নাস্তিক প্রশ্ন:
মানুষ জান্নাতে যাবে নাকি জাহান্নামে যাবে—তা তো আগে থেকেই তাকদিরে লেখা। আর এর ব্যতিক্রমও ঘটবে না। আল্লাহর হুকুম ছাড়া নাকি কোনো গাছের পাতাও পড়ে না; পৃথিবীর সব অপরাধ তো তাহলে আল্লাহর হুকুমেই হয়। অমুসলিমরা অমুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করে আর মুসলিমরা মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করে। কেউ যদি হিন্দু বা নাস্তিক হওয়ার জন্য জাহান্নামে যায়—এটা তো সেই ব্যক্তির দোষ না। এটা সৃষ্টিকর্তারই দোষ।
উত্তর:
আরবি ‘তাকদির’(تقدير) শব্দটি ‘কদর’(قدر) শব্দের সাথে সম্পর্কিত। শাব্দিকভাবে ‘কদর’ এর অর্থ – পরিমাপ, পরিমাণ, মর্যাদা, শক্তি। আর ‘তাকদির’ এর অর্থ – পরিমাপ করা, নির্ধারণ করা, সীমা নির্ণয় করা ইত্যাদি। [1]
তাকদির হচ্ছে, সর্বজ্ঞানী হিসাবে আল্লাহ তা’আলার পূর্ব জ্ঞান ও হিকমতের দাবি অনুযায়ী সমগ্র সৃষ্টিজগতের জন্য সব কিছু নির্ধারণ। [2]
আল-কুরআন আমাদেরকে জানাচ্ছে যে, মহান আল্লাহ অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত সব কিছুর ব্যাপারে জানেন। বলা হয়েছে –
“নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের গোপন রহস্য আল্লাহর কাছেই রয়েছে।...” [3]
“তুমি কি জানো না যে, আকাশসমূহ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা সম্পর্কে আল্লাহ জানেন? এসব বিষয় একটি কিতাবে সংরক্ষিত আছে। নিশ্চয়ই এটা আল্লাহর পক্ষে অতি সহজ।” [4]
“অদৃশ্য জগতের চাবিকাঠি তাঁরই নিকট রয়েছে; তিনি ছাড়া আর কেউঁই তা জ্ঞাত নয়। পৃথিবীতে ও সমুদ্রের সব কিছুই তিনি অবগত আছেন, তাঁর অবগতি ব্যতীত বৃক্ষ হতে একটি পাতাও ঝরে পড়ে না এবং ভূ-পৃষ্ঠের অন্ধকারের মধ্যে একটি দানাও পতিত হয় না, এমনিভাবে কোনো সরস ও নিরস বস্তুও পতিত হয় না; সমস্ত কিছুই সুস্পষ্ট কিতাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে। ” [5]
“এগুলো অদৃশ্যের খবর, যা ওহীর মাধ্যমে আমি তোমার [মুহাম্মাদ(ﷺ)] কাছে প্রেরণ করি। তুমি তাদের কাছে ছিলে না, যখন তারা ষড়যন্ত্র করে নিজেদের সিদ্ধান্ত স্থির করে ফেলেছিলো।” [6]
“তিনিই সেই সত্তা, যিনি আকাশসমূহ ও পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন যথোচিত। যেদিন তিনি বলবেন, ‘হয়ে যাও!’ তখন হয়ে যাবে। তাঁর কথা সত্য। যেদিন শিঙ্গায় ফুঁৎকার করা হবে, সেদিন আধিপত্য হবে তাঁরই। তিনি অদৃশ্য বিষয়ে এবং প্রত্যক্ষ বিষয়ে জ্ঞাত। তিনিই প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞ। ” [7]
“নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছেই কিয়ামতের জ্ঞান রয়েছে। তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং গর্ভাশয়ে যা থাকে, তিনি তা জানেন। কেউ জানে না, আগামীকাল সে কী উপার্জন করবে এবং কেউ জানে না, কোন দেশে সে মৃত্যুবরণ করবে। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্ববিষয়ে সম্যক জ্ঞাত।” [8]
“তিনি দৃশ্য ও অদৃশ্যের জ্ঞানী, পরাক্রান্ত, প্রজ্ঞাময়।” [9]
পৃথিবীর সব অপরাধ কি আল্লাহর হুকুমেই হয়?
হুকুম মানে নির্দেশ। আল্লাহ তা’আলা কখনোই অপরাধ বা খারাপ কাজের নির্দেশ দেন না। আল্লাহ বলেন—
“... আল্লাহ মন্দ কাজের আদেশ দেন না। তোমরা এমন কথা আল্লাহর প্রতি কেন আরোপ কর, যা তোমরা জানো না? ” [10]
আল্লাহ তা’আলা সমস্ত কিছুর সৃষ্টিকর্তা। পাপ কিংবা পূণ্য – মানুষের সকল কর্মও আল্লাহর সৃষ্টি। পৃথিবীতে যা ঘটে এবং মানুষ যা করে – এগুলোর সবগুলোই আল্লাহর অনুমতিক্রমে বা ইচ্ছায় হয়।
আল্লাহ তা’আলার ইচ্ছা ২ প্রকারের। [11] যথাঃ
১। কাউনিয়্যাহ
২। শারইয়্যাহ
১। কাউনিয়্যাহঃ
এ ধরণের ইচ্ছা দ্বারা আল্লাহ তা’আলার ইচ্ছাকৃত জিনিসটি সম্পন্ন হয়। তবে জিনিসটি আল্লাহ তা’আলার কাছে পছন্দনীয় হওয়া জরুরী নয়। আর এটা দ্বারাই ‘মাশিয়াত’ বা ইচ্ছা বোঝানো হয়। যেমনঃ আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
“...আর আল্লাহ যদি ইচ্ছা করতেন, তাহলে তারা পরস্পর লড়াই করতো না। কিন্তু আল্লাহ তাই করেন, যা তিনি ইচ্ছা করেন।” [12]
২। শারইয়্যাহঃ
এ ধরণের ইচ্ছা দ্বারা আল্লাহ তা’আলার ইচ্ছাকৃত জিনিসটি সম্পন্ন হওয়া অপরিহার্য নয়। তবে এ ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃত জিনিস বা বিষয়টি তাঁর পছন্দনীয়। যেমনঃ আল্লাহ তা’আলা বলেনঃ
“আর আল্লাহ তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিতে চান।... ” [13]
উদাহরণঃ
আবু বকর(রা.) এর ঈমান আনা – এই ঘটনাটি একই সাথে আল্লাহর কাউনিয়্যাহ ও শারইয়্যাহ ইচ্ছার উদাহরণ। এটি কাউনিয়্যাহ ইচ্ছা এই জন্য যেঃ এটি সংঘটিত হয়েছিল। শারইয়্যাহ ইচ্ছা এই জন্য যেঃ এটি আল্লাহর পছন্দনীয় ছিল।
আবার ফিরআউনের কুফরী – এটি শুধুমাত্র আল্লাহর কাউনিয়্যাহ ইচ্ছার উদাহরণ। এটি কাউনিয়্যাহ ইচ্ছা এই কারণে যেঃ এটি সংঘটিত হয়েছিল। কিন্তু এটি শারইয়্যাহ ইচ্ছা নয় কেননা এর পেছনে আল্লাহর কোন অনুমোদন বা সন্তুষ্টি ছিল না। আল্লাহ মুসা(আ.)কে তার নিকট ঈমানের দাওয়াত দিয়ে প্রেরণ করেছিলেন। [14]
আল্লাহ মানুষকে নির্দেশ দিয়েছেন যাকাত আদায় করার, তিনি মানুষকে চুরি করতে নিষেধ করেছেন। এ নির্দেশগুলো পালন করা আল্লাহর নিকট পছন্দনীয়। মানুষকে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দেওয়া হয়েছে যা দ্বারা সে এ আদেশগুলো মানতেও পারে আবার ভঙ্গও করতে পারে। মানুষ যদি নিজ ইচ্ছাশক্তি দ্বারা যাকাত আদায় না করে কিংবা চুরি করে, তাহলে আল্লাহ তা’আলা তাকে জোর করে যাকাত আদায় করতে বাধ্য করেন না কিংবা চুরি করা আটকে দেন না। যদিও আল্লাহর এ ক্ষমতা আছে। মানুষ যদি যাকাত আদায় না করে কিংবা যদি চুরি করে, তাহলে আল্লাহ তা’আলা তা হতে দেন। কিন্তু এসব ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টি নেই।
