প্রত্যয় ভাই তার বন্ধুদের সাথে রেস্তোরাঁয় খেতে এসেছে। আজ তারা গ্রিলড চিকেন খাবে। কোয়ার্টার গ্রিল একশ টাকা করে। খাওয়ার মাঝখানে কোথা থেকে এক পুঁচকে এসে এক টুকরা চেয়ে বসল। গরীব ছেলেটিকে দেখে প্রত্যয় ভাইয়ের একটু মায়াই হলো। ছেলেটার নাম নাকি সুমন। তবে গ্রিল সে সুমনকে দিলো না। ওকে কিছু টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলল কিছু খেয়ে নিতে। ওইটুকু নিয়েই আপাতত ছেলেটাকে চলে যেতে হলো।
তো পাঠক, খেয়াল করুন তারা সবাই এখানে খেতে এসেছিল, ভোগ করতে এসেছিল, 'কুরবানি' দিতে কিন্তু আসেনি। তাই মাত্র একশ টাকার গ্রিলও তারা ছেলেটাকে দিতে পারল না। তাও আবার এটি একটি মুরগির চার ভাগের এক ভাগ মাত্র! সেখানে মুসলিম জাতি আস্ত একটি পশুকে তিনটা ভাগ করে। এক ভাগ গরীবকে দেয়, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজনকে দেয় আর বাকি থাকে এক ভাগ যেটা নিজে খায়।
খুব কি সাধারণ ঠেকছে ব্যাপারটা? যেখানে সামান্য মুরগির একটা ভাগ বিনা দাবিতে ছেড়ে দিতে কষ্ট হয়ে যায় সেখানে নিজের গাঁটের টাকা খরচ করে কেনা আস্ত একটা পশুর সম্পূর্ণ দুই-তৃতীয়াংশ[1] বছরের পর বছর ধরে মুসলিম জাতি বিনা কোনো দাবিতে, বিনা কোনো সঙ্কোচে মানুষকে হাসিমুখে দিয়ে যাচ্ছে। কেন দিচ্ছে? কার জন্য দিচ্ছে? এটা রেস্তোরাঁর কোনো ভোগপণ্য নয়, এরই নাম 'কুরবানি'।
কুরবানি বলেই নিজের টাকায় কেনা হলেও এর উপর সবচেয়ে কম অধিকারটিও নিজের। কাউকে বঞ্চিত করার উপায়ও আমাদের নাই আবার নিজের টাকায় কিনেছি বলে যে শখের বশে মেরে ফেলে রাখব, নিজেও খাব না, কাউকে খেতেও দিব না এমনটাও করা সম্ভব না।
এর উদ্দেশ্য বুঝতে হলে কিছু অলঙ্ঘনীয় বিধান দেখি চলুন। ধরা যাক, কোনো কারণে এক ব্যক্তি নির্ধারিত তিন দিনের একদিনও কুরবানি করার সুযোগ পাননি। এক্ষেত্রে পশুর কী হবে? ইসলাম বলে, ওই পশু দান করে দাও[2]। যদি জবাই করে থাক তাহলে ওর সম্পূর্ণ মাংস দান করে দাও[3]। যদি মাংসের দাম পশুর দামের চেয়ে কম হয়ে যায় তাহলে বাকি টাকাও দান করে দাও[4]। যদি পশু থেকে এক চিমটি পশমও ভোগ করে থাক, দুধ পেয়ে থাক, হাল চাষ করে থাক তাহলে ওই পশম, দুধ, চাষের টাকা অবিলম্বে সদকা করে দাও[5]। যদি ওই পশু সন্তান দিয়ে থাকে তোমার অধীনে তবে তাও তোমার না, দান করে দাও[6]। বিক্রি করা চামড়ার একটা টাকাও তোমার না[7]।
যদি তোমার নিয়ত হয়ে থাকে পশুর মাংস ভক্ষণ বা কোনো সুবিধা ভোগ করা তবে তোমার সাথে করা সবার কুরবানি বাতিল[8]। তুমি কি ভেবেছ এগুলো তোমার কোয়ার্টার গ্রিল? হত্যা আর কুরবানি এক?
