Pray for the world economy

পেডোফিলিয়ার অভিযোগ বনাম সুস্থচিন্তার চর্চা

 

মুহাম্মাদ (ﷺ) সম্পর্কে পশ্চিমা মহলে নানাবিধ মিথ্যার ফুলঝুরির কথা সুস্থ ও সচেতন পাঠকের অজানা নয়। এনিয়ে নোবেলজয়ি সাহিত্যিক টমাস কার্লাইলের আক্ষেপের কথাও শুনেছেন কেউ কেউ। এমনই এক নব্য-অপপ্রচার হলো আয়েশা (রা) এর সাথে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর বিয়ে সংক্রান্ত বিতর্ক। কেন এটাকে নব্য-অপপ্রচার বলছি? কারন বিশ শতকের আগে এই নিয়ে কেউই অভিযোগ করেনি; উল্টো তাঁর প্রবল শত্রুরাও এই কাজকে সমর্থন করেছে! যেমন উনিশ শতকের এক খ্রিস্টান যাজকের কথাই বলা যায়। মুহাম্মাদ (ﷺ) কে প্রতারক সাব্যস্ত করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করতে গিয়ে তিনি শেক্সপিয়রীয় ইংরেজি ভাষায় থানইটের সমান একটা বই লিখে ফেললেন। এই বইতে তিনি লিখেছেন (1):

“[বিয়ের সময়] আবু-বকরের কন্যা আয়েশার… বয়স ছিলো মাত্র ছয় বছর। তাই সে-সময় আয়েশার সাথে তিনি (ﷺ) বাসর যাপন করেন নি। করেছেন আরো দুই বছর পরে (আসলে তিন বছর পরে, যাজক সাহেব গণনায় ভুল করেছেন) যখন আয়েশার বয়স পুরো আট বছর (আসলে নয় বছর)। সে সময় আরবদেশ, ইন্ডিয়া এসব উষ্ণমণ্ডলীয় এলাকায় মেয়েরা এমন বয়সেই বিয়ের উপযুক্ত হয়ে যেত। পরের বছরই তাদের কোলজুড়ে সন্তানের দেখা মিলত।”

 

সে-সময়ের হালত তো মহীয়সি নারী আয়েশা (রা) এর নিজের জবানেই জানা যায় (2):

 

কোনো বালিকা নয় বছরে পদার্পন করলে সে ইমরাআ’ (امْرَأَةٌ) অর্থাৎ মহিলা (স্ত্রী) বলে গণ্য হবে।

 

কলেজে উঠে বাংলা পাঠ্যপুস্তকে পড়েছি, “কন্যার বাপ সবুর করিতে পারিতেন, কিন্তু বরের বাপ সবুর করিতে চাহিলেন না। তিনি দেখিলেন, মেয়েটির বিবাহের বয়স পার হইয়া গেছে, কিন্তু আর কিছুদিন গেলে সেটাকে ভদ্র বা অভদ্র কোনো রকমে চাপা দিবার সময়টাও পার হইয়া যাইবে। মেয়ের বয়স অবৈধ রকমে বাড়িয়া গেছে বটে, কিন্তু পণের টাকার আপেক্ষিক গুরুত্ব এখনো তাহার চেয়ে কিঞ্চিৎ উপরে আছে, সেইজন্যই তাড়া।” এটা রবিঠাকুরের লেখা (১৯১৪ সালে প্রকাশিত) হৈমন্তী গল্পের অংশ। হৈমন্তীকে ডাকা হত আইবুড়ো বলে! তা মেয়ের বয়স কত হয়েছিলো যে “বিবাহের বয়স পার হইয়া” গেলো? মাত্র সতের!! অবাক হচ্ছেন নাকি? এই বয়সে এখন তো বিয়েই দেয়া যায় না। অথচ তখন সতের বছর হওয়া মানে বিয়ের বয়স শেষ! সে সময়ে ছয়/আট থেকে বারো বছরেই বিয়ে হয়ে যেত। পরে ভার্সিটি লেভেলে উঠে পড়লাম বঙ্গবন্ধুর “অসমাপ্ত আত্মজীবনী”। সাত নাম্বার পৃষ্ঠায় এসে চক্ষু চড়কগাছ টাইপের অনুভূতি নিয়ে দেখলাম লেখা আছে:

 

