মুসলিমদের পাপ কি অন্যায়ভাবে ইহুদি-খ্রিষ্টানদের উপর চাপিয়ে দেয়া হবে?

মুসলিমদের পাপ কি অন্যায়ভাবে ইহুদি-খ্রিষ্টানদের উপর চাপিয়ে দেয়া হবে?

23 বার দেখা হয়েছে
শেয়ার করুন:

 

অভিযোগঃ

ইসলাম একটি ইহুদিবিদ্বেষী ধর্ম। হাদিস অনুসারে মুসলিমদের পাপের ভার ইহুদি-খ্রিষ্টানদের উপর চাপিয়ে তাদেরকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। অর্থাৎ ইহুদি-খ্রিষ্টানরা বিনা অপরাধে মুসলিমদের পাপের কারণে শাস্তি পাবে!

আর এই সংক্রান্ত হাদিসগুলো কুরআনে আয়াতের সাথে সাংঘর্ষিক যেখানে বলা হয়েছেঃ কেউ কারো পাপের ভার বহন করবে না। অতএব কুরআন ও হাদিস সাংঘর্ষিক জিনিস বলে প্রমাণ হল!

মুসলিমরা খ্রিষ্ট ধর্মের উপর অভিযোগ করে যিশু খ্রিষ্ট মানব জাতির পাপের ভার বহন করবেন অর্থাৎ একজন মানুষ অন্যের পাপ বহন করবে এহেন ধর্মবিশ্বাস অনৈতিক। অথচ মুসলিমদের নিজ ধর্মেই এমন কথার উল্লেখ আছে যে ইহুদি-খ্রিষ্টানরা মুসলিমদের পাপের ভার বহন করবে!

 

জবাবঃ

অভিযোগকারীরা এ প্রসঙ্গে সহীহ মুসলিম থেকে পর পর কয়েকটি হাদিস উদ্ধৃত করে। আরো নির্দিষ্ট করে বললে সহীহ মুসলিমে ৬৭৫৫-৬৭৫৮ নং হাদিস উদ্ধৃত করে—

 

إِذَا كَانَ يَوْمُ الْقِيَامَةِ دَفَعَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ إِلَى كُلِّ مُسْلِمٍ يَهُودِيًّا أَوْ نَصْرَانِيًّا فَيَقُولُ هَذَا فَكَاكُكَ مِنَ النَّارِ

অর্থঃ “কিয়ামত দিবসে আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক মুসলিমকে এক এক জন খ্রীষ্টান বা ইয়াহুদী দিয়ে বলবেন, এ হচ্ছে তোমার জন্য জাহান্নামের আগুন হতে মুক্তিপণ।[1]

 

‏ لاَ يَمُوتُ رَجُلٌ مُسْلِمٌ إِلاَّ أَدْخَلَ اللَّهُ مَكَانَهُ النَّارَ يَهُودِيًّا أَوْ نَصْرَانِيًّا

অর্থঃ "যখনই কোন মুসলিম মারা যায় তখন আল্লাহ তার স্থলে একজন ইয়াহুদী বা খ্রীষ্টানকে জাহান্নামে দাখিল করেন।" [2]

 

৬৭৫৭ নং হাদিসে অনুরূপ বর্ণনা আছে।

 

يَجِيءُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ نَاسٌ مِنَ الْمُسْلِمِينَ بِذُنُوبٍ أَمْثَالِ الْجِبَالِ فَيَغْفِرُهَا اللَّهُ لَهُمْ وَيَضَعُهَا عَلَى الْيَهُودِ وَالنَّصَارَى ‏"‏ ‏.‏ فِيمَا أَحْسِبُ أَنَا ‏.‏ قَالَ أَبُو رَوْحٍ لاَ أَدْرِي مِمَّنِ الشَّكُّ ‏.

অর্থঃ “কিছুসংখ্যক মুসলিম পাহাড় সমান গুনাহ নিয়ে কিয়ামতের ময়দানে আসবে এবং আল্লাহ তাআলা তাদের গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন। আর তা ইয়াহুদী ও খ্রীষ্টানদের উপর চড়িয়ে দিবেন। আমার মনে হয় এ রূপই বর্ণনাকারী হাদীসের শেষোক্ত কথাটি সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। রাবী আবূ রাওহ (রহঃ) বলেন, কার পক্ষ থেকে সন্দেহের উদ্রেক হয়েছে, তা আমার জানা নেই।[3]

 

এখানে শুধুমাত্র ৬৭৫৮ নং হাদিসে এই কথার উল্লেখ আছে যে মুসলিমদের পাপ ইহুদি-খ্রিষ্টানদের উপর চড়িয়ে দেয়া হয়। অন্য হাদিসগুলোতে এমন কথা সরাসরি নেই।

 

এখন প্রশ্ন হল, এই হাদিস অনুসারে মুসলিমরা কি এমন কিছু বিশ্বাস করে যে মুসলিমদের পাপ ইহুদি-খ্রিষ্টানরা বহন করবে?

 

আল কুরআন অনুযায়ী কেউ অন্য কারো পাপ বহন করবে নাঃ

ইসলামী শরিয়তের প্রথম এবং সর্বপ্রধান উৎস আল কুরআন থেকে এই বিষয়টি স্পষ্ট যে – কোনো ব্যক্তি অন্য কারো পাপের ভার বহন করবে না। প্রত্যেক মানুষ নিজের বোঝা নিজেই বহন করবে, অন্যের বোঝা নয়। মানুষ নিজে যা করবে, শুধুমাত্র সেই কাজের ফল লাভ করবে। এটাই ইসলামী বিশ্বাস। 

 

وَلَا تَكۡسِبُ كُلُّ نَـفۡسٍ اِلَّا عَلَيۡهَا​ۚ وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِّزۡرَ اُخۡرٰى

অর্থঃ “প্রত্যেক ব্যক্তি যা অর্জন করে তার জন্য সে নিজেই দায়ী হবে। কোন ভারবহনকারীই অন্যের গুনাহের ভার বহন করবে না।[4]

 

مَنِ اهۡتَدٰى فَاِنَّمَا يَهۡتَدِىۡ لِنَفۡسِهٖ ​ۚ وَمَنۡ ضَلَّ فَاِنَّمَا يَضِلُّ عَلَيۡهَا​ ؕ وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِّزۡرَ اُخۡرٰى​

অর্থঃ “যে হিদায়াত গ্রহণ করে, সে তো নিজের জন্যই হিদায়াত গ্রহণ করে এবং যে পথভ্রষ্ট হয় সে নিজের (স্বার্থের) বিরুদ্ধেই পথভ্রষ্ট হয়। আর কোন বহনকারী অপরের (পাপের) বোঝা বহন করবে না।[5]

 

وَ لَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِّزۡرَ اُخۡرَىٰ ؕ وَاِنۡ تَدۡعُ مُثۡقَلَةٌ اِلٰى حِمۡلِهَا لَا يُحۡمَلۡ مِنۡهُ شَىۡءٌ وَّلَوۡ كَانَ ذَا قُرۡبٰى

অর্থঃ “কোন বহনকারী অন্যের (পাপের) বোঝা বইবে না। কেউ যদি তার গুরুভার বয়ে দেয়ার জন্য অন্যকে ডাকে তবে তার কিছুই বয়ে দেয়া হবে না- নিকটাত্মীয় হলেও।[6]

 

( 38 )   أَلَّا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَىٰ ( 39 )   وَأَن لَّيْسَ لِلْإِنسَانِ إِلَّا مَا سَعَىٰ

অর্থঃ “ওটা এই যে, কোন বহনকারী অপরের বোঝা বহন করবেনা। আর এই যে, মানুষ তা’ই পায় যা সে করে।[7]

 

