নাস্তিক প্রশ্নঃ
আল্লাহ যদি আদমকে আরবি ভাষা শিখিয়েই পৃথিবীতে পাঠান (Quran 2:31-32) তবে তাঁর বংশধরেরা যেখানেই বসবাস শুরু করুক না কেন, আরবি ভাষাই ব্যবহার করবে! তবে আজ সারা পৃথিবী জুড়ে প্রায় পাঁচ হাজারের উপরে ভাষা বিরাজ করছে কী করে?
উত্তরঃ
আল কুরআনে বলা হয়েছেঃ
( ৩১ ) وَعَلَّمَ آدَمَ الْأَسْمَاءَ كُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمْ عَلَى الْمَلَائِكَةِ فَقَالَ أَنبِئُونِي بِأَسْمَاءِ هَٰؤُلَاءِ إِن كُنتُمْ صَادِقِينَ
( ৩২ ) قَالُوا سُبْحَانَكَ لَا عِلْمَ لَنَا إِلَّا مَا عَلَّمْتَنَا ۖ إِنَّكَ أَنتَ الْعَلِيمُ الْحَكِيمُ
অর্থঃ আর আল্লাহ আদমকে সমস্ত বস্তু-সামগ্রীর নাম শিখালেন। তারপর সে সমস্ত বস্তু-সামগ্রীকে ফেরেশতাদের সামনে উপস্থাপন করলেন। অতঃপর বললেন, আমাকে তোমরা এগুলোর নাম বলে দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক।
তারা বলল, আপনি পবিত্র; আমরা কোন কিছুই জানি না, তবে আপনি যা আমাদেরকে শিখিয়েছেন (সেগুলো ব্যতীত) নিশ্চয় আপনিই প্রকৃত জ্ঞানসম্পন্ন, হেকমতওয়ালা। [1]
আমরা আলোচ্য আয়াতগুলোতে দেখতে পাচ্ছি যে—“আল্লাহ আদমকে আরবি ভাষা শিখিয়ে পৃথিবীতে পাঠান” এমন কোন কথাই সেখানে নেই। সম্পূর্ণ অর্থহীন একটি অভিযোগ।
এ ধরণের উদ্ভট প্রশ্নের উৎস বোধ করি বাংলাদেশে নাস্তিক্যবাদের অন্যতম পুরোধা আরজ আলী মাতুব্বর, যিনি তার একটি বইতে ইসলাম সম্পর্কে বিভিন্ন ধারণাভিত্তিক ও আজগুবি প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন যার একটি হচ্ছে—লক্ষাধিক নবীর প্রায় সবাই কেন আরব দেশে জন্মগ্রহণ করলেন? [2] অথচ কুরআন ও হাদিসে কোথাও এই ধরণের কিছু বলা হয়নি। বরং বলা হয়েছে—পৃথিবীর সব জাতির নিকটা নবী-রাসুল প্রেরণ করা হয়েছে। [3]
কুরআন বা হাদিস কখনোই এমন উদ্ভট দাবি করেনি যে আদম(আ) আরবিভাষী বা আরব ছিলেন। আদম(আ) তো অনেক আগের মানুষ, নবী মুহাম্মাদ (ﷺ) এর পূর্বপুরুষ ইসমাঈল(আ) এর সম্পর্কেও হাদিসে বলা হয়েছে যে তিনি জুরহুম গোত্রের কাছ থেকে আরবি ভাষা শেখেন। অর্থাৎ তিনিও আরব বা আরবিভাষী ছিলেন না।
“... অবশেষে (ইয়েমেন দেশীয়) জুরহুম গোত্রের একদল লোক তাদের কাছ দিয়ে অতিক্রম করছিল।তারা মক্কার নিচু ভুমিতে অবতরণ করল এবং তারা দেখতে পেল একঝাঁক পাখি চক্রাকারে উড়ছে। তখন তারা বলল, নিশ্চয় এ পাখিগুলো পানির উপর উড়ছে। আমরা এ ময়দানের পথ হয়ে বহুবার অতিক্রম করেছি। কিন্তু এখানে কোন পানি ছিল না। তখন তারা একজন কি দু’জন লোক সেখানে পাঠালো। তারা সেখানে গিয়েই পানি দেখতে পেল। তারা সেখান থেকে ফিরে এসে পানির সকলকে পানির সংবাদ দিল। সংবাদ শুনে সবাই সেদিকে অগ্রসর হল। রাবী বলেন, ইসমাঈল(আ)-এর মা পানির নিকট ছিলেন। তারা তাঁকে বলল, আমরা আপনার নিকটবর্তী স্থানে বসবাস করতে চাই। আপনি আমাদেরকে অনুমতি দিবেন কি ? তিনি জবাব দিলেন, হ্যাঁ। তবে, এ পানির উপর তোমাদের কোন অধিকার থাকবে না। তারা হ্যাঁ, বলে তাদের মত প্রকাশ করলেন।
