Pray for the world economy

সুরা বাকারাহর ১৮৪ নং আয়াতে ভিন্ন কিরাতগুলোতে কি আসলেই ভিন্ন তথ্য আছে?

 

সূরা বাকারাহর ১৮৩-১৮৪ আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেন, 


يا يها الذين آمنوا كتب عليكم الصيام كما كتب علي الذين من قبلكم لعلكم تتقون.

 اياما معدودات فمن منكم مريضا او علي سفر فعدة من ايام اخر و علي الذين يطيقونه فدية طعام مسكين

অর্থ : (১৮৩) হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর সিয়াম (রোজা) ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর।

(১৮৪) নির্দিষ্ট কয়েক দিন। তবে তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ হবে, কিংবা সফরে থাকবে, তাহলে অন্যান্য দিনে সংখ্যা পূরণ করে নেবে। আর যাদের জন্য তা কষ্টকর হবে, তাদের কর্তব্য ফিদিয়া- একজন দরিদ্রকে খাবার প্রদান করা। অতএব যে স্বেচ্ছায় অতিরিক্ত সৎকাজ করবে, তা তার জন্য কল্যাণকর হবে। আর সিয়াম পালন তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা জানো।

 

ইসলামবিরোধীদের অভিযোগঃ

সর্বাধিক প্রচলিত হাফস কিরাতে ১৮৪ নং আয়াতে  ‘মিসকিন’ (مسكين)  শব্দটি একবচনে আছে। আবার ওয়ারশ, ক্বালুন ইত্যাদি কিরাতে বহুবচনে ‘মাসাকিন’ (مساكين) আছে। খ্রিষ্টান মিশনারী ও নাস্তিক মুক্তমনাদের প্রশ্ন হচ্ছেঃ এভাবে ভিন্ন কিরাতে ভিন্নভাবে শব্দটি আছে কেন? এতে কি ভিন্ন ভিন্ন ধরণের বিধান পাওয়া যাচ্ছে না? লাওহে মাহফুজে তাহলে কুরআনের কোন বিধানটি লেখা আছে?

 

অভিযোগ পর্যালোচনাঃ

এই আয়াতে আমরা একটি জিনিস লক্ষ্য করি, ১৮৪ নং  আয়াতে আমরা সচরাচর যে কিরাত পড়ি, সেই হাফস কিরাতে এটি পড়া হয়,  فِدْيَةٌ طَعَامُ مِسْكِينٍ  অর্থাৎ একজন মিসকিন বা দরিদ্রকে খাবার প্রদান করা - এভাবে।

সর্বাধিক প্রচলিত হাফস কিরাতে এরূপে আছে। হাফস কিরাতের কুরআন থেকে আয়াতটি দেখতে ক্লিক করুন এখানে

আল কুরআন যেসকল ক্বারীদের দ্বারা বর্ণিত, তাঁদের মধ্যে  না’ফে ও ইবন আমির ব্যতিত সংখ্যাগরিষ্ঠ ক্বারীগণ এমনভাবে ‘মিসকিন’ শব্দটি একবচন যোগে পড়েছেন। [1]

 

আর না'ফে ও ইবন আমির বহুবচন যোগে পড়েছেন,  অর্থাৎ  তাঁরা পড়েছেন --

 فدية طعام مساكين [2]

 

ওয়ারশ কিরাতে এরূপে আছে। ওয়ারশ কিরাতের কুরআন থেকে আয়াতটি দেখতে ক্লিক করুন এখানে

 

এখন একবচন ও বহুবচন আসার কারণে কুরআনের সমালোচকদের থেকে প্রশ্ন আসে যে, একবচন ও বহুবচন পড়ার কারণে কি হুকুমের মধ্যে কোন পার্থক্য আসছে না? আর এভাবে ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে পড়ার কারণই বা কী?

