প্রায়ই সোশাল মিডিয়াতে বিভিন্ন উদ্ভট পোস্টের দেখা মেলে। সালাত পড়ার একশোটি উপকারিতা, সাওম পালন করলে ক্যান্সার থেকে মুক্তি , টাখনুর ওপর কাপড় পরার যে উপকারিতার কথা জানলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন- ইত্যাদি। এসব লেখায় সত্য যে একেবারে থাকে না তা নয়, তবে অনেকসময় কাল্পনিক তথ্যের সাহায্য নিয়ে বেশ হাস্যকর কথা লেখা হয়। যুগটা বিজ্ঞানের বলেই হয়তো যে কোনো পোস্টের চেয়ে এসব পোস্ট অনেক মুসলিমদেরকে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আচ্ছা, এর উল্টোটা যদি দেখা যায়? কেউ যদি প্রমাণ করতে পারে, নামায-রোযা নিয়মিত পালন করলে আমাদের শরীরে ক্ষতি হবার সম্ভাবনা আছে, তখন আমরা কী করব?
এই তো ক’দিন আগেই দেখলাম এক মুক্তমনা লিখেছে, সলাত বা নামাজের নাকি অনেক শারিরীক অপকারিতা আছে। তাই সলাত আল্লাহর দেয়া বিধান হতে পারে না!!! সলাতের ‘শারিরীক অপকারিতা’(!)র ব্যাপারে সে বা তারা যা লেখে, সেগুলো খণ্ডন করা যায়। কিন্তু আমার এই প্রবন্ধটি তার সে সব যুক্তিকে খণ্ডন করার জন্য নয়। বরং এক ধরণের ভ্রান্ত মানসিকতাকে খণ্ডন করার জন্য। যে মানসিকতার জন্য এইসব বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী নাস্তিক-মুক্তমনাদের অখাদ্য ধরণের লেখাগুলোও মুসলিমদের মাঝে ফিতনা তৈরি করছে।
ইসলামের বিধানগুলোর বিভিন্ন দুনিয়াবী উপকারিতা আছে – সত্য। কিন্তু বিধানগুলো কি আমরা সেই পার্থিব উপকারের জন্য পালন করি?
সলাত, সিয়াম (রোজা) কিংবা আল্লাহর অন্য বিধানগুলোর মধ্যে অজস্র দুনিয়াবি উপকারিতা আছে। যেমনঃ সলাতের দ্বারা উত্তম শারিরীক ব্যায়াম হয়। সিয়াম পালন করা হলে তা শরীরের অতিরিক্ত মেদ কমানোতে ভুমিকা রাখে। কিন্তু এই বিধানগুলোতে যদি এসব পার্থিব উপকারিতা না থাকত, তাহলে কি আমরা এগুলো পালন করতাম না?
উত্তর হচ্ছে— আমরা তবুও এগুলো পালন করতাম।
আমরা এই বিধানগুলো পালন করি একমাত্র এ জন্য যে আল্লাহ তা’আলা এগুলো পালনের আদেশ দিয়েছেন। এ ছাড়া এগুলো পালনের আর কোন উদ্যেশ্য নেই।
বর্তমান যুগে ইসলামের অনেক দাঈ আছেন যাঁরা আল্লাহর বিধানগুলোর দুনিয়াবী উপকারিতা বর্ণনা করেন। তাঁদের উদ্যেশ্য মহৎ। তাঁরা চান যে এর দ্বারা সাধারণ মানুষ বিধানগুলোর মাহাত্ম্য অনুধাবন করে ও এগুলোর প্রতি আকৃষ্ট হয়। কিন্তু অজ্ঞতার দরুণ অনেক মানুষ এই ব্যাপারে একটি ভুল ধারণা করে বসেন। তারা মনে করেন যে – জাগতিক উপকারিতাগুলোই বুঝি এই হুকুমগুলো দেবার কারণ! এ কারণে কেউ কেউ ধারণা করে বসেন যে, শরীরের অতিরিক্ত মেদভুঁড়ি কমিয়ে সুস্থতা দানের জন্যই বুঝি সিয়ামের বিধান দেয়া হয়েছে! [1] এ কারণেই “আমিন না বলে যাবেন না” টাইপের কোন লাইকভিক্ষুক ফেসবুক পেইজ থেকে যখন পোস্ট দেয়া হয় টাখনুর উপর প্যান্ট পরলে প্রজনন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, [2] তখন এটাকেই এ নির্দেশের ‘উদ্যেশ্য’ মনে করে হাজার হাজার লাইক শেয়ারে ঐসব পোস্ট ভরে যায়। কিংবা দেখা যায় “আল্লাহ অমুক বিধান কেন দিলেন” এই জাতীয় প্রশ্ন মানসপটে ঘুর ঘুর করে। এই মানসিকতার জন্যই নাস্তিক-মুক্তমনারা যখন সলাত বা ইসলামের অন্য কোন বিধানের পার্থিব ‘অপকারিতা’(?) নিয়ে লেখে, সেগুলো দেখে সরলপ্রাণ ঐসব মুসলিমরা বিভ্রান্ত হয়ে যান। তারা চিন্তা করেন –আল্লাহর কোন বিধানে কীভাবে জাগতিক বা পার্থিব অপকারিতা থাকতে পারে?
