Pray for the world economy

ইসলামে কি নারীদেরকে কুকুর আর গাধার পর্যায়ে গণ্য করা হয়?

 

 মূলঃ শায়খ মুহাম্মাদ সালিহ আল মুনাজ্জিদ

 অনুবাদঃ মুহাম্মাদ মুশফিকুর রহমান মিনার

 

অনুবাদকের ভূমিকাঃ ইসলামে নারীদেরকে কিভাবে গণ্য করা হয় এ বিষয়ে ইসলামবিরোধীদের অপপ্রচারের শেষ নেই। একটি হাদিস দেখিয়ে তারা দাবি করে ইসলামে নারীরা নাকি কুকুর আর গাধার সমপর্যায়ে (নাউযুবিল্লাহ) ! হাদিসটির সরল অনুবাদ দেখে অনেক সময় মুসলিম ভাই-বোনদের মধ্যেও কৌতুহল জাগ্রত হতে পারে। হাদিসটির ব্যাপারে এই প্রবন্ধে বিষদ আলোচনা করা হয়েছে।

 

ফতোয়া নং ২১৪৭৪৮:  একটি হাদিসের ব্যাপারে বিভ্রান্তি যেখানে বলা হয়েছে নারী, গাধা এবং কুকুরের দ্বারা সলাত ব্যাহত হয়

 

◘ প্রশ্নঃ

একজন খ্রিষ্টান আমাকে প্রশ্ন করেছেন ইসলাম কেন বলে যে নারীরা কুকুরের ন্যায়? সে এর প্রমাণ হিসাবে সহীহ মুসলিমের একটি হাদিস দেখায় যেখানে বলা হয়েছে যে কোনো মহিলা সামনে দিয়ে গেলে সলাত নষ্ট হয়ে যায়। অনুগ্রহ করে যত দ্রুত সম্ভব এ ব্যাপারে সৃষ্ট বিভ্রান্তির অপনোদন করে আপনার ওয়েবসাইটে উত্তর প্রদান করুন। ফলে এ বিভ্রান্তির বিস্তারিত উত্তর পাওয়া যাবে এবং মুসলিম নারীরা সেটি পড়তে পারবে। আশা করি যতো দ্রুত সম্ভব উত্তরটি প্রদান করবেন কেননা বিষয়টি অত্যন্ত জরুরী।

 

◘ উত্তরঃ

আলহামদুলিল্লাহ্‌।

যিনি এহেন অভিযোগ তুলেছেন বা বিভ্রান্ত হয়েছেন, কিছু মৌলিক জিনিস উল্লেখ করে আমরা তাকে এর জবাব প্রদান করবো। এ জাতীয় বিষয়গুলো বুঝবার এবং নিরীক্ষা করার জন্য যেগুলো অবশ্যই মাথায় রাখা দরকার।

 

■ প্রথমতঃ

পৃথিবীতে সব জিনিসেরই অন্য জিনিসের সাথে কিছু না কিছু সাদৃশ্য থাকে। অর্থগত মিলও থাকে। মানুষেরও বিভিন্ন সৃষ্ট ও অস্তিত্বশীল বস্তুর সাথে মিল আছে। মানুষের সাথে পশুদের কিছু কিছু জায়গায় মিল আছে। উভয়েই সৃষ্ট জীবদের অন্তর্গত, উভয়েই পানাহার করে, বাঁচে ও মরে। এমনকি দার্শনিকরা মানুষকে “কথা বলা জন্তুও” বলে থাকেন।

 

একইভাবে, মানুষের সাথে গাছপালারও কিছু জায়গায় মিল আছে। উভয়েরই জীবন আছে, দেহের বৃদ্ধি ঘটে এবং পরিচর্যার প্রয়োজন হয়।

 

শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া(র.) বলেছেন,

পৃথিবীর সব জিনিসের মধ্যেই কিছু না কিছু সাদৃশ্য থাকে। এমনকি সুক্ষ্ম হলেও কিছু সাদৃশ্য থাকে। এদের কারো মধ্যে কোনো সাদৃশ্য নেই এমন কিছু বলার অর্থ হল তাদের অস্তিত্বকেই অস্বীকার করা। কোনো জ্ঞানী ব্যক্তি বা চিন্তাবিদের দ্বারা এমন কিছু বর্ণিত হয়নি।

