আল্লাহ সর্বপ্রথম কী সৃষ্টি করেছেন?

আল্লাহ সর্বপ্রথম কী সৃষ্টি করেছেন?

73 বার দেখা হয়েছে
শেয়ার করুন:

 

নাস্তিক-মুক্তমনারা অভিযোগ করে, আল্লাহ তা’আলা প্রথম কী সৃষ্টি করেছেন এই মর্মে হাদিসের তথ্যে পরস্পরবিরোধিতা রয়েছে এবং অসঙ্গতি রয়েছে।

 

এর জবাবে আমরা বলবঃ আল্লাহ তা’আলা প্রথম কী সৃষ্টি করেছেন এই মর্মে নবী মুহাম্মাদ থেকে প্রমাণিত সহীহ হাদিসের মাঝে কোনো অসঙ্গতি নেই, পরস্পরবিরোধিতাও নেই।

 

‘নূরে মুহাম্মাদী’ বা নবী মুহাম্মাদ এর নূরকে প্রথম সৃষ্টি করা হয়েছে এই মর্মে কিছু বানোয়াট বা জাল হাদিস আছে। [1] এ ছাড়া বিদআতপন্থী সম্প্রদায় প্রথম সৃষ্টি প্রসঙ্গে আরো বিভিন্ন বানোয়াট কথা বলে থাকে। এই সব বানোয়াট কথা ও জাল হাদিস ইসলামের দলিল নয়।

 

আল্লাহ তা’আলা প্রথম কী সৃষ্টি করেছেন এই প্রসঙ্গে সহীহ হাদিসে একটি তথ্যই আছে। আর তা হলঃ আল্লাহ প্রথমে কলম সৃষ্টি করেছেন।

 

عَنْ أَبِي حَفْصَةَ، قَالَ: قَالَ عُبَادَةُ بْنُ الصَّامِتِ لِابْنِهِ: يَا بُنَيَّ، إِنَّكَ لَنْ تَجِدَ طَعْمَ حَقِيقَةِ الْإِيمَانِ حَتَّى تَعْلَمَ أَنَّ مَا أَصَابَكَ لَمْ يَكُنْ لِيُخْطِئَكَ، وَمَا أَخْطَأَكَ لَمْ يَكُنْ لِيُصِيبَكَ، سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، يَقُولُ: إِنَّ أَوَّلَ مَا خَلَقَ اللَّهُ الْقَلَمَ، فَقَالَ لَهُ: اكْتُبْ قَالَ: رَبِّ وَمَاذَا أَكْتُبُ؟ قَالَ: اكْتُبْ مَقَادِيرَ كُلِّ شَيْءٍ حَتَّى تَقُومَ السَّاعَةُ

অর্থঃ “আবূ হাফসাহ (রহঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা উবাদাহ ইবনুস সামিত (রাঃ) তাঁর ছেলেকে বললেন, হে আমার প্রিয় পুত্র! তুমি ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত ঈমানের স্বাদ পাবে না যতক্ষণ না তুমি জানতে পারবে ’’যা তোমার উপর ঘটেছে তা ভুলেও এড়িয়ে যাওয়ার ছিলো না। পক্ষান্তরে, যা এড়িয়ে গেছে তা তোমার উপর ভুলেও ঘটবার ছিলো না।  আমি রাসূলুল্লাহ -কে বলতে শুনেছিঃ মহান আল্লাহ সর্বপ্রথম যে বস্তু সৃষ্টি করেছেন তা হচ্ছে কলম। অতঃপর তিনি তাকে বললেন, লিখো! কলম বললো, হে রব! কি লখবো? তিনি বললেন, কিয়ামত সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেক বস্তুর তাকদীর লিখো।[2]

 

এই কলম এক বিশেষ প্রকারের কলম যার ধরন শুধুমাত্র আল্লাহই জানেন। তা আমাদের চেনাজানা কলমের মতো কিছু নয়।

 

যদিও এই প্রসঙ্গে উলামায়ে কিরামের মধ্যে একাধিক মত রয়েছে। এই সহীহ হাদিস অনুযায়ী কারো কারো মতে আল্লাহর প্রথম সৃষ্টি হল কলম। আবার কেউ কেউ প্রথম সৃষ্টি হিসেবে আরশ এবং পানির কথাও উল্লেখ করেছেন। যাঁরা আরশ ও পানিকে প্রথম সৃষ্টি বলেন, তাঁরা নিম্নোক্ত হাদিসগুলো ব্যাখ্যা করে এই অভিমত পোষণ করেছেন—