ইবন আব্বাস (রা) বলেন, নবী (ﷺ) বলেছেন, এ ঘটনা ইসমাঈলের মাকে একটি সুযোগ এনে দিল। আর তিনিও মানুষের সাহচর্য চেয়েছিলেন। এরপর তারা সেখানে বসতি স্থাপন করল এবং তাদের পরিবার –পরিজনের নিকটও সংবাদ পাঠাল । তারপর তারাও এসে তাদের সাথে বসবাস করতে লাগল। পরিশেষে সেখানে তাদের কয়েকটি পরিবারের বসতি স্থাপিত হল। আর ইসমাঈলও যৌবনে উপনীত হলেন এবং তাদের থেকে আরবি ভাষা শিখলেন। যৌবনে পৌঁছে তিনি তাদের কাছে অধিক আকর্ষণীয় ও প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলেন। এরপর যখন তিনি পূর্ণ যৌবন লাভ করলেন, তখন তারা তাঁর সঙ্গে তাদেরই একটি মেয়েকে বিবাহ দিল। এরই মধ্যে ইসমাঈলের মা হাযেরা (আঃ) ইন্তেকাল করেন। [4]
...”
অভিযোগকারীরা প্রশ্ন তুলেছেনঃ সারা পৃথিবী জুড়ে প্রায় পাঁচ হাজারের উপরে ভাষা বিরাজ করছে কী করে। তাদের অবগতির জন্য জানাতে চাই- আদম(আ) যদি আরবিভাষী হয়েও থাকতেন {যে কথা কুরআন-হাদিস কোথাও বলা হয়নি}, তারপরেও পৃথিবীজুড়ে অনেক ভাষা বিরাজ করাই স্বাভাবিক। আদম(আ) এর ভাষা আরবি হলে বর্তমান পৃথিবীর সবার ভাষাও যে আরবি হবে- এটা একটা উদ্ভট চিন্তা। আমরা জানি যে ভাষা নদীর মত, চিরন্তন প্রবাহমান ও পরিবর্তনশীল। কালের পরিক্রমায় এর পরিবর্তন হয়, এক ভাষা থেকে জন্ম নেয় আরেক ভাষা। ইউরোপ ও এশিয়ার বেশ কিছু ভাষার ধ্বনিতে ও শব্দে গভীর মিল লক্ষ্য করা যায়। এ ভাষাগুলো যে অঞ্চলে ছিল ও এখন আছে, তার সব চেয়ে পশ্চিমে ইউরোপ এবং পূর্বে ভারত ও বাংলাদেশ। ভাষাতাত্ত্বিকরা মনে করেন—ভারতীয় উপমহাদেশের ভাষাগুলো একটি ভাষাবংশের সদস্য। এই ভাষাবংশের নাম “ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশ”। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশের বেশ কিছু শাখা তৈরি হয় যার একটি শাখা হচ্ছে ভারতীয় আর্যভাষা। প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার প্রাচীন রূপ পাওয়া যায় ঋগবেদের মন্ত্রগুলোতে, যা লেখা হয়েছিল ১০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। এক সময় কালের পরিক্রমায় এই ভাষা মানুষের কাছে দুর্বোধ্য ঠেকে কারণ দৈনন্দিন ব্যবহার হতে হতে ভাষা অনেকখানি পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০ থেকে ৮০০ অব্দ পর্যন্ত বৈদিক বা বৈদিক সংস্কৃত ভাষার ব্যবহার ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ অব্দ থেকে পাওয়া