Pray for the world economy

একজন ইহুদি পণ্ডিতের সাথে কথোপকথন

   ফেসবুকে অনেক বিশ্বাস ও আদর্শের মানুষজনের সাথেই আমার কথা হয়। অবধারিতভাবেই উদ্দেশ্য থাকে তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেয়া। এদের মধ্যে ইহুদিদের সাথে আলোচনাগুলো আলাদাভাবে উল্লেখ করার মতো। কেননা, তাদের ধর্ম ইসলামের সাথে অত্যন্ত সাদৃশ্যপূর্ণ। সত্যের মুখোমুখি হলে অনেক সময়েই তাদের মধ্যে উপলব্ধির ছাপ স্পষ্ট হয়ে যায়। যদিও এই উপলদ্ধি সব সময়ে বিশ্বাসে অনূদিত হয় না। ইস্রায়েলী এক ইহুদির সাথে এমনই এক কথোপকথন এখানে উল্লেখ করছি। তিনি উচ্চতর ইহুদি র‍্যাবাইদের (Jewish rabbi) থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত একজন পণ্ডিত ইহুদি।

 

   আমি : আপনাদের তাওরাতে[1] একজন নবীর কথা বলা আছে, যিনি বনী ইস্রাইলীদের ভাইদের মধ্য থেকে আসবেন। এবং তিনি হবেন মুসা(আ.) এর মতো। তাঁর আনুগত্য না করলে আল্লাহ বনী ইস্রাইলীদের পাকড়াও করবেন। তিনি মুহাম্মাদ(ﷺ) ।

   ইহুদি পণ্ডিত : হ্যাঁ নিশ্চয়ই বলা আছে। তবে তিনি মুহাম্মাদ(ﷺ) নন। তিনি আমাদের ইহুদিদের মাসিহ। তাঁর আসার সময় এখনো হয়নি। তিনি ভবিষ্যতে আসবেন।[2]

   আমি : কিন্তু মাসিহ তো বনী ইস্রাঈল থেকে আসবার কথা, তাই না? এই নবী তো বনী ইস্রাঈলদের থেকে আসবেন না, বরং তাদের ভাইদের মধ্য থেকে আসবেন বলে আপনাদের তাওরাতে বলা আছে।

 

এখানে পাঠকদের সুবিধার্থে উল্লেখ করে দিচ্ছি যে ইহুদি [ও খ্রিষ্টান]দের তাওরাতে সেই বিশেষ নবীর ব্যাপারে কী বলা আছে।

 

আমি তাদের ভাইদের মধ্য থেকে তাদের জন্য তোমার [মুসা(.)] মতো একজন নবী দাঁড় করাব তার মুখ দিয়েই আমি আমার কথা বলব, আর আমি যা বলতে তাকে হুকুম দেব সে তা- তাদের বলবে সেই নবী আমার নাম করে যে কথা বলবে কেউ যদি আমার সেই কথা না শোনে, তবে আমি নিজেই সেই লোককে দায়ী করব[3]

 

ইহুদিদের পূর্বপুরুষ হচ্ছেন ইয়া’কুব(আ.) [যাঁর আরেক নাম ইস্রাঈল], যিনি ছিলেন নবী ইসহাক(আ.) এর সন্তান। ইয়া’কুব(আ.) এর বংশধর বলে ইহুদিদের বলা হয় ‘বনী ইস্রাঈল’। অপরদিকে নবী মুহাম্মাদ(ﷺ) এর পূর্বপুরুষ ছিলেন ইসমাঈল(আ.)। নবী মুহাম্মাদ(ﷺ) এর কুরাইশ বংশ ইসমাঈল(আ.) এর বংশ থেকে এসেছে। ইসমাঈল(আ.) ও ইসহাক(আ.) ছিলেন নবী ইব্রাহিম(আ.) এর ২ ছেলে। যেহেতু নবী মুহাম্মাদ(ﷺ) এর কুরাইশ বংশ ইসমাঈল(আ.) এর বংশ থেকে উদ্ভূত এবং ইহুদিরা ইসমাঈল(আ.) এর ভাই ইসহাক(আ.) এর বংশ থেকে উদ্ভূত, সুতরাং কুরাইশরা ইহুদিদের ভ্রার্তৃবংশ।

 

এ তো গেল সাধারণ হিসাবের কথা। এমনকি ইহুদিদের তাওরাতের একাধিক জায়গায় ইসমাঈল(আ.) এর বংশধরদের ইসহাক(আ.) এর বংশধরদের ভাই বলা হয়েছে। যেমন :

