অভিযোগঃ
আল্লাহ যদি সর্বজ্ঞানী হন, তিনি যদি আগেই থেকেই জানেন কোন মানুষ কী কাজ করবে, তাহলে কেন তিনি মানুষের পরীক্ষা নেন?
কুরআনের কিছু আয়াতের ভাষ্য অনুযায়ী আল্লাহ মানুষকে পরীক্ষা করেন যাতে তিনি জেনে নিতে পারেন কার কর্ম কেমন হবে। তাহলে এ থেকে কি প্রমাণ হয় না যে আল্লাহ আগে থেকেই সব কিছু জানেন না এবং তিনি সর্বজ্ঞানী নন? (নাউযুবিল্লাহ)
জবাবঃ
আল্লাহ তা’আলা তা’আলা সর্বজ্ঞানী এবং আগে থেকেই সকল কিছু জানেন এ ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। আল কুরআনের বহু আয়াতে আল্লাহ তা’আলার সর্বজ্ঞানী হবার গুণের উল্লেখ রয়েছে।
عٰلِمُ الۡغَیۡبِ وَ الشَّهَادَۃِ الۡكَبِیۡرُ الۡمُتَعَالِ
অর্থঃ "অদৃশ্য ও দৃশ্যমান সম্বন্ধে তিনি অবগত; তিনি সুমহান, সর্বোচ্চ।" [1]
وَ عِنۡدَهٗ مَفَاتِحُ الۡغَیۡبِ لَا یَعۡلَمُهَاۤ اِلَّا هُوَ ؕ وَ یَعۡلَمُ مَا فِی الۡبَرِّ وَ الۡبَحۡرِ ؕ وَ مَا تَسۡقُطُ مِنۡ وَّرَقَۃٍ اِلَّا یَعۡلَمُهَا وَ لَا حَبَّۃٍ فِیۡ ظُلُمٰتِ الۡاَرۡضِ وَ لَا رَطۡبٍ وَّ لَا یَابِسٍ اِلَّا فِیۡ كِتٰبٍ مُّبِیۡ
অর্থঃ "তাঁরই নিকট অদৃশ্যের চাবি রয়েছে; তিনি ব্যতীত অন্য কেউ তা জানে না। জলে-স্থলে যা কিছু আছে, তা তিনিই অবগত। তাঁর অজ্ঞাতসারে (বৃক্ষের) একটি পাতাও পড়ে না, মৃত্তিকার অন্ধকারে এমন কোন শস্যকণা অথবা রসযুক্ত কিম্বা শুষ্ক এমন কোন বস্তু পড়ে না, যা সুস্পষ্ট কিতাবে নেই।" [2]
اِنَّ اللّٰهَ عِنۡدَهٗ عِلۡمُ السَّاعَۃِ ۚ وَ یُنَزِّلُ الۡغَیۡثَ ۚ وَ یَعۡلَمُ مَا فِی الۡاَرۡحَامِ ؕ وَ مَا تَدۡرِیۡ نَفۡسٌ مَّاذَا تَكۡسِبُ غَدًا ؕ وَ مَا تَدۡرِیۡ نَفۡسٌۢ بِاَیِّ اَرۡضٍ تَمُوۡتُ ؕ اِنَّ اللّٰهَ عَلِیۡمٌ خَبِیۡرٌ
অর্থঃ "নিশ্চয় আল্লাহর নিকটেই আছে কিয়ামত (সংঘটিত হওয়ার) জ্ঞান, তিনি বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং তিনি জানেন জরায়ুতে যা আছে। কেউ জানে না আগামী কাল সে কি অর্জন করবে এবং কেউ জানে না কোন্ দেশে তার মৃত্যু ঘটবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্ববিষয়ে অবহিত।" [3]
اَلَمۡ تَعۡلَمۡ اَنَّ اللّٰهَ یَعۡلَمُ مَا فِی السَّمَآءِ وَ الۡاَرۡضِ ؕ اِنَّ ذٰلِكَ فِیۡ كِتٰبٍ ؕ اِنَّ ذٰلِكَ عَلَی اللّٰهِ یَسِیۡرٌ
অর্থঃ "তুমি কি জানো না যে, আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু রয়েছে আল্লাহ তা অবগত আছেন? এ সবই লিপিবদ্ধ আছে এক কিতাবে। অবশ্যই এটা আল্লাহর নিকট সহজ।" [4]