বক্তব্য সমাপ্ত। বায়ান তালবিসুল জাহমিয়্যাহ ৭/৫৬৯।

 

এটি জানা কথা যে, উপরে উল্লেখিত মানুষের এ সাদৃশ্যকে কোনো জ্ঞানী ব্যক্তি বা চিন্তাবিদ এমন নিন্দনীয় জিনিস বলে গণ্য করেননি যা সমালোচনাযোগ্য বা দোষণীয়। এর কিছু দিক আছে যা প্রশংসনীয় এবং কিছু দিক আছে যেগুলো নিছক ভৌত সাদৃশ্য যা প্রশংসনীয় বা নিন্দনীয় কোনোটিই নয়।

 

■ দ্বিতীয়তঃ

যুক্তিগত বা ভাষাগত দিক থেকে কোনোকিছুকে তুলনা বা সাদৃশ্য দেয়া চারটি মূলনীতির দিকে লক্ষ রেখে হয়। যে বস্তু অন্য কিছুর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হয়, যে বস্তুর সাথে সাদৃশ্য দেয়া হয়, সে সকল দিক থেকে তারা সাদৃশ্যপূর্ণ এবং সে সকল শব্দমালা বা উপমা যেগুলো তাদের সাদৃশ্য বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। কোনো কিছু তুলনা দেবার নিয়মের আলোচনায় আসি। কোনো তুলনাকে প্রশংসনীয় হিসাবে গ্রহণ করা হবে নাকি নিন্দনীয় হিসাবে গ্রহণ করা হবে এটি বোঝার জন্য যার সঙ্গে তুলনা দেয়া হচ্ছে শুধুমাত্র তার দিকেই দৃষ্টিকে সীমাবদ্ধ করে দেয়া একটি ত্রুটিপূর্ণ কাজ। বরং তুলনা দেয়ার কারণটির দিকে দৃষ্টিপাত করাও জরুরী[1]

 

একজন সাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে যে তিনি নিজের একটি কাজকে পশুর কাজের সঙ্গে তুলনা দিয়েছেন। আম্মার ইবন ইয়াসির(রা.) বলেনঃ রাসুলুলুল্লাহ() আমাকে একবার একটি প্রয়জনে প্রেরণ করলেন এবং আমি জুনুব (অপবিত্র) হলাম। আমি কোনো পানি খুঁজে পেলাম না। তাই আমি মাটির উপর পশুর মতো গড়াগড়ি খেলাম।

ইমাম বুখারী(র.) (৩৪৭) ও ইমাম মুসলিম(র.) (৩৬৮) বর্ণনা করেছেন।

 

এখান থেকে কেউ এমনটি বুঝবে না যে তিনি নিজেকে পুরোপুরিভাবে কোনো পশুর সাথে সাদৃশ্য দিয়েছেন (বা নিজেকে পশুর পর্যায়ে নামিয়েছেন)। আল্লাহ না করুন, কেউ এভাবে বুঝলে তা হবে মারাত্মক ভুল। কেননা আরবদের ভাষায় কখনো এ দ্বারা এমন কিছুই বোঝায় না। কাজেই এমন ভিত্তিহীন সংশয়ে নিপতিত হবার পূর্বে কুরআন ও সুন্নাহর ভাষা আরবি ভালো করে বোঝা জরুরী। এ ধরণের সংশয়ে পতিত হওয়া আরবি ভাষার ধরণ ও প্রয়োগবিধি সম্পর্কে অজ্ঞতার পরিচায়ক। হাদিসে উল্লেখিত উদাহরণ দ্বারা নারীজাতিকে অথবা স্ত্রীলিঙ্গকে অপমান করা হয়েছে এমন অভিযোগ তুলবার পূর্বে আমাদেরকে বিভিন্ন বস্তুকে সাদৃশ্য দেবার পদ্ধতিগুলো যাচাই করা প্রয়োজন।

 