কোনো কোনো মুহাদ্দিসের মতে আলোচ্য হাদিস ‘শায’ পর্যায়েরঃ

উপরে উল্লেখিত যে হাদিসটিতে (সহীহ মুসলিম ৬৭৫৮) এই কথার উল্লেখ আছে যে মুসলিমদের পাপ ইহুদি-খ্রিষ্টানদের উপর চড়িয়ে দেয়া হবেকোনো কোনো মুহাদ্দিসের মতে সেটি একটি শায হাদিস। [8] নির্ভরযোগ্য বা সিকাহ রাবী (বর্ণনাকারী) থেকে বর্ণিত হলেও শায হাদিসের মান হচ্ছে - বর্জনীয়। [9] কাজেই তা থেকে এই তথ্য প্রমাণিত হবে না যে মুসলিমদের পাপ ইহুদি-খ্রিষ্টানদের উপর চাপিয়ে দেয়া হবে। আর এটিও লক্ষণীয় যে, ঐ হাদিসের রাবী স্বয়ং শেষোক্ত কথাটি অর্থাৎ মুসলিমদের পাপ ইহুদি-খ্রিষ্টানদের উপর চড়িয়ে দেয়া হবে, এই কথা সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করেছেন বলে ঐ হাদিসের মধ্যেই উল্লেখ আছে।

 

আলোচ্য হাদিসকে ‘শায’ বলে উল্লেখ করে এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত মুহাদ্দিস শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানী(র.) বলেছেন—

 

شَاذٌّ

أَخْرَجَهُ مُسْلِمٌ (٨/ ١٠٥) مِنْ طَرِيقِ شَدَّادِ أَبِي طَلْحَةَ الرَّاسِبِيِّ، عَنْ غَيْلَانَ بْنِ جَرِيرٍ، عَنْ أَبِي بُرْدَةَ، عَنِ النَّبِيِّ ﷺ قَالَ: … فَذَكَرَهُ.

قَالَ أَبُو رُوحٍ: لَا أَدْرِي مِمَّنِ الشَّكُّ؟!

أَوْرَدَهُ شَاهِدًا لِمَا سَاقَهُ مِنْ قَبْلُ مِنْ ثَلَاثَةِ طُرُقٍ عَنْ أَبِي بُرْدَةَ بِلَفْظِ:

«إِذَا كَانَ يَوْمُ الْقِيَامَةِ؛ دَفَعَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ إِلَى كُلِّ مُسْلِمٍ يَهُودِيًّا أَوْ نَصْرَانِيًّا، فَيَقُولُ: هَذَا فِكَاكُكَ مِنَ النَّارِ».

هَذَا لَفْظُ طَلْحَةَ بْنِ يَحْيَى عَنْ أَبِي بُرْدَةَ. وَلَفْظُ عَوْنٍ وَسَعِيدِ بْنِ أَبِي بُرْدَةَ:

«لَا يَمُوتُ رَجُلٌ إِلَّا أَدْخَلَ اللَّهُ مَكَانَهُ النَّارَ يَهُودِيًّا أَوْ نَصْرَانِيًّا».

… … …

অর্থঃ “শায বর্ণনা।

 

ইমাম মুসলিম (৮/১০৫) এটিকে বর্ণনা করেছেন শাদ্দাদ আবু তালহা আর-রাসিবির মাধ্যমে, তিনি গাইলান ইবনে জারির থেকে, তিনি আবু বুরদা থেকে, তিনি নবী () থেকে, তিনি বলেছেন: ... অতঃপর তিনি তা উল্লেখ করেন। আবু রূহ বলেনঃ আমি জানি না সন্দেহটি কার (বর্ণনায়)!

 

তিনি [ইমাম মুসলিম(র.)] এটি একটি শাহেদ (সমর্থনকারী) বর্ণনা হিসেবে উল্লেখ করেছেন যা তিনি পূর্বে আবু বুরদা থেকে তিনটি সূত্রে এই শব্দে উল্লেখ করেছিলেনঃ

 

কিয়ামত দিবসে আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক মুসলিমকে এক এক জন খ্রীষ্টান বা ইয়াহুদী দিয়ে বলবেন, এ হচ্ছে তোমার জন্য জাহান্নামের আগুন হতে মুক্তিপণ।

 

এটি আবু বুরদা থেকে তালহা ইবনে ইয়াহইয়ার বর্ণনার ভাষ্য। আর আওন ও সাঈদ ইবনে আবি বুরদার বর্ণনার ভাষ্য হলঃ

 

"যখনই কোন মুসলিম মারা যায় তখন আল্লাহ তার স্থলে একজন ইয়াহুদী বা খ্রীষ্টানকে জাহান্নামে দাখিল করেন।" ” [10]

 

শায়খ আলবানী(র.) উল্লেখ করেছেন, ইমাম মুসলিম(র.) কর্তৃক এই শায বর্ণনা উল্লেখের কারণ হল পূর্বের অন্য বর্ণনাগুলো শাহেদ বা সমর্থনকারী হিসেবে তা উল্লেখ করা।

আলোচ্য হাদিসের সমস্যাগুলো চিহ্নিত হয়ে এর শায বা মুনকার হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন --

 

وَأَمَّا اللَّفْظُ الأَوَّلُ؛ فَهُوَ مُنْكَرٌ أَوْ شَاذٌّ عَلَى الأَقَلِّ؛ لِأَنَّهُ تَفَرَّدَ بِهِ الرَّاسِبِيُّ، وَهُوَ وَإِنْ كَانَ وَثَّقَهُ أَحْمَدُ وَغَيْرُهُ؛ فَقَدْ ضَعَّفَهُ شَيْخُهُ عَبْدُ الصَّمَدِ بْنُ عَبْدِ الْوَارِثِ. وَقَالَ العُقَيْلِيُّ:

«لَهُ غَيْرُ حَدِيثٍ لَا يُتَابَعُ عَلَيْهِ». وَقَالَ ابْنُ حِبَّانَ:

«رُبَّمَا أَخْطَأَ». وَقَالَ الدَّارَقُطْنِيُّ:

«يُعْتَبَرُ بِهِ». وَقَالَ الحَاكِمُ أَبُو أَحْمَدَ:

«لَيْسَ بِالْقَوِيِّ عِنْدَهُمْ».

قُلْتُ: فَهَذِهِ الأَقْوَالُ تَدُلُّ عَلَى أَنَّ الرَّجُلَ لَمْ يَكُنْ قَوِيًّا فِي حِفْظِهِ، وَإِنْ كَانَ صَدُوقًا فِي نَفْسِهِ. وَلِذَلِكَ؛ لَمْ يُخْرِجْ لَهُ مُسْلِمٌ إِلَّا فِي الشَّوَاهِدِ؛ كَهَذَا الحَدِيثِ. وَقَالَ الحَافِظُ فِي «التَّقْرِيبِ»:

«صَدُوقٌ يَخْطِئُ».

فَمِثْلُهُ حَدِيثُهُ مُرَشَّحٌ لِلتَّقْوِيَةِ بِالشَّاهِدِ وَالْمُتَابَعَةِ، أَوْ لِلضَّعْفِ بِالْمُخَالَفَةِ كَحَدِيثِ التَّرْجَمَةِ.

وَبِهَا أَعَلَّهُ البَيْهَقِيُّ، فَقَالَ فِي «شُعَبِ الإِيمَانِ» (١/ ٢٦٦–٢٦٧) – بَعْدَ أَنْ سَاقَ الحَدِيثَ الصَّحِيحَ مِنَ الطُّرُقِ الثَّلَاثِ عِنْدَ مُسْلِمٍ وَأَتْبَعَهُ بِحَدِيثِ التَّرْجَمَةِ –:

«فَهَذَا حَدِيثٌ شَكَّ فِيهِ [بَعْضُ] رُوَاتِهِ، وَشَدَّادُ أَبُو طَلْحَةَ مِمَّنْ تَكَلَّمَ أَهْلُ العِلْمِ بِالحَدِيثِ فِيهِ، وَإِنْ كَانَ مُسْلِمٌ اسْتَشْهَدَ بِهِ فِي كِتَابِهِ؛ فَلَيْسَ هُوَ مِمَّنْ يُقْبَلُ مِنْهُ مَا يُخَالِفُ فِيهِ، وَالَّذِينَ خَالَفُوهُ فِي لَفْظِ الحَدِيثِ عَدَدٌ، وَهُوَ وَاحِدٌ، وَكُلُّ وَاحِدٍ مِمَّنْ خَالَفَهُ أَحْفَظُ مِنْهُ، فَلَا مَعْنَى لِلِاشْتِغَالِ بِتَأْوِيلِ مَا رَوَاهُ، مَعَ خِلَافِ ظَاهِرِ مَا رَوَاهُ الأُصُولُ الصَّحِيحَةُ الْمُمَهَّدَةُ فِي أَنْ لَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَى. وَاللَّهُ أَعْلَمُ».

