নাস্তিক প্রশ্নঃ
মুহম্মদের কথায়, কবিতা দিয়ে মাথা ভর্তি করার চেয়ে পুঁজ দিয়ে উদর পূর্ণ করা উত্তম (Sahih Bukhari 8:73:175) ! মানুষের প্রতিভাকে হত্যা করার ব্যাপারে মুহম্মদের অবদান ভেবে দেখেছেন?
উত্তরঃ
ইসলামী শরিয়তে ইবাদতের ক্ষেত্রে মূলনীতি হচ্ছেঃ কোনো কিছু করা যাবে না যদি না তা কুরআন বা হাদিসে বলা থাকে। আর দুনিয়াবী কাজের ব্যাপারে মূলনীতি হচ্ছেঃ সব কিছুই করা যাবে যদি না কুরআন বা হাদিসে এ ব্যাপারে নিষেধ থাকে। [1] কবিতা লেখা একটি দুনিয়াবী কাজ। সকল প্রকার কবিতা জায়েজ যদি না তাতে হারাম উপাদান থাকে। [2] কবিতার ব্যাপারে হাদিসে বেশ কিছু নির্দেশনা দেখা যায় যার দ্বারা আমরা বুঝতে পারি কবিতা জায়েজ নাকি নাজায়েজ। চট করে অপ্রাসঙ্গিকভাবে একটি হাদিস দেখিয়ে কবিতার ব্যাপারে ইসলামের অবস্থান বলে দেয়া মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আমরা এই প্রবন্ধে কবিতার ব্যাপারে কুরআন, সুন্নাহ, সাহাবী ও আলেমদের বিস্তারিত অভিমত উল্লেখ করবো যার দ্বারা বোঝা যাবে অভিযোগকারীদের দাবি সঠিক নাকি ভুল।
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم: الشِّعْرُ بِمَنْزِلَةِ الْكَلاَمِ، حَسَنُهُ كَحَسَنِ الْكَلامِ، وَقَبِيحُهُ كَقَبِيحِ الْكَلامِ.
অর্থঃ আবদুল্লাহ ইবন আমর(রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেনঃ কবিতাও কথারই মতো (কথার সমষ্টি)। রুচিসম্মত কবিতা উত্তম কথাতুল্য এবং কুরুচিপূর্ণ কবিতা কুরুচিপূর্ণ কথাতুল্য। [3]
عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا، أَنَّهَا كَانَتْ تَقُولُ: الشِّعْرُ مِنْهُ حَسَنٌ وَمِنْهُ قَبِيحٌ، خُذْ بِالْحَسَنِ وَدَعِ الْقَبِيحَ، وَلَقَدْ رَوَيْتُ مِنْ شِعْرِ كَعْبِ بْنِ مَالِكٍ أَشْعَارًا، مِنْهَا الْقَصِيدَةُ فِيهَا أَرْبَعُونَ بَيْتًا، وَدُونَ ذَلِكَ.
অর্থঃ আয়িশা(রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলতেন, কবিতার মধ্যে কতক ভালো এবং কতক নিকৃষ্ট। তুমি তার ভালোটা গ্রহণ করো এবং নিকৃষ্টটা পরিহার করো। আমার কাছে কা’ব ইবনে মালেক(রা.) এর এমন কবিতাও বর্ণনা করা হয়েছে, যার মধ্যকার একটি কাসীদায় চল্লিশ বা তার কিছু কম সংখ্যক চরণ ছিলো। [4]
عَنْ خَالِدٍ هُوَ ابْنُ كَيْسَانَ قَالَ: كُنْتُ عِنْدَ ابْنِ عُمَرَ، فَوَقَفَ عَلَيْهِ إِيَاسُ بْنُ خَيْثَمَةَ قَالَ: أَلاَ أُنْشِدُكَ مِنْ شِعْرِي يَا ابْنَ الْفَارُوقِ؟ قَالَ: بَلَى، وَلَكِنْ لاَ تُنْشِدْنِي إِلاَّ حَسَنًا. فَأَنْشَدَهُ...
