Pray for the world economy

নবী(ﷺ) এবং সাহাবী(রা.)গণ কি কুরআনের কিছু আয়াত ভুলে গিয়েছিলেন?

 

ইসলামবিরোধীরা কিছু হাদিস দেখিয়ে অভিযোগ করে স্বয়ং নবী() নাকি কুরআনের আয়াত ভুলে গিয়েছিলেন। তারা আরো দাবি করে হাদিসের এই তথ্য কুরআনের সাথে সাংঘর্ষিক যেখানে আল্লাহ বলেছেন তিনি নবী()কে কুরআনের আয়াত ভুলতে দেবেন না। তারা আরো দাবি করে যে, নবী() এর সাহাবীরাও নাকি কুরআনের কিছু আয়াত ভুলে গিয়েছিলেন। এরূপ দাবি করে তারা প্রমাণের চেষ্টা করে যে কুরআনের কিছু আয়াত চিরতরে হারিয়ে গেছে এবং কুরআন আর সংরক্ষিত নেই (নাউযুবিল্লাহ)।    

 

নবী() কি কুরআনের কিছু আয়াত ভুলে গিয়েছিলেন?

ইসলামবিরোধীরা তাদের দাবির স্বপক্ষে নিম্নোক্ত হাদিস পেশ করে—

 

عَنْ عَائِشَةَ ـ رضى الله عنها ـ قَالَتْ سَمِعَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم رَجُلاً يَقْرَأُ فِي الْمَسْجِدِ فَقَالَ " رَحِمَهُ اللَّهُ، لَقَدْ أَذْكَرَنِي كَذَا وَكَذَا آيَةً أَسْقَطْتُهَا فِي سُورَةِ كَذَا وَكَذَا "‏‏.

অর্থঃ "আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী এক ব্যাক্তিকে মসজিদে কুরআন তিলাওয়াত করতে বললেন। তখন তিনি বললেনঃ আল্লাহ তার উপর রহমত করুন। সে আমাকে অমুক অমুক আয়াত স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, যা আমি অমুক অমুক সূরা থেকে ভুলে গিয়েছিলাম।" [1]

 

অনুরূপ রেওয়ায়েত আরো বিভিন্ন স্থানে আছে।

ইসলামবিরোধীরা কুরআনের একটি আয়াত উদ্ধৃত করে দাবি করে, এই আয়াতটি হাদিসের তথ্যের সাথের সাংঘর্ষিক—

 

سَنُقۡرِئُكَ فَلَا تَنۡسٰۤیۙ

অর্থঃ "অচিরেই আমি তোমাকে পাঠ করাব, ফলে তুমি ভুলবে না।" [2]

 

ইসলামবিরোধীরা এই আয়াত উদ্ধৃত করে এটা বোঝানোর চেষ্টা করে যে, কুরআন ও হাদিসের তথ্য এখানে সাংঘর্ষিক এবং একটি অন্যটিকে ভুল প্রমাণ করে (নাউযুবিল্লাহ)। কিন্তু তারা এখানে প্রতারণামূলকভাবে এর ঠিক পরের আয়াতটি উল্লেখ করে না। ঐ আয়াত উল্লেখ করলেই ইসলামবিরোধীদের এই বিভ্রান্তিমূলক অভিযোগ আনার আর কোনো সুযোগ থাকতো না এবং বোঝা যেতো যে কুরআন ও হাদিসের তথ্যে কোনো পরস্পরবিরোধিতা নেই। সুরা আ’লাতে এর ঠিক পরের আয়াতেই বলা হয়েছে—

 

اِلَّا مَا شَآءَ اللّٰهُ ؕ اِنَّهٗ یَعۡلَمُ الۡجَهۡرَ وَ مَا یَخۡفٰی ؕ

অর্থঃ "আল্লাহ যা ইচ্ছা করবেন তা ব্যতীত, নিশ্চয়ই তিনি ব্যক্ত ও গুপ্ত বিষয় পরিজ্ঞাত আছেন।" [3]

 

আল কুরআনে আরো উল্লেখ আছে—

 

مَا نَنۡسَخۡ مِنۡ اٰیَۃٍ اَوۡ نُنۡسِهَا نَاۡتِ بِخَیۡرٍ مِّنۡهَاۤ اَوۡ مِثۡلِهَا ؕ

অর্থঃ "আমি যে আয়াত রহিত করি কিংবা ভুলিয়ে দেই, তার চেয়ে উত্তম কিংবা তার মত [আয়াত] আনয়ন করি। ... " [4]

 

আলোচ্য আয়াতসমূহের সরল অনুবাদ থেকেই এটা বোঝা যাচ্ছে যে, আল্লাহ তা’আলা নবী()কে আয়াত ভুলে যাওয়া থেকে রক্ষা করবেন এটা যেমন সত্য, তেমনি তিনি ইচ্ছা করলে কিছু আয়াত ভুলিয়েও দিতে পারেন। সুরা আ’লার আলোচ্য আয়াতসমূহের ব্যাখ্যায় আল কুরআনের সর্বপ্রাচীন তাফসির গ্রন্থের অন্যতম ‘তাফসির তাবারী’তে উল্লেখ করা হয়েছে—

 

বাশার......হযরত আবূ কাতাদাহ (রা) হতে বর্ণনা করেছেন যে, سَنُقۡرِئُكَ فَلَا تَنۡسٰۤی ۙ এর তাৎপর্য এই যে, রাসূলুল্লাহ্ (সা) আল্লাহ্ তরফ হতে ওহী স্বরূপ যা পাঠ করতেন, তা কখনও বিস্মৃত হতেন না। অবশ্য আল্লাহ্ যা ইচ্ছা করবেন তা ব্যতীত।

কেউ কেউ বলেন এখানে تَنۡسٰۤی শব্দের অর্থ হলো ترك বা পরিহার করা।

আবার কারো কারো মতে এর অর্থ “হে মুহাম্মদ (সা) তুমি তোমার প্রভুর তরফ হতে যা পাঠ করবে, কখনও তার আমল পরিহার করবে না অবশ্য আল্লাহ্ যা ইচ্ছা করবেন এবং তা মনসূখ বাতিল বলে ঘোষণা দেবেন, তা ব্যতীত।[5]