 

 كَانَ اللَّهُ وَلَمْ يَكُنْ شَىْءٌ قَبْلَهُ، وَكَانَ عَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ، ثُمَّ خَلَقَ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ، وَكَتَبَ فِي الذِّكْرِ كُلَّ شَىْءٍ

অর্থঃ “… আল্লাহ তখন ছিলেন, তাঁর আগে আর কিছু ছিল না। তার আরশ তখন পানির ওপর ছিল। এরপর তিনি আসমান সমুহ ও যমীন সৃষ্টি করলেন। এবং লাওহে মাফফুযে সব বস্তু সম্পর্কে লিখে রাখলেন।[3]

 

عَنْ عَمِّهِ أَبِي رَزِينٍ، قَالَ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَيْنَ كَانَ رَبُّنَا قَبْلَ أَنْ يَخْلُقَ خَلْقَهُ قَالَ ‏ "‏ كَانَ فِي عَمَاءٍ مَا تَحْتَهُ هَوَاءٌ وَمَا فَوْقَهُ هَوَاءٌ وَخَلَقَ عَرْشَهُ عَلَى الْمَاءِ ‏"

অর্থঃ “আবূ রাযীন (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি বললামঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমাদের রব তাঁর মাখলূক সৃষ্টি করার আগে কোথায় ছিলেন? তিনি বললেনঃ তিনি ছিলেন তাঁর নূরের মধ্যে তার উপরেও বায়ূ ছিল না এর নিচেও বায়ূ ছিল না। তিনি তাঁর আরশ পানির উপর সৃষ্টি করেছেন।[4]

 

عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرِو، بْنِ الْعَاصِ قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ ‏ "‏ كَتَبَ اللَّهُ مَقَادِيرَ الْخَلاَئِقِ قَبْلَ أَنْ يَخْلُقَ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ بِخَمْسِينَ أَلْفَ سَنَةٍ - قَالَ - وَعَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ ‏"

অর্থঃ “আবদুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ কে বলতে শুনেছি যে, তিনি বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা সকল মাখলুকের তাকদীর আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বৎসর পূর্বে লিখেছেন। তিনি বলেছেন, সে সময় আল্লাহর আরশ পানির উপরে ছিল।[5]

 

এই হাদিসগুলোতে সরাসরি কোথাও উল্লেখ নেই যে আরশ বা পানিই প্রথম সৃষ্টি। এখানে শুধুমাত্র এটি বোঝা যাচ্ছে যে, আল্লাহ তা’আলা বহুকাল আগে আরশ, পানি ইত্যাদি সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু এগুলোর আগে আর কিছু সৃষ্টি করেছেন কি করেননি এই বিষয়ে এই হাদিসগুলোতে স্পষ্ট উল্লেখ নেই। অপরদিকে প্রথম হাদিসটিতে একদম সরাসরিই উল্লেখ আছে আল্লাহর প্রথম সৃষ্টি হল কলম। কোনো বিষয়ে ইখতিলাফ বা মতপার্থক্য হলে আমরা কুরআন এবং সহীহ হাদিসে প্রত্যাবর্তন করি এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিই। আর সহীহ হাদিস থেকে এটি প্রকাশ্য দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট যে আল্লাহ প্রথমে কলম সৃষ্টি করেছেন। এই প্রসঙ্গে কুরআনের অন্যতম প্রাচীন তাফসিরকারক ইমাম ইবন জারির তাবারী(র.) উল্লেখ করেছেন—

 

وَكَذَلِكَ قَوْلُ ابْنِ إِسْحَاقَ الَّذِي ذَكَرْنَاهُ عَنْهُ، مَعْنَاهُ أَنَّ اللَّهَ خَلَقَ النُّورَ وَالظُّلْمَةَ بَعْدَ خَلْقِهِ عَرْشَهُ، وَالْمَاءَ الَّذِي عَلَيْهِ عَرْشُهُ، وَقَوْلُ رَسُولِ اللَّهِ صلّى اللهُ عليهِ وسلّم الَّذِي رَوَيْنَاهُ عَنْهُ أَوْلَى قَوْلٍ فِي ذَلِكَ بِالصَّوَابِ، لِأَنَّهُ كَانَ أَعْلَمَ قَائِلٍ فِي ذَلِكَ قَوْلًا بِحَقِيقَتِهِ وَصِحَّتِهِ.