আল্লাহ তা’আলা কেন মানুষকে পরীক্ষা করেন, এ প্রসঙ্গে আল কুরআনে বেশ কিছু আয়াত রয়েছে।
وَ لَنَبۡلُوَنَّكُمۡ حَتّٰی نَعۡلَمَ الۡمُجٰهِدِیۡنَ مِنۡكُمۡ وَ الصّٰبِرِیۡنَ ۙ وَ نَبۡلُوَا۠ اَخۡبَارَكُمۡ
অর্থঃ "আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব যতক্ষণ না আমি তোমাদের মধ্যে মুজাহিদ ও ধৈর্যশীলদেরকে জেনে নিই এবং আমি তোমাদের অবস্থা পরীক্ষা করি।" [5]
وَ مَا جَعَلۡنَا الۡقِبۡلَۃَ الَّتِیۡ كُنۡتَ عَلَیۡهَاۤ اِلَّا لِنَعۡلَمَ مَنۡ یَّتَّبِعُ الرَّسُوۡلَ مِمَّنۡ یَّنۡقَلِبُ عَلٰی عَقِبَیۡهِ ؕ
অর্থঃ "...তুমি এ যাবৎ যে ক্বিবলার অনুসরণ করছিলে, তা এই উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম, যাতে আমি জানতে পারি যে, কে রসূলের অনুসরণ করে এবং কে ফিরে যায়? ..." [6]
এই আয়াতগুলো দেখিয়ে অনেক সময় ইসলামবিরোধীরা দাবি করতে চায় আল কুরআনের আল্লাহ সর্বজ্ঞানী নন (নাউযুবিল্লাহ)। কিন্তু আমরা যদি আলোচ্য আয়াতগুলোর ব্যাপারে সালাফে সলিহীনদের ব্যাখ্যা ও আলোচনা দেখি, তাহলেই তাদের এই দাবির অসারতা স্পষ্ট হয়ে যায়। পাশাপাশি আরো উত্তমভাবে অনুধাবন করা যায় আল্লাহ তা’আলা আগে থেকেই সব কিছু জানা সত্ত্বেও কেন মানুষকে পরীক্ষা করেন।
সুরা মুহাম্মাদের ৩১ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসির কুরতুবীতে উল্লেখ আছে—
قَوْلُهُ تَعَالَى:" وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ" أَيْ نَتَعَبَّدَكُمْ بِالشَّرَائِعِ وَإِنْ عَلِمْنَا عَوَاقِبَ الْأُمُورِ. وَقِيلَ: لَنُعَامِلَنَّكُمْ مُعَامَلَةَ الْمُخْتَبَرِينَ." حَتَّى نَعْلَمَ الْمُجاهِدِينَ مِنْكُمْ وَالصَّابِرِينَ" عَلَيْهِ. قَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ:" حَتَّى نَعْلَمَ" حَتَّى نُمَيِّزَ. وَقَالَ عَلِيٌّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ." حَتَّى نَعْلَمَ" حتى نرى.
......
وَهَذَا الْعِلْمُ هُوَ الْعِلْمُ الَّذِي يَقَعُ بِهِ الْجَزَاءُ، لِأَنَّهُ إِنَّمَا يُجَازِيهِمْ بِأَعْمَالِهِمْ لَا بِعِلْمِهِ الْقَدِيمِ عَلَيْهِمْ. فَتَأْوِيلُهُ: حَتَّى نَعْلَمَ الْمُجَاهِدِينَ عِلْمَ شَهَادَةٍ، لِأَنَّهُمْ إِذَا أُمِرُوا بِالْعَمَلِ يَشْهَدُ مِنْهُمْ مَا عَمِلُوا، فَالْجَزَاءُ بِالثَّوَابِ وَالْعِقَابِ يَقَعُ عَلَى عِلْمِ الشَّهَادَةِ." وَنَبْلُوَا أَخْبارَكُمْ" نَخْتَبِرُهَا وَنُظْهِرُهَا.
