি রেওয়ায়েতে الدخول ب ও البناء بِ এর বদলে 'الدخول علی' (আদ-দুখুলু আলা) কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে। [7]
ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমান তাঁর 'আল-মুজামূল ওয়াফী' (আরবি-বাংলা) অভিধানে الدخول علی এর অর্থ লিখেছেন : দেখতে যাওয়া, সাক্ষাত করা, পরিদর্শন করা। [8]
দুই.
মুসলিম, ইবন আবি-আসেম, আন-নাসাঈ, আবু-আওয়ানহ, আল-বাগভী, আল-বায়হাকী, আবু-নুয়াইম ও ইবন আবিদ-দুনিয়া এনাদের প্রত্যেকে একটি করে সর্বমোট ৮ রেওয়ায়েত বর্ণনা করেছেন। এই রেওয়ায়েতগুলোতে الدخول ب ও البناء بِ এর বদলে 'زف' (যাফফুন) ব্যবহৃত হয়েছে। [9]
ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমান তাঁর অভিধানে 'زف' এর অর্থ লিখেছেন : কনেকে বরের কাছে পাঠানো, কন্যা সম্প্রদান করা, বউ নিয়ে আসা। [10]
তিন.
আব্দুর-রাজ্জাকের দুইটি, আত-তাবারানীর একটি, আবু-নুয়াইমের একটি, অর্থাৎ তাঁদের সকলের বর্ণিত সর্বমোট ৪ টি রেওয়ায়েতে الدخول ب ও البناء بِ এর বদলে 'إهتداء إلی'
(ইহতিদা ইলা) ব্যবহৃত হয়েছে। [11]
ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমান তাঁর অভিধানে إهتداء إلی এর অর্থ লিখেছেন : পথের সন্ধান পাওয়া, পথ পাওয়া, পথ অনুসরণ করা, পরিচালিত হওয়া, পেয়ে যাওয়া, আবিষ্কার করা, পৌঁছে যাওয়া _ [12]
অর্থাৎ, উক্ত হাদিসটির অন্যান্য বিভিন্ন রেওয়ায়েতে الدخول ب ও البناء بِ এর বদলে এই তিনটি কথা الدخول علی ও زف ও إهتداء إلی বর্ণিত হয়েছে। বিকল্প হিসেবে বর্ণিত হওয়া উক্ত তিনটি কথা উক্ত দু’টি কথার সহিত অর্থের দিক দিয়ে খুবই কাছাকাছি, সাদৃশ্যপূর্ণ ও সামঞ্জস্যসাধনযোগ্য।
মুহাদ্দিস ড. ইব্রাহিম বিন আব্দুল্লাহ আল-লাহিম একই হাদিসের জন্য রেওয়ায়েতভেদে রাবীদের বর্ণিত শব্দ বা বাক্যের মাঝে পার্থক্য সৃষ্টি হওয়া প্রসঙ্গে লিখেছেন :
"الاختلاف بين الرواة له أسباب كثيرة، من أهمها فيما يتعلق بمتن الحديث: الرواية بالمعنى، إذ الأكثر على تجويزه، وهو الواقع في رواية السنة" _[13]
অর্থ : "রাবীদের মাঝে বর্ণনার ভিন্নতা হওয়ার প্রচুর কারণ রয়েছে, হাদিসের মতনের সহিত সম্পর্কিত ক্ষেত্রে সেসব কারণের মধ্যে অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ কারণটি হলো অর্থ অনুযায়ী বর্ণনা করা, কারণ অধিকাংশের নিকট ইহা যায়েয, এবং সুন্নাহ বর্ণনার ক্ষেত্রে ইহা সংঘটিত। "
যেহেতু বিকল্প হিসেবে বর্ণিত হওয়া উক্ত তিনটি কথা উক্ত দু’টি কথার সহিত অর্থের দিক দিয়ে খুবই কাছাকাছি, সাদৃশ্যপূর্ণ ও সরলভাবেই সামঞ্জস্যসাধনযোগ্য, সুতরাং এক্ষেত্রে অন্যান্য বিভিন্ন রেওয়ায়েতে الدخول ب ও البناء بِ এর বদলে এই তিনটি কথা الدخول علی ও زف ও إهتداء إلی বর্ণিত হওয়ার কারণ হলো রাবীদের 'অর্থ অনুযায়ী বর্ণনা করা'।