 

আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসির ইবন কাসিরে বলা হয়েছেঃ

 

অর্থাৎ আল্লাহ্ তা'আলা ওয়াদা করিতেছেন যে, হে মুহাম্মদ! নিশ্চয় আমি তোমাকে পাঠ করাইব, ফলে তুমি উহা ভুলিয়া যাইবে না। তবে আল্লাহ্ কোন কিছু ভুলাইয়া দিতে চাইলে তাহা স্বতন্ত্র কথা ।

কাতাদা (র) বলেনঃ আল্লাহ্ যাহা চাহিতেন, তাহা ব্যতীত রাসূলুল্লাহ্ (সা) কিছুই ভুলিতেন না। মোটকথা, আয়াতের মর্ম হইল এই যে, কুরআনের কোন অংশই ভুলিবে না। তবে কোন আয়াত রহিত করিয়া নিলে উহা স্মরণ রাখা তোমার দায়িত্ব নহে।[6]

 

অতএব আল কুরআন থেকে এটি স্পষ্ট হল যে, আল্লাহ তা’আলা ইচ্ছা করলে নবী()কে কিছু আয়াত ভুলিয়ে দিতে পারেন। তাফসিরসমূহে উল্লেখ আছে যে, এই ভুলে যাওয়ার মধ্যে অন্যতম বিষয় হল মানসুখ বা রহিত আয়াতসমূহ।

 

এবার আমরা সেই হাদিসগুলোর প্রসঙ্গে আসি, যেগুলোতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নবী() কিছু আয়াত ভুলে গিয়েছিলেন এবং একজন ব্যক্তির তিলাওয়াতের দ্বারা তাঁর সেই আয়াতগুলো স্মরণ হয়েছিল। হাদিসের সরল অনুবাদ দেখলেই বোঝা যায় যে, এখানে কুরআনের কোনো আয়াত হারিয়ে যাবার সম্ভাবনা নেই। কারণ সেই সময়টিতে যে আয়াতগুলো নবী() এর স্মরণে ছিল না, সেই আয়াতগুলো একজন সাহাবী পাঠ করছিলেন। অর্থাৎ সেই আয়াতগুলো সাহাবীদের নিকট ইতিমধ্যেই ছিল। ইসলামবিরোধীদের পেশকৃত হাদিস দ্বারাই তাদের বিভ্রান্তিকর দাবি খণ্ডন হয়ে যায়। এখন প্রশ্ন আসতে পারে যে, সেই মুহূর্তটিতেও বা কেন সেই আয়াতগুলো নবী() এর স্মরণে ছিল না? এই সংক্রান্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবন হাজার আসকালানী(র.) তাঁর সুবিখ্যাত ‘ফাতহুল বারী’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন—

 

قَالَ الْإِسْمَاعِيلِيُّ: النِّسْيَانُ مِنَ النَّبِيِّ لِشَيْءٍ مِنَ الْقُرْآنِ يَكُونُ عَلَى قِسْمَيْنِ: أَحَدُهُمَا: نِسْيَانُهُ الَّذِي يَتَذَكَّرُهُ عَنْ قُرْبٍ، وَذَلِكَ قَائِمٌ بِالطِّبَاعِ الْبَشَرِيَّةِ، وَعَلَيْهِ يَدُلُّ قَوْلُهُ فِي حَدِيثِ ابْنِ مَسْعُودٍ فِي السَّهْوِ: إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ أَنْسَى كَمَا تَنْسَوْنَ. وَالثَّانِي: أَنْ يَرْفَعَهُ اللَّهُ عَنْ قَلْبِهِ عَلَى إِرَادَةِ نَسْخِ تِلَاوَتِهِ، وَهُوَ الْمُشَارُ إِلَيْهِ بِالِاسْتِثْنَاءِ فِي قَوْلِهِ تَعَالَى: ﴿سَنُقْرِئُكَ فَلا تَنْسَى إِلا مَا شَاءَ اللَّهُ﴾

قَالَ: فَأَمَّا الْقِسْمُ الْأَوَّلُ فَعَارِضٌ سَرِيعُ الزَّوَالِ لِظَاهِرِ قَوْلِهِ تَعَالَى: ﴿إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ﴾ وَأَمَّا الثَّانِي فَدَاخِلٌ فِي قَوْلِهِ تَعَالَى: ﴿مَا نَنْسَخْ مِنْ آيَةٍ أَوْ نُنْسِهَا﴾

অর্থঃ “ইসমাঈলী(র.) বলেনঃ নবী -এর পক্ষ থেকে কুরআনের কোনো কিছু ভুলে যাওয়া ২ প্রকার হতে পারে

প্রথমটি হলোঃ এমন ভুলে যাওয়া, যা তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই স্মরণ করে নেন। আর এটি মানুষের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যের অন্তর্গত। আর তাঁর উক্তির মাঝেই এর দলিল আছে, যা [সিজদাহ] সাহু প্রসঙ্গে ইবনু মাসউদের(রা.) হাদিসে এসেছেঃ “আমি তো তোমাদের মতোই একজন মানুষ, আমি ভুলে যাই যেমন তোমরাও ভুলে যাও।” [বুখারী ৪০১]

দ্বিতীয়টি হলোঃ আল্লাহ তা‘আলা কোনো আয়াতের তিলাওয়াত রহিত করার ইচ্ছায় তা তাঁর হৃদয় থেকে উঠিয়ে দেন। এই ব্যতিক্রমী বিষয়টির ইঙ্গিত রয়েছে আল্লাহর বাণীতেঃ “অচিরেই আমি তোমাকে পাঠ করাব, ফলে তুমি ভুলবে নাআল্লাহ যা ইচ্ছা করবেন তা ব্যতীত, … ” [সুরা আ’লা ৮৭:৬-৭]।