[وَقَدْ رَوَيْنَا عَنْهُ عليهِ السَّلامُ أَنَّهُ قَالَ: أَوَّلُ شَيْءٍ خَلَقَهُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ الْقَلَمُ]

مِنْ غَيْرِ اسْتِثْنَاءٍ مِنْهُ شَيْئًا مِنَ الْأَشْيَاءِ أَنَّهُ تَقَدَّمَ خَلْقَ اللَّهِ إِيَّاهُ خَلْقُ الْقَلَمِ، بَلْ عَمَّ [بِقَوْلِهِ صلّى اللهُ عليهِ وسلّم: إِنَّ أَوَّلَ شَيْءٍ خَلَقَهُ اللَّهُ الْقَلَمُ] كُلَّ شَيْءٍ.

وَأَنَّ الْقَلَمَ مَخْلُوقٌ قَبْلَهُ مِنْ غَيْرِ اسْتِثْنَائِهِ مِنْ ذَلِكَ عَرْشًا وَلَا مَاءً وَلَا شَيْئًا غَيْرَ ذَلِكَ.

অর্থঃ “এবং ঠিক এভাবেই ইবন ইসহাকের সেই বক্তব্য—যা আমরা তাঁর পক্ষ থেকে উল্লেখ করেছি—এর অর্থ হলোঃ আল্লাহ তাঁর আরশ সৃষ্টি করার পর আলো ও অন্ধকার সৃষ্টি করেছেন, আর সেই পানিও সৃষ্টি করেছেন যার উপর তাঁর আরশ স্থাপিত। তবে রাসূলুল্লাহ –এর সে বক্তব্য, যা আমরা তাঁর থেকে বর্ণনা করেছি—এই বিষয়ে সবচেয়ে সঠিক এবং গ্রহণযোগ্য কথা। কারণ তিনি এ বিষয়ে সত্য ও বাস্তবতার দিক থেকে সবচেয়ে জ্ঞানী বক্তা ছিলেন।

[এবং আমরা তাঁর থেকে এ কথাও বর্ণনা করেছি যে তিনি বলেছেনঃ “আল্লাহ তা‘আলা যে প্রথম জিনিসটি সৃষ্টি করেছেন, তা হলো কলম।”] তিনি কোনো কিছুকেই এর বাইরে ব্যতিক্রম হিসেবে উল্লেখ করেননি—অর্থাৎ আল্লাহ কলম সৃষ্টি করার আগে অন্য কোনো জিনিস সৃষ্টি করেছিলেন এমন কথা তিনি বলেননি। [বরং তাঁর এই বক্তব্য—“নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রথম যে বস্তুটি সৃষ্টি করেছেন, তা হলো কলম”]—এর মধ্যে সকল কিছুর উপর এ সাধারণ নিয়ম প্রযোজ্য। অর্থাৎ কলমই প্রথম সৃষ্টি, আর এর আগে আরশ, পানি বা অন্য কোনো কিছুই সৃষ্টি করা হয়নি[6]

 

এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত মুহাদ্দিস শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানী(র.) উল্লেখ করেছেন—

 

