Pray for the world economy

ইসলাম কি ছোঁয়াচে রোগের অস্তিত্ব অস্বীকার করে?

 

ভূমিকাঃ

আল্লাহর সৃষ্টি এ পৃথিবীতে নানা উপকারী নিয়ামতের পাশাপাশি আছে বহু রোগ-ব্যাধি, অসুখ-বিসুখ। ইসলামবিরোধীরা দাবি করে যে, রোগ সংক্রমণ সম্পর্কে নবী মুহাম্মাদ(ﷺ) এর হাদিসের বক্তব্য বৈজ্ঞানিকভাবে ভুল। এ দাবি প্রমাণের জন্য তারা কিছু হাদিস দেখায়। যেমনঃ

 

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ عَنْ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ لاَ عَدْو‘ى وَلاَ طِيَرَةَ وَيُعْجِبُنِي الْفَأْلُ قَالُوا وَمَا الْفَأْلُ قَالَ كَلِمَةٌ طَيِّبَةٌ.

অর্থঃ আনাস(রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল() বলেছেন, ‘‘’আদওয়া’ (সংক্রমণ / সংক্রামক ব্যধি) ও অশুভ লক্ষণ বলতে কিছুই নেই। তবে শুভ লক্ষণ মানা আমার নিকট পছন্দনীয়।

[লোকেরা] বলল, শুভ লক্ষণ কী?

তিনি বললেন, উত্তম বাক্য।’’ [1]

 

আমরা দেখছি যে এ হাদিসে বলা হচ্ছে সংক্রমণ/সংক্রামক ব্যধি (عدوى) বলতে কিছু নেই। এটা দেখিয়ে অনেকে বলতে চায় – আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের জানায় জীবাণুর বিস্তারের দ্বারা এক প্রাণী থেকে অন্য প্রাণীতে রোগের সংক্রমণ ঘটে; কাজেই হাদিসের বক্তব্য সঠিক নয়। যারা এরূপ বলে, তারা আসলে অর্ধেক সত্য উপস্থাপন করে। আমরা যদি এ সংক্রান্ত আরো হাদিস সামনে আনি তাহলে দেখবো যে, এক প্রাণী থেকে অন্য প্রাণীতে রোগের জীবাণু ছড়ানো – এই প্রাকৃতিক নিয়মকে ইসলাম অস্বীকার করে না।

 

হাদিসের ব্যাখ্যাঃ

 

নবী() এর অন্যান্য হাদিসের আলোকেঃ

একটি হাদিসের ব্যাখ্যা পাওয়া যায় অন্যান্য হাদিসে। নবী(ﷺ) থেকে এ সংক্রান্ত আরো অনেক বর্ণনা পাওয়া যায়। এই বর্ণনাগুলো এক এক করে দেখলেই পুরো বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়।

 

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَا عَدْوَى، وَلَا طِيَرَةَ، وَلَا صَفَرَ، وَلَا هَامَّةَ فَقَالَ أَعْرَابِيٌّ: مَا بَالُ الْإِبِلِ تَكُونُ فِي الرَّمْلِ كَأَنَّهَا الظِّبَاءُ فَيُخَالِطُهَا الْبَعِيرُ الْأَجْرَبُ فَيُجْرِبُهَا؟ قَالَ: فَمَنْ أَعْدَى الْأَوَّلَ قَالَ مَعْمَرٌ: قَالَ الزُّهْرِيُّ: فَحَدَّثَنِي رَجُلٌ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّهُ سَمِعَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: لَا يُورِدَنَّ مُمْرِضٌ عَلَى مُصِحٍّ

অর্থঃ আবু হুরাইরা(রা) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসু্লুল্লাহ() বলেছেনঃ ‘আদওয়া’ (সংক্রমণ/সংক্রামক রোগ) বলতে কিছু নেই। কুলক্ষণ বলতে কিছু নেই সফর মাসকেও অশুভ মনে করা যাবে না এবং পেঁচা সম্পর্কে যেসব কথা প্রচলিত রয়েছে (هَامَّةَ) তাও অবান্তর। তখন এক বেদুঈন বললো, হে আল্লাহর রাসুল! আমার উটের পাল অনেক সময় মরুভূমির চারণ ভূমিতে থাকে, মনে হয় যেন নাদুস-নুদুস জংলী হরিণ। অতঃপর সেখানে কোনো একটি চর্মরোগে আক্রান্ত উট এসে আমার সুস্থ উটগুলোর সাথে থেকে এদেরকেও চর্মরোগী বানিয়ে দেয়। তিনি বললেনঃ প্রথম উটটির রোগ সৃষ্টি করলো কে?

মা‘মার (রহ.) বলেন, যুহরী (রহ.) বলেছেন, অতঃপর এক ব্যক্তি আবূ হুরাইরা(রা) সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি নবী()কে বলতে শুনেছেনঃ রোগাক্রান্ত উটকে যেন সুস্থ উটের সাথে একত্রে পানি পানের জায়গায় না আনা হয়।’’ ... [2]

 

قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم لاَ عَدْو‘ى وَلاَ طِيَرَةَ وَلاَ هَامَةَ وَلاَ صَفَرَ وَفِرَّ مِنَ الْمَجْذُومِ كَمَا تَفِرُّ مِنْ الأَسَدِ.

অর্থঃ “রাসুলুল্লাহ্() বলেছেনঃ রোগের কোনো সংক্রমন নেই, কুলক্ষণ বলে কিছু নেই, পেঁচা অশুভের লক্ষণ নয়, সফর মাসের কোন অশুভ নেই। কুষ্ঠ রোগী থেকে দূরে থাক, যেভাবে তুমি বাঘ থেকে দূরে থাক। [3]

 

এক উট থেকে অন্য উটে রোগের জীবাণু ছড়িয়ে যায়। এ ছাড়া কুষ্ঠ রোগীর নিকটে গেলে এর জীবাণু ছড়িয়ে যাবার সম্ভাবনা খুবই বেশি থাকে। [4] উপরের হাদিসগুলোতে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, “সংক্রমন নেই” বলবার সাথে সাথে এটাও বলা হচ্ছে যে, রোগাক্রান্ত উটকে যেন সুস্থ উটের কাছে না আনা হয় এবং কুষ্ঠ রোগীর থেকে যেন দূরত্ব বজায় রাখা হয়। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, রোগের জীবাণু সংক্রমিত হবার প্রাকৃতিক এ প্রক্রিয়া হাদিসে উপেক্ষিত হয়নি। এ প্রক্রিয়া যদি হাদিসে অস্বীকারই করা হত, তাহলে নবী(ﷺ) কেন কুষ্ঠ রোগীর থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে বললেন? আর কেনইবা রোগাক্রান্ত উটকে সুস্থ উটের কাছে আনতে নিষেধ করলেন? কেউ যদি আসলেই ছোঁয়াচে রোগের অস্তিত্ব অস্বীকার করে, তাহলে কি সে ঐ একই বক্তব্যের মধ্যে ছোঁয়াচে রোগ থেকে দূরে থাকতে বলে?

 

এবার কেউ কেউ হয়তো বলবেনঃ কিন্তু এখানে তো সরাসরিই এটি উল্লেখ করা হয়েছেঃ لاَ عَدْو‘ى অর্থাৎ “সংক্রমন/সংক্রামক ব্যধি নেই” !! তাদের উদ্যেশ্যে বলবোঃ হ্যাঁ, এটা অবশ্যই হাদিসের সঠিক অনুবাদ। কিন্তু এখানে চট করে একটা শব্দার্থ দেখেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে চলে যাওয়া সম্ভব না। বরং নবী(ﷺ) এর পূর্ণ বক্তব্য ও আমল দেখে হাদিসের বুঝ নিতে হবে। তা না হলে অনেক ক্ষেত্রেই ভুল বার্তা নেবার সম্ভাবনা থাকে। প্রেক্ষাপট বা অন্য কিছু বিবেচনা না করে শুধু ২-১টি শব্দের আক্ষরিক অর্থ থেকে যদি এই হাদিসের হুকুম নেয়া হয় তাহলে বেশ বড়সর সমস্যা হবে। যেমন ধরুন, উপরে উল্লেখিত হাদিসগুলোতে শুধু لاَ عَدْو‘ى (“লা আদওয়া” - সংক্রমন নেই) এই কথাই বলা নেই, এর সাথে “লা সফর” (لَا صَفَرَ), “লা হামাহ” (لاَ هَامَةَ) - এই কথাগুলোও কিন্তু বলা আছে। আরবিতে সফর (صَفَر) হচ্ছে একটি মাসের নাম। শুধু শাব্দিক অর্থ বিবেচনায় নিলে এর মানে দাঁড়ায়ঃ “সফর মাস নেই”! নবী(ﷺ) কি সফর মাসের অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন?!! আমার মনে হয় পাগলেও এমন কিছু দাবি করবে না। আবার, আরবিতে ‘হামাহ’ (هَامَةَ) শব্দ দিয়ে বোঝানো হয় হুতুম পেঁচাকে। [5] শুধু শাব্দিক অর্থ বিবেচনায় নিলে এর মানে দাঁড়ায়ঃ “হুতুম পেঁচা নেই”! নবী(ﷺ) কি এই হাদিসে পেঁচা নামক পাখিটির অস্তিত্বকে অস্বীকার করেছেন?!! ইসলাম ছোঁয়াচে রোগের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে বলে যারা দাবি করে, তাদের অভিযোগ সে কতোটা হাস্যকর তা বোধ করি এখন বোঝা যাচ্ছে। যে যুক্তিতে দাবি করা হয় “হাদিসে রোগ সংক্রমণের প্রক্রিয়াকে অস্বীকার করা হয়েছে অতএব হাদিসে বৈজ্ঞানিক ভুল (!) আছে”, ঐ একই (কু) যুক্তি দিয়ে এটাও প্রমাণ (!) করা যায় যে, হাদিসে সফর মাস এবং পেঁচার অস্তিত্বও অস্বীকার করা হয়েছে! আমার মনে হয় ইসলামের ঘোরতর শত্রুও এহেন পাগলাটে দাবি করবে না। আমরা যদি হাদিসের প্রেক্ষাপট, নবী(ﷺ) এর অন্যান্য হাদিস ও আমল বিবেচনায় না নিয়ে শুধু আক্ষরিক অর্থ বিবেচনা করি, তাহলে এভাবে ভুলভাল বার্তা পাবার সমূহ সম্ভাবনা থাকে।