 

ইসমাঈল মোট একশো সাঁইত্রিশ বছর বেঁচে ছিলেন। তারপর তিনি ইন্তেকাল করে তাঁর পূর্বপুরুষদের কাছে চলে গেলেন। হবীলা থেকে শূর পর্যন্ত যে জায়গাটা ছিল তাঁর বংশের লোকেরা সেখানে বাস করত। জায়গাটা ছিল মিসরের কাছে, আশেরিয়া যাবার পথে। তাদের ভাই ইসহাকের বংশধরদের দেশের কাছে তারা বাস করত [4]

 

যা হোক, আমরা এবার মূল কথোপকথনে ফিরে যাই।

 

   ইহুদি পণ্ডিত : কিন্তু আমাদের হিব্রু ভাষায় "তোমাদের ভাই" বলতে বনী ইস্রাঈলকেই বোঝায়, এটা বনী ইসমাঈল [ইসমাঈল(আ.) এর বংশধর] হতে পারে না।

{যদিও তাদের কিতাব অন্য কথা বলছে!}

    আমি : কিন্তু আপনাদের তাওরাত প্রমাণ করে এই নবী কোনোমতেই বনী ইস্রাঈল থেকে আসতে পারেন না। তিনি অবশ্যই বনী ইস্রাঈলের বাইরে থেকে আসবেন।

   ইহুদি পণ্ডিত : কীভাবে?

   আমি : আপনাদের তাওরাতের দ্বিতীয় বিবরণ (Deuteronomy/Devarim) ৩৪ : ১০ এ বলা আছে, বনী ইস্রাঈলে মুসা(আ.) এর মতো আর কোনো নবী নেই।[5] কী, বলা আছে না?

 

দ্বিতীয় বিবরণ ১৮ : ১৮ এ সেই নবীর ২টা বৈশিষ্ট্য দেওয়া আছে : তিনি বনী ইস্রাঈলের ভাইদের মধ্য থেকে আসবেন এবং তিনি হবেন মুসা(আ.) এর মতো। আপনাদের তাওরাত অনুযায়ী মুসা(আ.) এর মতো কোনো নবী বনী ইস্রাঈলে আসবে না।

 

মুহাম্মাদ(ﷺ) এর বংশ বনী ইস্রাঈলের ভ্রার্তৃবংশ এবং তিনি মুসা(আ.) এর মতো। কাজেই এই নবী মুহাম্মাদ(ﷺ) ছাড়া আর কে? এ ছাড়া যিশাইয় (Isaiah/Yeshayahu) ৪২ : ১-১৭ তে[6] বলা হয়েছে এই নবী অইহুদিদের মধ্যে প্রচার করবেন, মূর্তিপূজকদের লজ্জিত করবেন, কেদারের [আরবিতে ‘কায়দার’, ইহুদিদের কিতাবমতে ইসমাঈল(আ.) এর মেঝো ছেলে] বাসভূমির (মক্কা) লোকেরা উচ্ছ্বসিত হবে, তিনি ধর্মীয় যুদ্ধ করবেন, তিনি বিনয়ী হবেন, পথেঘাটে কণ্ঠস্বর উচ্চ করবেন না। তিনি পূর্ববর্তী নবীর বেশ পরে আসবেন, সাগরের তীরের লোকেরা তাঁর আইনের অপক্ষায় থাকবে, তিনি তাঁর ভূমিতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে তারপর ক্ষান্ত হবেন। তিনি হবেন অইহুদিদের (gentiles) অথবা বহু জাতির প্রতি আলোস্বরূপ।

 

আপনাদের মাসিহ তো বনী ইস্রাইলী। কিন্তু এই নবীর তো বনী ইস্রাইলী হবার কোনো সম্ভাবনাই নেই।

এই নবী মুহাম্মাদ(ﷺ) ছাড়া আর কে?