তিনি বলেনঃ প্রথম প্রকারটি হলো এক ধরণের সাময়িক বিষয়, যা দ্রুত চলে যায়। যা আল্লাহ তা‘আলার বাণী দ্বারা স্পষ্ট হয়ঃ “নিশ্চয় আমিই কুরআন নাযিল করেছি আর অবশ্যই আমি তার সংরক্ষক।” [সুরা হিজর ১৫ : ৯] আর দ্বিতীয় প্রকারটি আল্লাহর এই বাণীর অন্তর্ভুক্তঃ “আমি যে আয়াত রহিত করি কিংবা ভুলিয়ে দেই, …” [সুরা বাকারাহ ২ : ১০৬]। [7]

 

সাময়িকভাবে কোনো কিছু মনে করতে না পারা আর স্থায়ীভাবে স্মৃতি থেকে কোনো কিছু চলে যাওয়া এক জিনিস নয়। কুরআনের ব্যাপারে নবী এর ক্ষেত্রে ১মটি ঘটতো; ২য়টি ঘটতো না। আর আলোচ্য হাদিসে এই ১ম বিষয়টিরই উল্লেখ আছে। একজন মানুষ হিসেবে কখনো কখনো কুরআনের কিছু আয়াত নবী এর মনে আসতে সময় লাগতো যাকে তিনি “ভুলে যাওয়া” বলে অবহিত করতেন। কিন্তু অল্প সময় পরেই তা তাঁর স্মৃতিতে চলে আসতো কেননা আল্লাহ তা’আলা তাঁকে কুরআন স্থায়ীভাবে ভুলে যাওয়া থেকে হেফাজত করেছিলেন। মানসুখ নয় এমন কোনো আয়াতকে নবী স্থায়ীভাবে ভুলে যেতেন না। তাঁর অন্তরে যদি অসাধুতা থাকতো এবং তিনি যদি মিথ্যাবাদী বা ভণ্ড নবী হতেন, তাহলে তিনি তাঁর সামান্যতম মানবীয় সীমাবদ্ধতাকেও স্বীকার করতেন না। কিন্তু তিনি অকপটে এবং বিনয়ের সঙ্গে নিজ মানবীয় সীমাবদ্ধতাকে স্বীকার করতেন যা তাঁর এই উক্তির অনুরূপ—

 

عَنْ عُمَرَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَا تُطْرُونِي كَمَا أَطْرَتْ النَّصَارَى عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ، فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدٌ، فَقُولُوا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ

অর্থঃ "উমার (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ বলেছেনঃ খৃষ্টানরা যেমন ঈসা ইবনে মারইয়াম (আঃ) এর প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করতো, তেমনি তোমরা আমার প্রশংসায় বাড়াবাড়ি করো না। আমি তো কেবল আল্লাহর বান্দা ও রাসূল।" [8]

 

সাহাবী(রা.)গণ কি কুরআনের কিছু আয়াত ভুলে গিয়েছিলেন?

ইসলামবিরোধীরা তাদের দাবির স্বপক্ষে নিম্নোক্ত হাদিস পেশ করে—

 

بَعَثَ أَبُو مُوسَى الأَشْعَرِيُّ إِلَى قُرَّاءِ أَهْلِ الْبَصْرَةِ فَدَخَلَ عَلَيْهِ ثَلاَثُمِائَةِ رَجُلٍ قَدْ قَرَءُوا الْقُرْآنَ فَقَالَ أَنْتُمْ خِيَارُ أَهْلِ الْبَصْرَةِ وَقُرَّاؤُهُمْ فَاتْلُوهُ وَلاَ يَطُولَنَّ عَلَيْكُمُ الأَمَدُ فَتَقْسُوَ قُلُوبُكُمْ كَمَا قَسَتْ قُلُوبُ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ وَإِنَّا كُنَّا نَقْرَأُ سُورَةً كُنَّا نُشَبِّهُهَا فِي الطُّولِ وَالشِّدَّةِ بِبَرَاءَةَ فَأُنْسِيتُهَا غَيْرَ أَنِّي قَدْ حَفِظْتُ مِنْهَا لَوْ كَانَ لاِبْنِ آدَمَ وَادِيَانِ مِنْ مَالٍ لاَبْتَغَى وَادِيًا ثَالِثًا وَلاَ يَمْلأُ جَوْفَ ابْنِ آدَمَ إِلاَّ التُّرَابُ . وَكُنَّا نَقْرَأُ سُورَةً كُنَّا نُشَبِّهُهَا بِإِحْدَى الْمُسَبِّحَاتِ فَأُنْسِيتُهَا غَيْرَ أَنِّي حَفِظْتُ مِنْهَا ( يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لِمَ تَقُولُونَ مَا لاَ تَفْعَلُونَ‏) فَتُكْتَبُ شَهَادَةً فِي أَعْنَاقِكُمْ فَتُسْأَلُونَ عَنْهَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ .

অর্থঃ "আবূ মূসা আল আশ’আরী (রাযীঃ) একবার বাসরার কারীদেরকে (আলিমদের) ডেকে পাঠালেন। অতঃপর সেখানকার তিনশ’ কারী তার কাছে আসলেন এবং কুরআন পাঠ করলেন। তিনি (তাদের উদ্দেশে) বললেন, আপনারা বাসরার মধ্যে উত্তম লোক এবং সেখানকার কারী। সুতরাং আপনারা অনবরত কুরআন পাঠ করতে থাকুন। অলসতায় দীর্ঘ সময় যেন কেটে না যায়। তাহলে আপনাদের অন্তর কঠিন হয়ে যেতে পারে যেমন আপনাদের পূর্ববর্তী একদল লোকের অন্তর কঠিন হয়ে গিয়েছিল। আমরা একটি সূরা পাঠ করতাম যা দীর্ঘ এবং কঠোর ভীতি প্রদর্শনের দিক থেকে সূরা বারাআতের সমতুল্য। পরে তা আমি ভুলে গেছি। তবে তার এতটুকু মনে রেখেছি- “যদি কোন আদম সন্তান দুই উপত্যকা সম্পদের মালিক হয়ে যায় তাহলে সে তৃতীয় আর একটি উপত্যকা ভর্তি সম্পদ পেতে চাইবে। মাটি ছাড়া আর কোন কিছুতেই আদম সন্তানের পেট ভরে না।" আমি আরো একটি সূরা পাঠ করতাম যা মুসাব্বিহাত (গুণগানপূর্ণ) সূরাগুলো সমতুল্য। তাও আমি ভুলে গেছি, শুধু তা থেকে এ আয়াতটি মনে আছে– “হে ঈমানদারগণ! তোমরা কেন এমন কথা বল যা কর না"- (সুরাহ সফ ৬১:২)। আর যে কথা তোমরা শুধু মুখে আওড়াও অথচ করো না তা তোমাদের ঘাড়ে সাক্ষী হিসেবে লিখে রাখা হয়। কিয়ামতের দিন তোমাদেরকে এ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।" [9]