 

একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে। ধরা যাক দুই বন্ধু একটি গ্রামে এলো। ১ম বন্ধু ২য় বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলোঃ “এই গ্রামে কি মশার উপদ্রব আছে?” উত্তরে ২য় বন্ধু বললোঃ “মশা নেই। কিন্তু যদি পাশের গ্রামে যাও, তাহলে সাথে এরোসল বা কয়েল রেখো।” প্রিয় পাঠক, লক্ষ করুন। এখানে কেউ যদি ২য় বন্ধুর শুধুমাত্র “মশা নেই” এই কথাটিকে উদ্ধৃত করে আর দাবি করে “এই ব্যক্তি সারা পৃথিবীতেই মশার অস্তিত্ব অস্বীকার করেছে!!” - তাহলে বিষয়টি কেমন হবে? নিঃসন্দেহে ভুল হবে। কেননা কেউ যদি তার এই বক্তব্যের প্রেক্ষাপট এবং সম্পূর্ণ বক্তব্য দেখে তাহলে বুঝতে পারবে এই ব্যক্তি মোটেই সারা পৃথিবীতে মশার অস্তিত্ব অস্বীকার করেনি। সে শুধুমাত্র ঐ গ্রামে মশা নেই এটা বলেছে। পাশাপাশি এটাও বলেছে যে পাশের গ্রামে গেলে যেন এরোসল বা কয়েল সাথে রাখে। সে যদি সারা পৃথিবীতেই মশার অস্তিত্ব অস্বীকার করতো, তাহলে তো আর পাশের গ্রামে গেলে সতর্কতা অবলম্বন করতে বলতো না! প্রিয় পাঠক, এবার ছোয়াঁচে রোগ সংক্রান্ত হাদিসগুলোর পূর্ণ বক্তব্যের দিকে খেয়াল করুন।

 

এবার প্রশ্ন আসতে পারে – হাদিসে কেন বলা হলো “সংক্রমন/ সংক্রামক রোগ নেই” ? এই হাদিসের প্রেক্ষাপটই বা কী?

 

ইতিমধ্যেই উল্লেখিত সুনান আবু দাউদ ৩৯১১ নং হাদিসে সাহাবীগণ যখন এক উটের সংস্পর্শে অন্য উটের রোগাক্রান্ত হবার ঘটনার কথা উল্লেখ করলেন, তখন নবী(ﷺ) বললেন, “প্রথম উটটির রোগ সৃষ্টি করলো কে?” উত্তর হচ্ছেঃ এই রোগের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তা’আলা। যখন কেউ রোগাক্রান্ত ছিলো না, তখন এই রোগ তিনি সৃষ্টি করেছেন। প্রথম রোগাক্রান্ত প্রাণী তো কারো নিকট থেকে সংক্রমণের শিকার হয়নি। রোগের জীবাণু সংক্রমিত হয় বটে, কিন্তু জীবাণু সংক্রমিত হওয়া মানেই রোগ সংক্রমিত হওয়া না। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সুস্থ রাখেন, যাকে ইচ্ছা রোগাক্রান্ত করেন। যদি আল্লাহর ইচ্ছা ও অনুমতি না থাকে, তাহলে জীবাণু সংক্রমিত হলেও রোগ হয় না। আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতিত জীবাণুর সংক্রমিত হবারও যেমন সামর্থ্য নেই, আবার সংক্রমিত হয়েও কারো দেহে রোগ সৃষ্টি করার ক্ষমতা নেই। বিষয়টি তাকদিরের সাথে সম্পর্কিত। [6] সাধারণ পর্যবেক্ষণ ও যুক্তিও এটাই বলে যে – জীবাণু সংক্রমিত হওয়া মানেই রোগ সংক্রমিত হওয়া না। জীবাণু সংক্রমিত হলেও অনেক সময়েই মানুষ রোগাক্রান্ত হয় না। যেমনঃ বসন্ত রোগীর সংস্পর্শে থাকলে কেউ কেউ এ রোগে আক্রান্ত হয়, আবার কেউ কেউ আক্রান্ত হয় না। আলোচ্য হাদিসটির প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানা থাকলে এ নিয়ে প্রশ্ন তুলবার আর কোনোই সুযোগ থাকে না। এ হাদিসের প্রেক্ষাপট হলোঃ জাহেলী যুগে আরবের মানুষদের ধারণা ছিলো রোগ নিজে নিজেই অন্য দেহে সংক্রমণ করে। এই ভ্রান্ত ধারণার অপনোদন করে নবী(ﷺ) তাদেরকে জানালেন - ব্যাপারটি মোটেও এমন নয়। আর সব কিছুর মতো রোগ-ব্যাধিরও স্রষ্টা মহান আল্লাহ। তাঁর পক্ষ থেকেই রোগ অবতীর্ণ হয়। রোগের নিজে নিজে সংক্রমিত হবার কোনো ক্ষমতাই নেই। [7] নবী(ﷺ) থেকে এ সংক্রান্ত একটি দীর্ঘ ও বিস্তারিত বর্ণনা আছে মুসনাদ আহমাদে। দীর্ঘ সে হাদিসটি দেখলে পুরো বিষয়টি পানির মতো সহজ হয়ে যাবে। বুখারী-মুসলিমের ছোঁয়াচে রোগ সংক্রান্ত রেওয়ায়েতগুলো মূলত সংক্ষিপ্ত রেওয়ায়েত। বিস্তারিত রেওয়ায়েতটি আছে মুসনাদ আহমাদে। সেখান থেকে আমরা নবী(ﷺ) এর পূর্ণ বক্তব্য দেখে নিই—

 

عن أبى هريرة قال، قال رسول الله ﷺ لا يعدي شيء شيئا، لا يعدي شيء شيئا، ثلاثا، قال فقام أعرابي فقال يا رسول الله، ان النقبة من الجرب تكون بمشفر البعير، أو بعجبه، فتشتمل الإبل جربا، قال فسكت ساعة، ثم قال:  ما أعدى الأول، لا عدوى، ولا صفر، ولا هامة، خلق الله كل نفس، فكتب حياتها وموتها ومصيباتها ورزقها

অর্থঃ আবু হুরায়রা(রা.) থেকে বর্ণিত। আল্লাহর রাসুল() বলেছেনঃ  কোনো কিছুই নিজে থেকে অন্য কিছুকে সংক্রমিত করতে পারে না। কোনো কিছুই নিজে থেকে অন্য কিছুকে সংক্রমিত করতে পারে না। এভাবে তিনবার বললেন। (বর্ণনাকারী) বলেন, একজন বেদুঈন বললো, হে আল্লাহর রাসুল, উটের যে চর্মরোগ হয় সেটা তো সব উটকেই আক্রান্ত করে ফেলে। (বর্ণনাকারী) বলেন, তিনি [নবী()] এই মুহূর্তের জন্য থামলেন। এরপর বললেন, তাহলে প্রথম উটটিকে কে আক্রান্ত করেছিল? ‘আদওয়া’[সংক্রমণ] নেই, ‘সফর’ [মাসের অশুভ লক্ষণ] নেই, ‘হামাহ’ [পেঁচার অশুভ লক্ষণ] নেই। সকল প্রাণকেই আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন তার জীবন, মৃত্যু, বিপদাপদ, জীবিকা সবকিছুকেই তিনি নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন  [8]

 

এই হাদিসটি সাহাবী আবু হুরায়রা(রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে। এটি একটি সহীহ হাদিস। মুসনাদ আহমাদেই আরেক স্থানে অনুরূপ হাদিস বর্ণিত হয়েছে সাহাবী আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ(রা.) থেকে। [9]

 

এই হাদিসের শুরুতেই নবী(ﷺ) বলেছেন, “لا يعدي شيء شيئا” । আরবি ভাষায় এই বাক্যের অর্থ আলোচনা করা হয়েছে এডওয়ার্ড উইলিয়াম লেনের অভিধানে। এই অভিধানটি (Lane's Lexicon) আরবি ভাষার অত্যন্ত বিখ্যাত এবং প্রসিদ্ধ একটি অভিধান, সব মহলেই যার গ্রহণযোগ্যতা আছে। সেখানে “لا يعدي شيء شيئا” - এর অর্থ করতে গিয়ে বলা হয়েছেঃ A thing (meaning disease) does not pass by its own agency[10] অর্থাৎ, রোগ নিজে থেকে বা নিজের মাধ্যমে সংক্রমিত হতে পারে না। আরবি ভাষায় এর ব্যবহার আলোচনা করতে গিয়ে সেখানে আরো বলা হয়েছে, اعداه الله God made it to pass from him that had it to one that was near to him, so that he became affected therewith.”[11] অর্থাৎ, اعداه الله –আল্লাহই একে তার থেকে ছড়িয়ে পড়তে দিয়েছেন এবং তার নিকটবর্তী ব্যক্তির কাছে এটি (রোগের জীবাণু) চলে গেছে। এর ফলে সে এর দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে।

 

 

