অভিযোগঃ
ইসলাম ধর্মে নারী অশুভ বা নারীতে অমঙ্গল রয়েছে। মুহাম্মদ(ﷺ) বলেছেন, অমঙ্গল তিন বস্তুর মধ্যে - স্ত্রীলোক, গৃহ ও পশুতে।
জবাবঃ
এ সংক্রান্ত বিভিন্ন হাদিসঃ
১।
دَّثَنَا مُوسَى بْنُ إِسْمَاعِيلَ، حَدَّثَنَا أَبَانُ، حَدَّثَنِي يَحْيَى، أَنَّ الْحَضْرَمِيَّ بْنَ لاَحِقٍ، حَدَّثَهُ عَنْ سَعِيدِ بْنِ الْمُسَيَّبِ، عَنْ سَعْدِ بْنِ مَالِكٍ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم كَانَ يَقُولُ " لاَ هَامَةَ وَلاَ عَدْوَى وَلاَ طِيَرَةَ وَإِنْ تَكُنِ الطِّيَرَةُ فِي شَىْءٍ فَفِي الْفَرَسِ وَالْمَرْأَةِ وَالدَّارِ " .
অর্থঃ সা’দ ইবনু মালিক (রা.) থেকে বর্ণিতঃ রাসূলুল্লাহ(ﷺ) বলতেনঃ পেঁচা অশুভ নয়, ছোঁয়াচে রোগ নেই এবং কোন জিনিস অশুভ হওয়া ভিত্তিহীন। যদি কোন কিছুর মধ্যে অশুভ কিছু থাকতো তাহলে ঘোড়া, নারী ও বাড়ী এই তিন জিনিসের মধ্যে থাকতো। [1]
২।
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ " لاَ عَدْوَى وَلاَ طِيَرَةَ وَإِنَّمَا الشُّؤْمُ فِي ثَلاَثَةٍ الْمَرْأَةِ وَالْفَرَسِ وَالدَّارِ "
অর্থঃ আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রা.) থেকে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেনঃ সংক্রমণ ও অশুভ নেই; তবে (যদি থাকে) (শুভাশুভ) রয়েছে তিনটি বিষয়ে, স্ত্রী, ঘোড়া ও গৃহে। [2]
৩।
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ ـ رضى الله عنهما ـ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ " الشُّؤْمُ فِي الْمَرْأَةِ وَالدَّارِ وَالْفَرَسِ "
অর্থঃ আবদুল্লাহ ইবনু উমর (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেন, নিশ্চয়ই তোমাদের স্ত্রী, বাড়িঘর এবং ঘোড়ার ভিতরে অশুভের লক্ষণ আছে। [3]
বিভিন্ন হাদিস গ্রন্থে এ সংক্রান্ত বর্ণনা পাওয়া যায়। উপরের বর্ণনাগুলোই ঘুরেফিরে বিভিন্ন গ্রন্থে এসেছে।
হাদিসগুলো দেখিয়ে ইসলামবিরোধীরা দাবি করেন ইসলাম ধর্মে নারী এক প্রকার অশুভ বা অমঙ্গলজনক জীব। ইসলাম এভাবে নারীজাতিকে অবমাননা করেছে। আমরা এখন এহেন দাবির সত্যতা কতোটুকু তা যাচাই করে দেখবো।
আয়িশা(রা.) এর ব্যাখ্যাঃ
এ সংক্রান্ত বর্ণনার ব্যাপারে সম্মানিত উম্মুল মুমিনীন আয়িশা(রা.) থেকে বেশ কিছু আলোচনা পাওয়া যায়।
حدثنا عبد الله حدثني أبى ثنا يزيد قال أنا همام بن يحيى عن قتادة عن أبى حسان قال دخل رجلان من بنى عامر على عائشة فأخبراها ان أبا هريرة يحدث عن النبي صلى الله عليه و سلم انه قال : الطيرة من الدار والمرأة والفرس فغضبت فطارت شقة منها في السماء وشقة في الأرض وقالت والذي أنزل الفرقان على محمد ما قالها رسول الله صلى الله عليه و سلم قط إنما قال كان أهل الجاهلية يتطيرون من ذلك
تعليق شعيب الأرنؤوط : إسناده صحيح على شرط مسلم
অর্থঃ আবু হাসান বর্ণনা করেছেন, বনু আমিরের ২ জন লোক আয়িশা(রা.) এর নিকট এলো এবং বললো আবু হুরায়রা(রা.) বর্ণনা করেছেন নবী(ﷺ) বলেছেন, স্ত্রী, বাড়িঘর এবং ঘোড়ার ভিতরে অশুভের লক্ষণ আছে। (এটি শুনে) তিনি প্রচণ্ড রেগে গেলেন। রাগন্বিত অবস্থায় বললেন, “সেই সত্তার শপথ যিনি মুহাম্মাদ(ﷺ) এর উপর ফুরকান (কুরআন) নাজিল করেছেন; রাসুলুল্লাহ(ﷺ) মোটেও এমনটি বলেননি। তিনি আসলে যা বলেছেন তা হলো, জাহেলি যুগে লোকেরা এগুলোর ভেতরে অশুভ লক্ষণ আছে বলে মনে করতো।”
তাহকিক শুআইব আরনাউতঃ মুসলিমের শর্তানুযায়ী সনদ সহীহ। [4]
قيل : لعائشةَ إنَّ أبا هريرةَ يقول قال رسولُ اللهِ صلَّى اللهُ عليهِ وسلَّمَ : الشُّؤمُ في ثلاثٍ في الدَّارِ والمرأةِ والفرسِ فقالت عائشةُ : لم يحفظْ أبو هريرةَ لأنه دخل ورسولُ اللهِ صلَّى اللهُ عليهِ وسلَّمَ يقول : قاتَل اللهُ اليهودَ يقولون : إنَّ الشَّؤمَ في الدَّارِ والمرأةِ والفرسِ فسمع آخرَ الحديثِ ولم يسمع أولَه
