Pray for the world economy

শয়তান কই?

 

নাস্তিকতা বা সংশয়ে থাকা মানুষগুলো একটা কমন প্রশ্ন হলো – শয়তান কোথায়?

 

এসকল মানুষ বিজ্ঞানবাদিতা রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণে শয়তানের বৈজ্ঞানিক প্রমাণ চায়; বিজ্ঞানকেই সত্য জানার একমাত্র মানদণ্ড মন করে। শয়তানের অস্তিত্ব যদি থেকেই থাকে বিজ্ঞান কেন খুঁজে পায়নি— এমন কথা বলতে থাকে। বিজ্ঞান সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে এরা সার্কুলার রিজনিং ফ্যালাসিতে নিত্যদিন ঘুরপাক খায়।

 

বিজ্ঞান পথ চলা শুরু করে পদ্ধতিগত প্রকৃতিবাদের অনুমান (বা বলতে পারেন অন্ধবিশ্বাস) নিয়ে। যার লক্ষ্য হলো চোখের সামনে থাকা এই অবাক বিশ্বের কোনও ঘটনা ব্যাখ্যার সময় কেবল জাগতিক ব্যাখ্যাই দেওয়া হবে; স্রষ্টা/ফেরেশতা/জিন আছে কি নেই, সে বিষয়ে কথা বলা হবে না। এসব ব্যাপার বিজ্ঞানের গণ্ডীর বাইরে। যদি সকল তথ্য-উপাত্ত কোনও স্রষ্টার দিকে বা অতিপ্রাকৃত কিছুর দিকে ইঙ্গিত করে, তবে তাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হবে! অর্থাৎ শয়তানকে বিজ্ঞান খুঁজবে না বলে আগেই মনস্থির করে নিয়েছে। কাউকে ঘর থেকে আগেই বের করে দেওয়ার পর যদি বলা হয় – কই তাকে তো ঘরে খুঁজে পেলাম না! তাহলে বিষয়টা কেমন দাঁড়ায়!!

তাই যারা বলে – শয়তানের অস্তিত্ব যদি থেকেই থাকে বিজ্ঞান কেন খুঁজে পায়নি – এরা বিজ্ঞানের বেসিক এসাম্পসান ও কর্মপরিধি সম্পর্কে অজ্ঞ। বিজ্ঞানপ্রেমিদের অধিকাংশেরই এই বেহাল দশা।

 

হুমায়ুন আজাদ-এর আমার অবিশ্বাস বই পড়তে গিয়ে দেখি উনিও বেশ জোরের সাথে বলেছেন – শয়তান কোথাও নেই (পৃ. ১০১)। উনার সমমনারা অজ্ঞতার কারণে ভেবে বসে – শয়তান হলো কেবলই অতিপ্রাকৃত কোনও মন্দসত্তা, যাকে চোখে দেখা যায় না। কিন্তু ঝামেলা হলো ইসলামে শয়তানের ধারণা এতটা সংকীর্ণ নয়। অভিধান অনুযায়ী শয়তান মানে এমন সত্তা, যে সত্য থেকে বহু দূরে ছিটকে পড়েছে। (১) অপর অর্থে শয়তান হলো প্রত্যেক গর্বিত ও বিদ্রোহী জিন, মানুষ ও প্রাণী; যে শক্তি মানুষের অন্তরে স্বাভাবিক সৎ প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে কুমন্ত্রণা দান করে ও কুপরামর্শ দিয়ে মানুষকে পথ ভুলিয়ে দেয় ও বিপথগামী করে সেই শয়তান। ইমাম তাবারির মতে, অবিশ্বাসীরা আল্লাহর বদলে যার আনুগত্য স্বীকার করে সেই শয়তান। (২) অর্থাৎ শয়তান মূলত গুণবাচক বা কর্মবাচক নাম।

 

