এই বিষয়টি বুঝবার জন্য আমরা তিন ধরণের আলোচনার অবতারণা করব
ক) - সহীহ হাদিসে ইসরা ও মিরাজের ব্যাপারে কোন বিষয়গুলো অধিক পরিমাণে বলা হয়েছে?
খ) - সিঁড়ি জাতীয় বস্তুর মাধ্যমে আসমানে ভ্রমণ করার ব্যাপারে কি কোন হাদিস এসেছে?
গ) - বোরাকে বা বুরাকে করে আসমানে ভ্রমণ করার হাদিস কি বিশুদ্ধ? আর বিশুদ্ধ হলে তার ব্যাখ্যা আলেমগণ কিভাবে করেছেন ও কেন করেছেন?
[আলোচনা শুরু করার আগে একটি কথা জেনে রাখি, রাসুলুল্লাহ(ﷺ) ইসরা ও মি’রাজের বিষয়টি তাঁর উম্মতের কাছে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। সাহাবীদের থেকেও সেই বিষয় বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। তবে এটাও মনে রাখা জরুরি যে, কোন বিষয়ে কোন একজন সাহাবী থেকে ব্যতিক্রমী ইজতিহাদ পাওয়া যাওয়া অসম্ভব কিছু না। এবং অনেক হাদিসের সনদ বা সূত্র সহীহ হলেও মতন বা মূল কথা অন্যান্য হাদিসের সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারে। যেমন রাসুলুল্লাহ(ﷺ) এক হাদিসের গরুর গোশত খেতে নিষেধ করেছেন এবং কারণ হিসাবে বলা হয়েছে যে, তাতে রোগ আছে। মুস্তাদরাক হাকিম - ৮২৩২। অথচ রাসুলুল্লাহ(ﷺ) খাওয়ার জন্য গরু যবাই করেছেন বলেও হাদিসে উল্লেখ পাওয়া যায়। এর অর্থ মোটেও এই নয় যে নবী(ﷺ) স্ববিরোধী কর্ম করেছেন। বরং এর দ্বারা হাদিসের সনদের সাথে সাথে এর মতন বিশ্লেষণের গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। সনদের সাথে সাথে হাদিসের মতন বিশ্লেষণ করলে সঠিকভাবে হুকুম অনুধাবন করা যায়। এজন্য হাদিস যাচাইয়ের সময় মুহাদ্দিসগণ সনদ ও মতন দুটি নিয়েই আলোচনা করে থাকেন। হাদিস সহীহ হওয়ার জন্য মূল মতন শায ও ইল্লাত থেকে মুক্ত হতে হয়। মুহাদ্দিগন অনেক সময় হাদিসকে সনদকে সহীহ বলে উল্লেখ কিন্তু এর মতন সহীহ থাকে না। সনদের সাথে সাথে মতন সহীহ না হলে ঐ হাদিস চূড়ান্তভাবে সহীহ হয় না। ]
প্রথম আলোচনাঃ
সহীহ বুখারীতে এসেছে,
حَدَّثَنَا هُدْبَةُ بْنُ خَالِدٍ، حَدَّثَنَا هَمَّامُ بْنُ يَحْيَى، حَدَّثَنَا قَتَادَةُ، عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، عَنْ مَالِكِ بْنِ صَعْصَعَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا، أَنَّ نَبِيَّ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَدَّثَهُمْ عَنْ لَيْلَةِ أُسْرِيَ بِهِ: " بَيْنَمَا أَنَا فِي الحَطِيمِ، - وَرُبَّمَا قَالَ: فِي الحِجْرِ - مُضْطَجِعًا إِذْ أَتَانِي آتٍ، فَقَدَّ: قَالَ: وَسَمِعْتُهُ يَقُولُ: فَشَقَّ مَا بَيْنَ هَذِهِ إِلَى هَذِهِ - فَقُلْتُ لِلْجَارُودِ وَهُوَ إِلَى جَنْبِي: مَا يَعْنِي بِهِ؟ قَالَ: مِنْ ثُغْرَةِ نَحْرِهِ إِلَى شِعْرَتِهِ، وَسَمِعْتُهُ يَقُولُ: مِنْ قَصِّهِ إِلَى شِعْرَتِهِ - فَاسْتَخْرَجَ قَلْبِي، ثُمَّ أُتِيتُ بِطَسْتٍ مِنْ ذَهَبٍ مَمْلُوءَةٍ إِيمَانًا، فَغُسِلَ قَلْبِي، ثُمَّ حُشِيَ ثُمَّ أُعِيدَ، ثُمَّ أُتِيتُ بِدَابَّةٍ دُونَ البَغْلِ، وَفَوْقَ الحِمَارِ أَبْيَضَ، - فَقَالَ لَهُ الجَارُودُ: هُوَ البُرَاقُ يَا أَبَا حَمْزَةَ؟ قَالَ أَنَسٌ: نَعَمْ - يَضَعُ خَطْوَهُ عِنْدَ أَقْصَى طَرْفِهِ، فَحُمِلْتُ عَلَيْهِ، فَانْطَلَقَ بِي جِبْرِيلُ حَتَّى أَتَى السَّمَاءَ الدُّنْيَا فَاسْتَفْتَحَ، فَقِيلَ مَنْ هَذَا؟ قَالَ: جِبْرِيلُ، قِيلَ: وَمَنْ مَعَكَ؟
অর্থঃ হুদবা ইবন খালিদ(রা.) ... ... মালিক ইবনে সা’সা’(রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর নবী (ﷺ)-কে যে রাতে (বাইতুল মাকদিসে) ভ্রমণ করানো হয়েছে সে রাতের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, একদা আমি কাবা ঘরের হাতিমের অংশে ছিলাম। ... ... তারপর সাদা রং এর একটি জন্তু আমার নিকট আনা হল। যা আকারে খচ্চর থেকে ছোট ও গাধা থেকে বড় ছিল। জারুদ তাঁকে বলেন, হে আবু হামযা , ইহাই কি বুরাক? আনাস(রা.) বললেন, হ্যাঁ। সে একেক কদম রাখে দৃষ্টির শেষ প্রান্তে। আমাকে তার উপর সাওয়ার করানো হল। তারপর আমাকে নিয়ে জিবরাঈল (আ.) চললেন। ...।
[সহীহ বুখারী ৩৬০৮ ]
সহীহ মুসলিমে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,
أُتيتُ بالبُراقِ ، وهو دابَّةٌ أبيضُ طويلٌ ، فوق الحمارِ ، ودونَ البغلِ ، يضعُ حافرَه عند مُنتهَى طرْفِه ، فركبتُه ، حتى أتيتُ بيتَ المقدسِ ، فربطتُه بالحلْقة التي تَربِطُ بها الأنبياءُ
অর্থঃ “আমার কাছে বুরাক আনা হলো। তা ছিল সাদা রং-এর একটি জন্তু। আকৃতিতে গাধার চেয়ে বড় এবং খচ্চরের চাইতে ছোট। (এর চলার গতিবেগ এমন যে) যেখানে তার দৃষ্টি পৌঁছে সেখানেই তার প্রতিটি পদক্ষেপ গিয়ে পৌঁছায়। তিনি বলেন, আমি তার ওপর সাওয়ার হয়ে বাইতুল মুকাদ্দাস এসে উপস্থিত হলাম। এরপর অন্যান্য নবীরা যে খুঁটির সাথে তাঁদের সওয়ারীর পশু বেঁধে রাখতেন, আমিও আমার সওয়ারী তার সাথে বেঁধে নিলাম। ”
[সহীহ মুসলিমঃ ১৬২]
অন্য এক হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেন,
لَمَّا انْتَهَيْنَا إِلَى بَيْتِ المَقْدِسِ قَالَ جِبْرِيلُ بِإِصْبَعِهِ، فَخَرَقَ بِهِ الحَجَرَ، وَشَدَّ بِهِ البُرَاقَ
অর্থঃ “যখন আমরা বাইতুল মুকাদ্দাস পৌঁছলাম জিবরাঈল(আ.) তাঁর আঙুল দ্বারা পাথর ছেদ করলেন এবং বুরাককে এর সাথে বাঁধলেন।
[সুনানে তিরমিজিঃ ৩১৩২, সিলসিলাতু আহাদিস আস সহিহাঃ ৭/১৪২৫ , মুসতাদরাক হাকিমঃ ২/৩৬০]
এসব হাদিস থেকে এতটুকু স্পষ্ট হয়ে যায় যে,
ক- রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত বুরাকে সফর করেছিলেন
খ- বুরাককে বেঁধে এরপর সেখানে প্রবেশ করেন