অর্থাৎ এই আলোচ্য হাদিসটির আলোচ্য অংশটির বর্ণনাকারী রাবীগন আলোচ্য অংশ হিসেবে প্রকৃতপক্ষে যা শ্রবণ করেছেন, হুবহু তা বর্ণনা না করে অংশটির অর্থ বা মর্ম ভিন্ন ভিন্ন শব্দ ব্যবহার করে বর্ণনা করেছেন। আর একারণেই কিছু রেওয়ায়েতে البناء بِ, কিছু রেওয়ায়েতে الدخول ب, কিছু রেওয়ায়েতে الدخول علی, কিছু রেওয়ায়েতে زف এবং কিছু রেওয়ায়েতে إهتداء إلی বর্ণিত হয়েছে। এবং পাঁচটির সবগুলোই একটা নির্দিষ্ট সাধারণ অর্থ বোঝানের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে, ভিন্নভাবে বললে এক্ষেত্রে সবগুলোই সমান অর্থের।
দেখা যাচ্ছে যে الدخول علی মানে হলো 'সাক্ষাত করা, পরিদর্শন করা'। زف মানে হলো 'কনেকে বরের কাছে পাঠানো'। إهتداء إلی মানে হলো 'পৌছে যাওয়া'। এই তিনটি অর্থ একটা সাধারণ মর্মকে নির্দেশ করছে, এবং সেটা হচ্ছে 'বিবাহের পরে বউকে স্বামীর নিকট প্রেরণ করার মাধ্যমে তাদের মাঝে সর্বপ্রথম যথাযথ সাক্ষাত ঘটানো'।
পুর্বেই উল্লেখ করেছি যে الدخول ب ও البناء بِ এর দু’টি অর্থ আছে, একটা হলো স্বামী স্ত্রীর নির্জনে সাক্ষাত হওয়া আর আরেকটা হলো বিয়ে করে সহবাস করা। এখন প্রশ্ন হলো এ দু’টি অর্থের মধ্যে কোনটি আলোচ্য হাদিসটির এ দু’টি শব্দবিশিষ্ট রেওয়ায়েতগুলোর জন্য প্রযোজ্য হওয়ার ক্ষেত্রে সর্বাধিক উপযুক্ত?
যদি الدخول ب ও البناء بِ এর অর্থ 'স্বামী-স্ত্রীর নির্জনে সাক্ষাত হওয়া' ধরে নেই, তাহলে দেখা যাবে যে এ দু’টি কথা কর্তৃক নির্দেশিত মূল মর্মটা অপর তিনটি কথার অর্থসমুহ কর্তৃক নির্দেশিত সাধারণ মর্মটির সাথে সর্বাধিক সাদৃশ্যপূর্ণ। আবার যদি ধরে নেই যে الدخول ب ও البناء بِ এর অর্থ 'বিয়ে করে সহবাস করা', তাহলে তা ভাষার নিয়ম অনুযায়ী শতভাগ বিশুদ্ধ হবে, তবে এক্ষেত্রে তা অপর তিনটি কথার অর্থসমুহ কর্তৃক নির্দেশিত সাধারণ মর্মটির সাথে 'স্বামী-স্ত্রীর নির্জনে সাক্ষাত হওয়া' অর্থটির মূল মর্মের তুলনায় কম সাদৃশ্যপূর্ণ ও কম সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
অতএব, যেহেতু এ দু’টি কথার অর্থ 'স্বামী-স্ত্রীর নির্জনে সাক্ষাত হওয়া' হলে কথা দু’টো অপর তিনটি কথার দ্বারা উদ্দেশ্যকৃত সাধারণ মর্মটির সাথে সর্বাধিক সাদৃশ্যপূর্ণ ও সর্বাধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, এবং উক্ত পাঁচটি কথার সব ক’টিই একটা নির্দিষ্ট সাধারণ মর্মকে নির্দেশ করার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে, সুতরাং আলোচ্য রেওয়ায়েতগুলোতে الدخول ب ও البناء بِ এর অর্থ হিসেবে 'স্বামী-স্ত্রীর নির্জনে সাক্ষাত হওয়া' অর্থটিই সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত, সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য।