প্রসঙ্গসহ হাদিসটির অর্থ থেকেই বোঝা যাচ্ছে এর বক্তব্য বিষয় কী। এখানে মূল কথাটি হচ্ছেঃ কোনো রোগ নিজে থেকে ছড়াতে পারে না। বরং আল্লাহ তা’আলার ইচ্ছা ও অনুমতিক্রমে তা ছড়ায়। প্রাচীন আরবের কিছু কুসংস্কারের অসারতার কথা বলা হয়েছে একই সাথে রোগ যে নিজে থেকে সংক্রমিত হতে পারে না সেটিও বলা হয়েছে। “রোগ আদৌ ছড়ায় না” সেটি এখানে উদ্যেশ্য নয় বরং “রোগ নিজে থেকে ছড়ায় না” এটিই এখানে উদ্যেশ্য। প্রাচীন আরবের মানুষেরা আল্লাহ ব্যতিত (গায়রুল্লাহ) কল্পিত বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তি সংক্রান্ত বিভিন্ন কুসংস্কারপূর্ণ বিশ্বাস পোষণ করতো। এখানে নবী(ﷺ) সেই সকল কুসংস্কারপূর্ণ বিশ্বাসের অপনোদন করেছেন এবং সকল কিছু যে আল্লাহর ইচ্ছায় আল্লাহর নির্ধারনের দ্বারাই হয়, সেই সত্যটি জানিয়েছেন। এবং বলেছেনঃ “সকল প্রাণকেই আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন তার জীবন, মৃত্যু, বিপদাপদ, জীবিকা সবকিছুকেই তিনি নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন ”। নবী-রাসুলদের দায়িত্ব তো মূলত এটিই ছিলো, মানুষকে আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া। নবী(ﷺ) এখানে সেটিই করেছেন। প্রখ্যাত হাদিস বিশারদরা হাদিসের মূল অর্থ এবং অন্যান্য হাদিসগুলোকে একত্রে বিবেচনা করে বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করেছেন যা আমরা একটু পরেই আলোচনা করবো ইন শা আল্লাহ। 

 

এবার চলুন আমরা এই প্রসঙ্গে নবী(ﷺ) এর কিছু আমল এবং নির্দেশনার হাদিস দেখে নিই।

 

নবী(ﷺ) একবার সাহাবীদের নিকট থেকে বায়আত নিচ্ছিলেন। বায়আতের সময়ে হাতে হাত রাখতে হয়। এসময় বায়আত নিতে আগত সাকিফ গোত্রীয় প্রতিনিধি দলের মাঝে একজন কুষ্ঠ রোগী ছিলেন। ঘটনাটি হাদিসে এভাবে বর্ণিত আছেঃ

 

عَنْ عَمْرِو بْنِ الشَّرِيدِ، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ كَانَ فِي وَفْدِ ثَقِيفٍ رَجُلٌ مَجْذُومٌ فَأَرْسَلَ إِلَيْهِ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم ‏ "‏ إِنَّا قَدْ بَايَعْنَاكَ فَارْجِعْ ‏"

অর্থঃ আমর ইবনু শারীদ(র.) সুত্রে তার পিতা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, সাকীফ গোত্রীয় প্রতিনিধি দলের মাঝে একজন কুষ্ঠ রোগী ছিলেন। নবী() তার কাছে (সংবাদ) পাঠালেন যে, আমরা তোমাকে বায়আত করে নিয়েছি। তুমি ফিরে যাও। [12]

 

স্বয়ং নবী(ﷺ) একজন ছোঁয়াচে রোগীর সংস্পর্শে না এসে হাত দিয়ে তার বায়আত নেননি। তিনি যদি সত্যিই এটা বুঝিয়ে থাকতেন যে একজন ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে কখনোই রোগ ছড়ায় না - তাহলে কেন এটি করলেন? নাস্তিক-মুক্তমনাদের ভ্রান্ত দাবি এখানেই খণ্ডন হয়ে যাচ্ছে।

কিছু হাদিস থেকে অনেক মুসলিমও ভুল ব্যাখ্যা করে বলেনঃ “রোগ-ব্যধি কখনোই ছড়ায় না, সতর্কতা অবম্বনের প্রয়োজন নেই।” আমরা কি আজ নিজেদেরকে রাসুল(ﷺ) এর চেয়েও বেশি তাকওয়াবান ভাবছি?

 

আমরা আরো একটি হাদিস দেখতে পারি—

 

أُسَامَةَ بْنَ زَيْدٍ يُحَدِّثُ سَعْدًا عَنْ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم أَنَّه“ قَالَ إِذَا سَمِعْتُمْ بِالطَّاعُونِ بِأَرْضٍ فَلاَ تَدْخُلُوهَا وَإِذَا وَقَعَ بِأَرْضٍ وَأَنْتُمْ بِهَا فَلاَ تَخْرُجُوا مِنْهَا

অর্থঃ “উসামাহ ইবনু যায়দ(রা.) থেকে, তিনি সা’দ(রা.)-এর কাছে নবী() থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেছেনঃ যখন তোমরা কোনো অঞ্চলে প্লেগের বিস্তারের সংবাদ শোন, তখন সেই এলাকায় প্রবেশ করো না। আর তোমরা যেখানে অবস্থান কর, সেখানে প্লেগের বিস্তার ঘটলে সেখান থেকে বেরিয়ে যেয়ো না। [13]

 

কতোই না উত্তম ও কার্যকর একটি ব্যবস্থা। মহামারী আক্রান্ত অঞ্চল থেকে রোগীরা যদি বেরিয়ে না যায় এবং সে অঞ্চলে যদি বাইরে থেকে লোক না আসে, তাহলে রোগের জীবাণু ছড়িয়ে যাবার সুযোগ অনেক কমে যায়। এটা দেখে কি আদৌ মনে হচ্ছে যে হাদিসে রোগের জীবাণু ছড়িয়ে যাবার প্রাকৃতিক নিয়মকে অগ্রাহ্য করা হয়েছে? আধুনিক যুগে মহামারী প্রতিরোধ করার জন্য অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

 

ইমাম বায়হাকী(র.) এর সুনানুল কুবরা হাদিস গ্রন্থে পর পর দুইটি প্রায় একই মাতানের কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন সনদের হাদিস উল্লেখ করা হয়েছে---

 

لاعَدْوَى وَلاَ هَامَة وَلاَ صَفَرَ وَلاَ يَحل الْمُمْرِضُ عَلَى الْمصح وَليحل الْمصح حَيْثُ شَاءَ ‏ ‏.‏ فَقيل يَا رَسُولَ اللَّهِ وَلم ذَاكَ؟ قَالَ لانَّهُ أَذًى ‏

অর্থঃ ‘আদওয়া’ (সংক্রামক রোগ) নেই, পেঁচা (অশুভের লক্ষণ) নেই, সফর (মাসে অশুভ কিছু) নেই। তবে রোগা উটকে সুস্থ উটের সাথে রেখো না। অবশ্য সুস্থ উটকে যেখানে ইচ্ছা রাখতে পারো। অতঃপর তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো, হে আল্লাহর রাসুল, এমনটি কেন করা হবে? তিনি বললেনঃ কারণ তা ক্ষতিকর।[14]

 

 

এই হাদিসে স্পষ্টত বলা হচ্ছে, রোগাক্রান্ত উটকে সুস্থ উটের সাথে রাখা যাবে না কারণ তা ক্ষতিকর। (আল্লাহর ইচ্ছায়) এক উট থেকে অন্য উটে রোগের ছড়িয়ে পড়ার ক্ষতিকর প্রভাবকে এখানে সরাসরি উল্লেখ করা হচ্ছে। অবশ্য সুনানুল কুবরা র এই দুইটি হাদিসের সনদেই কিছু দুর্বলতা আছে। কাজেই এককভাবে এই হাদিস দলিল হবে না। তবে অন্যান্য সহীহ হাদিসের সাথে সমর্থকরূপে আমরা এটি উল্লেখ করতে পারি।

 

সাহাবীদের আমল থেকে ব্যাখ্যাঃ

 

মক্কা-মদীনার সাহাবীদের আমলঃ

 

عَنْ ابْنِ أَبِي مُلَيْكَةَ أَنَّ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ مَرَّ بِامْرَأَةٍ مَجْذُومَةٍ وَهِيَ تَطُوفُ بِالْبَيْتِ فَقَالَ لَهَا يَا أَمَةَ اللهِ لَا تُؤْذِي النَّاسَ لَوْ جَلَسْتِ فِي بَيْتِكِ فَجَلَسَتْ

অর্থঃ “ইবনু আবি মুলায়কা(র.) থেকে বর্ণিতঃ  বায়তুল্লাহর তাওয়াফরত কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত এক মহিলার নিকট দিয়ে উমার ইবনু খাত্তাব(রা.) যাচ্ছিলেন। তখন তিনি তাঁকে বললেন, হে আল্লাহর দাসী, অন্য মানুষকে কষ্ট দিও না। হায়, তুমি যদি তোমার বাড়িতেই বসে থাকতে। পরে উক্ত মেয়েলোকটি নিজের বাড়িতেই বসে থাকত। [15]

 

আমরা জানি যে কা'বায় তাওয়াফের সময় সেখানে অনেক মানুষ থাকে। উমার(রা.) তাঁকে এই ছোঁয়াচে রোগ নিয়ে কা'বায় তাওয়াফ করতে নিষেধ করে বাড়িতে অবস্থান করতে বলেছিলেন।

 

১৭ হিজরী সনে শামে (বৃহত্তর সিরিয়া-ফিলিস্তিন অঞ্চল) ভয়াবহ মহামারী ছড়িয়ে পড়ে। ইতিহাসে এটি Plague of Emmaus (طاعون عمواس) নামে পরিচিত।  [16]

 

সেই ছোঁয়াচে রোগঘটিত মহামারীর সময়টিতে উমার(রা.) শামে যাচ্ছিলেন। তিনি সেখানে মহামারীর সংবাদ পেলেন। এ পরিস্থিতিতে কর্মপন্থা নির্ধারণে তিনি সাহাবীদের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে বসলেন। সর্বশেষ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বয়োজ্যেষ্ঠ মুহাজির কুরাঈশী সাহাবীগণ। যারা ছিলেন প্রাথমিক যুগে ইসলাম গ্রহণকারী, রাসু্লুল্লাহ() এর ঘনিষ্ঠ শিষ্যবৃন্দ। তাঁরা সেই বৈঠকে কী বলেছিলেন?