একটা বিষয়ে আমাদের মুসলিমদের বিশ্বাস ঠিক রাখতে হবে যে, কোন বিধান কুরআন বা সুন্নাহতে আছে কিনা সেটাই হচ্ছে একমাত্র দেখার জিনিস। কুরআন বা সুন্নাহতে থাকলে সেটি আল্লাহর বিধান এবং এই বিধানটি আল্লাহ আমাদের পালনের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন একমাত্র এ জন্যই আমরা এটা পালন করি। এর দ্বারা পার্থিক উপকার হোক বা অপকার হোক এটা মু’মিনের দেখার বিষয় নয়। মু’মিনের কাজ হচ্ছে আল্লাহর বিধান জানা এবং তা পালন করা। সকল হুকুমের হিকমাহ খোঁজা দুর্বল ঈমানের বৈশিষ্ট্য। এবং এটি কোন সঠিক পদ্ধতি নয়।
কেন?
কারণ ইসলামের বেশ কিছু বিধান আছে যার দ্বারা আপাতদৃষ্টিতে মানুষের দুনিয়াবী ‘ক্ষতি’ হয়।
অনেকেই হয়ত কথাটা শুনে চমকে উঠতে পারে।
ইসলামের প্রাথমিক যুগে ৫ ওয়াক্ত সলাত ফরজ ছিল না। তখন তাহাজ্জুদের সলাত ফরজ ছিল এবং এর জন্য রাত্রির অন্তত এক চতুর্থাংশ মশগুল থাকা অপরিহার্য ছিল। এ কারণে রাসুলুল্লাহ (ﷺ) ও সাহাবীগণ রাতের অধিকাংশ সময়ে সলাতে দণ্ডায়মান থাকতেন। এর ফলে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ব্যাথায় তাঁদের পা ফুলে যেত। [3] কিন্তু তবু তাঁরা আল্লাহর বিধান পালন করতেন। সাহাবীগণ কখনো এই দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকবার ‘স্বাস্থ্যগত উপকার’ বা অন্য হিকমাহ খুঁজতেন না বরং আল্লাহর বিধান পালন করে যেতেন। [4] দীর্ঘ সময়ে দাঁড়িয়ে থেকে পা ফুলে যাওয়া – জাগতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এটা একটা স্বাস্থ্যগত ক্ষতি।
রাসুলুল্লাহ(সল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও সাহাবীগণ আল্লাহর পথে বহু যুদ্ধ করেছেন। এই যুদ্ধগুলোর জন্য সাহাবী(রা.)গণ নিজ অর্থ সম্পদ ও জীবন ব্যয় করতেন। তাবুকের যুদ্ধে সাহাবী আবু বকর(রা.) তাঁর সমুদয় সম্পদ ব্যয় করেছিলেন, উমার(রা.) তাঁর সম্পদের অর্ধেক ব্যয় করেছিলেন। আর মোট সৈন্যের এক তৃতীয়াংশের ব্যয়ভার গ্রহণ করেছিলেন উসমান(রা.)। [5] এই বিপুল পরিমাণ অর্থ চলে যাওয়া নিঃসন্দেহে পার্থিব দৃষ্টিকোণ থেকে ‘ক্ষতি’। সাহাবায়ে কিরাম(রা.)দের অনেকেই আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করে আহত হয়েছেন, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হারিয়েছেন এমনকি জীবন দিয়েছেন। [6] এগুলো কি পার্থিব দৃষ্টিকোণ থেকে আদৌ কোন লাভজনক জিনিস? কেউ যদি প্রশ্ন করে যে এই বিধানগুলোর ‘পার্থিব উপকারিতা’ কী, তাহলে এর জবাব কী হবে?
