ঘটনা ১:
রাসুলুল্লাহ(ﷺ) এর চাচা আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিব ছিলেন বেশ ধনী মানুষ। ইসলামের ইতিহাসে বিখ্যাত বদর যুদ্ধে তিনি মক্কার মুশরিক কুরাঈশ সৈন্যদলের সাথে ছিলেন। মক্কা থেকে রওনা হবার আগে গভীর রাতে খুব গোপনে বেশ কিছু সম্পদ স্ত্রীর কাছে লুকিয়ে রেখে যান। মক্কা থেকে তিনি যখন বদর যুদ্ধে যাত্রা করেন, তখন কাফির কুরাঈশ সৈন্যদের জন্য ব্যয় করার উদ্দেশ্যে বিশ ওকিয়া (স্বর্ণমুদ্রা) সাথে নিয়ে যাত্রা করেছিলেন। কিন্তু সেগুলো ব্যয় করার আগেই তিনি গ্রেফতার হয়ে যান। এ যুদ্ধে পরাজিত মক্কার কুরাঈশদের অনেকেই মুসলিমদের হাতে বন্দী হয়েছিল। যুদ্ধবন্দীদের মুক্তিপণ নিয়ে মুক্ত করে দেয়া হয়েছিল।
যখন মুক্তিপণ দেয়ার সময় আসে, তখন তিনি রাসুল(ﷺ)কে বললেন, “আমি তো মুসলিম ছিলাম!”
রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বললেন, “আপনার ইসলাম সম্পর্কে আল্লাহই ভালো জানেন। যদি আপনার কথা সত্য হয় তবে আল্লাহ আপনাকে এর প্রতিফল দেবেন। আমরা তো শুধু প্রকাশ্য কর্মকাণ্ডের উপর হুকুম দেব। সুতরাং আপনি আপনার নিজের এবং দুই ভাতিজা আকিল ইবন আবি তালিব ও নওফেল ইবন হারিসের মুক্তিপণও পরিশোধ করবেন।”
আব্বাস আবেদন করলেন, “আমার এত টাকা কোত্থেকে [আসবে]?”
রাসুলুল্লাহ(ﷺ)বললেনঃ “কেন, আপনার নিকট কি সে সম্পদগুলো নেই, যা আপনি মক্কা থেকে রওয়ানা হওয়ার সময়ে আপনার স্ত্রী উম্মুল ফযলের নিকট রেখে এসেছেন এবং বলেছিলেন [1] , আমি যদি এ যুদ্ধে মারা যাই, তাহলে এ মাল ফযল আবদুল্লাহ ও কুছামের সন্তানরদেরকে দিও?”
আব্বাস বললেনঃ “আপনি সে কথা কেমন করে জানলেন?! আমি যে রাত্রের অন্ধকারে একান্ত গোপনে সেগুলো আমার স্ত্রীর কাছে দিয়েছিলাম এবং এ ব্যাপারে তৃতীয় কোন লোক জানতো না!”
রাসুল(ﷺ) বললেনঃ “সে ব্যাপারে আমার রব আমাকে বিস্তারিত অবহিত করেছেন।” [2]
আব্বাস বললেন, আল্লাহর কসম, আমি নিশ্চিত হয়েছি যে, আপনি আল্লাহর রাসুল! কেননা, এই লুকানো সম্পদের কথা আমি আর উম্মুল ফযল ছাড়া আর কেউই জানতো না। [3]
তিনি শাহাদাহ পাঠ করলেন, ইসলামে দাখিল হলেন। রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা ‘আনহু।
ঘটনা ২:
খাইবারের দুর্গ বিজয়ের পর এক ইহুদি মহিলা বকরীর মাংসে বিষ মিশিয়ে রাসুলুল্লাহ(ﷺ)কে মেরে ফেলার চেষ্টা করল। একজন সাহাবী মারাও গেলেন। [4] এর কিছুক্ষন পরের ঘটনা।
রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বলেনঃ “এখানে যত ইহুদি আছে আমার কাছে তাদের একত্রিত কর।”
তাঁর কাছে সকলকে একত্র করা হল।
রাসুলুল্লাহ(ﷺ) তাদের উদ্দেশ্যে বললেনঃ “আমি তোমাদের কাছে একটা ব্যাপারে জানতে চাই, তোমরা কি সে বিষয়ে আমাকে সত্য কথা বলবে?”
তারা বললঃ “হ্যাঁ, হে আবুল কাসিম।” [মুহাম্মাদ(ﷺ) এর উপনাম]
রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বললেনঃ “তোমাদের পিতা কে?”