যেহেতু মানুষের সকল কর্ম আল্লাহর সৃষ্টি কাজেই পূণ্যের সাথে সাথে পাপও আল্লাহর ইচ্ছাক্রমে হয়। তবে তা কেবলমাত্র এ অর্থে যে আল্লাহ এগুলোকে(পাপ) নির্ধারিত করেছেন; এ অর্থে নয় যে আল্লাহ এগুলো অনুমোদন করেন বা আদেশ দেন। পৃথিবীতে যত খারাপ কাজ বা অপরাধ সংঘটিত হয়, এগুলোর উপর আল্লাহ তা’আলার কোনো সন্তুষ্টি নেই। আল্লাহ এগুলো ঘৃণা করেন, অপছন্দ করেন এবং এগুলো থেকে বিরত হবার আদেশ দেন। [15]
পৃথিবীতে যত অপরাধ সংঘটিত হয়, এগুলোর উপর আল্লাহর সন্তুষ্টি না থাকা সত্ত্বেও কেন আল্লাহ এগুলো সংঘটিত হতে দেন এর উত্তরে বলা যেতে পারে – কুফর যদি না থাকত, তাহলে মু’মিন ও কাফির আলাদা করা যেত না বরং সবাই মু’মিন হত। [16] একইভাবে, পাপ যদি না থাকতো, তাহলে পূণ্য বলে কিছু থাকতো না, সৎকর্ম ও মহত্ত্বেরও কোনো মানে থাকতো না। যদি অশুভ শক্তি না থাকতো, তাহলে শুভ ও কল্যাণকর জিনিসের কোনো মূল্য থাকতো না। অন্ধকার আছে বলেই আলোর গুরুত্ব আছে। পৃথিবীতে নিষ্ঠুরতা বা নৃশংসতা না থাকলে মানবতারও কোনো আলাদা অস্তিত্ব বা অর্থ থাকতো না। কাজেই পৃথিবীতে অন্যায়, পাপ ইত্যাদির অস্তিত্ত্বও আল্লাহর সৃষ্টির অসামান্য হিকমতের পরিচায়ক।
এ ব্যাপারে একটি কবিতা খুবই প্রাসঙ্গিক –
“আলো বলে, “অন্ধকার তুই বড় কালো,”
অন্ধকার বলে, “ভাই তাই তুমি আলো।” ”
মানুষের কর্ম তার পরিণতির কারণ
কুরআন ও সুন্নাহ দ্বারা এটি সাব্যস্ত হয়েছে যে – মানুষ যে কর্ম করবে ঠিক সে অনুযায়ী প্রতিদান পাবে। মানুষের প্রতিদান নির্ধারিত হবে তার কর্মের ভিত্তিতে।
“নিশ্চয়ই আমি [আল্লাহ] মানুষকে শ্রমনির্ভররূপে সৃষ্টি করেছি।” [17]
“সেখানে প্রত্যেকে যাচাই করে নিতে পারবে যা কিছু সে ইতিপূর্বে করেছিল এবং আল্লাহর প্রতি প্রত্যাবর্তন করবে যিনি তাদের প্রকৃত মালিক, আর তাদের কাছ থেকে দূরে যেতে থাকবে যারা মিথ্যা বলত।” [18]
“আর যত লোকই হোক না কেন, যখন সময় হবে, তোমার প্রভু তাদের সকলেরই আমলের প্রতিদান পুরোপুরি দান করবেন। নিশ্চয়ই তিনি তাদের যাবতীয় কার্যকলাপের খবর রাখেন।
...
“আর ধৈর্য্যধারণ কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ পূণ্যবানদের প্রতিদান বিনষ্ট করেন না।” [19]
“আজকের দিনে [শেষ বিচারের দিন] কারও প্রতি জুলুম করা হবে না এবং তোমরা যা করবে কেবল তারই প্রতিদান পাবে।” [20]
“যে মন্দ কর্ম করে, সে কেবল তার অনুরূপ প্রতিফল পাবে, আর যে, পুরুষ অথবা নারী মুমিন অবস্থায় সৎকর্ম করে তারাই জান্নাতে প্রবেশ করবে। সেখানে তাদেরকে বেহিসাব রিযিক দেয়া হবে।” [21]
আল কুরআন আমাদের জানাচ্ছে যে – মানুষ তার সৎকাজের জন্য পুরষ্কার পাবে। মানুষ দুনিয়াতে যে কর্ম করে, পরকালে তার প্রতিফলস্বরূপ জান্নাত লাভ করবে।
“ তাদেরই জন্য প্রতিদান হলো তাদের পালনকর্তার ক্ষমা ও জান্নাত, যার তলদেশে প্রবাহিত হচ্ছে প্রস্রবণ যেখানে তারা থাকবে অনন্তকাল। যারা আমল করে তাদের জন্য কতইনা চমৎকার প্রতিদান।” [22]
“ আর পুরুষ কিংবা নারীর মধ্য থেকে যে সৎকাজ করবে এমতাবস্থায় যে, সে মু’মিন(বিশ্বাসী), তাহলে তারা জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের প্রতি খেজুর বিচির আবরণ পরিমাণ জুলুমও করা হবে না।” [23]
“তোমাদের কাছে যা আছে তা নিঃশেষ হয়ে যাবে এবং আল্লাহর কাছে যা আছে, কখনও তা শেষ হবে না। যারা ধৈর্য ধরে, আমি তাদেরকে প্রাপ্য প্রতিদান দেব তাদের উত্তম কর্মের প্রতিদানস্বরূপ যা তারা করত। যে সৎকর্ম সম্পাদন করে এবং যে ঈমানদার— সে পুরুষ হোক কিংবা নারী হোক আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং প্রতিদানে তাদেরকে তাদের উত্তম কাজের কারণে প্রাপ্য পুরষ্কার দেব যা তারা করত।” [24]
“যে কষ্ট স্বীকার করে, সে তো নিজের জন্যেই কষ্ট স্বীকার করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ বিশ্ববাসীর উপর প্রাচুর্যশীল। আর যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে, আমি অবশ্যই তাদের মন্দ কাজগুলো মিটিয়ে দেব এবং তাদেরকে কর্মের উৎকৃষ্টতর প্রতিদান দেব।” [25]
“ নিশ্চয়ই যারা বলে, আমাদের প্রভু আল্লাহ অতঃপর অবিচল থাকে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তিত হবে না। তারাই জান্নাতের অধিকারী। তারা সেখানে চিরকাল থাকবে। তারা যে কর্ম করত, এটা তারই প্রতিফল। ” [26]
“ এটা তোমাদের প্রতিদান। তোমাদের প্রচেষ্টা স্বীকৃতি লাভ করেছে।” [27]
পক্ষান্তরে, মানুষ তার কর্মের জন্যই পরকালে শাস্তির সম্মুখীন হবে।
“বস্তুতঃ যারা মিথ্যা জেনেছে আমার আয়াতসমূকে এবং আখিরাতের সাক্ষাতকে, তাদের যাবতীয় কাজকর্ম ধ্বংস হয়ে গেছে। তেমন বদলাই সে পাবে যেমন আমল করত।” [28]
“ পার্থিব জীবনে সামান্যই লাভ, অতঃপর আমার নিকট প্রত্যাবর্তন করতে হবে। তখন আমি তাদেরকে আস্বাদন করাব কঠিন আযাব-তাদেরই কৃত কুফরীর বদলাতে।” [29]
“ যেদিন আমি পর্বতসমূহকে পরিচালনা করব এবং তুমি পৃথিবীকে দেখবে একটি উম্মুক্ত প্রান্তর এবং আমি মানুষকে একত্রিত করব অতঃপর তাদের কাউকে ছাড়ব না। তারা তোমার প্রভুর [আল্লাহ] সামনে পেশ হবে সারিবদ্ধ ভাবে এবং বলা হবেঃ তোমরা আমার কাছে এসে গেছ; যেমন তোমাদেরকে প্রথম বার সৃষ্টি করেছিলাম। না, তোমরা তো বলতে যে, আমি তোমাদের জন্যে কোন প্রতিশ্রুত সময় নির্দিষ্ট করব না। আর আমলনামা সামনে রাখা হবে। তাতে যা আছে; তার কারণে তুমি অপরাধীদেরকে ভীত-সন্ত্রস্ত দেখবে। তারা বলবেঃ “হায় আফসোস, এ কেমন আমলনামা। এ যে ছোট বড় কোন কিছুই বাদ দেয়নি-সবই এতে রয়েছে!” তারা তাদের কৃতকর্মকে সামনে উপস্থিত পাবে। তোমার প্রভু কারও প্রতি জুলুম করবেন না।” [30]