যায় সংস্কৃত ভাষার ব্যবহার, যেটি ব্যাকরণবিদ পাণিনির হাতে বিধিবদ্ধ হয়েছিল। প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা বলা হয় বৈদিক ও সংস্কৃতকে; এ ছাড়াও ছিল মধ্য ভারতীয় আর্যভাষা যা প্রাকৃত ভাষা নামেও পরিচিত। খ্রিষ্টপূর্ব ৪৫০ অব্দ থেকে ১০০০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এ ভাষাগুলোর কথ্য ও লেখ্য রূপ প্রচলিত ছিল।এ ভাষার অপভ্রংশ(বিকৃত রূপ) থেকে জন্ম নিয়েছে নানা আধুনিক ভারতীয় আর্যভাষা যেমনঃ বাংলা, হিন্দী, গুজরাটী, মারাঠী, পাঞ্জাবী প্রভৃতি ভাষা। আমাদের বাংলা ভাষার আদি রূপ পাওয়া যায় চর্যাপদে যা প্রায় ১ হাজার বছর আগে লেখা হয়েছিল। মাত্র ৩০০০ বছর সময়ের মধ্যে শুধু ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশ থেকে ভারতীয় উপমহাদেশের এতগুলো আধুনিক ভাষা জন্ম নিয়েছে। [5]
১ হাজার বছর আগের বাংলা ভাষার রূপ কেমন ছিল তার একটি নমুনা দেখুনঃ
'কতো নদী সরোবর বা বাঙলা ভাষার জীবনী' - হুমায়ুন আজাদ, পৃষ্ঠা ২০
১ হাজার বছর আগের সেই চর্যাপদের বাংলা বর্তমান সময়ে অনেকখানি পরিবর্তিত হয়ে গেছে। আজকের বাঙালীরা সেই ভাষা বুঝতে পারে না। সেটা এখনকার বাঙালীদের ভাষার থেকে অনেক ভিন্ন এক প্রকারের ভাষা ছিল। বর্তমানে বাংলার অনেক উপভাষা আছে। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্নভাবে বাংলা বলা হয়। ১ হাজার বছর আগের সেই বাংলা আর আজকের বাংলার শব্দগুলোর কিছু তুলনা দেখুনঃ
'কতো নদী সরোবর বা বাঙলা ভাষার জীবনী' - হুমায়ুন আজাদ, পৃষ্ঠা ২৩
আমরা ১ হাজার বছর আগের চর্যাপদের বাংলা আর আজকের বাংলা ভাষার মধ্যকার সুবিশাল পার্থক্য দেখলাম। আজ থেকে প্রায় ৫০০ বছর আগের শেক্সপিয়ারের যুগের ইংরেজির সাথেও বর্তমান ইংরেজির অনেক পার্থক্য দেখা যায়। ৫০০ বা ১০০০ বছর তো দীর্ঘ সময়; ১০০ বছর আগেই বাংলা ও ইংরেজির যে রূপ ছিল, তা আজকের বাংলা ও ইংরেজির চেয়ে অনেক ভিন্ন।
আমরা দেখলাম যে ভাষা কিভাবে সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়। এক ভাষা থেকে কত ভাষা জন্ম নিতে পারে। কাজেই পৃথিবীর আদি মানব আদম(আ) যে ভাষায় কথা বলতেন, আজকের পৃথিবীতেও সবাই সেই ভাষাতেই কথা বলবে—এটা ভ্রান্ত ও অজ্ঞতাপূর্ণ চিন্তা ছাড়া কিছুই না। এ ধরণের চিন্তা-ভাবনাকে মোটেও “বিজ্ঞানমনষ্ক” বলা যাচ্ছে না।
তথ্যসূত্রঃ
[1] কুরআন, বাকারাহ ২:৩১-৩২
[2] আরজ আলী মাতুব্বর রচনাসমগ্র-১, 'সত্যের সন্ধান', পৃষ্ঠা ৯৪
[3] দেখুন—কুরআন সুরা ইউনুস ১০:৪৭,সুরা রা’দ ১৩:৭, সুরা হিজর ১৫:১০, সুরা নাহল ১৬:৩৬
[4] সহীহ বুখারী, হাদিস নং : ৩৩৬৪
[5] 'কতো নদী সরোবর বা বাঙলা ভাষার জীবনী' - হুমায়ুন আজাদ, পৃষ্ঠা ১৩-১৪