গ – এবং এরপর সেখানে নামাজ আদায় করেন।
কিন্তু তিনি(ﷺ) কি আসমানে বুরাক নিয়ে গমন করেছিলেন? এসব রেওয়াত থেকে বিষয়টি স্পষ্টভাবে জানা গেল না।
নবী(ﷺ) আসমানে কিভাবে গমন করলেন তা জানবার জন্য আমরা এবার দ্বিতীয় আলোচনার অবতারণা করব।
দ্বিতীয় আলোচনাঃ
দ্বিতীয় আলোচনায় যাওয়ার পূর্বে আমরা জেনে রাখিঃ ‘মি’রাজ’ শব্দের অর্থ হল, সিঁড়ি।
[নিহায়া ফি গরিবীল হাদিসঃ ৩/২০৩]
এবং ‘ইসরা’ শব্দের অর্থ হল, রাতের ভ্রমণ।
কিছু কিছু দুর্বল হাদিসে পাওয়া যায় যে, রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-কে আসমানে নেওয়ার জন্য সিঁড়ি জাতীয় একধরণের বস্তু ব্যাবহার করা হয়। যেমন,
ইমাম বাইহাকি আবু সাইদ খুদরি(রা.) থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেন, রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেন,
قَالَ: "ثُمَّ دَخَلْتُ أَنَا وَجِبْرِيلُ بَيْتَ الْمَقْدِسِ، فَصَلَّيْتُ، ثمَّ أُتِيتُ بِالْمِعْرَاجِ
অর্থঃ “তারপর আমি ও জিবরাঈল বাইতুল মুকাদ্দাসে প্রবেশ করলাম এবং নামাজ আদায় করলাম। অতপর আমার জন্য সিঁড়ি (মিরাজ) আনা হল।”
[দালায়েলুন নবুয়ত ২/৩৯০-৩৯১]
ইবনে ইসহাক আবু সায়ীদ খুদরী (রা.) থেকে এবং তিনি রাসুলুল্লাহ(ﷺ) থেকে একই কথা বর্ণনা করেছেন। তবে তাতে এতটুকু বেশি আছে যে, “...বাইতুল মুকাদ্দাসে যা কাজ তা শেষ করার পর সিঁড়ি (মিরাজ) আনা হল। ইতিপূর্বে এমন সুন্দর সিঁড়ি আমি দেখিনি। ... আমার সাথী (জিবরাঈল) তাতে আমাকে আরোহণ করালেন এমনকি আমাকে নিয়ে আসমানের দরজায় এসে পৌঁছালেন।”
[সিরাতে ইবনে হিশামঃ ১/৪০৩]
কা’ব(রা.) রাসুলুল্লাহ(ﷺ) থেকেও সিঁড়ির কথা বর্ণনা করেছেন।
[ফাজায়েলে বাইতুল মুকাদ্দাসঃ ১৫৯-১৬০]
তবে এসব বর্ণনায় কিছু দুর্বলতা রয়েছে। আরও কিছু বর্ণনা রয়েছে যেগুলো বেশ দুর্বল। তবে সহীহ হাদিসগুলো সামনের রাখলে একটি বিষয় স্পষ্ট ফুটে ওঠে যে, রাসুলুল্লাহ(ﷺ) মি’রাজের ঘটনা এত বিস্তারিত বর্ণনা করা সত্ত্বেও প্রথম দফার বুরাকের মাধ্যে বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত সফরের কথা পরিষ্কার করে বললেও আসমান ভ্রমণের জন্য বুরাকের ব্যবহারের কথা স্পষ্ট করে বলেননি। তবে আরবি জানা কোন ব্যক্তি হাদিস বর্ণনার ধরণ ও এসব বর্ণনা খেয়াল করলে বুঝতে পারবে যে আসমানের সফর বুরাকের মাধ্যমে হয়নি। বরং সিঁড়ি জাতীয় বস্তু বা মিরাজের দ্বারা হয়েছিল। এর আলোকেই সেই রাতের নামকরণ হয়েছে ইসরা ও মিরাজের রাত।
এ জন্যই ইমাম ইবনে কাসির(র.) বলেছেন,
والمقصود أنه صلى الله عليه وسلم لما فرغ من أمر بيت المقدس نصب له المعراج؛ وهو السلم، فصعد فيه إلى السماء، ولم يكن الصعود على البراق كما قد يتوهمه بعض الناس؛ بل كان البراق مربوطًا على باب مسجد بيت المقدس ليرجع عليه إلى مكة.