অর্থঃ “আল্লাহ তা’আলার বাণী: “وَ لَنَبۡلُوَنَّكُمۡ” {আর আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব}; এর অর্থ হলঃ "আমি তোমাদের উপর শরিয়তের মাধ্যমে ইবাদতের আদেশ আরোপ করব, যদিও আমি সমস্ত বিষয়ের পরিণাম সম্পর্কে পূর্ব থেকেই জানি।" [এর তাফসিরে] আরো বলা হয়, "আমি তোমাদের সাথে এমনভাবে আচরণ করব ঠিক যেন আমি তোমাদেরকে পরীক্ষা করছি"।
“حَتّٰی نَعۡلَمَ الۡمُجٰهِدِیۡنَ مِنۡكُمۡ وَ الصّٰبِرِیۡنَ” {যতক্ষণ না আমি তোমাদের মধ্যে মুজাহিদ ও ধৈর্যশীলদেরকে জেনে নিই} – [এর ব্যাখ্যায়] ইবন আব্বাস (রা.) বলেছেন, " حَتّٰی نَعۡلَمَ" এর অর্থ হল, "যতক্ষণ না আমি পৃথক করি।" [এর ব্যাখ্যায়] আলি(রা.) বলেছেনঃ " حَتّٰی نَعۡلَمَ" অর্থঃ " যতক্ষণ না আমি দেখি"।
...
এই জ্ঞান এমন জ্ঞান যা দ্বারা প্রতিফল নির্ধারণ করা হয়। কারণ আল্লাহ তাদের পুরস্কার বা শাস্তি তাদের কাজের উপর ভিত্তি করে দেন। তাঁর পূর্বজ্ঞানের উপর ভিত্তি করে নয়। কাজেই এর [আলোচ্য আয়াতের] ব্যাখ্যা হচ্ছেঃ "যতক্ষণ না আমি মুজাহিদদের কর্মকে প্রত্যক্ষভাবে জেনে নিই" কারণ তাদেরকে যখন কোনো কাজ করার আদেশ দেওয়া হয়, তখন তারা কী করে তা তিনি প্রত্যক্ষ করেন। সুতরাং পুরস্কার বা শাস্তি সেই প্রকাশিত কর্মের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হয়। “وَ نَبۡلُوَا۠ اَخۡبَارَكُمۡ” {এবং আমি তোমাদের অবস্থা পরীক্ষা করি} এর অর্থ হল, "আমি তোমাদের পরীক্ষা করব এবং [তোমাদের কর্মকে] প্রকাশ করে দেবো।" ” [7]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, আলি(রা.) এর ন্যায় ইবন আব্বাস(রা.)ও আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যা نرى বা দেখা অর্থে করেছেন। তাফসির ইবন কাসিরে উল্লেখ আছে,
“বলাবাহুল্য যে, কোন কিছু সংঘটিত হবার পূর্বেই আল্লাহ তা’আলা সে সম্পর্কে সম্যক অবহিত। ইহাতে সন্দেহের লেশমাত্র নাই। অতএব আয়াতের অর্থ হইল যতক্ষণ না আমি জনসমক্ষে উহার বাস্তবায়ন দেখিব। এইজন্যই হযরত আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস(রা.) এ ধরণের ক্ষেত্রে نعلم এর অর্থ করেন نرى. অর্থাৎ দেখার অর্থে ব্যবহার করেন।” [8]
সুরা বাকারাহর ১৪৩ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসির আদওয়াউল বায়ানের বরাতে তাফসীরে জাকারিয়াতে বলা হয়েছে—
আয়াতে যে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে, তা হচ্ছে, لِنَعْلَمَ এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে, ‘যাতে আমরা জানতে পারি’। আয়াতের বাহ্যিক অর্থ থেকে কেউ কেউ এটা মনে করতে পারে যে, (নাউযুবিল্লাহ) আল্লাহ বুঝি আগে জানতেন না, ঘটনা ঘটার পরে জানেন। মূলত: এ ধরনের বোঝার কোন অবকাশই ইসলামী শরীআতে নেই। কারণ, আল্লাহ তা'আলা আগে থেকেই সবকিছু জানেন। কিন্তু আল্লাহ্ তা'আলা বান্দাকে পরীক্ষার মাধ্যমে তার জানা বিষয়টি অনুসারে বান্দার কর্মকাণ্ড সংঘটিত হতে দিয়ে বান্দার উপর তার প্রমাণাদি প্রতিষ্ঠা করেন। যাতে করে তার জানার উপর নয় বরং বাস্তব ভিত্তিতে তিনি বান্দাকে সওয়াব বা শাস্তি দিতে পারেন। মূলত: এর মাধ্যমে আল্লাহ তা'আলা বান্দার পরীক্ষা নিয়ে থাকেন।
