লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ সাদাত
এক.
ভূমিকা
দাসপ্রথা ইসলাম প্রবর্তিত কোন ব্যবস্থা নয়। আজ হতে প্রায় পৌনে ৪০০০ বছর আগের ব্যবলনিয় Code of Hammurabi-তেও দাসপ্রথার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। কিন্তু কেন যেন ইসলামের সমালোচনায় দাসপ্রথা একটি বেশ মুখরোচক বিষয়বস্তুতে পরিণয় হয়, আর আলোচনার ভঙ্গিটাও এমন থাকে যাতে পাঠকের কাছে মনে হতে থাকবে দাসপ্রথার মত ঘৃণ্য একটি ব্যবস্থাকে ইসলাম জন্ম দিয়েছে বা উন্নীত করেছে। অথচ আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে ইসলাম দাসপ্রথার মতো একটি বর্বর প্রথার বিরুদ্ধে যে ব্যবস্থা নিয়েছিল, ক্রীতদাসকে ভাতৃত্বের যে মর্যাদা দিয়েছিল, নেতৃত্বের যে সুযোগ দিয়েছিল, যে কোন নিরপেক্ষ বিশ্লেষক তার প্রশংসা না করে পারবে না।
দুই.
কুরআন এবং হাদিসে দাস-দাসি ও দাসপ্রথার অবস্থান
মূল আলোচনায় যাবার আগে আসুন কুরআনের কিছু আয়াত এবং কিছু হাদিস থেকে দাস-দাসি ও দাসপ্রথার ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝবার চেষ্টা করি।
কুরআনের কিছু আয়াত:
আয়াত-১: দাসমুক্তকরণ ধর্মের ঘাঁটি
অতঃপর সে ধর্মের ঘাঁটিতে প্রবেশ করেনি। আপনি জানেন, সে ঘাঁটি কি? তা হচ্ছে দাসমুক্তি অথবা দুর্ভিক্ষের দিনে অন্নদান- এতীম আত্মীয়কে অথবা ধুলি-ধুসরিত মিসকীনকে, অতঃপর তাদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া, যারা ঈমান আনে এবং পরস্পরকে উপদেশ দেয় সবরের ও উপদেশ দেয় দয়ার। [৯০:১১-১৭]
আয়াত-২: মুক্তিকামি ক্রীতদাসের জন্য সম্পদ ব্যয় করা বড় সৎকাজ
সৎকর্ম শুধু এই নয় যে, পূর্ব কিংবা পশ্চিমদিকে মুখ করবে, বরং বড় সৎকাজ হল এই যে, ঈমান আনবে আল্লাহর উপর কিয়ামত দিবসের উপর, ফেরেশতাদের উপর এবং সমস্ত নবী-রসূলগণের উপর, আর সম্পদ ব্যয় করবে তাঁরই মহব্বতে আত্নীয়-স্বজন, এতীম-মিসকীন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্যে। [২:১৭৭, প্রাসঙ্গিক অংশ]
আয়াত-৩: নিজেদের সমান হয়ে যাবার ভয়ে দাস-দাসীদের দান না করা আল্লাহর নেয়ামতকে অস্বীকার করার নামান্তর
আল্লাহ তাআলা জীবনোপকরণে তোমাদের একজনকে অন্যজনের চাইতে শ্রেষ্টত্ব দিয়েছেন। অতএব যাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দেয়া হয়েছে, তারা তাদের অধীনস্থ দাস-দাসীদেরকে স্বীয় জীবিকা থেকে এমন কিছু দেয় না, যাতে তারা এ বিষয়ে তাদের সমান হয়ে যাবে। তবে কি তারা আল্লাহর নেয়ামত অস্বীকার করে। [১৬:৭১]
আয়াত-৪: নিঃস্ব হলেও সৎকর্মপরায়ণ দাস-দাসীদের বিবাহ দিয়ে দিতে হবে
তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহহীন, তাদের বিবাহ সম্পাদন করে দাও এবং তোমাদের দাস ও দাসীদের মধ্যে যারা সৎকর্মপরায়ন, তাদেরও। তারা যদি নিঃস্ব হয়, তবে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে সচ্ছল করে দেবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। [২৪:৩২]
দাসদাসি ও দাসপ্রথা সম্পর্কিত কিছু হাদিস:
হাদিস-১: স্বাধীন ব্যক্তিকে কেনাবেচা নিষিদ্ধকরণ
আবু হুরাইরা(রা.) হতে বর্ণিত:
নবী(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, আল্লাহ[তায়ালা] বলেন:
আমি কিয়ামতের দিন তিন ব্যক্তির বিরূদ্ধে হবো,
[১] যে আমার নামে শপথ করে অত:পর বিশ্বাসঘাতকতা করে,
[২] যে কোন স্বাধীন ব্যক্তিকে (ক্রীতদাস হিসেবে) বিক্রি করে তার মূল্য ভক্ষণ করে,
[৩] যে কোন মজুরকে নিযুক্ত করে তার থেকে পরিপূর্ণ কাজ গ্রহণ করে অথচ তার পারশ্রমিক প্রদান করে না।
[সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ২২২৭; ইংরেজি অনুবাদ: ভলি ৩, বুক ৩৪, নম্বর ৪৩০; http://sunnah.com/urn/20920]
হাদিস-২: দাস-দাসির অধিকার
আল-মা’রুর বিন সুওয়াইদ(রা.) হতে বর্ণিত:
[রাসূলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)] বললেন:
তোমাদের দাসেরা তোমারদের ভাই যাদের ওপর আল্লাহ তোমাদের ক্ষমতা দিয়েছেন। কাজেই কারো নিয়ন্ত্রণে যদি তার ভাই থাকে, তবে সে যা খাবে তাকেও তাই খাওয়াবে, সে যা পরবে তাকেও তাই পরাবে। তাদের ওপর অতিরিক্ত কাজের বোঝা চাপাবে না যা তারা বহন করতে অক্ষম। যদি তা করো, তবে তাদেরকে সাহায্য কর।
[সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ২৫৪৫ (প্রাসঙ্গিক অংশ); ইংরেজি অনুবাদ: ভলি ৩, বুক ৪৬, নম্বর ৭২১; http://sunnah.com/bukhari/49#2]
হাদিস-৩: দাস-দাসিকে সম্মানজনকভাবে সম্বোধন করা
আবু হুরাইরা(রা.) হতে বর্ণিত:
নবী(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, “তোমাদের কেউ যেন [এভাবে সম্বোধন করে] না বলে, ‘তোমার প্রভুকে খাওয়াও’, ‘তোমার প্র্রভুকে অযু করাও’, ‘তোমার প্রভুকে পান করাও’; বরং বলবে, ‘আমার মুনিব (সাইয়্যিদ)’ বা ‘আমার অভিভাবক (মাওলা)’। আর তোমাদের কেউ যেন না বলে ‘আমার দাস/বান্দা (আবদ)’ বা ‘আমার দাসী/বান্দী (আমাত)’; বরং বলবে ‘আমার বালিকা (ফাতাত)’ এবং ‘আমর বালক (গুলাম)’।
[সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ২৫৫২; ইংরেজি অনুবাদ: ভলি ৩, বুক ৪৬, নম্বর ৭২৮; http://sunnah.com/urn/23920]
হাদিস-৪: দাস-দাসির ন্যায়বিচার লাভের অধিকার
সামুরাহ(রা.) হতে বর্ণিত:
রাসূলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: যদি কেউ তার ক্রীতদাসকে হত্যা করে আমরা তাঁকে হত্যা করবো, আর কেউ যদি তার ক্রীতদাসের নাক কেটে দেয়, আমরাও তার নাক কেটে দেবো।
[সুনান আবু দাউদ, হাদিস নম্বর ৪৫১৫; ইংরেজি অনুবাদ: বুক ৩৯, নম্বর ৪৫০১; http://sunnah.com/abudawud/41#22]
হাদিস-৫: দাস-দাসির ওপর অপবাদ আরোপের পরিণাম
আবু হুরাইরা (রা.) হতে বর্ণিত:
আমি আবুল ক্বসিম(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে বলতে শুনেছি, কেউ যদি তার ক্রীতদাসকে অপবাদ দেয় আর সেই ক্রীতদাস যদি সে যা বলছে তা হতে মুক্ত হয়, তবে তাকে (অপবাদ আরোপকারিকে) কিয়ামতের দিনে বেত্রাঘাত করা হতে থাকবে যতক্ষণ না সেই ক্রীতদাস তাই হয় যা সে বর্ণনা করেছে।
[সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ৬৯৪৩, ইংরেজি অনুবাদ: ভলি ৮, বুক ৮২, নম্বর ৮৪১; http://sunnah.com/urn/64520]