তাঁরা উমার(রা.)কে বললেনঃ "আমাদের রায় হল, আপনি লোকজনকে নিয়ে ফিরে যান এবং তাদেরকে এই মহামারীর কবলে ঠেলে দেবেন না।"

সে সময়ে কেউ কেউ দ্বিধান্বিতও হয়ে গিয়েছিলেন। কেউ কেউ ভাবছিলেন এটা করা তাকওয়ার পরিপন্থী হয় কিনা, আল্লাহর নির্ধারিত তাকদির থেকে পলায়ন হয়ে যায় কিনা। যেমন, আবু উবাইদাহ ইবনুল জাররাহ(রা.) উমার(রা.)কে বললেন, "আপনি কি আল্লাহর নির্ধারিত তাকদির থেকে পলায়ন করার জন্য ফিরে যাচ্ছেন?"

 

উমার(রা.) তখন তাকদিরের ব্যাপারে ইসলামী আকিদা ব্যাখ্যা করলেনঃ “হ্যাঁ। আমরা আল্লাহর তাকদির থেকে আল্লাহর তাকদিরের দিকেই ফিরে যাচ্ছি। তুমি বলো তো, তুমি কিছু উটকে যদি এমন কোন উপত্যকায় দিয়ে এসো, যেখানে আছে দু’টি প্রান্ত। তার মধ্যে একটি হল সবুজ-শ্যামল, আর অন্যটি হল বৃক্ষহীন।

এবার ব্যাপারটি কি এমন নয় যে, যদি তুমি সবুজ প্রান্তে চরাও, তাহলে তা আল্লাহর তাকদির অনুযায়ীই চরাচ্ছো?

আর যদি তুমি বৃক্ষহীন প্রান্তে চরাও তাহলেও তা আল্লাহর তকদির অনুযায়ীই চরাচ্ছো?”

 

এই ঘটনার বর্ণনাকারী [ইবন আব্বাস(রা.)] বলেন, এমন সময় আব্দুর রহমান ইবন আউফ(রা.) এলেন। তিনি এতক্ষণ যাবৎ তার কোন প্রয়োজনে অনুপস্থিত ছিলেন। তিনি বললেন, এ ব্যাপারে আমার নিকট একটি তথ্য আছে, আমি আল্লাহর রাসুল()-কে বলতে শুনেছি যে, “তোমরা যখন কোনো এলাকায় (প্লেগের) প্রাদুর্ভাবের কথা শুনবে, তখন সেখানে যেও না। আর যদি এলাকায় প্লেগের প্রাদুর্ভাব নেমে আসে আর তোমরা সেখানে থাকো, তাহলে পলায়ন করে সেখান থেকে বেরিয়ে যেও না।”

 

এ হাদিস শুনে উমার(রা.) আল্লাহর প্রশংসা করলেন এবং মদীনা ফিরে গেলেন। এই ঘটনাটি বুখারী ও মুসলিমে সহীহ সূত্রে বর্ণিত আছে।  [17]

 

 

শামের সাহাবীদের আমলঃ

 

মদীনা থেকে আগত সাহাবীরা এভাবে শামে (বৃহত্তর সিরিয়া-ফিলিস্তিন অঞ্চল) প্রবেশ না করেই ফিরে গেলেন। শামের অভ্যন্তরে তখন কী হচ্ছিলো?

 

মুআয বিন জাবাল(রা.) সেই সংক্রামক মহামারীতে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তিনি মৃত্যুকালে আমর ইবনুল আস (রা.)-কে তাঁর স্থলাভিষিক্ত রেখে যান। মহামারীর সময়ে আক্রান্ত এলাকা থেকে বের হয়ে অন্য এলাকায় যেতে রাসুল(ﷺ) নিষেধ করেছেন। শাম থেকে বেরিয়ে যাওয়া হবে রাসুল(ﷺ) এর আদেশের লঙ্ঘন। সে রোগ থেকে আত্মরক্ষার জন্য আমর ইবনুল আস (রা.) শামবাসীকে সেই এলাকার মধ্যেই একত্রিত অবস্থায় না থেকে পাহাড়ী এলাকায় ছড়িয়ে যেতে বললেন। যাতে দাবানলের মতো সেই রোগ আর ছড়াতে না পারে। তিনি একদিন জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। সেই ভাষণে বললেনঃ

 

“ হে লোক সকল! এই রোগের যখন প্রাদুর্ভাব হয় তখন আগুনের ন্যায় লেলিহান শিখা ছড়িয়ে জ্বলতে থাকে। সুতরাং তখন তোমরা পাহাড়ে গিয়ে তা থেকে আত্মরক্ষা করো।

 

তার এ বক্তব্য শুনে শাম অঞ্চলের সাহাবীরা কী করলেন?

বর্ণনাকারী বলেন, তারপর তিনি ঐ স্থান ত্যাগ করেন। লোকজনও সেখান থেকে বেরিয়ে যায়। তারা বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। এদিকে আল্লাহ্ তা'আলা ওই রোগ তাদের থেকে তুলে নেন। মাত্র একজন সাহাবী বাদে অন্য সবাই এই সিদ্ধান্তের উপর একমত হয়েছিলেন। এটা ছিলো শামের সাহাবীদেরও সম্মিলিত কর্ম।

বর্ণনাকারী বলেন, আমর ইবনুল আস (রা.)-এর এই অভিমত ও পদক্ষেপ খলিফা উমর (রা.)-এর নিকট পৌঁছালে তিনিও এটিকে অপছন্দ করেন নি। [18] সেই মহামারীতে প্রায় ৩০,০০০ মানুষ মারা গিয়েছিলো। [19] 

 

 

আমরা সংক্রামক মহামারীর পরিস্থিতিতে মদীনা ও শামের সাহাবীদের সম্মিলিত বুঝ এবং আমলের কথা জানলাম।

 

উপরের ঘটনাগুলো বিশেষণ করে যা বোঝা যায়ঃ

 

এক মহিলার কা'বায় তাওয়াফ করার ঘটনাতে আমরা দেখলাম যে, পূণ্যময় কাজ হওয়া সত্ত্বেও উমার(রা.) তাঁকে সেটি করতে নিষেধ করছিলেন। কারণ সেই মহিলা ছিলো কুষ্ঠ আক্রান্ত। কা'বায় তাওয়াফের স্থানে ব্যাপক জনসমাগম হয়। এক্ষেত্রে উমার(রা.) অন্য মানুষদের অসুবিধার কথা ভেবে এ কাজ থেকে সেই মহিলাকে বারণ করেছিলেন। লক্ষ করি উমার(রা.) সেখানে কী বলছিলেনঃ "...অন্য মানুষকে কষ্ট দিও না... তুমি যদি তোমার বাড়িতেই বসে থাকতে।" আধুনিক যুগেও আমরা দেখি যে ছোঁয়াচে রোগাক্রান্ত মানুষকে জনসমাগমের মাঝে যেতে নিষেধ করে গৃহে অবস্থান করতে বলা হয়। একে বলা হয় Home isolation। রাসুল(ﷺ) এর হাদিস থেকে উমার(রা.) যদি এটাই বুঝতেন যে রোগ কখনো একজন থেকে অন্যজনে ছড়ায় না - তাহলে তিনি কেন এই কাজ করতে পরামর্শ দিলেন?

 

শামে যাবার পথে বৈঠকে বয়োজ্যেষ্ঠ মুহাজির সাহাবীগণ উমার(রা.)কে বলেছিলেনঃ "আপনি লোকজনকে নিয়ে ফিরে যান এবং তাদেরকে এই মহামারীর কবলে ঠেলে দেবেন না"। এ থেকে বোঝা গেলো রাসুল(ﷺ) এর সাহাবীগণ রোগের সংক্রমণে বিশ্বাস করতেন এবং তারা মোটেও রাসুল(ﷺ) এর হাদিস থেকে এটা বোঝেননি যে রোগ আদৌ ছড়ায় না। তাঁরা যদি এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে রোগ ছড়ানোতে বিশ্বাস না-ই করতেন, তাহলে এই কথা কেন বললেনঃ “তাদেরকে এই মহামারীর কবলে ঠেলে দেবেন না" ? এ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে সাহাবীরা মনে করতেন মহামারী কবলিত এলাকায় গেলে সুস্থ মানুষও এতে আক্রান্ত হতে পারে।

 

রাসুল(ﷺ) থেকে হাদিস রয়েছে, কোনো এলাকায় সংক্রামক মহামারী হলে সেখানে প্রবেশ না করতে বা সেখান থেকে বেরিয়ে না যেতে। উপরের বিবরণে আমরা এটিও দেখলাম যে এই হাদিসের আলোকে রাসুল(ﷺ) এর সাহাবীগণ মহামারী কবলিত শামে প্রবেশ থেকে বিরত ছিলেন। আমরা আধুনিক যুগেও দেখি সংক্রামক রোগাক্রান্ত অঞ্চলের ব্যাপারে একই রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় যাতে সেখানে গিয়ে অন্যরা আক্রান্ত না হয় এবং সেখান থেকে রোগটি বাইরে ছড়িয়ে না যায়। ইসলামে যদি রোগ ছড়ানোর বিষয়টিকে অস্বীকার করা হতো, তাহলে রাসুল(ﷺ) কেন এমন আদেশ দিয়েছিলেন?

