Pray for the world economy

একজন দয়ালু স্রষ্টা কী করে কারো পুত্রকে জবাই করতে বলে পরীক্ষা নিতে পারেন?

 

কুরবানীর মৌসুম এলে নাস্তিকদের মুখে এই কথাগুলো প্রায়ই শোনা যায়ঃ আপনার প্রিয় সন্তানকে আজকে যদি কেউ গলায় ছুরি চালিয়ে উৎসর্গ করে পরীক্ষা নিতে চায়, আপনার কেমন লাগবে? আপনি কি তা মেনে নিতে পারবেন? একজন ঈশ্বর কী করে তার প্রিয়ভাজন নবীকে নিজ হাতে সন্তান হত্যা করার আদেশ দিতে পারেন? পরম দয়ালু স্রষ্টা কী করে এই ধরণের পরীক্ষা নিতে পারেন? [1]

 

এইসব কথাবার্তা বলে তারা আল্লাহ তা'আলা কর্তৃক নবী ইব্রাহিম(আ.)কে নেয়া মহাপরীক্ষাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায় এবং অমানবিক বলে অভিহীত করতে চায় (নাউযুবিল্লাহ)। নাস্তিকদের এই ধরণের আলোচনা দেখে অনেক সরলপ্রাণ মুসলিম হয়রান বোধ করেন।

 

নাস্তিকরা এখানে তাত্ত্বিক একটা কৌশল প্রয়োগ করে মুসলিমদেরকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করে। যেই বিধানটা ইসলামে দেয়া হয়নি, সেইরকম একটা দৃশ্যপট আপনার সামনে দাঁড় করিয়ে তারা আপনার আবেগ নিয়ে খেলা করবে। ইসলামে কোনো কালে কোনো নবীর শরিয়তে কিন্তু নিজ সন্তান কুরবানী করার বিধান দেয়া হয়নি। বরং সন্তান কুরবানীর বিষয়টা ছিল একজন বিশেষ মর্যাদাবান নবীকে করা বিশেষ এক পরীক্ষা। আর সেই পরীক্ষাতেও কিন্তু ইব্রাহিম(আ.)কে চূড়ান্তভাবে নিজ পুত্রকে জবাই করতে হয়নি। আর এমন পরীক্ষা অন্য সবার জন্য না। আমরা জানি যে সব থেকে কঠিন পরীক্ষাগুলো হয় নবী-রাসুলদের (আ.) জন্য হয়ে থাকে। [2] তাঁদের পরীক্ষা আর আম জনতার পরীক্ষা মোটেও এক নয়। আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে কষ্মিণকালেও নিজ সন্তান কুরবানী করার আদেশ দেননি। নিজ সন্তান হত্যা করা ইসলামের আদর্শ না। ইসলামপূর্ব যুগে অভাবের জন্য সন্তান হত্যা করা হতো। ইসলামে এই ধরণের কাজ হারাম করা হয়েছে। এবং এরপর কুরআনে ঘোষণা করে দেয়া হয়েছে যে, সন্তান হত্যা করা মহাপাপের কাজ। 

 

وَ لَا تَقۡتُلُوۡۤا اَوۡلَادَكُمۡ خَشۡیَۃَ اِمۡلَاقٍ ؕ نَحۡنُ نَرۡزُقُهُمۡ وَ اِیَّاكُمۡ ؕ اِنَّ قَتۡلَهُمۡ كَانَ خِطۡاً كَبِیۡرًا

অর্থঃ “তোমাদের সন্তানদেরকে তোমরা দারিদ্র্য-ভয়ে হত্যা করো না, আমিই তাদেরকে জীবনোপকরণ দিয়ে থাকি এবং তোমাদেরকেও। নিশ্চয় তাদেরকে হত্যা করা মহাপাপ।[3]

 

অনেক সময় নাস্তিকরা তাদের লাইভস্ট্রিম বা অন্যান্য মাধ্যমে সংবাদ থেকে রেফারেন্স দেখায় যে, কোনো কোনো উন্মাদ ব্যক্তি স্বপ্নে দেখে নিজ সন্তানকে জবাই করেছে। এই ধরণের কাজের উদাহরণ  দেখিয়ে তারা দাবি করে যে, এরা “কুরআনের আদেশ” পালন করছে! এখানে তারা এমন কাজের জন্য ইসলামকে দোষী করে যেই কাজ ইসলামে হারাম। ঐ ব্যক্তিরা আদৌ ইসলামী শরিয়তের বিধান পালন করেনি। বর্ণিত আছে যে, নবীদের স্বপ্ন হচ্ছে ওহী। [4] নবী ইব্রাহিম(আ.) ওহী মারফত পরীক্ষার আদেশ পেয়ে তা বাস্তবায়ন করেন। সাধারণ মানুষের স্বপ্ন কিন্তু নবীদের ন্যায় ওহী না। কাজেই কেউ যদি এমন স্বপ্ন দেখেও থাকে, সেটা কখনো তার জন্য বিধান হবে না, শরিয়তের দলিল হবে না। বরং ইসলামী শরিয়ত অনুযায়ী সে এমন কাজ থেকে বিরত থাকবে। কাজেই ইসলামবিরোধীদের অভিযোগ সম্পূর্ণ অসার।