এবার জিন বিষয়ে হালকা বাতচিত করা যাক। কারণ উনারা শয়তান বলতে মূলত জিনকেই বোঝায়। জিনেরা এই বস্তুজগতেরই অংশ, তবে তারা ভিন্ন মাত্রায় বিরাজমান। তাদেরকে সরাসরি দেখা যায় না, তবে তাদের প্রভাব সরাসরি দেখা যায়। (আমার দেখার ও শোনার সৌভাগ্যও হয়েছে) ড. আজাদ-সহ সংশয়ীরা সেই প্রভাব কোনোদিন দেখেনি বলে সরাসরি জিন শয়তানকে অস্বীকার করে বসেছেন। অথচ এদের অনেকেই বিশ্বাস করে অ্যালিয়েন অর্থাৎ ভিনগ্রহে কোনও বুদ্ধিমান প্রাণী থাকার সম্ভাবনা খুবই বেশি! যে অ্যালিয়েন নিজেও ভিন্ন মাত্রার, একই সাথে ভিন্ন জগতেরও। আরও অনেক সেক্যুলার পশ্চিমা গবেষক, বিজ্ঞানী, দার্শনিকও এমন বিশ্বাস করেন যে – ভিনগ্রহের বুদ্ধিমাণ প্রাণী থাকতে পারে।

 

ভিনগ্রহে বুদ্ধিমত্তার অনুসন্ধান (SETI) শুরু হয় সেই ১৯৬০ সালে। সেই থেকে প্রায় ৬০ বছর ধরে ভিনগ্রহের বুদ্ধিমান প্রাণীর খোঁজে বিজ্ঞানীরা মহাকাশ চষে বেড়াচ্ছেন। বুদ্ধিমান প্রাণীর খোঁজকারী ক্যালিফোর্নিয়ার সেটি ইন্সটিটিউট-এর বাৎসরিক ব্যায়ের পরিমাণ ৭০ লক্ষ ডলার! এদিকে আবার অ্যালিয়েন থেকে পৃথিবীকে রক্ষার জন্য নাসা অফিসার ভাড়া করছে, যার বাৎসরিক বেতন হবে প্রায় ১ লক্ষ ৯০ হাজার ডলার! হলিউডে কাড়িকড়ি চলচিত্র বানিয়ে অ্যালিয়েনের প্রতি বিশ্বাস পাকাপোক্ত করা হচ্ছে। এত বছর ধরে এমন হুলুস্থুল কাণ্ড করে, অগণিত অর্থ ব্যয় করে ফলাফলটা কী? নিশ্চয়ই কাড়ি কাড়ি অ্যালিয়েন খুঁজে পাওয়া গেছে, তাই না? সে আশায় গুড়ে বালি! পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির জ্যোতির্বিদ জেসন রাইট নেতৃত্বে এক গবেষকদল প্রায় ১,০০,০০০ (এক লক্ষ) বড়সড় গ্যালাক্সি চুলচেরা অনুসন্ধান করেও কোনও এলিয়েনের অস্তিত্ব খুঁজে পাননি। এরপরও ড. আজাদদের এলিয়েনের অস্তিত্ব খুবই সম্ভব মনে হয়, আর শয়তান নেই মনে হয়! বড় অদ্ভুত তাঁদের চিন্তাধারা!

 

তবে অনেকেই জানে না যে – বৈজ্ঞানিক মহলেও এখন শয়তান নিয়ে কথা ওঠা শুরু হয়েছে। প্রথিতযশা সাইকিয়াট্রিস্ট এবং ১০ মিলিয়ন কপিরও বেশি বিক্রি হওয়া বেস্ট সেলিং বইয়ের লেখক ডা. স্কট পেক তাঁর এক বইতে শয়তানের অস্তিত্ব বিষয়ে স্বীয় অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। জার্সি নামের একজন রোগীর কাহিনী নিয়ে লিখেছেন বইটি। লেখক নিজেও এককালে শয়তানের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু জীবনের পরিক্রমায় এমন কিছু ঘটনার সম্মুখীন হন, যার দ্বারা তাঁর চিন্তার জগতের মোড় ঘুরে যায়। এমন কিছু আবিষ্কার করে বসেন, যা নিছক পাগলামি বলে উড়িয়ে দেওয়া বা স্ট্যান্ডার্ড ক্লিনিক্যাল ডায়াগনোসিস দ্বারা সমাধা করা যায় না। চলুন তাঁর নিজের মুখ থেকেই তাঁর অভিজ্ঞতার কিয়দাংশ শোনা যাক:

 

“জার্সির সাথে আমার সাক্ষাৎ হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি শয়তানের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতাম না। অথবা আরও সঠিকভাবে বললে, তার সাথে সাক্ষাতের তিন ঘণ্টা পরও আমি ৯৯% নিশ্চিত ছিলাম যে শয়তান বলে কিছু নেই। বরং শয়তানের অনস্তিত্বকে যতটুকু বৈজ্ঞানিকভাবে পারা যায় প্রমাণ করার কৌশল হিসেবে আমি জার্সির ঘটনাকে কাজে লাগানোর চিন্তাভাবনা করতে থাকি। কিন্তু যখন জার্সিকে বলতে শুনি, ‘ওদের জন্য আমার খারাপ লাগে। তারা আসলেই বড্ড দুর্বল ও করুণা পাওয়ার যোগ্য’, তখন আমার অভিজ্ঞতা যেন আমাকেই ব্যাকফায়ার করে বসে। তার সাথে প্রথম সাক্ষাতের পরে যখন বাসায় ফিরে আসি তখনও শয়তানের অস্তিত্বে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারিনি, সর্বসাকুল্যে ফিফটি-ফিফটি বলা যায়। তারপরও বলতে হয়, মনের কী অদ্ভুত বিচলন! সংশয়বাদী থেকে একদিনের মাঝেই নিরপেক্ষ অবস্থানে এসে দাঁড়ানো, আসলেই, আরও খতিয়ে দেখতে হবে দেখছি! টেরি আর আমি জার্সির সম্মুখীন হয়ে তার মাঝে লুকিয়ে থাকা এক ভয়ংকর খারাপ সত্তাকে আবিষ্কার করি। এ নিয়ে ম্যালাকাইয়ের সাথে আলোচনা করে তা হজম করতে আমার বেশ সময় লেগেছে। তিনমাস পর আমার মনে হয় আমি বিশ্বাস শুরু করেছি। আমি তখন ৯৫% নিশ্চিত ছিলাম, এতটুকু নিশ্চিত যে বিনাদ্বিধায় ঝাড়ফুঁকের অনুমতি দিতাম। যদিও আমি জানতাম আমার নিজের ডাক্তারি পেশাই হয়তো আমাকে এহেন আচরণের জন্য বিদায় জানাবে। দুমাস পর ঝাড়ফুঁকের চরম মুহূর্তে যখন দেখি জার্সি আমার দিকে তাকিয়ে আর্তচিৎকার দিচ্ছে, সাথে সাথে হাসছেও। তখন আমি প্রায় ৯৯% নিশ্চিত হই যে সে আসলেই শয়তানের আসরে আক্রান্ত। চারদিন পর আমি শতভাগ নিশ্চিত হয়ে যাই, পুরোপুরি! আর কখনোই আমি শয়তানের অস্তিত্বে সন্দেহ করব না।”

[ DR. M. SCOTT PECK, M.D., GLIMPSES OF THE DEVIL: A PSYCHIATRIST’S PERSONAL ACCOUNTS OF POSSESSION, EXORCISM & REDEMPTION; PART III: CONCLUSION (FREE PRESS, 2005) ]

 

তা ছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে আরেকজন প্রথিতযশা বোর্ড সার্টিফাইড আমেরিকান সাইকিয়াট্রিস্ট ও নিউ ইয়র্ক মেডিকেল কলেজের ক্লিনিক্যাল সাইকিয়াট্রি-এর প্রফেসর এ নিয়ে মুখ খুলেছেন। তিনি হলেন ডা. রিচার্ড গ্যালাঘার। পড়াশোনা করেছেন প্রিন্সটন, ইয়েল এবং কলম্বিয়ায়। তাঁর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার সামান্য কিছু অংশ লিখেছেন দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট-এর এক দীর্ঘ আর্টিকেলে। তাঁকে নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে দ্য টেলিগ্রাফ, ডেইলি মেইল, সিএনএন ইত্যাদি আন্তর্জাতিক পত্রিকায় বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে।