হাদিস-৬: দাস/দাসিকে চপেটাঘাত করার শাস্তি
মুআবিয়া বিন সুওয়াইদ হতে বর্ণিত:
আমি আমাদের এক ক্রীতদাসকে চপেটাঘাত করি, অত:পর পলায়ন করি। আমি ঠিক মধ্যাহ্নের আগে ফিরে এলাম এবং আমার পিতার পেছনে সালাত আদায় করলাম। তিনি তাকে (ঐ ক্রীতদাসকে) এবং আমাকে ডাকলেন এবং বললেন: সে তোমার প্রতি যা করেছে, তুমিও তেমন করো. সে [ক্রীতদাস] আমাকে মাফ করে দিল। তখন তিনি (আমার পিতা) বললেন, রাসূলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর জীবদ্দশায় আমরা মুকাররিনের পরিবারভুক্ত ছিলাম এবং আমাদের একজন মাত্র ক্রীতদাসি ছিল। আমাদের একজন তাকে চড় মারলো। এই খবর রাসূলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে পৌঁছল এবং তিনি বললেন: তাকে মুক্ত করে দাও। তারা (পরিবারের লোকজন) বললেন: সে ছাড়া আমাদের আর কোন সাহায্যকারি নেই। কাজেই তিনি বললেন: তাহলে তাকে কাজে নিযুক্ত করো, আর যখনই তোমরা তাকে কাজ হতে অব্যাহতি দিতে সমর্থ হও, তাকে মুক্ত করে দাও।
[সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর ৪৩৯১; ইংরেজি অনুবাদ: বুক ১৫, নম্বর ৪০৮১; http://sunnah.com/urn/240810]
হাদিস-৭: দাসিকে বিবাহে উৎসাহ প্রদান
আবু মুসা(রা.) হতে বর্ণিত:
রাসূলুল্লাহ(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:
যার একটি ক্রীসদাসি আছে আর সে তাকে শিক্ষাদীক্ষা দান করে, তার সাথে সদয় ব্যবহার করে, অত:পর তাকে মুক্ত করে বিবাহ করে সে দ্বিগুণ সওয়াব পাবে। [সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ২৫৮৪; ইংরেজি অনুবাদ: ভলি. ৩, বুক ৪৬, নম্বর ৭২০; http://sunnah.com/urn/23840]
তিন.
দাসত্বের পথ এবং ইসলাম
সর্বশেষ আসমানী কিতাব কুরআন যখন নাযিল হচ্ছিল তখন শুধু আরবে নয় বরং সারা দুনিয়ায় ক্রীতদাসপ্রথার ব্যাপক প্রচলন ছিল। স্বাধীন মানুষ দাসত্ব বরণ করত প্রধানত দুটি উপায়ে:
১. স্বাধীন ব্যক্তিকে বেচাকেনার মাধ্যমে ক্রীতদাস বানানো: এই পথটি ইসলামে চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ইসলামে কোন স্বাধীন ব্যক্তিকে কেনাবেচা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। [দ্রষ্টব্য: হাদিস-১]
২. যুদ্ধবন্দীদের ক্রীতদাস বানানো:
যুদ্ধবন্দীদের ক্রীতদাস বানানো সেই সময় একটি স্বাভাবিক রীতি ছিল। কোন মুসলিম যদি যুদ্ধে অমুসলিমদের হাতে বন্দী হতো তাকেও এই পরিণতি বরণ করতে হতো। ইসলামে যুদ্ধবন্দীদের ক্রীতদাস বানানো কোন জরুরী বিষয় নয়। ইসলামী রাষ্ট্রপ্রধান যুদ্ধবন্দীদের মুক্তিপণ নিয়ে মুক্ত করতে পারে, বিনা মুক্তিপণেও মুক্ত করতে পারে, যুদ্ধবন্দি বিনিময় করতে পারে বা প্রয়োজনবোধে অন্যান্য রাষ্ট্রসমূহের রীতি অনুসারে দাস-দাসীও বানাতে পারে। তবে কোন রাষ্ট্রের সাথে মুসলিমদের যদি এমন কোন চুক্তি থাকে যে তারা তাদের যুদ্ধবন্দীদের দাস বানাতে পারবে না, তবে সেই চুক্তি রক্ষা করা মুসলিমদের জন্য জরুরি।
২.১ কেন ইসলামে এই সুযোগ রহিত করা হলো না?