অর্থঃ কিন্তু প্রথম বর্ণনাপাঠটি মুনকার, অথবা অন্তত শায; কারণ এটি কেবল রাসিবির একক বর্ণনা। যদিও আহমাদ ও অন্যান্যরা তাকে নির্ভরযোগ্য বলেছেন, কিন্তু তার নিজের শায়খ ‘আবদুস্‌ সামাদ ইবন ‘আবদুল ওয়ারিস তাকে দুর্বল বলেছেন।

আল-‘উকায়লী বলেছেনঃতার এমন একাধিক হাদিস আছে, যেগুলোর ক্ষেত্রে তাকে কেউ অনুসরণ করেনি।

ইবন হিব্বান বলেছেনঃসে কখনো কখনো ভুল করে।

দারাকুতনী বলেছেনঃতার বর্ণনা তুলনামূলকভাবে বিবেচিত হয় (ই‘তিবার করা যায়)।”

এবং আল-হাকিম আবু আহমাদ বলেছেনঃতাঁদের [মুহাদ্দিসদের] নিকট সে শক্তিশালী নয়।

 

আমি [আলবানী] বলিঃ এসব বক্তব্য প্রমাণ করে যে, এই ব্যক্তি [রাসিবি] স্মৃতিশক্তির দিক থেকে শক্তিশালী ছিলেন না, যদিও ব্যক্তিগতভাবে তিনি সত্যবাদী ছিলেন। এ কারণেই মুসলিম(র.) তাঁর থেকে কেবল শাওয়াহিদে (সমর্থক বর্ণনায়) হাদিস গ্রহণ করেছেন—এই হাদিসের মতো।

 আর হাফিজ [ইবন হাজার আসকালানী(র.)] ‘তাকরিব’ গ্রন্থে [রাসিবি সম্পর্কে] বলেছেনঃ সত্যবাদী, তবে ভুল করেন।”

 

এমন ব্যক্তির হাদিস সাধারণত শাহেদ ও মুতাবা‘আত দ্বারা শক্তিশালী হওয়ার উপযোগী হয় অথবা বৈপরিত্যের কারণে দুর্বল হয়ে পড়ে, যেমন আলোচ্য হাদিসটি। এই কারণেই বায়হাকী(র.) এ হাদিসটিকে দুর্বল সাব্যস্ত করেছেন। তিনি শু‘আবুল ঈমান (১/২৬৬–২৬৭)-এ বলেন, মুসলিমের তিনটি সূত্র থেকে সহীহ হাদীস বর্ণনা করার পর এবং তারপরে উল্লিখিত হাদিসটি বর্ণনা করার পরঃ

 

এটি এমন একটি হাদিস, যার ব্যাপারে এর কিছু বর্ণনাকারী সন্দেহে পড়েছেন। আর শাদ্দাদ আবু তালহা [রাসিবি] এমন এক ব্যক্তি, যাকে নিয়ে হাদিসবিদগণ আলোচনা করেছেন। যদিও মুসলিম তার বর্ণনাকে নিজের কিতাবে সমর্থনকারী [শাহেদ] হিসেবে এনেছেন, তবু তিনি এমন ব্যক্তি নন যার থেকে বৈপরিত্যযুক্ত বর্ণনা গ্রহণযোগ্য হবে। যারা হাদিসের বর্ণনাপাঠে তার থেকে ভিন্ন তথ্য দিয়েছেন, তাঁরা সংখ্যায় একাধিক; আর সে একজন মাত্র। আর যারা তার থেকে ভিন্ন তথ্য দিয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেকেই তার [রাসিবি] চেয়ে উত্তম স্মৃতির অধিকারী। সুতরাং সে যা বর্ণনা করেছে তার ব্যাখ্যা নিয়ে ব্যস্ত হওয়ার কোনো অর্থ নেই, বিশেষ করে যখন তা সেই সুপ্রতিষ্ঠিত ও সহীহ মূলনীতিসমূহের প্রকাশ্য বিরোধী, যেখানে স্পষ্টভাবে [আল কুরআনে] বলা হয়েছেঃ ‘কোনো বোঝা বহনকারী অন্যের [পাপের] বোঝা বহন করবে না।’ আর আল্লাহই সর্বাধিক জ্ঞানী।[11]

 

আলোচ্য হাদিসকে পূর্বে এক স্থানে সহীহ হিসেবে উল্লেখ করলেও পরবর্তীতে সেই অবস্থান থেকে নিজেকে সংশোধণ করেছিলেন শায়খ আলবানী(র.)। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন—

 

قُلْتُ: وَهٰذَا مِنْهُ رَحِمَهُ اللَّهُ فِي غَايَةِ التَّحْقِيقِ، وَإِلَيْهِ يَرْجِعُ الْفَضْلُ فِي تَنَبُّهِي لِهٰذِهِ الْعِلَّةِ، بَعْدَ أَنْ كُنْتُ أُورِدُ الْحَدِيثَ فِي «صَحِيحِ الْجَامِعِ» بِرَقْمِ (٧٨٩١) اعْتِمَادًا مِنِّي عَلَى الإِمَامِ مُسْلِمٍ، وَلَيْسَ بِتَحْقِيقِي؛ اتِّبَاعًا لِلْقَاعِدَةِ الْغَالِبَةِ: أَنَّ مَا أَخْرَجَهُ الشَّيْخَانِ أَوْ أَحَدُهُمَا؛ فَقَدْ جَاوَزَ الْقَنْطَرَةَ، لَا سِيَّمَا وَالْعُمْرُ أَقْصَرُ، وَالْوَقْتُ أَضْيَقُ مِنَ التَّوَجُّهِ إِلَى نَقْدِ «الصَّحِيحَيْنِ»؛ لِلتَّعَرُّفِ عَلَى الأَحَادِيثِ الْقَلِيلَةِ الَّتِي يُمْكِنُ أَنْ تَكُونَ مَعْلُولَةً عِنْدَ الْعَارِفِينَ بِهٰذَا الْعِلْمِ. بَيْنَمَا مَجَالُ نَقْدِ أَحَادِيثِ غَيْرِهِمَا مِنْ كُتُبِ السُّنَّةِ وَاسِعٌ جِدًّا.

وَهٰذَا مَا جَرَيْتُ عَلَيْهِ فِي كُلِّ مُؤَلَّفَاتِي؛ إِلَّا فِي بَعْضِ الأَحْوَالِ النَّادِرَةِ، مِمَّا جَرَّنِي إِلَيْهِ الْبَحْثُ وَالتَّحْقِيقُ، أَوْ نَبَّهَنِي عَلَى ذٰلِكَ بَعْضُ مَنْ سَبَقَنِي مِنْ أَهْلِ الْعِلْمِ وَالتَّوْفِيقِ، كَهٰذَا الْحَدِيثِ، وَالْحَمْدُ لِلَّهِ وَحْدَهُ.