অর্থঃ খালিদ ইবনে কায়সান(র.) বলেন, আমি ইবন উমার(রা.)-এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। তখন ইয়াস ইবনে খায়ছামা(র.) তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে বলেন, হে ফারুক তনয়! আমার কিছু কবিতা কি আপনাকে আবৃত্তি করে শুনাবো? তিনি বলেন, হাঁ, তবে কেবল উত্তম কবিতাই শুনাবে। তিনি তাঁকে তা আবৃত্তি করে শুনাতে থাকেন। … [5]
অর্থাৎ কবিতার হুকুম সাধারণ কথার মতোই। উত্তম কথার মতো উত্তম কবিতাও ইসলামে উত্তম বলে গণ্য হয়। আর ক্ষতিকর জিনিসে পূর্ণ কবিতা ইসলামে খারাপ বলে গণ্য হয়। [6] রাসুলুল্লাহ(ﷺ) স্বয়ং কিছু কবিতার ও কবির প্রশংসা করেছেন। যা দ্বারা ইসলামবিরোধীদের অভিযোগের অসারতা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ হয়।
ان من الشعر لحكمة
অর্থঃ নিশ্চয়ই কোনো কোনো কবিতায় প্রজ্ঞা রয়েছে। [7]
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، أَنَّ رَجُلاً، أَوْ أَعْرَابِيًّا، أَتَى النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم فَتَكَلَّمَ بِكَلاَمٍ بَيِّنٍ، فَقَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم: إِنَّ مِنَ الْبَيَانِ سِحْرًا، وَإِنَّ مِنَ الشِّعْرِ حِكْمَةً.
অর্থঃ ইবন আব্বাস(রা.) থেকে বর্ণিত। এক ব্যক্তি বা এক বেদুইন নবী(ﷺ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় কথাবার্তা বললো। নবী(ﷺ) বলেনঃ কথায়ও যাদুকরী প্রভাব থাকে এবং কবিতাও প্রজ্ঞাপূর্ণ হতে পারে। [8]
عَنْ عَمْرِو بْنِ الشَّرِيدِ، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ رَدِفْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَوْمًا فَقَالَ " هَلْ مَعَكَ مِنْ شِعْرِ أُمَيَّةَ بْنِ أَبِي الصَّلْتِ شَيْئًا " . قُلْتُ نَعَمْ قَالَ " هِيهِ " . فَأَنْشَدْتُهُ بَيْتًا فَقَالَ " هِيهِ " . ثُمَّ أَنْشَدْتُهُ بَيْتًا فَقَالَ " هِيهِ " . حَتَّى أَنْشَدْتُهُ مِائَةَ بَيْتٍ
অর্থঃ আমর ইবনু শারীদ(র.) এর সনদে তাঁর পিতা [শারীদ (রা.)] হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন আমি রাসুলুল্লাহ(ﷺ) এর (বাহনে) সফরসঙ্গী হলাম। তিনি বললেন, তোমার স্মৃতিতে (কবি) উমাইয়াহ ইবনু আবুস সালত এর কবিতার কোন কিছু আছে কি? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, পড়ো। আমি তখন তাঁকে একটি লাইন আবৃত্তি করে শুনলাম। তিনি বললেন, বলতে থাকো, তখন আমি তাঁকে আরও একটি শ্লোক পাঠ করে শুনালাম। তিনি আবার বললেন, বলতে থাকো। শেষ অবধি আমি তাঁকে ১০০ টি ছন্দ আবৃত্তি করে শুনালাম। [9]
উল্লেখ্য যে, উমাইয়াহ ইবনু আবুস সালত ছিলেন জাহেলী যুগের একজন কবি। কিন্তু কবিতায় উত্তম উপাদান থাকায় এবং অনিষ্টকর উপাদান না থাকায় স্বয়ং রাসুলুল্লাহ(ﷺ) তাঁর কবিতা বেশ সময় নিয়ে শুনেছেন। যেখানে স্বয়ং নবী(ﷺ) থেকে এভাবে কবিতা শোনার বিবরণ পাওয়া যায়, মানুষ এরপর কিভাবে বলতে পারে যে ইসলামে কবিতা হারাম অথবা ইসলাম মানুষের প্রতিভাকে হত্যা করে?