 

এই একই প্রসঙ্গে অন্যান্য হাদিসে এই ইঙ্গিত রয়েছে যে এখানে কুরআনের মানসুখ বা রহিত আয়াত প্রসঙ্গে বলা হচ্ছে এবং কিছু আয়াত সুরা তাকাসুরের দ্বারা রহিত হয়েছে। [10]

আলোচ্য হাদিসের ব্যাখ্যায় ইমাম সুয়ুতী(র.) উল্লেখ করেছেন—

 

كُنَّا نَقْرَأُ سُورَةً كُنَّا نُشَبِّهُهَا فِي الطُّولِ وَالشِّدَّةِ بِبَرَاءَةَ فَأَنْسَيْتُهَا، هَذَا مِنَ الْمَنْسُوخِ تِلَاوَةً، الَّذِي أُشِيرَ إِلَيْهِ بِقَوْلِهِ تَعَالَى: "مَا نَنْسَخْ مِنْ آيَةٍ أَوْ نُنْسِهَا"، فَكَانَ اللَّهُ يُنْسِيهِ النَّاسَ بَعْدَ أَنْ حَفِظُوهُ، وَيَمْحُوهُ مِنْ قُلُوبِهِمْ، وَذَلِكَ فِي زَمَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خَاصَّةً، إِذْ لَا نَسْخَ بَعْدَهُ.

অর্থঃ “আমরা এমন একটি সূরা পাঠ করতাম যার দৈর্ঘ্য ও কঠোরতার দিক থেকে আমরা এটিকে সূরা বারা'আহ (তাওবার) সূরার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ মনে করতাম, কিন্তু আমি তা ভুলে গেছি – এটি মানসুখ (রহিতকৃত) তিলাওয়াত অংশগুলোর অন্তর্গত, যা আল্লাহর বাণী " আমি যে আয়াত রহিত করি কিংবা ভুলিয়ে দেই,..." [সুরা বাকারাহ ২:১০৬] দ্বারা ইঙ্গিত করা হয়েছে। সুতরাং আল্লাহ মানুষকে তা ভুলিয়ে দিতেন, তারা তা মুখস্থ করার পরও, এবং তিনি তা তাদের অন্তর থেকে মুছে দিতেন। এটি শুধু নবী -এর জীবদ্দশায় সংঘটিত হয়েছে, কেননা তাঁর পরবর্তী সময়ে কোনো রহিতকরণ নেই।[11]

 

আলোচ্য হাদিস প্রসঙ্গে ইমাম কুরতুবী(র.) উল্লেখ করেছেন—

 

أَحَدُهَا: نَسْخُ الْحُكْمِ وَبَقَاءُ التِّلَاوَةِ.

وَالثَّانِي: عَكْسُهُ، وَهُوَ: نَسْخُ التِّلَاوَةِ وَبَقَاءُ الْحُكْمِ.

وَالثَّالِثُ: نَسْخُ الْحُكْمِ وَالتِّلَاوَةِ، وَهُوَ كَرَفْعِ هَاتَيْنِ السُّورَتَيْنِ الَّتَيْنِ ذَكَرَهُمَا أَبُو مُوسَى، فَإِنَّهُمَا رُفِعَ حُكْمُهُمَا وَتِلَاوَتُهُمَا. وَهَذَا النَّوْعُ مِنَ النَّسْخِ هُوَ الَّذِي ذَكَرَ اللَّهُ تَعَالَى حَيْثُ قَالَ: ﴿مَا نَنسَخْ مِنْ آيَةٍ أَوْ نُنْسِهَا﴾؛ عَلَى قِرَاءَةِ مَنْ قَرَأَهَا بِضَمِّ النُّونِ، وَكَسْرِ السِّينِ. وَكَذَلِكَ قَوْلُهُ تَعَالَى: ﴿سَنُقْرِئُكَ فَلَا تَنسَى * إِلَّا مَا شَاءَ اللَّهُ﴾، وَهَاتَانِ السُّورَتَانِ مِمَّا قَدْ شَاءَ اللَّهُ تَعَالَى أَنْ يُنْسِيَهُ بَعْدَ أَنْ أَنْزَلَهُ، وَهَذَا لِأَنَّ اللَّهَ تَعَالَى فَعَّالٌ لِمَا يُرِيدُ، قَادِرٌ عَلَى مَا يَشَاءُ؛ إِذْ كُلُّ ذَلِكَ مُمْكِنٌ.

وَلَا يَتَوَهَّمْ مُتَوَهِّمٌ مِنْ هَذَا وَشِبْهِهِ أَنَّ الْقُرْآنَ قَدْ ضَاعَ مِنْهُ شَيْءٌ، فَإِنَّ ذَلِكَ بَاطِلٌ؛ بِدَلِيلِ قَوْلِهِ تَعَالَى: ﴿إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُونَ﴾، وَبِأَنَّ إِجْمَاعَ الصَّحَابَةِ وَمَنْ بَعْدَهُمْ انْعَقَدَ عَلَى أَنَّ الْقُرْآنَ الَّذِي تُعُبِّدْنَا بِتِلَاوَتِهِ وَبِأَحْكَامِهِ هُوَ مَا ثَبَتَ بَيْنَ دَفَّتَيْ الْمُصْحَفِ مِنْ غَيْرِ زِيَادَةٍ وَلَا نُقْصَانٍ، كَمَا قَرَّرْنَاهُ فِي أُصُولِ الْفِقْهِ.