তারা বললঃ আমাদের পিতা অমুক...
রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বললেনঃ তোমরা মিথ্যে বলেছ; বরং তোমাদের পিতা অমুক। [তিনি তাদের সত্যিকার বাবার নাম বলে দিলেন]
তারা বললঃ “আপনি সত্য বলেছেন ও সঠিক বলেছেন।”
এরপর তিনি বললেনঃ “আমি যদি তোমাদের নিকট আর একটি প্রশ্ন করি, তাহলে কি তোমরা সেক্ষেত্রে আমাকে সত্য কথা বলবে?”
তারা বললঃ “হ্যাঁ, হে আবুল কাসিম যদি আমরা মিথ্যে বলি তবে তো আপনি আমাদের মিথ্যা জেনে ফেলবেন, যেমনিভাবে জেনেছেন আমাদের পিতার ব্যাপারে।” … [5]
যারা খাবারে বিষ মিশিয়ে তাঁকে মেরে ফেলতে চাইলো, তাদের কাছে এভাবে তিনি নিজ নবুয়তের সত্যতার একটা চিহ্ন দেখিয়ে গেলেন। সঠিকভাবে তাদের বাবার নাম বলে দিয়ে আসলেন। [6] তারাও দ্বিধাহীনভাবে স্বীকার করে নিল যে, তারা মিথ্যা বলার পরেও রাসুলুল্লাহ(ﷺ) সঠিকভাবে তাদের বাবার নাম বলে দিয়েছেন। এবং তারা এরপর মিথ্যা বললে সেটাও রাসুলুল্লাহ(ﷺ) ধরে ফেলবেন।
ঘটনা ৩:
মক্কা বিজয় হয়ে যাবার পরের ঘটনা। মক্কা বিজয় করে মুসলিমগণ নগরে প্রবেশ করার পর যখন রাতের আগমন হল, তখন রাতভর তাঁরা তাকবির ধ্বনি ও কালিমার আওয়াজে চারিদিক মুখরিত করে রাখলেন। এভাবে সকাল হয়ে গেল।
তখন আবু সুফিয়ান স্ত্রী হিন্দকে ডেকে বললেন – “দেখ না, এ সবই আল্লাহর পক্ষ থেকে হচ্ছে।”
হিন্দ বললো, “হ্যাঁ- এ আল্লাহর পক্ষ থেকেই।”
কুরাঈশদের নেতা আবু সুফিয়ান ও তার স্ত্রী হিন্দ সবসময়েই ইসলামের বিরোধিতা করে আসতেন। রাসুলুল্লাহ(ﷺ) এর সাথে শত্রুতা পোষণ করে করে তারা এতদিন অনেক কিছুই করে এসেছেন।
এরপর আবু সুফিয়ান খুব সকালে উঠে রাসুলুল্লাহ(ﷺ) এর নিকট গিয়ে উপস্থিত হলেন। তাকে দেখে রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বললেনঃ “ তুমি হিন্দকে বলেছিলে, “দেখ না-এ সব আল্লাহর পক্ষ থেকে হচ্ছে। আর হিন্দ বলেছিল, হ্যাঁ- এ আল্লাহর পক্ষ থেকে।”
তখন আবু সুফিয়ান বললো, “আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আপনি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। সেই আল্লাহর কসম, যার নামে কসম খাওয়া হয়— আমার এ কথা হিন্দ ব্যতিত অন্য কোন ব্যক্তি শোনেনি! ” [7]
অনলাইন জগতে মুহাম্মাদ(ﷺ) এর নবুয়তকে প্রশ্নবিদ্ধ করে অনেক কিছুই ইদানিং লেখা হচ্ছে। নাস্তিক-মুক্তমনা ও খ্রিষ্টান মিশনারীরা কুরআন, হাদিস, সিরাহ এসব সূত্র থেকেই বিভিন্ন ঘটনা বিচ্ছিন্নভাবে উদ্ধৃত করে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে— মুহাম্মাদ(ﷺ) কোন নবী ছিলেন না, বরং তিনি জোর জুলুম করে আরব দেশে একটা নতুন মতবাদ প্রতিষ্ঠা করে গেছেন! (নাউযুবিল্লাহ) তিনি নাকি তাঁর নবুয়তের কোন নিদর্শন (signs) বা প্রমাণ দেখিয়ে যাননি। (নাউযুবিল্লাহ) তারা এত সিরাহ অধ্যায়ন করেন, উপরের ঘটনাগুলোর একটিও কি তাদের চোখে পড়েনি? গায়েবের জ্ঞান তো কেবল আল্লাহই রাখেন, আর তিনি তাঁর নবীদের নিকট ওহীর দ্বারা সংবাদ প্রেরণ করেন। [8] মুহাম্মাদ(ﷺ)যদি আল্লাহর নবী নাই হয়ে থাকতেন, তাহলে তিনি কী