 

আলোচ্য ঘটনা থেকে আরো বোঝা গেলো সংক্রামক রোগ থেকে সাবধানতা অবলম্বন করা এবং আক্রান্তদের থেকে দূরে থাকা মোটেও তাকদির অস্বীকার করা নয়, শির্ক নয়, তাকওয়ার খেলাফ নয়। উমার(রা.) শামে যাবার পথের সেই ঘটনায় তাকদিরের ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করেছেন। রাসুল(ﷺ) এর সাহাবীগণ শির্কে লিপ্ত হননি বা তাকওয়ার ক্ষেত্রেও তাঁদের কমতি ছিলো না। বরং তাঁরা রাসুল(ﷺ) এর হাদিস থেকেই এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন।

 

আমরা উপরে দেখলাম যে, শাম অঞ্চলের মধ্যে সাহাবীরা ঐ এলাকায় একসাথে না থেকে পাহাড়ী এলাকায় ফাঁকা ফাঁকা হয়ে ছড়িয়ে গিয়েছিলেন। যাতে সংক্রামক রোগটি তাঁদের মধ্যে সহজে ছড়িয়ে যেতে না পারে। আমর ইবনুল আস(রা.) এর বক্তব্যটি পুনরায় লক্ষ করিঃ “এই রোগের যখন প্রাদুর্ভাব হয় তখন আগুনের ন্যায় লেলিহান শিখা ছড়িয়ে জ্বলতে থাকে। সুতরাং তখন তোমরা পাহাড়ে গিয়ে তা থেকে আত্মরক্ষা করো। শামের সাহাবীরা এর উপরেই আমল করেছেন। তাঁরা যদি এটাই বিশ্বাস করতেন যে রোগ-ব্যধি কখনোই একজন থেকে অন্যজনে ছড়ায় না – তাহলে কেন নিজ নিজ বাড়িতে স্বাভাবিকভাবে অবস্থা না করে পাহাড়ী এলাকায় ছড়িয়ে গেলেন? আধুনিক যুগেও ছোঁয়াচে রোগের সংক্রমণ হ্রাস করার জন্য এরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় যাকে বলে Social distancing।

 

নাস্তিক-মুক্তমনারা বলতে চান যে প্রাচীন মুসলিমরা ছোঁয়াচে রোগে বিশ্বাস করতেন না এবং আধুনিক মুসলিমরা নাকি নতুন করে ব্যাখ্যা তৈরি করে ইসলামকে “বিজ্ঞানসম্মত” বানাতে চান! উপরে রাসুল(ﷺ) ও সাহাবীদের ঘটনাগুলো তাদের এই অপপ্রচারকে নিদারুণ মিথ্যা বলে প্রমাণ করছে।

 

বরাবরের মতোই নাস্তিক-মুক্তমনারা এবার হয়তো দিক বদল করে বলতে চাইবেনঃ মুহাম্মাদ(ﷺ) এর সাহাবীরা হয়তো ছোঁয়াচে রোগে বিশ্বাস করতেন! তাঁরা জীবন বাঁচাতে হাদিসের আদেশ অমান্য (!) করে নিজেরা ছোঁয়াচে রোগে বিশ্বাস করেছেন (নাউযুবিল্লাহ), অথবা তাঁরা হয়তো মুহাম্মাদ(ﷺ) এর চেয়ে বেশি জ্ঞানী ছিলেন (নাউযুবিল্লাহ), নিজেদের জ্ঞান থেকে রোগের সংক্রমণে বিশ্বাস করেছেন!

 

নাস্তিক-মুক্তমনারা যদি স্বভাববশত এহেন অপযুক্তি দিতে চায়, তাহলে সেটিও নিদারুণ ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হবে। কেননা আমরা শুরুতেই দেখেছি স্বয়ং নবী মুহাম্মাদ(ﷺ) সংক্রামক রোগাক্রান্ত রোগে আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে আসেননি, অন্যান্য বিভিন্ন হাদিসে তিনি সংক্রামক রোগী থেকে দূরে থাকতে বলেছেন। প্রাচীন জাহেলী যুগের ভ্রান্তি নিরসনের জন্যই তিনি রোগের সংক্রমণ সম্পর্কে একটি বিশেষ উক্তি করেছিলেন। রাসুল(ﷺ) এর বিভিন্ন হাদিস থেকেই এটি দেখা যায় যে তিনি বিভিন্ন সময়ে ছোঁয়াচে রোগ থেকে সতর্কতার ব্যাপারে বলেছেন। অপরদিকে, সাহাবী(রা.) গণ যদি সত্যিই নবী(ﷺ)কে অমান্য করার মানসিকতা রাখতেন এবং নিজেদেরকে নবী(ﷺ) অপেক্ষা বেশি জ্ঞানী মনে করতেন (নাউযুবিল্লাহ), তাহলে তাঁরা নবী(ﷺ)কে ভালোবেসে জীবনে দিতেন না বা সদা-সর্বদা নবী(ﷺ) এর হাদিসকে নিজেদের সামনে রাখতেন না। সাহাবীদের মহান জীবনের দিকে লক্ষ করলেই নাস্তিক-মুক্তমনাদের বিভ্রান্তি স্পষ্ট বোঝা যায়।

 

হাদিস বিশারদদের ব্যাখ্যাঃ

       এবার আমরা কয়েকজন প্রখ্যাত আলেম এবং হাদিস বিশারদের থেকে সংক্রামক রোগ সংক্রান্ত হাদিসগুলোর ব্যাখ্যা দেখবো।

 

ইমাম বায়হাকীর(র.)‘সুনানুল কুবরা’ হাদিস গ্রন্থে ছোঁয়াচে রোগসংক্রান্ত বেশ কিছু হাদিসকে একই অধ্যায়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সেই অধ্যায়ের নামকরণ করা হয়েছেঃ

 

باب لا عدوى على  الوجه الذى كانو فى الجاهلية يعتقدونه من اضافة الفعل الى غير الله تعالى

অর্থঃ লা আদওয়া (সংক্রমণ/সংক্রামক রোগ নেই) অধ্যায়; কথাটি জাহিলিয়াতের যুগের প্রেক্ষিতে বলা হয়েছে যখন তারা গায়রুল্লাহর দিকে (আল্লাহ ব্যতিরেকে) কর্মের সংঘটনকে সম্পৃক্ত করায় বিশ্বাস করতো। [20]

 

 

ইমাম বায়হাকীর(র.)‘সুনানুল কুবরা’র সংশ্লিষ্ট অধ্যায়ের মধ্যেই হাদিসের প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে দেয়া হয়েছে। জাহিলিয়াতের যুগে আরবরা যদিও আল্লাহতে বিশ্বাস করতো, কিন্তু তারা অনেক কর্মকে গায়রুল্লাহর দিকে সম্পৃক্ত করতো। [21] তারা বিভিন্ন কুসংস্কারে বিশ্বাস করতো যেগুলো আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতিরেকেই সংঘটিত হয়। তারা রোগের সংক্রমণকেও আল্লাহর দিকে নিসবত করতো না। এ হাদিসের কথাগুলো যে জাহেলি আরবদের ভ্রান্ত বিশ্বাসের অপনোদনে বলা হয়েছে, সে প্রেক্ষাপটটিই অধ্যায়ের নামকরণের মাঝে উল্লেখ করা হয়েছে।

 

ইমাম বায়হাকীর(র.)‘সুনানুল কুবরা’র পরবর্তী অধ্যায়ের নামঃ

 

باب لَا يُورِدُ مُمْرِضٌ عَلَى مُصِحٍّ، فقد يجعل الله تعالى بمشيئته مخالطته اياه سببا لمرضه

অর্থঃ "অসুস্থ যেন সুস্থদের কাছে না আসে" অধ্যায়ঃ কারণ আল্লাহ তা'আলা নিজ ইচ্ছায় একে অন্যের সংস্পর্শে আসাকে রোগের কারণ বানিয়ে থাকেন। [22]

 

 

ইমাম বায়হাকী(র.) বলেনঃ “নবী() বলেছেন, (لا عدوى) এটি ছিল মূলত জাহিলী যুগে তাদের বিশ্বাসের দৃষ্টিকোণ থেকে। তারা কাজটাকে গায়রুল্লাহর [আল্লাহ ব্যতিত নিজে নিজেই সংঘটিত হওয়া] দিকে সম্পৃক্ত করতো। অথচ আল্লাহ যাকে ইচ্ছা তাকে অসুস্থ ব্যক্তির সাথে মিলিত হওয়ার কারণে আক্রান্ত করেন। এ কারণেই হাদিসে এসেছে, নবী() বলেনঃ "কুষ্ঠ রোগী থেকে দূরে থাকো, যেভাবে তুমি বাঘ থেকে দূরে থাকো; কেউ যেন কখনও রোগাক্রান্ত উট সুস্থ উটের সাথে না রাখে।" প্লেগ (মহামারীর) ক্ষেত্রে এসেছে, যে ব্যক্তি কোনো স্থানে ঐ রোগের খবর পাবে যে, তারা তাতে আক্রান্ত সেভাবে গমন করবে না। আর এসবই আল্লাহর নির্ধারিত তাকদির অনুযায়ী। দুই হাদিসের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য ইবনুস সলাহ-ও এই মতের অনুসরণ করেছেন। আর তার পরবর্তীগণ ও তার পূর্বের এক দলও।” [23]

 

এ প্রসঙ্গে শায়খ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল উসাইমিন(র.) বলেছেনঃ

 

“....সুতরাং যদি জানা যায় যে, কোনো বস্তু সংঘটিত হওয়াতে সঠিক কারণ রয়েছে, তাহলে তাকে কারণ হিসাবে বিশ্বাস করা বৈধ। কিন্তু নিছক ধারণা করে কো্নো ঘটনায় অন্য বস্তুর প্রভাব রয়েছে বলে বিশ্বাস করা ঠিক নয়। কোন বস্তু নিজে নিজেই অন্য ঘটনার কারণ হতে পারে না। ছোঁয়াচে রোগের অস্তিত্ব রয়েছে। নবী() বলেছেন, “অসুস্থ উটের মালিক যেন সুস্থ উটের মালিকের উটের কাছে অসুস্থ উটগুলো নিয়ে না যায়।” সুস্থ উটগুলো অসুস্থ হয়ে যাওয়ার ভয়ে নবী() এ রকম বলেছেন।

নবী() আরো বলেনঃ “সিংহের (অথবা বাঘের) ভয়ে তুমি যেমন পলায়ন কর, কুষ্ঠ রোগী দেখেও তুমি সেভাবে পলায়ন কর।” আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে নবী() কুষ্ঠ রোগী থেকে দূরে থাকতে বলেছেন। এখানে রোগের চলমান শক্তির কথা স্বীকার করা হয়েছে। তবে রোগ নিজস্ব ক্ষমতাবলে অন্যজনের কাছে চলে যায় তা অনিবার্য নয়। নবী() সতর্কতা অবলম্বনের আদেশ দিয়েছেন।

আল্লাহ বলেনঃ “তোমরা নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিও না।” (সূরা বাক্বারাহ ২:১৯৫)

এটা বলা যাবে না যে, নবী() রোগের সংক্রমন হওয়াকে অস্বীকার করেছেন। কেননা বাস্তব অবস্থা ও অন্যান্য হাদিসের মাধ্যমে এ রকম ধারণাকে খণ্ডন করা হয়েছে।

 

যদি বলা হয় যেঃ- নবী() যখন বললেন, রোগ সংক্রামিত হয় না, তখন একজন লোক বলল, হে আল্লাহর রাসূল()! মরুভূমিতে সম্পূর্ণ সুস্থ উট বিচরণ করে। উটগুলোর কাছে যখন একটি খুজ্‌লিযুক্ত উট আসে, তখন সব উটই খুজ্‌লিযুক্ত হয়ে যায়। তিনি বললেন, প্রথম উটটিকে কে খুজ্‌লিযুক্ত করল?

উত্তর হলঃ- নবী() এর উক্তি “প্রথমটিকে কে খুজ্‌লিযুক্ত করল?” এর মাধ্যমেই জবাব দিয়েছেন। আল্লাহর ইচ্ছাতেই রোগের জীবাণু অসুস্থ ব্যক্তির নিকট থেকে সুস্থ ব্যক্তির নিকট গমণ করে থাকে। তাই আমরা বলব যে, প্রথম উটের উপরে সংক্রামক ব্যতীত আল্লাহর ইচ্ছাতেই রোগ নাযিল হয়েছে। কোনো ঘটনার পিছনে কখনো প্রকাশ্য কারণ থাকে। আবার কখনো প্রকাশ্য কোনো কারণ থাকে না। প্রথম উট খুজ্‌লিযুক্ত হওয়ার পিছনে আল্লাহর নির্ধারণ ব্যতীত অন্য কোনো কারণ পাওয়া যাচ্ছে না। দ্বিতীয় উট খুজ্‌লিযুক্ত হওয়ার কারণ যদিও জানা যাচ্ছে, তথাপি আল্লাহ চাইলে খুজ্‌লিযুক্ত হত না। তাই কখনো খুজলিতে আক্রান্ত হয় এবং পরবর্তীতে ভা্লোও হয়ে যায়। আবার কখনো মারাও যায়। এমনিভাবে প্লেগ, কলেরা এবং অন্যান্য সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রেও একই কথা। একই ঘরের কয়েকজন আক্রান্ত হয়। কেউ মারা যায় আবার কেউ রেহাই পেয়ে যায়। মানুষের উচিৎ আল্লাহর উপর ভরসা করা। ...[24]

 

 

 

সুবিখ্যাত ইসলামী পত্রিকা ‘মাসিক আল কাউসার’ এ এ সংক্রান্ত একটি প্রবন্ধে অনেকগুলো হাদিসগ্রন্থের ব্যাখ্যার আলোকে উল্লেখ করা হয়েছেঃ

 

ছোঁয়াচে রোগ বলতে কিছু নেই-হাদীসের এ তরজমা বিশুদ্ধ নয়। কেননা, এর থেকে বোঝা যায়, বাস্তব ছোঁয়াচে রোগকে ইসলাম অস্বীকার করেছে। অথচ রোগাক্রান্ত হওয়ার অন্যান্য কারণ যেমনিভাবে বাস্তব তদ্রূপ রোগাক্রান্ত হওয়ার এই কারণটিও বাস্তব। ইসলাম একে অস্বীকার করেনি। এক্ষেত্রে যে বিষয়টিকে ভ্রান্ত ও বাতিল সাব্যস্ত করা হয়েছে তা হল, কোনো ব্যাধিকে এমন মনে করা যে, তা নিজে নিজেই সংক্রমিত হয়। যেমনটি জাহেলী যুগে মনে করা হত। উপাকার ও অপকারের একমাত্র মালিক আল্লাহ তাআলা। হায়াত-মওত, সুস্থতা-অসুস্থতা সবই তাঁর হুকুমে হয়ে থাকে। মোটকথা, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে রোগাক্রান্ত হওয়া একটি বাস্তব বিষয়। তবে সংক্রমনের এই ক্ষমতা রোগের নিজস্ব নয়; বরং আল্লাহপ্রদত্ত। তাই তিনি চাইলে সংক্রমণ হবে নতুবা হবে না এবং এটি যেহেতু রোগাক্রান্ত হওয়ার একটি বাস্তব কারণ তাই রোগাক্রান্ত হওয়ার অন্যান্য কারণ থেকে বেঁচে থাকতে যেমনিভাবে কোনো দোষ নেই তেমনি এক্ষেত্রেও উপযুক্ত সতর্কতা অবলম্বন করা দোষের নয়। বরং কিছু হাদীসে সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।”

[-বাযলুল মাজহূদ ১৬/২৪২; শরহুন নববী ২/২৩০; ফয়যুল কাদীর ৬/৪৩৩; তাকমিলাতু ফাতহিলমুলহিম ৪/৩৭০; তরজুমানুস সুন্নাহ ২/৪১৬; বুলুগুল আরাব ফী মারিফাতি আহওয়ালিল আরব ২/৩১৫] [24.5]

 

 

একটি হাদিসের ব্যাপারে ভুল ধারণার অপনোদনঃ

কোনো কোনো ভাই একটি হাদিস দেখিয়ে বলতে চান, রাসুল(ﷺ) এখানে রোগের ছড়ানোকে নাকচ করেছেন। নাস্তিক-মুক্তমনারাও হয়তো ইসলামকে ভ্রান্ত বলে প্রমাণ করার হীন  মানসিকতা থেকে এই হাদিস থেকে এমন অপব্যাখ্যা দাঁড় করাতে চাইতে পারেন। হাদিসটি হলোঃ

 

عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ أَخَذَ بِيَدِ رَجُلٍ مَجْذُومٍ فَأَدْخَلَهَا مَعَهُ فِي الْقَصْعَةِ ثُمَّ قَالَ ‏ "‏ كُلْ ثِقَةً بِاللَّهِ وَتَوَكُّلاً عَلَى اللَّهِ ‏"‏

অর্থঃ জাবির ইবন আব্দুল্লাহ(রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ() কুষ্ঠ রোগগ্রস্ত এক ব্যক্তির হাত ধরে তা নিজের আহারের পাত্রের মধ্যে রেখে বলেনঃ আল্লাহর উপর আস্থা রেখে এবং আল্লাহর উপর ভরসা করে খাও। [25]

 

প্রথমতঃ

এই হাদিসটি একটি দুর্বল হাদিস। এটি দলিলযোগ্য নয়। কলেবর বড় হয়ে যাবার আশঙ্কায় হাদিসটির বিস্তারিত তাহকিক উল্লেখ করলাম না। আগ্রহীরা শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানী(র.) এর ‘সিলসিলাহ আদ-দ্বঈফাহ’ (“য‘ঈফ ও জাল হাদীছ সিরিজ” শিরোনামে বাংলায় অনূদিত) কিতাব থেকে বিস্তারিত তাহকিক দেখে নিতে পারেন। [26]

 

 

দ্বিতীয়তঃ

এই হাদিসটিকে সহীহ ধরা হলেও এখানে এটি প্রমাণ হচ্ছে না যে এক প্রাণী থেকে অন্য প্রাণীতে রোগের জীবাণু ছড়ানোর এই (আল্লাহসৃষ্ট) প্রাকৃতিক নিয়মকে ইসলাম অস্বীকার করে। সকল রোগের সৃষ্টিকর্তা হচ্ছেন আল্লাহ। যখন কেউ রোগাক্রান্ত ছিল না, তখন এই রোগ তিনি সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সুস্থ রাখেন, যাকে ইচ্ছা রোগাক্রান্ত করেন। যদি আল্লাহর ইচ্ছা ও অনুমতি না থাকে, তাহলে জীবাণু সংক্রমিত হলেও রোগ হয় না। আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতিত জীবাণুর সংক্রমিত হবারও যেমন সামর্থ্য নেই, আবার সংক্রমিত হয়েও কারো দেহে রোগ সৃষ্টি করার ক্ষমতা নেই। আলোচ্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ(ﷺ) আল্লাহর উপর ভরসা করেছেন।

 

মূলত সহীহ হাদিসগুলোতে রাসুলুল্লাহ(ﷺ) কর্তৃক সংক্রামক রোগী থেকে দূরে থাকার আদেশেরই উল্লেখ পাওয়া যায় এবং তাঁর থেকেও এই দূরে থাকার আমল পাওয়া যায়।

 

আবু হুরায়রা(রা.) এর "সংক্রমণ নেই" হাদিস ভুলে যাওয়া প্রসঙ্গ এবং সংশয়ের নিরসনঃ

 

নাস্তিক-মুক্তমনারা সহীহ মুসলিম থেকে একটি হাদিস দেখিয়ে সাধারণ মুসলিমদের উদ্যেশ্যে সংশয় সৃষ্টির জন্য বলেঃ আবু হুরায়রা(রা.) হাদিসটি ভুলে যাবার দরুণ নাকি এটা প্রমাণ হয় - ঐ হাদিসের ব্যাখ্যা নিয়ে সাহাবীদের মধ্যে বিতর্ক ছিলো! তারা সেই হাদিস উল্লেখ করে আবু হুরায়রা(রা.) এর নামে নানা অপবাদ দেবার চেষ্টা করে। তারাও এটাও প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে, ইসলামে নাকি রোগ সংক্রমণের (আল্লাহসৃষ্ট) প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াটি অস্বীকার করা হয়েছে। সেই হাদিসটি এখানে উল্লেখ করা হলো এবং সহীহ মুসলিমের সব থেকে প্রসিদ্ধ শারহ (ব্যাখ্যা) গ্রন্থ ইমাম নববী(র.) এর শারহ মুসলিম থেকে আলোচ্য হাদিসের ব্যাখ্যা উল্লেখ করা হলো। যা থেকে বোঝা যাবে আলোচ্য হাদিসের ব্যাপারে প্রাচীন মুসলিমদের মধ্যে প্রচলিত সব থেকে প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যা কী ছিলো।