অর্থঃ “[রহিতকরণের প্রকারভেদঃ] একটি হলোঃ বিধান রহিত করা কিন্তু তিলাওয়াত বহাল রাখা।

দ্বিতীয়টি হলোঃ তার বিপরীত, অর্থাৎ তিলাওয়াত রহিত করা কিন্তু বিধান বহাল রাখা।

তৃতীয়টি হলোঃ বিধান ও তিলাওয়াত উভয়ই রহিত করা, যেমন আবু মূসা(রা.) কর্তৃক উল্লিখিত ঐ দুটি সূরার ক্ষেত্রে যা ঘটেছে, যেখানে তাদের বিধান ও তিলাওয়াত উভয়ই উঠিয়ে নেওয়া [রহিত করা] হয়েছে। এ ধরণের রহিতকরণের কথা আল্লাহ তাআলা উল্লেখ করেছেন তাঁর বাণীতেঃ "আমি যে আয়াত রহিত করি কিংবা ভুলিয়ে দেই,..." [সুরা বাকারাহ ২:১০৬] - যারা ‘নুন’-এ পেশ ও ‘সিন’-এ যের দিয়ে পড়েছেন তাদের কিরাত অনুযায়ী। আর যেমন তাঁর বাণীঃ “অচিরেই আমি তোমাকে পাঠ করাব, ফলে তুমি ভুলবে না। আল্লাহ যা ইচ্ছা করবেন তা ব্যতীত, … ” [সুরা আ’লা ৮৭:৬-৭]। এই দুটি সূরা এমন যেগুলো আল্লাহ তাআলা নাযিল করার পর ভুলিয়ে দিতে চেয়েছেন, কেননা আল্লাহ তাআলা যা ইচ্ছা তা-ই করেন, তিনি যা চান তা করতে সক্ষম। নিশ্চয় এ বিষয়গুলো সম্পূর্ণ সম্ভব। 

 

এবং কেউ যেন এ থেকে বা অনুরূপ বিষয় থেকে ভুল ধারণায় না পড়ে যে, কুরআনের কোনো অংশ হারিয়ে গেছে। কেননা তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এর প্রমাণ হলো আল্লাহর বাণীঃ “নিশ্চয় আমিই কুরআন নাযিল করেছি আর অবশ্যই আমি তার সংরক্ষক” [সুরা হিজর ১৫ : ৯]। এছাড়াও, সাহাবাগণ এবং তাদের পরবর্তী উম্মতের ইজমা (ঐক্যমত) এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যেঃ কুরআন — যার তিলাওয়াত ও বিধান দ্বারা আমরা ইবাদত করি, যা মুসহাফের দুই প্রচ্ছদের মধ্যে সংরক্ষিত হয়েছে। এতে কোনো কিছু সংযোজন বা বিয়োজন হয়নি। যেমন আমরা উসুলে ফিকহে তা নির্ধারণ করেছি।[12]

 

আমরা দেখলাম যে, কোনো কোনো সাহাবী কুরআনের যে আয়াতগুলো ভুলে গিয়েছিলেন সেগুলো ছিল কুরআনের মানসুখ বা রহিত আয়াত, যা চুড়ান্তভাবে কুরআনের অংশ ছিল না। এর দ্বারা আদৌ কুরআনের সংরক্ষণ প্রশ্নবিদ্ধ হয় না। এমনকি তা যদি কুরআনের মানসুখ অংশ নাও হতো, তাহলেও কুরআনের সংরক্ষণ প্রশ্নবিদ্ধ হতো না। কোনো কোনো সাহাবী কুরআনের কিছু আয়াত ভুলে গেলে তা থেকে কি এটা প্রমাণ হয় যে সব সাহাবী একযোগে ঐ আয়াতগুলো ভুলে গিয়েছিলেন বা আর কোনো জায়গায় ঐ আয়াতগুলো সংরক্ষিত ছিল না?!! এই প্রবন্ধের পরবর্তী অংশে আলোচনা করা হবে কী বিপুল পরিমাণে সাহাবী(রা.) সম্পূর্ণ কুরআন মুখস্ত (হিফজ) করেছিলেন, একই সঙ্গে লিপিবদ্ধ করেও পূর্ণ কুরআন সংরক্ষণ করা হয়েছিল।       

 

কুরআনের কোনো অংশ হারিয়ে যাওয়া কি আদৌ সম্ভব?

আমরা যদি তর্কের খাতিরে ধরে নিই যে, নবী কিংবা কোনো কোনো সাহাবী কুরআনের কিছু আয়াত আসলেই স্থায়ীভাবে ভুলে গিয়েছিলেন – তা থেকেও এটা প্রমাণ হয় না যে কুরআনের কিছু অংশ চিরতরে হারিয়ে গেছে। কুরআনের সংরক্ষণ পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা থাকলে যে কেউ এটা বুঝতে পারবে যে, কুরআনের কোনো অংশ হারিয়ে যাওয়া আদৌ সম্ভব না।

 

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، قَالَ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَجْوَدَ النَّاسِ، وَكَانَ أَجْوَدُ مَا يَكُونُ فِي رَمَضَانَ حِينَ يَلْقَاهُ جِبْرِيلُ، وَكَانَ يَلْقَاهُ فِي كُلِّ لَيْلَةٍ مِنْ رَمَضَانَ فَيُدَارِسُهُ الْقُرْآنَ، فَلَرَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَجْوَدُ بِالْخَيْرِ مِنَ الرِّيحِ الْمُرْسَلَةِ‏.