যেমন অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, “এটা এজন্যে যে, আল্লাহ তোমাদের অন্তরে যা আছে তা পরীক্ষা করেন এবং তোমাদের মনে যা আছে তা পরিশোধন করেন। আর অন্তরে যা আছে সে সম্পর্কে আল্লাহ বিশেষভাবে অবহিত।” [সূরা আলে ইমরান ১৫৪] এ আয়াতে পরীক্ষা করার কথা বলার মাধ্যমে এ কথাটি স্পষ্ট হয়েছে যে, আল্লাহ আগে থেকেই জানেন। কিন্তু তার উদ্দেশ্য পরীক্ষা করা। এ অর্থের সমর্থন পাওয়া যায় আয়াতের শেষে ‘আর অন্তরে যা আছে সে সম্পর্কে আল্লাহ বিশেষভাবে অবহিত এ কথা বলার মাধ্যমে। এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেলে পবিত্র কুরআনের অন্যত্র যেমন, সূরা আল-কাহাফ: ১২, সাবা ২১ এ ব্যবহৃত لِنَعْلَمَ শব্দটির অর্থ স্পষ্ট হয়ে যাবে এবং কোন সন্দেহের উদ্রেক হবে না। [আদওয়াউল বায়ান] [9]
সুরা বাকারাহর ১৪৩ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসির কুরতুবীতে বলা হয়েছে—
قَوْلُهُ تَعَالَى: إِلَّا لِنَعْلَمَ مَنْ يَتَّبِعُ الرَّسُولَ" قَالَ عَلِيُّ بْنُ أَبِي طَالِبٍ رَضِيَ اللَّهُ تَعَالَى عَنْهُ: مَعْنَى" لِنَعْلَمَ" لِنَرَى. وَالْعَرَبُ تَضَعُ الْعِلْمَ مَكَانَ الرُّؤْيَةِ، وَالرُّؤْيَةَ مَكَانَ الْعِلْمِ، كَقَوْلِهِ تَعَالَى:" أَلَمْ تَرَ كَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ " بِمَعْنَى أَلَمْ تَعْلَمْ. وَقِيلَ: الْمَعْنَى إِلَّا لِتَعْلَمُوا أَنَّنَا نَعْلَمُ، فَإِنَّ الْمُنَافِقِينَ كَانُوا فِي شَكٍّ مِنْ عِلْمِ اللَّهِ تَعَالَى بِالْأَشْيَاءِ قَبْلَ كَوْنِهَا. وَقِيلَ: الْمَعْنَى لِنُمَيِّزَ أَهْلَ الْيَقِينِ مِنْ أَهْلِ الشَّكِّ، حَكَاهُ ابْنُ فُوْرَكَ، وَذَكَرَهُ الطَّبَرِيُّ عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ. وَقِيلَ: الْمَعْنَى إِلَّا لِيَعْلَمَ النَّبِيُّ وَأَتْبَاعُهُ، وَأَخْبَرَ تَعَالَى بِذَلِكَ عَنْ نَفْسِهِ، كَمَا يُقَالُ: فَعَلَ الْأَمِيرُ كَذَا، وَإِنَّمَا فَعَلَهُ أَتْبَاعُهُ، ذَكَرَهُ الْمَهْدَوِيُّ وَهُوَ جَيِّدٌ. وَقِيلَ: مَعْنَاهُ لِيَعْلَمَ مُحَمَّدٌ، فَأَضَافَ عِلْمَهُ إِلَى نَفْسِهِ تَعَالَى تَخْصِيصًا وَتَفْضِيلًا، كَمَا كَنَّى عَنْ نفسه سبحانه في قوله: (يا ابن آدم مرضت فلم تعدني) الْحَدِيثَ. وَالْأَوَّلُ أَظْهَرُ، وَأَنَّ مَعْنَاهُ عِلْمُ الْمُعَايَنَةِ الَّذِي يُوجِبُ الْجَزَاءَ، وَهُوَ سُبْحَانُهُ عَالِمُ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ، عَلِمَ مَا يَكُونُ قَبْلَ أَنْ يَكُونَ، تَخْتَلِفُ الْأَحْوَالُ عَلَى الْمَعْلُومَاتِ وَعِلْمُهُ لَا يَخْتَلِفُ بَلْ يَتَعَلَّقُ بِالْكُلِّ تَعَلُّقًا وَاحِدًا. وَهَكَذَا كُلُّ مَا وَرَدَ فِي الْكِتَابِ مِنْ هَذَا الْمَعْنَى مِنْ قَوْلِهِ تَعَالَى:" وَلِيَعْلَمَ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا وَيَتَّخِذَ مِنْكُمْ شُهَداءَ"،" وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ حَتَّى نَعْلَمَ الْمُجاهِدِينَ مِنْكُمْ وَالصَّابِرِينَ" وَمَا أَشْبَهَ
অর্থঃ “আল্লাহ তাআলার বাণী: { إِلاَّ لِنَعْلَمَ مَن يَتَّبِعُ ٱلرَّسُولَ } (যাতে আমি জানতে পারি যে, কে রসূলের অনুসরণ করে) [এর ব্যাখ্যায়] আলি ইবন আবি তালিব রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বলেছেন: " لِنَعۡلَمَ" {শাব্দিক অর্থঃ যাতে আমি জানতে পারি} এর মানে হচ্ছেঃ "যেন আমি দেখি"। কারণ, আরবরা [ভাষার ক্ষেত্রে] ‘জানা’ এর পরিবর্তে ‘দেখা’ এবং ‘দেখা’ এর পরিবর্তে ‘জানা’ ব্যবহার করে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন: "أَلَمْ تَرَ كَيْفَ فَعَلَ رَبُّكَ" { তুমি কি দেখনি যে, তোমার প্রতিপালক [হাতি-ওয়ালাদের সাথে] কিরূপ (আচরণ) করেছিলেন? (সুরা ফিল: ১)}— এখানে এর অর্থ হচ্ছে “তুমি কি জানো না?” [অর্থাৎ, আয়াতে "দেখা" বলতে "জানার" অর্থ বোঝানো হয়েছে।]
[এর ব্যাখ্যায়] আরো বলা হয়, এর অর্থ হচ্ছে, "যেন তোমরা জানতে পারো যে আমি জানি।" কারণ আল্লাহ তা’আলা কর্তৃক কোনো কিছু ঘটার আগে থেকেই জ্ঞান থাকার ব্যাপারে মুনাফিকরা সন্দেহ করত।
আরো বলা হয়, এর অর্থ হচ্ছে, "যেন আমি দৃঢ় বিশ্বাসী [মুসলিম]দেরকে সংশয়বাদীদের [মুনাফিক] থেকে আলাদা করে দেই।" এটি ইবনু ফুরাক(র.) উল্লেখ করেছেন এবং তাবারী(র.) এটি ইবন আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন।
আরো বলা হয় এর অর্থ হচ্ছে, "যেন নবী(ﷺ) ও তাঁর অনুসারীরা জানতে পারেন।" এবং আল্লাহ এটি নিজের পক্ষ থেকে জানিয়ে দিয়েছেন। যেমন বলা হয়: "আমির এ কাজ করেছেন," যদিও প্রকৃতপক্ষে এটি তাঁর অনুসারীরা করেছেন। মাহদাওয়ী(র.) এটিকে উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন এটি একটি উত্তম ব্যাখ্যা।
আরো বলা হয় এর অর্থ হচ্ছে, "যেন মুহাম্মাদ(ﷺ) জানতে পারেন।" তবে আল্লাহ তা’আলা নিজের জ্ঞানের সাথে তা সম্পৃক্ত করেছেন এর মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যের কারণে। যেমন আল্লাহ বলেনঃ "হে আদম সন্তান! আমি অসুস্থ ছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে দেখতে আসোনি"—এই হাদিসে আল্লাহ নিজেকে উল্লেখ করেছেন।