“একটা ঘটনা লেখা দরকার, নিশ্চয়ই অনেকে আশ্চর্য হবেন। আমার যখন বিবাহ হয় তখন আমার বয়স বার তের বছর হতে পারে। রেণুর বাবা মারা যাবার পরে ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন, “তোমার বড় ছেলের সাথে আমার এক নাতনীর বিবাহ দিতে হবে। কারণ, আমি সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুই বোনকে লিখে দিয়ে যাব।” রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা। মুরব্বির হুকুম মানার জন্যই রেপুর সাথে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হল। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না, রেণুর বয়স তখন বোধহয় তিন বছর হবে। রেণুর যখন পাচ বছর বয়স তখন তার মা মারা যান। একমাত্র রইল তার দাদা। দাদাও রেণুর সাত বছর বয়সে মারা ঘান। তারপর, সে আমার মা’র কাছে চলে আসে। আমার ভাইবোনদের সাথেই রেণু বড় হয়।”

 

এতক্ষণের আলোচনায় কি বুঝা গেলো? স্থান-কাল-সমাজ ভেবে আজকে যেটাকে আমাদের অল্পবয়স মনে হয়, এই বয়সে বিয়ে হওয়া মানব সমাজের একটি খুবই কমন প্র্যাকটিস। যে সাদা চামড়ার গোলামি করার নিমিত্তে ইসলামবিদ্বেষীরা আবোল-তাবোল, হরিবল বকে, সেই সাহেবদের কি দশা ছিলো? ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায় (3):

 

“In medieval and early modern European societies, the age of marriage remained low, with documented cases of brides as young as seven years, although marriages were typically not consummated until the girl reached puberty.”

 

অর্থাৎ মধ্যযুগ এমনকি আধুনিক যুগের শুরুতেও সাহেবদের দেশে খুবই কমন প্র্যাকটিস ছিল আজকের সংজ্ঞায় ‘শিশুদের বিয়ে’ করা। তখন বয়ঃসন্ধি প্রাপ্ত হওয়াই বাসর যাপনের উপযুক্ততার নির্দেশক ছিল। ইতিহাসের অধিকাংশ সময়ে জুড়েই তা ছিল। বয়োপ্রাপ্তি আর মানসিক পূর্ণতার মাঝে আপাত পার্থক্যের বিষয়টা তো খুব সাম্প্রতিক একটা বিষয় (4)। এই বয়স ইস্যুতে যারা অন্ধের মত আজকের সামাজিক প্রেক্ষাপট অতীতে চাপিয়ে দেয়, তারা খুব বাজে কুযুক্তি চর্চায় লিপ্ত হয়, যার নাম প্রেজেন্টিজম। এরা মূলত এনাক্রনিজমের দোষে প্রবলভাবে দুষ্ট!

 

এই তো ১৯৬৫ এর দিকেও আমেরিকার ডেলাওয়ার রাজ্যে ৫০ বছরের পুরুষ সর্বনিম্ন সাত বছরের মেয়ের সাথেও বাসর যাপন করতে পারতেন। তা সমাজগত ও আইনগতভাবেও পুরোপুরি সিদ্ধ ছিল। (5) এখনো পশ্চিমে ১৬ বছর হলেই বিয়ের অনুমতি মেলে। স্পেনে কিছুদিন আগেও তা ১৪ ছিল। এখনো অনেক জায়গায় ১৪ বছরই বহাল আছে। (6) তবে বিয়ে ছাড়া শারীরিক সম্পর্কের ব্যাপারে তাদের তেমন মাথা ব্যাথা নেই। বয়সও আমলে আসে না তখন। হালফিলের বাস্তবতা পর্যবেক্ষণ করে নামকরা ব্রিটিশ আইনজীবী বারব্রা হিউসান বলেছেন, বিয়ের অনুমতির বয়স ১৩ তে নামানো হোক। বিয়ের ছাড়াই তারা এইসব মাঠেঘাটে করে বেড়াচ্ছে, বিয়ে করে অধিকারটা তো পাক। পাশাপাশি অপরাধীদের শাস্তি জোরদার হোক। এদিকে ব্রিটেনের ফ্যাকাল্টি অফ পাবলিক হেলথের প্রেসিডেন্ট প্রফেসর জন অ্যাশটনও বলছেন বিয়ের অনুমতির বয়স কমানো দরকার। উনি ১৫ বছরে আনার পক্ষপাতি। কারণ ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী (আজকের সংজ্ঞায়) শিশুদের ৩৩%-ই ১৬ বছরের আগে শারীরিক সম্পর্কে জড়াতে থাকে। তাই বয়স কমিয়ে আনলে তাদের যৌনজীবন সংক্রান্ত স্বাস্থ্য পরামর্শ দেয়া যাবে। বলাই বাহুল্য, এদের দুজনেই প্রবল গঞ্জনার সম্মুখীন হয়েছেন। এদের কেউই ধার্মিক নন, তারপরও তাদের এক প্রকার ধুয়ে ফেলা হয়েছে।