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ " أَشْعَرُ كَلِمَةٍ تَكَلَّمَتْ بِهَا الْعَرَبُ كَلِمَةُ لَبِيدٍ أَلاَ كُلُّ شَىْءٍ مَا خَلاَ اللَّهَ بَاطِلٌ
অর্থঃ আবূ হুরাইরাহ(রা.) এর সনদে নবী(ﷺ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আরবদের কবিতামালার মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাব্যময় বাণী হচ্ছে লাবীদের এ উক্তি। যেমন أَلاَ كُلُّ شَىْءٍ مَا خَلاَ اللَّهَ بَاطِلٌ "জেনে রেখো, আল্লাহ ছাড়া যা কিছু রয়েছে সব বাতিল।" [10]
নবী করিম(ﷺ) নিজে কবি ছিলেন না। কিন্তু তিনিও মাঝে মাঝে কবিতা আবৃত্তি করতেন। সে কবিতাগুলো ছিল হয়তো সাধারণ কবিতা, অথবা আল্লাহর স্মরণপূর্ণ কবিতা।
عَنِ الْمِقْدَامِ بْنِ شُرَيْحٍ، عَنْ أَبِيهِ قَالَ: قُلْتُ لِعَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا: أَكَانَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَتَمَثَّلُ بِشَيْءٍ مِنَ الشِّعْرِ؟ فَقَالَتْ: كَانَ يَتَمَثَّلُ بِشَيْءٍ مِنْ شِعْرِ عَبْدِ اللهِ بْنِ رَوَاحَةَ: وَيَأْتِيكَ بِالأَخْبَارِ مَنْ لَمْ تُزَوِّدِ
অর্থঃ মিকদাম ইবনে শুরায়হ(র.) থেকে তাঁর পিতার সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আয়িশা(রা.)-কে বললাম, রাসুলুল্লাহ(ﷺ) কি উপমা দেয়ার জন্য কবিতা পাঠ করতেন? তিনি বলেন, তিনি আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহার এ কবিতা আবৃত্তি করে উপমা দিতেনঃ “যাকে তুমি দাওনি তোশা, খবর আনবে সে নিশ্চয়”। [11]
সহীহ বুখারীতে বারা’ বিন আযিব(রা.) হতে বর্ণিত আছে,
‘আমি রাসুলুল্লাহ(ﷺ)-কে খন্দকের মাটি বহনরত অবস্থায় প্রত্যক্ষ করেছি। এ মাটি বহন করার কারণে তাঁর দেহ মুবারক ধূলি ধূসরিত হয়ে উঠেছিল। এ অবস্থায় তাঁকে আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহার কবিতার নিম্নোক্ত চরণগুলো আবৃত্তি করতে শুনেছিলাম :
اللهم لولا أنت ما اهتدينا ** ولا تصـدقنـا ولا صلينــا
فأنزلن سكينـة علينـا ** وثبت الأقـدام إن لاقينــا
إن الألى رغبوا علينـا ** وإن أرادوا فتـنـة أبينـــا
