Pray for the world economy

ইসরা-মিরাজের হাদিসসমূহে নবী ﷺ এর নিকট পেশকৃত দুধ, মদ ইত্যাদির পাত্রের সংখ্যা ও স্থান নিয়ে কি পরস্পরবিরোধিতা আছে?

 

ইসলামবিরোধীরা অভিযোগ করে, নবী এর ইসরা-মিরাজ সংক্রান্ত যেসব হাদিস আছে, সেগুলোতে নবী এর নিকট বিভিন্ন স্থানে দুধ, মদ, পানি, মধু ইত্যাদির পাত্র পেশ করার উল্লেখ আছে। তাদের দাবিমতে এই হাদিসগুলো নাকি পরস্পরবিরোধী।

 

এই অভিযোগের জবাবে আমরা এই সংক্রান্ত সকল হাদিস এক এক করে দেখব।

 

ক) আল আকসায় যাবার পরে, আসমানে গমনের পূর্বে যেসব পানীয় পেশ করা হয়েছিলঃ

 

১। পানি, মদ ও দুধঃ

এই সংক্রান্ত বর্ণনা আছে তাফসির ইবন কাসিরে

 

“… এইভাবে বাইতুল মুকাদ্দাস পর্যন্ত পৌছিয়া গেলেন। তথায় তাহার সম্মুখে মদ, পানি ও দুধ পেশ করা হইল। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা) দুধ গ্রহণ করিলেন। তখন জিবরীল (আ) বলিলেন, আপনি ফিতরাতকে লাভ করিয়াছেন (সঠিক পথাবলম্বন করিয়াছেন)। যদি আপনি পানি পান করিতেন তবে আপনার উম্মত ডুবিয়া মরিত। আর যদি আপনি মদ পান করিতেন তবে আপনার উম্মত ভ্রান্ত হইয়া পড়িত আর আপনিও ভ্রান্ত হইতেন। অতঃপর হযরত আদম (আ) হইতে রাসূলুল্লাহ (সা) পর্যন্ত সমস্ত আম্বিয়া কিরামকে তথায় প্রেরণ করা হইল এবং রাসূলুল্লাহ (সা) সেই রাত্রে তাহাদের সকলের ইমামত করিলেন। ...[1]

 

এই বর্ণনার বিশুদ্ধতা সম্পর্কে প্রখ্যাত মুহাদ্দিস শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানী(র.) বলেনঃ 

 

أَخْرَجَهُ ابْنُ جَرِيرٍ ١٥/٦ وَالْبَيْهَقِيُّ فِي "الدَّلَائِلِ" كَمَا فِي "تَفْسِيرِ ابْنِ كَثِيرٍ" ٣/٥ وَقَالَ: "وَفِي بَعْضِ أَلْفَاظِهِ نَكَارَةٌ وَغَرَابَةٌ".

قُلْتُ: وَعِلَّتُهُ عَبْدُ الرَّحْمَنِ بْنُ هَاشِمٍ هٰذَا، فَإِنِّي لَمْ أَجِدْ مَنْ تَرْجَمَهُ.

অর্থঃ “এটি ইবন জারীর(র.) {১৫/৬} এবং বাইহাকী তাঁর দালায়েল’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন, যেমনটি তাফসির ইবন কাসির (৩/৫)-এ এসেছে। তিনি বলেছেনঃ ‘এর কিছু শব্দবিন্যাসে নাকারাত (অস্বাভাবিকতা) ও গারাবাত আছে।’

আমি [নাসিরুদ্দিন আলবানী] বলিঃ এর দুর্বলতার কারণ হলো এই আবদুর রহমান ইবন হাশিম (হাদিসের বর্ণনাকারী) কারণ আমি তার কোনো জীবনীসংক্রান্ত তথ্য খুঁজে পাইনি (অর্থাৎ তিনি মাজহুল বা অজ্ঞাত রাবী) [2]

 

এই সংক্রান্ত আরো একটি বর্ণনা রয়েছে। --

 

 يَرْوِيهِ ابْنُ لَهِيعَةَ بِإِسْنَادِهِ عَنْهُ، قَالَ: لَمَّا عُرِضَ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ـ لَيْلَةَ أُسْرِيَ بِهِ ـ الْمَاءُ ثُمَّ الْخَمْرُ ثُمَّ اللَّبَنُ، أَخَذَ اللَّبَنَ، فَقَالَ لَهُ جِبْرِيلُ: أَصَبْتَ الْفِطْرَةَ، وَبِهِ غُذِّيَتْ كُلُّ دَابَّةٍ، وَلَوْ أَخَذْتَ الْخَمْرَ لَغَوَيْتَ وَغَوَتْ أُمَّتُكَ، وَكُنْتَ مِنْ أَهْلِ هَذِهِ. وَأَشَارَ [بِيَدِهِ] إِلَى الْوَادِيِ الَّذِي فِيهِ، وَفِي رِوَايَةٍ: الَّذِي يُقَالُ لَهُ: وَادِي جَهَنَّمَ. "فَنَظَرْتُ إِلَيْهِ، فَإِذَا هُوَ نَارٌ تَلْتَهِبُ".

أَخْرَجَهُ ابْنُ مَرْدُوَيْهِ، وَالسِّيَاقُ لَهُ، وَالطَّبَرَانِيُّ فِي "الْكَبِيرِ"، وَالرِّوَايَةُ الْأُخْرَى لَهُ، وَعَزَاهُ إِلَيْهِمَا السُّيُوطِيُّ فِي "الْخَصَائِصِ" ١/٣٩٦ ـ ٣٩٧، وَسَكَتَ عَنْهُ كَعَادَتِهِ.

وَأَعَلَّهُ الْهَيْثَمِيُّ ١/٧٨ بِابْنِ لَهِيعَةَ مُشِيرًا إِلَى ضَعْفِهِ، وَذَلِكَ لِأَنَّهُ مَعْرُوفٌ بِسُوءِ حِفْظِهِ.