একইভাবে, যেহেতু এ দু’টি কথার অর্থ 'বিয়ে করা সহবাস করা' হলে কথা দু’টো অপর তিনটি কথার দ্বারা উদ্দেশ্যকৃত সাধারণ মর্মটির সাথে 'স্বামী-স্ত্রীর নির্জনে সাক্ষাত হওয়া' অর্থটির তুলনায় তুলনামূলক কম সাদৃশ্যপূর্ণ ও কম সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়, যেখানে কিনা উক্ত পাঁচটি কথার সবকটিই একটা নির্দিষ্ট সাধারণ মর্মকে নির্দেশ করার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে, সুতরাং আলোচ্য রেওয়ায়েতগুলোতে الدخول ب ও البناء بِ এর অর্থ হিসেবে 'বিয়ে করে সহবাস করা অর্থটি' তুলনামূলকভাবে কম উপযুক্ত, কম গ্রহণযোগ্য।
এ ছাড়াও আরো বহু উপায়ে এ ব্যাপারটি অনুধাবন করা সম্ভব। যেমন : 'স্বামী-স্ত্রীর নির্জনে সাক্ষাত হওয়া' অর্থটি ধরলে দেখা যাবে যে, উক্ত পাঁচটি কথার সব ক’টাই একটা নির্দিষ্ট সাধারণ মর্ম ধারণ করছে, আর সেটা হচ্ছে 'স্বামীর স্ত্রীর সাক্ষাত হওয়া' বা 'বিবাহের পরে বউকে স্বামীর নিকট প্রেরণ করার মাধ্যমে তাদের মাঝে সর্বপ্রথম যথাযথ সাক্ষাত ঘটানো', যার ফলে এখানে সহজেই সামঞ্জস্যতা তৈরি হয়ে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে 'বিয়ে করা সহবাস করা' অর্থটি ধরলে এ দু’টি কথার অর্থে সম্পুর্ণ ভিন্ন এক ধরণের মাত্রা প্রকাশ পায়, যেই মাত্রাটি অপর তিনটি কথার অর্থের মধ্যে অনুপস্থিত, যার ফলে এখানে সহজে সামঞ্জস্যতা এসে যাচ্ছে না। আর এ দ্বারা সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে রেওয়ায়েতগুলোতে الدخول ب ও البناء بِ এর অর্থ হিসেবে 'স্বামী-স্ত্রীর নির্জনে সাক্ষাত হওয়া' অর্থটিই সবচেয়ে বেশি উপযুক্ত, সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য।
এতক্ষন পর্যন্ত আমি যা বলেছি, তা আমার একান্ত ব্যাক্তিগত কোনো তত্ত্ব নয় বরং এটি বিভিন্ন মুহাদ্দিসদের বক্তব্য দ্বারা সমর্থিত। নিম্নে এব্যাপারে কিছু মুহাদ্দিসের বক্তব্যের উদাহরণ উল্লেখ করা হলো।
উপমহাদেশের একজন বড় মাপের মুহাদ্দিস 'খালিল আহমদ আস-সাহারানফুরী' উক্ত পাঁচটি কথাদ্বারা একটিমাত্র সাধারণ অর্থ বা মর্ম উদ্দেশ্য হওয়ার বিষয়টির প্রতি সুস্পষ্ট সমর্থন জানিয়েছেন এবং উল্লেখ করেছেন যে الدخول ب, البناء بِ দ্বারা زف [স্বামীর ঘরে উঠা] বোঝানো হয়েছে।_[14]
মুহাদ্দিস 'মুহাম্মদ ইবনুল-মালাক আর-রুমী আল-কারামানী' এবং মুহাদ্দিস 'মাযহারুদ্দিন আল-হুসাইন আয-যাইদানী আল-মুযহিরী' البناء بِ কথাটির অর্থ বলেছেন "(স্ত্রীকে) ঘরে তোলা ও স্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করা " _। [15] [16] অনুরূপ বলেছেন প্রসিদ্ধ দুজন মুহাদ্দিস 'মোল্লা আলি আল-ক্বারী' ও 'শারফুদ্দিন আল-হুসাইন আত-তাইবী'। [17] [18]
মুহাদ্দিস 'আবুল-আব্বাস ইবনু রাসালান আল-মাকদিসী' البناء بِ এর অর্থ বলেছেন 'সাক্ষাত করা'। [19] মুহাদ্দিস 'মুহাম্মদ আল-আমিন আল-হারারী' البناء بِ এর অর্থ বলেছেন 'সাক্ষাত করা, স্বামীর নিকট প্রেরিত হওয়া, স্বামীর ঘরে (বউকে) উঠানো'। [20] মুহাদ্দিস 'মুহাম্মদ ফাওয়াদ আব্দুল-বাক্বী' সহিহ মুসলিমের টিকাতে البناء بِ এর ব্যাখ্যায় আল-হারারীর অনুরূপ বলেছেন। [21]