“হে অপরাধীরা! আজ তোমরা আলাদা হয়ে যাও। হে আদম সন্তান! আমি কি তোমাদেরকে বলে রাখিনি যে, শয়তানের দাসত্ব করো না, সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু? এবং আমার দাসত্ব কর। এটাই সরল পথ। শয়তান তোমাদের অনেক দলকে পথভ্রষ্ট করেছে। তবুও কি তোমরা বোঝোনি? এই সে জাহান্নাম, যার ওয়াদা তোমাদেরকে দেয়া হতো। তোমাদের কুফরের কারণে আজ এতে প্রবেশ কর।” [31]
তাদের কর্মই তাদের জিম্মাদার। এবং এই কর্ম আল্লাহর ইচ্ছা ও অনুমতিক্রমে হয়ে থাকে। এই আয়াত ও হাদিসগুলোতে পুরো ব্যাপারটি খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে---
“এখন মুশরিকরা বলবে, ‘যদি আল্লাহ ইচ্ছা করতেন, তবে না আমরা শিরক করতাম, না আমাদের বাপ-দাদারা আর না আমরা কোনো বস্তুকে হারাম করতাম।’ এমনিভাবে তাদের পূর্ববর্তীরা মিথ্যারোপ করেছে, পরিশেষে তারা আমার শাস্তি আস্বাদন করেছে। বলো, তোমাদের কাছে কি কোনো জ্ঞান আছে, যা আমাকে দেখাতে পারো? তোমরা যে-সবের পেছনে চলছো, তা ধারণা-অনুমান ছাড়া কিছু না। তোমরা শুধু অনুমান করেই কথা বলো। বলে দাও: অতএব, পরিপূর্ণ যুক্তি আল্লাহরই। তিনি ইচ্ছা করলে তোমাদের সবাইকে পথপ্রদর্শন করতেন।” [32]
আলী (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন রাসুলুল্লাহ(ﷺ) একখণ্ড কাঠ হাতে নিয়ে উপবিষ্ট ছিলেন। তিনি তা দ্বারা যমীনে টোকা দিচ্ছিলেন। এরপর তিনি তার মাথা উঠালেন। তখন তিনি বললেনঃ তোমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যার জান্নাত ও জাহান্নামের ঠিকানা পরিজ্ঞাত (নির্ণীত) নয়। তাঁরা বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ(ﷺ)! তাহলে আমরা কাজ-কর্ম ছেড়ে কি ভরসা করে বসে থাকব না? তিনি বললেন, না, বরং আমল করতে থাকো। যাকে যে জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে তাই তার জন্য সহজ করা হয়েছে।
এরপর তিনি তিলওয়াত করলেনঃ “সুতরাং কেউ দান করলে, মুত্তাকি হলে এবং যা উত্তম তা গ্রহণ করলে, আমি তার জন্য সুগম করে দেব সহজ পথ। এবং কেউ কার্পণ্য করলে ও নিজেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করলে, এবং যা উত্তম তা বর্জন করলে, তার জন্য আমি সুগম করে দেবো কঠোর পরিণামের পথ।” (সূরা লাইল ৯২:৫-১০) [33]
আনাস বিন মালিক(রা.) থেকে বর্ণিত; একজন ব্যক্তি বলল, “হে আল্লাহর রাসুল(ﷺ), আমি কি আমার উট বেঁধে আল্লাহর উপর ভরসা করব, নাকি আমি ওটাকে না বেঁধে ছেড়ে রেখেই আল্লাহর উপর ভরসা করব?” তিনি [রাসুল(ﷺ)] বললেন, "ওটাকে বাঁধো এবং [এরপর আল্লাহর উপর] ভরসা কর।” [34]
কাজেই— “আল্লাহ না চাইলে তো পাপ কাজ করতাম না, তাকদিরে আছে বলেই পাপকাজ করেছি”—এই জাতীয় কথা বলার কোনো মানে নেই। কারণ এরূপ কথা বলার অর্থ হচ্ছে—গায়েবের জ্ঞান থাকার দাবি করা। “তাকদিরে পাপ করার কথা আছে”—এটা তো কেউ আমাদের বলে দেয়নি। এই জ্ঞান তো আমাদের কারো নেই। কাজেই এধরনের কথা বলার অর্থ হচ্ছে, আন্দাজের অনুসরণ করা এবং ইচ্ছাকৃতভাবে পাপকাজে লিপ্ত হওয়া।
মানুষের কি আদৌ কোনো ইচ্ছাশক্তি আছে, নাকি তাকে বাধ্য করা হচ্ছে? আল্লাহ কি কাউকে জোর করে জাহান্নামে পাঠাবেন?
কে জান্নাতে যাবে আর কে জাহান্নামে যাবে এটা আল্লাহ তা‘আলা স্বাভাবিকভাবেই আগে থেকে জানেন। তবে এর মানে এই নয় যে, আল্লাহ্ জোর করে কাউকে জাহান্নামের পাঠান।
কুরআন ও হাদিসে বলা হয়েছে—
“…আল্লাহ এমন নন যে, তোমাদের ঈমান নষ্ট করে দেবেন। নিশ্চয়ই মানুষের প্রতি আল্লাহ অত্যন্ত স্নেহশীল, করুণাময়।” [35]
“তিনিই (আল্লাহ) প্রথমবার অস্তিত্ব দান করেন এবং পুনরায় জীবিত করেন। তিনি ক্ষমাশীল, প্রেমময়; মহান আরশের অধিকারী।” [36]
“উমার ইবনুল খাত্তাব (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একবার নবী (ﷺ)-এর নিকট কিছুসংখ্যক বন্দি আসে। বন্দিদের মধ্যে একজন মহিলা ছিলো। তার স্তন দুধে পূর্ণ ছিল। সে বন্দিদের মধ্যে কোনো শিশু পেলে তাকে ধরে কোলে নিতো এবং দুধ পান করাতো। নবী (ﷺ) আমাদের বললেন, “তোমরা কি মনে করো, এ মহিলা তার সন্তানকে আগুনে ফেলে দিতে পারে?” আমরা বললাম, “না। ফেলার ক্ষমতা রাখলেও সে কখনো ফেলবে না।” তারপর তিনি বললেন, “এ মহিলাটি তার সন্তানের উপর যতটুকু দয়ালু, আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রতি এর চেয়েও বেশি দয়ালু।” [37]
“আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি নেক কাজের ইচ্ছা করে অথচ এখনও তা সস্পাদন করেনি, তার জন্য একটি সাওয়াব লেখা হয়। আর যে ইচ্ছা করার পর কার্য সস্পাদন করে, তবে তার ক্ষেত্রে দশ থেকে সাতশ’ গুণ পর্যন্ত সাওয়াব লেখা হয়। পক্ষান্তরে যে কোনো মন্দ কাজের ইচ্ছা করে আর তা না করে, তবে কোনো গুনাহ লেখা হয় না; আর তা করলে (একটি) গুনাহ লেখা হয় ।” [38]
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবন তাইমিয়া(র) মানুষের কর্মের ভূমিকা সম্পর্কে বলেছেনঃ মানুষ প্রকৃতই কর্ম করে, এবং আল্লাহ তাদের কর্মের স্রষ্টা। কোনো ব্যক্তি মু’মিন অথবা কাফির হতে পারে, পূন্যবান কিংবা পাপী হতে পারে, সলাত আদায় ও সিয়াম পালন করতে পারে –মানুষের তার কর্মের উপর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এবং তার নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি রয়েছে। এবং আল্লাহ তার এ নিয়ন্ত্রণ ও ইচ্ছাশক্তির স্রষ্টা। যেরূপ আল্লাহ বলেছেন—“[এটা] তার জন্যে, যে তোমাদের মধ্যে সরল পথে চলতে চায়। তোমরা ইচ্ছা করবে না, যদি জগতসমূহের প্রভু আল্লাহ ইচ্ছা না করেন।” (সুরা তাকওয়ির ৮১:২৮-২৯) [39]
