নবি ইউসুফ আ. বলেন,
'হে আমার কারা-সঙ্গীদ্বয়! ভিন্ন ভিন্ন বহু রব উত্তম, না পরাক্রমশালী এক আল্লাহ্? তাকে ছেড়ে তোমরা শুধু এমন কতকগুলো নামের ইবাদত করছ, যে নামগুলো তোমাদের পিতৃপুরুষ ও তোমরা রেখেছ; এগুলো কোন প্রমাণ আল্লাহ্ পাঠাননি। বিধান দেয়ার অধিকার শুধু মাতর আল্লাহরই। তিনি নির্ধেশ দিয়েছে শুধু তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত না করতে, এটাই শাশ্বত দ্বীন কিন্ত অধিকাংশ মানুষ এটা জানে না।'
[সূরা ইউসুফ, ৩৯-৪০]
এই পৃথিবী এক বস্তা আইডলে ভরা। তারা প্রত্যেকেই চায়, আমরা যেন তাদের অনুসারী হই, তাদেরকে আপন করে নিই। কিন্তু যখনি আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যকিছুকে আমাদের জীবনের সফলতা-ব্যর্থতা, সুখ-দুখ নির্ণয়ের এখতিয়ার দিই, তখন আমরা তার দাসে পরিণত হই। আমাদের জীবনের মূল্য সেটাকেই ঘিরে বাড়ে কমে। জীবনের সফলতা-ব্যর্থতা সবকিছু তার ওপর নির্ভর করে নির্ণয় করা হয়। আমাদের পুরো জীবনটা তার নিয়ন্ত্রণ চলে যায়। এক কথায় বললে, সে অধিপতিতে পরিণত হয়, আর আমরা তার দাসে; এবং বন্দী হই তার জেলখানায়।
কালের পরিক্রমায় নারীদের মূল্য বিবেচনার ক্ষেত্রেও এই অধিপতিরা বিভিন্ন রূপ ধরে আসে। সর্বপ্রথম এরা একটি বুলির প্রচার চালায়। স্বাধীনতার বুলি। দেখায়, সমাজে সবাই বন্দী; বোঝায়, কেবল তারাই স্বাধীন! বিবেক যখন কোনো কিছুতে বন্দী হয়ে যায়, সে ঠিক বেঠিক যাচাইয়ের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। কিন্তু সে নতুনত্ব পছন্দ করে। এরা সর্বপ্রথম সেই অবলাদের নিয়ে কাজ করে। নতুনত্ব দ্বারা তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। এক পর্যায় মানদণ্ড দাঁড় করায়, এবং এটা দ্বারাই সে যুগে নারীদের সফলতা-ব্যর্থতা বিবেচনা শুরু হয়। এসব প্রোপাগান্ডার ভিতর সবচে' প্রভাব ফেলেছে 'পুরুষ আইডল'! অর্থাৎ সবক্ষেত্রে পুরুষদের সমপর্যায়ে থাকার নীতি। Gender Discrimination বা নারী পুরুষের শারীরিক এবং মানসিক বৈষম্যকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা, এবং এই বৈষম্য থেকে বেড়িয়ে আসার জন্য জাতিকে যুদ্ধে নামানো মতো প্রোপাগান্ডা এভাবেই সয়লাভ করেছে সমগ্র পৃথিবী জুড়ে। এ দ্বারা নারীকে বোঝানো হয়, তোমার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে; এবং পুরুষকে বোঝানো হয়, নারীদের রেস্পেক্ট করা হচ্ছে। সত্যিই কি তাই?
