Pray for the world economy

আল কুরআনে সুরা লাহাবে আবু লাহাবের ব্যাপারে অভিশাপপূর্ণ বাণী প্রসঙ্গ

 

নাস্তিক প্রশ্নঃ কুরআনে রয়েছে 'আবু লাহাব' নামক ব্যক্তির ব্যাপারে অভিশাপপূর্ণ বাণী। একজন সৃষ্টিকর্তার পক্ষে কি এটি হাস্যকর নয়? (আস্তাগফিরুল্লাহ)  

 

উত্তরঃ অমুসলিম এবং নাস্তিকদের করা যুক্তিসঙ্গত (!) প্রশ্নগুলোর মধ্যে এটিও বেশ বিখ্যাত। যুক্তিসঙ্গত এ জন্য বললাম যে, কুরআন যদি সৃষ্টিকর্তার বাণী হয়ে থাকে, যদি এটি মানবজাতির জন্য পথনির্দেশক হয়, তাহলে কি করে এতে কেবলমাত্র একজন মানুষকে উদ্দেশ্য করে সম্পূর্ণ একটি সূরা নাযিল হয়? এটি বোঝার জন্য তৎকালীন আরবের সামাজিক অবস্থা এবং আবু লাহাবের ভূমিকা পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।

 

[১]

তৎকালীন সেই অরাজকতা, বিশৃঙ্খলতার সময়েও আরবের লোকেরা কিছু নির্দিষ্ট নীতি কঠোরভাবে মেনে চলতো। আরবীয় সমাজের নৈতিক মূল্যবোধের মধ্যে আত্মীয়-স্বজনদের সাথে সদ্ব্যবহার ছিল অত্যন্ত গুরুত্বের অধিকারী। যা কিছুই হোক নিজের বংশের কাউকে শত্রুর হাতে তুলে দেয়া যাবে না- এটা ছিল তাদের নীতি। তারা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করাকে মহাপাপ মনে করত। রাসূল (সা) যখন ইসলামের দাওয়াত নিয়ে এগিয়ে এলেন তখন কুরাইশ গোত্রের অন্যান্য পরিবার ও তাদের সর্দাররা তাঁর কঠোর বিরোধিতা করলেও আরবের এ প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রভাবে বনী হাশেম ও বনী মুত্তালিব কেবল তাঁর বিরোধিতা থেকে বিরতই থাকেন নি, বরং প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়ে এসেছেন। অথচ তাদের অধিকাংশই তাঁর নবুওয়াতের প্রতি ঈমান আনে নি। কুরাইশের অন্যান্য পরিবারের লোকেরাও রাসূল (সা)-এর প্রতি সমর্থন দেয়াকে নৈতিকভাবে যথার্থ মনে করতো এবং তাদেরকে এই বলে ধিক্কার দেয় নি যে, ‘তোমরা আমাদের পৈতৃক ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছো!’ জাহেলী যুগের আরবরাও এই নৈতিক আদর্শকে এতোটা মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখত। তবে কেবলমাত্র একজন ব্যক্তি, ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ এবং শত্রুতায় অন্ধ হয়ে এই মূলনীতি লঙ্ঘন করে। তিনি আবু লাহাব, রাসূল (সা)-এর চাচা। আসল নাম আবদুল উয্‌যা।

 

প্রাথমিক অবস্থায় ইসলামের দাওয়াত ছিল গোপনে। এরপর যখন রাসূল (সা) এর প্রতি নিম্নোক্ত আয়াতটি নাযিল হল,

আর আপনি আপনার গোত্রের নিকট আত্মীয়দের ভীতি প্রদর্শন করুন। [1]

 

তখন রাসূল (সা) সাফা পর্বতে উঠে সকলকে ডাক দিয়ে একত্রিত করলেন। রাসূল (সা) বললেন, “আমি যদি বলি যে একটি শত্রুদল ক্রমশই এগিয়ে আসছে এবং সকাল বিকাল যে কোনো সময় তোমাদের উপর ঝাপিয়ে পড়বে। তোমরা কি আমার কথা বিশ্বাস করবে? সবাই এক বাক্যে বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই করবো।’ তখন রাসূল (সা) বললেন, “আমি (শিরক ও কুফরের কারণে আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে নির্ধারিত শাস্তি) এক ভীষণ আযাব সম্পর্কে তোমাদেরকে সতর্ক করছি।” একথা শুনে আবু লাহাব বলল, “ধ্বংস হও তুমি! এজন্যই কি আমাদেরকে একত্রিত করেছো?” একথা বলে তিনি রাসূল (সা)-কে পাথর মারতে উদ্যত হয়। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সূরা লাহাব অবতীর্ণ হয়।  [2]