তবে [এই সকল ব্যাখ্যার মাঝে] প্রথম ব্যাখ্যাটি অধিক স্পষ্ট। এর অর্থ হলো প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের জ্ঞান, যার ওপর ভিত্তি করে প্রতিফল দেয়া হয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা দৃশ্যমান ও অদৃশ্য সমস্ত বিষয়ে জ্ঞাত। তিনি কোনো কিছু ঘটার আগেই সে সম্পর্কে জানেন। তবে পরিস্থিতিগুলো [আল্লাহর] জ্ঞানের বিষয়বস্তুর ওপর ভিত্তি করে পরিবর্তিত হয়, কিন্তু তাঁর জ্ঞানের কোনো পরিবর্তন হয় না। বরং এটি সমস্ত বিষয়ের সঙ্গে একক ও সামগ্রিকভাবে সম্পর্কিত। এবং এই অর্থে কিতাবে (কুরআনে) যা কিছু এসেছে, যেমন আল্লাহ তাআলার বাণী:
{ وَلِيَعْلَمَ ٱللَّهُ ٱلَّذِينَ آمَنُواْ وَيَتَّخِذَ مِنكُمْ شُهَدَآءَ } (যাতে আল্লাহ বিশ্বাসীগণকে জানতে পারেন এবং তোমাদের মধ্য হতে কিছুকে শহীদরূপে গ্রহণ করতে পারেন) (আলে ইমরান: ১৪০),
{ وَلَنَبْلُوَنَّكُمْ حَتَّىٰ نَعْلَمَ ٱلْمُجَاهِدِينَ مِنكُمْ وَٱلصَّابِرِين } (আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করব যতক্ষণ না আমি তোমাদের মধ্যে মুজাহিদ ও ধৈর্যশীলদেরকে জেনে নিই) (মুহাম্মাদ: ৩১)—এবং অনুরূপ।” [10]
উপরের আলোচনা থেকে এটি পরিষ্কার হল যে, আগে থেকেই সব কিছু জানা সত্ত্বেও আল্লাহ তা’আলা মানুষকে পরীক্ষা করেন ও কর্ম করার সুযোগ দেন। এটা মহান আল্লাহর ন্যায়পরাণতা। আল্লাহ তা’আলা কর্তৃক মানুষকে পরীক্ষা করবার হিকমত ব্যাপক। আল্লাহ তা’আলা মানুষকে যেসব পরীক্ষার মধ্যে ফেলেন, এতে সফলকাম হবার দ্বারা মানুষ নেকি অর্জন করে। কেউ সে পরীক্ষাতে সফল হোক আর ব্যর্থ হোক, অন্যদের জন্য তা দৃষ্টান্ত হিসেবে থাকে। একজন মানুষের পরীক্ষায় পতিত হওয়া অন্য মানুষের জন্য উদাহরণস্বরূপ। আল্লাহ তা’আলা সব থেকে বড় পরীক্ষাগুলো নিয়েছিলেন সব থেকে নেককার বান্দা অর্থাৎ নবী-রাসুলদের (আ.)। এমন বহু পরীক্ষার বিবরণ আল কুরআনে আছে। [11] এই পরীক্ষাগুলো দ্বারা নবী-রাসুলদের (আ.) উত্তম কর্ম প্রকাশিত হয়েছে। যার ফলে মানুষের জন্য অনুসরণীয় উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে। আল কুরআনে সুরা আস-সফফাতে নবী ইব্রাহিম(আ.) এর সন্তান কুরবানীর মহা পরীক্ষার বিবরণ রয়েছে। সে ঘটনায় তিনি যখন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তারপর বলা হয়েছে,
وَ تَرَكۡنَا عَلَیۡهِ فِی الۡاٰخِرِیۡنَ
অর্থঃ "আর এ বিষয়টি পরবর্তীদের জন্য স্মরণীয় করে রাখলাম।" [12]
উপরের আলোচনার সারকথা হিসেবে বলা যায়—
১। কুরআনের বিভিন্ন আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে আল্লাহ তা’আলা সর্বজ্ঞানী, তিনি আগে থেকেই সব কিছু জানেন এবং তিনি সকলের অন্তরের খবরও জানেন।
২। আল্লাহ তা’আলা মানুষকে পরীক্ষা করেন তাদের কর্মকে প্রকাশ করে দেবার জন্য। মানুষের কর্মের ব্যাপারে আগে থেকেই জানা সত্ত্বেও সেই পূর্বজ্ঞানের আলোকে না বরং মানুষ পরীক্ষায় পতিত হয়ে বাস্তবে যে কর্ম করে এর আলোকে আল্লাহ তা’আলা বিচার করেন ও প্রতিফল দান করেন। এটা আল্লাহ তা’আলার ন্যাপরায়ণতার প্রমাণ।