সাহাবায়ে কিরাম(রা.) হচ্ছেন ঈমান ও অনুসরণের ক্ষেত্রে এই উম্মতের মধ্যে উত্তম আদর্শ। তাঁরা আল্লাহর বিধানগুলোর ক্ষেত্রে দুনিয়াবী উপকার খোঁজেননি। দুনিয়াবী উপকার থাক বা না থাক – “আল্লাহর বিধান” এটা জানাই যথেষ্ট। কোনো হুকুম সামনে এলেই তারা বলেছেন,
وَقَالُواْ سَمِعۡنَا وَأَطَعۡنَاۖ غُفۡرَانَكَ رَبَّنَا وَإِلَيۡكَ ٱلۡمَصِيرُ (٢٨٥)
“...তারা [ঈমানদারেরা] বলে, “আমরা শুনলাম ও মানলাম। হে আমাদের রব! আমরা আপনারই নিকট ক্ষমা চাই, আর আপনারই দিকে চূড়ান্ত প্রত্যাবর্তন।” [7]
আমরা যদি আমাদের আকিদা এভাবে সাহাবী(রা.)দের মত করে গঠন করি, তাহলে নাস্তিক মুক্তমনাদের ‘সলাতের অপকারিতা(!)’ জাতীয় পোস্ট আর পাত্তা পাবে না। দুনিয়াবী উপকার থাক বা না থাক – আল্লাহর বিধান আমরা মানবোই। কারণ এর দুনিয়াবী উপকার থাকুক বা না থাকুক আল্লাহ আখিরাতে অবশ্যই এর প্রতিদান আমাদেরকে দেবেন। আখিরাতের প্রতিদানই সর্বোত্তম। আমরা আমাদের বিবেক-বুদ্ধি কোন জ্ঞানপাপী অজমূর্খ নাস্তিক-মুক্তমনার হাতে বন্ধক দেইনি। ওরা সলাত কিংবা অন্য কোন বিধানের ১০০০টা তথাকথিত অপকারিতা(!) বের করলেও আমরা খুশীমনে ওদেরকে বলে দেব—
إِنِ ٱلۡحُكۡمُ إِلَّا لِلَّهِۖ يَقُصُّ ٱلۡحَقَّۖ وَهُوَ خَيۡرُ ٱلۡفَـٰصِلِينَ (٥٧)
“...হুকুমের মালিক আল্লাহ ছাড়া কেউ নয়। তিনি সত্য বর্ণনা করেন এবং তিনিই শ্রেষ্ঠতম মীমাংসাকারী। ” [8]
তথ্যসূত্রঃ
[1] সিয়ামের উদ্যেশ্য তাকওয়া বা পরহেজগারী অর্জন করা। দেখুনঃ সুরা বাকারাহ ১৮৩ নং আয়াত
[2] ভিত্তিহীন একটি কথা
[3] মুসলিম ৭৪৬; আরো দেখুন – কুরআনুল কারিম বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসির (ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া), ২য় খণ্ড, সুরা মুযযাম্মিলের ২ নং আয়াতের তাফসির, পৃষ্ঠা ২৭০৮
[4] পরবর্তীতে বিধানটি মানসুখ বা রহিত করা হয়। দেখুন – কুরআনুল কারিম বঙ্গানুবাদ ও সংক্ষিপ্ত তাফসির (ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া), ২য় খণ্ড, সুরা মুযযাম্মিলের ২০ নং আয়াতের তাফসির, পৃষ্ঠা ২৭১৪
[5] ■ তিরমিযী ৩৬৭৫, আবু দাউদ ১৬৭৮, দারেমী ১৬৬০
■ ‘আসহাবে রাসুলের জীবনকথা’ (১ম খণ্ড) – মুহাম্মদ আবদুল মা’বুদ; পৃষ্ঠা ৪২
[6] إِنَّ ٱللَّهَ ٱشۡتَرَىٰ مِنَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ أَنفُسَهُمۡ وَأَمۡوَٲلَهُم بِأَنَّ لَهُمُ ٱلۡجَنَّةَۚ يُقَـٰتِلُونَ فِى سَبِيلِ ٱللَّهِ فَيَقۡتُلُونَ وَيُقۡتَلُونَۖ وَعۡدًا عَلَيۡهِ حَقًّ۬ا فِى ٱلتَّوۡرَٮٰةِ وَٱلۡإِنجِيلِ وَٱلۡقُرۡءَانِۚ وَمَنۡ أَوۡفَىٰ بِعَهۡدِهِۦ مِنَ ٱللَّهِۚ فَٱسۡتَبۡشِرُواْ بِبَيۡعِكُمُ ٱلَّذِى بَايَعۡتُم بِهِۦۚ وَذَٲلِكَ هُوَ ٱلۡفَوۡزُ ٱلۡعَظِيمُ (١١١)
“ আল্লাহ মুমিনদের থেকে তাদের জান ও মাল এই মূল্যে ক্রয় করে নিয়েছেন যে—তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত। তারা যুদ্ধ করে আল্লাহর রাহে, অতঃপর মারে ও মরে। তাওরাত, ইঞ্জিল ও কুরআনে তিনি এ সত্য প্রতিশ্রুতিতে অবিচল। আর আল্লাহর চেয়ে প্রতিশ্রুতি রক্ষায় কে অধিক? সুতরাং তোমরা আনন্দিত হও সে লেনদেনের উপর, যা তোমরা করছ তাঁর সাথে। আর এ হল মহান সাফল্য।”
(আল কুরআন, তাওবা ৯ : ১১১)
[7] আল কুরআন, বাকারাহ ২ : ২৮৫
[8] আল কুরআন, আন’আম ৬ : ৫৭