 

প্রথমতঃ

এই আয়াতের হুকুম মানসুখ হয়ে গেছে, কিন্তু তিলাওয়াত অবশিষ্ট আছে। [[ নাসেখ-মানসুখ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে এখানে ক্লিক করুন ]]

ইসলামের প্রাথমিক যুগে ইচ্ছা করলে রোজা না রেখে ফিদিয়া দেবার অর্থাৎ দরিদ্রকে খাদ্য খাওয়ানোর সুযোগ ছিল। কিন্তু পরে বিধান দেয়া হয়, রোযা ফরজ হলে সামর্থ্য রাখে এমন প্রত্যেক ব্যক্তিকে রোজা রাখতে হবে। রোজা না রেখে শুধু ফিদিয়া দিলে হবে না। [3] তবে কেউ যদি রোজা রাখতে সামর্থ্য না রাখে, সেক্ষেত্রে ফিদিয়া দিতে পারে।

 

দ্বিতীয়তঃ

 আয়াতে একবচন শব্দ ও বহুবচন দ্বারা এখানে প্রকৃতপক্ষে অর্থের মধ্যে কোনো পার্থক্য আসে না। কেননা, একবচন দ্বারা প্রতিদিনের হুকুম বর্ননা করা হয়েছে। অর্থাৎ যে ব্যক্তি প্রতিদিন রোজা ভঙ্গ করবে, সে প্রতিদিন একজন করে মিসকিন বা দরিদ্রকে খাওয়াবে।

 

আর বহুবচন পড়তেও কোনো সমস্যা নেই। কেননা, তখন সারা মাসের হুকুম বর্ণনা করা উদ্দেশ্য। অর্থাৎ  এর দ্বারা বোঝানো হয়েছে যে সারা মাসে যারা রোজা রাখবে না সে যেন সারা মাসে ফিদিয়া দেয় অর্থাৎ দরিদ্রদেরকে  খাওয়ায়। একটি মাস দ্বারা বহুসংখ্যক দিনকে নির্দেশ করা হয়। সে হিসাবে মাসাকিন বহুবচন পড়লে অর্থের মধ্যে কোনো সমস্যা আসে না। [4]

 

এভাবে পড়ার দ্বারা একটা কারণ এ-ও যে, অনেক ব্যক্তির মধ্যে এই ধারনা আসে, সারা মাসে ফিদিয়া একজনকেই দিতে হবে, অন্য কাউকে দেওয়া যাবে না। কিন্তু বহুবচন শব্দটি এই ধারণা দূর করে দেয়। [5]

 

২ জায়গায় ২ রকম দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে পড়া হচ্ছে। কিন্তু মূল জিনিস এখানে একই।

আরো একটা উদাহরণ দেই। তাহলে হয়তো আরেকটু সহজে বোঝা যাবে।
ধরা যাক এক জন লোককে মাসে মোট ৩০ টি কলম দিতে হবে। প্রতিদিনের জন্য ১টি কলম।
এই ব্যাপারটিকেই ২ জায়গায় ২ ভাবে বলা হলঃ

1. You will give me ONE PEN for each day in that month.
2. You will give me 30 PENS in that month.

এখানে এক জায়গায় Pen এর একবচন আবার অন্য জায়গায় বহুবচন। কিন্তু মূল অর্থ এক।

 

এখন একটি প্রশ্ন আসতে পারে— আল্লাহ যে কুরআন নাযিল করেছিলেন, তাতে কি এই দুই রকমের শব্দ ছিল?