অর্থঃ “এটি ইবন লাহি’আহ তার সনদে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেনঃ ইসরার রাতে যখন রাসুলুল্লাহ –এর সামনে পানি, তারপর মদ, তারপর দুধ উপস্থিত করা হলো, তখন তিনি দুধ গ্রহণ করলেন। তখন জিবরাঈল (আ.) তাঁকে বললেনঃ "আপনি ফিতরাহকে (স্বাভাবিক সঠিক পথকে) নির্বাচন করেছেন, এবং এটির (দুধের) মাধ্যমেই প্রত্যেক প্রাণী পুষ্টি লাভ করে। আর যদি আপনি মদ গ্রহণ করতেন, তবে আপনি পথভ্রষ্ট হতেন এবং আপনার উম্মতও পথভ্রষ্ট হতো; এবং আপনি এই দলের অন্তর্ভুক্ত হতেন।"

এবং তিনি [হাতে] ইশারা করে সেই উপত্যকার দিকে দেখালেন, যেটিতে তা ছিল। অন্য একটি বর্ণনায় আছেঃ “যেটিকে বলা হয় ওয়াদী জাহান্নাম।” আমি [নবী ] সেখানে তাকালাম, দেখি সেটি জ্বলন্ত আগুন।”

 

ইবনু মারদাওয়াইহ(র.) এটি বর্ণনা করেছেন এবং শব্দচয়ন তাঁরই। তাবারানী(র.)ও ‘আল-কাবির’-এ এটি বর্ণনা করেছেন এবং অন্য বর্ণনাটি তাঁর। সুয়ুতী(র.) ‘আল-খাসাইস’-এ (১/৩৯৬-৩৯৭) এই বর্ণনাটিকে তাঁদের দুজনের দিকেই সম্পর্কিত করেছেন এবং তাঁর অভ্যাস অনুযায়ী এ বিষয়ে নীরবতা পালন করেছেন (হাদিসটির মান সম্পর্কে মন্তব্য করেননি)।

আর হাইসামী(র.) {১/৭৮} এই হাদিসটিকে ইবনু লাহি’আহর কারণে দুর্বল (মা'লুল) বলেছেন এবং তাঁর দুর্বলতার দিকে ইশারা করেছেন। কারণ ইবনু ইবনু লাহি’আহ দুর্বল স্মৃতিশক্তির জন্য পরিচিত।[3]

 

এ সংক্রান্ত প্রায় একই তথ্য নিয়ে আরো ১টি হাদিস আছে তাফসির ইবন কাসিরে। যেখানে উল্লেখ আছে, নবী আল আকসায় পৌঁছানোর পরে ও আসমানে গমনের পূর্বে তাঁর নিকট ৩টি পাত্র পেশ করা হয়েছিল। যেগুলো ছিল পানি, মদ ও দুধের পাত্র। নবী পানির পাত্র থেকে সামান্য পান করেন এবং দুধের পাত্র থেকে পূর্ণ তৃপ্তি সহকারে পান করেন। কিন্তু মদের পাত্র থেকে পান করেন না। [4]

 

ইমাম ইবন কাসির(র.) উল্লেখ করেছেন, এই বর্ণনায় আবু জাফর রাযী নামে যঈফ বা দুর্বল রাবী আছে। তাছাড়া বর্ণনার ভাষ্যের মাঝে নাকারত ও গারাবত আছে। [5] অতএব এই বর্ণনা বিশুদ্ধ নয়।

 

অতএব এই সংক্রান্ত একটি বর্ণনাও বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয়।

 

২। মধু, মদ ও দুধঃ

এ সংক্রান্ত একটি বর্ণনা বিভিন্ন গ্রন্থে রয়েছে।

 

صَلَّيْتُ لَيْلَةَ أُسْرِيَ بِي فِي مُقَدَّمِ الْمَسْجِدِ، ثُمَّ دَخَلْتُ إِلَى الصَّخْرَةِ، فَإِذَا أَنَا بِمَلَكٍ قَائِمٌ، مَعَهُ آنِيَةٌ ثَلَاثٌ، فَقَالَ: يَا مُحَمَّدُ - وَأَشَارَ إِلَيْهِ بِالْآنِيَةِ - قَالَ: فَتَنَاوَلْتُ الْعَسَلَ، فَشَرِبْتُ مِنْهُ قَلِيلًا، ثُمَّ تَنَاوَلْتُ الْآخَرَ، فَشَرِبْتُ مِنْهُ حَتَّى رَوِيتُ، فَإِذَا هُوَ لَبَنٌ، فَقَالَ: اشْرَبْ مِنَ الْآخَرِ. فَإِذَا هُوَ خَمْرٌ، قُلْتُ: قَدْ رَوِيتُ. قَالَ: أَمَا إِنَّكَ لَوْ شَرِبْتَ مِنْ هَذَا لَمْ تَجْتَمِعْ أُمَّتُكَ عَلَى الْفِطْرَةِ أَبَدًا. ثُمَّ انْطَلَقَ بِي إِلَى السَّمَاءِ، وَفُرِضَتْ عَلَيَّ الصَّلَاةُ، ثُمَّ رَجَعْتُ إِلَى خَدِيجَةَ، وَمَا تَحَوَّلَتْ عَنْ جَانِبِهَا الْآخَرِ».

অর্থঃ “ইসরার রাতে আমি মসজিদের সামনে অংশে সালাত আদায় করলাম। তারপর আমি শিলাখণ্ড [বর্তমান কুব্বাতুস সাখরা বা Dome of the Rock এর স্থানে - অনুবাদক] এর নিকট প্রবেশ করলাম। হঠাৎ দেখি—একজন ফেরেশতা দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁর সাথে তিনটি পাত্র। তিনি বললেনঃ ‘হে মুহাম্মদ’ (), এবং পাত্রগুলোর দিকে ইশারা করলেন।

আমি মধুর পাত্রটি নিলাম এবং তা থেকে অল্প পান করলাম। এরপর আরেকটি পাত্র নিলাম এবং তা থেকে পান করলাম যতক্ষণ না সম্পূর্ণ তৃপ্ত হলাম—দেখি সেটি দুধ। তিনি বললেনঃ ‘আরেকটি থেকেও পান করুন।’ দেখি সেটি মদের পাত্র। আমি বললামঃ ‘আমি তো তৃপ্ত হয়েছি।’