■ তৃতীয়তঃ

প্রশ্নে উল্লেখিত হাদিসটি হচ্ছে আবু হুরায়রা(রা.) বর্ণিত সেই হাদিসঃ তিনি বলেন, রাসুলুলুল্লাহ() বলেছেনঃ নারী, গাধা ও কুকুর সলাত (সামনে দিয়ে অতিক্রম করে) নষ্ট করে। আর এর থেকে রক্ষা করে হাওদার (পেছনে দণ্ডায়মান) ডাণ্ডার ন্যায় কোনো বস্তু ইমাম মুসলিম(র.) বর্ণনা করেছেন (৫১১)। যিনি এই হাদিসটি ভালো করে পড়বেন তিনি বুঝবেন যে এই সাদৃশ্যকরণের উদ্যেশ্যের সাথে গাধা ও কুকুরের খারাপ গুণের কোনো সম্পর্ক নেই। ইয়াযু বিল্লাহ, নারীরা কখনোই এই পশুদের সাথে একই পর্যায়ভুক্ত নয়। এগুলো ভ্রান্ত ও স্থুলবুদ্ধিসম্পন্ন লোকদের কথা। এই হাদিস শুনে আয়িশা(রা.) এমনটি ভাবেননি। তিনি বলেছেন, “তোমরা আমাদেরকে গাধা ও কুকুরের সাথে তুলনা করছো?” হাদিসটি ইমাম বুখারী(র.) বর্ণনা করেছেন (৫১৪)।

 

বরং এখানে উদ্যেশ্য হলো সলাতের সাথে সম্পর্কিত একটি সুনির্দিষ্ট বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করা। আর তা হলো, সলাত আদায়কারীর খুশু এবং আল্লাহ তা’আলার সাথে সংযোগটি নষ্ট হওয়া। সলাত আদায়কারীর সামনে দিয়ে কোনো নারীর যাতায়াতের ফলে আল্লাহর প্রতি খুশুতে ব্যাঘাত ঘটে - এ ব্যাপারে আয়িশা(রা.) একমত ছিলেন না। তবে অনেক সাহাবায়ে কিরাম(রা.) এ ব্যাপারে তাঁর সাথে ইখতিলাফ করেছেন।

 

আমাদেরকে একটি জিনিস লক্ষ রাখতে হবে, মূল বিষয় হচ্ছে একজন সলাত আদায়কারীর সামনে দিয়ে যে কেউ চলে গেলেই এতে বিঘ্ন ঘটে। পুরুষ হোক, মহিলা হোক অথবা কোনো জীব-জানোয়ার হোক, যে কারোই সলাত আদায়কারীর সামনে দিয়ে যাতায়াত করা নিষেধ। নবী(ﷺ) যে কারো জন্যই এই কাজটি থেকে নিষেধ করে বলেছেন, “সালাত আদায়কারীর সামনে দিয়ে চলাচলকারী যদি জানত সে কত বড় পাপ করছে; তাহলে সে তার সামনে দিয়ে চলাচল করার পরিবর্তে চল্লিশ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকা নিজের জন্য ভাল মনে করত।” আবূ নাযর বলেন, তিনি কি চল্লিশ দিন না চল্লিশ মাস না চল্লিশ বছর বলেছেন- তা আমার জানা নেই।

 ইমাম বুখারী(র.) বর্ণনা করেছেন (৫১০)।

 

ইমাম বুখারী(র.) (৪৮৭) ও ইমাম মুসলিম(র.) (৫০৫) বর্ণনা করেছেন, “আবূ সাঈদ খুদরী (রা.) জুম্মার দিন লোকদের জন্য সুতরা হিসাবে কোন কিছু সামনে রেখে সালাত (নামাজ) আদায় করছিলেন। আবূ মুআইত গোত্রের এক যুবক তাঁর সামনে দিয়ে যেতে চাইল। আবূ সাঈদ খুদরী (রা.) তার বুকে ধাক্কা মারলেন। যুবকটি লক্ষ্য করে দেখলো যে তাঁর সামনে দিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন পথ নেই। এজন্য সে পুনরায় তাঁর সামনে দিয়ে যেতে চাইল। এবার আবূ সাঈদ খুদরী (রা.) প্রথম বারের চাইতে জোরে ধাক্কা দিলেন। ফলে আবূ সাঈদ (রা.)-কে তিরস্কার করে সে মারওয়ানের কাছে গিয়ে আবূ সাঈদ (রা.)-এর ব্যবহারের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করল। এদিকে তার পরপরই আবূ সাঈদ (রা.)-ও মারওয়ানের কাছে গেলেন। মারওয়ান তাঁকে বললেনঃ হে আবূ সাঈদ! তোমার এই ভাতিজার কি ঘটেছে? তিনি জবাব দিলেনঃ আমি নবী ()-কে বলতে শুনেছি যে, তোমাদের কেউ যদি লোকদের জন্য সামনে সুতরা রেখে সালাত আদায় করে, আর কেউ যদি তার সামনে দিয়ে যেতে চায়, তাহলে যেন সে তাকে বাধা দেয়। সে যদি না মানে, তবে সে ব্যাক্তি (মুসল্লী) যেন তার সাথে মুকাবিলা করে, কারণ সে শয়তান।

