Pray for the world economy

কিয়ামতের প্রথম আলামত কী? এ প্রসঙ্গে হাদিসের তথ্যে কি অসঙ্গতি আছে?

 

অভিযোগঃ

ক)

একটি হাদিসে বলা হয়েছে কিয়ামতের প্রথম আলামত হল লেলিহান এক অগ্নি যা মানুষকে তাড়া করবে। এই আলামতটি এখনো প্রকাশ পায়নি। অথচ আমরা জানি যে কিয়ামতের বেশ কিছু ছোট আলামত ইতিমধ্যেই প্রকাশ পেয়েছে। তাহলে এই লেলিহান অগ্নির বিষয়টি কী করে কিয়ামতের প্রথম আলামত হতে পারে? 

অথবা  খ)

সহীহ বুখারীর একটি হাদিসে বলা হয়েছে কিয়ামতের প্রথম আলামত হল লেলিহান এক অগ্নি যা মানুষকে তাড়া করবে। আবার সহীহ মুসলিমের একটি হাদিসে একে কিয়ামতের শেষ আলামত বলা হয়েছে। এই দুই সহীহ হাদিস কি তবে পরস্পরবিরোধী?

 

জবাবঃ

এ প্রসঙ্গে আনাস(রা.) বর্ণিত সহীহ বুখারীর হাদিসটি নিম্নরূপঃ

 

قَالَ أَمَّا أَوَّلُ أَشْرَاطِ السَّاعَةِ فَنَارٌ تَحْشُرُهُمْ مِنْ الْمَشْرِقِ إِلَى الْمَغْرِبِ

অর্থঃ  আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেন, ... ...  নবী বললেন, (১) কিয়ামত নিকটবর্তী হওয়ার সর্বপ্রথম আলামত লেলিহান অগ্নি যা মানুষকে পূর্বদিক হতে পশ্চিম দিকে ধাবিত করে নিয়ে যাবে এবং সবাইকে একত্র করবে। …[1]

 

এই হাদিস দেখে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে কিয়ামতের সব আলামতের মধ্যে একদম প্রথম আলামত হচ্ছে লেলিহান অগ্নি। কিন্তু অন্য আরেক হাদিসে কিয়ামতের বড় আলামতগুলো একের পর এক বর্ণনা করা হয়েছে। এবং সেখানে কিয়ামতের সর্বশেষ আলামত হিসেবে একে উল্লেখ করা হয়েছে। 

এ প্রসঙ্গে হুযাইফা(রা.) বর্ণিত সহীহ মুসলিমের হাদিসটি নিম্নরূপঃ

 

عَنْ حُذَيْفَةَ بْنِ أَسِيدٍ الْغِفَارِىِّ قَالَ اطَّلَعَ النَّبِىُّ عَلَيْنَا وَنَحْنُ نَتَذَاكَرُ فَقَالَ مَا تَذَاكَرُونَ قَالُوا نَذْكُرُ السَّاعَةَ قَالَ إِنَّهَا لَنْ تَقُومَ حَتّٰـى تَرَوْنَ قَبْلَهَا عَشْرَ آيَاتٍ فَذَكَرَ الدُّخَانَ وَالدَّجَّالَ وَالدَّابَّةَ وَطُلُوعَ الشَّمْسِ مِنْ مَغْرِبِهَا وَنُزُولَ عِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ وَيَأْجُوجَ وَمَأْجُوجَ وَثَلاَثَةَ خُسُوفٍ خَسْفٌ بِالْمَشْرِقِ وَخَسْفٌ بِالْمَغْرِبِ وَخَسْفٌ بِجَزِيرَةِ الْعَرَبِ وَآخِرُ ذٰلِكَ نَارٌ تَخْرُجُ مِنَ الْيَمَنِ تَطْرُدُ النَّاسَ إِلَى مَحْشَرِهِمْ

অর্থঃ “হুযাইফা ইবনে আসীদ আল-গিফারী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমরা (দ্বীনী) আলোচনা করছিলাম। এমন সময় নবী আমাদের নিকট আসলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কী নিয়ে আলোচনা করছ? জবাবে তাঁরা বললেন, ’আমরা কিয়ামত নিয়ে আলোচনা করছি।’ এ কথা শুনে তিনি বললেন, কিয়ামত ততক্ষণ পর্যন্ত কায়েম হবে না যতক্ষণ না তোমরা দশটি বিশেষ নিদর্শন দেখবে। অতঃপর তিনি ধোঁয়া, দাজ্জাল, (বিশেষ) জন্তু, পশ্চিম দিগন্ত হতে সূর্য উদিত হওয়া, মারইয়াম তনয় ঈসা (আঃ)-এর অবতরণ, ইয়াজূজ মা’জূজ এবং তিনবার ভূমি ধসে যাওয়া তথা পূর্ব প্রান্তে ভূমি ধস, পশ্চিম প্রান্তে ভূমি ধস এবং আরব উপদ্বীপে ভূমি ধসের কথা উল্লেখ করলেন। সর্বশেষে ইয়ামান থেকে একটি অগ্নি প্রকাশিত হবে, যা মানুষকে হাঁকিয়ে হাশর প্রান্তরের দিকে নিয়ে যাবে[2]