এ প্রসঙ্গে শায়খ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল উসাইমিন(র) বলেছেনঃ “...মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি আছে যেমন মানুষের খাওয়া ও পান করার ক্ষমতা আছে। যেমনঃ ফজরের সলাতের সময় মানুষ (ওযু করতে) পানির দিকে যায় নিজ ইচ্ছায়, যখন ঘুম আসে, তখন মানুষ বিছানায় যায় নিজ ইচ্ছায়। ...এভাবে প্রতিটি কর্মের ব্যাপারেই মানুষের নিজস্ব ইচ্ছাশক্তি আছে। যদি তা না হত, তাহলে পাপীকে শাস্তি দেয়া অন্যায্য হত। মানুষকে এমন কিছুর জন্য কিভাবে শাস্তি দেয়া যেতে পারে যার উপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই? যদি তা না হত, তাহলে কিভাবে পূণ্যবানকে পুরষ্কার দেয়া যেতে পারে, যেখানে ঐ কর্মের উপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না? ...কাজেই মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি আছে তবে সে আল্লাহর নির্ধারণকৃত তাকদিরের বাইরে কোনো কাজ করে না কারণ তার কর্মের উপর আল্লাহর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। কিন্তু আল্লাহ মানুষকে বাধ্য করেন না। মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি আছে এবং এ অনুযায়ী মানুষ কাজ করে।
যদি নিজের ইচ্ছার বাইরে মানুষ কোনো কাজ করে ফেলে, তবে এ জন্য তাকে দায়ী করা হয় না। আল্লাহ গুহাবাসীদের(আসহাবে কাহফ) ব্যাপারে বলেছেনঃ “তুমি মনে করবে তারা জাগ্রত, অথচ তারা নিদ্রিত। আমি [আল্লাহ] তাদেরকে পার্শ্ব পরিবর্তন করাই ডান দিকে ও বাম দিকে। ...” (সুরা কাহফ ১৮:১৮)
এখানে তাদের পার্শ্ব পরিবর্তন করার কর্মটি আল্লাহর দিকে ন্যস্ত করা হয়েছে কারণ তারা ছিল ঘুমন্ত এবং তাদের নিজেদের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। আল্লাহর রাসুল(ﷺ) বলেছেন, “যদি কেউ ভুলক্রমে খায় ও পান করে তবে সে যেন তার সিয়াম(রোজা) পূর্ণ করে নেয়, কেননা আল্লাহ তা‘আলাই তাকে এ পানাহার করিয়েছেন।” [বুখারী : ১৯৩৩; মুসলিম : ১১৫৫] এখানে খাওয়া ও পান করার কর্মগুলো আল্লাহর দিকে ন্যস্ত করা হয়েছে কারণ মানুষ রোজা অবস্থায় ভুলবশত এ কাজগুলো করে ফেলে। সে নিজে থেকে খেয়ে বা পান করে নিজের রোজা নষ্ট করবার সিদ্ধান্ত নেয়নি।” [40]
ইসলামবিরোধীরা অভিযোগ করতে চায় যে – ইসলাম বলে মানুষের কর্মের কোনো ভূমিকা নেই বরং শুধুমাত্র পূর্বনির্ধারনের জন্যই মানুষ জান্নাত লাভ করে বা জাহান্নামে যায়। তাদের মতে সব কিছু পূর্ব নির্ধারণ অনুযায়ী সংঘটিত হয়, এতে মানুষের ব্যক্তিগত কোনো স্বাধীনতা নেই। প্রচণ্ড বাতাসে কারো ছাদ থেকে নিচে পড়ে যাওয়া আর সিঁড়ি বেয়ে স্বেচ্ছায় নিচে নেমে আসা একই কথা। অথচ এগুলো ছিল একটি বাতিল ফির্কা(heretic) ‘জাবারিয়াহ’দের আকিদা। [41] মুসলিম আলিমগণ এরূপ ভ্রান্ত বিশ্বাস খণ্ডন করে কলম ধরেছেন। যে ধরণের বিশ্বাস ইসলামে নেই এবং যে বিশ্বাসকে খণ্ডন করে মুসলিম আলিমগণ কলম ধরেছেন, সেই বিশ্বাস ইসলামের উপর চাপিয়ে দিয়ে মিথ্যা অভিযোগ তুলে যারা ইসলামকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়, তাদের উদ্যেশ্য অবশ্যই সৎ নয়।
পার্থিব জীবন মানুষের জন্য পরীক্ষা
আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন, ভালো-খারাপ উভয় পথই মানুষের জন্য উন্মুক্ত রয়েছে, এবং এটিই মানুষের জন্য পরীক্ষা।
“আমি তো মানুষকে সৃষ্টি করেছি মিলিত শুক্রবিন্দু হতে, তাকে পরীক্ষা করার জন্য। এজন্য আমি তাকে করেছি শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন। আমি তাকে পথনির্দেশ দিয়েছি, হয় সে কৃতজ্ঞ হবে, না হয় সে অকৃতজ্ঞ হবে।” [42]
“আমি কি তার জন্য সৃষ্টি করিনি দুই চক্ষু? আর জিহ্বা ও দুই ঠোঁট? এবং আমি কি তাকে দুইটি পথই দেখাইনি?” [43]
তাকদিরের এই প্রশ্নের সাথে সম্পর্কিত আরেকটি প্রশ্ন আসতে পারে যে, মুসলিমরা মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করে। আবার হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানরা নিজ নিজ পরিবারে জন্মগ্রহণ করে। আবার অনেকের কাছে হয়তো আদৌ ইসলামের দাওয়াতই পৌঁছেনি। এদের কী হবে? ইসলাম এসব ব্যাপারে খুব পরিষ্কারভাবে আমাদেরকে অবহিত করেছে।
মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণকারীরা মুসলিম আর অমুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণকারীরা অমুসলিম; মানুষের পরিণতি কি তবে জন্মের ভিত্তিতে?
যারা মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে, তারা জন্মের জন্য জান্নাতে যাবে না; বরং তাদের বিশ্বাস ও কর্মের জন্য জান্নাতে যাবে। অনেক মানুষ আছে, যারা মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়েও সলাত(নামায) আদায় করে না, অথচ সলাত ঈমান ও কুফরের মধ্যে পার্থক্যকারী। [44] আবার অনেকেই মুসলিম পরিবারে জন্মেও ইসলাম ত্যাগ করে। মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়া অবশ্যই জান্নাতের গ্যারান্টি নয়। আর যে অমুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছে, তার জন্য সেটি একটি পরীক্ষা। সে যদি সঠিক ও অবিকৃতভাবে ইসলামের দাওয়াত পায়, তাহলে ইসলাম গ্রহণ করা তার জন্য অবশ্য কর্তব্য হবে।
“যিনি (আল্লাহ) সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন, যাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে পারেন—কে তোমাদের মধ্যে কর্মে শ্রেষ্ঠ। তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাময়।” [45]
“...অতঃপর যদি তোমাদের নিকট আমার পক্ষ থেকে কোনো হেদায়েত পৌঁছে, তবে যে ব্যক্তি আমার সে হেদায়েত অনুসারে চলবে, তার উপর না কোনো ভয় আসবে, না (কোনো কারণে) তারা চিন্তাগ্রস্ত ও সন্তপ্ত হবে। আর যে লোক তা অস্বীকার করবে এবং আমার নিদর্শনগুলোকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার প্রয়াস পাবে, তারাই হবে জাহান্নামবাসী; তারা অনন্তকাল সেখানে থাকবে ।” [46]