 

হাদিসঃ

আবূ সালামা ইবনু আবদুর রহমান ইবনু আওফ (রা.) থেকে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ() বলেছেনঃ সংক্রমণ (-এর অস্তিত্ব) নেই। তিনি আরও হাদিস বর্ণনা করতেন যে, রাসুলুল্লাহ() বলেছেনঃ অসুস্থ উটপালের মালিক (অসুস্থ উটগুলিকে) সুস্থ উটপালের মালিকের (উটের) কাছে আনবে না। আবূ সালামা (র.) বলেন, আবূ হুরায়রা (রা.) এ দু'টি হাদিস রাসুলুল্লাহ() থেকে বর্ণনা করতেন। পরে আবূ হুরায়রা (রা.) তাঁর (প্রথম হাদিসের) ‘সংক্রমণ ...... নেই’ বলা থেকে নীরব থাকেন এবং অসুস্থ উটপালের মালিক সুস্থ উটপালের মালিকের কাছে আনবেনা এর বর্ণনায় দৃঢ় থাকেন।

 

রাবী বলেনঃ (একদিন) হারিস ইবনু আবূ যুবাব (র.), তিনি আবূ হুরায়রা (রা.) এর চাচাত ভাই, বললেন, হে আবূ হুরায়রা! আমি তে শুনতে পেতাম যে, আপনি এ হাদিসের সাথে আরও একটি হাদিস আমাদের কাছে রিওয়াত করতেন যা বর্ণনায় আপনি এখন নীরব থাকছেন। আপনি বলতেন যে, রাসুলুল্লাহ() বলেছেনঃ সংক্রমণ ...... নেই। তখন আবূ হুরায়রা (রা.) তা মেনে নিতে অস্বীকার করলেন এবং বললেন, অসুস্থ পালের মালিক সুস্থপালের মালিকের কাছে নিয়ে যাবে না। তখন হারিস (র.) এ ব্যাপারে তাঁর সাথে বিতর্কে লিপ্ত হলেন। ফলে আবূ হুরায়রা (রা.) রাগাম্বিত হয়ে হাবশী ভাষায় কিছু বললেন।

 

তিনি হাবিস (র.) কে বললেন, তুমি কি বুঝতে পেরেছো, আমি কি বলেছি? তিনি বললেন, না। আবূ হুরায়রা (রা.) বললেন, আমি বলেছি, আমি অস্বীকার করছি। আবূ সালামা (র.) বলেন, আমার জীবনের শপথ। আবূ হুরায়রা (রা.) অবশ্যই আমাদের কাছে হাদিস বর্ণনা করতেন যে, রাসুলুল্লাহ() বলেছেন 'সংক্রমণ ...... নেই'। এখন আমি জানি না যে, আবূ হুরায়রা(রা.) ভুলে গেলেন, নাকি একটি অপরটিকে (মানসুখ) রহিত করে দিয়েছে [27]

 

ইমাম নববী(র.) এর শারহ থেকেঃ

“অধিকাংশ আলেম বলেছেন, এই হাদিসগুলোর সমন্বয় করতে হবে। এবং এর উভয়ই সহীহ। তাঁরা বলেনঃ হাদিসগুলো সমন্বয়ের উপায় হচ্ছে, [ لا عدوى - সংক্রমণ নেই ] এই কথার উদ্যেশ্য হলো জাহিলী যুগের ঐ ধারণাকে নাকচ করা যে, অসুস্থতা ও রোগব্যধি নিজ ক্ষমতাতেই সংক্রমিত হতে পারে এবং এর পেছনে আল্লাহ তা’আলার কোনো ক্ষমতা/ক্রিয়া থাকে না। আর যে হাদিসে বলা হয়েছে [ لا يورد ممرض على مصح - রোগাক্রান্তকে যেন সুস্থের সাথে একত্রে না রাখা হয়], সেখানে আমাদেরকে এদিকেই পথনির্দেশ করা হচ্ছে যে, তার (রোগাক্রান্তের) নিকটবর্তী হলে খুব স্বাভাবিকভাবেই আল্লাহ তা’আলার ক্ষমতা এবং নির্ধারণের (তাকদির) দ্বারা সে আক্রান্ত হতে পারে। এটি থেকে যেন বিরত থাকা হয়।

 

তাঁরা (অধিকাংশ আলেম) বলেছেন, ১ম হাদিসের উদ্যেশ্য হলো রোগ নিজে নিজে (আল্লাহর ইচ্ছা ও অনুমতি ব্যতিত) সংক্রমিত হতে পারে - এই ধারণাকে নাকচ করা। এ হাদিসের উদ্যেশ্য এই ব্যাপারকে নাকচ করা নয় যে, তার (রোগাক্রান্তের) নিকটবর্তী হলে আল্লাহ তা’আলার ক্ষমতা এবং নির্ধারণের দ্বারা সে রোগাক্রান্ত হতে পারে। আর ২য় হাদিসে এদিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, তার (রোগাক্রান্ত) নিকটবর্তী হবার দ্বারা আল্লাহর ক্ষমতা, ইচ্ছা ও নির্ধারণের দ্বারা সে যে রোগাক্রান্ত হতে পারে, তা থেকে সাবধান থাকতে হবে।

 

আমরা এখানে সহীহ হাদিসগুলোর সমন্বয়ের ব্যাপারে যা আলোচনা করলাম, এটিই হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ আলেমের অনুসৃত সঠিক পন্থা। এবং বিষয়টি এদিকেই নির্দিষ্ট করতে হবে।

আবু হুরায়রা(রা.) যে হাদিসের একটি কথা [ ولا عدوى – এবং সংক্রমণ নেই] ভুলে গিয়েছিলেন, এই ব্যাপারটি কোনো প্রভাব সৃষ্টি করে না ২টি কারণেঃ

প্রথমত, অধিকাংশ আলেমের মতে বর্ণনাকারীর এই নিজ বর্ণনাকৃত হাদিস ভুলে যাওয়া সেই হাদিসের সহীহ হওয়াকে ত্রুটিযুক্ত করে না। বরং এর (হাদিসের) উপর আমল করা ওয়াজিব হয়ে যায়।

দ্বিতীয়ত, হাদিসের এই কথাটি [সংক্রমণ নেই] আবু হুরায়রা(রা.) ছাড়াও অন্যান্যদের রেওয়ায়েত দ্বারা প্রমাণিত। ইমাম মুসলিম(র.) এটি সাইব বিন ইয়াযিদ(রা.), জাবির বিন আব্দুল্লাহ(রা.), আনাস বিন মালিক(রা.), ইবন উমার(রা.) প্রমুখের থেকে রাসুল() এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন।

 

মাযিরী(র.), কাযী ইয়ায(র.) প্রমুখ কিছু আলেম থেকে এই হাদিসের [ لا يورد ممرض على مصح - রোগাক্রান্তকে যেন সুস্থের সাথে একত্রে না রাখা হয়] ব্যাপারে উল্লেখ করেছেন যে, এটি এই হাদিসকে মানসুখ করে দিয়েছে [ لا عدوى - সংক্রমণ নেই ]। কিন্তু এই কথা সঠিক নয় ২টি কারণে।

প্রথমত, নাসেখের একটি লক্ষণ হলো উভয় হাদিসের মধ্যে সমন্বয় করা অসম্ভব হয়ে যায়। কিন্তু এখানে তেমন কিছুই হয়নি। আমরা এদেরকে সমন্বয় করেছি।

দ্বিতীয়ত, এর আরেকটি লক্ষণ হলো ইতিহাসটি (অর্থাৎ কোনটি নাসেখ আর কোনটি মানসুখ) জানা থাকা। নাসেখের ইতিহাসটি জানা থাকা। কিন্তু এখানে এর কোনোটিই নেই।

 

কেউ কেউ বলেছেন, [ لا عدوى - সংক্রমণ নেই ] হাদিসের অর্থ এর যাহির (বা বাহ্যিক অর্থ) এর উপর নিতে হবে। তাদের মতে, لا يورد ممرض على مصح [রোগাক্রান্তকে যেন সুস্থের সাথে একত্রে না রাখা হয়] এই আদেশের কারণ রোগের সংক্রমণ নয়। বরং তা রোগীর দুর্গন্ধে কষ্ট হতে পারে এবং তার কদাকার চেহারা হয়ে যাবার কারণে। কিন্তু (এটি সঠিক মত নয়) আমরা শুরুতে যে মতটি উল্লেখ করেছিলাম, সেটিই সঠিক অভিমত। আল্লাহই সর্বোত্তম জানেন। [28]

[ইমাম নববী(র.) এর ব্যাখ্যা সমাপ্ত]

 

 

এ থেকে বোঝা গেলো যে হাদিসটির অর্থ নিয়ে সাহাবীদের মধ্যে এমন কোনো বিতর্ক ছিলো না। শুধু সহীহ মুসলিমেই অনেক সাহাবী থেকে হাদিসটি বর্ণিত আছে। আবু হুরায়রা(রা.) হাদিসের ২টি শব্দ ভুলে গিয়েছিলেন মাত্র। আর সেগুলোও তিনি নিজেই পূর্বে সহীহভাবে বর্ণনা করেছেন। কাজেই এটি হাদিসের শুদ্ধতার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা সৃষ্টি করে না। মানুষমাত্রই ভুলে যায়। স্বয়ং রাসুল(ﷺ)ও ভুলে যেতেন। [29] ভুলে যান না একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা। যেহেতু আবু হুরায়রা(রা.) ঐ কথাগুলোও পূর্বে বর্ণনা করে গিয়েছেন, কাজেই তাঁর থেকে হাদিসের কোনো অংশ ছুটে যাবার ব্যাপার ঘটেনি। তাঁর এই ভুলে যাবার মাঝেও হিকমত রয়েছে। যদিও তিনিও সাধারণত কখনোই হাদিস ভুলে যেতেন না, কিন্তু এই এক স্থানে মাত্র ২টি শব্দ ভুলে যাবার দরুণ তাঁর মধ্য থেকেও মানবীয় গুণাবলি প্রমাণিত হলো। আবারও প্রমাণিত হলো আল্লাহ ছাড়া আর সবাই ভুল করে, ভুলে যায়। তাঁর এই ভুলে যাওয়া আমাদের জন্য একটি শিক্ষনীয় বিষয়। কাজেই এখানে আবু হুরায়রা(রা.)কে কিংবা হাদিসশাস্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করবার চেষ্টা সম্পূর্ণ অসার।