مِنْ أَجْلِ ذٰلِكَ – وَتَعَاوُنًا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى – أَرْجُو مِنْ كُلِّ مَنْ كَانَ عِنْدَهُ نُسْخَةٌ مِنْ «ضَعِيفِ الْجَامِعِ الصَّغِيرِ» أَنْ يَنْقُلَ إِلَيْهِ هٰذَا الْحَدِيثَ، وَاللَّهَ تَعَالَى أَسْأَلُ أَنْ يَغْفِرَ لَنَا خَطَايَانَا، وَأَنْ لَا يُؤَاخِذَنَا بِمَا نَسِينَا أَوْ أَخْطَأْنَا؛ إِنَّهُ سَمِيعٌ مُجِيبٌ!

هٰذَا؛ وَمِمَّنْ لَمْ يَتَنَبَّهْ لِعِلَّةِ هٰذَا الْحَدِيثِ الإِمَامُ النَّوَوِيُّ رَحِمَهُ اللَّهُ؛ فَإِنَّهُ تَأَوَّلَهُ

অর্থঃ “আমি [আলবানী] বলিঃ আল্লাহ তাঁর [ইমাম বায়হাকীর] প্রতি রহম করুন। এটি তাঁর পক্ষ থেকে অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও গভীর গবেষণার নিদর্শন। [আলোচ্য হাদিসের] এই ত্রুটির প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণের কৃতিত্বও তাঁরই যদিও এর আগে আমি ইমাম মুসলিমের উপর নির্ভর করে নিজস্ব যাচাই ছাড়াই “সহীহুল জামিʿ (হাদিস নং ৭৮৯১)-এ এটি উল্লেখ করেছিলাম [অর্থাৎ সহীহ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলাম]। তা ছিল প্রচলিত সাধারণ নীতির অনুসরণে যে, শাইখাইন (বুখারী ও মুসলিম) অথবা তাঁদের একজন যে হাদিস সংকলন করেছেন, তা 'পুল পার' হয়ে গেছে (অর্থাৎ সহীহ হিসেবে গৃহিত হয়েছে)। আমাদের জীবন খুবই ছোট। আর 'সহীহাইন' [বুখারী ও মুসলিম]-এর সমালোচনার দিকে মনোযোগ দেওয়ার জন্য সময় এই জীবন তো খুবই সীমিতযে সময়কালের মধ্যে এই জ্ঞানে পারদর্শী ব্যক্তিরা যে অল্প কিছু হাদিসকে ত্রুটিপূর্ণ বলে বিবেচনা করতে পারেন তা শনাক্ত করা যায়। অথচ তাদের বাইরে অন্যান্য সুন্নাহর গ্রন্থসমূহের হাদিস সমালোচনার ক্ষেত্র অত্যন্ত বিস্তৃত। এটি এমন একটি পদ্ধতি যা আমি আমার সব রচনায় অনুসরণ করেছি কিছু বিরল ক্ষেত্র ছাড়া, যা আমাকে গবেষণা ও যাচাই করতে পরিচালিত করেছে, অথবা জ্ঞান ও সফলতার অধিকারী আমার পূর্বসূরীদের কেউ আমাকে সতর্ক করেছেন - যেমনটি এই হাদিসের ক্ষেত্রে ঘটেছে। আর সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্যই।

 

এ কারণেই, সৎকর্ম ও তাকওয়ার কাজে পারস্পরিক সহযোগিতার উদ্দেশ্যে—আমি আশা করি, যাঁর কাছে ‘যঈফুল জামিʿ আস সগীর’-এর কোনো কপি আছে, তিনি যেন সেখানে এই হাদিসটিকে যুক্ত করে দেন [অর্থাৎ যঈফ বা দুর্বল হাদিস হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন]। আর আমি আল্লাহ তাআলার নিকট প্রার্থনা করি তিনি যেন আমাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন এবং আমরা যা ভুলে গেছি বা ভুল করেছি তার জন্য আমাদেরকে পাকড়াও না করেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা, দোয়া কবুলকারী।

 

এ কথা উল্লেখযোগ্য যে, এই হাদিসের ত্রুটির দিকে যাঁদের দৃষ্টি যায়নি তাঁদের মধ্যে ইমাম নববী রহিমাহুল্লাহও আছেন; কারণ তিনি এর ব্যাখ্যা (তাবিল) করেছেন।[12] [13]

 

শায়খ আলবানী(র.) উল্লেখ করেছেন যে, আলোচ্য হাদিসের ক্ষেত্রে ইমাম বায়হাকী(র.) এর আলোচনা দেখে তিনি পূর্বের অবস্থান থেকে সরে আসেন। এবং পাঠকদেরকে অনুরোধ করেছেন আলোচ্য হাদিসকে যেন যঈফুল জামিʿ আস সগীর’ এর মাঝে তথা যঈফ বা দুর্বল হাদিসের সংকলনের মধ্যে অন্তর্ভুক করেন। 

 

তবে শায়খ আলবানী(র.) এটিও উল্লেখ করেছেন, মুহাদ্দিসদের অনেকে আলোচ্য হাদিসের ত্রুটির দিকে দৃষ্টি দেননি এবং একে ব্যাখ্যা করেছেন। যাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন ইমাম নববী(র.)

 

আলোচ্য হাদিসসমূহ প্রসঙ্গে মুহাদ্দিসদের ব্যাখ্যাঃ

আমরা উপরে শায়খ আলবানী(র.) এর আলোচনা উল্লেখ করলাম। তবে অধিকাংশ মুহাদ্দিস আলোচ্য হাদিসসমূহের কোনোটিকেই ত্রুটিপূর্ণ গণ্য করেননি বরং গ্রহণযোগ্য হিসেবে গণ্য করেছেন। তাঁরা আলোচ্য হাদিসমূহের ব্যাখ্যায় জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করেছেন। রাসিবি বর্ণিত হাদিসকে তাঁরা অন্য হাদিসের আলোকে ব্যাখ্যা করেছেন এবং এর তথ্যকে অন্য বর্ণনাসমূহের সাথে সাংঘর্ষিক বলে তাঁরা বিবেচনা করেননি।

 

 আলোচ্য হাদিসসমূহের ব্যাখ্যায় ইমাম নববী(র.) বলেনঃ

 

وَمَعْنَى هَذَا الْحَدِيثِ مَا جَاءَ فِي حَدِيثِ أَبِي هُرَيْرَةَ لِكُلِّ أَحَدٍ مَنْزِلٌ فِي الْجَنَّةِ وَمَنْزِلٌ فِي النَّارِ فَالْمُؤْمِنُ إِذَا دَخَلَ الْجَنَّةَ خَلَفَهُ الْكَافِرُ فِي النار لاستحقاقه ذلك بكفره ومعنى فَكَاكُكَ مِنَ النَّارِ أَنَّكَ كُنْتَ مُعَرَّضًا لِدُخُولِ النَّارِ وَهَذَا فَكَاكُكَ لِأَنَّ اللَّهَ تَعَالَى قَدَّرَ لَهَا عَدَدًا يَمْلَؤُهَا فَإِذَا دَخَلَهَا الْكُفَّارُ بِكُفْرِهِمْ وَذُنُوبِهِمْ صَارُوا فِي مَعْنَى الْفَكَاكِ لِلْمُسْلِمِينَ وَأَمَّا رواية يجيء يوم القيامة ناس من المسلمين بِذُنُوبٍ فَمَعْنَاهُ أَنَّ اللَّهَ تَعَالَى يَغْفِرُ تِلْكَ الذُّنُوبَ لِلْمُسْلِمِينَ وَيُسْقِطُهَا عَنْهُمْ وَيَضَعُ عَلَى الْيَهُودِ وَالنَّصَارَى مِثْلَهَا بِكُفْرِهِمْ وَذُنُوبِهِمْ فَيُدْخِلُهُمُ النَّارَ بِأَعْمَالِهِمْ لا بذنوب المسلمين ولا بدمن هَذَا التَّأْوِيلِ لِقَوْلِهِ تَعَالَى وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وزرأخرى وَقَوْلُهُ وَيَضَعُهَا مَجَازٌ وَالْمُرَادُ يَضَعُ عَلَيْهِمْ مِثْلَهَا بِذُنُوبِهِمْ كَمَا ذَكَرْنَاهُ لَكِنْ لَمَّا أَسْقَطَ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَنِ الْمُسْلِمِينَ سَيِّئَاتِهِمْ وَأَبْقَى عَلَى الْكُفَّارِ سَيِّئَاتِهِمْ صَارُوا فِي مَعْنَى مَنْ حَمَلَ إِثْمَ الْفَرِيقَيْنِ لِكَوْنِهِمْ حَمَلُوا الْإِثْمَ الْبَاقِي وَهُوَ إِثْمُهُمْ وَيُحْتَمَلُ أَنْ يَكُونَ الْمُرَادُ آثَامًا كَانَ لِلْكُفَّارِ سَبَبٌ فِيهَا بِأَنْ سَنُّوهَا فَتَسْقُطُ عَنِ الْمُسْلِمِينَ بِعَفْوِ اللَّهِ تَعَالَى وَيُوضَعُ عَلَى الْكُفَّارِ مِثْلُهَا لِكَوْنِهِمْ سَنُّوهَا وَمَنْ سَنَّ سُنَّةً سَيِّئَةً كَانَ عَلَيْهِ مِثْلُ وِزْرِ كُلِّ مَنْ يَعْمَلُ بِهَا