 

ইবনে যায়েদ বর্ণিত এক হাদিসে বলা হয়েছে, আবু লাহাব রাসূল (সা) কে একদিন জিজ্ঞেস করলো, ‘যদি আমি তোমার দ্বীনকে গ্রহণ করি, তাহলে আমি এর বদলে কি পাবো?’ তিনি জবাব দিলেন, অন্যান্য ঈমানদাররা যা পাবেন, আপনিও তাই পাবেন।’ আবু লাহাব বললো, ‘আমার জন্য বাড়তি কোনো মর্যাদা নেই?’ রাসূল (সা) বললেন, ‘আপনি কি চান?’ আবু লাহাবের উত্তর ছিল, ‘সর্বনাশ হোক এ দ্বীনের যেখানে আমি ও অন্যান্য লোকেরা একই পর্যায়ভুক্ত হবে?’ [3]

 

মক্কায় আবু লাহাব ছিল রাসূল (সা)-এর নিকটতম প্রতিবেশী। এছাড়াও হাকাম ইবনে আস, উকবা ইবনে আবু মুঈত, আদী ইবনে হামরা এবং ইবনুল আসদায়েল হুযালীও তাঁর প্রতিবেশী ছিল। এরা কেউই রাসূল (সা)-কে এক মুহূর্তের জন্যেও স্বস্তি দিতো না। রাসূল (সা) যখন নামায দাড়াতেন, তখন তাঁরা তাঁর উপর ছাগলের নাড়িভুঁড়ি নিক্ষেপ করতো, যখন রান্না হতো তখন হাড়ির উপর ময়লা ছুড়ে মারতো। এছাড়া আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামিল রাসূল (সা)-এর দরজার সামনে কাঁটাগাছের ডালপালা ছড়িয়ে রেখে দিয়ে যেত যাতে রাসূল ও সন্তানেরা আহত হয়। এটা ছিল রুটিনমাফিক আচরণ।  [4]

 

নবুওয়াত লাভের পূর্বে রাসূল (সা) তাঁর দুই মেয়ে রুকাইয়া এবং উম্মে কুলসুমকে আবু লাহাবের দুই পুত্র উতবা এবং উতাইবার সাথে বিয়ে দেন। নবুওয়াতের পর রাসূল (সা) যখন ইসলামের দাওয়াত দেয়া শুরু করেন, তখন আবু লাহাব তাঁর পুত্রদের রাসূলের কন্যাদের তালাক দিতে বাধ্য করে- ‘তোমরা মুহাম্মদের মেয়েদের তালাক না দিলে আমার পক্ষ থেকে তোমাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হারাম হয়ে যাবে।’  [5]

 

রাসূল (সা)-এর প্রথম পুত্র কাসেমের মৃত্যুর কিছুদিন পর তাঁর দ্বিতীয় পুত্র আবদুল্লাহরও মৃত্যুর হয়। এ খবরেই আবু লাহাব ভাতিজার সঙ্গ দেয়া তো দূরে থাক, তিনি আনন্দে আত্মহারা হয়ে দৌড়ে কুরাইশ সর্দারদের কাছে গিয়ে বলে, “শোনো, আজ মুহাম্মদের নাম নিশানা মিটে গেছে!”

 

রাসূল (সা) যেখানেই ইসলামেই দাওয়াত দিতে যেতেন, তিনি সেখানেই তাঁকে মিথ্যাবাদী বলে প্রচার করতো। রবী’আ ইবনে আব্বাদ (রা) বলেন, “আমি রাসূল (সা) কে জাহিলিয়াতের যুগে যুল-মাজায বাজারে দেখলাম, তিনি বলছিলেন, “হে মানব সম্প্রদায়! তোমরা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্‌ বলো, তোমরা সফলকাম হবে।” আর মানুষ তাঁর চারপাশে ভীড় জমাচ্ছিল। ওদিকে পিছন দিক থেকে গৌর বর্ণ টেরা চোখবিশিষ্ট সুন্দর চেহারার এক লোক তাঁকে পাথর মেরে চলেছে আর রাসূল (সা) এর গোড়ালি রক্তে ভিজে যাচ্ছিল আর সেই লোক বলছিল, ‘এ লোকটি ধর্মত্যাগী, মিথ্যাবাদী।’ রাসূল (সা) যেখানেই যেতেন, লোকটি তাঁর পেছন পেছন সেখানেই যেতো। তারপর লোকদের এ লোকটি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। লোকেরা বললো, এটি তাঁরই চাচা আবু লাহাব।” [6]