 

কথোপকথনের এই পর্যায়ে একটু বিরতি নিয়ে পাঠকদের জন্য মুসা(আ.) এর সাথে মুহাম্মাদ(ﷺ) এর মিলগুলো উল্লেখ করছি, যেহেতু এখানে বার বার বলা হচ্ছে তাওরাতে যে নবীর ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে তিনি মুসা(আ.) এর মতো। মুসা(আ.) এর সাথে মুহাম্মাদ(ﷺ) এর অনেক মিল রয়েছে। বনী ইস্রাঈলী নবীদের মধ্যে মুসা(আ.) এর অনন্য গুণ হচ্ছে তিনি তাওরাতের আইন পেয়েছেন। এই গুণ বনী ইস্রাঈলের আর কারও নেই। ইউশা বিন নুন(আ.) তাওরাতের মতো কোনো আইনগ্রন্থ পেয়েছেন বলে ইহুদিদের কিতাবে উল্লেখ নেই, মাসিহ ঈসা(আ.) নতুন কোনো আইন নিয়ে আসেননি; বরং তিনি তাওরাতকে সমর্থন করেছেন বলে খ্রিষ্টানদের বাইবেলের নতুন নিয়মে (New Testament) উল্লেখ আছে।[7] মুহাম্মাদ(ﷺ) এর ওপর নাজিলকৃত কুরআনে তাওরাতের মতোই আইন-কানুন আছে। মুসা(আ.) এবং মুহাম্মাদ(ﷺ) উভয়ই সব শিষ্য নিয়ে হিজরত করতে বাধ্য হয়েছিলেন। মুসা(আ.) মিসর থেকে ফিলিস্তিনের দিকে এবং মুহাম্মাদ(ﷺ) মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেছিলেন। মুসা(আ.) এবং মুহাম্মাদ(ﷺ) উভয়কেই শেষ পর্যন্ত তাঁদের সম্প্রদায়ের সবাই নবী হিসাবে মেনে নেয় এবং তাঁরা নিজ নিজ সম্প্রদায়ের শাসক হন। উভয় নবীই আল্লাহর পথে যুদ্ধ করেছেন। বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী বনী ইস্রাঈলের নবীগণ একের পর এক আগমন করতেন, কিন্তু মুসা (আ.) ছিলেন ব্যতিক্রম। তাঁর আগমন হয় অনেক দেরি করে, পূর্ববর্তী নবী ইউসুফ (আ.) এর প্রায় ৪৩০ বছর পরে।[8]    মুহাম্মাদ(ﷺ) এর জন্ম হয় ঈসা(আ.) এর প্রায় ৫০০ বছর পরে ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে। অর্থাৎ উভয় নবীই পূর্বের নবীর একটা দীর্ঘ সময় পরে আগমন করেছেন। আরও অনেক মিল আছে। কুরআনে ১৩৬ বার মুসা(আ.) এর নাম এসেছে, মুহাম্মাদ(ﷺ)কে বার বার মুসা(আ.) এর কথা স্মরণ করানো হয়েছে। এমনকি আল কুরআনেও মুহাম্মাদ(ﷺ)কে মুসা(আ.) এর সাথে তুলনা দেওয়া হয়েছে।

 

انَّا أَرْسَلْنَا إِلَيْكُمْ رَسُولًا شَاهِدًا عَلَيْكُمْ كَمَا أَرْسَلْنَا إِلَىٰ فِرْعَوْنَ رَسُولًا ﴿١٥﴾

অর্থ : “নিশ্চয়ই আমি তোমাদের কাছে তোমাদের জন্য স্বাক্ষীস্বরূপ রাসুল পাঠিয়েছি, যেমনিভাবে ফিরআউনের কাছে রাসুল [মুসা(.)] পাঠিয়েছিলাম [9]

 

মুসা(আ.) এর সাথে অন্য কোনো নবীর এত মিল দেখানো সম্ভব নয়, যতটা না তাঁর সাথে মুহাম্মাদ(ﷺ) এর মিল আছে।

যিশাইয় (Isaiah/Yeshayahu) ৪২:১-১৭ এ বর্ণিত গুণাবলীগুলোও মুহাম্মাদ(ﷺ) এর মাঝে বিদ্যমান ছিল। তিনি ছিলেন বিনয়ের মূর্ত প্রতীক, [10] তিনি ছিলেন উত্তম চরিত্রে মূর্ত প্রতীক[11] এমনকি কখনো হাটেবাজারেও কণ্ঠস্বর উচ্চ করতেন না, [12] তিনি আবির্ভুত হয়েছিলেন মক্কায় যা আরব উপদ্বীপের একটি শহর, তিনি পূর্ববর্তী নবী ঈসা (আ.) এর একটা দীর্ঘ সময় পরে আগমন করেন।[13] সেখানকার আহলে কিতাবদের (ইহুদি ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়) অনেকেই তাঁর জন্য প্রতীক্ষারত ছিল।[14] তিনি আল্লাহর পথে যুদ্ধ করেছেন এবং তাঁর ভূমিতে আল্লাহর দ্বীন ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি ছিলেন সারা  পৃথিবীর জন্য প্রেরিত[15] এবং আল্লাহর আদেশক্রমে তিনি অন্ধকারে আচ্ছন্ন মানুষকে বের করে এনেছিলেন আলোর দিকে। [16]