৩। কুরআনের যেসব আয়াতে বলা হয়েছে মানুষকে পরীক্ষা করার দ্বারা আল্লাহ তাদের কর্ম “জেনে নেন”, সে আয়াতগুলোর উদ্দেশ্য আদৌ এটা নয় যে আল্লাহ তা’আলা পূর্বে তাদের কর্মের ব্যাপারে জানতেন না। বরং তা এই অর্থে বলা হয়েছে - আল্লাহ এর দ্বারা মানুষের কর্মকে দেখেন, এবং প্রকাশ করেন। এর দ্বারা সকলের সামনে তিনি ভালো ও খারাপকে পৃথক করে দেন। আরবরা ভাষার ক্ষেত্রে জানা’ এর পরিবর্তে ‘দেখা’ এবং ‘দেখা’ এর পরিবর্তে ‘জানা’ ব্যবহার করে। এবং আরবদের এই ভাষাতেই কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে।
৪। আল্লাহ তা'আলা বান্দাকে পরীক্ষার মাধ্যমে তাঁর জানা বিষয়টি অনুসারে বান্দার কর্মকাণ্ড সংঘটিত হতে দিয়ে বান্দার উপর তার প্রমাণাদি প্রতিষ্ঠা করেন। যাতে করে তাঁর জানার উপর নয় বরং বান্দার প্রকাশ্য কর্মের ভিত্তিতে বান্দাকে সওয়াব বা শাস্তি দেয়া যায়।
৫। মানুষকে পরীক্ষা করার দ্বারা আল্লাহ তা’আলা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
আরো পড়ুনঃ
একজন দয়ালু স্রষ্টা কী করে কারো পুত্রকে জবাই করতে বলে পরীক্ষা নিতে পারেন?
জান্নাতীদের আমল করা কাউকে কি শুধুমাত্র তাকদিরের প্রভাবে জোর করে জাহান্নামী বানিয়ে দেয়া হয়?
কেউ যদি ইসলামের ভুল বার্তা পেয়ে মুসলিম না হয়েই মারা যায় তবে তার কী হবে?
তাকদির আগে থেকে নির্ধারিত হলে মানুষের বিচার হবে কেন? যাদের কাছে ইসলামের দাওয়াহ পৌঁছেনি তাদের কী হবে?
যার উপর নূরের আলোকপ্রভা পড়েছে সে সৎপথ পেয়েছে যার উপর পড়েনি সে পথভ্রষ্ট হয়েছে–এই হাদিসের ব্যাখ্যা
যে মেয়েকে জীবন্ত কবর দেওয়া হয় এবং যে কবর দেয় - উভয় কি জাহান্নামী?
তথ্যসূত্রঃ
[1] আল কুরআন, রা'দ ১৩ : ৯
[2] আল কুরআন, আন'আম ৬ : ৫৯
[3] আল কুরআন, লুকমান ৩১ : ৩৪
[4] আল কুরআন, হজ ২২ : ৭০
[5] আল কুরআন, মুহাম্মাদ ৪৭ : ৩১
[6] আল কুরআন, বাকারাহ ২ : ১৪৩
[7] তাফসির কুরতুবী, সুরা মুহাম্মাদের ৩১ নং আয়াতের তাফসির, খণ্ড ১৬, পৃষ্ঠা ২৫৩-২৫৪
https://shamela.ws/book/20855/6170
https://shamela.ws/book/20855/6171
অথবা (আর্কাইভকৃত)
[8] তাফসির ইবন কাসির (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), সুরা মুহাম্মাদের ৩১ নং আয়াতের তাফসির, খণ্ড ১০, পৃষ্ঠা ২৯৪
[9] আল-কুরআনুল কারীম বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসীর - ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া; সুরা বাকারাহর ১৪৩ নং আয়াতের তাফসির
[10] তাফসির কুরতুবী, সুরা বাকারাহর ১৪৩ নং আয়াতের তাফসির, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ১৫৬-১৫৭
https://shamela.ws/book/20855/628
https://shamela.ws/book/20855/629
অথবা (আর্কাইভকৃত)
[11] দেখুনঃ সুরা আম্বিয়া, সুরা আস-সফফাত, সুরা আ’রাফ
[12] আল কুরআন, আস-সফফাত ৩৭ : ১০৮