لَكِنَّ كَوْنَهُ قَالَ عَلَيْهِ السَّلَامُ: «وَكَانَ عَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ» هَذَا لَا يُبَيَّنُ أَنَّهُ لَمْ يَخْلُقْ شَيْئًا قَبْلَ ذَلِكَ الْمَاءِ الَّذِي كَانَ عَرْشُهُ عَلَيْهِ، فَإِذَا كَانَ هَذَا غَيْرَ مُبَيَّنٍ فِي هَذَا الْحَدِيثِ، وَكَانَ حَدِيثُ الْقَلَمِ صَرِيحٌ بِأَنَّهُ أَوَّلُ مَخْلُوقٍ، فَلَيْسَ هُنَاكَ مَا يَحْمِلُنَا عَلَى أَنْ نَتْرُكَ النَّصَّ الصَّرِيحَ إِلَى النَّصِّ الَّذِي يَحْتَمِلُ مَعْنَى هَذِهِ الْحَدِيثِ الصَّحِيحِ بِغَيْرِ الْقَلَمِ، فَحِينَئِذٍ عَلَى كُلِّ حَالٍ سَوَاءٌ كَانَ - الْآنَ الْبَحْثُ يَأْخُذُ طَوْرًا ثَانِيًا - سَوَاءٌ كَانَ الْقَلَمُ هُوَ أَوَّلُ مَخْلُوقٍ أَوِ كَانَ الْمَاءُ الَّذِي كَانَ عَلَيْهِ الْعَرْشُ، فَإِذًا: هُنَاكَ نُقْطَةُ الْتِقَاءٍ بَيْنَ جَمِيعِ الْمُخْتَلِفِينَ فِي تَعْيِينِ أَوَّلِ مَخْلُوقٍ أَنَّ هُنَاكَ أَوَّلَ مَخْلُوقٍ، صَحَّ هَذَا أَوْ لَا؟ إِنَّمَا الْخِلَافُ فِي تَحْدِيدِهِ وَتَعْيِينِهِ، لَكِنْ لَا خِلَافَ عِنْدَ الَّذِينَ اخْتَلَفُوا، وَهَذَا مِنَ الْعَجَائِبِ ابْنُ تَيْمِيَّةَ نَفْسُهُ حَكَى هَذَا الِاخْتِلَافَ أَنَّ الْعُلَمَاءَ اخْتَلَفُوا فِي أَوَّلِ مَخْلُوقٍ: هَلْ هُوَ الْعَرْشُ .. هَلْ هُوَ الْقَلَمُ .. هَلْ هُوَ الْمَاءُ؟ إِلَى آخِرِهِ، فَإِذًا هُنَاكَ شَيْءٌ مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ أَنَّهُ يُوجَدُ أَوَّلُ مَخْلُوقٍ، يُوجَدُ شَيْءٌ مُخْتَلَفٌ فِيهِ، مَا هُوَ هَذَا الْأَوَّلُ مِنَ الْمَخْلُوقَاتِ؟ قِيلَ وَقِيلَ.

وَالصَّرِيحُ كَمَا ذَكَرْنَا آنِفًا: أَوَّلُ مَا خَلَقَ اللَّهُ الْقَلَمَ، نَعَمْ.

অর্থঃ “তবে তাঁর এই উক্তিঃ "আর তাঁর আরশ ছিল পানির উপর" এটা স্পষ্ট করে না যে, সেই পানির আগে তিনি আর কিছু সৃষ্টি করেননি, যার উপর তাঁর আরশ অবস্থিত। যেহেতু এই হাদিসে এটি স্পষ্টভাবে বলা নেই [যে এটি প্রথম সৃষ্টি], আর কলম সম্পর্কিত হাদিসটিতে স্পষ্ট যে সেটিই প্রথম সৃষ্টি - তখন আমাদের জন্য সুস্পষ্ট নস (পাঠ/Text) ত্যাগ করে এমন নস এর দিকে যাওয়ার কোন কারণ নেই যা এই হাদিসের ভিন্ন অর্থ দিতে পারে। [অতএব আল্লাহ প্রথম সৃষ্টি করেছেন কলম, এটি প্রমাণিত।]

 

তাই যাই হোক না কেন, এখন আলোচনা দ্বিতীয় ধাপে প্রবেশ করছে। হোক কলমই প্রথম সৃষ্টি, অথবা সেই পানি যার উপর আরশ ছিল—সব মতভেদকারীদের মধ্যে একটি মিলের স্থান আছে। আর তা হল, প্রথম সৃষ্টি কিছু ছিল। তাই তো? মতভেদ শুধু এটিতে যে সেই প্রথম সৃষ্ট বস্তুটি কোনটি। এটি নির্ধারণ ও সুনির্দিষ্টকরণে মতভেদ রয়েছে। কিন্তু যারা মতভেদ করেছেন তাদের মধ্যে আশ্চর্যজনকভাবে একটা জায়গায় কোনো মতভেদ নেই। ইবন তাইমিয়া(র.) নিজেই উল্লেখ করেছেন যে, আলেমগণ প্রথম সৃষ্ট বস্তুকে নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছেনঃ তা কি আরশ? নাকি কলম? নাকি পানি? ইত্যাদি।