তিনি বললেনঃ ‘যদি আপনি এটি (মদ) পান করতেন, তবে আপনার উম্মত কখনোই ফিতরাহর (স্বাভাবিক প্রকৃতি বা সত্য ধর্মের) উপর একত্র হতে পারত না।’

এরপর তিনি আমাকে আসমানে নিয়ে গেলেন, এবং আমার উপর সালাত ফরজ করা হলো। তারপর আমি খাদিজার কাছে ফিরে এলাম—আর তিনি তাঁর আগের পাশ থেকেই নড়েননি (অর্থাৎ, খুব অল্প সময় অতিবাহিত হয়েছিল)।[6]

 

আমরা হাদিসের শেষাংশে দেখতে পাচ্ছি যে খাদিজা(রা.) এর উল্লেখ আছে। অথচ এটি প্রমাণিত যে, ইসরা-মিরাজের ঘটনার আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। এটি এই হাদিসের মাতানগত সমস্যা নির্দেশ করে। এ কারণেই ইবন কাসির(র.) হাদিসটি বর্ণনা করে উল্লেখ করেছেনঃ هَذَا حَدِيثٌ غَرِيبٌ جِدًّا অর্থাৎ এটি অত্যন্ত গারাবাতবিশিষ্ট বা অদ্ভুত হাদিস।

 

এই হাদিসের সনদের মাঝেও দুর্বলতা আছে। এই হাদিসের বর্ণনাকারী ঈসা ইবন সিনান সম্পর্কে ইমাম ইবন আদি(র.) উল্লেখ করেছেন

 

حَدَّثَنَا أَحْمَدُ بْنُ عَلِيِّ بْنِ بَحْرٍ، قَالَ: حَدَّثَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ الدَّوْرَقِيِّ قَالَ يَحْيَى بْنُ مَعِينٍ قَالَ عِيسَى بْنُ سِنَانٍ كُوفِيٌّ ضَعِيفُ الْحَدِيثِ.

حَدَّثَنَا ابْنُ حَمَّادٍ، حَدَّثَنَا عَبَّاسٌ، قَالَ: سَمِعْتُ يَحْيَى يَقُولُ: عِيسَى بْنُ سِنَانٍ ضَعِيفٌ.

অর্থঃ “আহমাদ ইবন আলী ইবনে বাহর আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেনঃ আবদুল্লাহ বিন দাওরাকী আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেনঃ ইয়াহইয়া ইবন মাঈন বলেছেন, ঈসা ইবন সিনান কুফী হাদিসের ক্ষেত্রে দুর্বল।

ইবন হাম্মাদ আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন, আব্বাস আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেনঃ আমি ইয়াহইয়াকে [ইবন মাঈন] বলতে শুনেছিঃ ঈসা ইবন সিনান দুর্বল।[7]

 

এ ছাড়া ইমাম ইবনুল জাওযি(র.) এর ‘আদ-দ্বুআফা ওয়াল মাতরুকুন’ গ্রন্থেও ঈসা ইবন সিনানকে দুর্বল রাবী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। [8]

 

অতএব এই হাদিস বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয়।

 

৩। মদ ও দুধঃ 

 

حَتَّى أَتَيْتُ بَيْتَ الْمَقْدِسِ - قَالَ - فَرَبَطْتُهُ بِالْحَلْقَةِ الَّتِي يَرْبِطُ بِهِ الأَنْبِيَاءُ - قَالَ - ثُمَّ دَخَلْتُ الْمَسْجِدَ فَصَلَّيْتُ فِيهِ رَكْعَتَيْنِ ثُمَّ خَرَجْتُ فَجَاءَنِي جِبْرِيلُ - عَلَيْهِ السَّلاَمُ - بِإِنَاءٍ مِنْ خَمْرٍ وَإِنَاءٍ مِنْ لَبَنٍ فَاخْتَرْتُ اللَّبَنَ فَقَالَ جِبْرِيلُ صلى الله عليه وسلم اخْتَرْتَ الْفِطْرَةَ ‏.‏ ثُمَّ عَرَجَ بِنَا إِلَى السَّمَاءِ

 অর্থঃ “…এবং বায়তুল মাকদাস পর্যন্ত এসে পৌছলাম। তারপর অন্যান্য আম্বিয়ায়ে কিরাম তাদের বাহনগুলো যে রজ্জুতে বাধতেন, আমি সে রজ্জুতে আমার বাহনটিও বাধলাম। তারপর মসজিদে প্রবেশ করলাম ও দু-রাকাত সালাত (নামায/নামাজ) আদায় করে বের হলাম।

জিবরীল (আলাইহিস সালাম) একটি শরাবের পাত্র এবং একটি দুধের পাত্র নিয়ে আমার কাছে এলেন। আমি দুধ গ্রহণ করলাম। জিবরীল (আলাইহিস সালাম) আমাকে বললেন, আপনি ফিতরতকেই গ্রহণ করলেন। তারপর জিবরীল (আলাইহিস সালাম) আমাকে নিয়ে ঊর্ধ্বলোকে গেলেন এবং আসমান পর্যন্ত পৌছে দার খুলতে বললেন।[9]

 

এই সংক্রান্ত হাদিস সহীহ মুসলিমে বর্ণিত এবং বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত।  

 

৪। দুধ ও মধুঃ

এই সংক্রান্ত বর্ণনা আছে তাফসির ইবন কাসিরে

 

“… এবং আমরা মসজিদের সেই দরজা দিয়া মসজিদে প্রবেশ করিলাম যেই দরজা দিয়া চন্দ্র ও সূর্যের আলো প্রবেশ করে। অতঃপর আমি মসজিদে সালাত পড়িলাম। তখন আমার অতিশয় পিপাসা অনুভূত হইল। অতএব আমাকে দুইটি পান পাত্র পেশ করা হইল। একটিতে ছিল দুধ এবং অপরটিতে ছিল মধু। আল্লাহ সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের তাওফীক দান করিলেন। দুধ গ্রহণ করিলাম এবং পূর্ণ তৃপ্তিসহকারে দুধ পান করিলাম। [10]

 

এই বর্ণনার বিশুদ্ধতা সম্পর্কে শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানী(র.) বলেনঃ

 

 أَعَلَّهُ الهَيْثَمِيُّ فَقَالَ ١/٧٤:

"رَوَاهُ البَزَّارُ وَالطَّبَرَانِيُّ فِي الكَبِيرِ، وَفِيهِ إِسْحَاقُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ بْنِ العَلَاءِ، وَثَّقَهُ يَحْيَى بْنُ مَعِينٍ، وَضَعَّفَهُ النَّسَائِيُّ."

وَقَالَ الحَافِظُ فِي التَّقْرِيبِ: "صَدُوقٌ يَهِمُ كَثِيرًا، وَأَطْلَقَ مُحَمَّدُ بْنُ عَوْفٍ أَنَّهُ يَكْذِبُ."

অর্থঃ “হাইসামী(র.) এ হাদিসটিকে দুর্বল বলে আখ্যায়িত করেছেন, তিনি বলেছেন (১/৭৪):

"এটি বাজ্জার(র.) ও তাবারানী(র.) 'আল-কাবির'-এ বর্ণনা করেছেন এবং এর সনদে রয়েছেন ইসহাক ইবন ইব্রাহিম ইবনিল আ'লা। ইয়াহইয়া ইবন মাঈন(র.) তাকে ছিকাহ বলেছেন, কিন্তু নাসাঈ(র.) তাকে দুর্বল বলেছেন"

হাফিয [ইবন হাজার(র.)] "আত-তাকরীব"-এ বলেছেনঃ "তিনি সত্যবাদী (সাদুক) কিন্তু অনেক ভুল করেন, এবং মুহাম্মাদ ইবনে আউফ স্পষ্টভাবে বলেছেন যে তিনি মিথ্যা হাদিস বর্ণনা করেন।" [11]

 

অতএব এই সংক্রান্ত হাদিস বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয়

 

খ) আসমানে গমন বা মিরাজের পরে যেসব পানীয় পেশ করা হয়েছিলঃ

 

৫। মদ ও দুধঃ (বায়তুল মামুরে) 

 

ثُمَّ رُفِعَ لِيَ الْبَيْتُ الْمَعْمُورُ فَقُلْتُ يَا جِبْرِيلُ مَا هَذَا قَالَ هَذَا الْبَيْتُ الْمَعْمُورُ يَدْخُلُهُ كُلَّ يَوْمٍ سَبْعُونَ أَلْفَ مَلَكٍ إِذَا خَرَجُوا مِنْهُ لَمْ يَعُودُوا فِيهِ آخِرُ مَا عَلَيْهِمْ ‏.‏ ثُمَّ أُتِيتُ بِإِنَاءَيْنِ أَحَدُهُمَا خَمْرٌ وَالآخَرُ لَبَنٌ فَعُرِضَا عَلَىَّ فَاخْتَرْتُ اللَّبَنَ فَقِيلَ أَصَبْتَ أَصَابَ اللَّهُ بِكَ أُمَّتُكَ عَلَى الْفِطْرَةِ ‏.‏

অর্থঃ “… এরপর আমাকে বায়তুল মামুরে উঠান হল। বললামঃ হে জিবরীল! এ কি? তিনি বললেন, এ হচ্ছে ’বায়তুল মামুর’। প্রত্যহ এতে সত্তর হাজার ফেরেশতা (তাওয়াফের জন্য) প্রবেশ করে। তারা একবার তাওয়াফ সেরে বের হলে কখনও আর ফের তাওয়াফের সুযোগ হয় না তাদের। তারপর আমার সম্মুখে দূটি পাত্র পেশ করা হলো, একটি শরাবের, অপরটি দুধের। আমি দুধের পাত্রটি গ্রহণ করলাম। তিনি আমাকে বললেন, আপনি ঠিক করেছেন। আল্লাহ আপনার উম্মাতকেও আপনার ওসীলায় ফিতরাত এর উপর কায়েম রাখুন।[12]

 

এই সংক্রান্ত হাদিস সহীহ মুসলিমে বর্ণিত এবং বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত। 

 

৬। মধু, মদ ও দুধঃ (সিদরাতুল মুনতাহায়)

 

 عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم رُفِعْتُ إِلٰى السِّدْرَةِ فَإِذَا أَرْبَعَةُ أَنْهَارٍ نَهَرَانِ ظَاهِرَانِ وَنَهَرَانِ بَاطِنَانِ فَأَمَّا الظَّاهِرَانِ النِّيلُ وَالْفُرَاتُ وَأَمَّا الْبَاطِنَانِ فَنَهَرَانِ فِي الْجَنَّةِ فَأُتِيتُ بِثَلاَثَةِ أَقْدَاحٍ قَدَحٌ فِيهِ لَبَنٌ وَقَدَحٌ فِيهِ عَسَلٌ وَقَدَحٌ فِيهِ خَمْرٌ فَأَخَذْتُ الَّذِي فِيهِ اللَّبَنُ فَشَرِبْتُ فَقِيلَ لِي أَصَبْتَ الْفِطْرَةَ أَنْتَ وَأُمَّتُكَ.

قَالَ هِشَامٌ وَسَعِيدٌ وَهَمَّامٌ عَنْ قَتَادَةَ عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ عَنْ مَالِكِ بْنِ صَعْصَعَةَ عَنْ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فِي الأَنْهَارِ نَحْوَه“ وَلَمْ يَذْكُرُوا ثَلاَثَةَ أَقْدَاحٍ.