অর্থ: ‘হে আল্লাহ! যদি তোমার অনুগ্রহ না হতো তাহলে আমরা হিদায়াতপ্রাপ্ত হতাম না, আমরা দান খায়রাত করতাম না এবং সলাত আদায় করতাম না। অতএব আমাদের প্রতি শান্তি বর্ষণ করো এবং কাফিরদের সঙ্গে যদি আমাদের মোকাবেলা হয় তাহলে আমাদেরকে ধৈর্য্যদান করিও। তারা আমাদের বিরুদ্ধে লোকদের প্ররোচিত করেছে। যদি তারা ফেৎনা সৃষ্টি করতে চায় তাহলে আমরা কখনই মাথা নত করব না।
বারা’ বিন আযিব বলেছেন, ‘শেষের শব্দগুলো রাসুলুল্লাহ(ﷺ)- অধিক টান দিয়ে উচ্চারণ করছিলেন, অন্য একটি বর্ণনায় কবিতাটির শেষাংশ ছিল নিম্নরূপ :
إن الألى قـد بغـوا علينـا ** وإن أرادوا فـتنـة أبينـا
অর্থঃ ‘তারা আমাদের উপর অত্যাচার করেছে এবং তারা যদি আমাদেরকে ফেৎনায় নিক্ষেপ করতে চায়, আমরা কখনই মাথা নত করে তা মেনে নেবো না।’ [12]
রাসুলুল্লাহ(ﷺ) এর সাহাবীদের অনেকেই কবিতা চর্চা করতেন। ইমাম শা'বী (রাহ.) বলেন,
كان ابو بكر شاعرا وكان عمر شاعرا وكان على شاعرا رضى الله عنهم
অর্থঃ আবু বকর(রা.) কবি ছিলেন। উমার (রা.)ও কবি ছিলেন। আর 'আলী(রা.)ও কবি ছিলেন।" [13]
তাঁদের মধ্যে বিশেষত আলী(রা.) এর কাব্যচর্চায় সুখ্যাতি রয়েছে। তিনি ছিলেন একজন সুবক্তা ও ভালো কবি। তাঁর কবিতার একটি ‘দিওয়ান’ পাওয়া যায় যাতে অনেকগুলো কবিতায় মোট ১৪০০ শ্লোক আছে। [14] সাহাবী-তাবীঈদের যুগে কাব্য চর্চাকে শিক্ষার একটি উপাদান হিসাবে গণ্য করা হতো।
حَدَّثَنِي عُمَرُ بْنُ سَلاَّمٍ، أَنَّ عَبْدَ الْمَلِكِ بْنَ مَرْوَانَ دَفَعَ وَلَدَهُ إِلَى الشَّعْبِيِّ يُؤَدِّبُهُمْ، فَقَالَ: عَلِّمْهُمُ الشِّعْرَ يَمْجُدُوا وَيُنْجِدُوا
অর্থঃ উমার ইবন সালাম(র.) থেকে বর্ণিত। আব্দুল মালিক ইবন মারওয়ান তার সন্তানদের আদব-কায়দা শিক্ষা দেয়ার জন্য শাবী(র.) এর নিকট সোপর্দ করেন। তিনি বলেন, এদের কবিতা শিক্ষা দিন, তাতে তারা উচ্চাভিলাসী ও নির্ভীক হবে। [15]
ইমাম শাফিঈ(র.) কাব্যচর্চার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। [16] তাঁর একটি সুবিখ্যাত কবিতার সংকলন রয়েছে। [17] ইসলামের মুবারক যুগে ইসলামী কবিতা ব্যতিতও নানা জায়েজ দুনিয়াবী বিষয়ে কাব্য চর্চার বিপুল পরিমাণে উদাহরণ পাওয়া যায়। সবগুলোর রেফারেন্স দিলে লেখার কলেবর বিশাল হয়ে যেতে পারে। আগ্রহীরা আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া গ্রন্থের ৭ম থেকে ১০ খণ্ডে খুঁজলে এগুলো পেয়ে যাবেন।
কুরআনের একটি সুরার নামকরণ করা হয়েছে কবিদের নামে। ২৬ নং সুরা শু’আরা (কবিগণ)। এ সুরাতে কবিদের নিন্দা করে একটি আয়াত আছে। এ আয়াতটি দেখিয়ে অনেকে বলতে চায় যে ইসলামে সব ধরণের কবি ও কবিতা নিন্দিত। আয়াতটি হচ্ছে –