অর্থঃ “এই হাদিসের মর্মার্থ আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত সেই হাদিসের অনুরূপ, যেখানে বলা হয়েছেঃ "প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য জান্নাতে একটি স্থান এবং জাহান্নামে একটি স্থান রয়েছে।"  [14] মুমিন ব্যক্তি যখন জান্নাতে প্রবেশ করে, তখন কাফির ব্যক্তি তার কুফরীর কারণে প্রাপ্য হিসেবে জাহান্নামে মুমিনের স্থলাভিষিক্ত হয়।

আর 'জাহান্নাম থেকে তোমার মুক্তিপণ' কথাটির অর্থ হলো—তুমি জাহান্নামে প্রবেশের সম্মুখীন ছিলে, কিন্তু এটি তোমার মুক্তিপণ হিসেবে গণ্য হলো। কারণ আল্লাহ তাআলা জাহান্নাম পূর্ণ করার জন্য একটি সংখ্যা নির্ধারণ করে রেখেছেন। কাফিররা যখন তাদের কুফরী ও পাপের কারণে সেখানে প্রবেশ করবে, তখন তারা মুসলিমদের মুক্তিপণ হিসেবে গণ্য হবে।

আর যে রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে—'কিয়ামতের দিন কিছু মুসলিম পাহাড়সম গুনাহ নিয়ে উপস্থিত হবে', এর অর্থ হলোঃ আল্লাহ তা'আলা মুসলিমদের সেই গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেবেন এবং তাদের থেকে তা মিটিয়ে দেবেন। অন্যদিকে ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের তাদের কুফরী ও নিজেদের পাপের কারণে সমপরিমাণ গুনাহ দিয়ে তাদের আমল অনুযায়ী জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন; মুসলিমদের গুনাহের কারণে নয়।

আল্লাহ তা'আলার এই বাণীর কারণে এই ব্যাখ্যাটি করা অপরিহার্য যে—" কোন বহনকারী অন্যের [পাপের] বোঝা বইবে না" (সুরা ফাতিরঃ ১৮) আর হাদিসে "তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে" কথাটি রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হলো—তাদের নিজেদের পাপের কারণেই তাদের ওপর অনুরূপ বোঝা রাখা হবে, যা আমরা উল্লেখ করেছি। কিন্তু মহান আল্লাহ যখন মুসলিমদের থেকে তাদের গুনাহ মিটিয়ে দিলেন এবং কাফিরদের গুনাহ বহাল রাখলেন, তখন তারা (কাফিররা) এমন ব্যক্তির পর্যায়ভুক্ত হলো যে যেন উভয় দলের পাপ বহন করছে; কারণ তাদের ওপর অবশিষ্ট পাপের বোঝা রয়ে গেছে এবং তা হলো তাদের নিজেদেরই পাপ।

আর এটাও সম্ভব যে এখানে উদ্দেশ্য এমন গুনাহ, যার ক্ষেত্রে কাফিররাই কারণ ছিল—যেহেতু তারা সেগুলো চালু করেছিল। ফলে আল্লাহর ক্ষমাগুণে মুসলিমদের থেকে তা মিটিয়ে দেওয়া হবে এবং কাফিরদের ওপর অনুরূপ গুনাহ চাপানো হবে, কারণ তারাই এর পথপ্রদর্শক ছিল। আর যে ব্যক্তি কোনো মন্দ প্রথার প্রচলন করে, সে ঐ কাজ সম্পাদনকারী প্রত্যেকের সমপরিমাণ পাপের ভাগী হয়।[15]

 

আলোচ্য হাদিসসমূহের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবন হাজার আসকালানী(র.) বলেছেন,

 

يَحْتَمِلُ أَنْ يَكُونَ الْفِدَاءُ مَجَازًا عَمَّا يَدُلُّ عَلَيْهِ حَدِيثُ أَبِي هُرَيْرَةَ الْآتِي فِي أَوَاخِرِ بَابُ صِفَةِ الْجَنَّةِ وَالنَّارِ قَرِيبًا بِلَفْظِ: لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ أَحَدٌ إِلَّا أُرِيَ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ، لَوْ أَسَاءَ لِيَزْدَادَ شُكْرًا الْحَدِيثَ، وَفِيهِ فِي مُقَابِلِهِ لِيَكُونَ عَلَيْهِ حَسْرَةً فَيَكُونُ الْمُرَادُ بِالْفِدَاءِ إِنْزَالُ الْمُؤْمِنِ فِي مَقْعَدِ الْكَافِرِ مِنَ الْجَنَّةِ الَّذِي كَانَ أُعِدَّ لَهُ، وَإِنْزَالُ الْكَافِرِ فِي مَقْعَدِ الْمُؤْمِنِ الَّذِي كَانَ أُعِدَّ لَهُ، وَقَدْ يُلَاحَظُ فِي ذَلِكَ قَوْلُهُ تَعَالَى: ﴿وَتِلْكَ الْجَنَّةُ الَّتِي أُورِثْتُمُوهَا﴾

অর্থঃ “এটি সম্ভাব্য যে এখানে “ফিদা (মুক্তিপণ)” শব্দটি রূপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে—যার ইঙ্গিত পাওয়া যায় আবূ হুরাইরা (রা.)-এর সেই হাদিস থেকে, যা জান্নাত ও জাহান্নামের বিবরণ অধ্যায়ের শেষের দিকে এসেছে। হাদিসটির শব্দলিপিতে বলা হয়েছেঃ 'জান্নাতে প্রবেশকারী প্রত্যেক ব্যক্তিকে জাহান্নামে তার (সম্ভাব্য) স্থানটি দেখানো হবে যে, যদি সে পাপাচার করত তবে সেখানে তার স্থান হতো—যাতে তার শুকরিয়া বা কৃতজ্ঞতাবোধ আরও বৃদ্ধি পায়।' এবং এর বিপরীতে (কাফিরদের ক্ষেত্রেও) একই কথা বলা হয়েছে যাতে তাদের আফসোস বৃদ্ধি পায়।

সুতরাং, এখানে 'মুক্তিপণ' দ্বারা উদ্দেশ্য হলো—কাফিরের জন্য জান্নাতে যে স্থানটি বরাদ্দ রাখা হয়েছিল সেখানে মুমিনকে স্থান দেওয়া এবং মুমিনের জন্য জাহান্নামে যে (সম্ভাব্য) স্থানটি ছিল সেখানে কাফিরকে স্থান দেওয়া। এই আলোচনার প্রেক্ষাপটে আল্লাহ তাআলার এই বাণীটিও প্রণিধানযোগ্যঃ 'আর এই হলো সেই জান্নাত, যার উত্তরাধিকারী তোমাদের করা হয়েছে।' (সুরা আয-যুখরুফঃ ৭২)[16]

 

আলোচ্য হাদিসসমূহের ব্যাখ্যায় কাযি ইয়ায(র.) বলেছেন,

 

لَمَّا كَانَ لِكُلِّ مُكَلَّفٍ مَقْعَدٌ مِنَ الْجَنَّةِ وَمَقْعَدٌ مِنَ النَّارِ، فَمَنْ آمَنَ حَقَّ الْإِيمَانِ بُدِّلَ مَقْعَدُهُ مِنَ النَّارِ بِمَقْعَدٍ مِنَ الْجَنَّةِ، وَمَنْ لَمْ يُؤْمِنْ فَبِالْعَكْسِ كَانَتِ الْكَفَرَةُ كَالْخَلَفِ لِلْمُؤْمِنِينَ فِي مَقَاعِدِهِمْ مِنَ النَّارِ وَالنَّائِبِ مَنَابَهُمْ فِيهَا، وَأَيْضًا لَمَّا سَبَقَ الْقَسَمُ الْإِلَهِيُّ بِمَلْءِ جَهَنَّمَ كَانَ مَلْؤُهَا مِنَ الْكُفَّارِ خَلَاصًا لِلْمُؤْمِنِينَ وَنَجَاةً لَهُمْ مِنَ النَّارِ، فَهُمْ فِي ذَلِكَ لِلْمُؤْمِنِينَ كَالْفِدَاءِ وَالْفِكَاكِ، وَلَعَلَّ تَخْصِيصَ الْيَهُودِ وَالنَّصَارَى بِالذِّكْرِ ; لِاشْتِهَارِهِمَا بِمُضَادَّةِ الْمُسْلِمِينَ، وَمُقَابَلَتِهِمَا إِيَّاهُمْ فِي تَصْدِيقِ الرَّسُولِ الْمُقْتَضِي لِنَجَاتِهِمْ

অর্থঃ “যেহেতু প্রত্যেক মুকাল্লাফ (শরিয়তের বিধান পালনে দায়বদ্ধ) ব্যক্তির জন্য জান্নাতে একটি স্থান এবং জাহান্নামে একটি স্থান নির্ধারিত রয়েছে; তাই যে ব্যক্তি যথাযথভাবে ঈমান এনেছে, জাহান্নামে তার স্থানটিকে জান্নাতের স্থান দ্বারা পরিবর্তন করে দেওয়া হয়। আর যে ঈমান আনেনি, তার ক্ষেত্রে বিষয়টি এর উল্টো হয়। ফলে কাফিররা জাহান্নামের সেই স্থানগুলোতে মুমিনদের স্থলাভিষিক্ত বা প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য হয়।

আর যেহেতু জাহান্নামকে পূর্ণ করার ব্যাপারে যেহেতু আল্লাহর পূর্বনির্ধারিত শপথ রয়েছে, তাই কাফিরদের দ্বারা তা পূর্ণ করা মুমিনদের জন্য অগ্নি থেকে নিষ্কৃতি ও মুক্তির কারণ হয়। এই প্রেক্ষিতে তারা (কাফিররা) মুমিনদের জন্য মুক্তিপণ বা বিনিময় স্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়।

আর এই বর্ণনায় ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের বিশেষভাবে উল্লেখ করার সম্ভাব্য কারণ হলো মুসলিমদের বিরোধিতায় তাদের প্রসিদ্ধি এবং রাসুলুল্লাহ ()-এর নবুওয়াতকে সত্য বলে স্বীকার করার ক্ষেত্রে মুমিনদের বিপরীতে তাদের অবস্থান, অথচ রাসুলকে () সত্যায়ন করাই ছিল তাদের নাজাতের পূর্বশর্ত।[17]

 

উপসংহারঃ

১। আল কুরআনের সুস্পষ্ট মূলনীতির আলোকে এটি প্রতিষ্ঠিত যে - কেউ অন্য কারো পাপের ভার বহন করবে না। প্রত্যেকেই শুধুমাত্র নিজ কর্মের জন্য দায়ী হবে। 

২। যে হাদিসটিতে উল্লেখ আছে মুসলিমদের পাপ ইহুদি-খ্রিষ্টানদের উপর চড়িয়ে দেয়া হবে, কোনো কোনো মুহাদ্দিসের মতে সেটি শায হাদিস। অন্য বিশুদ্ধ দলিলের বিপরীতে সেটি থেকে দলিল গ্রহণ করা হবে না। অন্যান্য মুহাদ্দিসগণ হাদিসটিকে রূপক অর্থে ব্যাখ্যা করেছেন এবং আক্ষরিকভাবেই মুসলিমদের পাপ ইহুদি-খ্রিষ্টানদের উপর চাপানো হবে এমন অর্থ নেননি।

৩। প্রত্যেক মানুষের জন্যই জান্নাত ও জাহান্নামে ২টি করে নির্ধারিত স্থান রয়েছে। মুসলিমরা যখন গুনাহ থেকে ক্ষমা লাভ করে জান্নাতে দাখিল হবে এবং ইহুদি-খ্রিষ্টানরা যখন নিজ আমলের জন্য জাহান্নামে স্থান পাবে, তারা ঠিক যেন মুসলিমদের জন্য মুক্তিপণের মতো হবে আর মুসলিমরা ঠিক যেন জান্নাতে তাদের স্থালাভিষিক্ত হবে।

৪। আলোচ্য হাদিসমূহে ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের কথা উল্লেখের কারণ হল তাদের দ্বারা ইসলাম ও মুসলিমদের বিরোধিতা এবং মুহাম্মাদ () এর নবুয়ত অস্বীকার করার গুনাহ। নিজ গুনাহের কারণেই তারা নাজাত থেকে বঞ্চিত হবে।

৫। দ্বীন ইসলামে অন্যায়ভাবে একের পাপ অন্যের উপর চাপানোর কোনো বিষয় নেই, কুরআন এবং বিশুদ্ধ হাদিস পরস্পর সাংঘর্ষিক নয় এবং ইসলামে ইহুদি-খ্রিষ্টানদের বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে কোনো বিদ্বেষ পোষণ করা হয়নি।

 

 

তথ্যসূত্রঃ


[1] সহীহ মুসলিম, হাদিস নং : ৬৭৫৫

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=19078

[2] সহীহ মুসলিম, হাদিস নং : ৬৭৫৬

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=19079

[3] সহীহ মুসলিম, হাদিস নং : ৬৭৫৮

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=19081

[4] আল কুরআন, আন’আম ৬ : ১৬৪

[5] আল কুরআন, বনী ইস্রাঈল ১৭ : ১৫

[6] আল কুরআন, ফাতির ৩৫ : ১৮

[7] আল কুরআন, নাজম ৫৩ : ৩৮-৩৯

[8] শায হাদিস কী, এই প্রসঙ্গে সানাউল্লাহ নজির আহমদ রচিত 'হাদিস শাস্ত্রের পরিভাষা পরিচিতি' গ্রন্থ থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করা হচ্ছে –

““আর যেখানে সেকাহ রাবি বৃহৎ সংখ্যক রাবির বিরোধিতা করে তাই শায। ...

শায হাদিসঃ
 
شاذ শব্দটি شذوذ থেকে গৃহীত, যার অর্থ একাকী, বিচ্ছিন্ন, দলছুট ও নীতি মুক্ত। ... একাধিক সেকাহ রাবির বিপরীত একজন সেকাহ রাবির বর্ণনাকে শায বলা হয়

...

মুসলিমের হাদিসে  لَا يَرْقُونَ  শব্দের বৃদ্ধির শাযঃ

قال الإمام مسلم –رحمه الله- حَدَّثَنَا سَعِيدُ بْنُ مَنْصُورٍ، حَدَّثَنَا هُشَيْمٌ، أَخْبَرَنَا حُصَيْنُ بْنُ عَبْدِ الرَّحْمَنِ، قَالَ: " كُنْتُ عِنْدَ سَعِيدِ بْنِ جُبَيْرٍ، فَقَالَ: ... ... وَلَكِنْ حَدَّثَنَا ابْنُ عَبَّاسٍ، عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: « ... ... هُمُ الَّذِينَ لَا يَرْقُونَ، وَلَا يَسْتَرْقُونَ، وَلَا يَتَطَيَّرُونَ، وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ»

... ... তবে আব্দুল্লাহ ইব্‌ন আব্বাস নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে আমাদেরকে বলেন, তিনি বলেছেন: “তারাই, যারা ঝাড়-ফুঁক করে না, ঝাড়-ফুঁক তলব করে না, কুলক্ষণ গ্রহণ করে না এবং তাদের রবের উপর তারা তাওয়াক্কুল করে”। [মুসলিম: (২২১)]

 

قال الإمام البخاري –رحمه الله- حَدَّثَنِي إِسْحَاقُ، حَدَّثَنَا رَوْحُ بْنُ عُبَادَةَ، حَدَّثَنَا شُعْبَةُ، قَالَ: سَمِعْتُ حُصَيْنَ بْنَ عَبْدِ الرَّحْمَنِ قَالَ: كُنْتُ قَاعِدًا عِنْدَ سَعِيدِ بْنِ جُبَيْرٍ، فَقَالَ: عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ: أَنّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «يَدْخُلُ الْجَنَّةَ مِنْ أُمَّتِي سَبْعُونَ أَلْفًا بِغَيْرِ حِسَابٍ، هُمُ الَّذِينَ لَا يَسْتَرْقُونَ، وَلَا يَتَطَيَّرُونَ، وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ»

... ... আব্দুল্লাহ ইব্‌ন আব্বাস থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “আমার উম্মত থেকে শত্তুর হাজার বিনা হিসেবে জান্নাতে প্রবেশ করবে; যারা ঝাড়-ফুঁক তলব করে না, কুলক্ষণ গ্রহণ করে না এবং তাদের রবের উপর তারা তাওয়াক্কুল করে”। [বুখারি: (৬৪৭২)]

 

আমাদের সামনে ইমাম মুসলিম ও বুখারির দু’টি সনদে একটি হাদিস বিদ্যমান। মুসলিমের সনদে لَا يَرْقُونَ রয়েছে, যা ইমাম বুখারির সনদে নেই। উভয় ইব্‌ন আব্বাস সূত্রে বর্ণনা করেছেন, তাই হাদিস এক। ইব্‌ন আব্বাস (মৃ.৬৮হি.); এর ছাত্র সা‘ঈদ ইব্‌ন জুবায়ের (মৃ.৯৫হি.); তার ছাত্র হুসাইন ইব্‌নে আব্দুর রহমান (মৃ.১৩৬হি.); তার ছাত্র দু’জন: শু‘বা (মৃ.১৬০হি.) ও হুশাইম (মৃ.১৮৩হি.) থেকে বুখারি ও মুসলিমের সনদ ভাগ হয়েছে। শু‘বার ছাত্র রাওহু ইব্‌নু উবাদাহ (মৃ২০৫হি.), তার ছাত্র ইসহাক (মৃ২৫১হি.), তার ছাত্র ইমাম বুখারি (মৃ.২৫৬হি.)। আর হুশাইমের ছাত্র সা‘ঈদ ইব্‌ন মানসুর (মৃ.২২৭হি.); তার ছাত্র ইমাম মুসলিম (মৃ.২৬১হি.)।

 

হাদিসটি ইমাম বুখারি নিয়েছেন হুসাইনের ছাত্র শু‘বা থেকে, ইমাম মুসলিম নিয়েছেন হুসাইনের ছাত্র হুশাইম থেকে। হুশাইমের হাদিসে لَا يَرْقُونَ রয়েছে, শু‘বার হাদিসে যা নেই। যদিও উভয়ই সেকাহ [‘শু‘বা’ সম্পর্কে হাফেজ ইব্‌ন হাজার রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন: “সেকাহ, হাফেযে হাদিস ও ইবাদত গুজার, ইরাকে সর্বপ্রথম তিনি রাবিদের ভালো-মন্দ যাচাই আরম্ভ করেন এবং সুন্নত থেকে মিথ্যা দূরীভূত করেন”। ‘হুশাইম’ সম্পর্কে তিনি বলেন: “সেকাহ, হাদিসের সুদৃঢ় ইমাম, অধিক তাদলিস ও সূক্ষ্ম ইরসালে অভ্যস্ত। তিনি হাদিসের ইমাম, তার আদালত সম্পর্কে সবাই একমত, তবে তার তাদলিস প্রসিদ্ধ ছিল। সকল ইমাম তাকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করেছেন”। দেখুন: তাহযিবুত তাহযীব, লি ইব্‌ন হাজার রহ.।],

তবে হুশাইম অপেক্ষা শু‘বা অধিক সেকাহ, তাই শু‘বার হাদিস মাহফুয ও হুশাইমের বৃদ্ধি শায। দ্বিতীয়ত শু‘বার স্বপক্ষে শাহেদ ও মুতাবি‘ রয়েছে, যা হুশাইমের পক্ষে নেই।

[অধিকন্তু ইমাম বুখারি রহ. হুসাইন ইব্‌ন আব্দুর রহমানের দু’জন ছাত্র: হুশাইম এবং মুহাম্মদ ইব্‌ন ফুদাইল সূত্রে এ হাদিস বর্ণনা করেছেন, তাতে  لَا يَرْقُونَ  শব্দের বৃদ্ধি নেই। বুখারি: (৬৫৪১); অনুরূপ ইমাম মুসলিম সাহাবি ‘ইমরান ইব্‌ন হুসাইন থেকে এ হাদিস বর্ণনা করেছেন তাতে  لَا يَرْقُونَ  শব্দের বৃদ্ধি নেই। অতএব শাহেদ ও মুতাবি‘ থাকার ফলে শু‘বার হাদিস আরো শক্তিশালী। দেখুন: মুসলিম: (২২০) ও (২২১)]

অতএব হুশাইমের  لَا يَرْقُونَ  বৃদ্ধি গ্রহণযোগ্য নয়।

 

শায়খুল ইসলাম ইব্‌নে তাইমিয়াহ রাহিমাহুল্লাহ্ বলেন:  لَا يَرْقُونَ  বৃদ্ধি শায, কারণ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও জিবরীল ‘আলাইহিস সালাম ঝাড়ফুঁক করেছেন, অতএব মতনের এ বাক্য হাদিস হতে পারে না।

...

এক হাদিস অপর হাদিসের কারণে শায হয়ঃ

শাযের জন্য এক হাদিস হওয়া জরুরি নয়, কখনো ভিন্ন দু’টি হাদিস একটির কারণে অপরটি শায হয়, যেমন: ‌

 

قال الإمام أبو داود -رحمه الله- حَدَّثَنَا قُتَيْبَةُ بْنُ سَعِيدٍ، حَدَّثَنَا عَبْدُ الْعَزِيزِ بْنُ مُحَمَّدٍ، قَالَ: قَدِمَ عَبَّادُ بْنُ كَثِيرٍ الْمَدِينَةَ، فَمَالَ إِلَى مَجْلِسِ الْعَلَاءِ فَأَخَذَ بِيَدِهِ فَأَقَامَهُ، ثُمَّ قَالَ: اللَّهُمَّ إِنَّ هَذَا يُحَدِّثُ عَنْ أَبِيهِ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «إِذَا انْتَصَفَ شَعْبَانُ، فَلَا تَصُومُوا»

“... ... আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: যখন শাবানের অর্ধেক হয়, তোমরা সিয়াম রেখ না”।[আবু দাউদ: (২৩৩৭)] আবু দাউদসহ অন্যান্য সুনান গ্রন্থকারগণ হাদিসটি বর্ণনা করেছেন। অনেকের নিকট হাদিসটি সহি, তাই তারা শাবানের শেষার্ধে সিয়াম রাখা মাকরুহ বলেন, তবে যার সিয়াম রাখার অভ্যাস আছে তার পক্ষে মাকরুহ নয়।

 

ইমাম আহমদ রাহিমাহুল্লাহ্ বলেছেন: “হাদিসটি শায, কারণ অন্যান্য সহি হাদিস তার পরিপন্থী, তাই সিয়াম রাখা মাকরুহ নয়তিনি বর্ণনা করেন:

 

حَدَّثَنَا وَكِيعٌ، حَدَّثَنَا عَلِيُّ بْنُ الْمُبَارَكِ، عَنْ يَحْيَى بْنِ أَبِي كَثِيرٍ، عَنِ أَبِي سَلَمَةَ، عَنِ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَا تَقَدَّمُوا شَهْرَ رَمَضَانَ بِصِيَامِ يَوْمٍ أَوْ يَوْمَيْنِ، إِلَّا رَجُلًا كَانَ يَصُومُ صَوْمًا فَلْيَصُمْهُ»

তোমরা এক দিন অথবা দু’দিনের সিয়াম দ্বারা রমযানকে এগিয়ে এনো না, তবে যে পূর্ব থেকে সিয়াম রাখত, সে যেন তাতে সিয়াম রাখে”। [আহমদ: (৯৮২৮)]

 

এ হাদিস অধিক সহি তাই মাহফুয, যা প্রমাণ করে রমযানের দু’দিন পূর্বে, তথা শাবানের শেষার্ধে সিয়াম রাখা বৈধ। হাদিস দু’টি আলাদা, তবু আহলে ইলম অধিকতর সহি হাদিসের কারণে অপেক্ষাকৃত কম সহি হাদিসকে শায বলেছেন। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, শাযের জন্য এক হাদিস হওয়া জরুরি নয়।

 

এ ছাড়া অন্যান্য সহি হাদিসও প্রমাণ করে শাবানের শেষার্ধে সিয়াম রাখা বৈধ, যেমন ইমাম বুখারি ও মুসলিম বর্ণনা করেন:

 

«لَا يَتَقَدَّمَنَّ أَحَدُكُمْ رَمَضَانَ بِصَوْمِ يَوْمٍ أَوْ يَوْمَيْنِ، إِلَّا أَنْ يَكُونَ رَجُلٌ كَانَ يَصُومُ صَوْمَهُ فَلْيَصُمْ ذَلِكَ الْيَوْمَ»

তোমাদের কেউ রমযানকে একদিন বা দু’দিনের সিয়াম দ্বারা এগিয়ে আনবে না, তবে যে নিজের সিয়াম পালন করত, সে যেন ঐ দিন সিয়াম রাখে”। [বুখারি: (১৯১৪), মুসলিম: (১০৮২)]

 

এ হাদিস প্রমাণ করে সিয়ামে অভ্যস্ত ব্যক্তির জন্য শাবানের শেষার্ধে সিয়াম পালন করা বৈধ, যেমন কোনো ব্যক্তির অভ্যাস সোম ও বৃহস্পতিবার সিয়াম পালন করা, অথবা একদিন সিয়াম রাখা ও একদিন ইফতার করা, তার জন্য রমযানের এক-দু’ দিন পূর্বে সিয়াম রাখা দোষণীয় নয়, যা يوم الشك বা সন্দেহের দিন নামে পরিচিত। এ দিন ব্যতীত শাবানের শেষার্ধে কারো জন্য সিয়াম রাখা দোষণীয় নয়।”

দেখুনঃ ‘হাদিস শাস্ত্রের পরিভাষা পরিচিতি - সানাউল্লাহ নজির আহমদ পৃষ্ঠা ২৩২-২৫৩

https://www.hadithbd.com/books/detail/?book=41&section=789

শায হাদিস সম্পর্কে আরো জানতে দেখুনঃ

হাদীসের পরিভাষা’ - মুহাম্মাদ আত তাহহান, পৃষ্ঠা ১০৭-১০৯

'হাদীস-শাস্ত্রের পারিভাষিক জ্ঞান' - আব্দুল হামীদ ফাইযী মাদানী, পৃষ্ঠা ৫৯-৬০]

[9] দেখুনঃ 'হাদীস-শাস্ত্রের পারিভাষিক জ্ঞান' - আব্দুল হামীদ ফাইযী মাদানী, পৃষ্ঠা ৬০

[10] সিলসিলাতুল আহাদিছিদ দ'ঈফাতি ওয়াল মাওদু’আতি ওয়া আছারুহাস সাইয়িউ ফিল উম্মাহ - নাসিরুদ্দিন আলবানী, খণ্ড ১১, পৃষ্ঠা ৬৬৫-৬৬৬

https://shamela.ws/book/12762/7522

https://shamela.ws/book/12762/7523 

[11] সিলসিলাতুল আহাদিছিদ দ'ঈফাতি ওয়াল মাওদু’আতি ওয়া আছারুহাস সাইয়িউ ফিল উম্মাহ - নাসিরুদ্দিন আলবানী, খণ্ড ১১, পৃষ্ঠা ৬৬৭-৬৬৮

https://shamela.ws/book/12762/7524

https://shamela.ws/book/12762/7525  

[12] সিলসিলাতুল আহাদিছিদ দ'ঈফাতি ওয়াল মাওদু’আতি ওয়া আছারুহাস সাইয়িউ ফিল উম্মাহ - নাসিরুদ্দিন আলবানী, খণ্ড ১১, পৃষ্ঠা ৬৬৮

https://shamela.ws/book/12762/7525  

[13] আলোচ্য হাদিস প্রসঙ্গে শায়খ আলবানী(.) এর আলোচনা দেখা যেতে পারে ‘সিলসিলা আহাদিছ আদ দ’ইফাহ’ এর বাংলা অনুবাদ ‘য’ঈফ ও জাল হাদীস সিরিজ’, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪০৬-৪০৮ এ।

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=72195

[14] সম্পূর্ণ হাদিসটি নিম্নরূপঃ

عَنْ أَبِي صَالِحٍ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ ‏"‏ مَا مِنْكُمْ مِنْ أَحَدٍ إِلاَّ لَهُ مَنْزِلاَنِ مَنْزِلٌ فِي الْجَنَّةِ وَمَنْزِلٌ فِي النَّارِ فَإِذَا مَاتَ فَدَخَلَ النَّارَ وَرِثَ أَهْلُ الْجَنَّةِ مَنْزِلَهُ فَذَلِكَ قَوْلُهُ تَعَالَى ‏(أُولَئِكَ هُمُ الْوَارِثُونَ )‏ ‏"‏ ‏.

অর্থঃ আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ বলেছেনঃ তোমাদের প্রত্যেকের জন্য দু’টি করে আবাস রয়েছে। একটি আবাস জান্নাতে এবং একটি জাহান্নামে। অতএব কোন ব্যক্তি মারা যাওয়ার পর জাহান্নামে প্রবেশ করলে তার জান্নাতের আবাস জান্নাতীরা ওয়ারিসী সূত্রে লাভ করবে। এটাই হলো আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণীর তাৎপর্য (অনুবাদঃ ’’তারাই হবে ওয়ারিস’’ (সূরা মুমিনূনঃ ১০)।

সুনান ইবনু মাজাহ, হাদিস নং : ৪৩৪১

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=45306

[15] শারহ মুসলিমইয়াহইয়া বিন শারাফ আন নববী, খণ্ড ১৭, পৃষ্ঠা ৮৫

https://shamela.ws/book/1711/3802

[16] ফাতহুল বারীইবন হাজার আসকালানী, খণ্ড ১১, পৃষ্ঠা ৩৯৮

https://shamela.ws/book/1673/6770

[17] মিরকাতুল মাফাতিহ মোল্লা আলি ক্বারী, খণ্ড ৮, পৃষ্ঠা ৩৫২৫

https://shamela.ws/book/8176/7689

সোশ্যাল লিঙ্ক ও অ্যাপ

সর্বাধিক পঠিত

সর্বশেষ পোস্টসমূহ