 

যা হোক, শেষ পর্যন্ত ইহুদি পণ্ডিত যা বললেন :

 

   ইহুদি পণ্ডিত : আমাদের গুরুজনেরা কিতাব ঠিক এভাবে ব্যাখ্যা করে না। কাজেই আপনার ব্যাখ্যা আমি নেব না।

যদিও আপনার কথায় যুক্তি আছে...

 

পরবর্তী সময় ওই ইহুদি পণ্ডিত আমাকে আনফ্রেন্ড করে দেন।

 

সেই ইহুদির সাথে কথোপকথন এখানেই শেষ। তিনি শেষ পর্যন্ত সত্য গ্রহণ করেননি, তাদের কিতাবে উল্লেখিত মুসা(আ.) এর মতো সেই নবীর দ্বীন গ্রহণ করেননি। কিন্তু এ কথোপকথনে এ সত্য পরিষ্কার হয়েছে যে—বিকৃত হওয়া সত্ত্বেও এখনো তাদের ধর্মগ্রন্থে শেষ নবী মুহাম্মাদ(ﷺ) এর উল্লেখ আছে।

 

"আমি যাদের কিতাব দান করেছি, তারা তাকে চেনে, যেমন করে চেনে নিজেদের পুত্রদের। আর নিশ্চয়ই তাদের একটি সম্প্রদায় জেনেশুনে সত্যকে গোপন করে।" [17]

 

এবার একটা আগ্রহোদ্দীপক ব্যাপার উল্লেখ করব। পাঠক নিশ্চয়ই ইতিমধ্যেই 6 নং টীকায় উল্লেখিত যিশাইয় ৪২ : ১-১৭ দেখে ফেলেছেন। না দেখে থাকলে এখন দেখে নিন। এবার আমি সহীহ বুখারী থেকে ২টি হাদিস উল্লেখ করছি :

 

মুহাম্মাদ ইবন সিনান (র.)... আতা ইবন ইয়াসার(র.) সূত্রে বর্ণিত, আমি আব্দুল্লাহ ইবন আমর ইবন আস(রা.)কে বললাম, আপনি আমাদের কাছে তাওরাতে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ() এর গুণাবলি বর্ননা করুন।

তিনি বললেন, আচ্ছা। আল্লাহর কসম, কুরআনে বর্ণিত তাঁর কিছু গুণাবলি তাওরাতেও উল্লেখ করা হয়েছে : “হে নবী! আমি আপনাকে সাক্ষীরূপে, সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শনকারীরূপে প্রেরণ করেছি এবং উম্মীদের [ইহুদিরা অইহুদি জাতি (gentile) আরবদের উম্মী’ (অশিক্ষিত) বলে ডাকত] রক্ষক হিসাবেও। আপনি আমার বান্দা ও আমার রাসুল। আমি আপনার নাম মুতাওয়াক্কিল (আল্লাহর ওপর ভরসাকারী) রেখেছি। তিনি মন্দ স্বভাবের নন, কঠোর হৃদয়ের নন এবং বাজারে চিৎকারকারীও নন। তিনি অন্যায়কে অন্যায় দ্বারা প্রতিহত করেন না; বরং মাফ করে দেন, ক্ষমা করে দেন। মহান আল্লাহ তাআলা তাঁকে ততক্ষণ মৃত্যু দেবেন না, যতক্ষণ না তাঁর দ্বারা বিকৃত মিল্লাতকে ঠিক পথে আনেন অর্থাৎ যতক্ষণ না তারা (আরববাসীরা) লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ এর ঘোষণা দেবে। আর এ কালিমার মাধ্যমে অন্ধ-চক্ষু, বধির-কর্ণ ও আচ্ছাদিত হৃদয় খুলে যাবে।[18]

 

