রাসুলুল্লাহ (ﷺ) এমন এক অন্ধকার সময়ের কথা বলে গিয়েছেন, যখন মানুষ সকালে মুমিন থাকবে, কিন্তু বিকেলে কাফির হয়ে যাবে। [1] গায়েবের ব্যাপারে আল্লাহ তা’আলাই ভালো জানেন, তবে বর্তমানে অনেক মানুষের ক্ষেত্রেই এ ঘটনা ঘটছে। তারা ইসলামের শত্রুদের বিভিন্ন অভিযোগ দেখে, অজ্ঞতার কারণে অতি সহজেই ঈমানহারা হয়ে যাচ্ছেন। কখনো কখনো তারা সেসব অভিযোগের সত্যতাও ভালোভাবে জানার চেষ্টা করেন না। আজ চারদিক থেকে নানাভাবে মুসলিমদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কখনো বলা হচ্ছেঃ তোমরা যে বিশ্বাস কর ইব্রাহিম(আ.) তাঁর ছেলে ইসমাঈল(আ.)কে কুরবানী করতে চেয়েছিল, আসলে এটি একটি মিথ্যা কথা। তারা দৃঢ়তার সাথে বলে, কুরআন ও হাদিসে কোথাও ইসমাঈলকে(আ.) কুরবানী করার কথা নেই! তারা বাইবেল ও কুরআন উভয় গ্রন্থ থেকে প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে— ইসহাক(আ.) ছিলেন কুরবানীর জন্য নির্বাচিত সন্তান(জবিহুল্লাহ)। তাদের উদ্যেশ্য মুসলিমদেরকে ঈমানের পথ থেকে দূরে নিয়ে যাওয়ার। খ্রিষ্টান মিশনারীরা তাদের ধর্ম প্রচার করার জন্য অনেক আগে থেকেই এ নিয়ে প্রচার চালিয়ে আসছিল। এখন তাদের দলে নাস্তিকরাও যোগ দিয়েছে। এ যেন চোরে চোরে মাসতুতো ভাই! যা হোক, এ বিষয়টা নিয়ে এই লেখা।
ইসলামী আকিদা হচ্ছে—নবী ইব্রাহিম(আ.) এর বড় ছেলে ইসমাঈল(আ.)কে কুরবানীর জন্য নির্বাচিত করা হয়েছিল অর্থাৎ ইসমাঈল(আ.) হচ্ছেন ‘জবিহুল্লাহ’। কুরআন দ্বারা এটি প্রমাণিত এবং এ ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহর ইজমা রয়েছে। [2]
অপরদিকে বাইবেল বলে যে, ইব্রাহিম(আ.) এর অন্য ছেলে ইসহাক(আ.)কে কুরবানীর জন্য নির্বাচিত করা হয়েছিল। বাইবেলের Old Testament বা ‘পুরাতন নিয়ম’ [3] অংশটিকে ইহুদি ও খ্রিষ্টান উভয় ধর্মালম্বীরা নিজ ধর্মগ্রন্থ হিসাবে স্বীকার করে। তাদের এ বিশ্বাসের উৎস হচ্ছে পুরাতন নিয়ম অংশের গ্রন্থ আদিপুস্তক(Genesis) এর বর্ণনা। কাজেই এ নিয়ে মুসলিমদের বিশ্বাস এক এবং ইহুদি-খ্রিষ্টানদের বিশ্বাস আরেক। নাস্তিকরা মূলত ইসলামের বিরোধিতা করে এবং অনেক সময়েই অটোমেটিক চয়েস হিসাবে ইহুদি-খ্রিষ্টানদের অবস্থানকে সমর্থন করে। আমরা এখন কুরআন-হাদিস এবং বাইবেল সকল প্রকারের উৎস থেকেই ইব্রাহিম(আ.) এর কুরবানীর ঘটনাটি নিরপেক্ষভাবে আলোচনা করব এবং দেখব আসলে কে কুরবানির জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন—ইসমাঈল(আ.) নাকি ইসহাক(আ.)।
কুরআনে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে যে ইব্রাহিম(আ.) এর বড় ছেলে অর্থাৎ ইসমাঈল(আ.)কে কুরবানী দেবার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
وَقَالَ إِنِّى ذَاهِبٌ إِلَىٰ رَبِّى سَيَہۡدِينِ (٩٩) رَبِّ هَبۡ لِى مِنَ ٱلصَّـٰلِحِينَ (١٠٠) فَبَشَّرۡنَـٰهُ بِغُلَـٰمٍ حَلِيمٍ۬ (١٠١) فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ ٱلسَّعۡىَ قَالَ يَـٰبُنَىَّ إِنِّىٓ أَرَىٰ فِى ٱلۡمَنَامِ أَنِّىٓ أَذۡبَحُكَ فَٱنظُرۡ مَاذَا تَرَىٰۚ قَالَ يَـٰٓأَبَتِ ٱفۡعَلۡ مَا تُؤۡمَرُۖ سَتَجِدُنِىٓ إِن شَآءَ ٱللَّهُ مِنَ ٱلصَّـٰبِرِينَ (١٠٢) فَلَمَّآ أَسۡلَمَا وَتَلَّهُ ۥ لِلۡجَبِينِ (١٠٣) وَنَـٰدَيۡنَـٰهُ أَن يَـٰٓإِبۡرَٲهِيمُ (١٠٤) قَدۡ صَدَّقۡتَ ٱلرُّءۡيَآۚ إِنَّا كَذَٲلِكَ نَجۡزِى ٱلۡمُحۡسِنِينَ (١٠٥) إِنَّ هَـٰذَا لَهُوَ ٱلۡبَلَـٰٓؤُاْ ٱلۡمُبِينُ (١٠٦) وَفَدَيۡنَـٰهُ بِذِبۡحٍ عَظِيمٍ۬ (١٠٧) وَتَرَكۡنَا عَلَيۡهِ فِى ٱلۡأَخِرِينَ (١٠٨) سَلَـٰمٌ عَلَىٰٓ إِبۡرَٲهِيمَ (١٠٩) كَذَٲلِكَ نَجۡزِى ٱلۡمُحۡسِنِينَ (١١٠) إِنَّهُ ۥ مِنۡ عِبَادِنَا ٱلۡمُؤۡمِنِينَ (١١١) وَبَشَّرۡنَـٰهُ بِإِسۡحَـٰقَ نَبِيًّ۬ا مِّنَ ٱلصَّـٰلِحِينَ (١١٢)
অর্থঃ “এবং সে [ইব্রাহিম(আ.)] বললঃ “আমি আমার প্রভুর দিকে চললাম, তিনি অবশ্যই আমাকে সৎ পথে পরিচালিত করবেন। হে আমার প্রভু, আমাকে সৎকর্মশীল সন্তান দান করুন।” অতঃপর তাঁকে আমি পরম ধৈর্যশীল একজন পুত্র সন্তানের [ইব্রাহিম(আ.) এর ১ম সন্তান] সুসংবাদ দিলাম। অতঃপর সে যখন তার পিতার সাথে কাজ করার মত বয়সে উপনীত হল তখন সে [ইব্রাহিম(আ.)] বললঃ “হে প্রিয় পুত্র, আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে যবেহ করছি, অতএব দেখ তোমার কী অভিমত।” সে বলল, “হে আমার পিতা, আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, আপনি তাই করুন। আপনি আমাকে ইনশাআল্লাহ অবশ্যই ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন।” যখন তাঁরা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করল এবং সে তাঁর পুত্রকে কাত করে শায়িত করল – তখন আমি তাকে আহবান করে বললাম, “হে ইব্রাহিম, তুমি তো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করেছ।“ নিশ্চয়ই আমি এভাবেই সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করে থাকি। নিশ্চয়ই এটা ছিল এক স্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তাকে মুক্ত করলাম এক মহান কুরবানীর বিনিময়ে। আর তার জন্য আমি পরবর্তীদের মধ্যে সুখ্যাতি রেখে দিয়েছি। ইব্রাহিমের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করে থাকি। সে ছিল আমার মু’মিন বান্দাদের অন্যতম। এবং আমি তাঁকে সুসংবাদ দিয়েছিলাম ইসহাকের [ইব্রাহিম(আ.) এর ২য় সন্তান], সে ছিল এক নবী, সৎকর্মশীলদের অন্যতম।” [4]
এখানে পুরো কুরবানীর ঘটনা বর্ণনা করার পরে ১১২নং আয়াতে ২য় সন্তান অর্থাৎ ইসহাক(আ.) এর জন্মের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ ঐ ঘটনার সময়ে ইসহাক(আ.) এর জন্মই হয়নি।