 

আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, ইব্রাহিম(আ.) এর সেই ঘটনাতেও নিজ পুত্রকে জবাই করার আগেই আল্লাহ তা’আলা তাঁকে তা থেকে বিরত করেন এবং পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার কথা উল্লেখ করেন। অথচ ইসলামবিরোধীরা এমনভাবে এই ঘটনা নিয়ে অভিযোগ করে যেন ইব্রাহিম(আ.) কর্তৃক তাঁর সন্তান জবাই হয়ে গেছিলেন! অথচ আদৌ এমন কিছু ঘটেনি। ইব্রাহিম(আ.)কে আল্লাহ তা’আলা কোনো পুত্র জবাইয়ের আলাদা বিধান দেননি বরং সেটা ছিল ‘পরীক্ষা’। ‘বিধান’ নয়। বিধান ছিল পশু কুরবানীর, এবং তা ইব্রাহিমি শরিয়তে পালন হয়ে এসেছে এবং মুহাম্মাদ() এর শরিয়তেও তা বহাল আছে।

 

এবার প্রশ্ন আসতে পারে, ইব্রাহিম(আ.)কে কেন আল্লাহ নিজ সন্তান হত্যা করার আদেশ দিয়ে পরীক্ষা নিলেন? ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গী থেকে এর উত্তর খুবই সহজ। আল্লাহ তা'আলা আমাদের সবার সৃষ্টিকর্তা, আমাদের সবার মালিক। যে কাউকে যে কোনোভাবে পরীক্ষা করার পূর্ণ অধিকার তাঁর আছে। আমাদেরকে যে কোনো বিধান দেবার অধিকারও তাঁর আছে। আমরা তা মাথা পেতে নিতে বাধ্য।

তবে এই দৃষ্টিভঙ্গী বাদে ভিন্নভাবেও বিষয়টি বোঝা সম্ভব।

 

ধরুন, এক দম্পতি একটা পার্বত্য অঞ্চলে ঘুরতে গেছে। স্ত্রীটি তার স্বামীকে বললেনঃ "তুমি আমাকে কতোটা ভালোবাসো?"

স্বামী বললেনঃ "অনেক ভালোবাসি।"

স্ত্রীঃ "পরীক্ষা দিতে পারবে?"

স্বামীঃ "পারবো।"

স্ত্রীঃ "আমাকে সত্যিই যদি ভালোবেসে থাকো, তাহলে এই পাহাড় থেকে ঝাঁপ দিয়ে দেখাও তো!"

স্বামী এবার পাহাড় থেকে ঝাঁপ দেবার জন্য এগিয়ে গেলেন।

তিনি এগিয়ে যেতেই স্ত্রী তাকে হাত ধরে আটকালেন। বললেন, "আরে আমি সত্যি কি তাই চাই নাকি? বুঝলাম তুমি আমাকে ভালোবাসো!"

 

এই ঘটনা দেখে কেউ কি বলবেন এই মহিলা নৃশংস বা বর্বর? !!

বলবেন না। কারণ সবাই এটা বুঝবেন যে এই মহিলা কখনোই চাননি তার স্বামী আসলেই পাহাড় থেকে ঝাঁপ দিক। বরং তিনি শুধুমাত্র পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন। আল্লাহ তা'আলা কখনো চাননি ইব্রাহিম(আ.) সত্যি সত্যি নিজ সন্তান ইসমাঈল(আ.)কে জবাই করুন। বরং তিনি শুধু ইব্রাহিম(আ.)কে পরীক্ষা করেছিলেন। আল্লাহ তাঁর আপনজনকে কখনও ধ্বংস করেন না। [5] আল্লাহ তা’আলা অসীম দয়ালু, সর্বজ্ঞানী এবং বান্দাদের প্রতি স্নেহশীল। আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলার সঙ্গে কোনো মানুষের বা অন্য কিছুর কখনোই তুলনা চলে না। কোনো কিছুই আল্লাহর সদৃশ নয়। উপরে দম্পতির উদাহরণটি শুধুমাত্র সহজে বুঝবার জন্য দেয়া হয়েছে। যেসব অবুঝ ব্যক্তি আল্লাহ তা'আলার পরীক্ষার উদাহরণ টেনে আল্লাহ তা'আলা সম্পর্কে বাজে মন্তব্য করে, আমরা তাদের সুপথপ্রাপ্তির জন্য উপরের উদাহরণটি টানলাম।

 

 

আরো পড়ুনঃ

আল্লাহ যদি আগে থেকেই সব কিছু জেনে থাকেন তাহলে কেন মানুষের পরীক্ষা নেন?

