স্ববিরোধিতার অভিযোগ: মদ খাওয়ার ব্যাপারে কুরান কি বলে ? – খাওয়া যাবে(Quran 16:67) তবে প্রার্থনা না করা অবস্থায় (Quran 4:43), খুবই খারাপ জিনিস (Quran 5:90) যার জন্য রয়েছে গুনাহ (Quran 2:219) !
জবাব: শরিয়তের নির্দেশসমূহের প্রতি গভীরভাবে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে, ইসলামী শরিয়ত কোনো বিষয়ে কোনো হুকুম প্রদান করতে গিয়ে মানুষের সামর্থ্যের প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ্য রেখেছে। যাতে মানুষ সেগুলোর অনুসরণ করতে গিয়ে বিশেষ কষ্টের সম্মুখীন না হয়।
যেমন, আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,
"আল্লাহ তা’আলা কোনো মানুষকেই এমন আদেশ দেন না, যা তার সাধ্যের বাইরে"
(সূরা বাকারা-২৮৬)
এ দয়া ও রহস্যের চাহিদা ছিলো যেন ইসলামী শরিয়তও মদ্যপানকে হারাম করার ব্যাপারে পর্যায়ক্রমিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।আলেমগণ বলেছেন, যেভাবে শিশুদেরকে মায়ের দুধ ছাড়ানো কঠিন ও কষ্টকর, তেমনিভাবে মানুষের কোনো অভ্যাসগত কাজ ছাড়ানো এর চেয়েও কষ্টকর। এজন্যে ইসলাম একান্ত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রথমে মদের মন্দ দিকগুলো মানব মনে বদ্ধমূল করেছে। অতঃপর বিশেষ বিশেষ সময় তথা নামাযের সময়ে একে নিষিদ্ধ করা হয় এবং পরবর্তীতে বিশেষ বিশেষ সময়ের পরিবর্তে কঠোরভাবে সর্বকালের জন্যে তা নিষিদ্ধ ও হারাম ঘোষণা করা হয়েছে।
(তাফসিরে মাআরেফুল কুরআন-১/৫২৪)
ইসলামের প্রথম যুগে জাহেলিয়াত আমলের সাধারণ রীতি-নীতির মত মদ্যপানও স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। অতঃপর রসূলে করীম (সাঃ)-এর হিজরতের পরেও মদীনাবাসীদের মধ্যে মদ্যপান ও জুয়ার প্রথা প্রচলিত ছিল। সাধারণ মানুষ এ দুটি বস্তুর শুধু বাহ্যিক উপকারিতার প্রতি লক্ষ্য করেই এতে মত্ত ছিল। কিন্তু এগুলোর অন্তর্নিহিত অকল্যাণ সম্পর্কে তাদের কোন ধারণাই ছিল না। মদীনায় পৌছার পর কতিপয় সাহাবী এসব বিষয়ের অকল্যাণগুলো অনুভব করলেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে হযরত মা’আয ইবনে জাবাল(রা)এবং কিছুসংখ্যক আনসার রসূলে- করীম (সাঃ)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে বললেনঃ “ মদ ও জুয়া মানুষের বুদ্ধি-বিবেচনাকে পর্যন্ত বিলুপ্ত করে ফেলে এবং ধনসম্পদও ধ্বংস করে দেয়। এ সম্পর্কে আপনার নির্দেশ কি?” এ প্রশ্নের উত্তরে সূরা বাকারায় নিম্নোক্ত আয়াতটি অবতীর্ণ হয়।
“তারা তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলে দাও, এতদুভয়ের মধ্যে রয়েছে মহাপাপ। আর মানুষের জন্য উপকারিতাও রয়েছে, তবে এ- গুলোর পাপ উপকারিতা অপেক্ষা অনেক বড়”।
(বাকারা-২১৯)
আয়াতটিতে বলা হয়েছে যে, মদ ও জুয়াতে যদিও বাহ্যিক দৃষ্টিতে কিছু উপকারিতা পরিলক্ষিত হয়, কিন্তু দু’টির মাধ্যমেই অনেক বড় বড় পাপের পথ উন্মুক্ত হয়; যা এর উপকারিতার তুলনায় অনেক বড় ও ক্ষতিকর। যেমন, মদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বড় দোষ হচ্ছে এই যে, এতে মানুষের সবচাইতে বড় গুণ, বুদ্ধি- বিবেচনা বিলুপ্ত হয়ে যায়। কারণ, বুদ্ধি এমন একটি গুণ যা মানুষের মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। পক্ষান্তরে যখন তা থাকে না, তখন প্রতিটি মন্দ কাজের পথই সুগম হয়ে যায়।এ আয়াতে পরিষ্কার ভাষায় মদকে হারাম করা হয়নি, কিন্তু এর অনিষ্ট ও অকল্যাণের দিকগুলোকে তুলে ধরে বলা হয়েছে যে,
মদ্যপানের দরুন মানুষ অনেক মন্দ কাজে লিপ্ত হয়ে যেতে পারে।
মদের ব্যাপারে পরবর্তী আয়াতটি নাযিল হওয়ার ঘটনা নিম্নরূপঃএকদিন হযরত আবদুর রহমান ইবনে আওফ(রাঃ) সাহাবিগণের মধ্যে হতে তাঁর কয়েকজন বন্ধুকে নিমন্ত্রণ করেন। আহারাদির পর যথারীতি মদ্যপানের ব্যবস্থা করা হলো এবং সবাই মদ্যপান করলেন। এমতাবস্থায় মাগরিবের নামাযের সময় হলে সবাই নামাযে দাঁড়ালেন এবং একজনকে ইমামতি করতে এগিয়ে দিলেন। নেশাগ্রস্থ অবস্থায় যখন তিনি সুরা আল-কাফিরূন ভুল পড়তে লাগলেন, তখনই মদ্যপান থেকে পুরোপুরি বিরত রাখার জন্যে দ্বিতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হল।....