তুমি চাইলেই কি ইচ্ছা মতো পশু কুরবান করতে পারবে[9]? অপরিণত পশু আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য না[10]। উটের বয়স পাঁচ, গরু-মহিষের জন্য দুই এবং ছাগ-ভেড়ার জন্য এক বছর না হলে ওকে বাড়তে দাও[11]। বালেগ পশু খোঁজ। আবারও বলছি নিয়ত শুদ্ধ করো, এটা ভোগ-বিলাস না, এটা আল্লাহর রাহে কুরবানি। নিজের অর্থ দিয়ে কিনবে বা পেলেপুষে বড় করবে। যত্ন নিবে, নিজের হাতে খাওয়াবে, কাপড় দিয়ে খিদমত করবে, অসুখ হলে চিকিৎসা করাবে, নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসবে। এরপর যদি মায়া জন্মায় ওই অবলার প্রতি। যে হাত দিয়ে খাইয়েছ ওই হাত যদি অগত্যা কেঁপে উঠতে চায়, তবেই হবে তোমার কুরবানি।
আরে এই পশু তো আগেও খেয়েছ। তাহলে সব বার আর এবারের ভিতর কী পার্থক্য? আহারের জন্য ছুরি তো প্রতিদিনই চলছে। কেন বাস্তুসংস্থানও কি পড়নি? আজকে যে উন্নত মস্তিষ্ক ধারণ করছ, এর পিছে পশুর কাছ থেকে পাওয়া মাংসের অবদান কি জান না?[12] খাদ্য হিসাবে নিঃসন্দেহে তা তোমাদের জন্য হালাল[13]। কিন্তু ওই ছুরি আর এই ছুরির ভিতর কী পার্থক্য? আগেরটা তো কেবল ভোগ করেছ। আর এটা ত্যাগের জন্য। আগেরটাকে বাজারে গিয়ে লোভের চোখে দেখতে, আর এটাকে দেখছ প্রাণের চোখে। এর রক্তের দাম সে-ই জানে যে তাকে নিজ হাতে দু'বেলা ঘাস খাইয়েছে, মাথায় হাত বুলিয়েছে।
যার তার গলায় ছুরি চালালেই তো কুরবানি হয় না। যেনতেন কুরবানি তো কবুল হবে না। তিনি তো বলেই দিয়েছেন,
'আপনি তাদেরকে আদমের দুই পুত্রের বাস্তব অবস্থা পাঠ করে শুনান। যখন তারা উভয়েই কিছু উৎসর্গ নিবেদন করেছিল। তখন তাদের একজনের উৎসর্গ গৃহীত হয়েছিল এবং অপরজনের গৃহীত হয়নি। সে বললঃ আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব। সে(আরেকজন) বললঃ আল্লাহ মুত্ত্বাক্বীদের পক্ষ থেকেই তো (কুরবানি) গ্রহণ করেন।'[14]
সুবিধা ভোগ করলে মুত্ত্বাক্বী হবে? পশুকে মাংসের দলা ভাবলে মুত্ত্বাকী হবে? আমার প্রতিবেশি, আমার আত্মীয় আমার সমাজের সুমনেরা অভুক্ত থাকবে আর আমার কুরবানি হবে?
ভাইরে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ একটা দেশের ঘরে-ঘরে কুরবানির দিন মাংস পৌঁছে যায়। যারা কুরবানি না দিয়ে টাকা দেওয়ার কথা বলে তারা কি জীবনে করে দেখিয়েছে এমন কিছু? তাও শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে? গরীব-ধনী, মুসলিম-অমুসলিম কেউ বাদ থাকে না[15]। ইসলাম তো আসলে এ মনুষ্যজাতকে ভোগবাদ শিখায়নি, শুধু বড় বড় কথা বলাতে আসেনি। কিছু করে দেখাতে বলেছে। হত্যা আর কুরবানি শব্দ দু’টিকে এক করে দেখা খুবই পীড়াদায়ক। অর্থ দানের ব্যাপারেও আমাদের যাকাত নামের একটা সুবিশাল বিধান ইতঃমধ্যেই আছে। এরপরেও এর ব্যাপ্তির ব্যাপারে যদি কোনো বিদ্বেষ থাকে তাহলে তা আর শোভনীয় দেখায় না। মানুষই এখানে দিনশেষে লাভবান হচ্ছে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসছে, পেট ভরছে কোটি মানুষের। আল্লাহয় বিশ্বাস যদি নাও থাকে মানুষের প্রতি তো আছে? আর উপকার যদি দিনশেষে মানুষেরই হয়, তাহলে বিধানটি কি তার স্রষ্টা প্রদত্ত নয়?
আমরা তো কুরবানি খেলার জন্য দিই না ভাই, আমরা কুরবানি লাভের জন্যও দিইনা। হত্যা তো অনেক ভাবেই করা যায় কিন্তু কুরবানি? কি প্রত্যয় ভাই কুরবানি?
'এগুলোর গোশত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, কিন্তু পৌঁছে তাঁর কাছে তোমাদের মনের তাক্বওয়া।'[16]
তথ্যসূত্রঃ
[1] বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৪
[2] বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০২, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩২০-৩২১
[3] প্রাগুক্ত
[4] প্রাগুক্ত
[5] মুসনাদে আহমাদ ২/১৪৬
[6] রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৩
[7] আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩২৮, ফাতওয়া হিন্দিয়া ৫/৩০১, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৫
[8] বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৮, সূরা কাওসার: ২
[9] মুয়াত্তা মালিক ২/৪৮২, তিরমিযী ১৪৯৭
[10] মুসলিম ১৯৬৩
[11] কাযীখান ৩/৩৪৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫-২০৬
[12] Here's How Meat-Eating Made Us Human
https://time.com/4252373/meat-eating-veganism-evolution/
[13] সূরা মুমিনুন: ২১
[14] সূরা মায়িদাহ: ২৭
[15] ইলাউস সুনান ৭/২৪৩
[16] সূরা হাজ্ব: ৩৭