অর্থঃ আয়িশা(রা.) এর নিকট বলা হলো, আবু হুরায়রা(রা.) বর্ণনা করেছেন রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেন, তিনটি বিষয়ের মাঝে অশুভের লক্ষণ আছে - স্ত্রী, বাড়িঘর এবং ঘোড়ায়। আয়িশা(রা.) বললেন, আবু হুরায়রা(রা.) (পুরো বক্তব্যটি) সংরক্ষণ করতে পারেননি। কারণ তিনি (মজলিসে) ঢুকছিলেন এবং রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বলছিলেন, “আল্লাহ ইহুদিদেরকে ধ্বংস করুন। তারা বলেঃ “স্ত্রী, বাড়িঘর এবং ঘোড়ার ভিতরে অশুভের লক্ষণ আছে।” তিনি (সঠিকভাবেই) নবী(ﷺ) এর বক্তব্যের শেষের অংশটি শুনেছেন, কিন্তু বক্তব্যের ১ম অংশটি তিনি শোনেননি।” [বর্ণনাটি হাসান] [5]
আমরা এ সংক্রান্ত বর্ণনার ব্যাপারে আয়িশা(রা.) এর ব্যাখ্যা দেখলাম। আয়িশা(রা.) এর মতে, জাহেলি যুগে ইহুদিদের থেকে এই বক্তব্য পাওয়া যেতো যে স্ত্রী, বাড়িঘর এবং ঘোড়ার মাঝে অশুভের লক্ষণ আছে। এখানে নবী(ﷺ) তাদের নিকট ইহুদিদের এই বক্তব্যের কথা উল্লেখ করেছেনমাত্র। হাদিসের বর্ণনাকারী নবী(ﷺ) এর কথার শেষাংশ শুনেছেন, কিন্তু প্রথমাংশ শুনতে পাননি। তিনি যতোটুকু শুনেছেন ততোটুকুই বর্ণনা করেছেন। তবে এখানে একটি ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে যেহেতু নবী(ﷺ) থেকে সেই কথার পূর্বেও আরেকটি বক্তব্য ছিলো। আয়িশা(রা.) ছিলেন অন্যতম সর্বোচ্চ হাদিস বর্ণনাকারী। তিনি উম্মাহর শিক্ষিকা। হাদিসশাস্ত্রে তাঁর পাণ্ডিত্য সর্বজনবিদিত। নবী(ﷺ) এর স্ত্রী হবার সুবাদে তাঁর থেকে এমন গভীরভাবে হাদিস শেখা সম্ভবপর হতো যা অন্য অনেকের পক্ষেই সম্ভব হতো না।
এখানে আমরা আবু হুরায়রা(রা.) থেকে এ সংক্রান্ত বর্ণনার ব্যাপারে আয়িশা(রা.) এর ব্যাখ্যা আলোচনা করলাম। তবে অন্য সাহাবীদের থেকেও এ সংক্রান্ত বর্ণনা পাওয়া যায়। আমরা এখন অন্য সাহাবীদের বর্ণনাগুলোর ব্যাপারে আলোচনা করবো।
ইসলামে অশুভ লক্ষণে বিশ্বাস করা নিষিদ্ধঃ
বিশুদ্ধ হাদিসে বলা হয়েছে কুলক্ষণ বা অশুভ লক্ষণে বিশ্বাসই করা যাবে না। এমনটি করা শির্কের অন্তর্ভুক্ত।
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ، عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ " الطِّيَرَةُ شِرْكٌ الطِّيَرَةُ شِرْكٌ " . ثَلاَثًا " وَمَا مِنَّا إِلاَّ وَلَكِنَّ اللَّهَ يُذْهِبُهُ بِالتَّوَكُّلِ "
অর্থঃ ‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস’ঊদ(রা.) থেকে বর্ণিতঃ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেনঃ কোন বস্তুকে কুলক্ষণ মনে করা ‘শিরক’, কোন বস্তুকে কুলক্ষন ভাবা শিরক। একথা তিনি তিনবার বললেন। আমাদের কারো মনে কিছু জাগা স্বাভাবিক, কিন্তু আল্লাহর উপর ভরসা করলে তিনি তা দূর করে দিবেন।” [6]
অশুভ লক্ষণ বলে কিছু নেই বরং শুভ লক্ষণ আছে – এই মর্মে নবী(ﷺ) থেকে অনেকগুলো বর্ণনা পাওয়া যায়।
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ عَنْ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ لاَ عَدْو‘ى وَلاَ طِيَرَةَ وَيُعْجِبُنِي الْفَأْلُ قَالُوا وَمَا الْفَأْلُ قَالَ كَلِمَةٌ طَيِّبَةٌ.
অর্থঃ আনাস(রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল(ﷺ) বলেছেন, ‘‘’আদওয়া’ (সংক্রমণ / সংক্রামক ব্যধি) ও অশুভ লক্ষণ বলতে কিছুই নেই। তবে শুভ লক্ষণ মানা আমার নিকট পছন্দনীয়।” [লোকেরা] বলল, শুভ লক্ষণ কী? তিনি বললেন, উত্তম বাক্য।’’ [7]
قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم لاَ عَدْو‘ى وَلاَ طِيَرَةَ وَلاَ هَامَةَ وَلاَ صَفَرَ وَفِرَّ مِنَ الْمَجْذُومِ كَمَا تَفِرُّ مِنْ الأَسَدِ.