 

নবওয়াতের সপ্তম বছরে কুরাইশদের সমস্ত পরিবার মিলে বনী হাশেম এবং বনী মুত্তালিব পরিবারকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বয়কট করে। এ সময় একমাত্র আবু লাহাবই নিজের পরিবার ও বংশকে কোনো প্রকার সমর্থন দেয়া তো দূরে থাক উল্টো কাফিরদের সাথে জোট বেঁধে সব থেকে আক্রমণাত্মক আচরণ করেছিল। মক্কার বাইরে থেকে কোনো বাণিজ্য কাফেলা এলে আবু তালেবদের কেউ তাদের কাছ থেকে খাদ্য দ্রব্য কিনতে গেলে আবু লাহাব চিৎকার করে বলতো, ‘ওদের কাছ থেকে এত বেশি দাম চাও যাতে ওরা কিনতে না পারে। এজন্য তোমাদের যত ক্ষতি হয়, আমি দেবো।’ তখন তারা বিরাট দাম হাঁকাত। এ বয়কট ৩ বছর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এ সময় বনী হাশেম এবং বনী মুত্তালিবকে বহু সময় অনাহারে থাকতে হয়েছে।  [7]

 

[২]

ধরুন, আপনি একজন সুপার হিউম্যান দাবিদার। একদিন আপনি কাউকে ভবিষ্যৎ বাণী করলেন, “শীঘ্রই শাকিল সাহেব ধ্বংস হয়ে যাবে। তার ধনসম্পদ, সন্তান কোনো কিছুই কাজে আসবে না। তার মৃত্যু হবে খুবই করুণ।” এখন শাকিল সাহেব যদি সুন্দরভাবে বেঁচে যায়, তাহলে কিন্তু আপনার ভবিষ্যৎবাণী মিথ্যা হয়ে যায়। আপনার উপর মানুষের যে আস্থা ছিল সব কিছুই এক মুহূর্তে তখন শেষ হয়ে যাবে। মানুষ তখন আর আপনার কথাকে বিশ্বাস করবে না, আপনাকে জানবে একজন ভন্ড হিসেবে। 

 

আমরা যেসব দুর্বল ঈমানের মুসলমানেরা যে সূরা লাহাব নিয়ে অস্বস্তিতে থাকি, সেই একই সূরা তিলওয়াত করে সাহাবীরা তাঁদের ঈমান চাঙ্গা করতেন। কারণ এটা কুরআনের ভবিষ্যৎবাণী সংশ্লিষ্ট একটি সূরা যেটা নাযিল তার মৃত্যুর বেশ কয়েক বছর আগে। “ধ্বংস হোক আবু লাহাবের দু’হাত।” (সূরা লাহাব ১১১: ১), এটা আসলে কোনো ধিক্কার নয়, এটা এক প্রকার ভবিষ্যৎবাণী। এখানে ভবিষ্যতে যে ঘটনাটি ঘটবে তাকে অতীতকালের অর্থ প্রকাশক শব্দের সাহায্যে বর্ণনা করা হয়েছে। যার অর্থ, তার ধ্বংস হওয়া এতোটাই নিশ্চিত যেন তা হয়ে গেছে। আর হাত ভেঙে যাওয়া অর্থ শরীরের কোনো অংগ- হাত ভেঙে যাওয়া নয়। বরং কোনো ব্যক্তি যে উদ্দেশ্য সম্পন্ন করার জন্য সম্পূর্ণ শক্তি নিয়োগ করে, তাতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে যাওয়াকেই এখানে বুঝানো হয়েছে। [8] যার সত্যতা আমরা দেখি বদর যুদ্ধের পর।

 