 

আমাদের বুঝতে হবে, বয়ঃসন্ধি ব্যতীত কাউকে শিশু গণ্য করার কোনো সার্বজনীন ক্রাইটেরিয়া এখনো নেই; একেক দেশে একেক রকম। আমার নিজের দাদির বিয়ে হয়েছিল ছয় বছর বয়সে, আর নানীর বিয়ে হয়েছিল বার বছর বয়সে। সে তো গেল তখনকার কথা। এখনকার যামানাতেও এমন ঘটনা আমি নিজেই দেখেছি। মেডিকেলে পড়ার সময় এক বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজে দলবেঁধে কেরানীগঞ্জ গিয়েছিলাম, তথ্য সংগ্রহ করতে। সেখানে পাকা দেয়াল-টিনের চালের বস্তিতে বসবাসরত এমন মেয়ের সাক্ষাতকারও নিয়েছি যার বিয়ে হয়েছে পাঁচ বছর বয়সে। এর কারণটা ধর্মীয় না, অর্থনৈতিক। তো যে-সব মস্তিষ্ক বিকৃত না-মানুষ প্রিয় নবী (ﷺ)কে পেডোফিল বলে নিজেরা হারাম জীবনে ডুবে থাকে, এইসব পার্ভার্টের দাবি সিরিয়াসলি নিলে পুরো মানবসভ্যতাকেই এক অর্থে পেডোফিল বলা হয়!! আমি বুঝি না, গরুর গোবরটা এদের মাথায় ঢুকলো কীভাবে? এ কেমন বিবর্তন? সেক্যুলার ঐতিহাসিক ক্যারেন আর্মস্ট্রং-এর বিশ্লেষণ জানায় (7):

 

“মুহম্মদের (ﷺ) অন্দরমহল সম্পর্কে পশ্চিমা সমাজে আবেগতাড়িত ও অসুস্থ ধারণার ছড়াছড়ি লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু আরবে, যেখানে একবিবাহের তুলনায় বহুবিবাহের চল বেশি, সেখানের কথা আলাদা। খাদিজার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মুহম্মদও তো একপত্নীকই ছিলেন। তাছাড়া মুহম্মদের (পরবর্তী) বিবাহগুলো রোমান্স কিংবা যৌন-তাড়নার ফলশ্রুতি ছিলো না, বরং এর পিছে বাস্তবিক কারণ ছিলো। যেমন – সাওদাহ্ ছিলেন যৌবনের প্রথমভাগ অতিক্রান্ত একজন সংসারী নারী; কিন্তু মুহম্মদের গৃহস্থালী দায়দায়িত্ব সামাল দিতে পারবেন তিনি। তাছাড়া সাওদাকে বিবাহ করার মাধ্যমে তাঁর জ্ঞাতিভাই সুহায়েলের সাথেও সম্পর্কোন্নয়নের সম্ভাবনা ছিলো, যে তখনও ওহির ব্যাপারে দোদুল্যমান ছিল। আয়েশার সাথে বাগদানেও মুহম্মদের কোনও ভুল ছিলো না। সে সময় মৈত্রীর স্বার্থে অপরিণতবয়েসী পাত্রীর অনুপস্থিতিতে এমন বিবাহ অতিসাধারণ ব্যাপার ছিলো। এমনকি কোনও কোনও ক্ষেত্রে পাত্রীর বয়স আয়েশার চেয়েও কম হতো৷ ইউরোপে আধুনিক যুগের প্রথমভাগ পর্যন্ত এই রীতি ভালোমতই অনুসৃত হয়েছেI বয়ঃসন্ধি উত্তীর্ণ হবার আগপর্যন্ত এই ক্ষেত্রে বাসরযাপনের কোনো প্রশ্ন আসতো না। বয়:প্রাপ্ত হওয়ার পর আর দশটা সাধারণ মেয়ের মতো আয়েশাকেও বিয়ের পিড়িতে চড়তে হতো। ”

 

ইসলাম যেহেতু একটি বিশ্বজনীন জীবনব্যবস্থা, তাই এর মূলনীতিগুলো এমনভাবে দেয়া হয়েছে যাতে যুগের চাহিদা অনুযায়ী সঠিক পথ বেছে নেয়া যায়। বালেগ হওয়ার অর্থও সেভাবে সমন্বয় করা হয়। ঐতিহাসিকভাবে তাই হয়ে এসেছে। (8) আলোচনা শেষ করবো একজন দাঈ-এর জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে। ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ে উনি ইসলামের উপর বক্তব্য রাখতে গিয়েছিলেন। লেকচারের পরে একজন অমুসলিম বোন তার সাথে কথা বলতে আসে। বোন বলেন, ইসলামের ধর্মতত্ত্ব আমি বুঝেছি। এটা বেশ সহজ, এবং সঠিকও লেগেছে আমার কাছে। তবে আয়েশার সাথে আপনাদের নবীর বিয়ের ব্যাপারটা আমার পক্ষে মানা সম্ভব হচ্ছে না।

 

দাঈ জিজ্ঞেস করলেন, বোন আপনি কি আয়েশা (রা) এর কোনো জীবনী পড়েছেন? আপনি কি জানেন উনি কেমন মহীয়সী ছিলেন? উনি কত বড় একজন হাদিস বিশারদ আর আইনজ্ঞ ছিলেন? উনি কতটা সম্মানের আসনে ছিলেন? সারা জীবন উনি নবী (ﷺ)কে কেমন অন্তর দিয়ে ভালোবেসে ভূয়সী প্রশংসা করে গেছেন? বোন জবাবে বললেন, না।

দাঈ অনুরোধ করলেন, আমি আপনাকে উনার জীবনী দিব। ইসলামবিদ্বেষীরা আপনার মাথায় যা ঢুকিয়েছে সবকিছু বের করে দিয়ে জীবনীটা মন দিয়ে পড়বেন। তারপর আমার সাথে যোগাযোগ করবেন বোন।

সেই অমুসলিম বোন বেশকিছু দিন পর দাঈ-এর সাথে যোগাযোগ করেন। অবাক করার মত ব্যাপার হলো, সেই বোন মুসলমান হয়ে যান। তার একটা মেয়েও হয় পরে। উনি সেই মেয়ের নাম কি রেখেছিলেন জানেন?

আয়েশা !!

 


বক্ষ্যমাণ লেখাটি লেখকের ই-বুক 'ভাবনার মোহনায়'থেকে ঈষৎ পরিবর্তন সহকারে গৃহীত

লেখকের মূল ওয়েবসাইট থেকে লেখাটির লিঙ্কঃ https://rafanofficial.wordpress.com/2020/10/01/the-wrong-accusation-of-pedophilia/


রেফারেন্স:

  1. Humphrey Prideaux (1698), The true nature of imposture, p. 53-54 [বন্ধনীর ভেতরের লেখাগুলো আমার যোগ করা]
  2. জামে তিরমিযি, হাদিস ১১০৯, হাসান হাদিস
  3. Richard Wortley & Stephen Smallbone (2012), Internet Child Pornography: Causes, Investigation, and Prevention, (ABC-CLIO) p. 10
  4. Peter Gluckman and Mark Hanson, “Evolution, Development and Timing of Puberty,” Trends in Endocrinology and Metabolism, 17:1 (2006), p. 10
  5. Professor AJP Cortese (2006), Opposing Hate Speech (Praeger Publishers) p. 85
  6. https://www.independent.co.uk/news-19/the-lowest-age-you-can-legally-get-married-around-the-world-10415517.html
  7. ক্যারেন আর্মস্ট্রং, মুহম্মদ : দ্য প্রফেট ফর আওয়ার টাইম; পৃ. ৯২-৯৩ (টুকরো ভাষান্তর: রাফান আহমেদ; হারপার কলিন্স, ২০০৭)
  8. Asadullah Ali & Jonathan Brown (2018), Understanding Aisha’s Age: An Interdisciplinary Approach

 

আরো পড়তে চাইলে:

১। আয়েশা (রা) এর জীবনী জানার জন্য ভালো রিসোর্স: সাইয়্যেদ সুলায়মান নদভী (২০১৭), সীরাতে আয়েশা (বঙ্গানুবাদ, ঢাকা: রাহনুমা প্রকাশনী, চতুর্থ সংস্করণ)

২। বয়স ও বিয়ে সংক্রান্ত অসাধারণ ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের জন্য দেখা যেতে পারে: Adnan Rashid (2019), Age of Aishah: Historical Analysis. Youtube