অর্থঃ “রাসুলুল্লাহ্(ﷺ) বলেছেনঃ রোগের কোনো সংক্রমন নেই, কুলক্ষণ বলে কিছু নেই, পেঁচা অশুভের লক্ষণ নয়, সফর মাসের কোন অশুভ নেই। কুষ্ঠ রোগী থেকে দূরে থাক, যেভাবে তুমি বাঘ থেকে দূরে থাক।” [8]
কাজেই দ্বীন ইসলামে কোনো কিছুকে কুলক্ষণযুক্ত বা অশুভ ভাবার কোনো ব্যাপার নেই। হোক সে নারী বা অন্য কিছু। বরং ইসলামে শুভ লক্ষণে বিশ্বাস রয়েছে।
কিন্তু হাদিসে তো সরাসরি নারীকে অশুভ লক্ষণযুক্ত বলা হয়েছে! :
কেউ কেউ দাবি করতে পারেনঃ কিছু হাদিসে তো সরাসরিই বলা আছে যে নারীর মাঝে অশুভ লক্ষণ আছে! যেমন, এই প্রবন্ধের শুরুতেই উল্লেখিত এই সংক্রান্ত বিভিন্ন হাদিসের ৩ নং হাদিসে বলা হয়েছেঃ “الشُّؤْمُ فِي الْمَرْأَةِ وَالدَّارِ وَالْفَرَسِ” [তোমাদের স্ত্রী, বাড়িঘর এবং ঘোড়ার ভিতরে অশুভের লক্ষণ আছে]। হাদিসটির বর্ণনাকারী আবদুল্লাহ ইবনু উমার(রা.)।
এখানে একটি জিনিস লক্ষনীয়। ২ নং ও ৩নং উভয় হাদিসেরই বর্ণনাকারী আবদুল্লাহ ইবনু উমার(রা.)। ২নং ও ৩নং হচ্ছে একই হাদিসের দীর্ঘ ও সংক্ষিপ্ত বর্ণনা। ৩নং এ কিছু কম শব্দে সংক্ষিপ্তরূপে হাদিসটি বর্ণিত হয়েছে। একই হাদিস কোনো স্থানে বেশি শব্দে আবার কোনো স্থানে কম শব্দে বর্ণিত হবার ব্যাপারে ইমাম ইবন হাজম(র.) বলেছেন,
“বর্ণনাকারী কর্তৃক হাদিস সংক্ষিপ্তকরণঃ অর্থাৎ, বর্ণনাকারী সম্পূর্ণ হাদিসটিই মুখস্ত করেছেন, কিন্তু এর কিছু অংশ এক স্থানে বর্ণনা করেছেন এবং এর সম্পূর্ণ অংশ অন্য কোথাও বর্ণনা করেছেন। উদাহরণস্বরূপঃ আবু হুরায়রা(রা.) কর্তৃক নবী(ﷺ) এর যুহর সলাতের ২ রাকাত ভুলে যাবার হাদিসটি বর্ণিত হয়েছে। এর পুরো ঘটনাটিও আবু হুরায়রা(রা.) কর্তৃকই বর্ণিত হয়েছে, এবং তা একই ঘটনা (আলাদা কোনো ঘটনা না)। এর দ্বারা বোঝা গেলো, (রাবীদের) কেউ কেউ (হাদিসের) কিছু অংশ সংক্ষিপ্ত করে বর্ণনা করার ফলে বিভিন্ন বর্ণনায় ভিন্নতা (অর্থাৎ কোনো বর্ণনা দীর্ঘ আবার কোনো বর্ণনা সংক্ষিপ্ত) দেখা যায়। দেখুনঃ সহীহ বুখারী ৭১৪, ৭১৫, ১২২৯। ”[9]
কাজেই এখানে আমরা দীর্ঘ ও সম্পূর্ণ বর্ণনা থেকে এই হাদিসের ব্যাখ্যা গ্রহণ করবো। আর সম্পূর্ণ বর্ণনাটিতে সরাসরি এটি বলা নেই যে নারীদের মাঝে অশুভ লক্ষণ আছে। বরং বলা হয়েছেঃ “যদি কোন কিছুর মধ্যে অশুভ কিছু থাকতো তাহলে ঘোড়া, নারী ও বাড়ী এই তিন জিনিসের মধ্যে থাকতো।”। এ দ্বারা মূলত কী বোঝানো হয়েছে? ঘোড়া, নারী ও বাড়ির ব্যাপারে কেন এমন কথা বলা হলো? একটু পরেই আমরা এ বিষয়ে হাদিস বিশারদদের ব্যাখ্যা দেখবো ইন শা আল্লাহ। প্রবন্ধের শুরুতে সা’দ ইবনু মালিক(রা.) থেকে বর্ণিত ১নং হাদিসে আমরা দেখেছি তাঁর ও আবদুল্লাহ ইবনু উমার(রা.) থেকে দীর্ঘ বর্ণনায় একই তথ্য আছে। নারীদের মাঝে অশুভের লক্ষণ আছে – বিষয়টি এমন নয় বরং “যদি অশুভ কিছু থাকতো তাহলে তা নারীর মাঝে থাকতে পারতো” এই কথা বলা হয়েছে। দু’টি বিষয় মোটেও এক নয়। এই বর্ণনা দ্বারা বরং বোঝা যাচ্ছে নারীরা অশুভ নয়; অশুভ লক্ষণ বলে কিছু নেই। আমরা ইতিমধ্যেই এ বিষয়ে আয়িশা(রা.) এর অভিমত দেখেছি যে “স্ত্রী, বাড়িঘর এবং ঘোড়ার ভিতরে অশুভের লক্ষণ আছে” সরাসরি এমন কথা নবী(ﷺ) বলেননি। বরং জাহিলি যুগে এমনটি বলা হতো। সহীহ বুখারীর ব্যাখ্যায় ‘নাসরুল বারী’ গ্রন্থেও এই কথারই প্রতিধ্বনী করা হয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইমাম বুখারী(র.) দীর্ঘ বর্ণনাটি পরে এনে হাদিসের উদ্যেশ্য স্পষ্ট করে দিয়েছেন। এবং এর দ্বারা প্রমাণ হচ্ছে যে সত্ত্বাগতভাবে কোনো জিনিসে অশুভ বা অকল্যাণ নেই; অর্থাৎ হাদিসে নারী জাতিকে মোটেও অশুভ বলে বোঝানো উদ্যেশ্য নয়। সেখানে বলা হয়েছেঃ
