নাস্তিক-মুক্তমনারা ‘ধ’ অদ্যাক্ষরবিশিষ্ট তাদের একটি ইসলামবিদ্বেষী ব্লগে দাবি করেছে নবী মুহাম্মাদ (ﷺ) এর আদেশে তাঁর শিষ্যরা নাকি অনেক বর্বরতা চালাতেন (নাউযুবিল্লাহ)। সাহাবীরা নাকি উম্মে কিরফা নামে অতিবৃদ্ধা এক মহিলাকে অমানুষিক পাশবিকতায় হত্যা করেন। এই ব্লগ থেকে এসব দেখে তারা আরো বিভিন্ন স্থানে নবী(ﷺ) ও সাহাবীদের বিরুদ্ধে খারাপ কথা বলে। আমরা এ সংক্রান্ত বর্ণনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখেছি উম্মে কিরফাকে হত্যা করার ব্যাপারে দুই ধরণের বিবরণ পাওয়া যায়। কোনো বর্ণনায় যায়দ বিন হারিসা(রা.) কর্তৃক আবার কোনো বর্ণনায় আবু বকর(রা.) কর্তৃক তাকে শাস্তি দেয়া বা হত্যা করার বর্ণনা পাওয়া যায়। তবে এ সংক্রান্ত একটি বর্ণনাও বিশুদ্ধ নয়। নবী(ﷺ) বা সাহাবীদের থেকে এমন কোনো ঘটনাই বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয়। নাস্তিকদের এ সংক্রান্ত অভিযোগের জবাবে আমরা কাতারভিত্তিক সুবিখ্যাত ইসলামী ওয়েবসাইট Islamweb থেকে বর্ণনাগুলোর তাহকিকযুক্ত সম্পূর্ণ একটি ফতোয়া উল্লেখ করছি।
ফতোয়া নং ১৯২৯৮৩: উম্মে কিরফাকে কিভাবে হত্যা করা হয়েছে এ সংক্রান্ত বর্ণনার দুর্বলতা
ফতোয়া প্রদানের তারিখঃ ১২-১২-২০১২, মুহাররাম ২৯, ১৪৩৪
মূলঃ Islamweb
অনুবাদঃ মুহাম্মাদ মুশফিকুর রহমান মিনার
প্রশ্নঃ
আসসালামু আলাইকুম। ইসলামবিরোধীরা ইসলামকে বর্বর ধর্ম হিসেবে দেখানোর জন্য নিচের ঘটনাটি উল্লেখ করছে। যায়দ(রা.) কায়স বিন মুসাহহারকে উম্মে কিরফাকে হত্যা করতে আদেশ দেন। তিনি সেই মহিলাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেন (ইবন ইসহাক)। যায়দ বিন হারিসা(রা.) উম্মে কিরফাকে হত্যার জন্য কায়সকে আদেশ করলে তিনি অত্যন্ত নির্দয়ভাবে তাকে হত্যা করেন। তিনি ঐ মহিলার দুই পা একটি করে রশি দিয়ে বাঁধেন এবং রশিগুলো দুইটি উটের সাথে বেঁধে দেন। (উটগুলো এরপর দৌঁড় দেয়) এবং ঐ মহিলা দুইভাগ হয়ে যায় (তাবারী)।
উপরের ঘটনাগুলো কতোটুকু সহীহ তা কি অনুগ্রহ করে জানাবেন? উম্মে কিরফা কী দোষ করেছিলো যার জন্য তাকে এমন নিষ্ঠুর শাস্তি দেয়া হলো? ঘটনাটি যদি সহীহ না-ই হয়ে থাকে, তাহলে ইবন ইসহাক এবং তাবারী কেন এমন নৃশংস একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন?