وَالشُّعَرَاءُ يَتَّبِعُهُمُ الْغَاوُونَ
অর্থঃ আর বিভ্রান্তরাই কবিদের অনুসরণ করে। [18]
তাফসির ইবন কাসিরে আয়াতটি নাজিলের প্রেক্ষাপট উল্লেখ আছে। ইবন আব্বাস(রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসুল(ﷺ) এর যুগে একজন আনসারী ও একজন অন্য সম্প্রদায়ের লোক কবিতার মাধমে একে অন্যের নিন্দা করতে লাগছিলো। তাদের নিজ নিজ সম্প্রদায়ের কিছু মূর্খ লোক এই কাজে তাদেরকে সমর্থন দিচ্ছিলো। এর ভিত্তিতে আয়াতটি নাজিল হয়। [19] অর্থাৎ কিছু কবির অনিষ্টকর কাজ ও এর অনুসরণ করা কিছু লোকের ব্যাপারে আলোচ্য আয়াত। এতে মোটেও সকল প্রকারের কবি ও কবিতার কথা বলা হয়নি। যে আয়াতে একে অন্যের নিন্দাকারী ও এ কাজ সমর্থন করা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের কথা বলা হলো, সেই আয়াত দেখিয়ে ইসলামবিরোধীরা বলতে চায় যে ইসলামে নাকি সব কবিতা হারাম! মূলত এটা তাদের সীমাহীন অজ্ঞতারই পরিচায়ক। আলোচ্য আয়াতের প্রসঙ্গে আরো বর্ণিত আছে,
ইবন আব্বাস(রা.) থেকে বর্ণিত। “আর বিভ্রান্ত লোকেরাই কবিদের অনুসরণ করে। তুমি কি দেখো না যে, তারা প্রতিটি ময়দানে উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায় এবং এমন কথা বলে যা তারা করে না” (সুরা শু’আরাঃ ২২৪-২২৫) উপরোক্ত অংশ (মহামহিম আল্লাহ) মানসুখ (রহিত) করেছেন এবং নিম্নোক্ত অংশ ব্যতিক্রম করেছেন; মহান আল্লাহ বলেনঃ
“তবে তারা স্বতন্ত্র, যারা ঈমান এনেছে, সৎকাজ করেছে, আল্লাহকে পর্যাপ্ত স্মরণ করে এবং নির্যাতিত হওয়ার পর প্রতিশোধ গ্রহণ করে। নির্যাতনকারীরা অচিরেই জানতে পারবে তাদের গন্তব্য কিরূপ” (সুরা শুআরাঃ ২২৭)। [20]
রাসুল(ﷺ) এর যুগে অন্ধ গোত্রবিদ্বেষ, অশ্লীল প্রেম এবং নানা রকমের অনিষ্টকর জিনিস নিয়ে কবিতা আরবদের মাঝে খুবই প্রচলিত ছিল ছিল। বিভিন্ন হাদিসে অনিষ্টকর কবি ও কবিতার ব্যাপারে নিন্দাসূচক কথা এসেছে। ইসলামে কেবল সে সকল কবিতা নিষিদ্ধ যেগুলোতে হারাম ও অনিষ্টকর উপাদান আছে।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " لأَنْ يَمْتَلِئَ جَوْفُ الرَّجُلِ قَيْحًا يَرِيهِ خَيْرٌ مِنْ أَنْ يَمْتَلِئَ شِعْرًا " . قَالَ أَبُو بَكْرٍ إِلاَّ أَنَّ حَفْصًا لَمْ يَقُلْ " يَرِيهِ " .