আব্দুল্লাহ(র.)… আমর ইবন আস (রা.) থেকে বর্ণিত যে, কুরআনের এ আয়াত, {إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ شَاهِدًا وَمُبَشِّرًا وَنَذِيرًا } “আমি তোমাকে পাঠিয়েছি সাক্ষীরূপে, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে” (সূরা ফাতহ ৪৮ :) তাওরাতে আল্লাহ এভাবে বলেছেন : “হে নবী আমি তোমাকে পাঠিয়েছি সাক্ষীরূপে, সুসংবাদবাদা ও উম্মী লোকদের মুক্তিদাতারূপে। তুমি আমার বান্দা ও রাসুল। আমি তোমার নাম নির্ভরকারী (মুতাওয়াক্কিল) রেখেছি, যে রূঢ় ও কঠোরচিত্ত নয়, বাজারে শোরগোলকারী নয় এবং মন্দ দ্বারা মন্দ প্রতিহতকারীও নয়; বরং তিনি ক্ষমা করবেন এবং উপেক্ষা করবেন। বক্র জাতিকে সোজা না করা পর্যন্ত আল্লাহ তাঁর জান কবয করবেন নাতা এভাবে যে, তারা বলবে, আল্লাহ ছাড়া ইলাহ নেই। ফলে খুলে যাবে অন্ধ চোখ, বধির কান এবং পর্দায় ঢাকা অন্তরসমূহ।[19]

 

ভালোভাবে লক্ষ করলে ওপরে উল্লেখিত সহীহ বুখারীর হাদিসদ্বয় এবং যিশাইয় ৪২ : ১-১৭ (ইংরেজি বাইবেলে Isaiah 42:1-17) এ উল্লেখিত তথ্যে মিল খুঁজে পাওয়া যাবে। হয়তো হুবহু মিল নয়—কিন্তু মূল বক্তব্য প্রায় এক। সন্দেহ নেই যে বুখারীর এই হাদিস ২টিতে সাহাবীদের যুগে ইহুদিদের Book of Isaiah (Yeshayahu) এর কথা বলা হয়েছে। বর্তমান যুগের Book of Isaiah এর সাথেও যার ব্যাপক মিল। ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের কিতাব যেভাবে বছর বছর পরিবর্তন ও ‘সম্পাদনা’র শিকার হয়, এরপরেও এ তথ্যগুলো থেকে যাওয়া বিশাল ব্যাপার। অন্ধকারের পর্দা দিয়ে কি আলোকে ঢেকে রাখা যায়?

 

সে সমস্ত লোক, যারা আনুগত্য অবলম্বন করে এ রাসুলের [মুহাম্মাদ()], যিনি উম্মী নবী, যাঁর সম্পর্কে তারা নিজেদের কাছে রক্ষিত তাওরাত ও ইঞ্জিলে লেখা দেখতে পায়, তিনি তাদের নির্দেশ দেন সৎ কর্মের, বারণ করেন অসৎ কর্ম থেকে; তাদের জন্য যাবতীয় পবিত্র বস্তু হালাল ঘোষণা করেন ও নিষিদ্ধ করেন হারাম বস্তুসমূহ এবং তাদের ওপর থেকে সে বোঝা নামিয়ে দেন এবং বন্দিত্ব অপসারণ করেন, যা তাদের ওপর বিদ্যমান ছিল। সুতরাং যেসব লোক তাঁর ওপর ঈমান এনেছে, তাঁর সাহচর্য অবলম্বন করেছে, তাঁকে সাহায্য করেছে এবং সে নূরের অনুসরণ করেছে যা তার সাথে অবতীর্ণ করা হয়েছে, শুধু তারাই নিজেদের উদ্দেশ্যে সফলতা অর্জন করতে পেরেছে।

বলে দাও, হে মানবমণ্ডলী, সমগ্র আসমান ও জমিনে যাঁর রাজত্ব, তোমাদের সবার প্রতি আমি সেই আল্লাহর রাসুলএকমাত্র তাঁকে ছাড়া আর কারও উপাসনা নয়। তিনি জীবন ও মৃত্যু দান করেন। সুতরাং তোমরা সবাই বিশ্বাস স্থাপন করো আল্লাহর ওপর এবং তাঁর প্রেরিত উম্মী নবীর [মুহাম্মাদ()] ওপর, যিনি বিশ্বাস রাখেন আল্লাহর এবং তাঁর সমস্ত কালামের ওপর। তাঁর অনুসরণ করো যাতে সরল পথপ্রাপ্ত হতে পারো [20]

 