এ প্রসঙ্গে ইবন আবিল ইজ্জ হানাফী(র) {১৩৩১-১৩৯০ খ্রি./৭৩১-৭৯২ হি.} বলেছেন, “...কেউ যদি সত্যের প্রমাণ সন্ধান ছাড়াই অন্ধভাবে বাবা-মা’কে অনুসরণ করে এবং তার সামনে প্রকাশ হয়ে যাওয়া সত্যকে অগ্রাহ্য করে, তাহলে সে প্রকৃতপক্ষে নিজ খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করছে। এ থেকে সতর্ক করে আল্লাহ বলেছেন, “এবং যখন তাদেরকে বলা হয় যে, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তা অনুসরণ কর, তখন তারা বলেঃ বরং আমরা ওরই অনুসরণ করব যা আমাদের পিতৃ-পুরুষগণ হতে প্রাপ্ত হয়েছি; যদিও তাদের পিতৃ-পুরুষদের কোনই জ্ঞান ছিলনা এবং তারা সুপথগামীও ছিলনা।” (সুরা বাকারাহ ২:১৭০) এই একই ব্যাপার মুসলিম পরিবারে জন্মানো অনেকের জন্যও সত্য। তারা বিশ্বাস ও কর্মের ক্ষেত্রে তাদের বাপ-দাদাদেরকেই অনুসরণ করে যায়। এগুলো যদি ভুলও হয় তবুও তারা সে ব্যাপারে সচেতন হয় না। এরা পরিবেশের দ্বারা মুসলিম, পছন্দের দ্বারা নয়। যখন এমন কাউকে কবরে জিজ্ঞেস করা হবেঃ “কে তোমার প্রভু?” সে বলবেঃ “হায়, আমি জানি না। আমি জানি না। আমি লোকজনকে কিছু জিনিস বলতে শুনতাম এবং আমিও তাই বলতাম।” [47]
যাদের কাছে পৌঁছেনি সত্য ধর্মের দাওয়াত
এক্ষেত্রে আরেকটি প্রশ্ন আসে যে, অনেকের কাছে তো ইসলামের দাওয়াতই পৌঁছায় না। পৃথিবীতে অনেক দুর্গম জায়গা আছে যেখানে হয়তো ইসলামের দাওয়াত যায়নি। আবার অনেকে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার জন্য (যেমন বার্ধক্য, জ্ঞান লোপ হওয়া) ইসলামের দাওয়াত থেকে বঞ্চিত হয়। এসব ব্যাপারেও ইসলাম আমাদেরকে সুস্পষ্টভাবে অভিহিত করে। আল্লাহ কারো প্রতি সামান্যতম অন্যায় করবেন না। এটি আল্লাহর সিফাত বা গুণ নয় যে তিনি বান্দার প্রতি বিন্দুমাত্রও জুলুম করেন।
“নিশ্চয়ই আল্লাহ কারো প্রতি বিন্দুমাত্রও জুলুম করেন না; আর যদি তা (মানুষের কর্ম) সৎকর্ম হয়, তবে তাকে দ্বিগুণ করে দেন এবং নিজের পক্ষ থেকে বিপুল সওয়াব দান করেন।” [48]
“...বস্তুতঃ আল্লাহ তাদের ওপর কোনো অন্যায় করেননি, কিন্তু তারা নিজেরাই নিজেদের ওপর অত্যাচার করছিলো।” [49]
“তারপর এদের প্রত্যেককে নিজ নিজ পাপের কারণে আমি পাকড়াও করেছিলাম; তাদের কারো ওপর আমি পাথরকুচির ঝড় পাঠিয়েছি, কাউকে পাকড়াও করেছে বিকট আওয়াজ, কাউকে আবার মাটিতে দাবিয়ে দিয়েছি আর কাউকে পানিতে ডুবিয়ে দিয়েছি। আল্লাহ এমন নন যে, তাদের উপর জুলুম করবেন বরং তারা নিজেরা নিজেদের ওপর জুলুম করতো।” [50]
“আর যখন তোমার পালনকর্তা বনী আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে বের করলেন তাদের সন্তানদেরকে এবং নিজের উপর তাদেরকে প্রতিজ্ঞা করালেন, ‘আমি কি তোমাদের পালনকর্তা নই?’ তারা বললো, ‘অবশ্যই, আমরা অঙ্গীকার করছি।’ আবার না কিয়ামতের দিন বলতে শুরু করো যে, এ বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না।” [51]
“কোনো রাসুল না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকেই শাস্তি দান করি না।” [52]
“চার প্রকারের লোক কিয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলার সাথে কথোপকথন করবে। প্রথম হলো বধির লোক, যে কিছুই শুনতে পায় না। দ্বিতীয় হলো সম্পূর্ণ নির্বোধ ও পাগল লোক, যে কিছুই জানে না। তৃতীয় হলো অত্যন্ত বৃদ্ধ, যার জ্ঞান লোপ পেয়েছে। চতুর্থ হলো ঐ ব্যক্তি, যে এমন যুগে জীবন যাপন করেছে যে যুগে কোনো নবী আগমন করেননি বা কোনো ধর্মীয় শিক্ষাও বিদ্যমান ছিলো না। বধির লোকটি বলবে, “ইসলাম এসেছিলো, কিন্তু আমার কানে কোনো শব্দ পৌঁছেনি”। পাগল বলবে, “ইসলাম এসেছিলো বটে, কিন্তু আমার অবস্থা তো এই ছিলো যে শিশুরা আমার ওপর গোবর নিক্ষেপ করতো।” বৃদ্ধ বলবে, “ইসলাম এসেছিলো, কিন্তু আমার জ্ঞান সম্পূর্ণ লোপ পেয়েছিলো, আমি কিছুই বুঝতাম না।” আর যে লোকটির কাছে কোনো রাসুল আসেনি এবং সে তাঁর কোনো শিক্ষাও পায়নি সে বলবে, “আমার কাছে কোনো রাসুল আসেননি এবং আমি কোনো সত্যও পাইনি। সুতরাং আমি আমল করতাম কীভাবে?” তাদের এসব কথা শুনে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে নির্দেশ দেবেন—“আচ্ছা যাও, জাহান্নামে লাফিয়ে পড়ো।” রাসুল (ﷺ) বলেন, “যাঁর হাতে আমার প্রাণ রয়েছে তাঁর শপথ! যদি তারা আল্লাহর আদেশ মেনে নেয় এবং জাহান্নামে লাফিয়ে পড়ে, তবে জাহান্নামের আগুন তাদের জন্য ঠাণ্ডা আরামদায়ক হয়ে যাবে।” অন্য বিবরণে আছে যে, যারা জাহান্নামে লাফিয়ে পড়বে তা তাদের জন্য হয়ে যাবে ঠাণ্ডা ও শান্তিদায়ক। আর যারা বিরত থাকবে, তাদের হুকুম অমান্যের কারণে টেনে হিঁচড়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।”
ইমাম ইবন জারির (রহ.) এই হাদিসটি বর্ণনা করার পরে আবু হুরাইরা (রা.) এর নিম্নের ঘোষণাটি উল্লেখ করেছেন, “এর সত্যতা প্রমাণ হিসেবে তোমরা ইচ্ছা করলে আল্লাহ তা‘আলার وَ مَا كُنَّا مُعَذِّبِينَ حَتَّى نَبْعَثَ رَسُولًا (কোনো রাসুল না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকেই শাস্তি দান করি না।) বাক্যও পাঠ করতে পারো।” [53],[54]
“কিয়ামতের দিন অজ্ঞ ও বোধহীন লোকেরা নিজেদের বোঝা কোমরে বহন করে নিয়ে আসবে এবং আল্লাহ্ তা’আলার সামনে ওজর পেশ করে বলবে, “আমাদের কাছে কোনো রাসুল আসেননি এবং আপনার কোনো হুকুমও পৌঁছেনি। এরূপ হলে আমরা মন খুলে আপনার কথা মেনে চলতাম।”
তখন আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, “আচ্ছা, এখন যা হুকুম করবো তা মানবে তো?” উত্তরে তারা বলবে, “হাঁ, অবশ্যই বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নেবো।” তখন মহামহিমান্বিত আল্লাহ বলবেন, “আচ্ছা যাও, জাহান্নামের পার্শ্বে গিয়ে তাতে প্রবেশ করো।” তারা তখন অগ্রসর হয়ে জাহান্নামের পার্শ্বে পৌঁছে যাবে। সেখানে গিয়ে যখন ওর উত্তেজনা, শব্দ এবং শাস্তি দেখবে তখন ফিরে আসবে এবং বলবে, “হে আল্লাহ! আমাদেরকে এর থেকে রক্ষা করুন।” আল্লাহ তা‘আলা বলবেন, “দেখো, তোমরা অঙ্গীকার করেছো যে, আমার হুকুম মানবে। আবার এই নাফরমানী কেন?” তারা উত্তরে বলবে, “আচ্ছা, এবার মানবো।” অতঃপর তাদের কাছ থেকে দৃঢ় অঙ্গীকার নেয়া হবে। তারপর এরা ফিরে এসে বলবে, “হে আল্লাহ, আমরা তো ভয় পেয়ে গেছি। আমাদের দ্বারা তো আপনার এই আদেশ মান্য করা সম্ভব নয়।” তখন প্রবল প্রতাপান্বিত আল্লাহ বলবেন, “তোমরা নাফরমানি করেছো। সুতরাং এখন লাঞ্ছনার সাথে জাহান্নামি হয়ে যাও।” রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেন যে, “প্রথমবার তারা যদি আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী জাহান্নামে লাফিয়ে পড়তো, তবে তার অগ্নি তাদের জন্য ঠাণ্ডা হয়ে যেতো এবং তাদের দেহের একটি লোমও পুড়তো না।” [55]