 

ইমাম নববী(র.) বলেছেন,

নবী() এর এই বক্তব্য কেননা সে শয়তান” - এর ব্যাখ্যায় আল কাযি [ইয়ায] (র.) বলেছেন, এই কথার অর্থ হলো, শয়তানই ঐ ব্যক্তিকে তার (সলাত আদায়কারীর) সামনে দিয়ে অতিক্রম করিয়েছে এবং ফিরে যাওয়া থেকে বিরত করিয়েছে। আরো বলেছেন, এর মানে হচ্ছে তিনি যা করছেন তা শয়তানের কাজ। কারণ সুন্নাতের কবুলিয়ত এবং কল্যাণ থেকে শয়তানের অবস্থান বহু দূরে। এখানে শয়তান বলতে ক্বারিনকে (প্রত্যেক মানুষের সাথে যে জিন শয়তান থাকে) বোঝানো হয়েছে যেমনটি অন্য একটি হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে,  নিশ্চয়ই তার সাথে ক্বারিন রয়েছেএবং আল্লাহই সর্বোত্তম জানেন।

বক্তব্য সমাপ্ত। শারহ মুসলিম ৪/১৬৭।

 

এখানে এটি পরিষ্কার যে, হাদিসটি আমভাবে সবার জন্য প্রযোজ্য যারা সলাত আদায়কারীর সামনে দিয়ে অতিক্রম করতে চায়। আবূ সা‘ঈদ খুদরী (রা.) এর ঘটনাটির মাঝে নারীদের কোনো ব্যাপারই নেই।

 

■ চতুর্থতঃ

সলাত আদায়কারীর সামনে দিয়ে অতিক্রম করা যে কোনো অবস্থাতেই নিষেধ এবং নারী-পুরুষ সবার জন্য এটি প্রযোজ্য। আর যেহেতু এটা সলাতকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে, কোনো কোনো আলেম (সলাত আদায়কারীর) সামনে দিয়ে যাওয়া সম্পর্কিত এ হাদিসকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন - এর উদ্যেশ্য এটি নয় যে সলাত বাতিল হয়ে যাবে। অথবা এই সলাত নতুন করে আদায় করাও জরুরী হবে না। বরং এর মানে হলোঃ এর ফলে ঐদিকে খেয়াল দিয়ে সলাতের পরিপূর্ণতা এবং খুশু ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়। সলাত আদায়কারীর মনোযোগ সেদিকে চলে যায়।

 

ইমাম কুরতুবী(র.) বলেছেন,

এর কারণ হচ্ছে নারীরা (পুরুষের জন্য) ফিতনা বা পরীক্ষার কারণ হতে পারে গাধা বিকট আওয়াজ করে ডাকে আর কুকুর মানুষের মনে ভীতির উদ্রেক করতে পারে। আর (সলাতের মধ্যে) কারো মনে যদি এইসব চিন্তা আসে, তাহলে তার মনোযোগ বিঘ্নিত হয়ে সলাত বাধাগ্রস্ত এবং নষ্ট হতে পারে। যেহেতু এসব বিষয়ের জন্য সলাত বাধাগ্রস্ত হতে পারে, এদেরকে সলাতের বাধা সৃষ্টিকারী হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। 

বক্তব্য সমাপ্ত। আল মুফহিম লিমা আশকালা মিন তালখিস সহীহ মুসলিম ২/১০৯।

 