অর্থঃ আবু হুরাইরা(রা.) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেনঃ কোনো লোকের পেট পুঁজ দিয়ে ভর্তি হয়ে যাওয়া যা তার পেট পঁচিয়ে বিনষ্ট করে দেয়, তা (পেট) কবিতায় ভর্তি হওয়ার চাইতে উত্তম।
বর্ণনাকারী আবু বাকর(র.) বলেন, তবে (আমার উস্তায বর্ণনাকারী) হাফ্স(র.) এর বর্ণনাতে (يَرِيهِ ) তথা ‘পঁচিয়ে বিনষ্ট করে দেয়’ কথাটি বলেননি। [21]
عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ: إِنَّ أَعْظَمَ النَّاسِ جُرْمًا إِنْسَانٌ شَاعِرٌ يَهْجُو الْقَبِيلَةَ مِنْ أَسْرِهَا، وَرَجُلٌ انْتَفَى مِنْ أَبِيهِ
অর্থঃ আয়িশা(রা.) থেকে বর্ণিত। নবী(ﷺ) বলেনঃ মানুষের মধ্যে মারাত্মক অপরাধী হলো সেই কবি যে সমগ্র গোত্রের নিন্দা করে এবং যে ব্যক্তি নিজ পিতাকে অস্বীকার করে। [22]
কোনো গোত্র বা সম্প্রদায়ের নিন্দাবাদ করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা একটি অনিষ্টকর কাজ। হাদিসে এই জাতীয় কবিতা লেখাকে অপরাধ বলে গণ্য করা হয়েছে। এমন নারী বা পুরুষের ব্যাপারে প্রেমের কবিতা লেখা জায়েজ নয় যে নারী বা পুরুষ ঐ কবির জন্য বৈধ নয়। কিন্তু নিজ স্বামী বা স্ত্রীকে নিয়ে ভালোবাসার কবিতা লেখা হালাল তো বটেই বরং সওয়াবের কাজ। [23] এমনকি নামহীন বা অচেনা (anonymous) কোনো নারীর কিছু সৌন্দর্যের দিকও কবিতায় প্রকাশ করা জায়েজ বলে আলেমগণ অভিমত প্রকাশ করেছেন – যদি না এতে অশ্লীলতা বা আপত্তিকর ভাষা না থাকে। কেননা কা’ব ইবন জুহাইর(রা.), হাসসান বিন সাবিত(রা.) প্রমুখ কবি-সাহাবীগণ রাসুলুল্লাহ(ﷺ) এর উপস্থিতিতে এমন কবিতা আবৃত্তি করেছেন। [24] হারাম জিনিস বাদে অন্য সকল জিনিস নিয়ে কবিতা লেখা যায়, সে ধরণের কবিতা লেখাকে পেশা হিসেবেও নেয়া যায়। ইমাম ইবনু কুদামা মাকদিসি(র.) বলেছেন, “কবিতা লেখা জায়েজ। এ নিয়ে ভিন্ন কোনো অভিমত নেই। এটাই সাহাবী ও আলেমদের অভিমত।” [25] ইবন হাজার(র.) এর মতে - যদি অতিমাত্রায় আবৃত্তি না করা হয়, মসজিদের ভেতর আবৃত্তি না করা হয়, যদি অন্যায়ভাবে কারো মানহানী না করা হয়, কারো মাত্রাতিরিক্ত প্রশংসা না করা হয়, মিথ্যাচার না থাকে এবং অশ্লীল প্রেমকাহিনী না থাকে – তাহলে কবিতা জায়েজ। ইবন আব্দুল বার(র.) কবিতা জায়েজ হবার ব্যাপারে আলেমদের ইজমা উল্লেখ করেছেন। [26] কাজেই কবি নজরুলের আল্লাহ ও রাসুল(ﷺ) এর স্তুতিমূলক কবিতাগুলো (যাতে শির্ক বা বিদআত নেই) ইসলামে উত্তম কাজ বলে বিবেচিত হতে পারে। একইভাবে জায়েজের সীমার মধ্যে থেকে শিক্ষামূলক, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমূলক এবং জীবনের নানা দিক নিয়ে কবিতা লেখা কিংবা পাঠ করা যেতেই পারে। ইসলাম কখনোই তা নিষেধ করে না।
উপরের আলোচনার আলোকে এটি পরিষ্কার হলো যে, ইসলামে মোটেও সব কবিতা নিষিদ্ধ নয়। ইসলামে ঢালাওভাবে সকল কবিতা বা সাহিত্যকর্ম নিষিদ্ধ – এটা একটা চরম অসত্য কথা। বরং যে সকল কবিতা বা সাহিত্যকর্মের দ্বারা অনিষ্ট হতে পারে, ইসলাম কেবল সেগুলোকে নিষিদ্ধ করেছে। মানুষের প্রতিভাকে বিনষ্ট করা মোটেও ইসলামের উদ্যেশ্য নয়। বরং মানবজাতির কল্যাণের জন্যই ইসলাম। এটা তারাই উপলব্ধি করতে পারে যারা নির্মোহভাবে ইসলাম সম্পর্কে জানার চেষ্টা করে।