 

অতএব, একটি বিষয়ে সকলেই একমত যে, একটি প্রথম সৃষ্টি রয়েছে। আর একটি বিষয়ে মতভেদ রয়েছেঃ সৃষ্টির মধ্যে এই প্রথম জিনিসটি কী? এক্ষেত্রে বিভিন্ন মতামত রয়েছে।

 

আর সুস্পষ্ট মতামত, যেমন আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছিঃ আল্লাহ সর্বপ্রথম যা সৃষ্টি করেছেন তা হল কলম, হ্যাঁ।[7]

 

অতএব আমরা দেখলাম, আল্লাহ প্রথমে কী সৃষ্টি করেছেন এই প্রসঙ্গে সহীহ হাদিসের তথ্যে কোনো পরস্পরবিরোধিতা নেই।

 

আল্লাহর প্রথম সৃষ্টি কলম, এই সম্পর্কিত হাদিসে ‘অসঙ্গতি’ আছে অভিযোগ করে বাংলাদেশি নাস্তিকদের একট ব্লগে উল্লেখ করা হয়েছে—

 

এবারে আসুন এই হাদিসটি নিয়ে একটু চিন্তা করি। উপরের হাদিস থেকে জানা যাচ্ছে, কলমকে আল্লাহপাক নির্দেশ দিলেন, কিয়ামত সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত সবকিছু লিখে ফেলতে। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, কলম কী একটি সচেতন সত্ত্বা? অর্থাৎ চিন্তাভাবনা করতে সক্ষম? নিজের মগজ খাটিয়ে কথাবার্তা বলতে সক্ষম? সেটি অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন কুদরতি কলম হয়ে থাকলে, সেই কলম কি গায়েব জানে? অর্থাৎ ভবিষ্যতে কী হবে না হবে, এটি তো ইসলাম ধর্ম অনুসারে শুধুমাত্র আল্লাহ পাক জানেন। তাহলে আল্লাহ না বলে দিলে কলম সেটি জানবে কীভাবে? লিখবেই বা কীভাবে? এখানে তো আল্লাহ পাকের ধারা বিবরণী দেয়ার প্রয়োজন ছিল যে, অমুকটি লেখো তমুকটি লেখো।

 

এর জবাবে আমরা বলবঃ এই অভিযোগ নিতান্তই ছেলেমানুষী অভিযোগ। কোনো কিছুকে লিখতে আদেশ দিতে হলে এর জন্য “ধারাবিবরণী” দিতে হবে, এটা বঙ্গীয় নাস্তিক-মুক্তমনাদের কে বলেছে? তারা তো সেই আদিম যুগেই পড়ে আছে আর সেভাবে চিন্তা করে ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। আমরা আধুনিক যুগে দেখি, কোনো যন্ত্রকেও কোনো কমান্ড বা নির্দেশ দিতে ‘ধারাবিবরণী’ দেয়া লাগে না, বরং এর মাঝে আগেই প্রোগ্রাম সেট করা থাকে এবং এতে নির্দিষ্ট বোতামে চাপলেই হয়ে যায়। নাস্তিকরা মুখে নিজেদের ‘বিজ্ঞানমনস্ক’ দাবি করে, কিন্তু তাদের অভিযোগ করার ধরন একেবারেই মধ্যযুগীয়!

 

আমরা এই দাবি করছি না যে আল্লাহ তা’আলা কোনো ‘বোতামে’ চাপ দিয়ে কলমকে লেখার আদেশ দিয়েছেন। শুধুমাত্র এটি বোঝার সুবিধার্থে এই উদাহরণটি দেয়া হয়েছে যে, কোনো কিছুকে আদেশ দিতে হলেই যে ধারাবিবরণী দিতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আল্লাহ তা’আলা সব কিছুর স্রষ্টা, সব কিছুর উপর সর্বশক্তিমান এবং গায়েবের জ্ঞান একমাত্র তিনিই রাখেন। তিনি “হও” বললেই সব কিছু হয়ে যায়। আল্লাহ তা’আলা তাঁর জ্ঞান থেকে কলমকে অবহিত করতে পারেন কখন কী ঘটবে এবং সেই অনুযায়ী তাঁর নির্দেশে কলম সব কিছু লিপিবদ্ধ করতে পারে।

 

বাংলাদেশি নাস্তিকদের ব্লগটিতে আরো উল্লেখ করা হয়েছে—

 

যখন কোন কিছুই আর ছিল না, এই কথা বলা কুদরতি কলমটি লিখবে কিসের ওপর? কালি এবং কাগজ না থাকলে কীভাবে হবে?”