আল্লাহর গুণাবলি সম্পর্কে কুরআন ও হাদিস থেকে আমরা যা জানতে পারি তা থেকে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে—যারা আদৌ ইসলামের দাওয়াত পাবে না, তাদের প্রতি পরকালে যে পরীক্ষা হবে তা মোটেও তাদের সাধ্যাতীত কিছু হবে না। অনেক লোকই আগুনের সেই পরীক্ষাতেও নিজ যোগ্যতায় পাশ করে যাবে এবং অনেকে নিজ অযোগ্যতায় ব্যর্থ হবে।
“আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যাতীত কোনো কাজের ভার দেন না; সে তা-ই পায় যা সে উপার্জন করে এবং তা-ই তার ওপর বর্তায় যা সে করে।…” [56]
ইসলাম বলে যে—মানবজাতির কাছ থেকে তাদের জন্মের পূর্বেই আল্লাহ তাঁর একত্ববাদের সাক্ষ্য নিয়েছিলেন। আল্লাহ আদি যুগ থেকে নবী-রাসুল প্রেরণ করে মানুষকে একত্ববাদের ধর্মের দিকে আহ্বান করেছেন। শেষ নবী মুহাম্মাদ (ﷺ) এর মাধ্যমে এই ধর্মের প্রচার আজও আছে। যুগে যুগে প্রত্যেকের কাছেই আল্লাহর পক্ষ থেকে দূত এসেছে। যারা তাদের নিজ যুগের নবীকে মেনেছে বা মানবে, তারা মুক্তি পাবে। আর যাদের কাছে আদৌ এই আহ্বান পৌঁছেনি, তাদের ফয়সালার কথা ইতিমধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে।
“(শুরুতে) সকল মানুষ একই জাতির অন্তর্ভুক্ত ছিলো। তারপর (যখন তাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিলো, তখন) আল্লাহ তা‘আলা নবীদের পাঠালেন সুসংবাদদাতা ও ভীতিপ্রদর্শনকারী হিসাবে। আর তাঁদের সাথে অবর্তীণ করলেন সত্যসম্বলিত কিতাব, যাতে তারা মানুষের মধ্যে সেসব বিষয়ে মীমাংসা করে দেন, যা নিয়ে তাদের মধ্যে মতভেদ ছিলো। আর (পরিতাপের বিষয় হলো,) অন্য কেউ নয়; বরং যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছিলো, তারাই সমুজ্জ্বল নিদর্শনাবলি আসার পরও কেবল পারস্পরিক রেষারেষির কারণে তাতেই (সেই কিতাবেই) মতভেদ সৃষ্টি করলো। তারপর যারা ঈমান এনেছে, আল্লাহ তাদেরকে তারা যে বিষয়ে মতভেদ করতো, সে বিষয়ে নিজ ইচ্ছায় সঠিক পথে পৌঁছে দেন। আর আল্লাহ যাকে চান, তাকে সরল-সঠিক পথে পৌছে দেন।” [57]
“আমি তোমার [মুহাম্মাদ (ﷺ)] পূর্বে পূর্ববর্তী সম্প্রদায়ের মধ্যে রাসুল প্রেরণ করেছি।” [58]
“আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রাসুল প্রেরণ করেছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাগুত(আল্লাহ ব্যতিত যার উপাসনা করা হয়) থেকে নিরাপদ থাকো। এরপর তাদের মধ্যে কিছুসংখ্যককে আল্লাহ হিদায়াত করেছেন এবং কিছু সংখ্যকের জন্যে বিপথগামিতা অবধারিত হয়ে গেলো। সুতরাং তোমরা পৃথিবীতে ভ্রমণ করো এবং দেখো মিথ্যারোপকারীদের কীরূপ পরিণতি হয়েছে।” [59]
“যে-কেউ সৎপথে চলে, তারা নিজের মঙ্গলের জন্যেই সৎপথে চলে। আর যে পথভ্রষ্ট হয়, তারা নিজের অমঙ্গলের জন্যেই পথভ্রষ্ট হয়। কেউ অপরের বোঝা বহন করবে না। কোনো রাসুল না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকেই শাস্তি দান করি না।” [60]
“তোমরা কুফর অবলম্বন করলে নিশ্চিত জেনে রেখো, আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন; তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য কুফর পছন্দ করেন না। আর যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো, তাহলে তিনি তা তোমাদের জন্য পছন্দ করবেন। আর কোনো ভারবাহী অন্যের বোঝা বহন করবে না। তারপর তোমাদের প্রভুর নিকটেই তোমাদের প্রত্যাবর্তন, তখন তিনি তোমাদের জানিয়ে দেবেন যা তোমরা করে যাচ্ছিলে। নিঃসন্দেহে অন্তরের ভেতরে যা আছে, সে সন্বন্ধে তিনি সম্যক অবগত।” [61]
এ ব্যাপারে প্রসিদ্ধ ফতোয়ার ওয়েবসাইট islamqa থেকে শায়খ সালিহ আল মুনাজ্জিদ (হাফিজাহুল্লাহ) এর এই ফতোয়াটি দেখা যেতে পারে:--
“The fate of kuffaar who did not hear the message of Islam” [62]
অমুসলিমদের মারা যাওয়া শিশু সন্তানদের পরিণতি কী হবে?
প্রত্যেক মানুষকেই স্রষ্টা আল্লাহ সঠিক ফিতরাত বা স্বভাবধর্মের ওপর সৃষ্টি করেন। আর সেটি হচ্ছে একত্ববাদ, স্রষ্টার প্রতি পূর্ণাঙ্গ আত্মসমর্পণ বা ইসলাম। পরবর্তীতে মানুষ পিতামাতা ও পারিপার্শ্বিক প্রভাবে বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাস লাভ করে। বিভিন্ন অমুসলিম সম্প্রদায় (হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, ইহুদি) এর শিশু সন্তানের ব্যাপারে ইসলাম যা বলে—
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) ইরশাদ করেছেন, “প্রতিটি নবজাতকই জন্মলাভ করে ফিতরাতের ওপর। এরপর তার মা-বাপ তাকে ইহুদি বা খ্রিষ্টান বা অগ্নিপূজারীরূপে গড়ে তোলে। যেমন, চতুষ্পদ পশু একটি পূর্ণাঙ্গ বাচ্চা জন্ম দেয়। তোমরা কি তাদের মধ্যে কোনো (জন্মগত) কানকাটা দেখতে পাও?” পরে আবু হুরায়রা (রা.) তিলাওয়াত করলেন—
فِطْرَةَ اللَّهِ الَّتِي فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا لاَ تَبْدِيلَ لِخَلْقِ اللَّهِ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ
“আল্লাহর দেয়া ফিতরাতের (অর্থাৎ, ইসলাম) অনুসরণ করো, যে ফিতরাতের ওপর তিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন। এটাই সরল সুদৃঢ় দ্বীন।” (সুরা রূম: ৩০:৩০) [63]