অর্থঃ “আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ বলেছেনঃ আমার সম্মুখে ’সিদরাতুল মুনতাহা’ তুলে ধরা হল। তখন দেখলাম চারটি নহর। দু’টি নহর হল যাহেরী, আর দু’টি নহর হল বাতেনী। যাহেরী দু’টি হল, নীল ও ফোরাত। আর বাতেনী দু’টি হল, জান্নাতের দু’টি নহর। আমার সম্মুখে তিনটি পেয়ালা তুলে ধরা হল, একটি পেয়ালায় আছে দুধ, একটি পেয়ালায় আছে মধু আর একটিতে শরাব। আমি দুধের পেয়ালাটি গ্রহণ করলাম এবং পান করলাম। তখন আমাকে বলা হল, আপনি এবং আপনার উম্মাত স্বভাবজাত বস্ত্ত গ্রহণ করেছেন। তবে তাঁরা তিনটি পেয়ালার কথা উল্লেখ করেননি।[13]

 

এই সংক্রান্ত হাদিস সহীহ বুখারীতে বর্ণিত এবং বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত। 

 

গ) মিরাজ থেকে ফিরে আল আকসায় আসার পর যেসব পানীয় পেশ করা হয়েছিলঃ

 

৭। দুধ ও মধুঃ

এই সংক্রান্ত বর্ণনা আছে তাফসির ইবন কাসিরে


“…
তাহাদের প্রত্যেকেই নবী করীম (সা) কে প্রথম সালাম করিয়াছেন। রাসূলুল্লাহ (সা) জিজ্ঞাসা করিলেন হে জিবরীল ইনি কে? তিনি বলিলেন, তিনি তোমার পিতা হযরত ইবরাহীম (আ)। রাসূলুল্লাহ (সা) দোযখের মধ্যে এমন কিছু লোকও দেখিয়াছেন, যাহারা মানুষের গোস্ত ভক্ষণ করিতেছিল। তিনি একজন অত্যধিক লাল বর্ণের নীলা চক্ষু বিশিষ্ট লোক দেখিতে পাইলেন। জিজ্ঞাসা করিলেন, লোকটি কে? তিনি বলিলেন হযরত সালেহ (আ) এর উটনী হত্যাকারী ব্যক্তি। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা) মসজিদে আকসা আগমন করিলে সালাত পড়িতে দাঁড়াইয়া গেলেন। তখন অন্যান্য সকল আম্বিয়ায়ে কিরামও তাহাদের সহিত সালাতে দণ্ডায়মান হইলেন। সালাত হইতে অবসর হইবার পর তাহার নিকট দুইটি পেয়ালা পেশ করা হইল। একটি ডান দিক হইতে অপরটি বাম দিক হইতে। একটিতে দুধ ছিল এবং অপরটিতে মধু। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা) দুধের পেয়ালা গ্রহণ করিলেন এবং উহা হইতে পান করিলেন। অতঃপর যাহার হাতে পিয়ালা ছিল সে বলিলেন, আপনি ফিতরাত মুতাবিক সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছেন। ...[14]

 

যদিও ইমাম ইবন কাসির(র.) এই বর্ণনাকে সহীহ বলে উল্লেখ করেছেন। তবে বহু পূর্বযুগের মুহাদ্দিসের মতে এই হাদিসের বর্ণনাকারী ক্বাবুস বিন আবি যবইয়ান একজন যঈফ বা দুর্বল বর্ণনাকারী। এই বর্ণনাকারীর ব্যাপারে ইমাম ইবনুল জাওযী(র.) তাঁর ‘আদ-দ্বুআফা ওয়াল মাতরুকুনগ্রন্থে উল্লেখ করেছেন –  

 

قَابُوسُ بْنُ أَبِي ظَبْيَانَ الْجَنَبِيُّ الْكُوفِيُّ وَاسْمُ أَبِي ظَبْيَانَ خُضَيْرُ بْنُ جُنْدُبٍ. قَالَ يَحْيَى: "ضَعِيفُ الْحَدِيثِ"، وَقَالَ مَرَّةً: "ثِقَةٌ". وَقَالَ أَبُو حَاتِمٍ الرَّازِيُّ: "يُكْتَبُ حَدِيثُهُ وَلَا يُحْتَجُّ بِهِ". وَقَالَ النَّسَائِيُّ: "لَيْسَ بِالْقَوِيِّ". وَقَالَ ابْنُ حِبَّانَ: "كَانَ رَدِيءَ الْحِفْظِ يَتَفَرَّدُ عَنْ أَبِيهِ بِمَا لَا أَصْلَ لَهُ، وَرُبَّمَا رَفَعَ الْمُرْسَلَ وَأَسْنَدَ الْمَوْقُوفَ، وَأَبُوهُ ثِقَةٌ". وَكَانَ يَحْيَى بْنُ مَعِينٍ شَدِيدَ الْحَمْلِ عَلَى قَابُوسَ.

অর্থঃ “ক্বাবুস বিন আবি যবইয়ান আল-জানাবি আল-কুফি। আবি যবইয়ানের নাম ছিল খুদাইর বিন জুনদুব। ইয়াহইয়া [ইবন মাঈন(র.)] তাকে একবার "হাদিস বর্ণনায় দুর্বল" বলেছেন এবং একবার বলেছেন ছিকাহ। আবু হাতিম আর-রাজি(র.) বলেছেন, "তার হাদিস লেখা যেতে পারে, তবে তা প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না" নাসাঈ(র.) বলেছেন, "তিনি শক্তিশালী নন"ইবন হিব্বান(র.) বলেছেন, "তার স্মৃতিশক্তি দুর্বল ছিল; তিনি তার পিতার সূত্রে এমন সব বিষয় বর্ণনা করতেন যার কোনো ভিত্তি ছিল না, এবং কখনও কখনও মুরসাল (যে হাদিসের প্রথম বর্ণনাকারী বাদ পড়েছেন) হাদিসকে মারফু (নবীজির সাথে সম্পর্কিত) এবং মাওকুফ (সাহাবীর সাথে সম্পর্কিত) হাদিসকে মুসনাদ (পূর্ণ সনদযুক্ত) হিসেবে বর্ণনা করতেন, যদিও তার পিতা নির্ভরযোগ্য ছিলেন।" ইয়াহইয়া ইবন মাঈন ক্বাবুসের প্রতি অত্যন্ত কঠোর ছিলেন [অর্থাৎ তাকে বিশুদ্ধ রাবী মনে করতেন না][15]

 

ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল(র.) নিকটেও তিনি নির্ভরযোগ্য রাবী নন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ আছে—

 

قَالَ عَبْدُ اللَّهِ: سَأَلْتُ أَبِي عَنْ قَابُوسِ بْنِ أَبِي ظُبْيَانٍ، قَالَ: لَيْسَ هُوَ بِذَاكَ، وَقَالَ: سُئِلَ جَرِيرٌ عَنْ شَيْءٍ مِنْ أَحَادِيثِ قَابُوسَ فَقَالَ: نَفَقَ قَابُوسُ، نَفَقَ.