উত্তরঃ
যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর যিনি জগৎসমূহের প্রতিপালক। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য উপাস্য নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি মুহাম্মাদ (ﷺ) তাঁর বান্দা ও রাসুল।
ইসলামেরর বিরুদ্ধে নানা বিদ্বেষপূর্ণ অভিযোগ খুঁজে বের করতে ইসলামের শত্রুরা কোনো কসুর করে না। তাদের উদ্যেশ্য হচ্ছে আল্লাহর দ্বীনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। তাদের এহেন কাজে অবাক হবার কিছুই নেই কেননা তারা তো ইসলামের শত্রু। তবে একজন মুসলিমের উচিত তার দ্বীনের প্রতি দৃঢ় ঈমান রাখা। এবং এসব অভিযোগ দেখে সংশয়ে পতিত না হওয়া – তার কাছে এর জবাব থাকুক আর না থাকুক। আর এমন কারো যদি পর্যাপ্ত দ্বীনি জ্ঞান এবং দৃঢ় ঈমান না থাকে তাহলে তার উচিত এসব জিনিস শ্রবণ করা অথবা পড়া থেকে বিরত থাকা। কেননা এর দ্বারা তার ঈমান নড়ে যেতে পারে।
উম্মে কিরফা সংক্রান্ত এই অভিযোগের ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে – প্রখ্যাত গবেষক আলি ইবন নায়িফ আশ শাহুদ লিখিত ‘আল মুফাসসাল ফির রাদ্দ ‘আলা শুবুহাত আ’দা আল ইসলাম’ (ইসলামের শত্রুদের অভিযোগের বিস্তারিত জবাব) শীর্ষক গ্রন্থে বলা হয়েছেঃ
“...[যায়দ(রা.) সংক্রান্ত] বর্ণনাটি ইবন সা’দ(র.) এর ‘তাবাকাত’ এ উল্লেখ আছে। ইবনুল জাওযি(র.) তাঁর সূত্রে এই বর্ণনাটি ‘মুনতাযিম’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। এই বর্ণনার উৎস হচ্ছেন মুহাম্মাদ ইবন উমার আল ওয়াকিদি। মুহাদ্দিসগণের মতে তিনি মিথ্যার দোষে অভিযুক্ত। ইবন কাসির(র.) এর ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’তেও এই বর্ণনাটি সংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে তিনি এর ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেননি। ইবন হিশাম(র.) তাঁর ‘সিরাহ’ গ্রন্থেও এই বর্ণনা উল্লেখ করেছেন। তাঁরা উভয়েই [ইবন কাসির(র.) এবং ইবন হিশাম(র.)] এটি মুহাম্মাদ ইবন ইসহাক থেকে উল্লেখ করেছেন যিনি এই বর্ণনার কোনো সনদ উল্লেখ করেননি। উপসংহারে আমরা বলতে পারি এই বর্ণনা বিশুদ্ধ নয়। কাজেই একে দলিল হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।”
এরপরে গ্রন্থটির লেখক আল ওয়াকিদির ব্যাপারে মুহাদ্দিসদের বক্তব্যগুলো উল্লেখ করেছেন। [1]