সামুরা ইবন জুনদুব (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (ﷺ) প্রায়ই তাঁর সাহাবীদেরকে (রা.) বলতেন, তোমাদের কেউ কোনো স্বপ্ন দেখেছো কি? রাবি বলেন, যাদের বেলায় আল্লাহর ইচ্ছা, তারা রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এর কাছে স্বপ্ন বর্ণনা করতো।
তিনি [রাসুলুল্লাহ (ﷺ)] একদিন সকালে আমাদের বললেন, গত রাতে আমার কাছে দু’জন আগন্তুক আসলেন। তাঁরা আমাকে ওঠালেন। আর আমাকে বললো, চলুন। ......তাঁরা আমাকে বললেন, চলুন, চলুন। তিনি বলেন, আমরা চললাম এবং একটা সজীব শ্যামল বাগানে উপনীত হলাম, যেখানে বসন্তের হরেক রকম ফুলের কলি রয়েছে। আর বাগানের মাঝে আসমানের থেকে অধিক উঁচু দীর্ঘকায় একজন পুরুষ রয়েছে, যার মাথা যেন আমি দেখতেই পাচ্ছি না। এমনিভাবে তার চতুষ্পার্শে এতো বিপুল সংখ্যক বালক-বালিকা দেখলাম যে, এতো বেশি আর কখনো আমি দেখিনি। আমি [মুহাম্মাদ (ﷺ)] তাদেরকে বললাম, উনি কে? এরা কারা? তাঁরা আমাকে বললেন, চলুন, চলুন। ...... আর ঐ দীর্ঘকায় ব্যক্তি যিনি বাগানে ছিলেন, তিনি হলেন, ইবরাহিম (আ.)। আর তাঁর আশেপাশের বালক-বালিকারা হলো ঐসব শিশু, যারা ফিতরাত (স্বভাবধর্মের) ওপর মৃত্যুবরণ করেছে। তিনি বলেন, তখন কিছু সংখ্যক মুসলিম জিজ্ঞাসা করলেন, হে আল্লাহর রাসুল (ﷺ)! মুশরিকদের(বহু ঈশ্বরবাদী/পৌত্তলিক) শিশু সন্তানরাও কি? তখন রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, মুশরিকদের শিশু সন্তানরাও। ...” [64]
রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, “প্রত্যেক শিশু ফিতরাতের ওপর জন্মগ্রহণ করে থাকে।” জনগণ তখন উচ্চস্বরে তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, “মুশরিকদের শিশুরাও কি?” উত্তরে তিনি বলেন, “মুশরিকদের শিশুরাও।” [65]
রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন যে, “মুশরিকদের শিশুদেরকে জান্নাতবাসীদের খাদেম বানানো হবে। “ [66]
হাসনা বিন্ত মুআবিয়া (র.) বানী সুরাইম (র.) হতে বলেন যে, তাঁর চাচা তাঁকে বলেছেনঃ আমি জিজ্ঞেস করলাম, “হে আল্লাহর রাসুল (ﷺ), জান্নাতে কারা কারা যাবে? জবাবে তিনি বলেনঃ ‘শহীদ, শিশু এবং জীবন্ত প্রোথিত মেয়ে শিশুরা।'[67]
এ ব্যাপারে আরো ভিন্ন ভিন্ন রেওয়ায়েত আছে। এ সংক্রান্ত বিভিন্ন হাদিস পর্যালোচনা করে সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ইবন হাজার আসকালানী(র.) এর অভিমত হচ্ছেঃ প্রাপ্তবয়স্ক হবার আগে অমুসলিমদের যে শিশুসন্তানরা মারা যায়, তারা জান্নাতী হবে। [68] নওয়াভী(র.) থেকেও অনুরূপ অভিমত বর্ণিত আছে। [69]
শিশু অবস্থায় মারা গেলে সেটি তাদের জন্য ওজর হিসাবে গণ্য হতে পারে। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় যে কোনো মানুষের বুদ্ধি ও বিবেক থাকে। এই সময়ে যদি তার কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছায় এবং সে যদি তা গ্রহণ না করে, তাহলে হিন্দু, খ্রিষ্টান বা নাস্তিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করা তার জন্য অজুহাত হতে পারে না। নিজ কর্মের জন্যই সে জাহান্নামের উপযুক্ত হয়। তার জন্য নির্ধারিত পরীক্ষায় অকৃতকার্য হবার দ্বারা। পৃথিবীতে বহু মানুষ এই পরীক্ষায় কৃতকার্য হচ্ছে, অমুসলিম থেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছে।
উপসংহার:
আমরা উপসংহারে বলতে পারি যে— দুনিয়াতে যার নিকট ইসলামের দাওয়াত পৌঁছেছে এবং সে তা অস্বীকার করেছে, পরকালে তার আর কোনো ওজর পেশ করার সুযোগ নেই। যাদের নিকট দুনিয়াতে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছেনি, পরকালে তাদের এক প্রকারের পরীক্ষা হবে এবং তাতে উত্তীর্ণ ব্যক্তিরা মুক্তিলাভ করবে। সকলের প্রতি ন্যায়বিচার করা হবে, কারো প্রতি সামান্যতম জুলুমও করা হবে না। পৃথিবীতে অন্যায় আছে বলেই ন্যায়ের মহিমা প্রকাশ পায়। পাপ না থাকলে পূণ্য বলে কিছু থাকতো না, পূণ্যবানের পূণ্যের কোনো মূল্য থাকতো না। পৃথিবীতে যত অন্যায়-অপরাধ হয়, এর কোনোটির উপর আল্লাহর সন্তুষ্টি নেই। আল্লাহ মানুষের তাকদির নির্ধারণ করেছেন। মানুষকে ইচ্ছাশক্তিও দিয়েছেন, মানুষের বিশ্বাস ও কর্ম দ্বারা সে জান্নাত বা জাহান্নামের উপযোগী হয়। আল্লাহ মানুষের প্রতি বিন্দুমাত্র জুলুমও করেন না। পরিণতি জানা সত্ত্বেও আল্লাহ মানুষকে দুনিয়ার পরীক্ষাক্ষেত্রে পাঠান, তার ভালো-মন্দ পরীক্ষা করার জন্য। মানুষের কর্ম অনুযায়ী আল্লাহ এর প্রতিদান দেন। আল্লাহ সব থেকে বড় ন্যায়বিচারক। মানুষকে চেতনা, বিবেক ও বিচারবুদ্ধি দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ মানুষকে বিবেক-বুদ্ধি এইজন্য দিয়েছেন যেন মানুষ তা ব্যবহার করে। সুনির্দিষ্টভাবে সাহাবীদের—“ তাহলে আমরা কাজ-কর্ম ছেড়ে কি ভরসা করে বসে থাকব না??”—প্রশ্নের উত্তরে রাসুল (ﷺ) এটি করতে নিষেধ করেছেন এবং সাধ্যানুযায়ী সৎকর্মের উপদেশ দিয়েছেন। মানুষ যদি এরপরেও তাকদিরের ওপর দোষ দিয়ে বসে থাকে ও সৎকর্ম না করে, তবে এজন্য আল্লাহ মোটেও দায়ী নন। কারণ তাকে তো তার তাকদির জানিয়ে দেয়া হয়নি। কে তাকে বলে দিয়েছে যে সে জাহান্নামেই যাবে? বরং এই বসে থাকাটাই তার জন্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে।
এবং আল্লাহই ভালো জানেন।
এ প্রসঙ্গে আরো পড়ুনঃ
জান্নাতীদের আমল করা কাউকে কি শুধুমাত্র তাকদিরের প্রভাবে জোর করে জাহান্নামী বানিয়ে দেয়া হয়?
কেউ যদি ইসলামের ভুল বার্তা পেয়ে মুসলিম না হয়েই মারা যায় তবে তার কী হবে?
আল্লাহ যদি আগে থেকেই সব কিছু জেনে থাকেন তাহলে কেন মানুষের পরীক্ষা নেন?
যার উপর নূরের আলোকপ্রভা পড়েছে সে সৎপথ পেয়েছে যার উপর পড়েনি সে পথভ্রষ্ট হয়েছে–এই হাদিসের ব্যাখ্যা
যে মেয়েকে জীবন্ত কবর দেওয়া হয় এবং যে কবর দেয় - উভয় কি জাহান্নামী?