ইসলাম একটি বাস্তব ধর্ম। ইসলাম এমন কোন ধর্ম না যে কেউ এক গালে চড় মারলে আরেকটা গাল পেতে দিতে বলবে। মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে নিজ অনুসারিদের বিপদ বা অস্তিত্ব সংকটের মুখে ফেলে দেবার ধর্ম ইসলাম নয়। যেখানে মুসলিমরা অমুসলিমদের হাতে যুদ্ধবন্দী হলে তাদেরকেও দাসত্ব বরণ করতে হতো, সেখানে ইসলাম যদি একই সুযোগ না রাখতো তবে তা হতো শত্রুর হাতে এক বিরাট মারণাস্ত্র তুলে দেওয়ার নামান্তর। কাজেই যতদিন মুসলিমদের জন্য এই নিশ্চয়তা না আসে যে তাদের যুদ্ধবন্দীদের দাসদাসী বানানো হবে না, ততদিন পর্যন্ত মুসলিমদের জন্যও এই সুযোগ রহিত করার কোন যুক্তি থাকতে পারে না।
২.২ দাসত্বের এই পথ বন্ধ করার উপায়
ইসলামে দাসত্ব বরণের এই পথটি যদিও খোলা রয়েছে তবে একটি বন্ধযোগ্য পথ, যা বন্ধ করার চাবি অমুসলিম রাষ্টসমূহের হাতেই দেওয়া আছে। যে কোন অমুসলিম রাষ্ট্র মুসলিম রাষ্ট্রের সাথে এই ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ হয়ে যে ‘আমরা একে অপরের যুদ্ধবন্দীদের দাস-দাসী বানাবো না’, দাসত্বে প্রবেশের এই উন্মুক্ত পথটি বন্ধ করে দিতে পারে।
চার.
ইসলামে দাসমুক্তির পথসমূহ
১. যাকাত: ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ যাকাত। আর এই যাকাতের একটা খাত নির্ধারণ করা হয়েছে দাসমুক্তির জন্য। [দ্রষ্টব্য ৯:৬০]
২. কাফফারা: বিভিন্ন গুনাহ বা ভুলের কাফফারা নির্ধারণ করা হয়েছে দাস মুক্তকরণকে। [দ্রষ্টব্য ৫:৮৯, ৫৮:৩, ৪:৯২]
৩. লিখিত চুক্তি: ইসলাম দাস-দাসিদের তার মালিকের সাথে মুক্তির জন্য লিখিত চুক্তির অনুমতি প্রদান করেছে।
তোমাদের অধিকারভুক্তদের মধ্যে যারা মুক্তির জন্য লিখিত চুক্তি করতে চায়, তাদের সাথে তোমরা লিখিত চুক্তি কর যদি জান যে, তাদের মধ্যে কল্যাণ আছে। আল্লাহ তোমাদেরকে যে অর্থ-কড়ি দিয়েছেন, তা থেকে তাদেরকে দান কর। [২৪:৩৩, প্রাসঙ্গিক অংশ]
৪. ক্ষতিপূরণ: কোন দাস/দাসিকে চপেটাঘাত করা হলে তার শাস্তি হিসেবে উক্ত দাস/দাসিকে মুক্ত করে দিতে হবে। [দ্রষ্টব্য: হাদিস-৬]
৫. দাসমুক্তকরণে উৎসাহ প্রদান:
৫.১ দাসমুক্তিকে একটি বিরাট সওয়াবের কাজ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। [দ্রষ্টব্য: আয়াত-২]
৫.২ বিভিন্ন প্রাকৃতিক নির্দশনের সময় দাসমুক্তির নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে, যেমন; চন্দ্রগ্রহণ বা সূর্যগ্রহণ কালে। [দ্রষ্টব্য: সহিহ বুখারি, ইংরেজি অনুবাদ: ভলি.২, বুক ১৮, নম্বর ১৬৩; ভলি.৩, বুক ৪৬, নম্বর ৬৯৫; ভলি.৩, বুক ৪৬, নম্বর ৬৯৬]
৫.৩ মুক্তিকামি দাসদাসীদের অর্থকড়ি প্রদান করে সাহায্য করতে বলা হয়েছে। [দ্রষ্টব্য ২৪:৩৩]
৫.৪ মালিকের অধিক পছন্দনীয় এবং অধিক দামী দাস-দাসীর মুক্তিপ্রাপ্তির সম্ভাবনা স্বাভাবিকভাবে কম থাকে। তাই ঘোষণা করা হয়েছে যে, সর্বোত্তম দাসমুক্তি হচ্ছে সবচেয়ে দামী এবং মালিকের অধিক পছন্দনীয় দাসকে মুক্ত করা। [দ্রষ্টব্য: সহিহ বুখারি, ইংরেজি অনুবাদ: ভলি ৩, বুক ৪৬, নম্বর ৬৯৪]
৫.৫ দাস-দাসি নিজের সমান হয়ে যাবে এমন আশঙ্কায় যারা তাদের দান করা থেকে বিরত থাকে তাদের তিরস্কার করা হয়েছে। [দ্রষ্টব্য ১৬:৭১]
৫.৬ কোন ক্রীতদাস যদি একাধিক মালিকের আয়ত্বাধীনে থাকে এবং কোন একজন মালিক তার অংশ হতে ঐ দাসকে মুক্ত করে দেয় তবে উক্ত মালিকের জন্য ঐ ক্রীতদাসকে অপর অংশীদারদের হতেও মুক্ত করে দেওয়াকে জরুরী করে দেওয়া হয়েছে। মালিক তাতে অসমর্থ হলে, উক্ত ক্রীতদাসকে মুক্তি লাভের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহ করার নিমিত্তে কাজ করার অনুমতি দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। [দ্রষ্টব্য: সহিহ বুখারি, ইংরেজি অনুবাদ ভলি. ৩, বুক ৪৪, নম্বর ৬৭২]
৫.৭ দাসিকে শিক্ষাদীক্ষা দিয়ে মুক্ত করে বিবাহকারীকে দ্বিগুণ সওয়াবের অধিকারী বলা হয়েছে। [দ্রষ্টব্য: হাদিস-৭]
পাঁচ.