নৃশংস হত্যাকাণ্ডের এহেন বর্ণনার ব্যাপারে হাফিয ইবন হাজার(র.) অভিমত হচ্ছে, এই বর্ণনাটি যঈফ (দুর্বল)। তিনি তাঁর ‘আদ দিরায়াহ ফি তাখরিজ আহাদিস আল হিদায়াহ’ গ্রন্থে বলেছেন, “দারাকুতনী(র.) একটি বিচ্ছিন্ন সনদে উল্লেখ করেছেন যে আবু বকর(রা.) উম্মে কিরফা আল ফাযারিয়্যাহকে মুর্তাদ হবার জন্য হত্যা করেছেন এবং তার মৃতদেহ বিকৃত করেছেন।” আর এটি তো সকলেরই জানা যে বিচ্ছিন্ন সনদের হাদিসকে যঈফ (দুর্বল) হাদিসের শ্রেণীভুক্ত করা হয়।
হাফিয যায়লাঈ(র.) তাঁর ‘নাসবুর রাইয়াহ লি আহাদিসিল হিদায়াহ’ গ্রন্থেও [আবু বকর(রা.) সংক্রান্ত] এ বর্ণনাকে যঈফ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেছেন, “সাঈদ ইবন আব্দুল আযিযের সুত্রে দারাকুতনী(র.) বর্ণনা করেছেনঃ আবু বকর(রা.) উম্মে কিরফা আল ফাযারিয়্যাহকে মুর্তাদ হবার জন্য হত্যা করেছেন এবং তার মৃতদেহ বিকৃত করেছেন। তিনি তার উভয় পা একটা করে ঘোড়ার সাথে বেঁধে দেন। এরপর চিৎকার করে ঘোড়াগুলোকে যেতে বললে সেগুলো (দৌঁড় দেয় এবং) ঐ মহিলার দেহকে দুই ভাগে চিড়ে ফেলে। যাই হোক, সাঈদের আবু বকর(রা.) এর সঙ্গে কখনো সাক্ষাৎ হয়নি। কাজেই এই বর্ণনাটি বিচ্ছিন্ন।”
যায়দ বিন হারিসা(রা.) একজন মহান সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন এবং তিনি কখনোই একজন নারীর সঙ্গে এমন আচরণ করেননি। আর মৃতদেহ বিকৃত করা ইসলামে নিষিদ্ধ। বুরায়দাহ(রা.) বর্ণনা করেছেন, সৈন্যবাহিনীর অধিনায়কদের প্রতি নবী(ﷺ) এর উপদেশগুলোর মধ্যে ছিলো, “...যুদ্ধ চালিয়ে যাও, তবে গনীমাতের মালের খিয়ানাত করবে না, চুক্তি ভঙ্গ করবে না, শত্রু পক্ষের অঙ্গ বিকৃতি সাধন করবে না। শিশুদেরকে হত্যা করবে না।...” [সহীহ মুসলিম] [2]
ইসলামে যুদ্ধের ময়দানে নারীদেরকে হত্যা করা নিষিদ্ধ যদি না সে লড়াই করে অথবা যোদ্ধাদের সাহায্য করে লড়াইয়ে উস্কানী দেয়। কেবলমাত্র এই ক্ষেত্রে তাদেরকে হত্যা করা যায়।
রিবাহ ইবন রাবী(রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ আমরা কোন এক যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ্(ﷺ) এর সঙ্গে ছিলাম। তিনি কিছু লোককে এক স্থানে একত্রিত হতে দেখেন। তখন তিনি এক ব্যক্তিকে পাঠান এবং বলেনঃ দেখ তো এরা কি জন্য সেখানে একত্রিত হয়েছে? তখন সে ব্যক্তি এসে বললঃ তারা জনৈক নিহত মহিলার নিকট একত্রিত হয়েছে। তখন তিনি [নবী(ﷺ)] বলেনঃ এ মহিলা তো কারো সাথে যুদ্ধ করতে আসেনি (একে মারা হলো কেন?) তখন এক ব্যক্তি বললঃ অগ্রবর্তী সেনাদলের নেতা হলেন খালিদ ইবন ওয়ালীদ। তখন তিনি এক ব্যক্তিকে পাঠিয়ে বলেনঃ খালিদকে বল, মহিলা ও মজদুর (খাদিম) যেন হত্যা না করে।” [আহমাদ এবং আবু দাউদ] [3]
ইমাম বায়হাকী(র.) তাঁর ‘সুনান আস সুগরা’ গ্রন্থে এই হাদিসের ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন, “কোনো নারী যদি যুদ্ধ করে, তবে তাকে হত্যা করা বৈধ। এই হাদিসটি এর প্রমাণ।” [4]