তথ্যসূত্রঃ
[1] দেখুন শায়খ মুখতার আহমাদের এই আলোচনার ৩৫ সেকেন্ড থেকে ১ মিনিট ১৬ সেকেন্ড পর্যন্ত
https://www.youtube.com/watch?v=CA9w5BxkPTM&t=35s
[2] "Poetry in Islam" - Islamweb
https://www.islamweb.net/en/fatwa/86790/
[3] দারাকুতনী, আদাবুল মুফরাদ হাদিস নং : ৮৭৩ (সহীহ)
[4] আদাবুল মুফরাদ হাদিস নং : ৮৭৪ (সহীহ)
[5] আদাবুল মুফরাদ হাদিস নং : ৮৬৪ (দুর্বল)
[6] “Islam's position on poetry” - Islamweb
https://islamweb.net/en/fatwa/91021/
[7] সহীহ বুখারী, হাদিস নং : ৬১৪৫
[8] আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবন মাজাহ, মুসনাদ আহমাদ, ইবন হিব্বান, তহাবী, আদাবুল মুফরাদ হাদিস নং : ৮৮০ (সহীহ)
[9] সহীহ মুসলিম, হাদিস নং : ৫৭৭৮
[10] সহীহ মুসলিম, হাদিস নং : ৫৭৮১
[11] তিরমিযী, নাসাঈ, মুসনাদ আহমাদ, তহাবী, আদাবুল মুফরাদ হাদিস নং : ৮৭৫ (সহীহ)
[12] সহীহ বুখারী ২য় খন্ড ৫৮৯ পৃঃ; আর রাহিকুল মাখতুম–শফিউর রহমান মুবারকপুরী (তাওহীদ পাবলিকেশন্স), পৃষ্ঠা ৩৪৬-৩৪৭
[13] ইবনু আবী শাইবাহ, আল-আদাব, হাদিস নং : ৩৬৬ ও আল-মুসান্নাফ, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ১৭৩
[14] ■ কিতাবুল উমদাহ – ইবন রশীক ১/২১
■ আসহাবে রাসুলের জীবনকথা – মুহাম্মাদ আব্দুল মাবুদ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৫
[15] তারীখুল কাবীর, আবু হাতিম, ইবন হিব্বান, আদাবুল মুফরাদ হাদিস নং : ৮৮১
[16] "Poetic Jewels from Imam Al-Shafi'i - The Imam of Imams" - AUSTRALIAN ISLAMIC LIBRARY
https://www.australianislamiclibrary.org/imam-al-shafiis-poetry.html
[17] এখান থেকে সেটি পড়া ও ডাউনলোড করা যাবেঃ
https://archive.org/details/DiwanOfImamShafiiArabic
[18] আল কুরআন, শু’আরা ২৬ : ২২৪
[19] তাফসির ইবন কাসির, ৮ম খণ্ড (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), সুরা শু’আরার ২২৪ নং আয়াতের তাফসির, পৃষ্ঠা ৩৪৪
[20] আবু দাউদ, আদাবুল মুফরাদ হাদিস নং : ৮৭৯ (সহীহ)
[21] সহীহ মুসলিম, হাদিস নং : ৫৬৯৬
[22] ইবন মাজাহ হাদিস নং : ৩৭৬১, আদাবুল মুফরাদ হাদিস নং : ৮৮২ (সহীহ)
[23] Islam and Poetry - IslaQA Hanafi
https://islamqa.org/hanafi/albalagh/22351
[24] "Partaking in love poetry contest" - Islamweb
https://islamweb.net/en/fatwa/327949/
[25] ■ আল মুগনী ১০/১৭৬; কবিতার ব্যাপারে আলেমদের বিস্তারিত অভিমতের জন্য দেখুনঃ মাওসু’আহ আল ফিকহিয়্যাহ ২৬/১১৩-১১৭
■ “Ruling on earning money by publishing poetry” - islamQA Shaykh Muhammad Saalih al-Munajjid
https://islamqa.info/en/146652/
[26] "Partaking in love poetry contest" - Islamweb