" কিন্তু তাদের অধিকাংশই বিশ্বাস করে না। নিশ্চয়ই তোমার প্রভু প্রবল পরাক্রমশালী, পরম দয়ালু।

এই কুরআন তো বিশ্বজাহানের পালনকর্তার নিকট থেকে অবতীর্ণ। বিশ্বস্ত ফেরেশতা (জিব্রাইল) একে নিয়ে অবতরণ করেছে। তোমার [মুহাম্মাদ()] অন্তরে, যাতে তুমি সতর্ককারী হতে পারো, [অবতীর্ণ করা হয়েছে] সুস্পষ্ট আরবী ভাষায়।

নিশ্চয়ই এর উল্লেখ আছে পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে।

তাদের জন্যে এটা কি নিদর্শন নয় যে, বনী-ইসরাঈলের আলেমগণ এটা অবগত আছে?"[21]

 

 

তথ্যসূত্রঃ

[1]. তাওরাত(توراة‎) হচ্ছে নবী মুসা(আ.) এর নিকট আল্লাহর নাজিলকৃত কিতাব। সাধারণভাবে বাইবেলের ১ম ৫টি বইকে ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা মুসা(আ.) এর ‘তাওরাত’(Torah) বলে গণ্য করে। হিব্রু ভাষায় তাওরাত (תּוֹרָה) মানে ‘আইন’ বা ‘বিধান’। এই ৫টি বই Pentateuch নামেও পরিচিত। বাইবেলের পুরাতন নিয়ম (Old Testament) অংশটি ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের কমন ধর্মগ্রন্থ। ইহুদিরা একে Tanakh বলে। ঈসা(আ.) এর পূর্বে আগমনকারী বনী ইস্রাঈলের নবীদের নামে লেখা সমুদয় বিকৃত কিতাবগুলোর সংকলন হচ্ছে Tanakh / Old Testament। কখনো কখনো বৃহত্তর অর্থে সমগ্র Tanakh / Old Testament কেও ইহুদিরা ‘তাওরাত’ বলে অভিহিত করে।

বিস্তারিত জানতে দেখুন : “Judaism 101 Torah”; লিঙ্ক : http://www.jewfaq.org/torah.htm

[2].  এ ব্যাপারে ইহুদিদের মধ্যে সব থেকে প্রচলিত বিশ্বাস হচ্ছে এই নবী হচ্ছেন Joshua Son of Nun (ইউশা বিন নুন)। আবার অনেক ইহুদির মতে মুসা (আ.) এর পরে বনী ইস্রাঈলের যে কোন নবীই এর অন্তর্গত। তবে এই ইহুদি পণ্ডিত এখানে তাদের মাসিহ (Jewish Messiah) তথা মাসিহ দাজ্জালের কথা উল্লেখ করেছেন।

[3]বাইবেল, দ্বিতীয় বিবরণ [Deuteronomy (Christian Bible) / Devarim (Jewish Tanakh)] ১৮ : ১৮-১৯; কিতাবুল মোকাদ্দস অনুবাদ, বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি

[4]. বাইবেল, আদিপুস্তক (পয়দায়েশ/Genesis/Bereishit) ২৫ : ১৭-১৮; কিতাবুল মোকাদ্দস অনুবাদ, বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি। আরও দেখুন : আদিপুস্তক ১৬ : ১১-১২

[5]. “And there has not arisen a prophet since in Israel like Moses, whom the Lord knew face to face,” [Deuteronomy 34:10, RSV(Revised Standard Version) Bible]

The Sages note the Torah’s statement here that in Israel there will never be a Prophet like Moses implies that among the non-Jewish nations there could be such a prophet…

[Artscholl Chumash Commentary on Deuteronomy, p. 187]