 

জাজিরাতুল আরবের পূর্বদিকে ইয়েমেন। উভয় হাদিসে একই অগ্নির ঘটনার কথাই বলা হয়েছে। হুযাইফা(রা.) বর্ণিত এই হাদিস থেকে স্পষ্ট হল কিয়ামতের সর্বশেষ আলামত হল লেলিহান অগ্নি, প্রথম আলামত নয়। কাজেই কিয়ামতের অনেক আলামত ইতিমধ্যেই সংঘটিত যাওয়ার দ্বারা এখানে কোনো অসঙ্গতির বিষয় সৃষ্টি হয়নি। কিয়ামতের কিছু ছোট আলামত ইতিমধ্যেই প্রকাশ পেয়েছে, বড় আলামতগুলোও ভবিষ্যতে প্রকাশ পাবে এবং সর্বশেষ আলামত হিসেবে লেলিহান অগ্নির বিষয়টি সংঘটিত হবে ইন শা আল্লাহ।

 

এখন প্রশ্ন আসতে পারে, সহীহ বুখারীর হাদিস দেখে মনে হচ্ছে লেলিহান অগ্নির বিষয়টি কিয়ামতের প্রথম আলামত। আবার সহীহ মুসলিমের হাদিস দেখে মনে হচ্ছে এটি সর্বশেষ আলামত। এখানে হাদিসদ্বয়ের মাঝে কি পরস্পরবিরোধিতা আছে? প্রথম হাদিসে কী অর্থে একে ‘প্রথম আলামত’ বলা হল?

 

এই প্রশ্নের উত্তরে সহীহ বুখারীর সব থেকে প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘ফাতহুল বারী’তে ইমাম ইবন হাজার আসকালানী(র.) উল্লেখ করেছেনঃ   

 

وَهَذَا في الظَّاهِرِ يُعَارِضُ حَدِيثَ أَنَسٍ الْمُشَارَ إِلَيْهِ فِي أَوَّلِ الْبَابِ؛ فَإِنَّ فِيهِ أَنَّ أَوَّلَ أَشْرَاطِ السَّاعَةِ نَارٌ تَحْشُرُهُمْ مِنَ الْمَشْرِقِ إِلَى الْمَغْرِبِ، وَفِي هَذَا أَنَّهَا آخِرُ الْأَشْرَاطِ، وَيَجْمَعُ بَيْنَهُمَا بأن آخِرِيَّتهَا بِاعْتِبَارِ مَا ذُكِرَ مَعَهَا مِنَ الْآيَاتِ وَأَوَّلِيَّتُهَا بِاعْتِبَارِ أَنَّهَا أَوَّلُ الْآيَاتِ الَّتِي لَا شَيْءَ بَعْدَهَا مِنْ أُمُورِ الدُّنْيَا أَصْلًا، بَلْ يَقَعُ بِانْتِهَائِهَا النَّفْخُ فِي الصُّورِ، بِخِلَافِ مَا ذُكِرَ مَعَهَا، فَإِنَّهُ يَبْقَى بَعْدَ كُلِّ آيَةٍ مِنْهَا أَشْيَاءُ مِنْ أُمُورِ الدُّنْيَا.

অর্থঃ “অধ্যায়ের শুরুতে আনাস(রা.) বর্ণিত হাদিস আছে যেখানে বলা হয়েছে কিয়ামতের প্রথম নিদর্শন হল আগুন যা মানুষকে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে তাড়িয়ে নিয়ে একত্রিত করবে। আপাতদৃষ্টিতে তা এই হাদিসের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে হয়। কারণ এখানে [হুযাইফা (রা.) বর্ণিত হাদিসে] বলা হয়েছে এটি (কিয়ামতের) শেষ নিদর্শনসমূহের একটি। এর সামঞ্জস্য বিধান এভাবে করা যায়ঃ এর সঙ্গে আর যেসব [বাকি ৯টি] নিদর্শনের উল্লেখ আছে তা বিবেচনা করে একে সর্বশেষ নিদর্শন বলা হচ্ছে। আর [আনাস (রা.) বর্ণিত হাদিসে] একে প্রথম নিদর্শন বলা হচ্ছে এই কথা বিবেচনা করে যে, এই নিদর্শনটি সংঘটিত হবার পরে দুনিয়ার আর কোনো কার্যাবলি অবশিষ্ট থাকবে না। বরং এটি সংঘটিত হবার পরেই শিঙ্গায় ফুঁ দেয়া হবে। অন্য [হুযাইফা (রা.) বর্ণিত] হাদিসে যেমনটি বলা হয়নি। কেননা সেখানে উল্লেখিত নিদর্শনগুলোর পরেও দুনিয়ার বিভিন্ন কার্যাবলি অবশিষ্ট থাকবে।[3]