অর্থঃ "ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ দাতা। রমযানে তিনি আরো বেশী দানশীল হতেন, যখন জিবরীল (আঃ) তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেন। আর রমযানের প্রতি রাতেই জিবরীল (আঃ) তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং তাঁরা পরস্পর কুরআন তিলাওয়াত করে শোনাতেন। নিশ্চয়ই রাসুলুল্লাহ রহমতের বাতাস থেকেও অধিক দানশীল ছিলেন।" [13]

 

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ كَانَ يَعْرِضُ عَلَى النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم الْقُرْآنَ كُلَّ عَامٍ مَرَّةً فَعَرَضَ عَلَيْهِ مَرَّتَيْنِ فِي الْعَامِ الَّذِيْ قُبِضَ فِيْهِ وَكَانَ يَعْتَكِفُ كُلَّ عَامٍ عَشْرًا فَاعْتَكَفَ عِشْرِيْنَ فِي الْعَام الَّذِيْ قُبِضَ فِيْهِ

অর্থঃ আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, প্রতি বছর জিব্রীল (আঃ) নবী -এর সঙ্গে একবার কুরআন মাজীদ শোনাতেন ও শুনতেন। কিন্তু যে বছর তাঁর ওফাত হয় সে বছর তিনি রাসূল -কে দু’বার শুনিয়েছেন। প্রতি বছর নবী রমাযানে দশ দিন ই’তিকাফ করতেন। কিন্তু যে বছর তাঁর ওফাত হয় সে বছর তিনি বিশ দিন ই’তিকাফ করেন। [14]

 

আমরা বিশুদ্ধ হাদিস থেকে দেখলাম যে, রমযান মাসে ফেরেশতা জিব্রাঈল(আ.) নবী এর নিকট কুরআন শুনতেন ও শোনাতেন। তর্কের খাতিরে যদি এটাও ধরে নেয়া হয় যে, অতীতে নবী কুরআনের কিছু আয়াত একেবারেই ভুলে গিয়েছিলেন, অন্য সাহাবীরাও একযোগে সেই আয়াতগুলো ভুলে গেছিলেন এবং সেই আয়াতগুলো সেই সময়ে হারিয়ে গিয়েছিল [যদিও বাস্তবে তা হয়নি] – তাহলেও রমযান মাসে জিব্রাঈল(আ.) এর কাছ থেকে শুনে নিয়ে নবী সেই আয়াতগুলো পুনরুদ্ধার করে নিতে পারতেন! যেই বছর নবী মৃত্যুবরণ করেন সেই বছর রমযানে তিনি ২ বার জিব্রাঈল(আ.) এর কাছ থেকে কুরআন শুনেছেন। অতএব কোনো আয়াত চিরতরে হারিয়ে যাবার সুযোগই ছিল না।

 

শুধু তাই না, বিপুল পরিমাণ হাফিজ সাহাবী(রা.) ছিলেন যাঁরা পূর্ণ কুরআন মুখস্ত (হিফজ) করেছিলেন। যাঁদের থেকে কুরআনের কিরাআত বর্ণিত আছে। এই হাফিজ সাহাবীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেনঃ

মুহাজির সাহাবীদের মধ্যেঃ আবু বকর(রা.), উমার(রা.), উসমান(রা.), আলি(রা.), তালহা(রা.), সা’দ(রা.), আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ(রা.), হুযাইফা ইবন ইয়ামান(রা.), সালিম(রা.), আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস(রা.), আমর ইবনুল আস(রা.),  আব্দুল্লাহ ইবন আমর(রা.), মুয়াবিয়া(রা.), আব্দুল্লাহ ইবন যুবাইর(রা.), আব্দুল্লাহ বিন সাইব(রা.), আয়িশা(রা.), হাফসা(রা.), উম্মু সালামাহ(রা.) এবং আরো অনেকে।

আনসার সাহাবীদের মধ্যেঃ উবাই বিন কা’ব(রা.), মুআয বিন জাবাল(রা.), আবু দারদা(রা.), যায়দ বিন সাবিত(রা.), আবু যায়দ(রা.), মুজাম্মা’ বিন জারিয়াহ(রা.), আনাস বিন মালিক(রা.) এবং আরো অনেকে। [15]

হাফিজ সাহাবীদের মধ্যে আরো উল্লেখ করা যায়ঃ উম্মে ওয়ারাকাহ(রা.), মাসলামা ইবন মুখাল্লাদ(রা.), উকবা ইবন আমির(রা.), তামিম দারী(রা.), আবু মুসা আশআরী(রা.) প্রমুখের নাম। [16]

 

আরো বহু হাফিজ সাহাবী ছিলেন যাঁদের নাম উল্লেখ করলে প্রবন্ধের কলেবর অনেক বেড়ে যাবে। একটা গ্রন্থ যদি এত বিপুল পরিমাণ মানুষ সম্পূর্ণরূপে মুখস্ত করে, তাহলে সেই গ্রন্থের কোনো অংশ কি হারিয়ে যাওয়া সম্ভব? আরো বিপুল পরিমাণ সাহাবী ছিলেন যাঁরা পূর্ণ কুরআন মুখস্ত না করলেও কুরআনের উল্লেখযোগ্য অংশ যাঁদের মুখস্ত ছিল। কুরআন প্রথম নাজিলের পর থেকেই প্রতিটি মুমিনের প্রতিদিনের পাঠ্য এক গ্রন্থ। প্রতিদিন নিজের নামাজে, জামাতে নামাজে ও সাধারণভাবে প্রত্যেক মুমিন কুরআন তিলাওয়াত করেন বা শোনেন। বর্তমান সময়ের চেয়ে সাহাবীদের(রা.) যুগে কুরআন মুখস্ত করার প্রবণতা অনেক বেশি ছিল। হাজার হাজার হাফিজ সাহাবী-তাবিঈ মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে ছিলেন। আল্লাহ তা’আলা নবী কে বলেছেনঃ

 

وَأَنْزَلْتُ عَلَيْكَ كِتَابًا لاَ يَغْسِلُهُ الْمَاءُ

অর্থঃ "এবং তোমার প্রতি আমি এমন কিতাব অবতীর্ণ করেছি যা পানি কখনো ধুয়ে-মুছে ফেলতে পারবে না।" [17]

