Pray for the world economy

বদরের যুদ্ধে কতজন ফেরেশতা নবী মুহাম্মাদ(ﷺ) কে সাহায্য করেছিলেন ?

স্ববিরোধিতার অভিযোগঃ বদরের যুদ্ধে কতজন ফেরেশতা মুহাম্মাদ(ﷺ) কে সাহায্য করেছিল ? – ৩০০০ (Quran 3:124), ১০০০ (Quran 8:9), নাকি একজনও নয় (Quran 15:8) !

 

জবাবঃ সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলো নিচে উল্লেখ করা হল।

 

 ( 124 )   إِذْ تَقُولُ لِلْمُؤْمِنِينَ أَلَن يَكْفِيَكُمْ أَن يُمِدَّكُمْ رَبُّكُم بِثَلَاثَةِ آلَافٍ مِّنَ الْمَلَائِكَةِ مُنزَلِينَ

( 125 )   بَلَىٰ ۚ إِن تَصْبِرُوا وَتَتَّقُوا وَيَأْتُوكُم مِّن فَوْرِهِمْ هَٰذَا يُمْدِدْكُمْ رَبُّكُم بِخَمْسَةِ آلَافٍ مِّنَ الْمَلَائِكَةِ مُسَوِّمِينَ

অর্থঃ “ তুমি [মুহাম্মাদ(ﷺ)] যখন বলতে লাগলে মু’মিনদেরকে-তোমাদের জন্য কি এটা যথেষ্ট নয় যে, তোমাদের সাহায্যার্থে তোমাদের প্রভু আসমান থেকে অবতীর্ণ ৩০০০ ফেরেশতা পাঠাবেন?

অবশ্য তোমরা যদি ধৈর্য ধর এবং তাকওয়া অবলম্বন কর আর তারা যদি তারা দ্রুত গতিতে তোমাদের উপর আক্রমণ করে, তাহলে তোমাদের প্রভু ৫০০০ চিহ্নিত ফেরেশতা দিয়ে তোমাদের সাহায্য করবেন।” [1]

 

إِذْ تَسْتَغِيثُونَ رَبَّكُمْ فَاسْتَجَابَ لَكُمْ أَنِّي مُمِدُّكُم بِأَلْفٍ مِّنَ الْمَلَائِكَةِ مُرْدِفِينَ

অর্থঃ “  তোমরা যখন ফরিয়াদ করতে আরম্ভ করেছিলে তোমাদের প্রভুর [আল্লাহ] নিকট, তখন তিনি তোমাদের ফরিয়াদের মঞ্জুরী দান করলেন যে, আমি তোমাদিগকে সাহায্য করব ধারাবহিকভাবে আগত হাজার ফেরেশতার মাধ্যমে।” [2]

 

( 6 )   وَقَالُوا يَا أَيُّهَا الَّذِي نُزِّلَ عَلَيْهِ الذِّكْرُ إِنَّكَ لَمَجْنُونٌ

( 7 )   لَّوْ مَا تَأْتِينَا بِالْمَلَائِكَةِ إِن كُنتَ مِنَ الصَّادِقِينَ

( 8 )   مَا نُنَزِّلُ الْمَلَائِكَةَ إِلَّا بِالْحَقِّ وَمَا كَانُوا إِذًا مُّنظَرِينَ

 

অর্থঃ “তারা বললঃ হে ঐ ব্যক্তি, যার প্রতি কুরআন নাযিল হয়েছে— তুমি তো একজন উম্মাদ! যদি তুমি সত্যবাদী হও, তবে আমাদের কাছে ফেরেশতাদেরকে আনো না কেন?

আমি ফেরেশতাদেরকে একমাত্র ফায়সালার জন্যেই নাযিল করি। [ফেরেশতাদের পাঠানো হলে] তখন তাদেরকে আর অবকাশ দেয়া হবে না।“ [3]

 

সুরা হিজরের আলোচ্য আয়াতটি (আয়াত ১৫:৮) প্রসঙ্গসহ পড়লেই দেখা যাচ্ছে যে এখানে মোটেও বদরের যুদ্ধের কথা বলা হচ্ছে না। সুরা হিজর একটি মাক্কী সুরা, এটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়। আর বদরের যুদ্ধ হয় তার অনেক পরে, রাসুল(ﷺ) মদীনায় হিজরত করার পর। [4] 