 অর্থঃ “আব্দুল্লাহ বলেনঃ আমি আমার পিতাকে (আহমাদ বিন হাম্বল) ক্বাবুস বিন আবি যবইয়ান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেনঃ "সে তেমন উল্লেখযোগ্য নয়" (অর্থাৎ, হাদিসের ক্ষেত্রে শক্তিশালী নয়)। তিনি আরও বললেনঃ জারিরকে কাবুসের কিছু হাদিস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে, তিনি বললেনঃ "ক্বাবুস ধ্বংস হয়েছে, ক্বাবুস ধ্বংস হয়েছে।[16]

 

ইবন সা’দ(র.) উল্লেখ করেছেন – 

 

 قَابُوسُ بْنُ أَبِي ظَبْيَانَ الْجَنَبِيُّ. وَفِيهِ ضَعْفٌ لَا يُحْتَجُّ بِهِ.

 অর্থঃ “ক্বাবুস বিন আবি যবইয়ান আল-জানাবী। তার মধ্যে দুর্বলতা রয়েছে, তাই তার বর্ণনাসমূহ প্রমাণ হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়[17]

 

এই হাদিসটি মুসনাদ আহমাদ গ্রন্থেও আছে। এবং এর তাহকিকের মাঝে ক্বাবুস বিন আবি যবইয়ানের জন্য শায়খ শুআইব আরনাউত(র.) এর সনদকে যঈফ বা দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন। [18]

 

এই সংক্রান্ত আরো বর্ণনা আছে তাফসির ইবন কাসিরে

 

“… অতঃপর জিবরীল (আ) আমাকে বলিলেন, আপনার পিতা হযরত ইবরাহীম (আ)-এর নিকট চলুন। আমরা তাহার নিকট গিয়া সালাম করিলাম এবং তিনি উহার জবাবও দান করিলেন। হযরত ইবরাহীম (আ) জিজ্ঞাসা করিলেন, হে · জিবরীল! ইনি কে? তিনি বলিলেন আপনার সন্তান 'আহমদ' তখন তিনি বলিলেন উম্মী নবীকে আমি স্বাগত জানাইতেছি যিনি তাহার রিসালাতের দায়িত্ব পালন করিয়াছেন এবং স্বীয় উম্মতের মঙ্গল কামনা করিয়াছেন। তুমি আজ রাত্রেই স্বীয় প্রতিপালকের সাক্ষাৎ লাভ করিবে আর তোমার উম্মতই সর্বশেষ উম্মত এবং সর্বাধিক দুর্বল উম্মত। তোমার উম্মতের প্রতি হুকুম সহজ হউক, তাহার প্রতি যেন লক্ষ্য থাকে । রাসূলুল্লাহ (সা) ইরশাদ করেন অতঃপর আমরা রওনা হইয়া মাসজিদুল আকসা পর্যন্ত পৌঁছিয়া গেলাম। আমি অবতীর্ণ হইয়া মাসজিদের দরজার হলকার সহিত সোয়ারী বাঁধিয়া রাখিলাম। এই হলকার সহিত অন্যান্য আম্বিয়ায়ে কিরামও সোয়ারী বাঁধিতেন। অতঃপর আমি মাসজিদে প্রবেশ করিয়া জানিলাম কেহ দণ্ডায়মান, কেহ সিজায় অবনত রহিয়াছে কেহ রুকু করিতেছে। অতঃপর আমার নিকট একটি মধুর ও একটি দুধের পেয়ারা আনা হইল। আমি দুধের পেয়ালা গ্রহণ করিয়া উহা পান করিলাম। অতঃপর জিবরীল (আ) আমার কাঁধে হাত মারিয়া বলিলেন ফিতরাত অনুসারে আপনি সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছেন । রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, অতঃপর সালাতের ইকামত বলা হইল এবং আমি তাহাদের ইমামত করিলাম। …” [19]

 

ইমাম ইবন কাসির(র.) এই বর্ণনার সনদকে গরিব বলে উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া মাতানগত কিছু সমস্যাও উল্লেখ করেছেন। অতএব বর্ণনাটি সহীহ নয়। [20]

 

অতএব এই সংক্রান্ত কোনো হাদিস বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয়

 

বিশ্লেষণঃ

আমরা দেখলাম, ইসরা-মিরাজ সংক্রান্ত যেসব হাদিসে নবী এর নিকট বিভিন্ন পানীয় পেশ করার কথা উল্লেখ আছে, এর অনেকগুলোই বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয় এবং দুর্বল সনদে বর্ণিত। বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত হাদিসগুলোতে নবী কর্তৃক আল আকসায় পৌঁছে আসমানে গমনের পূর্বেও পানীয় পরিবেশনের উল্লেখ আছে, আবার আসমানে গমনের পরেও পানীয় পরিবেশনের উল্লেখ আছে।

 

ইসরা-মিরাজ সংক্রান্ত হাদিসগুলো একের পর এক উল্লেখ করে ইমাম ইবন কাসির(র.) উপসংহারমূলক আলোচনায় উল্লেখ করেছেন - নবী এর নিকট বিভিন্ন পানীয় পেশ করার ঘটনা বাইতুল মুকাদ্দাস এবং আসমান উভয় স্থানেই হবার সম্ভাবনা রয়েছে। যেমন কোনো আগন্তুকের জন্য আতিথেয়তাস্বরূপ পানীয় পেশ করা হয়। [21]

 

এ প্রসঙ্গে শাইখুল ইসলাম আহমাদ বিন ইসমাঈল আল কুরানী(র.) উল্লেখ করেছেন

 

 ذِكْرُ الِاثْنَيْنِ لَا يُنَافِي ذِكْرَ الثَّلَاثَةِ. هَذَا وَالتَّحْقِيقُ أَنَّ الْإِتْيَانَ بِالْإِنَاءَيْنِ كَانَ وَهُوَ بِبَيْتِ الْمَقْدِسِ، وَالثَّلَاثَةُ كَانَتْ وَهُوَ عِنْدَ السِّدْرَةِ، وَلَعَلَّ الْحِكْمَةَ فِي ذَلِكَ أَنَّهُ لَمَّا رُفِعَ زَيْدٌ فِي إِكْرَامِهِ، وَاخْتَارَ اللَّبَنَ لِمَا قَدَّمْنَا مِنْ فَوَائِدَ مِرَارًا.