আবু লাহাবের সামনে রাসূল (সা)-কে ভন্ড প্রমাণ করার খুব সহজ একটা রাস্তা ছিল, সেটা হলো মুসলমান হয়ে যাওয়া। কারণ তিনি মুসলিম হয়ে গেলেই মুহাম্মদ (সা) ভন্ড প্রমাণিত হয়ে যান। কিন্তু তিনি যে সেটা হবেন না এবং রাসূল (সা) যে সত্য নবী সেটি তো আবু লাহাবের মৃত্যু আর সূরা লাহাবের নিশ্চয়তা প্রদানই তা প্রমাণ করে। এ সুরাটি নাযিল হওয়ার সাত আট বছর পরই বদর যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। এই যুদ্ধে কুরাইশদের অধিকাংশ বড় বড় সর্দারই নিহত হয়। মজার ব্যাপার হলো আবু লাহাব কিন্তু এই যুদ্ধে অংশগ্রহণই করে নি! সে নিজে না গিয়ে তার পক্ষ থেকে আস ইবনে হিশামকে (আবু জাহেলের ভাই) পাঠায়। তাকে এই কথা বলে সমঝোতা করা হয় যে, তার কাছে সে যে ৪০০০ দিরহাম পেতো সেটা এর মাধ্যমে পরিশোধ হয়ে যাবে। বোঝাই যাচ্ছে কি পরিমাণ অর্থলিপ্সু আর কাপুরুষ ছিল সে। যুদ্ধের ফলাফল শোনার পর তার দেহে ভয়ঙ্কর রকম ফুসকুড়ি দেখা দেয়। রোগ সংক্রমণের ভয়ে পরিবারের লোকেরা তাকে ছেড়ে পালিয়ে যায়। মৃত্যুর পর ৩ দিন পর্যন্ত তার ধারে কাছে কেউ ঘেসে নি। তার শরীরে পচন ধরে যায়। ফলে এক সময় লোকেরা তার ছেলেদেরকে ধিক্কার দিতে থাকে। তখন তারা মজুরীর বিনিময়ে লাশ দাফন করার জন্য কয়েকজন হাবশিকে নিয়োগ করে যারা তার লাশ মক্কার বাইরে দাফন করে আসে।  [9]

 

যে ব্যক্তির ধৃষ্টতার কারণে এতোবার নির্যাতিত হয়েছেন আমাদের প্রিয় নবী, তার পরিচয় তুলে ধরার জন্য কুরআনে কেবলমাত্র একটি ছোট সূরা আছে, এতে এতো অবাক হওয়ার কি আছে?

 

অনেকে আরো একটি প্রশ্ন তোলে যে - আল কুরআন তো বিশ্বজগতের জন্য উপদেশ। এই সুরায় কী উপদেশ রয়েছে? 

উত্তরে আমরা বলিঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসুল(সা) এর সাথে শত্রুতা ও বিদ্রোহের পরিনতি যে কী হতে পারে, এই সুরা তো তারই সাক্ষ্য বহন করছে। আল্লাহর রাসুলের(সা) শত্রুর ভয়ঙ্কর পরিনতির ব্যাপারে এখানে একটি ভবিষ্যতবাণী রয়েছে এবং ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে এ ভবিষ্যতবাণী সত্যে পরিনত হচ্ছে। কাজেই বিবেকবান ব্যক্তি এ সুরা থেকে যে উপদেশ লাভ করতে পারে তা হল - আল্লাহ ও রাসুল(সা) এর প্রতি কুফরী ও বিরুদ্ধাচরণ করা ঠিক নয়। 

 

 

তথ্যসূত্রঃ

[1] সূরা আশ-শু’আরা ২৬: ২১৪

[2] সহীহ বুখারী ৪৯৭১, ৪৯৭২, সহীহ মুসলিম ২০৮, জামে’ তিরমিজি ৩৩৬৩, ফাতহুল বারী ৮/৬০৯

[3]  ইবনে জারীর

[4]  বায়হাকী, ইবনে আবী হাতেম, ইবনে জারীর, ইবনে আসাকির, ইবনে হিশাম

[5]   ইবনে ইসহাক ও ইবনে সা’দ

[6]  মুসনাদে আহমাদ ৪/৩৪১, তিরমিজি 

[7]   ইবনে সা’দ ও ইবনে হিশাম

[8]  কুরতুবী, ফাতহুল কাদীর

[9]  ইবনে ইসহাক