 

একটি কথা ভালো করে বুঝতে হবে, আগের যুগে নবীগণ কোনো এক গোত্র বা এলাকার জন্য ছিলেন। তাই তাঁদের এক ধরনের শব্দ পড়তে কোন কষ্ট হত না যেহেতু তাঁরা সেই গোত্রেরই ছিলেন। কিন্তু আমাদের নবী(ﷺ)কে আল্লাহ সমস্ত ভাষাভাষী,  গোত্র ও রাষ্ট্রের জন্য নবী করে পাঠিয়েছেন।  তাই প্রথমে কুরাইশের পদ্ধতিতে নাযিল হলেও পরে রাসুলুল্লাহর(ﷺ) আবেদনের কারণে আরো কিছু পদ্ধতিতে পড়ার অনুমতি দেওয়া হয় বা অন্য কিছু পদ্ধতি ওহী করে প্রেরণ করা হয়। পরে আবার পরিস্থিতি অনুযায়ী সাহাবীদের দ্বারা সে প্রথম পদ্ধতি কুরাইশদের পদ্ধতিকে একটি পাণ্ডুলিপিতে আনা হয়। যেমন রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেন,

 

أقرأني جبريل علي حرف فراجعته فلم ازل استزبده و يزيدني حتي انتهي الي سبعة احرف

অর্থ: জিব্রাইল(আ.) আমাকে এক হরফে (কুরআন) পড়ালেন। আমি তাঁর সাথে আলোচনা করলাম এবং বারবার বৃদ্ধি করার কথা বললাম,  তিনি (আল্লাহর কাছে থেকে বৃদ্ধি করিয়ে আনলেন) আমার কাছে ৭ হরফ পর্যন্ত বৃদ্ধি করলেন। [6]

 

روى مسلم عن أبي بن كعب : أن النبي - صلى الله عليه وسلم - كان عند أضاة بني غفار ، فأتاه جبريل عليه السلام فقال : إن الله يأمرك أن تقرأ أمتك القرآن على حرف ; فقال : أسأل الله معافاته ومغفرته وإن أمتي لا تطيق ذلك . ثم أتاه الثانية فقال : إن الله يأمرك أن تقرأ أمتك القرآن على حرفين ; فقال : أسأل الله معافاته ومغفرته وإن أمتي لا تطيق ذلك . ثم جاءه الثالثة فقال : إن الله يأمرك أن تقرأ أمتك القرآن على ثلاثة أحرف ; فقال : أسأل الله معافاته ومغفرته وإن أمتي لا تطيق ذلك . ثم جاءه الرابعة فقال : إن الله يأمرك أن تقرأ أمتك القرآن على سبعة أحرف فأيما حرف قرؤوا عليه فقد أصابوا .

অর্থ: ইমাম মুসলিম উবাই ইবনে কা'ব থেকে বর্ননা করেন যে, নবী(ﷺ) গিফার গোত্রের কূপের নিকট ছিলেন। তখন জিবরাঈল(আ.) তাঁর নিকট এসে বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ আপনাকে এই নির্দেশ দিয়েছেন যে, আপনি যেন আপনার জাতিকে এক হরফে কুরআন পড়ান। তিনি বলেন, আমি আল্লাহর নিকট তাঁর ক্ষমা ও উদারতা প্রার্থনা করি। নিশ্চয়ই আমার জাতি এতে সমর্থ হবে না। তিনি পুনর্বার তাঁর নিকট এসে বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ আপনাকে এই নির্দেশ দিয়েছেন যে, আপনি যেন আপনার জাতিকে দুই হরফে কুরআন পড়ান। তিনি বলেন, আমি আল্লাহর নিকট তাঁর উদারতা ও ক্ষমা প্রার্থনা করি। নিশ্চয়ই আমার জাতি এতে সমর্থ সমর্থ হবে না। জিবরাঈল(আ.) তৃতীয়বার এসে বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ আপনাকে এই নির্দেশ দিয়েছেন যে, আপনি যেন আপনার জাতিকে তিন হরফে কুরআন পড়ান। তিনি বলেন নিশ্চয়ই আমার জাতি এতে সমর্থ হবে না। আমি তাঁর উদারতা ও ক্ষমা প্রার্থনা করি। জিব্রাইল(আ.) চতুর্থ বার তাঁর নিকট এসে বলেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ আপনাকে এই নির্দেশ দিয়েছেন যে, আপনি যেন আপনার জাতিকে সাত হরফে(পদ্ধতিতে) কুরআন শিক্ষা দেন। তারা এর যে কোন পদ্ধতিতে পাঠ করলে তা যথার্থ হবে। [7]  