 

অর্থাৎ যেই হাদিসে বলা হয়েছেঃ “'কিয়ামত নিকটবর্তী হওয়ার সর্বপ্রথম আলামত লেলিহান অগ্নি” এর অর্থ হল কিয়ামত এসে গেলে শুরুতেই এই আলামতের ঘটনাটি ঘটবে। অর্থাৎ এটা হল শেষের শুরু। এর মানে এই না যে এর আগে আর কোনো নিদর্শন দেখা যাবে না।

 

একটা উদাহরণ দিলে হয়তো বোঝা সহজ হবে। ধরা যাক কোনো একটা গন্তব্যে পৌছাতে হলে ১০টি দরজা খুলে এরপর সেখানে যেতে হবে। গন্তব্যের সব থেকে কাছাকাছি আছে সাদা রঙের দরজা।

তাহলে, বিষয়টা এভাবে বলা যেতে পারেঃ সাদা দরজা হল সর্বশেষ দরজা।

আবার এভাবেও বলা যেতে পারেঃ গন্তব্যের নিকটবর্তী হলে সর্বপ্রথম সাদা দরজাটাই খুলবে। সাদা দরজা হল শেষের শুরু।

 

আবার সহীহ মুসলিমের আরেক বর্ণনায় দশম লক্ষণ সম্পর্কে বলা হয়েছে ---

 

وَرِيحٌ تُلْقِي النَّاسَ فِي الْبَحْر

অর্থঃ “এমন এক বাতাস প্রবাহিত হবে যা মানুষদেরকে (কাফিরদেরকে) সাগরে নিক্ষেপ করবে।[4]

 

এর ব্যাখ্যায় মিরকাতুল মাফাতিহ গ্রন্থে ইমাম কুরতুবী(র.) থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে,

 

أَنَّ الْمُرَادَ بِالنَّاسِ الْكُفَّارُ، وَأَنَّ نَارَهُمْ تَكُونُ مُنْضَمَّةً إِلَى رِيحٍ شَدِيدَةِ الْجَرْيِ، سَرِيعَةِ التَّأْثِيرِ فِي إِلْقَائِهَا إِيَّاهُمْ فِي الْبَحْرِ، وَهُوَ مَوْضِعُ حَشْرِ الْكُفَّارِ، أَوْ مُسْتَقَرُّ الْفُجَّارِ، كَمَا وَرَدَ: إِنَّ الْبَحْرَ يَصِيرُ نَارًا، وَمِنْهُ قَوْلُهُ تَعَالَى: {وَإِذَا الْبِحَارُ سُجِّرَتْ} [التكوير: ٦] ، بِخِلَافِ نَارِ الْمُؤْمِنِينَ، فَإِنَّهَا لِمُجَرَّدِ التَّخْوِيفِ بِمَنْزِلَةِ السَّوْطِ مَهَابَةً ; لِتَحْصِيلِ السَّوْقِ إِلَى الْمَحْشَرِ وَالْمَوْقِفِ الْأَعْظَمِ، وَاللَّهُ تَعَالَى أَعْلَمُ.

অর্থঃ “এখানে মানুষদেরকে [সাগরে নিক্ষেপ করবে] কথাটির দ্বারা কাফিরদেরকে বোঝানো হচ্ছে। আর তাদের অগ্নি এক শক্তিশালী ঝঞ্ঝা বাতাসের সঙ্গে মিলিত হবে, এর প্রভাব দ্রুত বৃদ্ধি হয়ে তাদেরকে সাগরে ফেলে দেবে। আর তা হবে কাফিরদের একত্রিত হবার স্থান। অথবা পাপীদের আবাসস্থল। আর তা হবে কাফির ও পাপীদের একত্রিত হওয়ার স্থান। আর তখন সাগর আগুনে পরিণত হবে। যেমনটি বলা হয়ে থাকে, “সাগর পরিণত হবে অগ্নিতে”। এর মাঝে আছে আল্লাহ তা’আলার বাণীঃ (وَ اِذَا الۡبِحَارُ سُجِّرَتۡ) “যখন সমুদ্রগুলোকে প্রজ্বলিত করে উত্তাল করা হবে।” (সূরা আত্ তাকওয়ির ৮১: ৬)। এর বিপরীত হবে মু'মিনদের আগুন। মূলত আগুন মু'মিনদের ভীতির কারণ হবে এবং চাবুকের ন্যায় তাদেরকে তাড়িয়ে হাশরের দিকে তাড়িয়ে নেবে। আল্লাহই এ ব্যাপারে অধিক জানেন।[5]