“ইমাম বুখারী(র.) نحوست তথা অশুভ বা অকল্যাণ সম্পর্কে উভয় রকম রেওয়ায়াত নকল করেছেন। দ্বিতীয় রেওয়ায়াত পরে এনে ইমাম বুখারী(র.) উদ্দেশ্যকে সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, যদি কোন জিনিসে অশুভ, অকল্যাণ থাকতো তাহলে এই তিনটি জিনিসে হতো যথা ১. স্ত্রীলোক, ২. ঘোড়া এবং ৩. ঘর। সত্ত্বাগতভাবে কোন জিনিসে অশুভ বা অকল্যাণ নেই। যেমন স্বয়ং ৭৬৩ পৃঃ (নাসরুল বারী গ্রন্থে) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর(রা.) এর রেওয়ায়াতে উল্লেখ রয়েছে যে, ذكروا الشؤم عند النبى ﷺ الخ অর্থাৎ রাসূল(ﷺ) এর নিকট মানুষেরা কুলক্ষণের কথা আলোচনা করল। তখন রাসূল(ﷺ) বললেন, যদি কোন জিনিসে অশুভ বা অকল্যাণ হতো তাহলে ঘোড়া, স্ত্রীলোক ও ঘরে হতো। তো এর দ্বারা পরিষ্কার হয়ে গেল যে, সত্ত্বাগতভাবে কোন জিনিসে অশুভ বা অকল্যাণ নেই।” [10]
আমরা দেখলাম যে, লোকেরা যখন নবী(ﷺ) এর সামনে কুলক্ষণ বা অশুভ লক্ষণের ব্যাপারে আলোচনা করছিলো, তখন তিনি প্রসঙ্গক্রমে বলেছেন, তা যদি আসলেই থাকতো তবে তা এই তিন বিষয়ের মধ্যে থাকতে পারতো। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যে অশুভ লক্ষণ বলে কিছু নেই, সেটি স্বয়ং নবী(ﷺ) বহু স্থানে বলেছেন। প্রসঙ্গসহ পুরো ঘটনা দেখলেই বোঝা যাচ্ছে নারী জাতিকে অশুভ বা অলক্ষুণে বলে সাব্যস্ত করা মোটেও নবী(ﷺ) এর মাকসাদ ছিলো না। শুধু তাই নয়, অন্যত্র নবী(ﷺ) থেকে এটিও বর্ণিত হয়েছে যে স্ত্রীলোকের মাঝে শুভ লক্ষণ আছে!
نْ عَمِّهِ مِخْمَرِ بْنِ مُعَاوِيَةَ قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ لَا شُؤْمَ وَقَدْ يَكُونُ الْيُمْنُ فِي ثَلَاثَةٍ فِي الْمَرْأَةِ وَالْفَرَسِ وَالدَّارِ
অর্থঃ “মিখমার বিন মুআবিয়াহ(রা.) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ(ﷺ)-কে বলতে শুনেছি: অশুভ আলামাত বলতে কিছু নেই। অবশ্য তিনটি জিনিসে শুভ আলামাত আছেঃ স্ত্রীলোক, ঘোড়া ও বাড়ি।” [11]
হাদিসে বলা হয়েছে স্ত্রীলোকের মাঝে শুভ লক্ষণ আছে। অথচ এই হাদিস কিন্তু ইসলামবিরোধীদের আলোচনার মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় না। বরং তারা সব সময় সচেষ্ট থাকে কিভাবে কিছু হাদিস অপব্যাখ্যা করে ইসলামকে নারীবিদ্বেষী ধর্ম বলে প্রমাণ করবে।
একই হাদিসে ঘোড়ার ব্যাপারেও উল্লেখ ছিলো। বিশুদ্ধ হাদিসে বলা হয়েছে ঘোড়ার ললাটে কিয়ামত পর্যন্ত কল্যাণ নিহিত আছে। অর্থাৎ ঘোড়াও অশুভ বা অকল্যাণকর নয়।
عَنْ أَبِيهِ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْخَيْلُ مَعْقُودٌ فِي نَوَاصِيهَا الْخَيْرُ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ
অর্থঃ “আবু হুরায়রা(রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেন, আল্লাহ্ তা'আলা কিয়ামত পর্যন্ত ঘোড়ার ললাটে কল্যাণ বেঁধে রেখেছেন। … …” [12]
হাদিস থেকে প্রমাণিত হলো কোনো কিছু অলক্ষুণে বা অশুভ নয়। স্ত্রীলোক, ঘোড়া – আল্লাহর সব সৃষ্টিই শুভ ও কল্যাণকর। স্বয়ং রাসুলুল্লাহ(ﷺ) অশুভ লক্ষণকে অস্বীকার করেছেন।
হাদিস বিশারদগণের ব্যাখ্যাঃ
এ সংক্রান্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনুল কাইয়িম(র.) বলেছেন,