অনুরূপ ধরণের মত দিয়েছেন আরবি ভাষাবিদ 'আবু-নাসর আজ-জাওহারী' ও মুহাদ্দিস 'শামসুদ্দিন আল-বিরমাওই'। [22] মুহাদ্দিস 'মুহাম্মদ আল-আমিন আল-হারারী' পরোক্ষভাবে الدخول ب এর অর্থ বলেছেন "সাক্ষাত করা, স্বামীর নিকট প্রেরিত হওয়া, স্বামীর ঘরে (বউকে) উঠানো"। [23] [24]
'আবুল-আব্বাস ইবনু রাসালান আল-মাকদিসী' الدخول ب এর জন্য ইবনু আব্দিল-বার এর একটি বক্তব্যের অংশ উল্লেখ করে ব্যাখ্যা করেছেন যে এরদ্বারা 'সংসার তৈরি করা' উদ্দেশ্য। [25] প্রসিদ্ধ বড়মাপের একজন আলেম 'ইবনু কাইয়িমিল যাওযিয়াহ' পরোক্ষভাবে ইংগিত করেছেন যে الدخول ب কথাটি 'সাক্ষাত করা' অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। [26]
উল্লেখ, الدخول ب ও البناء بِ পরস্পরের সমার্থক, ঠিক যেভাবে 'লাউ' ও 'কদু' পরস্পরের সমার্থক, কাজেই এ দু’টির কোনো একটির জন্য যা প্রযোজ্য, তা একইসাথে উভয়েরই জন্য প্রযোজ্য, অর্থাৎ এদের কোনো একটির ব্যাপারে কোনো কিছু প্রযোজ্য তখন হবে যখন সেই বিষয়টি এদের উভয়ের ব্যাপারেই প্রযোজ্য হবে।_ [27]
এসব কারণেই এই সংক্রান্ত হাদিসের বাংলা অনুবাদে ‘বাসর হওয়া’ কথাটি দেখা যায়। বাসর হওয়া দ্বারা বিবাহের পর স্বামী-স্ত্রীর প্রথম একাকী অবস্থান করাকে বোঝানো হয়। কিন্তু বাসর হওয়া মানেই যৌন সহবাস না।
عَنْ عُرْوَةَ تَزَوَّجَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم عَائِشَةَ وَهِيَ بِنْتُ سِتِّ سِنِينَ وَبَنٰى بِهَا وَهِيَ بِنْتُ تِسْعٍ وَمَكَثَتْ عِنْدَه“ تِسْعًا.
অর্থঃ উরওয়াহ (রহ.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘আয়িশাহ (রাঃ)-কে বিয়ে করেন তখন তাঁর বয়স ছিল ছয় বছর এবং যখন বাসর করেন তখন তাঁর বয়স ছিল নয় বছর এবং নয় বছর তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে জীবন কাটান। [28]
উপসংহারঃ
আমরা উপসংহারে বলতে পারি যে, আলোচ্য হাদিসগুলো দ্বারা এটি প্রমাণ হয় যে ৯ বছর বয়সে আয়েশাহ(রা.) স্বামীগৃহে গিয়েছেন, তাঁর স্বামী নবী করিম(ﷺ) এর সঙ্গে তাঁর বাসর হয়েছে, তাঁরা একত্রে একই ঘরে থাকা আরম্ভ করেছেন । কিন্তু এর দ্বারা মোটেও সন্দেহাতীতভাবে এটি প্রমাণ হয় না যে ৯ বছর বয়সেই নবী(ﷺ) তাঁর সঙ্গে সহবাস করেছেন। এটি এমন এক ব্যাপার যা স্বামী-স্ত্রীর একান্ত ব্যক্তিগত জিনিস এবং এ ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই ভালো জানেন। আর এমনটি যদি প্রমাণিত হতোও তবু সেটিকে আমরা দোষনীয় কিছু মনে করি না বা এর দ্বারাই কেউ শিশুকামী প্রমাণ হয়ে যায় না। তবুও ইসলামবিরোধীদের লাগাতার অপপ্রচারের প্রেক্ষিতে আমরা আলোচ্য হাদিসগুলোর অর্থ ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করলাম।
উৎস ও টীকা :
[1] আল-মুসনাদুল মুসান্নাফুল মুয়াল্লাল (38/212-218)
[2] আল-মুসনাদুল জামে (19/788-792)
[3] আল-মুসনাদুল মুসান্নাফুল মুয়াল্লাল (38/212-218)
[4] আল-মুসনাদুল জামে (19/788-792)
[5] ইবনুল যাওযী, কাশফুল মুশকিল (3/494)