তথ্যসূত্রঃ
[1] ইবনু ফারিস, মু’জামু মাকায়িসিল লুগাহ ৫/৫৬;
‘কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা’ – খন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর(র); পৃষ্ঠা ৩৩৯
[2] ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের আকীদা’ – শায়খ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল উসাইমিন(র), পৃষ্ঠা ৮২ (islamhouse)
[3] আল-কুরআন, সুরা আন-নাহল ১৬:৭৭
[4] আল-কুরআন, সুরা হাজ ২২:৭০
[5] আল-কুরআন, সুরা আন‘আম ৬:৫৯
[6] আল-কুরআন, সুরা ইউসুফ ১২:১০২
[7] আল-কুরআন, সুরা আন‘আম ৬:৭৩
[8] আল-কুরআন, সুরা লুকমান ৩১:৩৪
[9] আল-কুরআন, সুরা তাগাবুন ৬৪:১৮
[10] আল-কুরআন, সুরা আ’রাফ ৭:২৮
[11] ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের আকীদা’ – শায়খ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল উসাইমিন(র), পৃষ্ঠা ২০-২২ (islamhouse)
[12] আল-কুরআন, সুরা বাকারাহ ২:২৫৩
[13] আল-কুরআন, সুরা নিসা ৪:২৭
[14] ‘Are we Forced or do we have a Free Will’ by Shaykh Muhammad Ibn Salih Al Uthaymeen; page 27-29;
ডাউনলোড লিঙ্কঃ https://drive.google.com/file/d/1ccqWYhrsbD7qdeP6bFNmwvRYoXeZagEs/view?usp=sharing
[15] ‘শারহ আকিদা আত ত্বহাওয়ী’ – ইবন আবিল ইজ্জ হানাফী(র); পৃষ্ঠা ৩৮(ইংরেজি অনুবাদ)
[16] ‘Are we Forced or do we have a Free Will’ by Shaykh Muhammad Ibn Salih Al Uthaymeen; page 32
[17] আল-কুরআন, সুরা বালাদ ৯০:৪
[18] আল-কুরআন, সুরা ইউনুস ১০:৩০
[19] আল-কুরআন, সুরা হুদ ১১: ১১১, ১১৫
[20] আল-কুরআন, সুরা ইয়াসিন ৩৬:৫৪
[21] আল-কুরআন, সুরা মু’মিন(গাফির) ৪০:৪০
[22] আল-কুরআন, সুরা আলি ইমরান ৩:১৩৬
[23] আল-কুরআন, সুরা নিসা ৪:১২৪
[24] আল-কুরআন, সুরা নাহল ১৬:৯৬-৯৭
[25] আল-কুরআন, সুরা আনকাবুত ২৯:৬-৭
[26] আল-কুরআন, সুরা আহকাফ ৪৬:১৩-১৪
[27] আল-কুরআন, সুরা দাহর(ইনসান) ৭৬:২২
[28] আল-কুরআন, সুরা আ’রাফ ৭:১৪৭
[29] আল-কুরআন, সুরা ইউনুস ১০:৭০
[30] আল-কুরআন, সুরা কাহফ ১৮:৪৭-৪৯
[31] আল-কুরআন, সুরা ইয়াসিন ৩৬:৫৯-৬৪
[32] আল-কুরআন, সুরা আন‘আম ৬:১৪৮-১৪৯
[33] সহীহ মুসলিম, হাদিস: ৬৪৯২
[34] সুনান তিরমিযি, হাদিস: ২৫১৭, হাসান
[35] আল-কুরআন, সুরা বাকারাহ ২:১৪৩
[36] আল-কুরআন, সুরা বুরুজ ৮৫:১৩-১৫
[37] সহীহ বুখারি, হাদিসঃ ৫৯৯৯; সহীহ মুসলিম, হাদিসঃ ২৭৫৪
[38] সহীহ মুসলিম, খণ্ড ১, হাদিস ২৩৬
[39] আল ওয়াসিত্বিয়া মা’আ শারহ হাররাস, পৃষ্ঠা ৬৫;
“Is man’s fate pre-destined or does he have freedom of will?” (islamQA - Shaykh Muhammad Saalih al-Munajjid)
[40] ‘Are we Forced or do we have a Free Will’ by Shaykh Muhammad Ibn Salih Al Uthaymeen; page 54-55
মূল আরবির জন্য দেখুনঃ শারহ হাদিস জিব্রীল [শায়খ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল উসাইমিন(র)]
ডাউনলোড লিঙ্কঃ https://goo.gl/mGrWGn অথবা http://bit.ly/2jjYxnQ
[41] ‘ফতোওয়া আরকানুল ইসলাম’ – শায়খ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল উসাইমিন(র); পৃষ্ঠা ১০৫-১০৬
‘তাক্বদীর—আল্লাহর এক গোপন রহস্য’ – আব্দুল আলীম ইবন কাওছার; পৃষ্ঠা ৩১
[42] আল-কুরআন, সুরা দাহর (ইনসান) ৭৬:২-৩
[43] আল-কুরআন, সুরা বালাদ ৯০:৮-১০
[44] সুনান তিরমিজি, হাদিস: ২৬১৯-২৬২৩
[45] আল-কুরআন, সুরা মুলক ৬৭:২
[46] আল-কুরআন, সুরা বাকারাহ ২:৩৮-৩৯
[47] ‘শারহ আকিদা আত ত্বহাওয়ী’ – ইবন আবিল ইজ্জ হানাফী(র); পৃষ্ঠা ১৯০(ইংরেজি অনুবাদ)
[48] আল-কুরআন, সুরা নিসা ৪:৪০
[49] আল-কুরআন, সুরা আলি ইমরান ৩:১১৭
[50] আল-কুরআন, সূরা আনকাবুত ২৯:৪০
[51] আল-কুরআন, সুরা আ‘রাফ ৭:১৭২
[52] আল-কুরআন, সুরা বনী ইসরাইল (ইসরা) ১৭:১৫
[53] মুসনাদ আহমাদ, তাফসির ইবন কাসির {তাফসির পাবলিকেশন কমিটি (ড. মুজিবুর রহমান)}, সুরা বনী ইসরাইল ১৫ নং আয়াতের তাফসির
[54] ইমাম মুহাম্মাদ ইবন ইয়াহইয়া যাহলী (র) কর্তৃক বর্ণিত একটি রেওয়াতে নবীশূন্য যুগের লোক, পাগল ও শিশুর কথাও এসেছে
[55] মুসনাদ বাযযার, ইমাম ইবন কাসির (রহ.) এর মতে ইমাম ইবন হিব্বান (রহ.) নির্ভরযোগ্যরূপে বর্ণনা করেছেন; তাফসির ইবন কাসির {তাফসির পাবলিকেশন কমিটি (ড. মুজিবুর রহমান)}, সুরা বনী ইসরাইল ১৫ নং আয়াতের তাফসির, ইয়াহইয়া ইবন মুঈন (রহ.) ও নাসাঈ (রহ.) এর মতে এতে (সনদের ব্যাপারে) ভয়ের কোনো কারণ নেই।
[56] আল-কুরআন, সুরা বাকারাহ ২:২৮৬
[57] আল-কুরআন, সুরা বাকারাহ ২:২১৩
[58] আল-কুরআন, সুরা হিজর ১৫:১০
[59] আল-কুরআন, সুরা নাহল ১৬:৩৬
[60] আল-কুরআন, সুরা ইসরা ১৭:১৫
[61] আল-কুরআন, সুরা যুমার ৩৯:৭
[62] https://islamqa.info/en/1244
[63] সহীহ বুখারি, হাদিস: ৯৫৩১
[64] সহীহ বুখারি; খণ্ড ৯, অধ্যায় ৮৭ (স্বপ্নের ব্যাখ্যা প্রদান অধ্যায়), হাদিস নং ১৭১
[65] সহীহ বুখারি, হাদিস নং : ৭০৪৭
[66] তাবারানি, মুজাম আল কাবির ৭/২৪৪, আল মাজমা ৭/২১৯, তাফসির ইবন কাসির, সুরা বনী ইসরাইলের ১৫ নং আয়াতের তাফসির
[67] আহমাদ ৫/৫৮, আল মাজমা ৭/২১৯, তাফসির ইবন কাসির, সুরা বনী ইসরাইলের ১৫ নং আয়াতের তাফসির
[68]"They will be from amongst the dwellers of Jannah (paradise) according to the nature of Islam that every child is created upon. In the famous Hadith, Rasoolullah Sallahu alaihi wasallam has said: ‘ Every born child is created upon the fitrah (natural religion of Islam in which there is inclination to Tawhid, the oneness of Allah). Thereafter, his/her parents make him Jew, Chistian or a Fire-Worshipper.’
From this Hadith we learn that every child is born Muslim, so according to it, if a child dies before reaching the age of understanding, then he should be granted entry into Paradise. Hafiz Ibn Hajar, one of the leading Hadith Scholars of all tme is inclined towards this view. He states: ‘ The Hadith mentioned above was narrated by the Prophet before anything concrete was revealed to him about the dying children of the non-believers. This is why the Prophet left it to Allah’s knowledge and didn’t make a judgement."
From: "Do All Kids Go To Heaven - IslamQA Hanafi"
http://islamqa.org/hanafi/muftisays/9358
[69] নওয়াভী (রহ.) বলেন, মুসলিমদের শিশু সর্বসম্মতি মতে জান্নাতী। আর মুশরিকদের শিশুদের ব্যাপারে তিনটি অভিমত রহিয়াছে : অধিকাংশের মতে পিতা-মাতার সহিত জাহান্নামে যাইবে। আর কতিপয় আলিম তাওয়াকফ করিয়াছেন। আর সহীহ অভিমত হইতেছে যাহা মুহাককিকীনের অভিমত, তাহারা জান্নাতী। তাহারা এই হাদীছের জবাব দিয়াছেন যে, ইহাতে জাহান্নামে যাওয়ার কথা উল্লেখ নাই; বরং ইহার মর্ম এইরূপ যে, সে বয়াে-প্রাপ্ত হইলে আল্লাহ জানেন সে কি আমল করিত। (নওয়াভী ২:৩৩৭)
শারহে সহীহ মুসলিম - মাওলানা মুহাম্মাদ আবুল ফাতাহ ভূঞা, পৃষ্ঠা ৩০৩