আলোচ্য আয়াতের প্রেক্ষাপট হচ্ছে, মক্কার অবিশ্বাসীরা রাসুলুল্লাহ(ﷺ)কে বলেছিল, “হে ঐ ব্যক্তি, যার প্রতি কুরআন নাযিল হয়েছে— তুমি তো একজন উম্মাদ!” তারা আরো দাবি করে যে তিনি যদি সত্যবাদী হন, তাহলে তাদের কাছে ফেরেশতা নিয়ে আসেন না কেন? এর জবাবে আল্লাহ নাজিল করেন, “আমি ফেরেশতাদেরকে একমাত্র ফায়সালার জন্যেই নাযিল করি। তখন তাদেরকে আর অবকাশ দেয়া হবে না।“  যখন ফেরেশতাদের আগমনের পরেও বিশ্বাস স্থাপন করত না, যা তাদের অবস্থাদৃষ্টে নিশ্চিত, তখন তাৎক্ষণিকভাবে তাদেরকে ধ্বংস করে দেওয়া হত। যেমন সুরা আন’আমের ১ম শেষ আয়াতগুলোতে এর কারণ বর্ণিত হয়েছে। [5]  

কুরআনেই এর বাস্তব উদাহরণ পাওয়া যায়। নবী লুত(আ) এর জাতির সীমালঙ্ঘণের কারণে তাদের জন্য ফেরেশতা প্রেরণ করা হয় এবং তাদেরকে একেবারে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। [6] এ ছাড়া বদর যুদ্ধেও মক্কার অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে ফয়সালামূলক যুদ্ধে মুসলিমদের সাহায্য করার জন্য ফেরেশতা অবতীর্ণ করা হয়।

অর্থাৎ এখানে অভিযোগকারীরা সম্পূর্ণ ভিন্ন ঘটনার উপর ও ভিন্ন প্রসঙ্গে নাজিল হওয়া একটি আয়াতকে অন্য ঘটনার সাথে জুড়ে দিয়ে কুরআন থেকে ‘স্ববিরোধিতা’(!) বের করার প্রয়াস পেয়েছেন।

 

এবার বদরের যুদ্ধের প্রেক্ষিতে নাজিলকৃত আয়াতগুলোর আলোচনায় আসি যেগুলোর ব্যাপারে স্ববিরোধিতার অভিযোগ তোলা হয়েছে।

 

বদরের যুদ্ধের সময়ে আল্লাহ তা’আলার পক্ষে থেকে যে সমস্ত ফেরেশতা সাহায্যের জন্য পাঠানো হয়েছিল, সুরা আনফাল ৮:৯ নং আয়াতে তাদের সংখ্যা ১০০০ জন ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ সুরা আলি ইমরানে (আয়াত ৩:১২৪-১২৫) ৩০০০ এবং ৫০০০ ফেরেশতারও উল্লেখ রয়েছে।

এর কারণ ছিল—প্রকৃতপক্ষে ৩টি ওয়াদার ভিন্নতা যা বিভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষিতে করা হয়েছে।

১ম ওয়াদাটি ছিল ১০০০ ফেরেশতা প্রেরণের (সুরা আনফাল ৮:৯) , যার কারণ ছিল মহানবী(ﷺ) এর দুআ এবং সাধারণ মুসলিমদের ফরিয়াদ।

২য় ওয়াদা, যা ৩০০০ ফেরেশতার ব্যাপারে করা হয় এবং যা সুরা আলি ইমরানে (আয়াত ৩:১২৪) উল্লেখ করা হয়েছে। এটা সেই সময়ে করা হয়েছিল যখন মুসলিমদের কাছে এই সংবাদ এসে পৌঁছে যে, কুরাইশ বাহিনীর জন্য আরো বর্ধিত সাহায্য আসছে। তাফসির রুহুল মা’আনী গ্রন্থে ইবন আবি শায়বা ও ইবন মুনজির কর্তৃক শা’বীর উদ্ধৃতিক্রমে উল্লেখ রয়েছে যে, ইবন জাবির মুহারিবী মুশরিকদের সহায়তার উদ্যেশ্যে আরো সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসছে এ সংবাদে মুসলিমদের মাঝে এক ত্রাসের সৃষ্টি হয়। এরই প্রেক্ষিতে সুরা আলি ইমরানের ৩:১২৪ নং আয়াত নাজিল হয়। এতে ৩০০০ ফেরেশতাকে মুসলিমদের সাহায্যকল্পে আকাশ থেকে অবতীর্ণ করার ওয়াদা করা হয়।