যেহেতু পাশ্চাত্যের নারীবাদীরা জাতির মস্তিষ্ক থেকে আল্লাহর অস্তিত্বই মুছে দিতে চায়; আর তাই পুরুষ ছাড়া তাদের কাছে ভিন্ন কোনো মানদণ্ড থাকে না। ফলশ্রুতিতে তারা বাধ্য হয় পুরুষদের মাঝেই নিজেদের মূল্য খুঁজে নিতে। এভাবে একজন নারী এমন কিছুকে তার আইডল বানিয়ে নেয়, এমন কিছুর দাসত্ব শুরু করে যা নিজেই ত্রুটিপূর্ণ। সে ভাবতে শুরু করে, জীবনের মূল্য নির্ধারণে পুরুষই হচ্ছে উপযুক্ত মানদণ্ড; এটাই তাকে স্বাধীন করতে পারে। সে বিশ্বাস করে, একটি মেয়ে শিশু ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষের মতো মানুষ হতে পারবে না যতক্ষণ না সে পুরুষদের মতো সব করতে পারছে। সে ততক্ষণ পর্যন্ত স্বাধীন নয়, যতক্ষণ সে পুরুষদের মতো সব পাচ্ছে কিংবা তার চেয়েও বেশী পাচ্ছে। কারণ, এটাই মানদণ্ড। পুরুষরা যদি জিন্স প্যান্ট পড়তে পারে, তাহকেও পড়তে হবে। পুরুষরা যদি আর্মিতে যেতে পারে, তাকেও আর্মিতে যেতে হবে। সে এগুলো চায় কারণ, মানদণ্ড! স্ট্যান্ডার্ড। সে এটা বুঝতে পারে না, আল্লাহ্ তা'আলা নারী-পুরুষ উভয়কেই স্বতন্ত্রভাবে সম্মানিত করেছেন। স্বতন্ত্রতার মাঝেই তাদের সম্মান রেখেছেন; একে অন্যের কার্বন কপি হবার মাঝে নয়।
একজন নারী যখন পুরুষকে তার স্ট্যান্ডার্ড বানায়, তখন থেকেই অন্তরে একটি সন্দেহ জেঁকে বসে- 'আমাকে ঠকানো হচ্ছে।' সে সবকিছুতে সন্দেহ করতে থাকে। এমনকি নিজের অস্তিত্ব নিয়েও কখনো কখনো হীনমন্যতায় ভোগে। যে স্বতন্ত্রগুণ নিয়ে সে জন্মেছে, এগুলো তার নিকট অপমানজনক বিবেচিত হয়। আচরণে স্পর্শকাতরতা অপমানজনক, পড়াশোনা শেষে ফুল টাইম মা হওয়া লজ্জাজনক, ভাল রেজাল্ট করে ঘরে বসে থাকা অধঃপতন, বিয়ের পর কেবল ঘরে স্ত্রীর ভূমিকা রাখা বন্দিত্ব...! এভাবে একজন নারী যখন মনে করে পুরুষদের যা আছে, তারা যা করতে পারে, তাদেরকে যা দেয়া হয়েছে—এগুলোই সর্বোত্তম, তখন তার অন্তরে এই নতুন লক্ষ্য গেড়ে বসে; সমপর্যায়ে থাকার লক্ষ্য। সে দাবী করে, যদি এগুলো একজন পুরুষ পেতে পারে, তাহলে আমারও এটা চাই। যদি পুরুষরা ওড়না ছাড়া চলতে পারে, তাহলে আমাকেও দিতে হবে। পুরুষরা ডিভোর্স দিতে পারে, তাহলে আমাকেও এ অধিকার দিতে হবে। যদি পুরুষরা ঘরের বাহিরে কাজ করতে পারে, তাহলে আমিও করতে চাই। যদি পুরুষরা আকাশে প্লেন চালাতে পারে, তাহলে আমিও চালাতে চাই। যদি পুরুষরা পাবলিক স্পিকার হতে পারে, তাহলে আমাকেও হতে হবে। যদি পুরুষরা অন্য দেশে ডিগ্রির জন্য যেতে পারে, তাহলে আমাকেও যেতে হবে। যদি পুরুষরা প্রেসিডেন্ট হতে পারে, তাহলে আমাকেও হতে হবে..ইত্যাদি। তাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে হবে; কারণ, পুরুষই স্ট্যান্ডার্ড! সে এসব করে ভাবে, সে স্বাধীন! কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সে বন্দী...
আমি এই লেখা দ্বারা নারীদের ছোট করছি না। বরং এসব যে একটা নষ্ট সমাজ ব্যবস্থার ফল—সেটা বোঝাচ্ছি। ছোট বেলা থেকেই মেয়ে শিশুদের মনে এই বীজ বুনে দেয়া হয়। পরিবেশ পরিস্থিতি তাকে এরকম করেই ভাবতে শেখায়। সে হারিয়ে ফেলে স্বাধীনতার মূল চাবি। ভুলে যায়, কোথায় তার সম্মান-মর্যাদার খনী। জীবনের সফলতা-ব্যর্থতা নির্ণয়ে কী হবে তার মানদণ্ড—এ নিয়ে সে থাকে দ্বিধায়। সত্যি বলতে, মেয়েরা এগুলো ভাবারও সুযোগ পায় না। ভাবার বয়সে পৌঁছানোর আগেই তাকে এসবে অভ্যস্ত করে ফেলা হয়। এবং একটা পর্যায়ে সমাজে প্রচলিত রীতিকেই সে মেনে নেয়। মনের অজান্তেই এই মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে সে হেরে যায়।