 

স্রেফ লিপিবদ্ধ কপির উপরে যে গ্রন্থের সংরক্ষণ নির্ভরশীল, পানি ধুয়েমুছে দিলে সেই গ্রন্থ বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু যেই গ্রন্থ ব্যাপকভাবে মুখস্তের দ্বারা সংরক্ষিত হয়, পানি সেই গ্রন্থকে ধুয়ে মুছে দিতে পারে না।

 

শুধু মুখস্ত করেই নয় বরং লিখিত আকারেও পূর্ণ কুরআনকে স্বয়ং নবী এর যুগ থেকেই সংরক্ষণ করা হয়েছিল। কুরআনকে যাঁরা লিপিবদ্ধ করতেন সেই সাহাবীদের বলা হতো ‘কাতিবে ওহী’। নবী এর অন্যতম কাতিবে ওহী ছিলেন যায়িদ বিন সাবিত(রা.), যিনি পরবর্তীকালে আবু বকর(রা.) ও উসমান(রা.) এর খিলাফতকালে কুরআন সংকলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। যায়িদ বিন সাবিত(রা.) থেকে বর্ণিত আছে—

 

كُنتُ أَكتُبُ الوَحيَ لِرَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّم، وَكانَ إِذَا نَزَلَ عَلَيْهِ أَخَذَتْهُ بَرحَاءُ شَدِيدَةٌ، وَعَرِقَ عَرَقًا شَدِيدًا مِثلَ الجُمَانِ، ثُمَّ سُرِّيَ عَنهُ، فَكُنتُ أَدخلُ بِقِطعَةِ العُسْبِ أَو كِسَرِهِ، فَأَكتُبُ وَهُوَ يُملِي عَلَيَّ، فَمَا أُفرِغُ حَتَّى تَكَادُ رِجلِي تَنكَسِرُ مِن ثِقَلِ القُرآنِ، حَتَّى أَقُولَ: لَا أَمشِي عَلَى رِجلِي أَبَدًا، فَإِذَا فَرَغتُ، قَالَ: اِقرَأْهُ، فَأَقرَأَهُ، فَإِن كَانَ فِيهِ سَقْطٌ أَقَامَهُ، ثُمَّ أُخرِجُ بِهِ إِلَى النَّاسِ.

অর্থঃ “আমি আল্লাহর রাসূল -এর জন্য ওহী [কুরআন] লিপিবদ্ধ করতাম। যখন তাঁর উপর ওহী নাযিল হত, তখন তিনি প্রচণ্ড কষ্টে আক্রান্ত হতেন এবং মুক্তোর দানার মতো ঘামতে থাকতেন। এরপর যখন সেই অবস্থা কেটে যেত, আমি খেজুরের ডাল বা তার টুকরো নিয়ে আসতাম। এবং তিনি আমাকে বলতেন, আমি লিখতাম। আমি তখনও লেখা শেষ করিনি, অথচ কুরআনের ভারে আমার পা যেন ভেঙে যেতে চাইত, এমনকি আমি বলতাম, “আমি আর কখনো আমার এই পায়ে হাঁটতে পারব না!” যখন আমি লিখে শেষ করতাম, তিনি বলতেন, "এটা আমাকে পড়ে শোনাও।" আমি পড়ে শোনাতাম, যদি কোনো অংশ বাদ পড়ে থাকত, তিনি তা সংশোধন করে দিতেন। এরপর আমি তা মানুষের কাছে নিয়ে যেতাম।[18]

 

যায়িদ বিন সাবিত(রা.) ছাড়াও আরো বহু সাহাবী কুরআন লিপিবদ্ধ করার কাজে নিয়োজিত ছিলেন। যেমনঃ আবু বকর(রা.), উমর(রা.), উসমান(রা.), আলি(রা.), মুয়াবিয়া(রা.), যুবাইর(রা.), আমির বিন ফাহীরা(রা.), আমর ইবনুল আস(রা.), উবাই বিন কা'ব(রা.), আব্দুল্লাহ বিন আরকাম(রা.), সাবিত বিন কায়েস(রা.), হানজালা বিন রবী' আযাদী(রা.), মুগিরা বিন শু'বা(রা.), আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা(রা.), খালিদ বিন ওয়ালিদ(রা.), খালিদ বিন সাঈদ ইবনুল আস(রা.) প্রমুখ। [19] এমন ৪০ জনের মতো সাহাবীর (রা.) নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। [20] আমরা সকলের নাম উল্লেখ করে প্রবন্ধের কলেবর বড় করছি না।

 

নবী এর যুগে কুরআনকে সংকলনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিছু সাহাবী(রা.) এই দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। 

 

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، قَالَ جَمَعَ الْقُرْآنَ عَلَى عَهْدِ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَرْبَعَةٌ كُلُّهُمْ مِنَ الأَنْصَارِ أُبَىُّ بْنُ كَعْبٍ وَمُعَاذُ بْنُ جَبَلٍ وَزَيْدُ بْنُ ثَابِتٍ وَأَبُو زَيْدٍ .