আর ৩য় ওয়াদা ছিল ৫০০০ এর। তা ছিল এই শর্তযুক্ত যে—বিপক্ষ দল যদি প্রচণ্ড আক্রমণ করে বসে, তবে ৫০০০ ফেরেশতার সাহায্য পাঠানো হবে। আর তা সুরা আলি ইমরানের পরবর্তী আয়াতে (আয়াত ৩:১২৫) ব্যক্ত করা হয়েছে। ... কোন কোন তাফসিরবিদ বলেন যে, এ ওয়াদার শর্ত ছিল ৩টি। (১) দৃঢ়তা অবলম্বন (২) তাকওয়ার উপর স্থির থাকা থাকা এবং (৩) প্রতিপক্ষের ব্যাপক আক্রমণ।

১ম ২টি শর্ত সাহাবায়ে কিরামের(রা) এমনিতেই বিদ্যমান ছিল এবং তাঁদের এ আশায় প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এতটুকু পার্থক্য আসেনি।

কিন্তু ৩য় শর্তটি অর্থাৎ ব্যাপক আক্রমণের ব্যাপারটি প্রথমে সংঘটিত হয়নি কাজেই ৫০০০ ফেরেশতার আগমনের প্রয়োজন হয়নি।

...

এখানে এ বিষয়টিও লক্ষণীয় যে, উক্ত আয়াতগুলোতে যে ৩টি দল (১০০০, ৩০০০ ও ৫০০০ জনের) প্রেরণের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, তাদের প্রত্যেকটি দলের সাথেই একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ রয়েছে। সুরা আনফালের যে আয়াতে ১০০০এর ওয়াদা করা হয়েছে (আয়াত ৮:৯) তাতে ফেরেশতাদের বৈশিষ্ট্য বলতে গিয়ে مُرْدِفِينَ শব্দ বলা হয়েছে। এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছেঃ ‘পেছনে লাগোয়া’। এ থেকে এ ইঙ্গিত বোঝা যায় যে এদের পেছনে আরো ফেরেশতা আসবে। পক্ষান্তরে সুরা আলি ইমরানের উল্লেখিত প্রথম আয়াতটিতে (আয়াত ৩:১২৪) ফেরেশতাদের বৈশিষ্ট্য مُنزَلِينَ বলা হয়েছে। অর্থাৎ এ সমস্ত ফেরেশতা আকাশ থেকে অবতারণ করা হবে। এতে একটি বিশেষ গুরুত্বের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, পূর্ব থেকেই যে সব ফেরেশতা পৃথিবীতে অবস্থান করছেন, তাদেরকে এ কাজে নিয়োগ না করে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে এ কাজের জন্য আকাশ থেকে ফেরেশতা অবতারণ করা হবে।

আর সুরা আলি ইমরানের অন্য আয়াতে যেখানে ৫০০০ ফেরেশতার কথা উল্লেখ আছে (আয়াত ৩:১২৫) তাতে ফেরেশতাদের مُسَوِّمِينَ বৈশিষ্ট্য বলা হয়েছে। অর্থাৎ তাঁরা হবেন বিশেষ চিহ্ন ও বিশেষ পোশাকে ভূষিত। হাদিসের বর্ণণায় তাই রয়েছে যে, বদর যুদ্ধে অবতীর্ণ ফেরেশতাদের পাগড়ী ছিল সাদা। এ ছাড়া হুনাইন যুদ্ধে সাহায্যের জন্য আগত ফেরেশতাদের পাগড়ী ছিল লাল। [7]   

 

অতএব আলোচ্য আয়াতগুলোতে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন সংখ্যক ফেরেশতার দল দ্বারা মুসলিমদের সাহায্য করবার কথা বলা হয়েছে। এই তথ্যগুলোতে কোন প্রকারের বৈপরিত্য নেই।

 

তথ্যসূত্রঃ

[1]  আল কুরআন, আলি ইমরান ৩:১২৪-১২৫

[2]  আল কুরআন, আনফাল ৮:৯

[3]  আল কুরআন, হিজর ১৫:৬-৮

[4]  আর রাহিকুল মাখতুম {শফিউর রহমান মুবারকপুরী(র)}, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, পৃষ্ঠা ২৪৮

[5]  তাফসির মা’আরিফুল কুরআন, ৫ম খণ্ড {মুফতি শফি(র)}, সুরা হিজরের ৮নং আয়াতের তাফসির, পৃষ্ঠা ২৬৯-২৭০

[6]  সুরা হুদ ১১:৬৯-৮৩ ও সুরা যারিয়াত ৫১:২৪-৩৫ দ্রষ্টব্য

[7]  তাফসির মা’আরিফুল কুরআন, ৪র্থ খণ্ড {মুফতি শফি(র)}, সুরা আনফালের ৯নং আয়াতের তাফসির, পৃষ্ঠা ২১৩-২১৪