“যে ব্যক্তি এই বিশ্বাস রাখে যে রাসুলুল্লাহ(ﷺ) কোনো কিছুতে অশুভ লক্ষণ ও অমঙ্গলের প্রভাব এভাবে সাব্যস্ত করেছেন যে সেটা আল্লাহ ব্যতিত নিজে থেকেই ক্ষতি করতে পারে – সে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল(ﷺ) এর উপর মহা মিথ্যারোপ করেছে এবং সে পথভ্রষ্ট হয়েছে। ... মোটকথা, তিনটি বিষয়ের (স্ত্রী, ঘোড়া ও গৃহ) মধ্যে অশুভ লক্ষণ থাকার কথা দ্বারা সেই জিনিসের অস্তিত্ব প্রমাণ হয়ে যায় না যার অস্তিত্ব তিনি পূর্বেই অস্বীকার করেছেন।
... মহামহিম আল্লাহই ভালো ও মন্দের স্রষ্টা। সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্যের স্রষ্টা। তাঁর সৃষ্টির মাঝে কিছু জিনিস সৌভাগ্যজনক এবং বারাকাহযুক্ত হয়। যারা এগুলোর সংস্পর্শে আসে তাদের জন্য এগুলো আনন্দের কারণ হয়। কাজেই এরা বারাকাহময়। আবার আল্লাহর সৃষ্টির মাঝে কিছু জিনিস দুর্ভাগ্যজনক হয়। যারা এগুলোর সংস্পর্শে আসে তাদের জন্য এগুলো দুর্ভাগ্যের কারণ হয়। আর এর সবকিছুই হয় তাঁর (আল্লাহর) ইচ্ছা ও নির্ধারণ অনুসারে। ঠিক যেমনভাবে তিনি অন্য বিভিন্ন উপকরণ সৃষ্টি করেছেন এর বিপরীত উপকরণের সাথে এগুলোকে সংযুক্ত করে দিয়েছেন। যেমন, তিনি মিসক (কস্তুরী) এবং অন্যান্য সুগন্ধী বস্তু সৃষ্টি করেছেন। এগুলোর সংস্পর্শে এলে সুখানুভূতি তৈরি হয়। আবার তিনি এর ঠিক বিপরীত ধরণের কিছু বস্তুও সৃষ্টি করেছেন যেগুলোর সংস্পর্শে এলে অপ্রীতিকর অনুভূতি হয়। এই দুই ধরণের বস্তুর পার্থক্য বোঝা যায় অভিজ্ঞতার দ্বারা। গৃহ, স্ত্রী ও ঘোড়ার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এটা এক বিষয়; আর অশুভ লক্ষণের ব্যাপারে শির্কী বিশ্বাস সম্পূর্ণ ভিন্ন আরেকটা বিষয়।” [13]
তাকমিলা ফাতহুল মুলহিমের গ্রন্থকার মুফতি তাকি উসমানী(হাফি.) বলেন, “আমার মতে এই হাদিসের প্রাধান্য ব্যাখ্যা এই যে, এর দ্বারা মর্ম হচ্ছে, এই তিনটি বস্তুতে [নারী, গৃহ, ঘোড়া] কুলক্ষণ প্রমাণিত করার দ্বারা প্রকৃত কুলক্ষণ প্রমাণ করা উদ্দেশ্য নয়; বরং এর মর্ম হচ্ছে, এই সকল বস্তু যখন স্বভাবের অনুকূলে না হয় তখন বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয় এবং তাকে সর্বদা কষ্ট দিতে থাকে। যেমন, কুলক্ষণের প্রবক্তাদেরকে কষ্ট দিয়ে থাকে। আর বিশেষভাবে এই তিন বস্তুকে উল্লেখ করবার কারণ হচ্ছে, এগুলোর কারণে বড় এবং বেশি মুসিবতে পড়তে হয়। কেননা, প্রত্যেককেই এই তিনটি বস্তুর সাথে দীর্ঘ সংস্পর্শে থাকতে হয়। ... ...আর এটি সেই হাদিস দ্বারা তায়ীদ হয় যা বাযযার(র.) সা’দ বিন আবু ওয়াককাস(রা.) হতে মারফু হাদিস রিওয়ায়েত করেছেন যেঃ (সুখের বস্তু তিনটিঃ নেককার স্ত্রী, প্রশস্ত বাড়ী এবং স্বচ্ছন্দ বাহন)-(কাশফুল অসতার ২:১৫৬)। তবে এর সনদ শক্তিশালী নয়। কিন্তু মুসনাদ আহমাদ গ্রন্থে সহীহ সনদে এই মর্মে আরও পূর্ণাঙ্গ হাদিস সংকলন করেছেন। এর শব্দসমূহ এরূপঃ [আদম (আ.)-এর পুত্রদের সৌভাগ্যের (সুখের) বস্তু তিনটি। আর আদমের(আ.) পুত্রদের দুর্ভাগ্যের (দুঃখের) বস্তুও তিনটি। আদমের(আ.) পুত্রদের সুখের বস্তু হচ্ছে সৎ স্ত্রী, যথাযোগ্য বাড়ী এবং যোগ্য বাহন। আর আদম (আ.)-এর পুত্রদের দুঃখের বস্তু হচ্ছে অসৎ স্ত্রী, অনুপযোগী বাড়ী এবং দুর্বল বাহন] - (এই হাদিস আল্লামা আল হায়সামী(র.) মাজমাউয যাওয়ায়িদ গ্রন্থের ৪:২৭২ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করে বলেন, এটি আহমাদ, বাযযার এবং তিরমিযী(র.) স্বীয় ‘আল কাবির’ এবং ‘আল আওসাত’ গ্রন্থে রিওয়ায়েত করেছেন। মুসনাদ আহমাদ গ্রন্থের সনদ সহীহ।)।