[6] ড. আহমদ মুখতার , মুজামূল লুগাতিল আরাবীয়াতিল মুয়াসিরাহ (1/727)
[7] সুনান আন-নাসাঈ (হা/3378), সহিহ আল-বুখারী (হা/5133),মুস্তাখরাজ আবি-আওয়ানাহ (হা/4266), আল-মুজামূল কাবির (23/21) , আল-মুজামূল আওসাত (7/94) & (2/301) ,হুজ্জাতুল ওইদা'আ (হা/506), সহিহ ইবন হিব্বান (হা/3454)
[8] ড.ফজলুর রহমান, আল-মুজামূল ওয়াফী (পৃ/465)
[9] সহিহ মুসলিম (হা/1422),আল-আহাদ ওয়াল মাছানী (হা/3028), সুনানুন নাসাঈ আলকুবরা (হা/5544),মুস্তাখরাজ আবি-আওয়ানাহ (হা/4271),শারহুস সুন্নাহ (9/35), সুনানুল বায়হাকী আল-কুবরা (10/371),আল-মুসনাদুল মুস্তাখরাজ আলা সহিহ মুসলিম (হা/3312), আন-নুফকাহ আলাল ইয়াল (2/755)
[10] ড.ফজলুর রহমান, আল-মুজামূল ওয়াফী(পৃ/536-537)
[11] মুসান্নাফ আব্দুর-রাজ্জাক (হা/11191),আল-মুজামূল কাবির (23/17),মা'রেফাতুস সাহাবাহা (6/3208)
[12] ড.ফজলুর রহমান, আল-মুজামূল ওয়াফী(পৃ/187)
[13] আল-লাহিম, মুক্বারানাতুল মারওইয়াত (1/391)
[14] আস-সাহারানফুরী, বাযলুল মাজহুদ ফি হিল্লে সুনানে আবি-দাউদ (8/47)
[15] ইবনুল-মালাক,শারহু মাসাবিহিস সুন্নাহ (3/560)
[16] আল-মুযহিরী,আল-মাফাতিহ ফি শারহিল মাসাবিহ (4/35)
[17] আল-ক্বারী,মিরকাতুল মাফাতিহ শারহু মিশকাতিল মাফাতিহ (5/2066)
[18] শারহুল মিশকাহ (আল-কাশিফ আন হাক্বাইক্বিস সুনান) - (7/2285)
[19] ইবনু রাসালান,শারহু সুনানে আবি-দাউদ (19/18)
[20] আল-আমিন,মুরশিদ যাওইল হাজা ওয়াল হাজাহ (11/425)
[21] মুহাম্মদ ফাওয়াদ আব্দুল-বাক্বীর টিকাবিশিষ্ট : সহিহ মুসলিম (2/1038)
[22] আল-বিরমাওই, আল-লামিউস সাবিহ (10/466)
[23] আল-আমিন আল-হারারী, আল-কাওকাবুও ওয়াহহাজ শারহু সহিহে মুসলিম আল-হাজ্জাজ (15/295)
[24] আল-আমিন,মুরশিদ যাওইল হাজা ওয়াল হাজাহ (11/425)
[25] ইবনু রাসালান, শারহু সুনানে আবি-দাউদ (9/431)
[26] ইবনু কাইয়িমিল যাওযিয়াহ, তাহযিবু সুনানে আবিদাউদ (1/447-448)
[27] দ্রষ্টব্য : আরবি ভাষায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে দু’টো পরস্পর সমার্থক শব্দ দুইটি ভিন্ন ভিন্ন আলাদা অর্থ বোঝানোর জন্য ব্যবহার হতে পারে, এবং সাধারণভাবে এ ব্যাপারটা البناء بِ ও الدخول ب এর জন্যও প্রযোজ্য, এরা যেভাবে একে অপরের সমার্থক হিসেবে ব্যবহৃত হয়, ঠিক একইভাবে ক্ষেত্রবিশেষে এরা অসমার্থক হিসেবেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে এই হাদিসের ক্ষেত্রে এমনটা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই সুযোগ নেই। কারণ এই হাদিসে البناء بِ ও الدخول ب একই অর্থ বোঝানোর উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়েছে, البناء بِ ও الدخول ب অংশ দু’টি সহ বর্ণিত রেওয়ায়েতগুলো হচ্ছে একটা সুনির্দিষ্ট হাদিসেরই একাধিক রকমের রূপ, যাদের ব্যাহ্যিক শব্দ ও বাক্যে হালকা পার্থক্য থাকলেও মূল অর্থে ও মর্মে কোনো পার্থক্য নেই।
[28] সহীহ বুখারী, হাদিস নং : ৫১৫৮