করে উপরের ৩টি ঘটনায় গোপন সংবাদগুলো বলে দিলেন? কোন ‘বিজ্ঞানমনস্ক’ চেতনা বা অন্য কোন চেতনা দিয়ে কি এগুলো ব্যাখ্যা করা যাবে? যে সূত্রগুলো (হাদিস ও সিরাত গ্রন্থ) ব্যবহার করে নাস্তিক-মুক্তমনা ও খ্রিষ্টান মিশনারীরা মুহাম্মাদ(ﷺ) এর নবুয়তকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চান, সে সূত্রগুলো থেকেই তো এ ঘটনাগুলো নেয়া। তারা যদি এ ঘটনাগুলো অবিশ্বাস করেন বা অগ্রহণযোগ্য বলেন, তাহলে আমরা তাদেরকে বলবঃ তাহলে আপনারা কোন মুখে ইসলামকে মিথ্যা প্রমাণের জন্য হাদিস ও সিরাত থেকে কোট করেন? ঐ কাজগুলোও তাহলে বন্ধ করুন। সরাসরি বলে দিনঃ আমরা কোন ইতিহাস বিশ্বাস করি না! এত ডাবল স্ট্যান্ডার্ড কেন আপনাদের?
উপরের ৩টি ঘটনার মত আরো বহু ঘটনা ছড়িয়ে আছে হাদিস ও সিরাত গ্রন্থগুলোতে। সবগুলো একত্র করলে একটি বই হয়ে যাবে নিঃসন্দেহে। মুহাম্মাদ(ﷺ) এর এ কাজগুলো দেখে সে যুগে বিবেকবান লোকেরা ঈমান এনেছে। আজও এ ঘটনাগুলো দেখে মানুষ ঈমান আনবে - যদি সে বিবেকবান ও সত্য সন্ধানী হয়। এ ঘটনাগুলো একটি মহাসত্যেরই সাক্ষ্য দেয়---মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর রাসুল।
“এগুলো অদৃশ্যের সংবাদ, যা আমি তোমার [মুহাম্মাদ (ﷺ)] কাছে ওহী মারফত পৌঁছে দিচ্ছি। ইতিপূর্বে এটা না তুমি জানতে, আর না তোমার জাতি। অতএব তুমি ধৈর্য ধারণ কর; নিশ্চয়ই শুভ পরিণাম মুত্তাকীদের জন্যই।” [9]
“তিনি [আল্লাহ] অদৃশ্যের জ্ঞানী, আর তিনি তাঁর অদৃশ্যের জ্ঞান কারো কাছে প্রকাশ করেন না। তবে তাঁর মনোনিত রাসুল ছাড়া। আর তিনি তখন তাঁর সামনে ও তার পিছনে প্রহরী নিযুক্ত করেন। যাতে তিনি এটা জানতে পারেন যে, তারা তাদের রবের রিসালাত পৌঁছিয়েছে কিনা। আর তাদের কাছে যা রয়েছে, তা তিনি পরিবেষ্টন করে রেখেছেন এবং তিনি প্রতিটি বস্তু গুণে গুণে হিসাব করে রেখেছেন।” [10]
তথ্যসূত্রঃ
[1] এ অংশটুকু ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’তে আছে
[2] কুরআনুল কারীম (বাংলা অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসির), ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া, ১ম খণ্ড, সুরা আনফালের ৭০ নং আয়াতের তাফসির, পৃষ্ঠা ৯২৮-৯২৯
[3] ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ – ইবন কাসির(র.) (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫২২
[4] সহীহ মুসলিম, হাদিস নং : ৩৫০ দ্রষ্টব্য
[5] সহীহ বুখারী, হাদিস নং : ৫৭৭৭
[6] সঠিকভাব এতগুলো লোকের বাবার নাম বলে দেয়া কোন সাধারন ব্যাপার নয়। সে যুগে জন্ম নিবন্ধন হত না, কোন ডাটাবেসও ছিল না।
[7] ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ – ইবন কাসির(র.) (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫২২
[8] "No one knows the unseen in the absolute sense except Allaah" -- islamQa (Shaykh Muhammad Saalih al-Munajjid)
https://islamqa.info/en/101968
[9] আল কুরআন, হুদ ১১ : ৪৯
[10] আল কুরআন, জিন ৭২ : ২৬-২৮