 

এখানে এই হাশর বা জমায়েতের অর্থ প্রসঙ্গে মিরকাতুল মাফাতিহ গ্রন্থে ইমাম কুরতুবী(র.) থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে,

 

قِيلَ: الْمُرَادُ مِنَ الْمَحْشَرِ أَرْضُ الشَّامِ، إِذْ صَحَّ فِي الْخَبَرِ: إِنَّ الْحَشْرَ يَكُونُ فِي أَرْضِ الشَّامِ، لَكِنَّ الظَّاهِرَ أَنَّ الْمُرَادَ أَنْ يَكُونَ مُبْتَدَؤُهُ مِنْهَا، أَوْ تُجْعَلَ وَاسِعَةً تَسَعُ خَلْقَ الْعَالَمِ فِيهَا.

অর্থঃ “এর অর্থ হল এই হাশর বা জমায়েতের স্থান হচ্ছে শামের ভূমিতে (বৃহত্তর সিরিয় অঞ্চল)। যেহেতু এটি বিশুদ্ধভাবে বর্ণিত আছে, নিশ্চয়ই জমায়েত হবে শামের ভূমিতে।[6]

 

বিভিন্ন দলিলের আলোকে ইমাম ইবন কাসির(র.)ও অনুরূপ তথ্য উল্লেখ করেছেন। [7]  

 

এ থেকে বোঝা যাচ্ছে এই সাগরে নিক্ষেপের ঘটনাটি লেলিহান অগ্নির ঘটনা থেকে আলাদা কিছুই নয়। বরং একই সঙ্গে তা ঘটতে থাকবে। ঝঞ্ঝা বায়ুর সঙ্গে অগ্নি মিলিত হয়ে কাফির ও পাপীদেরকে সমুদ্রে নিক্ষেপ করবে। আর লেলিহান অগ্নি মুমিনদেরকে তাড়িয়ে বৃহত্তরে সিরিয় অঞ্চলে জমায়েতের দিকে নিয়ে যাবে।  

 

অতএব হাদিসগুলোর মাঝে কোনো প্রকারের স্ববিরোধিতা বা অসঙ্গতি নেই, আলহামদুলিল্লাহ।

 

 

তথ্যসূত্রঃ


[1]  সহীহ বুখারী, হাদিস নং : ৩৯৩৮

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=28379

[2]  মুসলিম ৭৪৬৭-৭৪৬৮, আবূ দাউদ ৪৩১১, তিরমিযী ২১৮৩

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=67597

[3]  ফাতহুল বারী – ইবন হাজার আসকালানী, খণ্ড ১৩, পৃষ্ঠা ৮২

https://shamela.ws/book/1673/7513

অথবা https://archive.is/wip/7xQhV (আর্কাইভকৃত)

[4]  মুসলিম, মিশকাতুল মাসাবীহ  হাদিস নং : ৫৪৬৪

 https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=85442

[5]  মিরকাতুল মাফাতিহ – মোল্লা আলি ক্বারী, খণ্ড ৮, পৃষ্ঠা ৩৪৫০

https://shamela.ws/book/8176/7547

অথবা https://archive.is/wip/nZdES (আর্কাইভকৃত)

[6] প্রাগুক্ত

[7]  “…ইমাম ইবনে কাছীর এ অর্থে আরো অনেক হাদীছ বর্ণনা করেছেন। পরিশেষে বলেছেন, হাদীছগুলোর বর্ণনা প্রসঙ্গ প্রমাণ করে যে, এটি হবে আখেরী যামানায় দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সমস্ত মানুষকে সিরিয়ার একটি স্থানে সমবেত করণ

দেখুনঃ 'আল ইরশাদ-সহীহ আকীদার দিশারী' - শাইখ ড. ছলিহ ইবনে ফাওযান আল ফাওযান, পঞ্চম মূলনীতি: শেষ দিবসের প্রতি ঈমান

https://www.hadithbd.com/books/link/?id=13271