অপরদিকে এই রোগ এতটা মহামারি আকার ধারণ করেছে যে, দ্বীনে ফিরে আসার পরেও অনেক বোনদের মাঝে এর প্রভাব থেকে যায়। এবং তাদেরকে একটা পর্যায় মডার্নিজমের ভ্রান্তির জালে আটকে দেয়। হিজাব পড়ে ভার্সিটির ছেলেদের সাথে চিল করা, তাদের সাথে আড্ডা দেয়া, ছেলে বন্ধু রাখা বা বয় ফ্রেন্ড থাকা, পুরুষদের সাথে জব করা, হিজাব পড়ে ফ্যাশন শো করা; এবং এসবকে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখা—ইত্যাদি যে কমন সিনারিগুলো এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি দ্বীনি সমাজে, এসবের উৎপত্তি ঐ রোগ থেকেই। এবং এটা তাদেরকে ধীরে ধীরে মডার্নিজমের দিকে নিয়ে যায়। তাদেরকে ভাবায়, ইসলাম নারীদের পূর্ণ অধিকার দেয় না, কাঠ মোল্লারা তাদেরকে এক ঘরে করে রাখে। মুফতিদের কাছে প্রশ্ন আসে- "ইসলামে নারীর অধিকার নিয়ে আমি কনফিউজড।"
তাহলে সমাধান কোথায়? সাহাবিরা যখন নতুন কোনো শহরে প্রবেশ করতেন, সর্বপ্রথম একটি দাওয়াহ নিয়ে যেতেন, ‘আমরা এসেছি তোমাদেরকে মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে আল্লাহর দাসত্বে ফিরিয়ে নিতে।’
[আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ইবনু কাসীর]
আমরা যদি একটু ভাবি তাহলে দেখবো, এই বক্তব্যের ভিতর লুকিয়ে আছে অনেক দামী একটি চাবি; প্রকৃত স্বাধীনতার চাবি, যে চাবি দিয়ে ব্যক্তি পাবে সকল দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি। অর্থাৎ আল্লাহকে স্ট্যান্ডার্ড হিশেবে গ্রহণ করার মাঝে। তাঁর কাছে শ্রেষ্ঠ হবার স্বদিচ্ছা। যখন আমরা আল্লাহর বিধানকে মানদণ্ড হিশেবে গ্রহণ করব, সর্বত্র তাঁর রসূলের এবং সাহাবাদের নীতি প্রয়োগ করব, তখন সমাজ থেকে যুলুম বিলুপ্ত হবে, তেমনি সকলের পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। আর আল্লাহর কাছে শ্রেষ্ঠত্ব ভিত্তি লিঙ্গ নয়, বরং তাকওয়া। তিনি বলেন,
"নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তিই আল্লাহর নিকট অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে অধিক আল্লাহ-ভীরু। অবশ্যই তিনি সবকিছু জানেন, সবকিছুর খবর রাখেন।"
[সূরা হুজুরাত, ১৩]
এটাই আল্লাহর মানদণ্ড প্রিয় বোন! লিঙ্গ নয়। তোমার শ্রেষ্ঠত্ব পুরুষ হবার মাঝে নয়। তোমার মূল্য এত ঠুনকো কিছু নির্ধারণ করার অধিকার রাখে না। তোমার দেহের মূল্য কাগজের টাকা নির্ধারণ করতে পারে না। আল্লাহ্ তোমাকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর জন্য। তাঁর সাথে সম্পর্ক গড়ার জন্য। তাঁর রঙ্গে রঙ্গিন হবার জন্য। তুমি জানো, এই জাঁকজমক-পূর্ণ দুনিয়া মূলত এক বিশাল জেলখানা। এই দুনিয়ার কাছে তুমি স্বাধীনতা আশা করে পাবে না। সে তোমাকে সর্বদা ঠকাবে। পদে পদে ধোঁকা দেবে। ন্যায়বিচার তার কাছে পাবে না। সে তোমার সরলতার সুযোগ নিয়ে বন্দী করবে। মুক্ত আকাশের কথা বলে তার বানানো অন্ধকার প্রাচীরেই ঘিরে ফেলবে। তোমাকে তার প্রোডাক্ট বানাবে। তোমার মস্তিষ্ককে তার কবজায় বন্দী করবে। অপরদিকে আল্লাহ্ তোমার জন্য খুলে রেখেছেন স্বাধীনতা দুয়ার, এনে দিয়েছেন তোমার হাতের নাগালে জান্নাত। কতই না সহজ উপায় রেখেছেন তিনি!
আবু হুরায়রা রাযি. থেকে বর্ণিত, রসূল ﷺ বলেছেন: 'যদি কোন নারী পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করে, রমাদান মাসে সিয়াম পালন করে, লজ্জাস্থানের হেফাযত করে এবং স্বামীর আনুগত্য করে, সে জান্নাতের যে দরজা দিয়ে ইচ্ছা প্রবেশ করবে।’
[ইবনু হিববান এটি বর্ণনা করেছেন এবং আলবানী একে সহীহ বলেছেন]
তাই ফিরে এসো সেই পথে যে পথে হেটে গেছেন নবিগণ। হেটেছেন উম্মুল-মুমিনীন রাদিয়াল্লাহু আনহুন্না। তাঁরা রেখে গেছেন অবদান, করেছেন নারী জাতিকে সম্মানিত এবং হয়েছেন সর্বকালের উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাদের দেখানো পথে ফিরে এসো হে বোন!
আরো পড়ুনঃ
"নারীবাদ এবং অবাস্তব সমতা"