অর্থঃ “রাসুলুল্লাহ(ﷺ) যখন বাইতুল মুকাদ্দাসের কাজ (নামাজ ও নবীদের সাথে সাক্ষাত থেকে) শেষ করলেন তখন তাঁর জন্য সিঁড়িজাতীয় বস্তু (মিরাজ) আনা হল এবং এতে করে তিনি আসমানে গমন করেন। বুরাকে করে যাননি। যেমন কতিপয় মানুষ তা ধারণা করে থাকে। বরং বুরাক বাইতুল মুকাদ্দাসের দরজায় সাথে বাঁধা ছিল যেন তাতে করে তিনি আবার মক্কায় ফিরে আসতে পারেন।”
[আল বিদায়া ওয়ান নিহায়াঃ ৩/১৩৮]
ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ুতী(র.) বলেছেন,
الصحيح الذي تقرر من الأحاديث الصحيحة أن العروج كان في المعراج لا على البراق
অর্থঃ “বিশুদ্ধ মত যা সহীহ হাদিস থেকে স্থিরকৃত হয়েছে, আকাশে গমন মি’রাজ বা সিঁড়ি জাতীয় এক ধরণের বস্তুর মাধ্যমে হয়েছিল, বুরাকের মাধ্যমে নয়।”
[আয়াতুল কুবরা ফি শরহে কিসসাতুল মি’রাজঃ ৬০]
বুরাকে করে আসমানে ভ্রমণ সংক্রান্ত বর্ণনাগুলো কি আদৌ বিশুদ্ধ? এ সম্পর্কে জানার জন্য আমরা এবার তৃতীয় আলোচনার অবতারণা করব।
তৃতীয় আলোচনাঃ
যির ইবনে হুবাইশ(র.), তিনি হুজাইফা(রা.) থেকে রাসুলুল্লাহ(ﷺ)-এর মিরাজের কথা এভাবে বর্ণনা করেন –
"أُتِيَ بِالْبُرَاقِ، وَهُوَ دَابَّةٌ أَبْيَضُ فَوْقَ الْحِمَارِ وَدُونَ الْبَغْلِ، فَلَمْ يُزَايِلاَ ظَهْرَهُ هُوَ وَجِبْرِيلُ حَتَّى انْتَهَيْنَا إِلَى بَيْتِ الْمَقْدِسِ، فَصَعِدَ بِهِ جِبْرِيلُ إِلَى السَّمَاءِ
অর্থঃ “তাঁর [নবী(ﷺ)] জন্য বুরাক আনা হল। তা ছিল সাদা রং-এর একটি জন্তু। আকৃতিতে গাধার চেয়ে বড় এবং খচ্চরের চাইতে ছোট। তিনি ও জিবরাঈল(আ.) বাইতুল মুকাদ্দাস পৌঁছা পর্যন্ত এর পিঠেই ছিলেন। অতঃপর এতে করেই জিবরাঈল(আ.) আসমানে আরোহণ করেন।”
[মুসনাদে আহমাদঃ ২৩৩৮০ , সিলসিলাতুল আহাদিস আস সহিহাঃ ৮৭৪]
এই হাদিসের সনদ সহীহ দেখে অনেকে মনে করে, মি’রাজ বা আসমানে ভ্রমণ বুঝি বুরাকের মাধ্যমে হয়েছিল!