 

নিজেকে গর্বের সাথে ‘বিজ্ঞানের মানুষ’ বলে পরিচয় দেওয়া ডা. রিচার্ড নিজেও শয়তানের অস্তিত্বে সন্দিহান ছিলেন। তিনি শয়তান দ্বারা আক্রান্ত হওয়া সংক্রান্ত বাইবেলে বর্ণিত বিভিন্ন ঘটনা জানতেন। তবে তিনি মনে করতেন প্রাচীন মানুষ বিভিন্ন রোগের (যেমন : মৃগীরোগ) কারণ বুঝতে না পেরে এগুলোকে শয়তানের আসর মনে করত। কিন্তু বিগত পঁচিশ বছর ধরে অর্জিত তাঁর অভিজ্ঞতা যেন অন্য এক জগতের দিকে ইঙ্গিত করছে! ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে মেডিসিন পড়ার সময় তিনি কস্মিনকালেও ভাবেননি একদিন তাঁকে শয়তানের চ্যালাদের সাথে টক্কর লাগতে হবে!

 

ডা. রিচার্ড এর মতো আরও কতিপয় সাইকিয়াট্রিস্ট নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে শয়তানের আসর সম্ভব মনে করেন। যেমন : ডা. মার্ক আলবানিজ, নিউ ইয়র্ক সাইকিয়াট্রি ইন্সটিটিউটের পরিচালক ও সিজোফ্রেনিয়া বিশেষজ্ঞ ডা. জেফরি লাইবারম্যান, নিউ ইয়র্ক মেডিকেল কলেজের সাইকিয়াট্রি ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান ডা. জোসেফ ইংলিশ প্রমুখ। যেমন – ডা. জোসেফ ইংলিশ বলেন :

 

“(সম্ভাব্য শয়তানের আসরের) এমন ঘটনাগুলোর নজির আজকের আধুনিক দুনিয়াতেও পাওয়া যাচ্ছে, যদিও তা আমাদের প্রচলিত ধ্যানধারণার বিপরীত। এহেন সমস্যাগুলোকে স্রেফ মেডিকেল বা সাইকিয়াট্রিক-ব্যাধি বলে উড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতাকে কাঁচকলা দেখিয়ে এমন ঘটনা ঘটেই চলছে ।”

 

নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে ডা. রিচার্ড গ্যালাঘারের অনুধাবন হলো, এই শয়তানেরা খুবই স্মার্ট, মানুষের চেয়ে এদের ঘটে ঘিলু অনেক বেশি। তাই তারা মানুষকে তুচ্ছজ্ঞান করে। মাঝে মাঝে মানুষকে বাঁদর বলে গালি দেয়! মুক্তমণারা (!) শয়তানের অস্তিত্ব মানতে চায় না-জানতে পারলে এদের শয়তানরা কী বলে সম্বোধন করে সেটা ভাবার বিষয়। 

 

          (১) T. P. Hughes, A Dictionary Of Islam; p. 84 (New York : Scribner, Welford, & Co., 1885)
          (২) সম্পাদনা পরিষদ, সংক্ষিপ্ত ইসলামি বিশ্বকোষ; খণ্ড ০২, পৃ. ৩৪২ (ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, মে ২০০৭)

 

 

লেখকের নিজস্ব ওয়েবসাইট থেকে লেখাটি পড়তে ক্লিক করুনঃ

https://rafanofficial.wordpress.com/2019/12/06/does-satan-exist/

 

আরো পড়ুনঃ

"আল্লাহ কেন শয়তান সৃষ্টি করলেন?"