 

 

তথ্যসূত্রঃ


[1] আল কুরআন থেকে আল্লাহ তা’আলা কর্তৃক নবী ইব্রাহিম(আ.) নেয়া পরীক্ষার ঘটনাটি নিম্নরূপঃ

 "অতঃপর তাকে আমি পরম ধৈর্যশীল একজন পুত্র সন্তানের সুসংবাদ দিলাম। অতঃপর যখন সে তার সাথে চলাফেরা করার বয়সে পৌঁছল, তখন সে বলল, ‘হে প্রিয় বৎস, আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে যবেহ করছি, অতএব দেখ তোমার কী অভিমত’; সে বলল, ‘হে আমার পিতা, আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, আপনি তাই করুন। আমাকে ইনশাআল্লাহ আপনি অবশ্যই ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন’। অতঃপর তারা উভয়ে যখন আত্মসমর্পণ করল এবং সে তাকে কাত করে শুইয়ে দিল। তখন আমি তাকে আহবান করে বললাম, ‘হে ইবরাহীম, ‘তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছ। নিশ্চয় আমি এভাবেই সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করে থাকি’। ‘নিশ্চয় এটা সুস্পষ্ট পরীক্ষা’। আর আমি এক মহান যবেহের বিনিময়ে তাকে মুক্ত করলাম।"

[সুরা আস-সফফাত ৩৭ : ১০১-১০৭]

[2] এই সংক্রান্ত হাদিস এনে সহীহ বুখারীর একটা পরিচ্ছেদের নামকরণ করা হয়েছেঃ "মানুষের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হন নবীগণ। এর পরে ক্রমান্বয়ে প্রথম ব্যক্তি এবং পরবর্তী প্রথম ব্যক্তি"

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=5889

সুনান তিরমিযির একটি হাদিসে বলা হয়েছেঃ

"...  একজন তার দ্বীনদারীর অনুপাতে পরীক্ষায় নিপতিত হয়। যদি সে তার দীনে মজবুত হয় তবে তার পরীক্ষাও তুলনামূলকভাবে কঠোরতর হয়; আর সে যদি দীনের ক্ষেত্রে দুর্বল ও হালকা হয় তবে সে তার দ্বীনদারীর অনুপাতেই পরীক্ষার সম্মুখীন হয়। ..."

[সুনান তিরমিযি ২৪০১ (হাসান)]

https://www.hadithbd.com/hadith/error/?id=37755

[3] আল কুরআন, বনী ইস্রাঈল ১৭ : ৩১

[4]আমর (রহ.) বললেন, ‘উবায়দ ইবনু ‘উমার (রহ.)-কে আমি বলতে শুনেছি যে, নিশ্চয়ই নবীগণের স্বপ্ন ওয়াহী। অতঃপর তিনি তিলাওয়াত করলেন إِنِّي أَرَى فِي الْمَنَامِ أَنِّي أَذْبَحُكَ [ইব্রাহীম (‘আ.), ইসমা‘ঈল (‘আ.)-কে বললেন] ‘‘আমি স্বপ্ন দেখলাম, তোমাকে কুরবানী করছি।’ (সূরাহ্ আস্ -সাফ্ফাত ৩৭/১০২)।

সহীহ বুখারী, ৮৫৯ নং হাদিস দ্রষ্টব্য।

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=24696

ইবনু আব্বাস (রাযিঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেছেন, নবীদের স্বপ্নও ওয়াহী।

সুনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), ৩৬৮৯ নং হাদিস দ্রষ্টব্য।

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=42069

[5] সহীহ বুখারীর একটি হাদিসে শিশু ইসমাঈল(আ.) এবং তাঁর মাকে মক্কার জনমানবহীন মরুভূমিতে রেখে আসার ব্যাপারে আরো একটি কঠিন পরীক্ষার উল্লেখ রয়েছে। সেই দীর্ঘ হাদিসের মাঝে ফেরেশতার একটি উক্তি উল্লেখযোগ্য।

"... তখন ফিরিশ্‌তা তাঁকে বললেন, আপনি ধ্বংসের কোন আশংকা করবেন না। কেননা এখানেই আল্লাহর ঘর রয়েছে। এ শিশুটি এবং তাঁর পিতা দু’জনে এখানে ঘর নির্মাণ করবে এবং আল্লাহ তাঁর আপনজনকে কখনও ধ্বংস করেন না।"

[সহীহ বুখারী ৩১২৫]

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=3383

পিপাসার্ত শিশু ইসমাঈল(আ.)কে পানির অভাবে মৃত্যু থেকে রক্ষা করার জন্য আল্লাহর হুকুমে জমজম কুপ সৃষ্টি করে ফেরেশতা এই উক্তিটি বিবি হাযেরা [হাযার(আ.)] এর উদ্দেশ্যে করেছিলেন।