আর নবী(ﷺ)-এর ইরশাদঃ (কোন জিনিসের মধ্যে যদি বস্তুতঃভাবে অশুভ বলে কোনো কিছু থাকতো তা হলে ঘোড়া, স্ত্রী ও বাড়ীর মধ্যে থাকতো)। অর্থাৎ যদি প্রকৃতপক্ষে কুলক্ষণ বলে কিছু থাকতো তবে এই বস্তুগুলোতে থাকতো। কেননা এগুলোর কারণে অনেক সময় দুঃখে পতিত হতে হয় যেমন তথাকথিত কুলক্ষণে বিশ্বাসীরা দুঃখে সমাবৃত হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কুলক্ষণ প্রমাণিত নয়। তবে যেই ব্যক্তি নেককার স্ত্রী, যথাযোগ্য বাসস্থান এবং স্বচ্ছন্দ বাহন লাভ করে সেই ব্যক্তি এই দুনিয়ায় সৌভাগ্যবান। আর যেই ব্যক্তি এই তিন বস্তুতে মন্দে সমাবৃত হয় সেই ব্যক্তি এই দুনিয়ায় দুর্ভাগা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা সর্বজ্ঞ।” [14]
হাদিস বিশারদগণের আলোচনা থেকে এটি পরিষ্কার যে এখানে নারী, গৃহ, ঘোড়া – এর কোনো বিষয়কেই পরমভাবে অশুভ বা অমঙ্গলজনক বলা হয়নি। নবী(ﷺ) থেকে বর্ণিত বহুসংখ্যক হাদিসে কোনো কিছুতে অশুভ প্রভাবের অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা বিভিন্ন বস্তুর মাঝে বিভিন্ন প্রকার গুণাবলী ও প্রভাব সৃষ্টি করে দিয়েছেন। এটা তো সুবিদিত বিষয় যে আদম(আ.) এর পুত্রদের অর্থাৎ পুরুষ জাতির জন্য সকল যুগেই অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, আকর্ষনীয় ও পরম আকাঙ্খিত তিনটি বিষয় হচ্ছে নারী, বাসগৃহ এবং বাহন। সেই আদিম যুগ থেকে আজকের আধুনিক যুগ অবধি এই তিনটি জিনিসের জন্য পুরুষ জাতি বহু শ্রম সাধনা, অপরাধ এমনকি যুদ্ধ পর্যন্ত করেছে। আদিম যুগে যেমন উত্তম বাসগৃহ, ঘোড়া ও নারীর জন্য পুরুষ বহু কিছু করেছে, আজকের আধুনিক যুগের পুরুষেরও মানসপটে জাগরুক হয়ে থাকে একজন উত্তম জীবনসঙ্গিনী, দামী গাড়ি এবং বাড়ি। এই বিষয়গুলোর উত্তম প্রভাবে একজন পুরুষ যেমন সৌভাগ্যমণ্ডিত হতে পারে, খারাপ প্রভাবে একজন পুরুষের জীবনও দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে, অতি আকাঙ্খার জন্য অনেক অপরাধেও জড়িয়ে যেতে পারে। এখানে ভালো ও মন্দ উভয় প্রভাবই থাকতে পারে। বিভিন্ন হাদিসে নারী, বাসগৃহ এবং ঘোড়া তথা বাহনের উভয় রকমের প্রভাবের কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। হাদিসে অত্যন্ত বাস্তবসম্মতভাবেই বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। নারীকে অশুভ লক্ষণযুক্ত বলে ঘৃণিত হিসেবে দেখানো মোটেও হাদিসের উদ্যেশ্য নয়।
ইসলামে নারীকে যেভাবে গণ্য করা হয়েছেঃ
দ্বীন ইসলামে বলা হয়েছেঃ মায়ের পায়ের নিচে জান্নাত।
عَنْ مُعَاوِيَةَ بْنِ جَاهِمَةَ السَّلَمِيِّ أَنَّ جَاهِمَةَ جَاءَ إِلَى النَّبِيِّ ﷺ فَقَالَ يَا رَسُولَ اللهِ أَرَدْتُ أَنْ أَغْزُوَ وَقَدْ جِئْتُ أَسْتَشِيرُكَ فَقَالَ هَلْ لَكَ مِنْ أُمٍّ قَالَ نَعَمْ قَالَ فَالْزَمْهَا فَإِنَّ الْجَنَّةَ تَحْتَ رِجْلَيْهَا
অর্থঃ মুআবিয়া বিন জাহেমাহ সুলামী বলেন, একদা জাহেমাহ (রা.) নবী(ﷺ)-এর নিকট এসে বললেন, ‘হে আল্লাহর রসূল! আমি জিহাদ করব মনস্থ করেছি, তাই আপনার নিকট পরামর্শ নিতে এসেছি।’ এ কথা শুনে তিনি বললেন, তোমার মা আছে কি? জাহেমাহ (রা.) বললেন, ‘হ্যাঁ’। তিনি বললেন, তাহলে তুমি তার খিদমতে অবিচল থাক। কারণ, তার পদতলে তোমার জান্নাত রয়েছে। [15]
ইসলামে নারী জাতি যদি সত্যিইই অশুভ এক জীব হতো – তাহলে কী করে মায়ের পায়ের নিচে জান্নাত হয়? অশুভ বা অমঙ্গলজনক কারো পায়ের নিচে কি জান্নাত হতে পারে? যার পায়ের নিচে জান্নাত, তার থেকে মহান মর্যাদা আর কার হতে পারে?