অনুরূপ একটি ব্যাখ্যা উল্লেখপূর্বক ইবন রজব(র.) বলেছেন,

এই ব্যাখ্যার চেয়েও (সঠিকের) আরো নিকটবর্তী হবে এভাবে বলাঃ একজন মুসল্লী সলাতের মধ্যে আল্লাহর সঙ্গে একান্ত কথোপকথনের মধ্যে থাকেন, আল্লাহর সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ অবস্থায় থাকেন। তাই একজন মুসল্লীর প্রতি নির্দেশ হচ্ছে, শয়তান যেন আল্লাহর সহিত তাঁর এই একান্ত আলাপন ও ঘনিষ্ঠতার মাঝে বাগড়া না দিতে পারে এ জন্য আগে থেকেই সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেয়া। কাজেই উচিত হবে সলাত আদায়ের সময় শয়তান যেন বাগড়া দিতে না পারে এ জন্য সুতরা (অন্তরাল) ব্যবহার করা। কারণ একজন মুসল্লী যখন তাঁর রবের সাথে আলাপরত অবস্থায় থাকে, শয়তান তাঁকে বাধা দিতে চেষ্টা করে। শয়তান হচ্ছে বিতাড়িত এবং অভিশপ্ত। আল্লাহর ধ্যান থেকে তার অবস্থান বহু দূরে। সে যদি মুসল্লীর কাছাকাছি এসে যায়, মুসল্লী তাঁর রব থেকে দূরে সরে যায়। তাঁর রবের সাথে নৈকট্য, রহমত ও দয়া থেকে বাধার সৃষ্টি হয়।

আল্লাহ ভালো জানেন, এ সব কারণেই খাসভাবে তিনটা বিষয় থেকে সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়েছে এরা হচ্ছেঃ 

 

নারী - নারীদের দ্বারা শয়তান ফাঁদ পাতেএকজন নারী যখন ঘরের বাইরে যায়, শয়তান তার দিকে নজর দেয়। নারীর মাধ্যমেই শয়তান আদম(আ.)কে জান্নাত থেকে বের করেছিলো। [2]

কালো কুকুর হচ্ছে শয়তান। হাদিসে এটি উল্লেখ আছে। [3]

গাধার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কেউ যদি রাতে গাধার স্বর শোনে, তাকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাইতে বলা হয়েছে কেননা এটি শয়তানকে দেখতে পায়। [4]

 

কাজেই নবী() (সলাত আদায়ের সময়ে) সুতরা ব্যবহার করার আদেশ দিয়েছেন যাতে শয়তান সলাতে বাধা সৃষ্টি করতে না পারে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে (কেউ সলাতের সামনে দিয়ে গেলে) সলাত বাতিল হয়ে যাবে বা নতুন করে তা আদায় করতে হবে। এবং আল্লাহই সর্বোত্তম জানেন। বরং এটা সলাতে (মনোযোগ নষ্ট করে) ঘাটতির সৃষ্টি করে। যা উল্লেখ করেছেন সাহাবীরা যেমন উমার(রা.) এবং ইবন মাসউদ(রা.)সলত আদায়কারীর সামনে দিয়ে একজন ব্যক্তির যাবার যে ঘটনা ইতিমধ্যেই আলোচনা করা হয়েছে। নবী() এমন ব্যক্তিকে বাধা দিতে ও মুকাবিলা করতে আদেশ করেছে। এবং তিনি বলেছেনঃ “কারণ সে (বাধা দেবার পরেও যে মুসল্লীর সামনে দিয়ে যেতে চায়) শয়তান”আরেকটি রেওয়াত অনুযায়ী তিনি বলেছেন, “নিশ্চয়ই তার সাথে ক্বারিন (জিন শয়তান) রয়েছেতবে শয়তানের সাথে সংশ্লিষ্ট যেসব পশুর কথা উল্লেখ করা হয়েছে, এরা সামনে দিয়ে অতিক্রম করলে সলাতের যে ঘাটতি হয় এর পরিমাণ অনেক বেশি। সলাত বাধাগ্রস্ত করা বলতে একেই বোঝানো হয়েছে। তবে এতে সলাত বাতিল হয় না, নতুন করেও আদায় করতে হয় না। আল্লাহই সর্বোত্তম জানেন।

বক্তব্য সমাপ্ত। ফাতহুল বারী – ইবন রজব ৪/১৩৫।

 