তাবারী(র.) এবং ইবন ইসহাক(র.) এই হাদিসকে কেন নিজ গ্রন্থে উল্লেখ করলেন এর উত্তরে আমরা বলবোঃ তারিখ (ইতিহাস) গ্রন্থের ক্ষেত্রে তাঁদের কর্মপন্থা ছিলো – তাঁরা যা যা বিবরণ পেতেন, সবই লিপিবদ্ধ করতেন। তবে এ ব্যাপারে তাঁরা সকলেই একমত ছিলেন যে, দলিল হিসেবে পেশ করার ক্ষেত্রে কোনো হাদিসকে যাচাই করা জরুরী এবং সেই হাদিসকে অবশ্যই সহীহ হতে হবে।
আল্লাহই সর্বোত্তম জানেন।
মূল ফতোয়ার লিঙ্কঃ https://www.islamweb.net/en/fatwa/192983/
পাদটীকা
[1] আগ্রহী পাঠকরা অনলাইনে আলি ইবন নায়িফ আশ শাহুদ লিখিত ‘আল মুফাসসাল ফির রাদ্দ ‘আলা শুবুহাত আ’দা আল ইসলাম’ (ইসলামের শত্রুদের অভিযোগের বিস্তারিত জবাব) গ্রন্থটি থেকে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা দেখে নিতে পারেন নিচের লিঙ্ক থেকেঃ
[2] হাদিসের অনুবাদ নেয়া হয়েছে এখান থেকেঃ
[3] হাদিসের অনুবাদ নেয়া হয়েছে এখান থেকেঃ
[4] নিঃসন্দেহে এ সংক্রান্ত বর্ণনাগুলো দুর্বল এবং বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয়। তবে এই দুর্বল বর্ণনাগুলোতেও এটি উল্লেখ নেই যে উম্মে কিরফাকে বিনা দোষে হত্যা করা হয়েছে! তাবাকাত এবং ইবন হিশামের বর্ণনায় আছেঃ যায়দ বিন হারিসা(রা.) ব্যাবসার জন্য সিরিয়ায় গেলে ওয়াদিল কুরার নিকটে বনু ফাযারার লোকেরা তাঁকে হামলা করে। এদের সর্দার ছিলো উম্মে কিরফা। তারা হামলা করে যায়দ(রা.) এর কিছু সঙ্গীকে হত্যা করে এবং সকল ব্যাবসায়িক পণ্য লুট করে নিয়ে যায়। যায়দ(রা.) নিজেও এর ফলে আহত হন। এই ভয়াবহ অপরাধের জন্য বনু ফাযারার নেত্রী উম্মে কিরফার দুই পা উটের সাথে বেধে উটগুলোকে হটিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। [বিস্তারিত দেখুনঃ ইবন হিশাম ২/২১৭, তাবাকাত – ইবন সা’দ ২/৯০] ‘সিরাত হালাবিয়্যা’তে এটাও উল্লেখ আছে যে উম্মে কিরফা সন্তান ও নাতিদের মধ্য থেকে ৩০ জন অশ্বারোহীও প্রস্তুত করেছিলো এবং মদিনায় আক্রমণ ও নবী(ﷺ)কে হত্যার আদেশ দিয়েছিলো। [সিরাত হালাবিয়্যা ৩/২৫১] যদিও এই বর্ণনাগুলো বিশুদ্ধ নয়, তথাপি এগুলোতে উম্মে কিরফার ভয়াবহ সব অপরাধ এবং এর প্রেক্ষিতে তাকে শাস্তি দেয়া হয়েছিলো বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। অথচ ইসলামের শত্রুরা সেই দুর্বল বিবরণগুলো লুফে নিয়ে এমন এক চিত্র আঁকে যেন ইসলাম এক বর্বর ধর্ম এবং নবী(ﷺ) ও সাহাবী(রা.)গণ অযথা নৃশংসতা করে বেড়াতেন (নাউযুবিল্লাহ)। সত্যের সাথে তাদের অঙ্কিত চিত্রের পার্থক্য বিশাল।