যে আরবে একসময় কন্যা সন্তানদেরকে অশুভ ও লজ্জার বিষয় মনে করে জীবন্ত কবর দেয়া হতো – ইসলাম তা চিরতরে বন্ধ করেছে।
“... ...আর তিনি [নবী(ﷺ)] মায়েদের অবাধ্য হতে, কন্যা সন্তানদের জীবন্ত কবর দিতে ও প্রাপকের পাওনা দেয়া থেকে হাত গুটাতে আর নেয়ার ব্যাপারে হাত বাড়িয়ে দিতে নিষেধ করতেন। আবূ ‘আবদুল্লাহ্ [বুখারী (র.)] বলেন, তারা (কাফির) জাহিলীয়্যাতের যুগে স্বীয় কন্যাদেরকে হত্যা করতেন। অতঃপর আল্লাহ তা হারাম করে দেন।” [16]
ইসলাম শুধু জীবন্ত কন্যা সন্তান কবর দেয়া বন্ধ করেই ক্ষান্ত হয়নি, কন্যা সন্তানকে উত্তমভাবে প্রতিপালন করবার আদেশ দিয়েছে এবং একে তার পিতামাতার জান্নাতে যাবার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে! এমনকি ভাইয়ের জন্য বোনের সাথে মমতাপূর্ণ আচরণ করাকেও জান্নাতে যাবার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
কন্যা সন্তান উত্তমভাবে প্রতিপালন সম্পর্কে অনেক সাহাবী থেকে বহু সংখ্যক হাদিস বর্ণিত রয়েছে যার সবগুলো উল্লেখ করলে আমাদের প্রবন্ধের কলেবর বিশাল হয়ে যেতে পারে। আমরা উদাহরণ হিসেবে ইমাম বুখারী(র.) এর আদাবুল মুফরাদ গ্রন্থ থেকে ৭৬ থেকে ৭৯ নং হাদিস উল্লেখ করছি। এর প্রতিটি হাদিসই সহীহ। –
উকবা ইবনে আমার (রা.) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ(ﷺ) -কে বলতে শুনেছিঃ যার তিনটি কন্যা সন্তান আছে এবং সে তাদের ব্যাপারে ধৈর্য ধারণ করে এবং তাদেরকে যথাসাধ্য উত্তম পোশাকাদি দেয়, তারা তার জন্য দোযখ থেকে রক্ষাকারী প্রতিবন্ধক হবে (আবু দাউদ, ইবনে মাজাহ)।
ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। নবী (ﷺ) বলেন, যে মুসলিমের দুইটি কন্যা সন্তান আছে এবং সে তাদেরকে উত্তম সাহচর্য দান করে তারা তাকে বেহেশতে দাখিল করবে (ইবনে মাজাহ, হাকিম)।
জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেনঃ যার তিনটি কন্যা সন্তান আছে এবং সে তাদেরকে আশ্রয় দিয়ে তাদের ব্যয়ভার বহন করে এবং তাদের সাথে দয়ার্দ্র ব্যবহার করে, তার জন্য বেহেশত অবধারিত হয়ে যায়। লোকজনের মধ্য থেকে একজন বললো, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কারো যদি দুটি কন্যা সন্তান থাকে? তিনি বলেনঃ দুইটি কন্যা সন্তান হলেও (আবু দাউদ, তাবারানী, বাযযার)।
আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ(ﷺ) বলেনঃ যে ব্যক্তির তিনটি কন্যা সন্তান বা তিনটি বোন আছে এবং সে তাদের সাথে মমতাপূর্ণ ব্যবহার করে, সে বেহেশতে প্রবেশ করবে (দারিমী, তিরমিযী, আবু দাউদ, হিব্বান)। [17]
অশুভ বা অমঙ্গলজনক কেউ কি জান্নাতে যাবার কারণ হতে পারে? ইসলামে নারীকে যদি অশুভ জীব হিসেবেই গণ্য করা হতো, তাহলে কি কন্যাসন্তানকে এভাবে উত্তমভাবে প্রতিপালনের আদেশ দেয়া হতো বা একে জান্নাতে যাবার কারণ বলা হতো? জান্নাতে যাবার কারণের চেয়ে মঙ্গলজনক আর কিছু কি হতে পারে? প্রিয় পাঠক, লক্ষ করুন। যে ইসলাম জাহিলী আরবের বর্বর রীতিনীতিকে উৎখাত করে কন্যাসন্তানের প্রতি সদাচরণের আদেশ দিয়েছে এবং একে জান্নাতে যাবার কারণ বানিয়েছে, নাস্তিক-মুক্তমনারা সেই ইসলামকেই নারীবিদ্বেষী এক ধর্ম হিসেবে উপস্থাপনের অপচেষ্টা করছে।
ইসলাম মুমিন পুরুষদেরকে আদেশ করেছে মুমিন নারীর প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ না রাখতে। তাকে অশুভ বা অপয়া মনে করে ঘৃণিত বানিয়ে রাখবার কোনো সুযোগ ইসলামে নেই।
قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَا يَفْرَكْ مُؤْمِنٌ مُؤْمِنَةً إِنْ كَرِهَ مِنْهَا خُلُقًا رَضِيَ مِنْهَا آخَرَ»
অর্থঃ রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেনঃ কোনো মু’মিন যেন মু’মিনাহ্-কে ঘৃণা না করে (বা তার প্রতি শত্রুতা পোষণ না করে); যদি তার কোনো আচরণে সে অসন্তোষ প্রকাশ করে, তবে অন্য আর এক আচার-ব্যবহারে সন্তুষ্টি লাভ করবে। [18]
এই হাদিসের ব্যাখ্যায় [19] বলা হয়েছে,