■ পঞ্চমতঃ

কিছু লোক অনেক সময় ইচ্ছাকৃতভাবে এমন একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করে যেটি হয়তো সম্পূর্ণরূপে স্পষ্ট নয় এবং যেটির হয়তো ব্যাখ্যার অবকাশ রয়েছে। এবং তার অনুসন্ধানের বিষয়ের সাথে এর কোনো সম্পর্কই নেই। সেই বর্ণনাটিকেই হয়তো তিনি (বা তারা) একটি পরিপূর্ণ ধর্মের বিরুদ্ধে বিষোদগারের জন্য ব্যবহার করছেন, যেমন ইসলাম ধর্ম। যে ধর্মটিতে আদেশ-নিষেধ ও নীতি-নৈতিকতার জন্য পূর্ণাঙ্গ বিধি-বিধান রয়েছে। এটা সেই ধর্ম যা থেকে বহু উদ্ধৃতি ও শিক্ষা দেখানো যাবে যাতে নারীদের এমন সম্মান দেয়া হয়েছে যেমনটি অন্য কোনো ধর্ম, আইন বা ব্যাবস্থায় দেয়া হয়নি। এগুলোর ব্যাপারে চোখ বুজে থেকে (বিষোদগারের উদ্যেশ্যে অপ্রাসঙ্গিকভাবে) একটি বর্ণনা নিয়ে আসা - কোনো গবেষকের জন্যই একে ন্যায় বা ইনসাফপূর্ণ আচরণ বলা যাবে না। হোক তিনি যে কোনো ধর্মের বা দলের।

 

আয়িশা(রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেন, “…নারীরা তো পুরুষের অংশ (তাদের মতোই)।”

ইমাম তিরমিযি(র.) (১১৩) বর্ণনা করেছেন। শায়খ আলবানী(র.) সহীহ আবু দাউদে (২৩৪) একে বিশুদ্ধ বলে চিহ্নিত করেছেন।

খাত্তাবী(র.) বলেছেন, “নারীরা তো পুরুষের অংশ (তাদের মতোই)” - তাঁর এই বাণীর অর্থ হলো, তারা তাদের (পুরুষদের) সমকক্ষ। সৃষ্টিগত ও প্রকৃতিগতভাবে তারা পুরুষদের সাথে এমনই সাদৃশ্যপূর্ণ ঠিক যেন তারা পুরুষদের জমজ। ... [5]

হাদিস থেকে যা বোঝা যায়…যদি সাধারণভাবে কোনো কিছুকে পুরুষবাচক শব্দ দ্বারা উল্লেখ করা হয়, সেটি নারীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। শুধুমাত্র কিছু সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্র বাদে, যেখানে দলিল আছে যে এগুলো শুধুমাত্র তাদের (পুরুষদের) জন্য প্রযোজ্য।

বক্তব্য সমাপ্ত। মা’আলিমুস সুনান ১/৭৯।

 

উলামাগণ এই হাদিস থেকে দলিল পেশ করেছেন যে, সাধারণ নিয়ম হচ্ছে যেসব জিনিস পুরুষদের জন্য জরুরী, সেগুলো নারীদের জন্যও জরুরী। পুরুষদের জন্য যা জায়েয, নারীদের জন্যও তা জায়েয। এক্ষেত্রে তাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না যদি না এ ব্যাপারে কুরআন-সুন্নাহর কোনো উদ্ধৃতি থাকে।

 

এভাবে কুরআনে নারীদেরকে সম্বোধণ করেছে, ঠিক যেভাবে পুরুষদেরকেও সম্বোধণ করেছে। এ ব্যাপারে বহু উদ্ধৃতি রয়েছে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেছেন,

 

مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِّن ذَكَرٍ أَوْ أُنثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حَيَاةً طَيِّبَةً وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَجْرَهُم بِأَحْسَنِ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ

অর্থঃ “যে মুমিন অবস্থায় নেক আমল করবে, পুরুষ হোক বা নারী, আমি তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং তারা যা করত তার তুলনায় অবশ্যই আমি তাদেরকে উত্তম প্রতিদান দেব।

[আল কুরআন, নাহল ১৬ : ৯৭]

 