 

উপসংহারঃ

নবী মুহাম্মাদ(ﷺ) যে যুগের মানুষ ছিলেন, সে যুগে পুরো পৃথিবী ছিল কুসংস্কারাচ্ছন্ন। বিভিন্ন প্রকার কুলক্ষণ, কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাস সে যুগে প্রচলিত ছিল। জাহেলী যুগে আরবরা হামাহ বা হাম্মাহ (هَامَّةَ/هَامَةَ) বলতে কুসংস্কারপূর্ণ বিশ্বাসকে বুঝে থাকতো। তাদের ধারণামতে ‘হামাহ’ ছিল হুতুম পেঁচা যা গভীর রাতে নিহত ব্যক্তির বাড়িতে উপস্থিত হয়ে তার পরিবারের লোকদেরকে ডাকাডাকি করে এবং প্রতিশোধ নেয়ার উৎসাহ দেয়। তাদের কেউ কেউ ধারণা করতো যে, নিহত ব্যক্তির আত্মা পাখির আকৃতি ধরে উপস্থিত হয়েছে। তৎকালিন আরবরা এ পাখির ডাককে কুলক্ষণ মনে করতো। কারো ঘরের পাশে এসে এ পাখি ডাকলে তারা বিশ্বাস করতো যে, সে মৃত্যুবরণ করবে।  আরবরা সফর মাসকে অপয়া মাস মনে করতো। কোনো জিনিস দেখে, কোনো কথা শুনে বা জানার মাধ্যমে কুলক্ষণ মনে করাকে ‘ত্বিয়ারাহ’(طِيَرَةَ) বলা হয়। নবী(ﷺ) এর যুগে এই সমস্ত ভ্রান্ত জিনিস আরবরা বিশ্বাস করতো। [30] যে হাদিসগুলো দেখিয়ে ইসলামবিরোধীরা বলতে চায় যে এগুলোতে ছোঁয়াচে রোগ সম্পর্কে ‘ভুল’(!) তথ্য আছে, সেই হাদিসগুলোতেই প্রাচীন আরবদের এই সমস্ত কুসংস্কারের অপনোদন করা হয়েছে। ভুল তথ্য থাকা তো অনেক দূরের কথা, এই হাদিসগুলোতে কুসংস্কারের মূলোৎপাটন করা হয়েছে। এমনকি কুলক্ষণ বিশ্বাস করার মত জিনিসকে ইসলামে শির্ক বলে অভিহীত করা হয়েছে। [31] কিন্তু যাদের অন্তরে ব্যধি আছে, তাদের অন্তর এই হাদিসগুলো থেকে শুধু ভুল(!)ই খুঁজে বের করে।

 

অতএব হাদিসের বক্তব্য থেকে যারা ভুল বের করার চেষ্টা করে, তাদের উদ্যেশ্য আবারও ব্যর্থ হল। ‘ছোঁয়াচে রোগ’ তো তাদের অন্তরে, যা তারা তাদের অপ্রপচারের দ্বারা মানুষের ভেতর ছড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সফলকাম করেন, আর যাকে ইচ্ছা ব্যর্থ করে দেন।

 

 

দেখুনঃ

 

“কোনো ছোঁয়াচে রোগ নেই” এই হাদিসের ব্যাখ্যা _ শায়খ ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

 

ইসলামে সংক্রামক রোগ বলতে কিছু নেই - এ কথা কি ঠিক? _ শায়খ মুখতার আহমাদ
 
 

তথ্যসূত্রঃ

[1] সহীহ বুখারী ৫৭৭৬, সহীহ মুসলিম ৫৯৩৩-৫৯৩৪

[2] সুনান আবু দাউদ ৩৯১১

[3] সহীহ বুখারী ৫৭০৭

[4] ‘Park's preventive and social medicine’ by K. Park; Page 316

[5] ‘ফতোওয়া আরকানুল ইসলাম’ — শায়খ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল উসাইমিন(র.), পৃষ্ঠা ১১৩

[6] তাকদির প্রসঙ্গে বিস্তারিত ধারণার জন্য এই প্রবন্ধটি পড়ুনঃ “তাকদির আগে থেকে নির্ধারিত হলে মানুষের বিচার হবে কেন? যাদের কাছে ইসলামের দাওয়াহ পৌঁছেনি তাদের কী হবে?”

https://is.gd/JHQVfm

[7] বিস্তারিত দেখুনঃ তুহফাতুল আহওয়াযী ৬/২৯৫

[8] মুসনাদ আহমাদ, হাদিস নং : ৮৩২৫; শায়খ আহমাদ শাকিরের তাহকিকে একে সহীহ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

https://is.gd/uEHBDg

[9] মুসনাদ আহমাদ, হাদিস নং : ৪১৮৬

https://is.gd/pvMbum

[10] Edward William Lane's Arabic-English lexicon

http://www.studyquran.org/LaneLexicon/Volume5/00000263.pdf

[11]

[12] সহীহ মুসলিম ৫৬২৮

[13] সহীহ বুখারী ৫৭২৮

[14] সুনানুল কুবরা – বায়হাকী, হাদিস নং : ১৪২৪০। ১৪২৩৯ নং হাদিসের শব্দাবলি প্রায় একই।

এ ছাড়া দুর্বল সনদে অনুরূপ আরেকটি হাদিস আছে মুয়াত্তা গ্রন্থে। বই নং ৫০, হাদিস নং ১৮

https://sunnah.com/urn/517120

[15] মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হাদিস নং : ৯৪৫

http://www.ihadis.com/books/muatta-malik/hadis/945

[16] ■ “Plague of Amwas - Wikipedia”

https://en.wikipedia.org/wiki/Plague_of_Emmaus

"The Illustrated History Of Islam" By Dr. Tareq Al Suwaidan

https://is.gd/WubIXD

[17] সহীহ বুখারী ৫৭২৯; সহীহ মুসলিম ৫৯১৫

http://www.ihadis.com/books/hadis-somvar/hadis/130

[18] আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া – ইবন কাসির, ৭ম খণ্ড (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ) পৃষ্ঠা ১৪৮

[19] “The plague of Amwaas” – IslamQA Hanafi

https://islamqa.org/hanafi/askimam/82994

[20] সুনানুল কুবরা – ইমাম বায়হাকী, অধ্যায় ৭, পৃষ্ঠা ৩৫১

https://is.gd/DvJFCL

[21] এমনকি মুসলিম উম্মাহর মাঝেও পরবর্তীকালে এই জাতীয় ভ্রান্ত আকিদার ফির্কার উদ্ভব ঘটেছে। যেমনঃ কাদারিয়ারা মন্দ কর্মকে আল্লাহর সৃষ্টি বলে বিশ্বাস করতো না। আল্লাহর ইচ্ছা ও অনুমতির ব্যাপারে তারা ভ্রান্ত আকিদা পোষণ করতো।

[22] সুনানুল কুবরা – ইমাম বায়হাকী, অধ্যায় ৭, পৃষ্ঠা ৩৫২

https://is.gd/DvJFCL

[23] ফাতহুল বারী - ইমাম ইবন হাজার আসকালানী(র) ১০ম খণ্ড, হাঃ ৫৭০৭

[24] ‘ফতোওয়া আরকানুল ইসলাম’ — শায়খ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল উসাইমিন(র.), পৃষ্ঠা ১১৪-১১৬

[24.5] মাসিক আল কাউসার (অনলাইন সংস্করণ)

https://www.alkawsar.com/bn/qa/answers/detail/505/

[25] তিরমিযী ১৮১৭, আবু দাউদ ৩৯২৫, মিশকাত ৪৫৮৫

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=44506

[26] সিলসিলাহ আদ-দ্বঈফাহ (“য‘ঈফ ও জাল হাদীছ সিরিজ” শিরোনামে বাংলায় অনূদিত) - নাসিরুদ্দিন আলবানী; ৩য় খণ্ড (তাওহীদ পাবলিকেশন্স); পৃষ্ঠা ২২৮-২২৯

https://i-onlinemedia.net/7371

[27] সহীহ মুসলিম (ই.ফা.); হাদিস নং : ৫৫৯৭

https://is.gd/RmrIj4

[28] شرح النووي على مسلم

https://is.gd/Kfiqtc

[29] “Reconciling between the verse “We shall make you to recite (the Qur’an), so you (O Muhammad shall not forget (it)” and the fact that the Prophet sometimes forgot when praying and otherwise” islamQA(Shaykh Muhammad Saalih al-Munajjid)

https://islamqa.info/en/184148/

[30] “What did the Prophet (peace and blessings of Allaah be upon him) mean by “No contagion (‘adwa)”?” - islamQA(Shaykh Muhammad Saalih al-Munajjid)
https://islamqa.info/en/45694

[31] আল্লাহর রাসুল() বলেন, ‘‘কিছুকে অশুভ লক্ষণ বলে মনে করা শির্ক। কিছুকে কুপয়া মনে করা শির্ক, কিছুকে কুলক্ষণ মনে করা শির্ক। কিন্তু আমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যার মনে কুধারণা জন্মে না। তবে আল্লাহ (তাঁরই উপর) তাওয়াক্কুল (ভরসার) ফলে তা (আমাদের হৃদয় থেকে) দূর করে দেন।’’ [মুসনাদ আহমাদ ১/৩৮৯, ৪৪০, আবু দাউদ ৩৯১২, তিরমিজী, ইবন মাজাহ, ইবন হিব্বান, হাকিম প্রমুখ, সিলসিলাহ সহীহাহ ৪৩০]