অথচ পুরো হাদিসের কয়েকটি বিষয়ে অন্যান্য সহীহ হাদিসের সাথে এই বর্ণনাটি সাংঘর্ষিক। হাদিসের পূর্ণ অংশের কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়ঃ
ক) হুজাইফা(রা.) আল্লাহর কসম দিয়ে বলেছেন যে, এই রাতে রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বাইতুল মুকাদ্দাসে নামাজ পড়েননি। অথচ বহু সহীহ হাদিসে এর বিপরীত কথা আছে।
খ) রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বাইতুল মুকাদ্দাসের মসজিদের দরজায় বুরাককে বাঁধার কথা সহীহ হাদিসে পাওয়া যায়। অথচ হুজাইফা(রা.)-এর বর্ণনায় এই তথ্যকে নাকচ করা হয়েছে।
গ) আরবি ভাষার বর্ণনারীতি এবং অন্যান্য সহীহ ও দুর্বল হাদিসের আলোকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, তিনি বুরাকের মাধ্যে শুধু বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত সফর করেছিলেন। কিন্তু এই হাদিসে বলা হয়েছে আসমান পর্যন্ত তাঁরা উভয়ে বুরাকের পিঠে করেই সফর করেছিলেন। জিবারাঈল(আ.)ও বুরাকের পিঠে ছিলেন। অথচ এমন কোন কথা এই হাদিস ছাড়া আর কোন গ্রহণযোগ্য হাদিসে পাওয়া যায় না।
ঘ) এবং হাদিসটি থেকে বোঝা যায় যে, হুজাইফা(রা.) এই কথাগুলোকে স্পষ্ট রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর দিকে সম্পৃক্ত করে বর্ণনা করেনি। বরং এটিকে তাঁর ইজতিহাদ হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
যদি শুধু বুরাকের মাধ্যমে আসমান সফরের কথা মেনেও নেওয়া হয়, তাহলে এর ফলে বাকি যেসব বিষয়ে সহীহ হাদিসের সাথে দ্বন্দ্ব দেখা যাচ্ছে, সেগুলোর সমাধাণ দেয়া কি আদৌ সম্ভব?!!
এ কারণেই সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ হাদিস বিশারদ ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী(র.) এই হাদিসের বিস্তারিত ব্যাখ্যায় লিখেছেন,
حَتَّى أَتَى السَّمَاءَ الدُّنْيَا ظَاهِرُهُ أَنَّهُ اسْتَمَرَّ عَلَى الْبُرَاقِ حَتَّى عَرَجَ إِلَى السَّمَاءِ وَهُوَ مُقْتَضَى كَلَام بن أَبِي جَمْرَةَ الْمَذْكُورِ قَرِيبًا وَتَمَسَّكَ بِهِ أَيْضًا مَنْ زَعَمَ أَنَّ الْمِعْرَاجَ كَانَ فِي لَيْلَةٍ غَيْرِ لَيْلَةِ الْإِسْرَاءِ إِلَى بَيْتِ الْمَقْدِسِ فَأَمَّا الْعُرُوجُ فَفِي غَيْرِ هَذِهِ الرِّوَايَةِ مِنَ الْأَخْبَارِ أَنَّهُ لَمْ يَكُنْ عَلَى الْبُرَاقِ بَلْ رَقِيَ الْمِعْرَاجَ وَهُوَ السُّلَّمَ كَمَا وَقَعَ مُصَرَّحًا بِهِ فِي حَدِيث أبي سعيد عِنْد بن إِسْحَاقَ وَالْبَيْهَقِيِّ فِي الدَّلَائِلِ وَلَفْظُهُ فَإِذَا أَنَا بِدَابَّةٍ كَالْبَغْلِ مُضْطَرِبَ الْأُذُنَيْنِ يُقَالُ لَهُ الْبُرَاقُ وَكَانَتِ الْأَنْبِيَاءُ تَرْكَبُهُ قَبْلِي فَرَكِبْتُهُ فَذَكَرَ الْحَدِيثَ قَالَ ثُمَّ دَخَلْتُ أَنَا وَجِبْرِيلُ بَيْتَ الْمَقْدِسِ فَصليت ثمَّ أتيت بالمعراج وَفِي رِوَايَة بن إِسْحَاقَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ لَمَّا فَرَغْتُ مِمَّا كَانَ فِي بَيْتِ الْمَقْدِسِ أُتِيَ بِالْمِعْرَاجِ فَلَمْ أَرَ قَطُّ شَيْئًا كَانَ أَحْسَنَ مِنْهُ وَهُوَ الَّذِي يَمُدُّ إِلَيْهِ الْمَيِّتُ عَيْنَيْهِ إِذَا حُضِرَ فَأَصْعَدَنِي صَاحِبِي فِيهِ حَتَّى انْتَهَى بِي إِلَى بَابٍ مِنْ أَبْوَابِ السَّمَاءِ الْحَدِيثَ وَفِي رِوَايَةِ كَعْبٍ فَوُضِعَتْ لَهُ مَرْقَاةٌ مِنْ فِضَّةٍ وَمَرْقَاةٌ مِنْ ذَهَبٍ حَتَّى عَرَجَ هُوَ وَجِبْرِيلُ وَفِي رِوَايَةٍ لِأَبِي سَعِيدٍ فِي شَرَفِ الْمُصْطَفَى أَنَّهُ أُتِيَ بِالْمِعْرَاجِ مِنْ جَنَّةِ الْفِرْدَوْسِ وَأَنَّهُ مُنَضَّدٌ بِاللُّؤْلُؤِ وَعَنْ يَمِينِهِ مَلَائِكَةٌ وَعَنْ يَسَارِهِ مَلَائِكَةٌ وَأَمَّا الْمُحْتَجُّ بِالتَّعَدُّدِ فَلَا حُجَّةَ لَهُ لِاحْتِمَالِ أَنْ يَكُونَ التَّقْصِيرُ فِي ذَلِكَ الْإِسْرَاءِ مِنَ الرَّاوِي وَقَدْ حَفِظَهُ ثَابِتٌ عَنْ أَنَسٌ عَنْ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ أُتِيتُ بِالْبُرَاقِ فَوَصَفَهُ قَالَ فَرَكِبْتُهُ حَتَّى أَتَيْتُ بَيْتَ الْمَقْدِسِ فَرَبَطْتُهُ بِالْحَلْقَةِ الَّتِي تَرْبِطُ بِهَا الْأَنْبِيَاءُ ثُمَّ دَخَلْتُ الْمَسْجِدَ فَصَلَّيْتُ فِيهِ رَكْعَتَيْنِ ثُمَّ خَرَجْتُ فَجَاءَنِي جِبْرِيلُ بِإِنَاءَيْنِ فَذَكَرَ الْقِصَّةَ قَالَ ثُمَّ عُرِجَ بِي إِلَى السَّمَاءِ وَحَدِيثُ أَبِي سَعِيدٍ دَالٌّ عَلَى الِاتِّحَادِ وَقَدْ تَقَدَّمَ شَيْءٌ مِنْ هَذَا الْبَحْثِ فِي أَوَّلِ الصَّلَاةِ وَقَوْلُهُ فِي رِوَايَةِ ثَابِتٍ فَرَبَطْتُهُ بِالْحَلْقَةِ أَنْكَرَهُ حُذَيْفَةُ فَرَوَى أَحْمَدُ وَالتِّرْمِذِيُّ مِنْ حَدِيثِ حُذَيْفَةَ قَالَ تُحَدِّثُونَ أَنَّهُ رَبَطَهُ أَخَافَ أَنْ يَفِرَّ مِنْهُ وَقَدْ سَخَّرَهُ لَهُ عَالِمُ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ قَالَ الْبَيْهَقِيُّ الْمُثْبِتُ مُقَدَّمٌ عَلَى النَّافِي يَعْنِي مَنْ أَثْبَتَ رَبْطَ الْبُرَاقِ وَالصَّلَاةَ فِي بَيْتِ الْمَقْدِسِ مَعَهُ زِيَادَةُ عِلْمٍ عَلَى مَنْ نَفَى ذَلِكَ فَهُوَ أَوْلَى بِالْقَبُولِ وَوَقَعَ فِي رِوَايَةِ بُرَيْدَةَ عِنْدَ الْبَزَّارِ لَمَّا كَانَ لَيْلَةَ أُسْرِيَ بِهِ فَأَتَى جِبْرِيلُ الصَّخْرَةَ الَّتِي بِبَيْتِ الْمَقْدِسِ فَوَضَعَ إِصْبَعَهُ فِيهَا فَخَرَقَهَا فَشَدَّ بِهَا الْبُرَاقَ وَنَحْوَهُ لِلتِّرْمِذِيِّ وَأَنْكَرَ حُذَيْفَةُ أَيْضًا فِي هَذَا الْحَدِيثِ أَنَّهُ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ صَلَّى فِي بَيْتِ الْمَقْدِسِ وَاحْتَجَّ بِأَنَّهُ لَوْ صَلَّى فِيهِ لَكُتِبَ عَلَيْكُمُ الصَّلَاةُ فِيهِ كَمَا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصَّلَاةُ فِي الْبَيْتِ الْعَتِيقِ وَالْجَوَابُ عَنْهُ مَنْعُ التَّلَازُمِ فِي الصَّلَاةِ إِنْ كَانَ أَرَادَ بِقَوْلِهِ كُتِبَ عَلَيْكُمْ الْفَرْضُ وَإِنْ أَرَادَ التَّشْرِيعَ فَنَلْتَزَمُهُ وَقَدْ شَرَعَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الصَّلَاةَ فِي بَيْتِ الْمَقْدِسِ فَقَرَنَهُ بِالْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَمَسْجِدِهِ فِي شَدِّ الرِّحَالِ وَذَكَرَ فَضِيلَةَ الصَّلَاةِ فِيهِ فِي غَيْرِ مَا حَدِيثٍ وَفِي حَدِيثِ أَبِي سَعِيدٍ عِنْدَ الْبَيْهَقِيِّ حَتَّى أَتَيْتُ بَيْتَ الْمَقْدِسِ فَأَوْثَقْتُ دَابَّتِي بِالْحَلْقَةِ الَّتِي كَانَتِ الْأَنْبِيَاءُ تَرْبِطُ بِهَا وَفِيهِ فَدَخَلْتُ أَنَا وَجِبْرِيلُ بَيْتَ الْمَقْدِسِ فَصَلَّى كُلُّ وَاحِدٍ مِنَّا رَكْعَتَيْنِ وَفِي رِوَايَةِ أَبِي عُبَيْدَةَ بْنُ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ عَنْ أَبِيهِ نَحْوَهُ وَزَادَ ثُمَّ دَخَلْتُ الْمَسْجِدَ فَعَرَفْتُ النَّبِيِّينَ مِنْ بَيْنِ قَائِمٍ وَرَاكِعٍ وَسَاجِدٍ ثُمَّ أُقِيمَتِ الصَّلَاةُ فَأَمَمْتُهُمْ وَفِي رِوَايَةِ يَزِيدَ بْنِ أَبِي مَالِكٍ عَنْ أَنَسٍ عِنْد بن أَبِي حَاتِمٍ فَلَمْ أَلْبَثْ إِلَّا يَسِيرًا حَتَّى اجْتَمَعَ نَاسٌ كَثِيرٌ ثُمَّ أَذَّنَ مُؤَذِّنٌ فَأُقِيمَتِ الصَّلَاةُ فَقُمْنَا صُفُوفًا نَنْتَظِرُ مَنْ يَؤُمُّنَا فَأَخَذَ بِيَدِي جِبْرِيلُ فَقَدَّمَنِي فَصَلَّيْتُ بِهِمْ وَفِي حَدِيثِ بن
[ফাতহুল বারী ৭/২০৮]
এর সারকথা হল, তিনিও বুঝাতে চেয়েছেন এই হাদিসে যে বলা হয়েছে “তিনি বুরাকের মাধ্যমে আসমান ভ্রমণে গিয়েছিলেন” - কথাটি ঠিক নয়। অন্যান্য হাদিসের আলোকে এটি বোঝা যায়। এবং এই হাদিসে যে বলা হয়েছে, রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বাইতুল মুকাদ্দাসে নামাজ পড়েনি, সেই কথাটিও ঠিক না। এবং তিনি যে বুরাককে বাইতুল মুকাদ্দাসের মাসজিদের দরজায় বাঁধেননি বলে বলা হয়েছে, তাও অন্যান্য গ্রহনযোগ্য হাদিসের পরিপন্থী।
তাই তো তিনি অন্য আরেকটি বিষয় আলোচনা করা সময় এই হাদিসের ব্যাপারে বলেছেন যে,
أَتَى رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِالْبُرَاقِ فَلَمْ يُزَايِلْ ظَهْرَهُ هُوَ وَجِبْرِيلُ حَتَّى انْتَهَيَا إِلَى بَيْتِ الْمَقْدِسِ فَهَذَا لَمْ يُسْنِدْهُ حُذَيْفَةُ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَيحْتَمل انه قَالَ عَنِ اجْتِهَادٍ وَيَحْتَمِلُ أَنْ يَكُونَ قَوْلُهُ هُوَ وَجِبْرِيلُ يَتَعَلَّقُ بِمُرَافَقَتِهِ فِي السَّيْرِ لَا فِي الرّكُوب