ইসলামে দাস/দাসী'র অধিকার ও মর্যাদা
১. ভ্রাতৃত্বের মর্যাদা:
ইসলাম দাসদের ভাইয়ের মর্যাদায় উন্নীত করেছে। [দ্রষ্টব্য: হাদিস-২]
২. নেতৃত্বের অধিকার:
ইসলামে দাসও আমীর হতে পারে এবং সেক্ষেত্রে তাকে মান্য করা সকলের জন্য জরুরি। [দ্রষ্টব্য: সহিহ বুখারি, হাদিস নম্বর ৭২২৯; ইংরেজি অনুবাদ: ভলি ৯, বুক ৮৯, নম্বর ২৫৬; http://sunnah.com/urn/67120]
৩. অন্ন-বস্ত্রের সমানাধিকার:
৩.১ মুনিব যা খাবে দাসকেও তাই খাওয়াতে হবে। [দ্রষ্টব্য: হাদিস-২]
৩.২ মুনিব যা পরবে দাসকেও তা-ই পরাতে হবে। [দ্রষ্টব্য: হাদিস-২]
৪. কাজ-কর্মে সহানুভূতি লাভের অধিকার:
৪.১ দাসের ওপর তার সামর্থ্যের অতিরিক্ত কোন কাজের বোঝা চাপানো যাবে না। [দ্রষ্টব্য: হাদিস-২]
৪.২. দাসের ওপর অতিরিক্ত কোন কাজের বোঝা দিতে হলে নিজেকেও তাতে সাহায্য করতে হবে। [দ্রষ্টব্য: হাদিস-২]
৫. সম্মান লাভের অধিকার:
৫.১ দাস-দাসীদের ‘আমার বান্দা/দাস’ ‘আমার বান্দি/দাসী’ বলা যাবে না, বলতে হবে ‘আমার বালক’, 'আমার বালিকা'। [দ্রষ্টব্য: হাদিস-৩]
৫.২ দাস-দাসীদের চপেটাঘাত পর্যন্ত করা যাবে না। তাদেরকে চপেটাঘাত করা হলে এর শাস্তিস্বরূপ তাদেরকে মুক্ত করে দিতে হবে। [দ্রষ্টব্য: হাদিস-৬]
৫.৩ দাস-দাসীদের ওপর কোন অপবাদ আরোপ করা যাবে না। [দ্রষ্টব্য: হাদিস-৫]
৬. ধর্মীয় মর্যাদা:
ইসলামে একজন দাসের ধর্মীয় মর্যাদা একজন স্বাধীন মুসলিমের চেয়ে কোন অংশে কম নয় বরং বেশি। কেননা, যদি কোন দাস তার মালিকের প্রতি সৎ এবং বিশ্বস্ত থাকে এবং তার প্রভুর (আল্লাহর) ইবাদতও যথাযথভাবে করে তবে সে দ্বিগুণ সওয়াব পাবে। [দ্রষ্টব্য: সহিহ বুখারি, ইংরেজি অনুবাদ ভলি ৩, বুক ৪৬, নম্বর ৭২২]
৭. ন্যায়বিচার লাভের অধিকার:
ইসলাম ক্রীতদাসের ন্যায়বিচার লাভের অধিকারকে নিশ্চিত করে। বিশ্বে যেখানে দাসদের ওপর চলছিল ইচ্ছামত অত্যাচার, নিপীড়ণ; দাসদের হত্যা করাও যখন ছিল আইনসিদ্ধ, সেই সময় ইসলাম ঘোষণা করে কঠোরতম সতর্কবাণী, কেউ কোন ক্রীতদাসকে হত্যা করলে তাকেও হত্যা করা হবে, কেউ কোন ক্রীতদাসের অঙ্গহানি ঘটালে তারও অঙ্গহানি ঘটানো হবে। [দ্রষ্টব্য: হাদিস-৪]
৮. জৈবিক চাহিদা পূরণের অধিকার:
ইসলাম দাস-দাসীদের জৈবিক চাহিদা পূরণের অধিকার নিশ্চিত করেছে এবং নিজের দাস-দাসীদের বিবাহ দিয়ে দেওয়াকে মুনিবের জন্য দায়িত্ব হিসেবে নির্ধারণ করেছে। [দ্রষ্টব্য ২৪:৩২]
৯. পবিত্র জীবন যাপনের অধিকার:
ইসলামে দাসীদের পতিতাবৃত্তিতে নিযুক্ত করা কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে।
তোমাদের দাসীরা নিজেদের পবিত্রতা রক্ষা করতে চাইলে তোমরা পার্থিব জীবনের সম্পদের লালসায় তাদেরকে ব্যভিচারে বাধ্য কারো না। [২৪:৩৩, প্রাসঙ্গিক অংশ]
১০. বিবাহের ক্ষেত্রে মতামত প্রদানের অধিকার:
কোন মুনিব তার ক্রীতদাসির সাথে আলোচনা না করে তাকে কারো সাথে বিবাহ দিতে পারবে না। [দ্রষ্টব্য: বুখারি, হাদিস নম্বর ৭০৫৬; ইংরেজি অনুবাদ: ভলি ৯, বুক ৮৬, নম্বর ১০০; http://sunnah.com/urn/65560]
১১. ক্রীতদাসি এবং তার শিশুর একত্রিত থাকার অধিকার:
কোন ক্রীতদাসীকে ভিন্ন কোথাও বিক্রি করে তার থেকে তার শিশুকে বিচ্ছিন্ন করার কোন অনুমতি ইসলামে নেই, এবং এই ধরণের বেচাকেনা নিষিদ্ধ। [দ্রষ্টব্য: সুনান আবু দাউদ, ইংরেজি অনুবাদ: বুক ১৪, নম্বর ২৬৯০]
ছয়.
শেষের কথা
এতক্ষণ তো দেখলেন প্রায় দেড় হাজার বছর আগে ইসলামে দাস/দাসীদের অবস্থান কোথায় ছিল। এবার মাত্র কয়েক শতক আগে পাশ্চাত্যের Slave code-এ দাস/দাসীদের আইনসিদ্ধ অবস্থান কোথায় ছিল তার একটু নমুনা দেখা যাক:
Virginia, 1705 – "If any slave resists his master…correcting such a slave, and shall happen to be killed in such correction…the master shall be free of all punishment…as if such accident never happened."
Alabama, 1833, section 31 – "Any person or persons who attempt to teach any free person of color, or slave, to spell, read, or write, shall, upon conviction thereof by indictment, be fined in a sum not less than two hundred and fifty dollars, nor more than five hundred dollars."
Alabama, 1833, section 32 – "Any free person of color who shall write for any slave a pass or free paper, on conviction thereof, shall receive for every such offense, thirty-nine lashes on the bare back, and leave the state of Alabama within thirty days thereafter…"
Alabama, 1833, section 33 – "Any slave who shall write for any other slave, any pass or free-paper, upon conviction, shall receive, on his or her back, one hundred lashes for the first offence, and seven hundred lashes for every offence thereafter…"
South Carolina, 1712–No slave shall be allowed to work for pay, or to plant corn, peas or rice; or to keep hogs, cattle, or horses; or to own or operate a boat; to buy or sell; or to wear clothes finer than 'Negro cloth'
[সূত্র এখানে: http://en.wikipedia.org/wiki/Slave_codes]
অর্থাৎ দাসদের পড়া-লেখা শেখার, মজুরি খাটার, কিছু উৎপাদন করার, গবাদি পশু রাখার, নৌকা রাখা/চালানোর, কেনা-বেচা করার, ভালো কাপড় পরিধান করার অধিকারই শুধু হরণ করা হয় নাই, মালিককে এতটুকু অধিকারও দেওয়া হয়েছিল যে যদি ক্রীতদাসকে সংশোধন করতে গিয়ে সে তাকে মেরেও ফেলে, তবু তার কোন শাস্তি হবে না, যেন এমন কোন ঘটনাই ঘটে নাই!
এরপরও যদি কেউ দাসপ্রথার কথা এলেই ইসলামের দিকে আঙুল উঁচু করতে চান, তবে বলতেই হবে, যারা চোখ বন্ধ করে ঘুমান তাদের জাগাবার সাধ্য কারো নেই।
[নোট: এই লেখায় দাস-দাসীদের সাধারণ বিষয়গুলো নিয়েই মূলত আলোচনা করা হয়েছে। অনেকক্ষেত্রেই দাস বলতে দাস-দাসী উভয়কে বুঝানো হয়েছে। লেখার কলেবর বৃদ্ধির আশঙ্কায় একটি প্রসঙ্গ ইচ্ছা করেই আলোচনায় আনা হয় নাই, সেটি হচ্ছে- দাসীদের সাথে শারীরিক সম্পর্কের ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কী? এই বিষয় নিয়ে একটি স্বতন্ত্র লেখা ইনশাআল্লাহ শীঘ্রই প্রকাশ করা হবে।]
*************************
আরো পড়ুনঃ
"ইসলামে ক্রীতদাসি ও যুদ্ধবন্দিনীর সাথে যৌন সম্পর্কের বৈধতার স্বরূপ"
"ইসলামে দাসপ্রথা"
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ সদালাপ ব্লগ
মূল আর্টিকেলঃ http://shodalap.org/bngsadat/12301/