অর্থঃ আনাস ইবনু মালিক (রাযিঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ -এর যমানায় চারজন ব্যক্তি কুরআন সংকলন করেন, তারা সকলেই আনসারদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেনঃ উবাই ইবনু কাব, মুআয ইবনু জাবাল, যাইদ ইবনু সাবিত ও আবূ যাইদ (রাযিঃ)। [21]

 

তাঁরা লিপিবদ্ধ কুরআনকে সংকলন বা একত্রিত করতেন। যদিও নবী এর যুগে পূর্ণ কুরআনকে একই মলাটের মাঝে মুসহাফ আকারে তা করা হয়নি, যেটি পরবর্তীকালে সাহাবীদের খিলাফতকালে হয়েছিল। কিন্তু পূর্ণ কুরআনকে লিখিতভাবে নবী এর যুগেই সংরক্ষিত করা হয়েছিল।  

 

যেই কুরআনুল কারিমকে বিপুল পরিমাণ সাহাবী(রা.) কর্তৃক মুখস্ত ও  লিখিতভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে – তা থেকে যদি কোনো এক সময়ে নবী বা সাহাবী(রা.)দের কেউ কিছু অংশ ভুলেও যেতেন তা হলেও এর কোনো অংশ লুপ্ত হয়ে যাবার আদৌ সম্ভাবনা ছিল না। যদিও স্থায়ীভাবে কখনোই কুরআনুল কারিম নবী এর স্মৃতি থেকে হারিয়ে যায়নি বরং মানসুখ আয়াত ব্যতিরেকে পূর্ণ কুরআন নবী এর এবং অজস্র সাহাবীর মুখস্ত ছিল। ইসলামবিরোধীরা কুরআনের আয়াত হারিয়ে যাবার যে অভিযোগ করে তা নিতান্তই অসার এবং ভিত্তিহীন।

 

 

তথ্যসূত্রঃ


[1] সহীহ বুখারী, হাদিস নং : ৫৮৯৬

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=6639

[2] আল কুরআন, সুরা আ’লা ৮৭ : ৬

[3] আল কুরআন, সুরা আ’লা ৮৭ : ৭

[4] আল কুরআন, সুরা বাকারাহ ২ : ১০৬

[5] তাফসির তাবারী (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), শেষ খণ্ড, সুরা আ’লার ৬-৭ নং আয়াতের তাফসির, পৃষ্ঠা ১৫৬

[6] তাফসির ইবন কাসির (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), খণ্ড ১১, সুরা আ’লার ৬-৭ নং আয়াতের তাফসির, পৃষ্ঠা ৪৭৯

[7] ফাতহুল বারী – ইবন হাজার আসকালানী, খণ্ড ৯, পৃষ্ঠা ৮৬

https://shamela.ws/book/1673/5175

 অথবা https://web.archive.org/web/20250430193223/https://shamela.ws/book/1673/5175 (আর্কাইভকৃত)

[8] মুসনাদ আহমাদ , হাদিস নং : ১৬৪ (সহীহ)

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=62988

[9] সহীহ মুসলিম, হাদিস নং : ২৩০৯

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=49396

[10] সহীহ বুখারীর ৬৪৩৯ ও ৬৪৪০ নং হাদিসে বলা হয়েছেঃ

أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم صلى الله عليه وسلم قَالَ لَوْ أَنَّ لِابْنِ آدَمَ وَادِيًا مِنْ ذَهَبٍ أَحَبَّ أَنْ يَكُونَ لَهُ وَادِيَانِ وَلَنْ يَمْلاَ فَاهُ إِلاَّ التُّرَابُ وَيَتُوبُ اللهُ عَلَى مَنْ تَابَ

অর্থঃ রাসূলুল্লাহ্ বলেনঃ যদি বানী আদমের স্বর্ণ ভরা একটা উপত্যকা থাকে, তথাপি সে তার জন্য দু’টি উপত্যকা হওয়ার কামনা করবে। তার মুখ মাটি ব্যতীত অন্য কিছুতেই ভরবে না। তবে যে ব্যক্তি তওবা করবে, আল্লাহ্ তার তওবা কবূল করবেন।

وَقَالَ لَنَا أَبُو الْوَلِيدِ حَدَّثَنَا حَمَّادُ بْنُ سَلَمَةَ عَنْ ثَابِتٍ عَنْ أَنَسٍ عَنْ أُبَيٍّ قَالَ كُنَّا نَرَى هَذَا مِنْ الْقُرْآنِ حَتَّى نَزَلَتْ (أَلْهَاكُمْ التَّكَاثُرُ)

অর্থঃ অন্য এক সূত্রে আনাস (রাঃ) ’উবাই ইবনু কা’ব (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেন, আমরা ধারণা করছিলাম এটা কুরআনেরই অন্তর্গত। অবশেষে (সূরায়ে) তাকাসুর নাযিল হলো। [সূরাহ আত্-তাকাসুর ১০২/১)

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=31203

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=31204

[11] শারহুস সুয়ুতী ‘আলা মুসলিম – জালাল আস সুয়ুতী, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ১২৯

https://shamela.ws/book/1712/594

অথবা https://web.archive.org/web/20250501182022/https://shamela.ws/book/1712/594 (আর্কাইভকৃত)

[12] আল মুফহিমু লিমা আশকালা মিন তাখলিসি কিতাবি মুসলিম – আবুল আব্বাস আল কুরতুবী, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ৯৪

https://shamela.ws/book/132524/1343

অথবা https://web.archive.org/web/20250501184351/https://shamela.ws/book/132524/1343 (আর্কাইভকৃত)

[13] সহীহ বুখারী, হাদিস নং : ৫

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=5

[14] সহীহ বুখারী, হাদিস নং : ৪৯৯৮

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=29512

[15] আন নাশর ফিল কিরাআতিল ‘আশর – ইবনুল জাযারী, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৬

https://shamela.ws/book/22642/14

অথবা https://web.archive.org/web/20250502174237/https://shamela.ws/book/22642/14 (আর্কাইভকৃত)

[17] সহীহ মুসলিম, হাদিস নং : ৭০৯৯

https://www.hadithbd.com/hadith/detail/chapter/?book=22&chapter=19025

[18] মাজমাউয যাওয়াইদ ৮/২৬০; হাদিসটি ২টি সনদের মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে; যার একটি সনদের রাবীগণ নির্ভরযোগ্য (সিকাহ)।

https://dorar.net/h/NSNAZriz

অথবা https://web.archive.org/web/20250502182408/https://dorar.net/h/NSNAZriz (আর্কাইভকৃত)

[19] দেখুনঃ যাদুল মা’আদ, ১ম খণ্ড (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), ইবনুল কাইয়িম জাওযিয়্যাহ, পৃষ্ঠা ৭৫

[21] সুনান তিরমিযি,  হাদিস নং : ৩৭৯৪ (সহীহ)

 https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=42143