অর্থঃ “দুটি পাত্রের উল্লেখ করা তিনটি পাত্রের উল্লেখের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। আর এই অনুসন্ধান এটাই প্রমাণ করে যে, ২টি পাত্র আনা হয়েছিল যখন তিনি [নবী ] বাইতুল মাকদিসে ছিলেন এবং ৩টি পাত্র আনা হয়েছিল যখন তিনি সিদরাতুল মুনতাহার কাছে ছিলেনসম্ভবত এর পেছনে হিকমাহ হলো, যখন তাঁকে অধিক মর্যাদা ও সম্মানে উন্নীত করা হলো, তখন তিনি আবারও দুধকেই নির্বাচন করলেন যার কারণ ও উপকারিতার কথা আমরা পূর্বে বহুবার উল্লেখ করেছি।[22]

 

মুফতি মুহাম্মাদ আশিক ইলাহী বুলান্দ শাহরী(র.) বলেন --

 

এমনটি হওয়া অসম্ভব না যে রাসুলুল্লাহ()কে প্রথমে বাইতুল মাকদিসে কিছু পানের জন্য পরিবেশন করা হয়েছিল, এবং পরে আসমানের জগতে আবার পরিবেশন করা হয়েছিল। অবশ্যই এর মাঝে কোনো পরস্পরবিরোধিতা নেই। [হাদিসের বক্তব্যের মাঝে] কোনো প্রকার লিখিত অথবা যৌক্তিক প্রমাণ নেই যা দ্বারা [বাইতুল মাকদিসে এবং আসমানে] উভয় জগতে পানীয় পরিবেশনের এই সম্ভাবনা নাকচ করা যায়।[23] 

 

নবী এর নিকট কেন বার বার বিভিন্ন প্রকার পানীয় পেশ করা হয়েছিল, এর হিকমাহ সম্পর্কে ইমাম ইবন হাজার আসকালানী(র.) বলেছেন,

 

  وَوَقَعَ فِي حَدِيثِ أَبِي هُرَيْرَةَ عِنْدَ الطَّبَرِيِّ لَمَّا ذَكَرَ سِدْرَةَ الْمُنْتَهَى: يَخْرُجُ أَصْلُهَا مِنْ أَنْهَارٍ مِنْ مَاءٍ غَيْرِ آسِنٍ، وَمِنْ لَبَنٍ لَمْ يَتَغَيَّرْ طَعْمُهُ، وَمِنْ خَمْرٍ لَذَّةٍ لِلشَّارِبِينَ، وَمِنْ عَسَلٍ مُصَفًّى، فَلَعَلَّهُ عُرِضَ عَلَيْهِ مِنْ كُلِّ نَهْرٍ إِنَاءٌ.

 অর্থঃ “তাবারী(র.) কর্তৃক বর্ণিত আবু হুরায়রা (রা.)-এর হাদিসে যখন সিদরাতুল মুনতাহার (চূড়ান্ত সীমার কুল গাছ) কথা উল্লেখ করা হয়, তখন বলা হয়েছেঃ এর মূল থেকে প্রবাহিত হয় এমন সব নদী, যার পানি কখনো নষ্ট হয় না (স্বচ্ছ ও সুপেয়), এমন দুধের নদী, যার স্বাদ কখনো পরিবর্তিত হয় না, এমন মদের নদী, যা পানকারীদের জন্য সুস্বাদু; এবং এমন বিশুদ্ধ মধুর নদী। সম্ভবত এই প্রতিটি নদী থেকে একটি করে পাত্র তাঁর (নবী -এর) সামনে পেশ করা হয়েছিল।[24]

 

সিদ্ধান্তঃ

১। নবী বাইতুল মাকদিসে আল আকসা মসজিদে পৌঁছানোর পরে তাঁর নিকট মদ ও দুধের পাত্র আনা হয়, তিনি দুধ পান করেন। 

২। আসমানে গমনের পরে বায়তুল মামুরে তাঁর নিকট মদ ও দুধের পাত্র পেশ করা হয়। তিনি দুধ পান করেন।

৩। এর পরে সিদরাতুল মুনতাহায় যাবার পরে তাঁর নিকট মধু, মদ ও দুধের পাত্র পেশ করা হয়। তিনি দুধ পান করেন।

 

অর্থাৎ, ইসরা-মিরাজের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন সময়ে নবী এর নিকট মোট ৩ বার বিভিন্ন প্রকার পানীয় পেশ করা হয়। আর প্রত্যেকবারেই তিনি দুধ পান করেন। যা ফিতরাতের প্রতীক, এর ফলে তিনি এবং তাঁর উম্মত কেউ পথভ্রষ্ট হয়নি। একেক হাদিসে একেক সময়ের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে।

 

যেমন ধরা যাক, একজন ব্যক্তি ঢাকা থেকে খুলনা যাবার জন্য রাতের বাসে উঠল। বাসে উঠেই সে ঘুম তাড়ানোর জন্য একবার কফি খেলো। তার বাস ফরিদপুরে পৌঁছানোর পরে সে আবার কফি খেল। আবার সে যশোর পৌঁছানোর পরে ৩য় বারের মতো কফি খেলো।

সে তার ভ্রমণকাহিণী বলার সময়ে একজনকে বললঃআমি বাসে উঠেই কফি খেয়েছিলাম।”

আরেকজনকে বললঃ “আমি ফরিদপুরে গিয়ে কফি খেয়েছিলাম।”

আবার আরেকজনকে বললঃ “আমি যশোরে পৌঁছে কফি খেয়েছিলাম।”

এখন তার এই বর্ণনাগুলো কি পরস্পরবিরোধী? উত্তর হচ্ছেঃ না। কারণ, সে তার বিভিন্ন সময়ের ঘটনা বিভিন্ন জনের কাছে ব্যক্ত করেছে।