আল্লাহ তা’আলা বলেছেন,

إِنَّ الْمُسْلِمِينَ وَالْمُسْلِمَاتِ وَالْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ وَالْقَانِتِينَ وَالْقَانِتَاتِ وَالصَّادِقِينَ وَالصَّادِقَاتِ وَالصَّابِرِينَ وَالصَّابِرَاتِ وَالْخَاشِعِينَ وَالْخَاشِعَاتِ وَالْمُتَصَدِّقِينَ وَالْمُتَصَدِّقَاتِ وَالصَّائِمِينَ وَالصَّائِمَاتِ وَالْحَافِظِينَ فُرُوجَهُمْ وَالْحَافِظَاتِ وَالذَّاكِرِينَ اللَّهَ كَثِيرًا وَالذَّاكِرَاتِ أَعَدَّ اللَّهُ لَهُم مَّغْفِرَةً وَأَجْرًا عَظِيمًا

অর্থঃ “নিশ্চয় মুসলিম পুরুষ ও মুসলিম নারী, মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী, অনুগত পুরুষ ও অনুগত নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও সত্যবাদী নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ও ধৈর্যশীল নারী, বিনীত পুরুষ ও বিনীত নারী, দানশীল পুরুষ ও দানশীল নারী, সওম পালনকারী পুরুষ সওম পালনকারী নারী, যৌনাঙ্গ হিফাযতকারী পুরুষ ও যৌনাঙ্গ হিফাযতকারী নারী, আল্লাহ্‌কে অধিক স্মরণকারী পুরুষ ও আল্লাহ্‌কে অধিক স্মরণকারী নারীতাদের জন্য আল্লাহ রেখেছেন ক্ষমা ও মহাপ্রতিদান।

[আল কুরআন, আহযাব ৩৩ : ৩৫]

 

আরো তথ্যের জন্য দেখুন ওয়েবসাইটের ৭০০৪২, ৪০৪০৫ এবং ১৩২৯৫৯ নং প্রশ্নের উত্তর।

 

এবং আল্লাহই সর্বোত্তম জানেন।

 

 

মূল ফতোয়ার লিঙ্কঃ

○ আরবিঃ https://islamqa.info/ar/214748/

○ ইংরেজিঃ https://islamqa.info/en/214748/

 

 

অনুবাদকের টিকা

[1] একটি উদাহরণ দিলে হয়তো বিষয়টি বোঝা আরো সহজ হবে। ধরা যাক বলা হলোঃ “মানুষ, গরু, গাধা সবাই এই পৃথিবীতে বসবাসকারী প্রাণী” – এই বাক্য দেখে কেউ কি বুঝবে যে এখানে মানবজাতিকে গরু ও গাধার পর্যায়ে নামানো হয়েছে? উত্তর হচ্ছেঃ না। এখানে মানবজাতিকে গাধা ও গরুর পর্যায়ে নামানোর উদ্যেশ্যে তাদের নাম একসাথে উল্লেখ করা হয়নি। এখানে এই তুলনার উদ্যেশ্য হলো, এরা সবাই জীবন্ত প্রাণী এটা বোঝানো। যে কোনো যুক্তি-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই এটি বুঝবে এবং এ নিয়ে প্রশ্ন তুলবে না। দুঃখের বিষয় হলো, হাদিসে যখন নারী, কুকুর ও গাধার নাম একসাথে উল্লেখ করা হয়, যুক্তি-বুদ্ধির ধার না ধেরে কিছু মানুষ মরিয়া হয়ে ইসলামকে আক্রমণ করতে শুরু করে। এই নামগুলো কেন একসাথে উল্লেখ করা হয়েছে, এর উদ্যেশ্য মাথা খাটিয়ে বুঝতে চেষ্টা করে না।    

[2] ইস্রাঈলী রেওয়ায়েতে উল্লেখ আছে আদম(আ.) এর স্ত্রী হাওয়া(আ.)কে শয়তান ওয়াসওয়াসা দেয় এবং এর ফলশ্রুতিতে তিনি নিষিদ্ধ গাছের ফল খেতে আদম(আ.)কে প্ররোচিত করেন। প্রাসঙ্গিক ক্ষেত্রে ইস্রাঈলিয়্যাহ বর্ণনা করা একটি বৈধ বিষয়। এর ভিত্তিতে অনেক সম্মানিত মুফাসসির এবং মুহাদ্দিসই এটি উল্লেখ করেছেন। যদিও কুরআন বা সহীহ হাদিসে এর উল্লেখ নেই। এ প্রসঙ্গে আল কুরআনে উল্লেখ আছেঃ

 

অতঃপর সে (শয়তান) তাদের উভয়কে বিভ্রান্ত করল। যখন তারা সেই নিষিদ্ধ গাছের ফলের স্বাদ গ্রহণ করল তখন তাদের লজ্জাস্থান তাদের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ল এবং তারা বাগানের বৃক্ষপত্র দ্বারা নিজেদেরকে আবৃত করতে লাগল। তাদের রব তাদেরকে সম্বোধন করে বললেনঃ আমি কি এই বৃক্ষ সম্পর্কে তোমাদেরকে নিষেধ করিনি এবং বলিনি যে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শক্র?”

