Pray for the world economy

ফেরেশতারা কি পৃথিবীতে বিচরণ করেন?

স্ববিরোধিতার অভিযোগঃ ফেরেশতারা কি পৃথিবীতে বিচরণ করে বেড়ায় ? – না (Quran 17:95) এবং হ্যাঁ (Quran 2:102) !

 

জবাবঃ সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলো নিচে উল্লেখ করা হল।

 

قُل لَّوْ كَانَ فِي الْأَرْضِ مَلَائِكَةٌ يَمْشُونَ مُطْمَئِنِّينَ لَنَزَّلْنَا عَلَيْهِم مِّنَ السَّمَاءِ مَلَكًا رَّسُولًا

অর্থঃ “বলঃ  যদি পৃথিবীতে ফেরেশতারা স্বচ্ছন্দে বিচরণ করত, তবে আমি আকাশ থেকে কোন ফেরেশতাকেই তাদের নিকট রাসুল করে প্রেরণ করতাম।” [1]

 

وَاتَّبَعُوا مَا تَتْلُو الشَّيَاطِينُ عَلَىٰ مُلْكِ سُلَيْمَانَ ۖ وَمَا كَفَرَ سُلَيْمَانُ وَلَٰكِنَّ الشَّيَاطِينَ كَفَرُوا يُعَلِّمُونَ النَّاسَ السِّحْرَ وَمَا أُنزِلَ عَلَى الْمَلَكَيْنِ بِبَابِلَ هَارُوتَ وَمَارُوتَ ۚ وَمَا يُعَلِّمَانِ مِنْ أَحَدٍ حَتَّىٰ يَقُولَا إِنَّمَا نَحْنُ فِتْنَةٌ فَلَا تَكْفُرْ ۖ فَيَتَعَلَّمُونَ مِنْهُمَا مَا يُفَرِّقُونَ بِهِ بَيْنَ الْمَرْءِ وَزَوْجِهِ ۚ وَمَا هُم بِضَارِّينَ بِهِ مِنْ أَحَدٍ إِلَّا بِإِذْنِ اللَّهِ ۚ وَيَتَعَلَّمُونَ مَا يَضُرُّهُمْ وَلَا يَنفَعُهُمْ ۚ وَلَقَدْ عَلِمُوا لَمَنِ اشْتَرَاهُ مَا لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِنْ خَلَاقٍ ۚ وَلَبِئْسَ مَا شَرَوْا بِهِ أَنفُسَهُمْ ۚ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ

অর্থঃ “তারা ঐ শাস্ত্রের অনুসরণ করেছে, যা সুলাইমানের রাজত্ব কালে শয়তানরা আবৃত্তি করত। সুলাইমান কুফরী করেনি; শয়তানরাই কুফরী করেছিল।

 তারা মানুষকে শিক্ষা দিত জাদুবিদ্যা এবং বাবেল শহরে দুই ফেরেশতার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছিল; হারুত ও মারুত— তারা উভয়ই এই কথা না বলে কাউকে শিক্ষা দিত না যে, “আমরা নিছক একটি পরীক্ষা; কাজেই তুমি কুফরী করো না”।

 তা সত্ত্বেও তারা তাদের কাছ থেকে এমন জাদু শিখত, যার দ্বারা স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে। তারা আল্লাহর অনুমতি ছাড়া তা দ্বারা কারো অনিষ্ট করতে পারত না। তারা তাই শিখত যা তাদের ক্ষতি করত এবং কোন উপকারে আসত না। তারা ভালো করে জানে যে, যে কেউ তা খরিদ করে(অর্থাৎ জাদুর আশ্রয় নেয়), তার জন্য পরকালে কোন অংশ নেই।

যার বিনিময়ে তারা নিজেদের বিকিয়ে দিচ্ছে, তা খুবই মন্দ— যদি তারা জানত![2]

 

ফেরেশতারা আদৌ পৃথিবীতে আসেন না—এমন কথা কুরআন বলেনি। অভিযোগকারী নাস্তিক মুক্তমনাদের দাবি--সুরা বানী ইস্রাঈলের ৯৫ নাম্বার আয়াতটিতে বলা হচ্ছে ফেরেশতারা পৃথিবীতে বিচরণ করেন না যা কুরআনের অন্যান্য আয়াতের সাথে সাংঘর্ষিক। কিন্তু এটি অত্যন্ত ভুল এবং হাস্যকর বুঝ। তারা আদৌ এ আয়াতটি বোঝেননি (বা বোঝার চেষ্টা করেননি)।

কেননা সুরা বানী ইস্রাঈলের ৯৫ নাম্বার আয়াতটি নিয়েও অবতরণ করেছিলেন একজন ফেরেশতা {জিব্রাঈল(আ)}। এটা কী করে সম্ভব হতে পারে যে একজন ফেরেশতা অবতরণ করে এসে আয়াত আবৃত্তি করছেন—“পৃথিবীতে কখনো ফেরেশতারা আসেন না” ?!

আমরা যদি আলোচ্য আয়াতের সরল অনুবাদটি ভালো করে লক্ষ্য করি, তাহলে দেখব যে আয়াতে এটা বলা হচ্ছে--  পৃথিবীতে ফেরেশতারা স্বাচ্ছন্দে বিচরণ করেন না এবং আল্লাহ ফেরেশতাদের রাসুল করে প্রেরণ করেন না। আয়াতের মূল বিষয় হচ্ছেঃ আল্লাহ ফেরেশতাদের রাসুল হিসাবে, রাসুলের দায়িত্ব দিয়ে{কিতাব-শরিয়ত বহন করা, দ্বীনের দাওয়াত দেওয়া} সাধারণ মানুষের নিকট পাঠান না। পৃথিবীতে আদৌ ফেরেশতারা বিচরণ করেন না বা আসেন না—এই কথা আলোচ্য আয়াতে বলা হয়নি।

ধরা যাক বলা হল,  “তিনি যদি গ্রামে স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করতে পারতেন, তাহলে আমি তাকে ঐ গ্রামে কোম্পানীর প্রতিনিধি নিযুক্ত করতাম।”

এ দ্বারা কি বোঝায় যে ঐ ব্যক্তি কোনদিনই গ্রামে যাননি বা যেতে পারেন না? মোটেও না। বরং এ দ্বারা বোঝাচ্ছে যে তিনি সচরাচর গ্রামে যান না, বা গ্রামে তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। এবং এই বাক্যের মূল বক্তব্য হচ্ছেঃ ঐ ব্যক্তিকে প্রতিনিধি নিযুক্ত করা হবে না।

 

প্রসঙ্গসহ যদি আমরা আয়াতটি পড়ি, তাহলে আমরা দেখব যে, আরবের মুশরিকরা কেন একজন মানুষকে রাসুল করে পাঠানো হল—এহেন উদ্ভট অভিযোগ তুলে যাচ্ছিল।তাদের এহেন অভিযোগের জবাবে আল্লাহ এ আয়াত নাজিল করেন। মানুষের নিকট রাসুলের দায়িত্ব পালনের জন্য তাদের স্বজাতি অর্থাৎ মানুষই এ জন্য সব থেকে উপযোগী, ফেরেশতারা নয়—এ কথাই ধারাবাহিকভাবে বলা হয়েছে। [3]  

 

এখানে প্রাসঙ্গিক আরো কিছু আয়াতের কথা আসতে পারে। কুরআনের কিছু আয়াতে ফেরেশতাদের ক্ষেত্রেও ‘রাসুল’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। যেমনঃ

 

“  আল্লাহ ফেরেশতা ও মানুষের মধ্য থেকে বাণীবাহক(রাসুল) মনোনীত করেন। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।[4]

আরো দেখা যেতে পারেঃ সুরা মারইয়াম ১৯:১৯, সুরা ফাতির ৩৫:১

 

আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসির মাজহারীতে বলা হয়েছেঃ “আল্লাহ ফেরেশতা ও মানুষের মধ্য থেকে বাণীবাহক(রাসুল) মনোনীত করেন” এ কথার অর্থ---আল্লাহ তাঁর বাণীবাহক মনোনিত করেন ফেরেশতা, মানুষ উভয় শ্রেণী থেকে। ফেরেশতা বার্তাবাহকেরা আল্লাহর বার্তা পৌঁছে দেন নবীগণের কাছে, কেউ আবার কবজ করেন প্রাণীকূলের রূহ, আবার কেউ পালন করেন সৃষ্টিকূলের রিজিক বণ্টনের দায়িত্ব।

বাগাবী(র) লিখেছেন,  বাণীবাহক ফেরেশতাবৃন্দ হচ্ছেন জিব্রাঈল(আ), মিকাইল(আ), ইস্রাফিল(আ) ও আজরাঈল(আ)। আর বার্তাবাহক মানুষ হচ্ছেন পৃথিবীতে প্রেরিত নবী-রাসুলগণ। তাঁরা আল্লাহ কর্তৃক প্রত্যাদেশিত বিধানবলী প্রচার করতেন মানুষের মধ্যে। [5]   

 

কুরআন-সুন্নাহ থেকে এটি প্রতিষ্ঠিত যে, মানুষ নবীগণ ফেরেশতাদের চেয়ে উচ্চতর মর্যাদার অধিকারী। [6]  ‘রাসুল’ হচ্ছে নবীগণের একটি প্রকার। শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া(র) এর মতে, “যাঁদেরকে অবিশ্বাসী(কাফির) জাতির নিকট প্রেরণ করা হত, তাঁদেরকে রাসুল বলা হয়। আর নবীগণকে পূর্ববর্তী রাসুলের শরিয়ত সহকারে বিশ্বাসী(মু’মিন) জণগনের নিকট পাঠানো হয়।”

সকল রাসুলই নবী। সকল নবী রাসুল নন। [7]

মানব রাসুল ও ফেরেশতাদের দায়িত্ব ভিন্ন। ফেরেশতাগণকে কখনো কিতাব ও শরিয়ত সহকারে মানুষের নিকট প্রচার করার জন্য প্রেরণ করা হয় না। যেই দায়িত্ব মানব রাসুলেরা পালন করতেন।

 

ফেরেশতারা অবশ্যই পৃথিবীতে আসেন। তাঁরা আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশেষ দায়িত্ব নিয়ে আসেন। যেমনঃ মুহাম্মাদ(ﷺ) এর নিকট ওহী নিয়ে আসতেন জিব্রাঈল(আ) [সুরা শু’আরা ২৬:১৯৩], বৃষ্টি বর্ষণের কাজে নিযুক্ত ফেরেশতা আছেন যাঁর নাম রা’দ [তিরমিযী ৩১১৭ দ্রষ্টব্য], নবীদের নিকট সুসংবাদ ও পাপী সম্প্রদায়ের প্রতি আল্লাহর শাস্তি নিয়ে আসতেন [সুরা হুদ ১১:৬৯-৭৪], মানুষের প্রাণ হরণ করেন [সুরা সাজদাহ ৩২:১১]সুরা বাকারাহ ২:১০২ নং আয়াতেও হারুত ও মারুত নামক ২ জন ফেরেশতার কথা আছে। তবে এদের কাউকে আল্লাহ মানুষের নিকট প্রচারকারী রাসুল হিসাবে নিযুক্ত করেননি বরং এরা বিশেষ কিছু কাজ সম্পন্ন করবার জন্য পৃথিবীতে এসেছেন।

 

কাজেই আমরা দেখতে পাচ্ছি যে সুরা বানী ইস্রাঈলের ৯৫নং আয়াত সুরা বাকারাহ এর ১০২নং আয়াতের সাথে মোটেও সাংঘর্ষিক নয়।

 

 

তথ্যসূত্রঃ

[1]  আল কুরআন, বানী ইস্রাঈল(ইসরা) ১৭:৯৫

[2]  আল কুরআন, বাকারাহ ২:১০২

[3]  বিস্তারিত দেখুনঃ তাফসির ইবন কাসির, ৪র্থ খণ্ড(হুসাইন আল মাদানী প্রকাশনী), সুরা বানী ইস্রাঈলের ৯৪-৯৫নং আয়াতের তাফসির, পৃষ্ঠা ৬৯৬-৬৯৮

[4]  আল কুরআন, হাজ্জ ২২:৭৫

[5]  তাফসির মাজহারী, ৮ম খণ্ড, সানাউল্লাহ পানিপথী(র), সুরা হাজ্জ এর ৭৫নং আয়াতের তাফসির, পৃষ্ঠা ১৮৩

[6]  Are Angels Superior or the Prophets and the Righteous? - islamqa.info [Shaykh Salih Al Munajjid]

https://islamqa.info/en/177709

[7]  “The difference between a Messenger and a Prophet - islamqa.info” [Shaykh Salih Al Munajjid]

https://islamqa.info/en/11725