 

এটি আরো একটি ছেলেমানুষী অভিযোগ। হাদিসে উল্লেখ আছে, আল্লাহ প্রথমে কলম সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু এটি তো উল্লেখ নেই যে তিনি কলমের পরে আর কিছুই তিনি সৃষ্টি করেননি! আল্লাহ কলম সৃষ্টির পরে আরো এমন কিছু সৃষ্টি করেছেন, যার উপরে সেই কলম সব কিছু লিপিবদ্ধ করতে পারে। আর তা হল লাওহে মাহফুজ। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ বিন আলি বিন আদাম আল আছইয়ুবী(র.) উল্লেখ করেছেন—

 

فَالدَّرَجَةُ الْأُولَى بِأَنَّْ اللَّهَ تَعَالَى عَلِيمٌ بِالْخَلْقِ، وَهُمْ عَامِلُونَ بِعِلْمِهِ الْقَدِيمِ الَّذِي هُوَ مَوْصُوفٌ بِهِ أَزَلًا وَأَبَدًا، وَعَلِمَ جَمِيعَ أَحْوَالِهِمْ مِنَ الطَّاعَاتِ، وَالْمَعَاصِي، وَالْأَرْزَاقِ، وَالْآجَالِ، ثُمَّ كَتَبَ اللَّهُ فِي اللَّوْحِ الْمَحْفُوظِ مَقَادِيرَ الْخَلْقِ، فَأَوَّلُ مَا خَلَقَ اللَّهُ الْقَلَمَ، قَالَ لَهُ: اكْتُبْ، قَالَ: مَا أَكْتُبُ؟ قَالَ: اكْتُبْ مَا هُوَ كَائِنٌ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ، فَمَا أَصَابَ الْإِنْسَانَ، لَمْ يَكُنْ لِيُخْطِئَهُ، وَمَا أَخْطَأَهُ لَمْ يَكُنْ لِيُصِيبَهُ، جَفَّتِ الْأَقْلَامُ، وَطُوِيَتِ الصُّحُفُ، كَمَا قَالَ تَعَالَى: {أَلَمْ تَعْلَمْ أَنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ مَا فِي السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ إِنَّ ذَلِكَ فِي كِتَابٍ إِنَّ ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ} [الحج: ٧٠], وَقَالَ تَعَالَى: {مَا أَصَابَ مِنْ مُصِيبَةٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي أَنْفُسِكُمْ إِلَّا فِي كِتَابٍ مِنْ قَبْلِ أَنْ نَبْرَأَهَا إِنَّ ذَلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ} [الحديد: ٢٢], وَهَذَا التَّقْدِيرُ التَّابِعُ لِعِلْمِهِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى يَكُونُ فِي مَوَاضِعَ جُمْلَةً وَتَفْصِيلًا، فَقَدْ كَتَبَ فِي اللَّوْحِ الْمَحْفُوظِ مَا شَاءَ.

