আল কুরআন থেকে আমরা জানতে পারি নবী নুহ(আ.) তাঁর সম্প্রদায়ের মাঝে সাড়ে নয় শ বছর অবস্থান করেছিলেন।
وَ لَقَدۡ اَرۡسَلۡنَا نُوۡحًا اِلٰی قَوۡمِهٖ فَلَبِثَ فِیۡهِمۡ اَلۡفَ سَنَۃٍ اِلَّا خَمۡسِیۡنَ عَامًا ؕ فَاَخَذَهُمُ الطُّوۡفَانُ وَ هُمۡ ظٰلِمُوۡنَ
অর্থঃ “আমি অবশ্যই নূহকে তার সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরণ করেছিলাম; সে ওদের মধ্যে অবস্থান করেছিল সাড়ে ন’শ বছর। অতঃপর বন্যা ওদেরকে গ্রাস করল; কারণ ওরা ছিল সীমালংঘনকারী।” [1]
এ ছাড়া হাদিস থেকে জানা যায় প্রথম মানুষ ও প্রথম নবী আদম(আ.) এর জীবনকাল ছিল ৯৬০ বছর। [2]
নাস্তিক-মুক্তমনারা এই বর্ণনাগুলো উদ্ধৃত করে দাবি করে প্রাচীন পৃথিবীতে এভাবে কোনো মানুষের ৯০০-১০০০ বছরের জীবনকাল নাকি অবাস্তব এবং অসম্ভব ব্যাপার। তারা দাবি করে বর্তমানকালে চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির ফলে মানুষের গড় আয়ু পূর্বের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে, কাজেই সুপ্রাচীন পৃথিবীতে মানুষের এত দীর্ঘ জীবনকাল কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তারা এ ব্যাপারে বৈজ্ঞানিক নানা কারণও নিয়ে আসার চেষ্টা করে। মানুষের বয়স নিয়ে নানা অর্থহীন প্রলাপ বকার পর প্রজাতির বয়সের সাথে সম্পর্কিত টেলোমিয়ার হাইপোথিসস কে প্রমাণ হিসেবে ‘গভীর বিশ্বাসের’ সাথে উপস্থাপন করে থাকে। তাদের মতে, ক্রমাগত কোষ বিভাজনের ফলে সময়ের সাথে সাথে টেলোমিয়ারের দৈর্ঘ্য ক্রমশ ছোট হতে থাকে। একবার তারা খুব ছোট হয়ে গেলে কোষগুলো আর ঠিকভাবে বিভাজিত হতে পারে না। এর ফলে মানুষ বৃদ্ধ হয়ে যায় এবং মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। এই কারণে মানুষ ৬০-৭০ বছর বা এর কাছাকাছি সময়ের জীবনকাল লাভ করে। সমস্যা হল এই ইসলামবিরোধীরা টেলোমিয়ারের দৈর্ঘ্য কি আসলেই বয়স নির্ধারণ করে সে সম্পর্কে গবেষণা করার প্রয়োজন বোধ করেন না। হয়ত এসব বিষয় নিয়ে পড়ার ও যৌক্তিকভাবে প্রশ্ন করার যথেষ্ট ব্যাকগ্রাউন্ড নলেজ তারা রাখেন না।
চলুন টেলোমিয়ারের গল্পটা নিয়ে গভীরে যাই। আমরা জানি, একটা ইউক্যারিয়োট কোষ যখন বিভাজিত হয়, তখন ডিএনএ-র ঠিক দুটো কপি তৈরি হয়। যে প্রক্রিয়াকে বলে ডিএনএ রেপ্লিকেশন। একটি ক্রোমোজমে এক জোড়া ডিএনএ থাকে। রেপ্লিকেশনের সময় দুই জোড়া কপি তৈরি হয়। ডিএনএ-সুতাকে যখন ‘ডিএনএ পলিমারেজ’ এনজাইম কপি করতে থাকে, তখন ডিএনএ-এর একটি সুতাকে একাধারে কপি করতে থাকে এবং অন্য সুতাকে ভেঙে ভেঙে কপি করতে থাকে। ভেঙে ভেঙে কপি করা মানে হল, ধরুন ২১ থেকে ৪০ কপি করল, এরপর ১ থেকে ২০ কপি করল এবং দুটোকে একসাথে জোড়া লাগিয়ে দিলো। উল্টো দিক থেকে কপি করতে হয় বলে, অন্য সুতাটিকে এভাবে রেপ্লিকেট করতে হয়। যাই হোক, এভাবে কপি তৈরি করতে করতে, ডিএনএ-এর উক্ত সুতোর শেষ প্রান্তে এসে কিছু অংশ বাকি থেকে যায়, যা অনিবার্য গাঠনিক কারণে রেপ্লিকেট করা যায় না। [3]
মজার বিষয় হল, শেষ প্রান্তের এই অংশটিতে কিছু রিপিটেটিভ নিওক্লিওটাইড সিকোয়েন্স থাকে। যেমন, TTAGG সিকোয়েন্স, যা শত শত বা হাজার হাজার বার রিপিট হতে পারে। ক্রোমোজোমের শেষপ্রান্তের এই অংশকে বলে টেলোমিয়ার। প্রতিবার কোষ বিভাজনের সময় এই টেলোমিয়ার সিকোয়েন্সের ছোট্ট একটি অংশ আর কপি হয় না। ফলে, যতবার কোষ বিভাজন হয়, ততই টেলোমিয়ার সিকোয়েন্স ছোট হতে থাকে। একপর্যায়ে গিয়ে কোষ মারা যায়। এ বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে কিছু কিছু বিজ্ঞানী মনে করলেন যে, শৈশবে কোষের টেলোমিয়ারের দৈর্ঘ্য যত বেশি হবে ততই একজনের জীবনকাল বেশি হবে। [4] কিন্তু এটাই কি চূড়ান্ত কথা? মোটেও না। চলতে থাকলো গবেষণা।
এক সময় একটা মজার ব্যাপার জানা গেল। এই হিসেবে তো ঘরের ইঁদুরের বয়স মানুষের চেয়ে বেশি হবার কথা। কারণ, ঘরের ইঁদুরের টেলোমিয়ারের দৈর্ঘ্য মানুষের টেলোমিয়ারের চেয়ে প্রায় তিন গুন বেশি ! [5] আবার, সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা আবিস্কার করলেন যে টেলোমিয়ার দৈর্ঘ্যে বেশি বড় হলেও সমস্যা। টেলোমিয়ার দৈর্ঘ্যে বড় হলে মানুষে হয় অনিয়ন্ত্রিত কোষ বিভাজন, তৈরি হয় ক্যান্সার। [6] অর্থাৎ, একদিকে টেলোমিয়ার ছোট হলে হয়, পালমোনারী ফাইব্রোসিস নামক দীর্ঘমেয়াদী ফুসফুসের রোগ, অন্যদিকে বড় হলে হয়, রক্ত ও স্কিনের ক্যান্সার।
অন্যদিকে, উপরের কোষ বিভাজনের সময় টেলোমিয়ার রেপ্লিকেশনের যে সমস্যার কথা আলোচনা করেছি, গবেষণায় দেখা গেছে, কোষের ভেতর এর সমাধান আগেই ডিজাইন করা আছে। টেলোমিয়ারের শেষ প্রান্তের বাকি থেকে যাওয়া অংশগুলো সংশ্লিষ্ট নিউক্লিওটাইড অণু দিয়ে পূরণ করার কাজটি করে টেলোমারেজ নামক এনজাইম। তার মানে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে আবশ্যিকভাবেই টেলোমিয়ারের দৈর্ঘ্য কমতে থাকবে, তাত্ত্বিকভাবে তার কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। কেননা, টেলোমারেজ এনজাইম প্রতিটি কোষ বিভাজনের সময় উক্ত ঘাটতি পূরণ করে দেয়ার কথা। [7]
একদিকে, বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে গবেষণা করে দেখা গেছে যে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত প্রাণীগুলোর মধ্যে টেলোমিয়ারের দৈর্ঘ্য কমতে থাকে এবং প্রাণীদের জীবনকাল নির্ভর করে টেলোমিয়ারের দৈর্ঘ্য ছোট হওয়ার হারের ওপর। [8] অন্যদিকে, সমুদ্র তীরের একটি পাখি প্রজাতিতে বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন যে তাদের বয়সের সাথে সাথে টেলোমিয়ারের দৈর্ঘ্য কমার পরিবর্তে বাড়তে থাকে। [9] প্রিয় পাঠক, আমার প্রশ্ন হচ্ছে— দেশীয় নাস্তিক-মুক্তমনা ও ইসলামবিরোধীদের ‘যুক্তি’ অনুযায়ী এই পাখির কি তাহলে অনেক দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকা উচিত?? ওদের তো সময়ের সাথে সাথে টেলোমিয়ারের দৈর্ঘ্য বেড়ে যাচ্ছে! কথা এখানেই শেষ না। প্রাণীর বয়স বাড়ার সাথে সাথে সব কোষের তো বিভাজন হয় না। অসংখ্য কোষ আছে, যা শৈশবে একটি নির্দিষ্ট শেপে পৌছে স্থির হয়ে যায় এবং আমৃত্যু কাজ করতে থাকে। যেমন: নিউরন। সে সব ক্ষেত্রে কোষের জীবনকাল কিভাবে নির্ধারণ হয়?
ন্যাচার সেল বায়োলজির একটা পেপারে রোসিয়েলো এবং তার দল বয়সের প্রক্রিয়া নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। তারা দেখিয়েছেন, কোষের মৃত্যু টেলোমিয়ারের সাথে সংযুক্ত হলেও, এর ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল নয়। হ্যাঁ, বয়স বাড়লে, টেলোমিয়ার ডিসফাংশন পাওয়া যায়। যা টেলিমিয়ার সংশ্লিষ্ট ডিএনএ ড্যামেজ রিপেয়ার ফাংশনের সাথে সম্পর্কিত। দীর্ঘমেয়াদী প্রদাহ, মাইটোকন্ড্রিয়ার সমস্যা, মেদবহুলতা এবং অটোফ্যাগী (কোষের নিয়ন্ত্রিত মৃত্যু ও অপসারন) কমে যাওয়ার মাধ্যমে টেলিমিয়ার সংশ্লিষ্ট ডিএনএ ড্যামেজ রিপেয়ার সিস্টেম জমতে থাকে। এছাড়াও, নানাবিধ জেনেটিক, এপিজেনেটিক, পরিবেশগত এবং জীবনাচার জনিত প্রভাবক মিলে নির্ধারণ করে আমাদের বয়সের সীমা। কেননা, আমাদের কোষের বয়সের পরিসমাপ্তি হয় প্রোগ্রামড ওয়েতে। যার সাথে যুক্ত হয় বাহিরের নানাবিধ প্রভাবক। দেশীয় নাস্তিক-মুক্তমনারা যেইভাবে টেলোমিয়ারের দৈর্ঘ্য হ্রাস আর ডিএনএর ক্রমশ অবনতির কথা উল্লেখ করে দিয়েই ‘রায়’ দিয়ে দেয়ঃ মানুষের জীবনকাল এই রেঞ্জের মধ্যেই হতে হবে! - মনে হয় না এই তথ্যগুলো তাদের আদৌ জানা আছে।
গত শতাব্দীতে জনসংখ্যার ব্যাপক বৃদ্ধির ও ইন্ড্রাস্ট্রি বৃদ্ধির সাথে সাথে পরিবেশের ক্ষতি বাড়তে থাকে, ইনফেকশন ছড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় এবং মানুষ অনেক বেশি চাষজাত এবং প্রসেসড ফুডের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। একই সাথে সে অণুপাতে চিকিৎসার উন্নতি না হওয়ায় মানুষের গড় আয়ু ছিল কম। এখন আমি যদি ইনড্রাসট্রিয়াল এইজ-এ মানুষের গড় বয়সসীমার উদাহরণ টেনে বলি, লক্ষ বছর আগের মানুষেদেরও একই রকম আয়ু ছিল, তা হবে ভুল। কেননা, লক্ষ বছর আগের মানুষের খাদ্যাভ্যাস, জেনেটিক, এপিজেনেটিক গঠন সম্পর্কে আমরা কোন ডিরেক্ট পরীক্ষালব্ধ তথ্য পাবো না। আমরা পাবো সারকামসটেনসিয়াল এভিডেন্স।
অতএব, কোন মানুষের দীর্ঘদিন বেঁচে থাকার ব্যাপারে যদি কোনো দাবি আসে, আমরা শুধু এইটুকুই চিন্তার চর্চা করতে পারবো যে, মানুষের পক্ষে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকা সম্ভব কিনা? যদি শত শত বছর ধরে কোন কোন বৃক্ষ বেঁচে থাকতে পারে, যদি কচ্ছপ, ‘শ্লথ’-এর চেয়ে অধিক গতিশীল হয়েও তার চেয়ে বেশি প্রায় এক দু’শ বছর বাঁচতে পারে, তাহলেও মানুষের প্রজাতিরও মাঝেও এমন কোন সময় থাকা যৌক্তিকভাবে অসম্ভব নয়, যখন মানুষ শত শত বছর বাঁচতে পারতো। আমরা, শুধু সে ধরনের জেনেটিক এবং এপিজেনেটিক গঠন এবং সংশ্লিষ্ট পরিবেশগত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে গবেষণা করে এখনও জানতে পারিনি। ব্যস, এটুকুই।
উপসংহারে আমরা বলব, বিজ্ঞান অনেক কিছুই এখনো জানতে পারেনি। কিন্তু যতটুকু জানতে পেরেছে, তার আলোকে এটা বলা যায় যে অতি প্রাচীন পৃথিবীতে মানব প্রজাতির সহস্র বছরের জীবনকাল আদৌ অসম্ভব কিছু নয়। অল্প কিছু পয়েন্ট উল্লেখ করেই বিষয়টিকে অসম্ভব বলে রায় দিয়ে দেয়া অজ্ঞতার পরিচায়ক।
আরো পড়ুনঃ
আদম(আ.) এর ৬০ হাত উচ্চতা, ইসলামবিরোধীদের আপত্তি এবং আমাদের জবাব
রেফারেন্স:
[1] আল কুরআন, আনকাবুত ২৯ : ১৪
[2] তিরমিযী, মিশকাত হা/১১৮ ‘তাক্বদীরে বিশ্বাস’ অনুচ্ছেদ; সনদ ছহীহ, তিরমিযী হা/৩০৭৬ ‘তাফসীর সূরা আ‘রাফ’। একই হাদীছ মিশকাত হা/৪৬৬২ ‘শিষ্টাচার’ অধ্যায় ‘সালাম’ অনুচ্ছেদে এসেছে। যেখানে ‘আদম তার বয়স থেকে ৬০ বছর দান করেন’ বলা হয়েছে। তিরমিযী হাদীছটিকে ‘হাসান গরীব’ বলেছেন ছাহেবে মিরক্বাত ও ছাহেবে তোহফা উভয়ে বলেন যে, ‘৪০ বছর দান করার হাদীছ অগ্রগণ্য (الأرجح)। দ্রঃ তুহফাতুল আহওয়াযী হা/৫০৭২-এর ব্যাখ্যা।
[3] Razgonova MP, Zakharenko AM, Golokhvast KS, Thanasoula M, Sarandi E, Nikolouzakis K, et al. Telomerase and telomeres in aging theory and chronographic aging theory (Review). Mol Med Rep. 2020;22: 1679–1694. doi:10.3892/mmr.2020.11274
[4] Holesova Z, Krasnicanova L, Saade R, Pös O, Budis J, Gazdarica J, et al. Telomere Length Changes in Cancer: Insights on Carcinogenesis and Potential for Non-Invasive Diagnostic Strategies. Genes (Basel). 2023;14. doi:10.3390/genes14030715
[5] Vera E, Bernardes de Jesus B, Foronda M, Flores JM, Blasco MA. The Rate of Increase of Short Telomeres Predicts Longevity in Mammals. Cell Rep. 2012;2: 732–737. doi:10.1016/j.celrep.2012.08.023
[6] McNally EJ, Luncsford PJ, Armanios M. Long telomeres and cancer risk: the price of cellular immortality. J Clin Invest. 2019;129: 3474–3481. doi:10.1172/JCI120851
[7] Razgonova MP, Zakharenko AM, Golokhvast KS, Thanasoula M, Sarandi E, Nikolouzakis K, et al. Telomerase and telomeres in aging theory and chronographic aging theory (Review). Mol Med Rep. 2020;22: 1679–1694. doi:10.3892/mmr.2020.11274
[8] Whittemore K, Vera E, Martínez-Nevado E, Sanpera C, Blasco MA. Telomere shortening rate predicts species life span. Proc Natl Acad Sci U S A. 2019;116: 15122–15127. doi:10.1073/pnas.1902452116
[9] Haussmann MF, Mauck RA. Telomeres and longevity: Testing an evolutionary hypothesis. Mol Biol Evol. 2008;25: 220–228. doi:10.1093/molbev/msm244