“নবী(ﷺ) -এর বাণী : (لَا يَفْرَكْ) শেষ অক্ষর সাকীন বা জযম কিংবা পেশ উভয় যোগ পাঠ সিদ্ধ। (ر) বর্ণটি যবর যোগে পঠিত হয়; আভিধানিক অর্থ মর্দন করা, দলিত করা। মুল্লা ‘আলী কারী(রহঃ) বলেনঃ (فَرْكٌ) শব্দটি بُعْضٌ এর অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, যার অর্থ ঘৃণা, অবজ্ঞা, অপছন্দ ইত্যাদি। হাদীসের অর্থ দাঁড়ায়, কোনো মু’মিন পুরুষ কোনো মু’মিনাহ্ নারীকে অর্থাৎ স্বামী তার স্ত্রীকে ঘৃণা করবে না। কোনো বিষয়েই ঘৃণা বা অবজ্ঞা করবে না, কারণ তার মধ্যে অন্য যে গুণটি রয়েছে তাতে সে খুশি হবে। একজন মানুষ হিসেবে সকল গুণ তার মধ্যে থাকতে পারে না।
কাযী ‘ইয়ায বলেনঃ (لَا يَفْرَكْ) এটা নাফী বা না-বাচক কর্ম কিন্তু অর্থ প্রদান করেছে নাহী বা নিষেধাজ্ঞাবাচক কর্মের। এর অর্থ হয়েছে স্ত্রীর অপছন্দনীয় কিছু দেখে তাকে অবজ্ঞা অথবা ঘৃণা করা কোনো পুরুষের জন্য উচিত নয়। কেননা একটি বিষয় সে অপছন্দ করছে অন্যটি সে অবশ্যই পছন্দ করবে এবং তাতে খুশি হবে। এই ভালো গুণটি দিয়ে সে খারাপটির মোকাবেলা করবে। এতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, দোষ ছাড়া কোনো মানুষই পাওয়া যায় না, কেউ যদি দোষ ছাড়া কোনো মানুষ খুঁজতে যায় তাহলে সে সাথীহীন একাই পড়ে থাকবে।
এতে আরো ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, সকল মানুষই বিশেষ করে মু’মিনের মধ্যে কতিপয় উত্তম ও প্রশংসিত স্বভাব বা গুণাবলী রয়েছে, এই উত্তম আচরণ ও গুণাবলীকে বিবেচনায় আনবে আর অন্য খারাপ স্বভাবগুলো ঢেকে রাখবে এবং এড়িয়ে চলবে। ”[20]
অশুভ ও অমঙ্গলজনক হিসেবে গণ্য করা তো দূরের বস্তু – ইসলামে একজন সচ্চরিত্রবান নারীকে পৃথিবীর সর্বোত্তম সম্পদ বলা হয়েছে।
“‘সম্পূর্ণ পৃথিবী সম্পদ। আর পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তম সম্পদ হচ্ছে সৎ চরিত্রবান নারী’ [21]
উপসংহারঃ
আমরা আশা করছি এই আলোচনার দ্বারা সকলের নিকট এটি স্পষ্ট হয়েছে ইসলামে নারীকে অশুভ ও অমঙ্গলজনক বলে বিবেচনা করা হয় না। “শুধু নারী হবার জন্য ইসলাম একজন মানুষকে ঘৃণা করতে বলে” – এমন বিকৃত ধারণা শুধুমাত্র ইসলামবিরোধীদের অপব্যাখ্যার মাধ্যমেই পাওয়া সম্ভব। বরং ইসলাম জাহিলি যুগের অন্ধকারকে ছিন্ন করে নারীকে সুমহান মর্যাদা দান করেছে। একজন সচ্চরিত্রবান নারীকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ বলে অভিহীত করেছে।
আরো পড়ুনঃ
হাদিসে কি নারীদেরকে ভোগ্যপণ্য বলা হয়েছে?
"তোমাদের স্ত্রীগণ তোমাদের শস্যক্ষেত্র" (২ : ২২৩) - এই আয়াতের মাধ্যমে ইসলাম কি নারীকে ছোট করেছে?
দেখুনঃ
"Is There Bad Omen in Women | Sheikh Assim Al Hakeem"
তথ্যসূত্রঃ
[1] সুনান আবু দাউদ, হাদিস নং: ৩৯২১
[2] সহীহ মুসলিম, হাদিস নং: ৫৬১১
[3] সহীহ বুখারী, হাদিস নং: ৪৭২২
[4] মুসনাদ আহমাদ, হাদিস নং : ২৬০৭৬ (সহীহ)
http://islamport.com/d/1/mtn/1/89/3525.html
আয়িশা(রা.) থেকে সহীহ সনদে অনুরূপ আরো বর্ণনা পাওয়া যায়।
দেখুনঃ https://is.gd/2Nx0uZ
[5] সিলসিলা সহিহাহ ২/৬৯০, শায়খ আলবানী(র.) এর মতে হাদিসটি হাসান
[6] সুনান আবু দাউদ, হাদিস নং : ৩৯১০ (সহীহ)
http://www.ihadis.com/books/abi-dawud/hadis/3910
আরো দেখুন, সুনান ইবন মাজাহ, হাদিস নং : ৩৫৩৮ (সহীহ)
[7] সহীহ বুখারী ৫৭৭৬, সহীহ মুসলিম ৫৯৩৩-৫৯৩৪
[8] সহীহ বুখারী ৫৭০৭
[9] আল ইহকাম ১/১৩৪
সূত্রঃ شرح القصيدة الميمية للآثاري في مدح خير الرسل ﷺ - خضر موسى محمد حمود ،الدكتور
[10] নাসরুল বারী শারহে সহীহ বুখারী (আল-কাউসার প্রকাশনী), খণ্ড ৭, পৃষ্ঠা ১১৭
[11] সুনান ইবন মাজাহ, হাদিস নং : ১৯৯৩ (হাসান)
[12] সুনান নাসাঈ, হাদিস নং : ৩৫৬৩ (সহীহ)
[13] মিফতাহ দার আস-সা’আদাহ ২/২৫৭
[14] তাকমিলা ৪:৩৮০-৩৮১
[15] আহমাদ ১৫৫৩৮, নাসাঈ ৩১০৪, ইবনে মাজাহ ২৭৮১, বাইহাক্বী ১৮২৮৮, হাকেম ২৫০২ (সহীহ)
[16] সহীহ বুখারী, হাদিস নং : ৭২৯২
[17] আল আদাবুল মুফরাদ – ইমাম বুখারী
[18] সহীহ : মুসলিম ১৪৬৯, আহমাদ ৮৩৬৩, সহীহ আত্ তারগীব ১৯২৮, সহীহ আল জামি‘ ৭৭৪১।
[19] হাদিসের ব্যাখ্যার উৎসঃ তাহকিক মিশকাতুল মাসাবিহ (হাদিস একাডেমি), ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩০১
[20] শারহে মুসলিম ৯/১০ খন্ড, হাঃ ১৪৬৯; মুসনাদ আহমাদ ২য় খন্ড, ৩২৯ পৃঃ; মিরকাতুল মাফাতীহ
[21] বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৩০৮৩; সুত্রঃ উপদেশ – আব্দুর রাজ্জাক বিন ইউসুফ পৃষ্ঠা ১৪৭