অর্থঃ “প্রথম ধাপ হল এই যে, মহান আল্লাহ সৃষ্টি সম্পর্কে জ্ঞাত, এবং তারা [সৃষ্ট জীবেরা] তাঁর চিরন্তন জ্ঞান অনুসারে কাজ করে, যে জ্ঞান দ্বারা তিনি আদি অনন্তকাল থেকে গুণান্বিত। তিনি তাদের সমস্ত অবস্থা সম্পর্কে জানেন, যার মধ্যে রয়েছে আনুগত্য, অবাধ্যতা, জীবিকা এবং আয়ুষ্কাল। আল্লাহ তাকদিরকে লাওহে মাহফুজে লিপিবদ্ধ করেন। আল্লাহ সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করলেন এবং তাকে বললেনঃ 'লেখো' কলম বললঃ 'আমি কী লিখব?' তিনি বললেনঃ 'কেয়ামত পর্যন্ত যা কিছু ঘটবে তা লেখো' সুতরাং, যা একজন মানুষের ভাগ্যে ঘটেছে, তা তাকে কখনো এড়িয়ে যেতে পারত নাআর যেসব ঘটনা তাকে এড়িয়ে গেছে, তা কখনো তার ভাগ্যে ঘটার ছিল না। কলম শুকিয়ে গেছে এবং খাতা গুটিয়ে নেওয়া হয়েছে, যেমনটি আল্লাহ তাআলা বলেছেনঃ {তুমি কি জানো না যে, আল্লাহ আকাশ ও জমিনে যা আছে তা জানেন? নিশ্চয়ই তা একটি কিতাবে রয়েছে। নিশ্চয়ই এটি আল্লাহর জন্য খুবই সহজ} [আল-হাজ্জ: ৭০], এবং তিনি আরও বলেছেনঃ {পৃথিবীতে অথবা তোমাদের নিজেদের মধ্যে যে কোনো বিপদ আসে, তা আমরা সংঘটিত করার পূর্বেই একটি কিতাবে (লিপিবদ্ধ) থাকে। নিশ্চয়ই এটি আল্লাহর জন্য খুবই সহজ} [আল-হাদীদ: ২২]। আর তাঁর জ্ঞানের অধীন এই তাকদির বিভিন্ন স্থানে সমষ্টিগতভাবে এবং বিস্তারিতভাবে সংঘটিত হয়। সুতরাং তিনি লাওহে মাহফুজে যা ইচ্ছা লিপিবদ্ধ করেছেন।" [8]

 

অতএব আমরা দেখলাম আল্লাহ তা’আলা প্রথম কী সৃষ্টি করেছেন এই প্রসঙ্গে হাদিসের তথ্যে কোনোরূপ অসঙ্গতি নেই।

 

এ প্রসঙ্গে আরো দেখতে পারেনঃ

আল্লাহ সর্বপ্রথম কী সৃষ্টি করেছেন? | শায়খ আহমাদুল্লাহ

https://youtu.be/xswv-kqzPx0

 

 

তথ্যসূত্রঃ


[1] বিস্তারিত দেখুনঃ হাদিসের নামে জালিয়াতী – ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, পৃষ্ঠা ৩৪৭-৩৭০

অথবা দেখুনঃ "নূর মুহাম্মাদীই (সা.) প্রথম সৃষ্টি" - ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর

https://assunnahtrust.org/2015/01/07/nur-muhammadi-prothom-sristi/

https://archive.is/wip/1JYRM (আর্কাইভকৃত)

[2] সুনান আবু দাউদ, হাদিস নং : ৪৭০০ (সহীহ)

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=62068

[3] সহীহ বুখারী, হাদিস নং : ৬৯১৩

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=7656

[4] সুনান আত তিরমিজী, হাদিস নং : ৩১০৯ (যঈফ)

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=38461

[5] সহীহ মুসলিম, হাদিস নং : ৬৬৪১

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=53739

[6] তারিখুর রুসুল ওয়াল মুলুক (তারিখ আত তাবারী) – ইবন জারির তাবারী, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৩৫-৩৬

https://shamela.ws/book/9783/33

https://shamela.ws/book/9783/34

অথবা (আর্কাইভকৃত)

https://archive.is/wip/ryWJh

https://archive.is/wip/doTry

[7] জামি’উ তুরাছিল ‘আল্লামাতিল আলবানিয়্যি ফিল ‘আকিদাহ (মাউসু’আতুল আকিদাহ) – নাসিরুদ্দিন আলবানী, খণ্ড ৭, পৃষ্ঠা ৮৯৭-৮৯৮

https://shamela.ws/book/36190/3330

https://shamela.ws/book/36190/3331

অথবা (আর্কাইভকৃত)

https://archive.is/wip/q8sGP

https://archive.is/wip/kzLyj

[8] মাশারিক্বুল আনওয়ারিল ওয়াহহাজাহ ওয়া মাত্বালিউল আসরারিল বাহহাজাহ ফী শারহি সুনানিল ইমাম ইবনি মাজাহ - মুহাম্মাদ বিন আলি বিন আদাম আল আছইয়ুবী, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ২৯২

https://shamela.ws/book/17132/845

অথবা https://archive.is/wip/nv68f (আর্কাইভকৃত)

 

সোশ্যাল লিঙ্ক ও অ্যাপ

সর্বাধিক পঠিত

সর্বশেষ পোস্টসমূহ