একইভাবে, নবী এর ইসরা-মিরাজ সংক্রান্ত হাদিসগুলোতেও একেক স্থানে তাঁর নিকট বিভিন্ন সংখ্যায় বিভিন্ন পানীয়ের পাত্র পেশ করার উল্লেখ আছে। এগুলো মোটেও পরস্পরবিরোধী নয়।   

 

 

তথ্যসূত্রঃ


[1] তাফসির ইবন কাসির (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ১৯৮, সুরা বনী ইস্রাঈলের ১ নং আয়াতের তাফসির

[2] আল ইসরাউ ওয়াল মি’রাজু ওয়া যিকরু আহাদিছিহিমা ওয়া তাখরিজুহা ওয়া বায়ানু সহিহিহা নাসিরুদ্দিন আলবানী, পৃষ্ঠা ৪১

https://shamela.ws/book/7540/38

অথবা https://archive.is/wip/vHHAU (আর্কাইভকৃত)

[3] আল ইসরাউ ওয়াল মি’রাজু ওয়া যিকরু আহাদিছিহিমা ওয়া তাখরিজুহা ওয়া বায়ানু সহিহিহা নাসিরুদ্দিন আলবানী, পৃষ্ঠা ৭০

https://shamela.ws/book/7540/67

অথবা https://archive.is/wip/DJU4f (আর্কাইভকৃত)

[4] তাফসির ইবন কাসির (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ২৪২, সুরা বনী ইস্রাঈলের ১ নং আয়াতের তাফসির

[5] দেখুনঃ তাফসির ইবন কাসির (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ২৪৮-২৪৯, সুরা বনী ইস্রাঈলের ১ নং আয়াতের তাফসির

[6] মুসনাদুল ফারুক্ব ইবন কাসির, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৫৩৫

https://shamela.ws/book/16555/521

 অথবা https://archive.is/wip/JNTsq (আর্কাইভকৃত)

[7] আল কামিলু ফি দ্বু'আফাইর রিজাল - ইবন আদি, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ৪৪৬

https://shamela.ws/book/12579/3117

 অথবা https://archive.is/wip/ykgMW (আর্কাইভকৃত)

[8] দেখুনঃ আদ-দ্বুআফা ওয়াল মাতরুকুন – ইবনুল জাওযি, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ২৩৮

https://shamela.ws/book/5830/548

 অথবা https://archive.is/wip/gQdJj (আর্কাইভকৃত)

[9] সহীহ মুসলিম, হাদিস নং : ৩০৮

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=8099

[10] তাফসির ইবন কাসির (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ২২৭, সুরা বনী ইস্রাঈলের ১ নং আয়াতের তাফসির

[11] আল ইসরাউ ওয়াল মি’রাজু ওয়া যিকরু আহাদিছিহিমা ওয়া তাখরিজুহা ওয়া বায়ানু সহিহিহা নাসিরুদ্দিন আলবানী, পৃষ্ঠা ৬৯

https://shamela.ws/book/7540/66

অথবা https://archive.is/wip/PI0nr (আর্কাইভকৃত)

[12] সহীহ মুসলিম, হাদিস নং : ৩১৩

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=8104

[13] সহীহ বুখারী, হাদিস নং :  ৫৬১০

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=30192

[14] তাফসির ইবন কাসির (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ২২৯, সুরা বনী ইস্রাঈলের ১ নং আয়াতের তাফসির

[15] আদ-দ্বুআফা ওয়াল মাতরুকুন ইবনুল জাওযি, খণ্ড ৩ পৃষ্ঠা ১২

https://shamela.ws/book/5830/567

অথবা https://archive.is/wip/nx31l (আর্কাইভকৃত)

[16] আল জামি’উ লিউলুমিল ইমামি আহমাদ আহমাদ বিন হাম্বল, খণ্ড ১৮, পৃষ্ঠা ৪৪৮

https://shamela.ws/book/20881/1663

অথবা https://archive.is/wip/HZvit (আর্কাইভকৃত)

[17] ত্বাবাকাতুল কুবরা – ইবন সা’দ, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ২৩০

https://shamela.ws/book/1686/2262

অথবা https://archive.is/wip/VVMnh (আর্কাইভকৃত)

[18] দেখুনঃ মুসনাদ আহমাদ, তাহকিকঃ শুআইব আরনাউত, ২৩২৪ নং হাদিসের তাহকিক, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ১৬৭, টীকা নং: ৩

https://shamela.ws/book/25794/1677

অথবা https://archive.is/wip/Ry7AG (আর্কাইভকৃত)

[19] তাফসির ইবন কাসির (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ২৩৪-২৩৫, সুরা বনী ইস্রাঈলের ১ নং আয়াতের তাফসির

[20] দেখুনঃ তাফসির ইবন কাসির (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ২৩৫, সুরা বনী ইস্রাঈলের ১ নং আয়াতের তাফসির

[21] দেখুনঃ তাফসির ইবন কাসির (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ২৫৫, সুরা বনী ইস্রাঈলের ১ নং আয়াতের তাফসির

[22] আল কাওছারুল জারি ইলা রিয়াদ্বি আহাদিছিল বুখারী আহমাদ বিন ইসমাঈল আল কুরানী, খণ্ড ৯, পৃষ্ঠা ২১৩

https://shamela.ws/book/16584/4143

অথবা https://archive.is/wip/bwTq1 (আর্কাইভকৃত)

[23] “It is not unlikely that Rasulullah (SAW) may have been first offered something to drink in the Baitul Maqdis and then again in the realm of the heavens. There is definitely no contradiction here and absolutely no textual or logical proof to discount the possibility of it having been offered in both the worlds.”

- 'The Miracles of Miraj' By Mufti Muhammad Aashiq Ilahi Buland Shahri, Page 35

https://jamiat.org.za/wp-content/uploads/2013/06/The-Miracle-Of-Miraj.pdf

অথবা https://web.archive.org/web/20251115194953/https://jamiat.org.za/wp-content/uploads/2013/06/The-Miracle-Of-Miraj.pdf (আর্কাইভকৃত)

[24] ফাতহুল বারী - ইবন হাজার আসকালানী, খণ্ড ৭, পৃষ্ঠা ২১৬

https://shamela.ws/book/1673/4044

অথবা https://archive.is/wip/Lf0xZ (আর্কাইভকৃত)

 

Go to Top