(তিরমিযী হা/৩০২৬ দ্রষ্টব্য।)
এরশাদ হলঃ “হে ঈমানদারগণ! নেশাগ্রস্থ অবস্থায় তোমরা নামাযের কাছেও যেওনা।”
(সূরা নিসা:৪৩)
এই আয়াতের মাধ্যমে নামাযের সময় মদ্যপানকে হারাম করা হয়েছে। তবে অন্যান্য সময় তা পান করার অনুমতি তখনও পর্যন্ত বহাল রয়ে গেল।
মদ্যপান সম্পূর্ণরূপে হারাম হওয়ার ঘটনাটি নিম্নরূপঃ হযরত আতবান ইবনে মালেক(রা) কয়েকজন সাহাবীকে নিমন্ত্রণ করেন, যাদের মধ্যে সা’দ ইবনে আবী ওয়াক্কাসও(রা) উপস্থিত ছিলেন। খাওয়া-দাওয়ার পর মদ্যপান করার প্রতিযোগিতা এবং নিজেদের বংশ ও পূর্ব-পুরুষদের অহংকারমূলক বর্ণনা আরম্ভ হয়। সা’দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস (রা) একটি কবিতা আবৃত্তি করলেন যাতে আনসারদের দোষারোপ করে নিজেদের প্রশংসাকীর্তন করা হয়। ফলে একজন আনসার যুবক রাগাম্বিত হয়ে উটের গন্ডদেশের একটি হাড় সা’দ এর মাথায় ছুঁড়ে মারেন। এতে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। পরে সা’দ রসূল (সাঃ)-এর দরবারে উপস্থিত হয়ে উক্ত আনসার যুবকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। তখন হুযূর (সাঃ) দোয়া করলেনঃ"হে আল্লাহ! শরাব সম্পর্কে আমাদের একটি পরিষ্কার বর্ণনা ও বিধান দান করুন।"...( মুসলিম হা/১৭৪৮; বায়হাক্বী ৮/২৮৫ হাদীস দ্রষ্টব্য)
তখনই সূরা মায়েদার উদ্ধৃত মদ ও মদ্যপানের বিধান সম্পর্কিত বিস্তারিত আয়াতটি অবতীর্ণ হয়।
এতে মদকে সম্পূর্ণরূপে হারাম করা হয়েছে।
“হে ঈমানদারগণ! নিশ্চিত জেনো, মদ, জুয়া, মূর্তি এবং তীর নিক্ষেপ এসবগুলোই নিকৃষ্ট শয়তানী কাজ। কাজেই এসব থেকে সম্পূর্ণভাবে সরে থাক, যাতে তোমরা মুক্তিলাভ ও কল্যাণ পেতে পার। মদ ও জুয়ার দ্বারা তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক শত্রুতা ও তিক্ততা সৃষ্টি হয়ে থাকে; আর আল্লাহর যিকর ও নামায থেকে তোমাদেরকে বিরত রাখাই হল শয়তানের একান্ত কাম্য, তবুও কি তোমরা তা থেকে বিরত থাকবে না?"
(আল মায়িদাহ:৯০-৯১)
জাবের (রাযি.) থেকে বর্ণিত:"এক ব্যক্তি ইয়ামান থেকে (মদিনায়) আগমন করলো এবং সে নবী করীম (সা.)-কে ঐ মদের বিধান সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলো, যা তাদের দেশে পান করা হয়। তাদের এ মদটি ভুট্টা থেকে বানানো হতো। তারা এটিকে ‘মিযর’ বলে। এর উত্তরে রাসূলুল্লাহ (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, এর দ্বারা কি নেশা সৃষ্টি হয়? লোকটি বললো, হ্যাঁ, তখন রাসূল (সা.) বললেন, নেশা সৃষ্টি করে এমন প্রত্যেক জিনিসই হারাম। আর আল্লাহর প্রতিজ্ঞা হলো,যে ব্যক্তি নেশা সৃষ্টিকারী জিনিস পান করবে, তাকে আল্লাহপাক ‘তীনাতুল খাবাল’ পান করাবেন। উপস্থিত লোকেরা জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! ‘তীনাতুল খাবাল’ জিনিসটি কি? রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, এটি জাহান্নামীদের গায়ের ঘাম অথবা রক্ত ও পুঁজ।"
(সহীহ মুসলিম -২/১৬৭)
অতএব আমরা দেখলাম যে, আল কুরআনে ধাপে ধাপে মদপান নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রথমে মদের ক্ষতি সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে, এরপর নামাযের সময় মদ্যপানকে হারাম করা হয়েছে এবং সব শেষে চিরতরে হারাম করা হয়েছে। এর মাঝে স্ববিরোধিতার লেশমাত্রও নেই। এমনকি চিরতরে হারাম হয়ে যাবার আগেও মদের ব্যাপারে যে আয়াতগুলো নাযিল হয়েছিল, সেগুলোও এখনো প্রযোজ্য আছে। কেননা মদের ক্ষতিকর প্রভাব, নেশাগ্রস্থ অবস্থায় নামাযে যাবার নিষেধাজ্ঞা – এগুলো তো চিরতরে মদ হারাম হয়ে যাবার বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। এ থেকে 'স্ববিরোধিতা' খোঁজা নিতান্তই মূর্খতার পরিচায়ক।