 

মনে রাখার মত জরুরী কিছু কথা:

 

১। এই সামান্য কিছু শব্দের ভিন্নতা অর্থের মৌলিক বিষয়ের মধ্যে কোন ইখতিলাফ বা মতানৈক্য সৃষ্টি করেনি। মূল অর্থ একই রয়েছে।

২। এখানে পার্থক্য কিরাত বা পঠনে; লিখিত রূপে নয়। আদি আরবি ভাষায় নুকতা, যবর, যের, পেশ,  তাশদিদ বা তানবীন ছিল না। কাজেই বিভিন্নভাবে কিরাত বা পঠনের সুযোগ থেকে যায়। তাই আমরা যখন দেখি  مسكين  শব্দটি নুনের নুকটা  এবং যবর, যের, পেশ ছাড়া তখন  مساكين পড়ারও সুযোগ থাকে। কেননা مسكين শব্দের মাঝে খাড়া যবর দিলে مساكين হয়ে যায়। এখানে মূলত অতিরিক্ত কোনো অক্ষর নেই। খাড়া যবরের জন্য আলিফ দেয়া হয়েছে। আলিফ ব্যতিত শুধু খাড়া যবর দিয়েও এটি লেখা হয়। আদি অবস্থায় যবর, যের, পেশ ব্যতিত লিখিত রূপ একই থাকে। লাওহে মাহফুজে সেই আদি অবস্থাতেই কুরআন রয়েছে।

২।  সব শব্দে এবং সব আয়াতে যে এই ভিন্নতা আছে এমন না। বরং এই ভিন্নতা সামান্য কিছু আয়াতে সামান্য  কিছু  শব্দে আছে মাত্র। অধিকাংশ আয়াতের মধ্যে আদৌ পঠনের কোনো ভিন্নতাই নেই । 

৩। এগুলো প্রথমে উম্মতের সহজতার জন্য করা হয়েছিল।

 

অতএব কুরআনের ভিন্ন কিরাতগুলোতে ভিন্ন কোনো তত্থ্য দেয়া নেই। তা একই কুরআনের ভিন্ন পঠনের রীতিমাত্র, যা দ্বারা মূল অর্থের কোনো পরিবর্তন হয় না।

 

এবং আল্লাহই ভালো জানেন।

 

আরো পড়ুনঃ

 

কুরআনের ৭ হারফ এবং ১০ কিরাআত - ইবন তাইমিয়া(র.)

 

 সাত হারফ কি কুরআনের একাধিক ভার্সন?

 

দেখুনঃ

"কুরআনের বিভিন্ন কিরাত এবং আহরুফ কি কুরআনের ভিন্ন ভিন্ন ভার্সন?_শায়খ আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া"

https://youtu.be/cqS7GI4P6DA

 

 

তথ্যসূত্রঃ

[1] হুজ্জাতুল কিরাআত-১২৪, তাকরিবুন নাশর-৯৬

[2] প্রাগুক্ত

[3] বুখারী-৫/১৫৫, মুসলিম- ২/৮০২, তবারী-২৭৪৭, বাইহাকী-৪/২০০, নাসেখ-মানসুখ- (৫৮-৬৩-আলোচনা)

[4] হুজ্জাতুল কিরাআত-১২৪-১২৫, কিরাআতুল মুতায়াতিরাহ ওয়া আসারুহা ফি রসমিল কুরআনী ওয়া আহকামিশ শারয়ী-২৬৫-২৬৬

[5] কিরাআতুল মুতায়াতিরাহ ওয়া আসারুহা ফি রসমিল কুরআনী ওয়া আহকামিশ শারয়ী-২৬৫-২৬৬

[6] বুখারী-৪৭০৫, মুসলিম-১৯৩৯

[7] মুসলিম-১৭৮৩