[6]. মাবুদ বলছেন, “দেখ, আমার গোলাম, যাঁকে আমি সাহায্য করি; আমার বাছাই করা বান্দা [আরবিতে - মুস্তফা], যাঁর উপর আমি সন্তুষ্ট। আমি তাঁর উপরে আমার রূহ্‌ দেব [মুহাম্মাদ(ﷺ) এর কাছে রুহুল কুদস জিব্রাঈল(আ.) ওহী নিয়ে আসতেন] আর তিনি জাতিদের কাছে ন্যায়বিচার নিয়ে আসবেনতিনি চিৎকার করবেন না বা জোরে কথা বলবেন না; তিনি রাস্তায় রাস্তায় তাঁর গলার স্বর শোনাবেন না। তিনি থেঁৎলে যাওয়া নল ভাংবেন না আর মিটমিট করে জ্বলতে থাকা সল্‌তে নিভাবেন না। তিনি সততার সংগে ন্যায়বিচার করবেন। দুনিয়াতে ন্যায়বিচার স্থাপন না করা পর্যন্ত তিনি দুর্বল হবেন না বা ভেংগে পড়বেন না। দূরের লোকেরা তাঁর নির্দেশের অপেক্ষায় থাকবে।” মাবুদ আল্লাহ্‌ আসমান সৃষ্টি করে মেলে দিয়েছেন; তিনি দুনিয়া ও তাতে যা জন্মায় তা সব বিছিয়ে দিয়েছেন; তিনি সেখানকার লোকদের নিঃশ্বাস দেন আর যারা সেখানে চলাফেরা করে তাদের জীবন দেন। তিনি বলছেন, “আমি মাবুদ তোমাকে ন্যায়ভাবে ডেকেছি; আমি তোমার হাত ধরে রাখব। আমি তোমাকে রক্ষা করব [সুরা মায়িদাহর ৬৭নং আয়াতে আল্লাহ নবী মুহাম্মাদ(ﷺ)কে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন] এবং আমার বান্দাদের জন্য তোমাকে একটা ব্যবস্থার মত করব আর অন্যান্য জাতিদের জন্য করব আলোর মত। [“...I will keep you and will make you  to be a covenant for the people and a light for the Gentiles;” দেখুন Isaiah 42:6, ইংরেজি বাইবেল-NIV, KJV ASV ভার্সন] তুমি অন্ধদের চোখ খুলে দেবে, জেলখানা থেকে বন্দীদের মুক্ত করবে আর সেখানকার অন্ধকার গর্তে রাখা লোকদের বের করে আনবে। “আমি মাবুদ, এ-ই আমার নাম। আমি অন্যকে আমার গৌরব কিংবা মূর্তিকে আমার পাওনা প্রশংসা পেতে দেব নাদেখ, আগেকার ঘটনাগুলো ঘটে গেছে আর এখন আমি নতুন ঘটনার কথা ঘোষণা করব; সেগুলো ঘটবার আগেই তোমাদের কাছে তা জানাচ্ছি। হে সাগরে চলাচলকারীরা, সাগরের মধ্যেকার সব প্রাণী, হে দূরের দেশগুলো আর তার মধ্যেকার বাসিন্দারা,তোমরা সবাই মাবুদের উদ্দেশে একটা নতুন কাওয়ালী গাও, দুনিয়ার শেষ সীমা থেকে তাঁর প্রশংসার কাওয়ালী গাওমরুভূমি ও তার শহরগুলো জোরে জোরে প্রশংসা করুক; কায়দারীয়দের [ইসমাঈল(আ.) এর ছেলে কায়দারের বংশধর; দেখুন বাইবেল, আদিপুস্তক২৫:১৩] গ্রামগুলোও তা করুক, শেলার [মদীনার একটি পাহাড়] লোকেরা আনন্দে কাওয়ালী করুক,পাহাড়ের চূড়াগুলো থেকে আনন্দে চিৎকার করুক।তারা মাবুদের গৌরব করুক; দূরের দেশগুলোর মধ্যে তাঁর প্রশংসা ঘোষণা করুক। একজন শক্তিশালী লোকের মত করে মাবুদ বের হয়ে আসবেন; তিনি যোদ্ধার মত তাঁর আগ্রহকে উত্তেজিত করবেন; তিনি চিৎকার করে যুদ্ধের হাঁক দেবেন আর শত্রুদের উপর জয়ী হবেন। “আমি মাবুদ অনেক দিন চুপ করে ছিলাম [সুরা মায়িদাহর ১৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে যে, রাসুল আগমনের এক দীর্ঘ বিরতির পর মুহাম্মাদ(ﷺ) এর আগমন হয়েছে]; আমি শান্ত থেকে নিজেকে দমন করে রেখেছিলাম। কিন্তু এখন প্রসবকারিণী স্ত্রীলোকের মত আমি চিৎকার করছি, শ্বাস টানছি ও হাঁপাচ্ছি। আমি পাহাড়-পর্বতগুলো গাছপালাহীন করব আর সেখানকার সমস্ত গাছপালা শুকিয়ে ফেলব; আমি নদীগুলোকে দ্বীপ বানাব আর পুকুরগুলো শুকিয়ে ফেলব। আমি অন্ধদের তাদের অজানা রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাব, যে পথ তারা জানে না সেই পথে তাদের চালাব। [মুহাম্মাদ(ﷺ) এর পূর্বে আরব উপদ্বীপের মানুষেরা ছিল অন্ধের মতই; তারা জাহিলিয়াতের অন্ধকারে ডুবে ছিল। সেই উম্মী (নিরক্ষর/gentile) জাতির মানুষেরা পরবর্তীতে পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক অংশ জয় করে ও শাসন করে] তাদের আগে আগে আমি অন্ধকারকে আলো করব আর অসমান জায়গাকে সমান করে দেব। এ সবই আমি করব, নিশ্চয়ই করব। কিন্তু যারা খোদাই করা মূর্তির উপর ভরসা করে, যারা ছাঁচে ঢালা মূর্তিগুলোকে বলে, ‘তোমরা আমাদের দেবতা,’ আমি তাদের ভীষণ লজ্জায় ফেলে ফিরিয়ে দেব