[ফাতহুল বারী ৭/২০৭]
অর্থাৎ, হুজাইফা(রা.) হাদিসটিকে রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর দিকে সম্পৃক্ত করেননি। বরং এই সম্ভাবনা আছে যে এটা তিনি ইজতিহাদ করে নিজের থেকে বলেছেন। এবং এই সম্ভাবনাও আছে যে তিনি আর জিবরাঈল সফরে খুব কাছাকাছি ছিলেন, একসাথে বোরাকের পিঠে আরোহণ করেননি । (এই কাছাকাছি থাকা বোঝাতে এক সাথে বোরাকের পিঠে চড়েছেন শব্দ ব্যাবহার করা হয়েছে। )”
সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুফাসসির ইমাম ইবনে কাসির(র.)-ও একই রকম অভিমত পোষণ করেছেন।
"বাইতুল মুকাদ্দাসে সালাত পড়া ও হালকার সহিত বোরাক বাঁধাকে হযরত হুযায়ফা(রা.) অস্বীকার করিয়াছেন। কিন্তু অন্যান্য রাবীগণ তাহা রাসূলুল্লাহ(ﷺ)- হইতে বর্ণনা করিয়াছেন। আর রাসূলুল্লাহ(ﷺ) হইতে যাহা বর্ণিত হইয়াছে উহা হযরত হুযাইফা (রা.) এর কথা হইতে অধিক গ্রহণযোগ্য।"
[তাফসির ইবন কাসির, ৬ষ্ঠ খণ্ড (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), সুরা বনী ইস্রাঈলের ১নং আয়াতের তাফসির, পৃষ্ঠা ২২৫ দ্রষ্টব্য পৃষ্ঠা ২১৭-২১৮]
পরিশেষে বলব, এখানে কারো ভিন্ন মত থাকলেও যারা এই কথার প্রমাণ দিয়েছেন যে, বুরাকের মাধ্যমে শুধু বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত মি’রাজ হয়েছে এবং আসমান ভ্রমণ মিরাজে (সিঁড়িতে) করে হয়েছে - তাদেরকে অপবাদ দেবার সুযোগ নেই। যেহেতু তাঁদের কথার পক্ষে দলিল আছে এবং পূর্বযুগের গ্রহণযোগ্য আলেমদের যৌক্তিক ব্যাখ্যা আছে। কারো এখানে দ্বিমত থাকলে ভিন্ন কথা, কিন্তু অন্যদেরকে নিজের মত মানতে জোর করা উচিত নয়। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে নবী(ﷺ) এর ইসরা-মিরাজ সত্য, তা আল্লাহর বড় নিদর্শনের একটি, এই ভ্রমণ স্বশরীরে এবং বাস্তবেই হয়েছে। উম্মাহ এর উপরে একমত রয়েছে। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক কথাগুলো সঠিকভাবে মানার তাওফিক দান করুন। আমিন।
আরো পড়ুনঃ
মিরাজের রাতে নবী(ﷺ) কি আসলেই ডানাওয়ালা ঘোড়ায় করে আসমানে গিয়েছেন?
নবী (ﷺ) এর ইসরা ও মিরাজ: ইসরার ঘটনার সত্যতা কতটুকু? মাসজিদুল আকসা (বাইতুল মুকাদ্দাস) কি আসলেই সে সময়ে ছিল?
কা'বা ও আল আকসা নির্মাণের সময়ের ব্যাবধান সম্পর্কে হাদিসের তথ্য কতটুকু সঠিক?
মিরাজের রাতে নামায ৫০ থেকে ৫ ওয়াক্ত হবার দ্বারা কি আল্লাহর বাণী বা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হয়েছে?
মিরাজের যাত্রা শুরুর স্থান নিয়ে হাদিসে কি স্ববিরোধিতা আছে?