[আল কুরআন, আ’রাফ ৭ : ২২]

 

অতঃপর শয়তান তাকে কুমন্ত্রণা দিল; সে বলল, হে আদম! আমি কি আপনাকে বলে দেব অনন্ত জীবনদায়িনী গাছের কথা ও অক্ষয় রাজ্যের কথা? তারপর তারা উভয়ে সে গাছ থেকে খেল; তখন তাদের লজ্জাস্থান তাদের কাছে প্ৰকাশ হয়ে পড়ল এবং তারা জান্নাতের গাছের পাতা দিয়ে নিজেদেরকে ঢাকতে লাগলেন। আর আদম তার রব-এর হুকুম অমান্য করলেন, ফলে তিনি পথভ্রান্ত হয়ে গেলেন। তারপর তার রব তাকে মনোনীত করলেন, অতঃপর তার তাওবা কবুল করলেন ও তাকে পথনির্দেশ করলেন।

[আল কুরআন, ত্বা-হা ২০ : ১২০-১২২]

 

একটি সহীহ হাদিসে যদিও হাওয়া(আ.) এবং স্বামীর খিয়ানতের কথা উল্লেখ আছে।

 

…আর যদি হাওয়া (আ.) না হতেন তাহলে কোন নারীই স্বামীর খিয়ানত করত না।”

[মুসলিম ১৭/১৯ হাঃ ১৪৭০, আহমাদ ৮০৩৮]

 

এই হাদিসের ব্যাখ্যাতেও অনেক সম্মানিত মুহাদ্দিস ইস্রাঈলিয়্যাহ থেকে প্রাপ্ত ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন। যদিও এই হাদিসে স্পষ্টত এটি উল্লেখ নেই যে আদম(আ.)কে নিষিদ্ধ গাছের ফল খেতে হাওয়া(আ.) উদ্বুদ্ধ করেন। ইসলামী আকিদা হিসাবে কেবল সেটিই গণ্য হবে যা কুরআন বা সহীহ হাদিসে আছে।

[3] সহীহ হাদিসে উল্লেখ আছে যে জিন শয়তান কালো কুকুরের রূপ ধারণ করতে পারে।

عَنْ أَبِي ثَعْلَبَةَ الْخُشَنِيِّ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْجِنُّ عَلَى ثَلَاثَةِ أَصْنَافٍ صِنْفٌ كِلَابٌ وَحَيَّاتٌ وَصِنْفٌ يَطِيرُونَ فِي الْهَوَاءِ وَصِنْفٌ يَحُلُّونَ وَيَظْعَنُونَ

অর্থঃ  আবু ছা’লাবাহ খুশানী(র.) বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ() বলেছেন, “জিনের তিনটি রূপ আছে, একটা রূপ হচ্ছে কালো কুকুর আর সাপের মতো, আরেকটা রূপ বাতাসে উড়ে বেড়ায়আরেকটি রূপ আছে যারা আসে এবং যায়।

[ইবন হিব্বান ৬১৫৬, সহীহ (আলবানী)]

[4] জাবের(রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি নবী()-কে বলতে শুনেছেনঃ রাত শান্তভাব ধারণ করার পর তোমরা কমই বাইরে বের হবে। কারণ (এ সময়) আল্লাহ তাঁর কতক সৃষ্টিকে (স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে) ছড়িয়ে দেন। অতএব তোমরা কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ ও গাধার ডাক শনতে পেলে শয়তানের অনিষ্ট থেকে আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করো।

[আল-আদাবুল মুফরাদ ১২৪৭, সহীহ (আলবানী)]

[5] যদিও নারী ও পুরুষের মাঝে অনেক বৈসাদৃশ্যও রয়েছে। তবে তাদের মাঝে প্রচুর সাদৃশ্যও রয়েছে। এখানে সে সাদৃশ্যগুলোর দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে।