সূচিপত্র
1. হাদিস বনাম বিজ্ঞান: সম্ভাব্য সংঘাত?
2. হাদিস ব্যাখ্যার কিছু মূলনীতি
a. মূলনীতি ১ – হাদিসের প্রকৃত বক্তব্য জানতে হলে এর সমস্ত রিওয়ায়াত বা বর্ণনা একসাথে বিবেচনা করতে হবে
b. মূলনীতি ২ – হাদিসে উল্লিখিত কোন শব্দের একাধিক অর্থ থাকলে, অন্যান্য অর্থও বিবেচনা করতে হবে
c. মূলনীতি ৩ – হাদিসে উল্লিখিত বক্তব্য কি আসলেই ওহী থেকে এসেছে, নাকি সেটা নবীর ব্যক্তিগত মতামত, সেটা নির্ণয় করতে হবে
3. তিন মূলনীতির আলোকে হাদিসের পর্যালোচনা
a. আলোচ্য হাদিসের বক্তব্য
b. প্রথম মূলনীতির প্রয়োগ — অন্যান্য রিওয়ায়াত
c. দ্বিতীয় মূলনীতির প্রয়োগ – سَبَقَ শব্দের অর্থ
d. তৃতীয় মূলনীতির প্রয়োগ – এই হাদিসের বক্তব্য দুনিয়াবি জ্ঞান নয়
4. বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা: বাবা-মায়ের সাথে সন্তানের সাদৃশ্য কীভাবে ধার্য হয়?
5. হাদিস বনাম বিজ্ঞান: সংঘাত নাকি সামঞ্জস্য?
6. পিতামাতার সাথে সন্তানের সাদৃশ্য বিষয়ক আরেকটি হাদিস
a. দ্বিতীয় হাদিসের বক্তব্য
b. হাদিসের বিশ্লেষণ ও তিনটি মূলনীতির প্রয়োগ
7. উপসংহার
১। হাদিস বনাম বিজ্ঞান: সম্ভাব্য সংঘাত?
সহিহ মুসলিমের একটা হাদিসের সাথে অনেকে বৈজ্ঞানিক বাস্তবতার সংঘর্ষ খুঁজে পান। হাদিসটির প্রাসঙ্গিক অংশ এরকম—
===
فَإِذَا اجْتَمَعَا فَعَلاَ مَنِيُّ الرَّجُلِ مَنِيَّ الْمَرْأَةِ أَذْكَرَا بِإِذْنِ اللَّهِ وَإِذَا عَلاَ مَنِيُّ الْمَرْأَةِ مَنِيَّ الرَّجُلِ آنَثَا بِإِذْنِ اللَّهِ
অনুবাদঃ "(নারী ও পুরুষের) মিলনের সময় পুরুষের পানি যদি নারীর পানির ওপর ক্ষমতাশীল হয়, তাহলে আল্লাহর ইচ্ছায় সন্তান ছেলে হয়। আর যদি নারীর পানি পুরুষের পানির ওপর ক্ষমতাশীল হয়, তাহলে আল্লাহর ইচ্ছায় সন্তান হয় মেয়ে।" [1]
===
অধিকাংশ বাংলা অনুবাদে এই হাদিসে ‘বীর্য’ বলে অনুবাদ করা হয়েছে, যদিও মূল আরবিতে ‘পানি’র কথা আছে। মূল হাদিসে ব্যবহৃত শব্দটি ماء, যার আক্ষরিক অর্থ পানি; কিন্তু প্রেক্ষিত থেকে বোঝা যাচ্ছে এখানে জনন উপাদানের কথা বোঝানো হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সামনে বিস্তারিত আলোচনা থাকছে।
হাদিসটি যেহেতু সহিহ মুসলিমে এসেছে, কাজেই সাধারণভাবে বলা যায় এই বক্তব্য জাল বা দুর্বল হবার সম্ভাবনা নেই। অন্যদিকে, এই হাদিসের বক্তব্য আপাতদৃষ্টিতে বিজ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক মনে হয়। আজ আমরা জানি, সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণের জন্য মূলত বাবার জনন উপাদান দায়ী। সন্তান জন্ম হয় শুক্রাণু এবং ডিম্বাণুর মিলনের মাধ্যমে—শুক্রাণু আসে বাবার কাছ থেকে, ডিম্বাণু মায়ের কাছ থেকে। এই শুক্রাণুতে যদি এক্স-ক্রোমোজোম থাকে, তাহলে সন্তান হয় মেয়ে। অন্যদিকে শুক্রাণুতে ওয়াই-ক্রোমোজোম থাকলে সন্তান হয় ছেলে। অর্থাৎ বাবার শুক্রাণুতে কোন ক্রোমোজোম আছে—এক্স নাকি ওয়াই—তার ভিত্তিতেই সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারিত হয় (চিত্র ১)। [2]
চিত্র ১ – মানুষের এক্স-ওয়াই ক্রোমোজোমের মাধ্যমে লিঙ্গ নির্ধারণ প্রক্রিয়া।
জাইগোট = শুক্রাণু আর ডিম্বাণুর মিলনের ফলে যে কোষ তৈরি হয়।
ইসলামের আক্বিদা বা বিশ্বাস অনুসারে, ওহী থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান এবং বাস্তবতা সম্পর্কে শক্ত প্রমাণসিদ্ধ তথ্য—এই দুই ধরণের জ্ঞানের মধ্যে কোন সংঘাত থাকতে পারে না। ত্রয়োদশ খ্রিষ্টাব্দের প্রবাদপ্রতিম ইসলামী শাস্ত্রবিদ ইবন তাইমিয়া (র.) বলেছেন, জগত সম্পর্কে যুক্তিপ্রমাণ এবং অনুসন্ধানের ভিত্তিতে আমরা যে জ্ঞান (‘আক্বল) অর্জন করি, সেই জ্ঞানও আল্লাহরই দেওয়া—কাজেই এর সাথে আল্লাহপ্রদত্ত ওহীর সংঘর্ষ থাকা অসম্ভব। [3] কিন্তু ওপরের উদাহরণটাতে সহিহ হাদিসের সাথে প্রমাণসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক বাস্তবতার একটা আপাত সংঘাত দেখা যাচ্ছে।
এই লেখায় আমরা দেখব, হাদিসশাস্ত্রের কিছু প্রাথমিক, সার্বজনীন মূলনীতি ব্যবহার করেই কীভাবে এ ধরণের সংঘাত নিরসন করা যায়। এই আলোচনার মাধ্যমে শুধু এই একটা হাদিসই নয়, বরং যেকোনো হাদিসের সাথেই আপাতভাবে বিজ্ঞানের সংঘাত দেখা গেলে কীভাবে তার সমাধান করা সম্ভব, তার একটা বিস্তারিত রোডম্যাপ পাওয়া যাবে। [4]
২। হাদিস ব্যাখ্যার কিছু মূলনীতি
মূল আলোচনায় ঢোকার আগে আমাদের হাদিস ব্যাখ্যার কয়েকটি মূলনীতির সাথে পরিচিত হতে হবে। এই মূলনীতিগুলো বহু প্রাচীন, আধুনিক বিজ্ঞানের আবির্ভাবের অনেক আগেই হাদিস শাস্ত্রবিদেরা এগুলো দাখিল করে গেছেন। এই মূলনীতিগুলো প্রয়োগ না করলে হাদিসের সঠিক বক্তব্যে আমরা পৌঁছতেই পারব না, কাজেই তার আগে এর সাথে বিজ্ঞানের সংঘাত আছে কিনা, সেই আলোচনা অনর্থক।
চলুন আমরা এই মূলনীতিগুলোর সাথে এক এক করে পরিচত হই।
মূলনীতি ১ – হাদিসের প্রকৃত বক্তব্য জানতে হলে এর সমস্ত রিওয়ায়াত বা বর্ণনা একসাথে বিবেচনা করতে হবে
হাদিস হল রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এর কোন কথা, কাজ বা মৌন সম্মতির বর্ণনা; কিন্তু একই ঘটনার বর্ণনা একেক সাহাবী একেকভাবে করতে পারেন। স্বাভাবিকভাবেই, কোন ঘটনার একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী থাকলে সব প্রত্যক্ষদর্শী ঘটনার হুবহু একইরকম বর্ণনা দেবেন না। এজন্যই একই হাদিসে উল্লিখিত ঘটনারও একাধিক বর্ণনা বা “রিওয়ায়াত” থাকে, এবং রিওয়ায়াতগুলোর মধ্যে শব্দের কিছু পার্থক্য থাকতে পারে।
এটাই হচ্ছে কুর'আন ও হাদিস সংরক্ষণের একটা মূল পার্থক্য। কুর'আনের আয়াতগুলো সাহাবীরা (রা.) অক্ষরে অক্ষরে মুখস্থ করে বর্ণনা করতেন। অন্যদিকে হাদিসের ক্ষেত্রে অনেক সময় রাসুলুল্লাহর (ﷺ) বক্তব্য তারা একদম আক্ষরিকভাবে হুবহু মুখস্থ আবৃত্তি না করে শুধু কথার অর্থটা বর্ণনা করতেন। এইজন্যই একই ঘটনার বিভিন্ন বর্ণনায় শব্দচয়নের কিছু পার্থক্য দেখা যায়। সেক্ষেত্রে যেকোনো হাদিসের প্রকৃত বক্তব্য জানার জন্য আমাদের এর প্রত্যেকটা বর্ণনা বা রিওয়ায়াত বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে।
এই মূলনীতির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মুফতি মুনতাসির জামান লিখেছেন –
===
"হাদিসের বর্ণনাপদ্ধতি জটিল, কারণ প্রায়সময়ই একই হাদিস একাধিক সূত্রে কয়েক প্রজন্ম জুড়ে বর্ণিত হয়ে থাকে। এর ফলে একই হাদিসের বিভিন্ন বর্ণনায় শব্দের ভিন্নতা দেখা যায়। এজন্যই হাদিসের প্রত্যেকটা বর্ণনা বা রিওয়ায়াত আলাদা আলাদাভাবে বিশ্লেষণের মাধ্যমে এর “’আসল” বা প্রকৃত বক্তব্য উদঘাটন করতে হবে। বসরার মুহাদ্দিস ইবনুল মাদানি বলেছেন, হাদিসের বর্ণনায় কোন উহ্য ভুল (hidden defect) থাকলে সেটা বের করার জন্য এ ধরণের বিশ্লেষণ অপরিহার্য। একইভাবে ইবনুল কায়্যিমের মতে, হাদিসের বিভিন্ন বর্ণনার বক্তব্যের সংঘাত থাকলে ক্ষেত্রবিশেষে মেনে নিতে হবে, কোন একটা রিওয়ায়াতে বর্ণনাকারী ভুল করেছেন। সেটা না করে জোরপূর্বক প্রত্যেকটা রিওয়ায়াতের শব্দকেই একইসাথে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা করা অনুচিত।" [5]
===
কাজেই যেকোনো হাদিস বিশ্লেষণের আগে আমাদের জানতে হবে এটা কতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, সেই রিওয়ায়াতগুলোতে কী ধরণের পার্থক্য রয়েছে, এবং সবচেয়ে শক্তিশালী বা প্রসিদ্ধ রিওয়ায়াত কোনটি। এর মাধ্যমেই আমরা হাদিসের প্রকৃত বক্তব্য জানতে পারব। এই প্রক্রিয়াকে ইসলামী শাস্ত্রের পরিভাষায় বলা হয় তারজিহ। [6]
এক্ষেত্রে প্রশ্ন আসতে পারে, একাধিক বর্ণনা বা রিওয়ায়াতে একেক বক্তব্য থাকলে কোন শব্দচয়নটি ঠিক, সেটা বোঝার উপায় কী? সংক্ষেপে, এর জন্য আমাদের প্রত্যেক রিওয়ায়াতের ইসনাদ বা বর্ণনার পরম্পরা বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। এই লেখার পরবর্তী অংশে এই প্রক্রিয়ার একটা হাতেকলমে উদাহরণ দেখানো হয়েছে।
মূলনীতি ২ – হাদিসে উল্লিখিত কোন শব্দের একাধিক অর্থ থাকলে, অন্যান্য অর্থও বিবেচনা করতে হবে
হাদিসের সঠিক বর্ণনা বা রিওয়ায়াত সনাক্ত করার পরেও প্রশ্ন থেকে যায়, এর অনুবাদ আমরা যথাযথভাবে করছি কিনা। অন্য সব ভাষার মত আরবিতেও একই শব্দের একাধিক অর্থ থাকতে পারে, কাজেই হাদিস ব্যাখ্যার সময় গ্রহণযোগ্য সব অর্থই বিবেচনা করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে হাদিসের যথেচ্ছ ব্যাখ্যা করা চলবে না—শব্দের যে অর্থ করা হচ্ছে, প্রাচীন আরবি অভিধান অথবা কুর’আন-হাদিস-তাফসিরগ্রন্থে সেই অর্থটার উল্লেখ থাকতে হবে।
এভাবে হাদিসের কোন শব্দের অন্য ব্যাখ্যা বের করার প্রক্রিয়াকে ইসলামী শাস্ত্রে বলা হয় জাম’। [7] এই লেখার আলোচ্য হাদিসের ক্ষেত্রেই আমরা এই প্রক্রিয়ার একটা উদাহরণ দেখব।
মূলনীতি ৩ – হাদিসে উল্লিখিত বক্তব্য কি আসলেই ওহী থেকে এসেছে, নাকি সেটা নবীর ব্যক্তিগত মতামত, সেটা নির্ণয় করতে হবে
এই মূলনীতিটা একটু বিস্তারিত আলোচনার দাবি রাখে।
মদিনার মানুষ খেজুর গাছ পরাগায়ন করত। রাসুলুল্লাহ (ﷺ) ব্যাপারটা সম্পর্কে জানতে পেরে বলেছিলেন—আমার মনে হয় এটা তোমরা না করলেই ভাল হয়।
তাঁর এই কথা শুনে ঐ বছর মদিনার মানুষ আর পরাগায়ন করল না, ফলে খেজুরের ফলন ভালো হল না। এই ঘটনা আল্লাহর রাসূলকে বলার পর তিনি বললেন—
===
"আমি একজন মানুষ। দ্বীনের ব্যাপারে যখন তোমাদের আমি কোন নির্দেশ দেই তোমরা তখন তা পালন করবে, আর যখন কোন কথা আমি আমার নিজস্ব মতামত বা ধ্যান-ধারণা থেকে বলি—তখন বুঝতে হবে আমি কেবলই একজন মানুষ।" [8]
===
মুসলিম হিসেবে আমরা বিশ্বাস করি, আল্লাহর রাসূল (ﷺ) যখন দ্বীন, শরীয়ত বা গায়েবি ব্যাপারে কথা বলতেন, তাঁর সেই জ্ঞান ছিল আল্লাহ থেকে ওহী মারফত প্রাপ্ত এবং সেখানে কোন ভুল থাকার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু ওপরের এই খেজুর গাছের পরাগায়ন বিষয়ক ঘটনা এবং তাঁর জীবনের আরও বহু ঘটনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, পার্থিব বা দুনিয়াবি ব্যাপারে আল্লাহর রাসূলের (ﷺ) বক্তব্য ছিল একজন মানুষ হিসেবে তাঁর মতামত, এবং সেটা সবক্ষেত্রে ভুলের উর্ধ্বে নয়। কেননা তিনি গায়েবের জ্ঞান রাখতেন না। একমাত্র আল্লাহই গায়েবের জ্ঞান রাখেন।
এই বিষয়টি ইসলামী শাস্ত্রে ব্যাপকভাবে আলোচিত। ইসলামের ইতিহাসের হাদিসের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাকারীদের একজন ইমাম নববী (র.) তাঁর মুসলিম শরিফের ব্যাখ্যাগ্রন্থে উল্লেখ করেছেন—
===
“[খেজুরের পরাগায়ন সংক্রান্ত] এই হাদিস এবং এর বিভিন্ন বর্ণনায় নবী (ﷺ) শরীয়তের একটা গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেটা হল, দুনিয়াবি বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের জানাশোনা কিছু ক্ষেত্রে তাঁর তুলনায় বেশি থাকতে পারে। কাজেই স্রেফ দুনিয়াবি জ্ঞানের ব্যাপারে তাঁর মতামত গ্রহণ করার কোন বাধ্যবাধকতা শরীয়তে নেই, বরং এরকম ক্ষেত্রে তার মতামত একজন সাধারণ মানুষের মতই।” [9]
===
বিখ্যাত ইসলামী আইনশাস্ত্রবিদ এবং হাদিস বিশারদ ক্বাদি ইয়াদ (র.) এখন থেকে প্রায় এক হাজার বছর আগে আল্লাহর রাসূলের (ﷺ) জীবন এবং বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে একটি বিশদ বই লিখেছিলেন, সেখানে এই ব্যাপারটি নিয়ে আলাদা একাধিক অধ্যায়ই রয়েছে। এখানে সেই বইয়ের কিছু অংশ উদ্ধৃতির দাবি রাখে।
===
"ইবনু আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন—"আমি একজন মানুষ। আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে যা বলি, তা সত্য। কিন্তু আমি নিজের মতামত হিসেবে যা বলি—তা একজন নেহায়েত মানুষ হিসেবেই বলি। সেসব ক্ষেত্রে আমি ঠিকও বলতে পারি, ভুলও বলতে পারি।" পার্থিব বা দুনিয়াবি বিষয় সম্পর্কে নিজের মতামত বিষয়ে আল্লাহর রাসূলের বক্তব্য ছিল এই। কিন্তু তাঁর পক্ষ থেকে শরীয়ত প্রণয়ন বা কোন সুন্নত জারি করার ক্ষেত্রে এই কথা প্রযোজ্য নয়।
ইবনু ইসহাক বদরের প্রান্তরে সংঘটিত একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন, যা এই মূলনীতির ওপরে আলো ভালোভাবে আলোকপাত করে। বদর যুদ্ধের প্রাক্বালে রাসুলুল্লাহ (ﷺ) প্রান্তরের একটি জায়গায় তার বাহন থেকে নামলেন। সেটা দেখে আল হুবাব ইবনুল মুনযির তাকে বললেন—"আপনি যে এখানে নামলেন, এটা কি আল্লাহর নির্দেশ, নাকি এটা রণকৌশল বিষয়ে আপনার ব্যক্তিগত চিন্তা-ফিকির?" আল্লাহর রাসূল উত্তরে বললেন—"এটা রণকৌশলের অংশ"। শুনে আল-হুবাব উত্তরে বললেন, "তাহলে এখানে নামা ঠিক হবে না। আমরা শত্রুপক্ষের কাছাকাছি যাত্রা করে জলাশয়ের আরও নিকটে চলে যাই। সেখানে আমরা নেমে প্রান্তরের পানির কূপগুলো দখল করতে পারব, ফলে আমাদের হাতে পানি থাকবে, শত্রুদের হাতে থাকবে না।"
আল হুবাবের কথা শুনে রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, "তুমি সঠিক নির্দেশনাই দিয়েছ", এবং সেই অনুসারেই কাজ করলেন।
অন্য একটা ঘটনার প্রেক্ষিতে আল্লাহ তাঁর নবীকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, “এই বিষয়ে তাদের সাথে পরামর্শ করো” [সূরা ‘আলি ইমরান, ৩:১৫৯]। আল্লাহর রাসূল তার শত্রুদের শান্ত করার জন্য মদিনার খেজুরের এক তৃতীয়াংশ দান করে দিতে চাচ্ছিলেন। এই বিষয়ে তিনি আনসারের সাথে পরামর্শ করলেন, এবং তাদের কথা শোনার পর নিজের মত পরিবর্তন করলেন।
এরকম দুনিয়াবি বিভিন্ন ব্যাপারে তার ভুলের সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু এগুলোর সাথে দীনের জ্ঞান বা আক্বিদা-শরীয়তের কোন সম্পর্ক নেই। একই সাথে, এরকম ভুলভ্রান্তি হওয়ার ফলে আল্লাহর রাসূলের মর্যাদার কোন কমতি হয় না।" [10]
===
ওপরে যেমনটা বলা হল, নবীর পার্থিব জ্ঞান সংক্রান্ত এসব সীমাবদ্ধতার ব্যাপারটি আলেমদের মধ্যে ব্যাপকভাবে আলোচিত। উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ আলেমদের একজন ছিলেন শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভি (র.)। তিনি তাঁর হুজ্জাতুল্লাহ আল-বালিগা শীর্ষক গ্রন্থেও এই ব্যাপারে একটা আলাদা অধ্যায় রেখেছেন। [11] আলেমদের এরকম বিবৃতির উদাহরণ আরও আছে, আমরা প্রবন্ধের পরবর্তী একটা অংশে এই প্রসঙ্গে আরেকবার ফিরে আসব।
কিন্তু আল্লাহ তাঁর নবীকে সমস্ত বিষয় সম্পর্কে নিখুঁত জ্ঞান দিয়ে দিলেন না কেন? এই প্রশ্ন নিয়েও আলেমরা আলোচনা করেছেন। ক্বাদি ইয়াদ (র.) স্বয়ং তাঁর বইয়ের পরবর্তী অধ্যায়েই আল্লাহর রাসূলের (ﷺ) বিচারপ্রক্রিয়া বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন—
=
"আল্লাহ যদি চাইতেন, তাহলে তিনি তাঁর নবী (ﷺ) কে সবকিছু জানিয়ে দিতে পারতেন—প্রত্যেক মানুষের সমস্ত গোপন তথ্য, মনের কথা সবকিছু—যার ফলে একদম নিখুঁত জ্ঞানের ভিত্তিতে নবী বিচারকার্য পরিচালনা করতে পারতেন। এর ফলে বিচারক হিসেবে তার প্রমাণপত্র, সাক্ষ্য, স্বীকারোক্তি, শপথ, কোনকিছুই শোনার দরকার হত না।
কিন্তু সেটা করলে একটা সমস্যা দেখা দিত। আল্লাহ আমাদেরকে বলেছেন নবী (ﷺ) কে অনুসরণ করতে, যার মধ্যে তাঁর কাজকর্ম, সিদ্ধান্ত, জীবনধারণের সব অনুষঙ্গই অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু সব ব্যাপারেই যদি তার নিখুঁত গায়েবী জ্ঞান থাকত, তাহলে তাঁর উম্মত তাঁকে এসব ব্যাপারে অনুসরণ করতে পারত না। কারণ, নবীর (ﷺ) বিভিন্ন সিদ্ধান্তের পেছনে কী যুক্তি-তথ্য কাজ করেছে, সেটা সম্পর্কে আমাদের কোন ধারণা থাকত না। আল্লাহর শেখানো কোন এক গায়েবি উপায়ে তিনি এসব ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতেন—সেই গায়েব অনুসরণ করা তো আমাদের পক্ষে সম্ভব হত না। এজন্যই আল্লাহ এমন ব্যবস্থা করেছেন যাতে নবীর (ﷺ) সিদ্ধান্তগুলো সাধারণ জ্ঞানের ভিত্তিতে নেওয়া হয়, যে জ্ঞানের দিক থেকে তিনি আর-দশজন মানুষের মতই। এর ফলে আমরা তার সিদ্ধান্ত এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া, দু'টো জিনিসই আমরা অনুসরণ করতে পারি।" [12]
=
পুরো আলোচনার সারাংশ টানতে গিয়ে লেখক বলেছেন—
===
"এসব কিছুই তার নবুওয়াত, কামালিয়ত অথবা মর্যাদাকে কিছুমাত্র হ্রাস করে না।" [13]
===
এতক্ষণকার আলোচনা এবং আলেমদের বক্তব্য থেকে আমরা হাদিসের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সংক্রান্ত আরেকটা মূলনীতি জানতে পারি, সেটা হচ্ছে—হাদিসে নবীর বক্তব্য কি ওহী থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান, নাকি দুনিয়াবি কোন বিষয়ে তার নিজস্ব মতামত—সেই ব্যাপারটিও মাথায় রাখতে হবে। [14]
প্রশ্ন হচ্ছে, হাদিসের কোন বক্তব্য তাঁর ব্যক্তিগত মতামত সেটা বোঝার উপায় কী? সংক্ষেপে বলতে গেলে, হাদিসের ভাষা, বিষয়বস্তু এবং প্রেক্ষিত বিচার করেই এই সিদ্ধান্ত টানা সম্ভব। আমরা এই প্রক্রিয়ার একটা উদাহরণ এই লেখার মধ্যেই দেখব।
এই মূলনীতিগুলো মাথায় রেখে চলুন এবার আমরা আমাদের এই প্রবন্ধের আলোচ্য হাদিসটার দিকে তাকাই।
৩। তিন মূলনীতির আলোকে হাদিসের পর্যালোচনা
আলোচ্য হাদিসের বক্তব্য
হাদিসটি মুসলিম শরিফে এসেছে। হাদিসটি দীর্ঘ বলে শুধু প্রাসঙ্গিক অংশ এখানে উল্লেখ করা হচ্ছে।
===
أَنَّ ثَوْبَانَ، مَوْلَى رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم حَدَّثَهُ قَالَ كُنْتُ قَائِمًا عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَجَاءَ حَبْرٌ مِنْ أَحْبَارِ الْيَهُودِ فَقَالَ السَّلاَمُ عَلَيْكَ يَا مُحَمَّدُ .
…
قَالَ وَجِئْتُ أَسْأَلُكَ عَنْ شَىْءٍ لاَ يَعْلَمُهُ أَحَدٌ مِنْ أَهْلِ الأَرْضِ إِلاَّ نَبِيٌّ أَوْ رَجُلٌ أَوْ رَجُلاَنِ . قَالَ " يَنْفَعُكَ إِنْ حَدَّثْتُكَ " . قَالَ أَسْمَعُ بِأُذُنَىَّ . قَالَ جِئْتُ أَسْأَلُكَ عَنِ الْوَلَدِ قَالَ " مَاءُ الرَّجُلِ أَبْيَضُ وَمَاءُ الْمَرْأَةِ أَصْفَرُ فَإِذَا اجْتَمَعَا فَعَلاَ مَنِيُّ الرَّجُلِ مَنِيَّ الْمَرْأَةِ أَذْكَرَا بِإِذْنِ اللَّهِ وَإِذَا عَلاَ مَنِيُّ الْمَرْأَةِ مَنِيَّ الرَّجُلِ آنَثَا بِإِذْنِ اللَّهِ " . قَالَ الْيَهُودِيُّ لَقَدْ صَدَقْتَ وَإِنَّكَ لَنَبِيٌّ ثُمَّ انْصَرَفَ فَذَهَبَ . فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " لَقَدْ سَأَلَنِي هَذَا عَنِ الَّذِي سَأَلَنِي عَنْهُ وَمَا لِي عِلْمٌ بِشَىْءٍ مِنْهُ حَتَّى أَتَانِيَ اللَّهُ بِهِ " .
অনুবাদঃ "সাওবান (রা.) বর্ণনা করেছেন— আমি একদিন আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম, এমন সময় একজন ইহুদী শিক্ষক এসে বললেন, হে মুহাম্মদ, আপনার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। .... আমি আপনাকে এমন একটা ব্যাপার সম্পর্কে প্রশ্ন করতে এসেছি, যেটার জ্ঞান একমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত নবী অথবা আর দুই-একজন মানুষ ছাড়া আর কারো পক্ষে জানা সম্ভব নয়।
নবী উত্তরে বললেন, এর উত্তর জেনে কি আপনার কোন লাভ হবে?
ইহুদী—আমি আপনার উত্তর শুনে দেখব। আমার প্রশ্নটি হচ্ছে সন্তান (ও তার জন্মপ্রক্রিয়া) সম্পর্কে।
নবী বললেন—পুরুষের পানির রং সাদা, এবং নারীর পানির রং হলুদ। এদের মিলনের সময় পুরুষের পানি যদি নারীর পানির ওপর ক্ষমতাশীল হয়, তাহলে আল্লাহর ইচ্ছায় সন্তান ছেলে হয়। আর যদি নারীর পানি পুরুষের পানির ওপর ক্ষমতাশীল হয়, তাহলে আল্লাহর ইচ্ছায় সন্তান হয় মেয়ে।
ইহুদী—আপনি সত্যই বলেছেন, নিঃসন্দেহে আপনি আল্লাহর নবী।
এটুকু বলে ইহুদী ফিরে গেলেন। নবী (ﷺ) মন্তব্য করলেন, এই ব্যক্তি আমাকে যা জিজ্ঞেস করল তা সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না, আল্লাহ স্বয়ং আমাকে এই বিষয়গুলোর জ্ঞান দিয়েছেন।" [15]
===
হাদিসের সাথে বিজ্ঞানের সংঘাত নিয়ে চিন্তা করার আগে আমাদের ওপরে উল্লিখিত মূলনীতিগুলো প্রয়োগ করতে হবে।
প্রথমে আমাদের দেখতে হবে, আল্লাহর রাসূলের (ﷺ) সাথে ইহুদীর প্রশ্নোত্তরের এই ঘটনা কি অন্য কোন সাহাবী দেখেছেন? যদি দেখে থাকেন, তাহলে তার বর্ণনায় ঘটনার বিবরণ কীরকম ছিল? দুই বিবরণের মধ্যে কোন পার্থক্য আছে কি?
দ্বিতীয়ত, হাদিসের কোন রিওয়ায়াতের মধ্যে কি এমন কোন শব্দ আছে, যার একাধিক অর্থ হতে পারে? সেই অন্য অর্থ গ্রহণ করলে কি মূল বক্তব্যে কোন পরিবর্তন আসে?
এবং তৃতীয়ত, হাদিসের এই বক্তব্য কি ওহী-লব্ধ জ্ঞান, নাকি মানুষ হিসেবে নবীর ব্যক্তিগত মতামত?
চলুন এক এক করে এই মূলনীতিগুলো হাদিসের ওপর প্রয়োগ করি।
প্রথম মূলনীতির প্রয়োগ — অন্যান্য রিওয়ায়াত
আমাদের প্রথম প্রশ্নটির উত্তর হচ্ছে হ্যাঁ—হাদিসের এই ঘটনাটি কমপক্ষে আরেকজন সাহাবী দেখেছেন এবং বর্ণনা করেছেন। সেই সাহাবীর নাম আনাস ইবনু মালিক (রা.), এবং তাঁর বর্ণনা সহিহ বুখারিতে স্থান পেয়েছে। মুসলিম শরিফে যে নামহীন ইহুদির কথা বলা আছে, আনাসের বর্ণনায় আমরা তার নাম-পরিচয় জানতে পারি—তিনি ছিলেন বিখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু সালাম (রা.)।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, বুখারির এই রিওয়ায়াতে সন্তান জন্ম সংক্রান্ত এই কথোপকথন একটু ভিন্নভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।
এই বর্ণনার শুরুতে আব্দুল্লাহ ইবনু সালাম (রা.) প্রশ্ন করেছেন—সন্তান দেখতে তার বাবা বা মায়ের মত হয় কেন?
তার উত্তরে নবী (ﷺ) বলেছেন—
===
“পুরুষের পানি যদি নারীর পানির ওপর سَبَقَ হয়, তাহলে সন্তান দেখতে পিতার মত হয়। অন্যদিকে নারীর পানি যদি পুরুষের পানির ওপর سَبَقَ হয়, তাহলে সন্তান দেখতে মায়ের মত হয়।” [16]
===
লেখার পরবর্তী অংশে দ্বিতীয় মূলনীতির আলোচনায় আমরা দেখব سَبَقَ কথাটির একাধিক অর্থ হতে পারে, কাজেই এখনই এর অর্থের মীমাংসা না করে মূল আরবি শব্দটিই বহাল রাখা হচ্ছে।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, দুই সাহাবীর বর্ণনাতে কিন্তু নবীর (ﷺ) বক্তব্য ভিন্ন। সাওবানের (রা.) বর্ণিত প্রথম রিওয়ায়াতে কথা হচ্ছে শিশুর লিঙ্গ সম্পর্কে, সে কি ছেলে সন্তান হবে নাকি মেয়ে সন্তান হবে সেই বিষয়ে। কিন্তু আনাস (রা.) বর্ণিত দ্বিতীয় রিওয়াওয়াতে আলোচনা হচ্ছে শিশু দেখতে কার মত হবে, সেই বিষয়ে। দুই সাহাবী একই ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছেন, কাজেই দুইজনের বক্তব্য একই সাথে ঠিক হওয়া অসম্ভব। দু'জনের একজন এখানে ঘটনার প্রকৃত বর্ণনা দিয়েছেন—নবী হয় সন্তানের লিঙ্গ নিয়ে বলেছেন, অথবা তার পিতামাতার সাথে সন্তানের সাদৃশ্য নিয়ে বলেছেন। তাহলে আসল ঘটনা কী ছিল?
সেই প্রশ্নের উত্তর বের করার জন্য আমাদের এই দুইটি রিওয়ায়াত কীভাবে কতজন বর্ণনা করেছেন, সেই চিত্রের দিকে তাকাতে হবে (চিত্র ২)।
চিত্র ২ – হাদিসের দুই রিওয়ায়াতের বর্ণনার পথ। সবুজ রিওয়ায়াতে সন্তানের সাথে পিতামাতার সাদৃশ্যের ও কমলা রিওয়ায়াতে সন্তানের লিঙ্গের উল্লেখ আছে।
ওপরের ছবিতে দুই রিওয়ায়াতের ইসনাদ বা বর্ণনার পথ, অর্থাৎ কোন সাহাবীর কাছ থেকে হাদিস কোন তাবি'ঈ শুনেছেন এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম সেটা কীভাবে বর্ণিত হয়ে হাদিস গ্রন্থগুলোতে শেষ পর্যন্ত স্থান পেয়েছে—তার একটা পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র প্রদান করা হয়েছে। এই ছবি থেকে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, যে রিওয়ায়াতে সন্তানের সাথে পিতামাতার সাদৃশ্যের প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে, তার ইসনাদ অপেক্ষাকৃত বেশি শক্তিশালী। আনাস ইবনু মালিকের (রা.) কাছ থেকে এই হাদিস দুইজন তাবি'ঈ শুনেছেন, এবং তাদের একজনের কাছ থেকে আটজন বর্ণনাকারী হাদিসটা পরবর্তী প্রজন্মে বর্ণনা করেছেন। সাহাবী-পরবর্তী তিন নম্বর প্রজন্মে মোট নয়জন রাবী আলাদা আলাদাভাবে এই হাদিস উল্লেখ করেছেন। খোদ সহিহ বুখারিতেই হাদিসটা তিনবার স্থান পেয়েছে, এবং প্রত্যেকটা বর্ণনাতেই সন্তানের সাথে পিতামাতার সাদৃশ্যের উল্লেখ্য ছিল, লিঙ্গের নয়। [17]
অন্যদিকে যে রিওয়ায়াতে সন্তানের লিঙ্গের উল্লেখ ছিল, তার ইসনাদ বা বর্ণনার পথ অপেক্ষাকৃত কম সবল। সাহাবীর কাছ থেকে মাত্র একজন তাবি'ঈ হাদিসটা শুনেছেন, তাঁর কাছ থেকেও মাত্র একজন, এবং তাঁর পরবর্তী প্রজন্মেও একজন। অর্থাৎ প্রথম চার প্রজন্মে হাদিসটা কেবল একক বর্ণনাকারীর সূত্রে বর্ণিত হয়েছে।
এখান থেকে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, সন্তানের সাথে পিতামাতার সাদৃশ্য বিষয়ক রিওয়ায়াতটি সঠিক এবং বস্তুনিষ্ঠ হওয়ার পক্ষে প্রমাণ নিঃসন্দেহে বেশি। [18]
হাদিস সম্পর্কে এই একই মত দিয়েছিলেন দ্বাদশ শতাব্দীর বিখ্যাত শাস্ত্রবিদ ইবনুল কায়্যিম (র.)। মুসলিম শরিফে সন্তানের লিঙ্গ বিষয়ক বর্ণনাটি সম্পর্কে তিনি বলেছেন—
===
“আমার শিক্ষক (ইবনু তাইমিয়া) বলতেন, এই রিওয়ায়াতের শব্দচয়ন নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।” [19]
===
এর কারণ হিসেবে ইবনুল কায়্যিম (র.) সহিহ বুখারিতে পাওয়া অপেক্ষাকৃত প্রমাণসিদ্ধ রিওয়ায়াতটির কথাই উল্লেখ করেছেন। যেহেতু শক্তিশালী ইসনাদবিশিষ্ট বর্ণনায় সাদৃশ্যের কথা আছে, লিঙ্গ নয়, কাজেই সেটাই আমাদের গ্রহণ করা উচিত।
এর পাশাপাশি প্রমাণ হিসেবে তিনি উম্ম সুলাইম কর্তৃক বর্ণিত আরেকটি হাদিস উদ্ধৃত করেছেন, যেখানে এই পিতা-মাতার পানির তথা জনন উপাদানের سَبَقَ এর ফলে তাদের সাথে সন্তানের সাদৃশ্যের বর্ণনা আরও এক বার এসেছে। অর্থাৎ শুধু এই হাদিসের শক্তিশালী রিওয়ায়াতই নয়, সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি ঘটনা সংক্রান্ত হাদিসেও আল্লাহর রাসূল (ﷺ) এই সাদৃশ্যের ব্যাপারটা একইভাবে উল্লেখ করেছেন। এই হাদিসটা নিয়েও আমরা এই লেখার শেষ অংশে আলোচনা করব।
এই সমস্ত প্রমাণ একত্র করলে বলতে হয়, মুসলিম শরিফে সাওবানের (রা.) বর্ণিত সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণ সংক্রান্ত কথাগুলো সঠিক নয়। আব্দুল্লাহ ইবনু সালাম (রা.) সন্তানের সাথে পিতামাতার সাদৃশ্য নিয়েই প্রশ্ন করেছিলেন, এবং আল্লাহর রাসূল (ﷺ) সেই প্রশ্নেরই উত্তর দিয়েছেন। লিঙ্গের ব্যাপারটা ভুলক্রমে সাওবানের (রা.) বর্ণনায় ঢুকে গেছে।
দ্বিতীয় মূলনীতির প্রয়োগ – سَبَقَ শব্দের অর্থ
হাদিসে যে ক্রিয়াপদটি ব্যবহৃত হয়েছে—سَبَقَ—এই কথাটির মূল অর্থ হল আগে যাওয়া। কিন্তু এটা ছাড়া আরেকটি অর্থেও শব্দটি ব্যবহৃত হয়, সেটা হচ্ছে অন্য কিছুর ওপরে ক্ষমতা বা আধিপত্য থাকা। প্রাচীন আরবি অভিধান, কুর'আনের আয়াত, তাফসির—সব সূত্র থেকেই এই অর্থের প্রমাণ পাওয়া যায়।
প্রসিদ্ধ আরবি অভিধান লিসানুল 'আরাব-গ্রন্থে سَبَقَ কথাটির প্রায়োগিক উদাহরণ হিসেবে এসেছে—
===
وسَبَقَ على قومِه — অর্থ সে তার গোত্রের ওপর আধিপত্য বিস্তার করল (বদান্যতার দিক দিয়ে)। [20]
===
একইভাবে কুর'আনেও শব্দটি এই দ্বিতীয় অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেছেন—
===
نَحْنُ قَدَّرْنَا بَيْنَكُمُ الْمَوْتَ وَمَا نَحْنُ بِمَسْبُوقِينَ
অর্থ - আমি তোমাদের মৃত্যু নির্ধারণ করেছি, এবং আমার ওপর কারো আধিপত্য নেই। [৫৬:৬০]
===
অন্যান্য অনুবাদে এসেছে "এবং আমি অক্ষম নই", অর্থাৎ আমার ওপর কারো ক্ষমতা নেই।
এই سَبَقَ শব্দটির এরকম অর্থ আমরা তাফসির গ্রন্থেও পাই। যেমন, কুর'আনের সূরা আনকাবুতের আটাশতম আয়াতে লুত (আ.) তাঁর জাতিকে উদ্দেশ্য করে বলছেন—"তোমরা এমন অশ্লীল কাজ করছ, যার ব্যাপারে তোমাদের ওপর পৃথিবীর কারো سَبَقَ ছিল না।" সাধারণত এই আয়াতটির অনুবাদ করা হয় "যা তোমাদের পূর্বে পৃথিবীর কেউ করেনি"। কিন্তু কুর'আনের প্রখ্যাত ব্যাখ্যাবিদ ফাখরুদ্দিন আর-রাজি (র.) এই আয়াতের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে লিখেছেন—
===
"যার ব্যাপারে তোমাদের ওপর পৃথিবীর কারো سَبَقَ ছিল না" কথাটির দু'টি অর্থ হতে পারে -
১। এর পূর্বে কেউ কখনোই এরকম অশ্লীল কাজ করে নি। এটাই আপাত অর্থ।
২। এমন হতে পারে যে এর আগে হয়ত ব্যক্তিবিশেষ কাজটি করেছে, কিন্তু লূত (আ)-এর জাতি এ ব্যাপারে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেছে। সেদিক থেকে দেখলে আল্লাহর কথা "مَا سَبَقَكُم بِهَا" এর অর্থ হল তোমরা এই ব্যাপারে সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছ। কথ্য ভাষায় আমরা বলে থাকি "অমুক ব্যক্তি সব কৃপণের কৃপণতাকে ছাড়িয়ে গেছে (سَبَقَ)", অথবা "সব খারাপ লোকের অসততাকে ছাড়িয়ে গেছে (سَبَقَ)", যদি তার এই বৈশিষ্ট্য অন্য সবার চেয়ে বেশি থাকে।" [21]
===
অর্থাৎ তাফসিরশাস্ত্রেও سَبَقَ কথাটা শুধুমাত্র "আগে যাওয়া" নয়, বরং কোন বৈশিষ্ট্য বেশি পরিমাণে থাকা, অপরপক্ষের ওপর আধিপত্য বা ক্ষমতা থাকা, ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
এই আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে, কুর'আনের আয়াত, তাফসির, আরবি অভিধান, সব সূত্রেই سَبَقَ কথাটার আধিপত্য থাকা অর্থটির প্রমাণ পাওয়া যায়।
তৃতীয় মূলনীতির প্রয়োগ – এই হাদিসের বক্তব্য দুনিয়াবি জ্ঞান নয়
আব্দুল্লাহ ইবন সালামের প্রশ্নের উত্তরে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যা বলেছেন তা নিঃসন্দেহে ওহী থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান। প্রশ্ন করার সময়ই সাহাবী বলেছেন, এই প্রশ্নের উত্তর শুধুমাত্র আল্লাহর নবী ছাড়া প্রায় কেউই জানেন না, অর্থাৎ স্রেফ সাধারণ জ্ঞানের ভিত্তিতে এই প্রশ্নের উত্তরে দেওয়া সম্ভব নয়। পাশাপাশি সাওবানের বর্ণনাতে নবী (ﷺ) স্পষ্টই বলেছেন, এই জ্ঞান তাঁকে স্বয়ং আল্লাহই দান করেছেন। কাজেই তাঁর এই বক্তব্য মানুষ হিসেবে তাঁর সীমাবদ্ধতার উর্ধ্বে—এগুলো পার্থিব জ্ঞান নয়, বরং আসমানী জ্ঞান। এখানে ভুল থাকতে পারে না।
হাদিসের ওপর এই মূলনীতিগুলোর প্রয়োগের ফলে আমরা এর প্রকৃত রিওয়ায়াত এবং একটা সম্ভাব্য অর্থ বের করেছি। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আব্দুল্লাহ ইবন সালামের (রা.) প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, পিতা বা মাতার মধ্যে যার পানির ক্ষমতা বা আধিপত্য বেশি থাকে, শিশুর সাদৃশ্য তার মত হয়।
এই পর্যায়ে এসে অবশেষে আমরা প্রশ্ন করতে পারি, হাদিসের এই বক্তব্য কি বিজ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক? সেটা জানার জন্য আগে পিতামাতার সাথে সন্তানের সাদৃশ্য কীভাবে নির্ধারিত হয়, তার প্রক্রিয়া সম্পর্ক বিজ্ঞানের বক্তব্য নিয়ে আলোচনা করতে হবে।
৪। বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা: বাবা-মায়ের সাথে সন্তানের সাদৃশ্য কীভাবে ধার্য হয়?
লেখার শুরুতেই আমরা দেখলাম, শুক্রাণু এবং ডিম্বাণুর মিলনের ফলে জাইগোট তৈরি হয় এবং সেই জাইগোট থেকেই শিশুর বিকাশ ঘটে। বাবা ও মা থেকে প্রাপ্ত এই দু’টি জননকোষে এক কপি করে ক্রোমোজোম থাকে। অর্থাৎ প্রতিটি শিশু তার প্রতি জোড়া ক্রোমোজোমের একটি পায় মায়ের ডিম্বাণুর কাছ থেকে, আরেকটি পায় বাবার শুক্রাণুর কাছ থেকে। মা ও বাবা থেকে পাওয়া এই দুই ক্রোমোজোমে একই জিনের দু’টি রূপ বা ভার্সন থাকতে পারে, প্রতিটি রূপকে বলা হয় অ্যালিল।
এই দুই অ্যালিল যদি অভিন্ন হয়, অর্থাৎ মা ও বাবার একই বৈশিষ্ট্য থাকে, তাহলে সন্তান কার মত হবে সেই প্রশ্নটি ওঠে না। কিন্তু যদি দুইটি অ্যালিলের মধ্যে ভিন্নতা থাকে, তাহলে শিশুর মধ্যে কোন অ্যালিলটি প্রকাশিত হয়—মায়ের, নাকি বাবার? এটাই মূল প্রশ্ন, এবং এর উত্তর থেকেই বোঝা যাবে, বাবা-মায়ের সাথে সন্তানের সাদৃশ্য কীসের ভিত্তিতে আসে।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে—বলতে গেলে প্রায় সবক্ষেত্রেই—দুই অ্যালিলের মধ্যে যেটি "ডমিনেন্ট", সেটার বৈশিষ্ট্যই সন্তানের মধ্যে প্রকাশ পাবে। (চিত্র ৩)
ধরে নিন মা ও বাবা থেকে যে দু'টি অ্যালিল সন্তানের মধ্যে এসেছে, তার মধ্যে একটি অ্যালিল থেকে একটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যধারণকারী প্রোটিন তৈরি হয়, আরেকটি থেকে হয় না। সেক্ষেত্রে যে অ্যালিলটি থেকে প্রোটিন তৈরি হয় (ডমিনেন্ট) সেটার প্রভাবই সন্তানের মধ্যে দেখা যাবে। যেটা থেকে হয় না সেটা সন্তানের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে সাধারণত সেরকম প্রভাব ফেলবে না। যেমন, বাদামী চোখের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণকারী অ্যালিল থেকে মেলানিন বেশি তৈরি হয়, আর নীল চোখের বৈশিষ্ট্যধারী অ্যালিল থেকে কম। কোন সন্তানের মধ্যে যদি দুইটি অ্যালিল একসাথে থাকে, তাহলে যে অ্যালিল থেকে বেশি মেলানিন তৈরি হয় সেটাই হবে ডমিনেন্ট, এবং তার চোখের রংও হবে বাদামি।
চিত্র ৩ – ধরে নিন B এবং b নামের দুইটি অ্যালিল আছে। B এর বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেলে বাদামী চোখ হয়, b এর ক্ষেত্রে নীল। সন্তানের মধ্যে দু’টি অভিন্ন অ্যালিল থাকে, অর্থাৎ বাবা ও মা উভয়ের কাছ থেকেই যদি সে একই অ্যালিল পায় (BB অথবা bb), তাহলে কার সাথে তার সাদৃশ্য আছে, সেই প্রশ্নটির কোন মানে হয় না। কিন্তু যদি সে একজনের কাছ থেকে B ও অন্যজনের কাছ থেকে b পায়, তাহলে ওপরের চিত্র অনুসারে তার চোখের রং হবে বাদামী, কারণ সেই অ্যালিলটিই ডমিনেন্ট।
এজন্য অনেক জিনেটিক অসুখের ক্ষেত্রে, কেউ যদি মা বা বাবা কোন একজনের কাছ থেকে মাত্র একটি কার্যকর (বা "সুস্থ", নরমাল) অ্যালিল পায়, তাহলেই সাধারণত তার আর অসুখটা হবে না। দুই জন্মদাতার একজনের কাছ থেকে প্রাপ্ত অ্যালিলের বৈশিষ্ট্যই তার দেহে প্রকাশ পাবে। অর্থাৎ মা ও বাবা থেকে প্রাপ্ত অ্যালিলদু'টোর মধ্যে যেটা ডমিনেন্ট, সেটার প্রভাবই শিশুর দেহে দেখা যায়। [22]
এক কথায় বলতে গেলে, মায়ের অ্যালিল ডমিনেন্ট হলে শিশুর বৈশিষ্ট্য মায়ের মত হয়, আর বাবার অ্যালিল ডমিনেন্ট হলে তার বৈশিষ্ট্য হয় বাবার মত। [23]
৫। হাদিস বনাম বিজ্ঞান: সংঘাত নাকি সামঞ্জস্য?
ওপরে আমরা যেমন দেখলাম, আলোচ্য হাদিসটির একটা সম্ভাব্য অনুবাদ হল— পিতা বা মাতার মধ্যে যার জনন উপাদানের ক্ষমতা বা আধিপত্য বেশি থাকে, শিশুর সাদৃশ্য তার মত হয়।
আজ আমরা বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে জিনেটিক্স সম্পর্কে যা জেনেছি, তার থেকে এই হাদিসের বক্তব্য খুব দূরে নয়। কুর'আন-হাদিসের প্রত্যেকটা কথাই এমনভাবে বলা হয়েছে যেন তা সবার কাছে বোধগম্য হয়, বিশেষ করে সেই সপ্তম শতাব্দীর আরবদের কাছে।
ওপরে যেমনটা বললাম, অ্যালিল হচ্ছে জিনের অন্য নাম—মানুষের জিনেটিক্সের প্রেক্ষিতে, মা ও বাবার ক্রোমোজোমে একই জিনের যে দুই রূপ বা ভার্সন থাকে, তাদেরকে অ্যালিল বলা হয়। জিন থাকে ক্রোমোজোমে, এবং সন্তানের মধ্যে বংশপরম্পরায় যে ক্রোমোজোম পৌঁছয় তা থাকে শুক্রাণু এবং ডিম্বাণুতে। শুক্রাণু আর ডিম্বাণু, দু’টোই তরলে নিমজ্জিত থাকে—শুক্রাণু থাকে সেমিনাল প্লাজমায়, এবং ডিম্বাণু থাকে ফলিউকিউলার ফ্লুয়িডে।
অর্থাৎ, শিশুর বৈশিষ্ট্য সৃষ্টিকারী জিন বা অ্যালিল দেহের ভেতরের তরলের মধ্যেই থাকে (চিত্র ৪)। সেভাবে দেখলে মা ও বাবার "অ্যালিল" কথাটিকে সহজ করে সাধারণভাবে “পানি” হিসেবে আখ্যায়িত করাই স্বাভাবিক।
চিত্র ৪ – পুরুষ ও নারীর জনন উপাদানের মধ্যে অ্যালিলের অবস্থান অতি-সরলীকৃত কার্টুনের মত করে দেখানো হয়েছে। পুরুষের জনন উপাদান বীর্য, সেখানে জননকোষ শুক্রাণু সেমিনাল প্লাজমার মধ্যে থাকে। অন্যদিকে নারীদের জননকোষ ডিম্বাণু থাকে ফলিকিউলার ফ্লুয়িডের মধ্যে। এই জননকোষদু’টো সমন্বয়ের মাধ্যমেই শিশুর জন্ম হয়, এবং কোষের ভেতরের ক্রোমোজোমে থাকা বিভিন্ন অ্যালিল তার বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, সাওবানের (রা.) রিওয়ায়াতটির দিকে যদি আমরা তাকাই—সেখানে একটি তথ্য পাই যার মাধ্যমে এই “পানির” সাথে অ্যালিলের সম্পর্কটা আরও পরিষ্কার হয়। নবী (ﷺ) পুরুষের “পানি” তথা জনন উপাদানকে বলেছেন সাদা এবং ঘন, অন্যদিকে নারীর জনন উপাদানকে বলেছেন পাতলা এবং হলুদ।
পুরুষের জনন উপাদান তথা বীর্য যে সাদা এবং ঘন সেটা সহজেই দেখা যায়, কিন্তু নারীর জনন উপাদানের এই বর্ণনা বিজ্ঞানের অগ্রগতির আগে জানা সম্ভব ছিল না। ডিম্বাণু অবস্থান করে ফলিকিউলার ফ্লুয়িডের ভেতর (চিত্র ৪), যার রং হলুদ, এবং এই তরল থাকে দেহের ভেতরে (চিত্র ৫)।
চিত্র ৫ – ফলিকিউলার ফ্লুয়িড, নারীর জননকোষ বা ডিম্বাণু যে তরলে নিমজ্জিত থাকে, তা একটি টিউবে সংগ্রহ করা হয়েছে। সংগ্রহের পর এটা লাল দেখায় (বামের চিত্র), কারণ দেহের ভেতর থেকে এই তরল বের করার সময় এর সাথে রক্ত মিশ্রিত হয়ে যায়। কিন্তু পরীক্ষাগারে ফলিকিউলার ফ্লুয়িডকে আলাদা করলে বোঝা যায়, এর রং হলুদ (ডানের চিত্র)। ছবিটা এই প্রোটোকল থেকে নেওয়া হয়েছে - https://www.protocols.io/view/human-follicular-fluid-procurement-and-processing-eq2lyjpzmlx9/v1
হাদিসে নারী ও পুরুষের “পানি”র বর্ণনা, এবং আধুনিক যুগে সন্তানের বৈশিষ্ট্য নির্ধারক জননকোষধারী তরলের এই মিল দেখে আমরা বুঝতে পারি, নবী (ﷺ) পানি বলতে জনন উপাদানকেই সঠিকভাবে নির্দেশ করেছেন। সপ্তম শতাব্দীতে বসবাসরত আরবদের জন্য “অ্যালিল” জিনিসটাকে বোধগম্য করে বলতে গেলে এর চেয়ে যথাযথ শব্দ ব্যবহার আদৌ সম্ভব নয়।
এক মিনিটের জন্য এর বিপরীত বাস্তবতাটা চিন্তা করুন, নবীকে (ﷺ) সাদা বা হলুদ বর্ণের পানি না বলে "অ্যালিল" ব্যাখ্যা করতে গেলে কী ধরণের কথা বলতে হত—"আমাদের দেহ অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত, যাদেরকে বলা হয় কোষ। এই কোষের মধ্যে অনেকগুলো সুতো আছে, সেই সুতোগুলোর মধ্যে আবার কিছু রাসায়নিক অক্ষর আছে, যাদের বিন্যাস নির্ধারণ করে আমাদের বৈশিষ্ট্য কীরকম হবে। মা ও বাবার মিলনের পর শিশু তার দু'জোড়া সুতোর একটা পায় মায়ের কাছ থেকে, আরেকটা বাবার কাছ থেকে। এই দুই সুতোর মধ্যে যে সুতোর বৈশিষ্ট্যের আধিপত্য থাকে বেশি, সেই বৈশিষ্ট্যই শিশুর মধ্যে প্রকাশ পায়। তবে কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রমও আছে, যেমন..."
এ ধরণের বিবরণ দিলে কি তা এই হাদিসের শ্রোতাদের কাছে আদৌ বোধগম্য বা গ্রহণযোগ্য হত? একেবারেই না, বরং তা আরও অস্পষ্টতা তৈরি করত। তার চেয়েও বড় কথা, আল্লাহর রাসূলকে (ﷺ) পাঠানো হয়েছে আমাদের দ্বীনের জ্ঞান এবং আখিরাতে মুক্তিলাভের পথ চেনানোর জন্য, বৈজ্ঞানিক জ্ঞান বিতরণের জন্য নয়। এজন্য অ্যালিলের বিস্তারিত বর্ণনায় না গিয়ে সাধারণভাবে হাদিসে নির্দিষ্ট রঙের জনন উপাদানের কথা এসেছে, যাদের মধ্যে থাকা অ্যালিলের আধিপত্য বা ডমিনেন্সের কারণে সন্তানের সাথে মা-বাবার সাদৃশ্য দেখা যায়।
সমস্ত কিছু বিবেচনা করলে বলতে হয়, হাদিসের সাথে বিজ্ঞানের সংঘাত থাকা দূরে থাক, বরং নবীর (ﷺ) দেওয়া উত্তরের মধ্যে বৈজ্ঞানিক বাস্তবতার মূল সুরটুকুই অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত, সরল এবং বোধগম্য ভাষায় ফুটে উঠেছে।
৬। পিতামাতার সাথে সন্তানের সাদৃশ্য বিষয়ক আরেকটি হাদিস
ওপরের আলোচনা থেকে আমরা দেখলাম, আলোচ্য হাদিসের সাথে বৈজ্ঞানিক বাস্তবতার কোন সংঘাত নেই, বরং সামঞ্জস্য আছে।
কিন্তু আলোচনার এই জায়গাতে আমরা ইতি টানতে পারি না, কারণ শিশুর সাথে পিতামাতার সাদৃশ্য কীভাবে ধার্য হয়, সেটা নিয়ে আরেকটা হাদিস আছে—যার বক্তব্য নিয়ে অনেকে আপত্তি করেন। যদি আসলেই প্রমাণ করতে হয় যে এই ব্যাপারে হাদিসের সাথে বিজ্ঞানের কোন সংঘাত নেই, তাহলে এই দ্বিতীয় হাদিস নিয়েও আমাদের একই উপায়ে আলোচনা করতে হবে।
হাদিসের বক্তব্য
আলোচ্য দ্বিতীয় হাদিসটিতে একজন নারী এসে আল্লাহর রাসূলকে নারীদের স্বপ্নদোষ সম্পর্কে জিগ্যেস করলেন, যার উত্তরে নবী গোসল করার প্রয়োজনীয়তার কথা বললেন। এই আলোচনার প্রেক্ষিতে নবীর (ﷺ) স্ত্রী উম্মু সালামা (রা.) প্রশ্ন করলেন—“হে রাসুলুল্লাহ (ﷺ), এটা (নারীদের স্বপ্নদোষ) কি সত্যিই হয়?"
===
নবী—হ্যাঁ, পুরুষের পানি ঘন এবং সাদা, এবং নারীর পানি পাতলা এবং হলুদ। এদের মধ্যে যেটার سَبَقَ হয়, তার সাথে শিশুর সাদৃশ্য থাকে। [24]
===
দেখা যাচ্ছে নবী (ﷺ) এখানে সন্তানের সাথে পিতামাতার সাদৃশ্য বিষয়ে মোটামুটি একই উত্তর দিয়েছেন। সমস্যা হল, তিনি এই উত্তরটা দিয়েছেন স্বপ্নদোষ বিষয়ক একটা প্রশ্নের উত্তরে, যা থেকে মনে হয় তিনি বলছেন স্বপ্নদোষ বা যৌনমিলনের সময় নারীদের যে তরল নির্গত হয়, সেটাই তাদের পানি।
কিন্তু বাস্তবতা হল, নারীদের জননকোষ থাকে ডিম্বাশয়ে, এবং যৌনমিলনের সময় সেটা আদৌ নির্গত হয় না। প্রকৃতপক্ষে যৌনমিলনের সময় নারীদের নির্গত তরলের সাথে আসলে বংশবিস্তার বা জননের কোন সম্পর্কই নেই—সেই তরলটার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে যোনিপথ পিচ্ছিল করা বা লুব্রিকেন্ট হিসেবে কাজ করা (চিত্র ৬)।
চিত্র ৬ – সাধারণত নারীদের ডিম্বাণু ওভারিতে (ovary) জমা থাকে, কিন্তু রজঃচক্রের একটি নির্দিষ্ট সময়ে তা ফ্যালোপিয়ান টিউবে পৌঁছয়। অন্যদিকে, যৌনমিলনের পর পুরুষের বীর্যের ভেতরে থাকা শুক্রাণু যোনিপথ দিয়ে যাত্রা করে জরায়ু হয়ে ফ্যালোপিয়ান টিউবে ডিম্বাণুর দেখা পায়। অর্থাৎ, ডিম্বাণু যোনিপথ পর্যন্ত আসে না, এবং যৌনমিলনের সময় যোনিপথে যে তরল দেখা যায় তার সাথে নারীদের জনন উপাদানের সম্পর্ক নেই। ছবিটি invitra.com ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া হয়েছে। [25]
তাহলে নবীর (ﷺ) এই হাদিসের বক্তব্যকে আমরা কীভাবে দেখব? চলুন একইভাবে এর ওপর শুরুতে আলোচিত তিনটি মূলনীতি প্রয়োগ করি।
দ্বিতীয় হাদিসের বিশ্লেষণ ও তিনটি মূলনীতির প্রয়োগ
এই হাদিসটিরও বেশ কয়েকটি রিওয়ায়াত বা বর্ণনা আছে, কিন্তু প্রত্যেক বর্ণনাতেই নবী (ﷺ) স্বপ্নদোষের প্রেক্ষিতে নারী এবং পুরুষের পানি তথা জনন উপাদানের আলোচনা এনেছেন। অর্থাৎ হাদিসের যে অংশটি বিজ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক বলে আমরা মনে করছি, সে অংশে বিভিন্ন রিওয়ায়াতের মধ্যে কোন ভিন্নতা নেই। কাজেই প্রথম মূলনীতি এই হাদিসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। একইভাবে, হাদিসটিতে দ্ব্যার্থবোধক কোন শব্দ নেই যেটার অন্য কোন অর্থ এই সংঘর্ষের বিষয়টির ওপর আলোকপাত করবে।
বাকি রইল তৃতীয় মূলনীতি—নবী (ﷺ) কিছু ক্ষেত্রে হাদিসের মধ্যে এমন কথা বলেন, যেগুলো ওহী থেকে প্রাপ্ত নয়, বরং তার নিজের ব্যক্তিগত মতামত বা অভিজ্ঞতার ফসল। আমরা ওপরে যেমনটা আলোচনা করলাম, পার্থিব বা দুনিয়াবি কোন বিষয়ে নবীর (ﷺ) বক্তব্যের ক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে, নবী (ﷺ) একজন মানুষ মাত্র। আগের হাদিসটি আলোচনার সময় আমরা দেখলাম, সন্তানের সাথে পিতামাতার সাদৃশ্য বিষয়ক বক্তব্য যে ওহী থেকেই এসেছে, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। কিন্তু স্বপ্নদোষ বিষয়ক প্রশ্নের ক্ষেত্রে নবী (ﷺ) যে এই যৌনমিলনের সময় নির্গত তরলকে জনন উপাদান মনে করেছেন—সেটুকু কি তাঁর ব্যক্তিগত মতামত হতে পারে?
লক্ষ্য করুন, এই হাদিসটিতে কোথাও এমন কোন কথার উল্লেখ নেই, যার মাধ্যমে প্রমাণিত হয় নবীর (ﷺ) বক্তব্য জিবরিল (আ.) মারফত ওহীর অংশ হিসেবে এসেছে। উম্মু সালামার (রা.) প্রশ্নের উত্তরে নবী তাঁর বক্তব্য দিয়েছেন, কিন্তু সেই বক্তব্যের উৎস সম্পর্কে কিছু বলেননি। অর্থাৎ, স্বপ্নদোষের সময় নির্গত তরলকে জনন উপাদান মনে করা—এই ধারণাটুকু ওহীর বাইরে তাঁর ব্যক্তিগত মতামত হওয়া একদম অসম্ভব নয়।
এটা স্রেফ একটা সম্ভাবনা, কিন্তু আসলেই যে ওষুধপথ্য বা শারীরতত্ত্ব, বিশেষ করে যৌন প্রজনন এবং বংশবিস্তার সংক্রান্ত বিভিন্ন ক্ষেত্রে নবী (ﷺ) কখনো ব্যক্তিগত মতামতের ভিত্তিতে কথা বলতেন—সেটার প্রমাণ অন্যান্য হাদিস এবং আলেমদের বক্তব্য থেকে পাওয়া যায়।
যেমন, এই লেখার শুরুতে তৃতীয় মূলনীতিটি আলোচনার সময় আমরা উপমহাদেশের বিখ্যাত আলেম শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীর (র.) কথা বলেছিলাম। তিনি তাঁর বইয়ের পঁচাত্তরতম অধ্যায়ে নবীর (ﷺ) বক্তব্যের কোন অংশগুলোকে আমরা ওহীর বাইরে তাঁর ব্যক্তিগত মতামত হিসেবে গ্রহণ করতে পারি, তার একটি তালিকা দিয়েছেন। সেই তালিকার মধ্যে মেডিসিন বা ওষুধপথ্যও রয়েছে। [26]
শায়খ মুহাম্মাদ সুলাইমান আল আশকার তাঁর বইতে নানা ধরণের দলিল এবং আলেমদের বক্তব্যের ভিত্তিতে মত দিয়েছেন, দুনিয়াবি বিভিন্ন বিষয়—যার মধ্যে ওষুধপথ্যও অন্তর্ভুক্ত—বিষয়ক আলোচনা নবীর (ﷺ) ব্যক্তিগত অভিমত বলেই গণ্য হবে, এর সাথে ওহীর সম্পর্ক নেই। তিনি লিখেছেন—
===
"এমনটা হতেও পারে যে, নবী (ﷺ) বিশ্বাস করতেন...কোন নির্দিষ্ট পথ্য দিলে অসুখ ভালো হয়ে যাবে, কিন্তু আদতে সেটা হবে না; বা কোন নির্দিষ্ট কৃষি, শিল্প অথবা ব্যবসায়িক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ফলাফল পাওয়া যাবে, যদিও আদতে সেরকম ফল পাওয়া যাবে না বরং বিপরীতটা হবে; অথবা কোন সমরকৌশল অনুসরণের ফলে লাভ হবে, যদিও বাস্তবে সেরকমটা হবে না। তার কারণ, এসব বিশ্বাসের সাথে নবুওয়াতের কোন সম্পর্ক নেই। এই বিশ্বাসগুলো নবী (ﷺ) ধারণ করতেন একজন মানুষ হিসেবে। হয়ত এসব বিষয়ে তাঁর কিছু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ছিল, অথবা তিনি বাস্তবে কিছু পর্যবেক্ষণ করেছেন, অথবা কারো কাছ থেকে মতামত শুনে সেটার প্রয়োগে ফল পেয়েছেন। এ ধরণের অভিজ্ঞতার ফলে তিনি আর দশজন মানুষের মতই কিছু ব্যক্তিগত মতামত ধারণ করতে পারেন।" [27]
===
তাঁর এই মতামতের পক্ষে দলিল হিসেবে লেখক বেশ কয়েকজন প্রাচীন এবং আধুনিক আলেমের নাম উল্লেখ করেছেন। এদের মধ্যে ত্রয়োদশ শতাব্দীর বিখ্যাত মনীষী, মালিকি ফকিহ ইবন খালদুনের (র.) একটা উক্তি আলাদাভাবে উল্লেখ করতে হয়, কারণ এই ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য ছিল বেশ খোলাখুলি—
===
"ওষুধপথ্য সংক্রান্ত যে বর্ণনাগুলো পাওয়া যায় তার ভিত্তি হল তৎকালীন আরবদের সীমিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লব্ধ জ্ঞান, এবং এর সাথে নবুওয়াতের সম্পর্ক নেই। আরবদের মধ্যে এ ধরণের বিভিন্ন রীতি প্রচলিত ছিল, এবং সেগুলোই নবীর (ﷺ) হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। এগুলো মানুষ হিসেবে তাঁর (ﷺ) ব্যক্তিগত মতামত, শরীয়তের হুকুম নয়। কারণ তাঁকে পাঠানো হয়েছিল আমাদের দ্বীন এবং শরীয়ত শিক্ষা দিতে, ওষুধপথ্য বা কোন দুনিয়াবি জ্ঞান শিক্ষা দিতে নয়। খেজুর গাছের পরাগায়নের সময় এ ধরণের ঘটনাই ঘটেছিল, যার প্রেক্ষিতে নবী (ﷺ) বলেছিলেন—"তোমাদের পার্থিব বিষয়াদি সম্পর্কে তোমরাই ভাল জ্ঞান রাখো।" [28]
===
কাজেই দেখা যাচ্ছে, ওষুধপথ্য—যার সাথে দেহের কার্যকারিতা, শারীরতত্ত্ব ইত্যাদিও জড়িত—বিষয়ে নবীর (ﷺ) বক্তব্যগুলো মানুষ হিসেবে তাঁর ব্যক্তিগত মতামতও হতে পারে। এর সাথে নবুওয়াত বা ওহীর কোন সম্পর্ক নেই।
আপাতত আমাদের আলোচ্য হাদিসের বিষয় হচ্ছে প্রজনন এবং বংশবিস্তার প্রক্রিয়া। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, হাদিস থেকেই জানা যায় যে এই ব্যাপারে মতামত দেয়ার সময় নবী (ﷺ) ক্ষেত্রবিশেষে পার্থিব বা দুনিয়াবি অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করতেন। ইবন মাজাহতে বর্ণিত একটি হাদিসে নবী (ﷺ) বলেছেন—
===
"আমি স্তন্যদায়িনী মায়ের সাথে মিলন করা অবৈধ ঘোষণা করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তারপর দেখলাম রোমীয় এবং পারস্যবাসীদের মধ্যে এই রীতি প্রচলিত আছে, এবং এর ফলে শিশুর মৃত্যু হয় না।" [29]
===
এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, এই ব্যাপারটিতে নবী (ﷺ) বাস্তব অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করেই তাঁর মতামত এবং কর্মপদ্ধতি স্থির করেছেন। কাজেই স্বপ্নদোষের সাথে নারীদের জনন উপাদান মিলিয়ে ফেলার যে বক্তব্য, সেটাও নবীর (ﷺ) পার্থিব জ্ঞানের ভিত্তিতে হওয়া অসম্ভব নয়। হাদিসে এমন কিছু বলা নেই যার ফলে মনে হয় এই বক্তব্য ওহী মারফত এসেছে। বরং এই ব্যাপারে নবীর (ﷺ) অন্যান্য হাদিস এবং আলেমদের বিশ্লেষণ সাপেক্ষে বিপরীত মতটাও গ্রহণযোগ্য মনে হয়।
৭। উপসংহার
এই প্রবন্ধে আমরা হাদিস ব্যাখ্যার কিছু প্রাচীন মূলনীতির আলোকে দু’টি হাদিসের বক্তব্য পর্যালোচনা করে দেখলাম। প্রথম হাদিসের ক্ষেত্রে আমরা দেখলাম, এর একটি গ্রহণযোগ্য অনুবাদের সাথে বিজ্ঞানের কোনো সংঘাত নেই, বরং সামঞ্জস্য আছে; অন্যদিকে দ্বিতীয় হাদিসের ক্ষেত্রে দেখলাম এর বক্তব্যকে ওহী থেকে লব্ধ জ্ঞান হিসেবে গ্রহণ করা জরুরি নয়—তা অন্যান্য বিভিন্ন বিষয়ের মত নবীর পার্থিব জ্ঞানের অংশও হতে পারে।
হাদিসের সাথে প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানের কোন সংঘাত নেই, যদি হাদিস ব্যাখ্যার যথাযথ প্রক্রিয়া ব্যবহার করে এর অনুবাদ করা হয়। এই প্রবন্ধে সেটাই করার চেষ্টা করা হয়েছে, এবং একই প্রক্রিয়া অন্যান্য আপাত সাংঘর্ষিক হাদিসের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে।
তথ্যসূত্রঃ
[1] সহিহ মুসলিম, হাদিস ৩১৫ : https://sunnah.com/muslim:315a
[2] উল্লেখ্য, এক্স-ওয়াই ক্রোমোজোম থাকলেই যে সন্তান পুরুষ লিঙ্গের বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করবে, ব্যাপারটা তা নয়। ওয়াই-ক্রোমোজোমে SRY নামে একটি জিন থাকে, ভ্রূণ বিকাশের মোটামুটি সপ্তম সপ্তাহের এই জিনের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পাওয়া শুরু করে। এর ফলে সন্তানের মধ্যে ক্রমান্বয়ে পুরুষ লিঙ্গের বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন হয়। এই ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে এই আর্টিকল দেখতে পারেন—
https://www.nature.com/scitable/topicpage/genetic-mechanisms-of-sex-determination-314/
[3] ওহী এবং ‘আক্বলের সম্পর্ক বিষয়ে ইবন তাইমিয়ার বিস্তারিত বক্তব্য পাওয়া যাবে এই বইতে—El-Tobgui, C.S., 2019. Ibn Taymiyya on Reason and Revelation: A Study of Darʾ taʿāruḍ al-ʿaql wa-l-naql (Vol. 111). Brill.
[4] হাদিসের সাথে বৈজ্ঞানিক তথ্যের আপাত সংঘাত নিরসনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা এই প্রবন্ধে দেওয়া আছে—Zaman, M., 2025. On the Conflict between Science and Hadith: A Framework for Navigating Epistemological Tensions. Journal of Islamic Sciences, p. 59
[5] ৪ নং তথ্যসূত্র দ্রষ্টব্য, পৃ ৬৮
[6] ৪ নং তথ্যসূত্র দ্রষ্টব্য, পৃ ৬৬
[7] ৪ নং তথ্যসূত্র দ্রষ্টব্য, পৃ ৬৬
[8] সহিহ মুসলিম, হাদিস ২৩৬২ https://sunnah.com/muslim:2362 , এবং সুনান ইবন মাজাহ, হাদিস ২৪৭১ https://sunnah.com/ibnmajah:2471
[9] আরবিতে মূল বক্তব্য—
وبهذا الحديث، برواياته المختلفة، يوصّل النبي - صلى الله عليه وسلم - أصلاً عظيماً في الشريعة، ويبيّنه لنا، ويشعرنا بأن بعض أفراد الأمة قد يكونون أحياناً أعلم منه - صلى الله عليه وسلم - بما يتقنونه من أمور الدنيا، والمقصود أهل الخبرة في كل فن وصناعة، وأنه لا داعيَ شرعاً لالتفاتهم إلى ما يصدر عنه - صلى الله عليه وسلم - من ذلك إلاّ كما يلتفتون إلى قول غيره من الناس.
[10] ক্বাদি ইয়াদ রচিত এই গ্রন্থটির নাম আশ-শিফা বি তা’রিফ হুক্বুক্ব আল-মুস্তাফা। মূল লেখায় উল্লিখিত উদ্ধৃতিটি আয়েশা বিউলির অনুবাদ থেকে নেওয়া হয়েছে (পৃ ৩৪৯)।
[11] শাহ ওয়ালিউল্লাহর (র.) গ্রন্থটির নাম হুজ্জাতুল্লাহ আল-বালিগা। বইয়ের পঁচাত্তরতম অধ্যায়ে এই বিষয়টির আলোচনা আছে।
[12] ১০ নং তথ্যসূত্র দ্রষ্টব্য, পৃ ৩৫০
[13] ১০ নং তথ্যসূত্র দ্রষ্টব্য, পৃ ৩৫০
[14] পার্থিব বা দুনিয়াবি বিষয়ে রাসুলুল্লাহর (ﷺ) কথা ও কাজের বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে বিস্তারিত আলোচনা এসেছে মুহাম্মাদ সুলাইমান আল-আশক্বারের গ্রন্থে, যার নাম আফ’আল আর-রাসূল ﷺ ওয়া দালালাতুহা ‘আলা আল-আহকামুশশারী’আহ। বইটি মূলত লেখকের তাঁর পিএইচডি থিসিস ছিল। এই লেখার প্রাসঙ্গিক অংশের আলোচনা শুরু হয়েছে এখান থেকে— http://shamela.ws/book/31471/232#p1
[15] সহিহ মুসলিম, হাদিস ৩১৫: https://sunnah.com/muslim:315a
[16] সহিহ বুখারি, হাদিস নং ৪৪৮০ https://sunnah.com/bukhari:4480
[17] হুমাইদ (র.) থেকে যে আটজন হাদিসটা বর্ণনা করেছেন, তাঁদের একজনের বর্ণনায় আবার লিঙ্গের উল্লেখ আছে। কিন্তু যেহেতু একই উৎস থেকে বাকি সাতজন বর্ণনাকারীই সাদৃশ্যের কথা বলেছেন, কাজেই ধরে নেওয়া যায় এই একক বর্ণনার শব্দচয়নে ভুল হয়েছে।
[18] এই হাদিসের আরেকটি রিওয়ায়াত আছে, সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাসের (রা.) বর্ণনায়। কিন্তু তাঁর পক্ষে এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হওয়া সম্ভব নয়, কারণ এই ঘটনা ঘটেছে হিজরতের পরপর, আর এই সাহাবীর জন্মই হয়েছিল হিজরতের মাত্র তিন বছর আগে। কাজেই তিনি তাঁর বর্ণনাটি অন্য কারো কাছ থেকে শুনেছেন, এটা তাঁর নিজের দেখা ঘটনা নয়।
[19] আত-তুরুক্ব আল-হুকুমিয়াহ ফিস সিয়াসাহ আশ-শর’ঈয়্যাহ, উক্তিটি নেওয়া এই অংশ থেকে— https://shamela.ws/book/18159/682#p1
[21] মাফাতিহুল গাইব, প্রাসঙ্গিক অংশটির সূত্র - https://tafsir.app/alrazi/29/28
[22] তবে এর ব্যতিক্রম আছে। কিছু ক্ষেত্রে মা ও বাবার বৈশিষ্ট্যের মাঝামাঝি কিছু একটা প্রকাশ পায় (incomplete dominance), আবার অন্যান্য ক্ষেত্রে মা ও বাবার বৈশিষ্ট্য দু’টোই একই সাথে প্রকাশ পায় (codominance)। তবে মানুষের জিনেটিক্সের ক্ষেত্রে এগুলো সবই ব্যতিক্রম, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দুই অ্যালিলের মধ্যে একটি থাকে ডমিনেন্ট, একটি রেসেসিভ, এবং ডমিনেন্টটির প্রকাশ ঘটে। এই ব্যাপারগুলো নিয়ে বিশদভাবে জানতে দেখুন— https://www.nature.com/scitable/topicpage/genetic-dominance-genotype-phenotype-relationships-489/
[23] কিছু ক্ষেত্রে শিশুর মধ্যে এমন বৈশিষ্ট্য থাকে, যা বাবা ও মা কারো মতই নয়। এসব ক্ষেত্রে সে বাবা ও মা উভয়ের কাছ থেকেই রেসেসিভ অ্যালিলটি লাভ করে। এই পরিস্থিতির আলোচনাও অন্য হাদিসে এসেছে, সহিহ বুখারির ৬,৮৪৭ নং হাদিসটি দেখুন— https://sunnah.com/bukhari:6847
[24] সুনান ইবন মাজাহ, হাদিস নং ৬০১ https://sunnah.com/ibnmajah:601
[26] শাহ ওয়ালিউল্লাহর (র.) গ্রন্থটির নাম হুজ্জাতুল্লাহ আল-বালিগা। বইয়ের পঁচাত্তরতম অধ্যায়ে এই বিষয়টির আলোচনা আছে।
[27] পার্থিব বা দুনিয়াবি বিষয়ে রাসুলুল্লাহর (ﷺ) কথা ও কাজের বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে বিস্তারিত আলোচনা এসেছে মুহাম্মাদ সুলাইমান আল-আশক্বারের গ্রন্থে, যার নাম আফ’আল আর-রাসূল ﷺ ওয়া দালালাতুহা ‘আলা আল-আহকামুশশারী’আহ। বইটি মূলত লেখকের তাঁর পিএইচডি থিসিস ছিল। এই লেখার প্রাসঙ্গিক অংশের আলোচনা শুরু হয়েছে এখান থেকে— http://shamela.ws/book/31471/232#p1
[28] প্রাগুক্ত
[29] সুনান ইবন মাজাহ, হাদিস নং ২০১১ https://sunnah.com/ibnmajah:2011