[বাইবেল, যিশাইয়(Isaiah/Yeshayahu) ৪২ : ১-১৭; কিতাবুল মোকাদ্দস অনুবাদ, বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি। উপরে বাইবেলের পদগুলোতে ব্রাকেটে ব্যাখ্যামূলক কথাগুলো লেখকের যোগ করা।]

[7]. বাইবেল, মথি (Matthew) ৫ : ১৭-২০ দ্রষ্টব্য

[8]. বাইবেল, যাত্রাপুস্তক (Exodus) ১২ : ৪০-৪১ দ্রষ্টব্য

[9]. আল কুরআন, সুরা মুযযাম্মিল ৭৩:১৫

[10]. বিস্তারিত দেখুন, ‘শামাইলুন নাবিয়্যী (সা.)’ [শামায়েলে তিরমিযি] – ইমাম তিরমিযি (র.), পৃষ্ঠা ১৬৮-১৭৮ (বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার)

[11]. বিস্তারিত দেখুন, ‘শামাইলুন নাবিয়্যী (সা.)’ [শামায়েলে তিরমিযি] – ইমাম তিরমিযি (র.), পৃষ্ঠা ১৭৯-১৯০

[12]. বিস্তারিত দেখুন, ‘শামাইলুন নাবিয়্যী (সা.)’ [শামায়েলে তিরমিযি] – ইমাম তিরমিযি (র.), পৃষ্ঠা ১৮৩

[13].  “হে আহলে কিতাবগণ, রাসুলদের আগমন দীর্ঘকাল বন্ধ থাকার পর তোমাদের নিকট আমার রাসুল [মুহাম্মাদ()] এসে পৌঁছেছে, যে তোমাদেরকে স্পষ্টভাবে (আল্লাহর হুকুম) বলে দিচ্ছে, যেন তোমরা (কিয়ামাত দিনে) বলতে না পার যে, তোমাদের নিকট কোন সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী আগমন করেনি। (এখন তো) তোমাদের নিকট সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী এসে গেছে, আর আল্লাহ সকল বস্তুর উপর পূর্ণ ক্ষমতাবান।”  (আল কুরআন, সুরা মায়িদাহ ৫ : ১৯)

[14]. বিস্তারিত দেখুন, ‘সীরাতুননবী (সা.)’ – ইবন হিশাম, ১ম খণ্ড (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), পৃষ্ঠা ১৮৯-২০৪

[15]. আল কুরআন, আম্বিয়া ২১ : ১০৭ দ্রষ্টব্য

[16].  “আলিফ-লাম-রা; এই কিতাব, যা আমি তোমার প্রতি নাযিল করেছি, যাতে তুমি মানুষকে তাদের রবের অনুমতিক্রমে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করে আন, পরাক্রমশালী সর্বপ্রশংসিতের [আল্লাহ] পথের দিকে।” (আল কুরআন, ইব্রাহিম ১৪ : ১)

[17]. আল কুরআন, বাকারাহ ২ : ১৪৬

[18]. সহীহ বুখারী, হাদিস নং ২১২৫

[19]. সহীহ বুখারী, হাদিস নং ৪৮৩৮

[20]. আল কুরআন, আ’রাফ ৭ : ১৫৭-১৫৮

[21]. আল কুরআন, শুআরা ২৬ : ১৯০-১৯৭