وَلَقَدۡ جَآءَتۡ رُسُلُنَآ إِبۡرَٲهِيمَ بِٱلۡبُشۡرَىٰ قَالُواْ سَلَـٰمً۬اۖ قَالَ سَلَـٰمٌ۬ۖ فَمَا لَبِثَ أَن جَآءَ بِعِجۡلٍ حَنِيذٍ۬ (٦٩) فَلَمَّا رَءَآ أَيۡدِيَہُمۡ لَا تَصِلُ إِلَيۡهِ نَڪِرَهُمۡ وَأَوۡجَسَ مِنۡہُمۡ خِيفَةً۬ۚ قَالُواْ لَا تَخَفۡ إِنَّآ أُرۡسِلۡنَآ إِلَىٰ قَوۡمِ لُوطٍ۬ (٧٠) وَٱمۡرَأَتُهُ ۥ قَآٮِٕمَةٌ۬ فَضَحِكَتۡ فَبَشَّرۡنَـٰهَا بِإِسۡحَـٰقَ وَمِن وَرَآءِ إِسۡحَـٰقَ يَعۡقُوبَ (٧١)
অর্থঃ “আর অবশ্যই আমার ফেরেশতারা সুসংবাদ নিয়ে ইব্রাহিমের কাছে আসলো। তারা বলল, “সালাম।” সেও বলল, “সালাম।” বিলম্ব না করে সে একটি ভুনা গো বাছুর নিয়ে আসল। অতঃপর যখন সে দেখতে পেল, তাদের হাত এর [খাবারের] প্রতি পৌঁছছে না, তখন তাদেরকে অস্বাভাবিক মনে করল এবং সে তাদের থেকে ভীতি অনুভব করল। তারা বলল, “ভয় করো না, নিশ্চয়ই আমরা লুতের সম্প্রদায়ের কাছে প্রেরিত হয়েছি।” তাঁর স্ত্রীও নিকটেই দাঁড়িয়েছিল, সে হেসে ফেলল। অতঃপর আমি তাঁকে ইসহাকের জন্মের সুখবর দিলাম এবং ইসহাকের পরের ইয়া’কুবেরও।” [5]
এখানে স্পষ্টত বলা হচ্ছে ফেরেশতারা একই সাথে ইব্রাহিম(আ.)কে ইসহাক(আ.) ও ইয়া'কুব(আ.) এর সুসংবাদ দেন। ইসহাক(আ.) যদি জবিহুল্লাহ হয়ে থাকেন, তাহলে ইয়া'কুব(আ.) এর সংবাদ কিভাবে দেওয়া হবে? তিনি তো কুরবানীই হয়ে যাবেন! তাহলে তো ইব্রাহিম(আ.)কে কোন পরীক্ষা করা হল না। পরীক্ষার ফল আগে থেকেই জানা, ইসহাক(আ.) বেঁচে যাবেন ও তাঁর ছেলে ইয়া'কুব(আ.) নবী হবেন!
আল কুরআনের তথ্যের ভিত্তিতে এভাবে মুসলিম উম্মাহ নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করে ইসমাঈল(আ.) হচ্ছেন জবিহুল্লাহ।
খ্রিষ্টান প্রচারক কিংবা নাস্তিকরা এই বলে জল ঘোলা করে যেঃ কুরআনে কেন সরাসরি নাম বলা হয়নি? আমরা ইতিমধ্যেই দেখেছি যে সরাসরি নাম না বললেও কুরআনে এটা স্পষ্ট যে ইব্রাহিম(আ.) এর ১ম সন্তান অর্থাৎ ইসমাঈল(আ.)ই জবিহুল্লাহ। কুরআনে কুরবানীর পুরো ঘটনা উল্লেখ করে [6] জবিহুল্লাহর নাম উহ্য রাখা হয়েছে। ঘটনা বর্ণনা শেষ করার পরে ইসহাক(আ.) এর বৃত্তান্ত শুরু করা হয়েছে। এরপর মুসা(আ.) ও হারুন(আ.) এর বৃত্তান্ত। [7] একজন নবীর পর আরেকজন নবীর বিবরণ। এ দ্বারা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে কুরবানীর উদ্যেশ্যে ইসহাক(আ.)কে নেওয়া হয়নি বরং বড় ছেলে অর্থাৎ ইসমাঈল(আ.)কে নেওয়া হয়েছিল। মুসলিম, ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা একমত যে ইব্রাহিম(আ.) এর বড় ছেলে ইসমাঈল(আ.)। কুরআন অনেক সময়েই মহিমান্বিত ব্যক্তির নাম উহ্য রেখে বিশেষণ দিয়ে ঐ ব্যক্তিকে প্রকাশ করা হয়েছে। এটা কুরআনের একটি বর্ণনাভঙ্গি। ইসমাঈল(আ.) ছাড়াও ইউনুস(আ.) এর নাম উহ্য রেখে এক স্থানে তাঁকে 'যান নুন'(মাছওয়ালা) বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
وَذَا ٱلنُّونِ إِذ ذَّهَبَ مُغَـٰضِبً۬ا فَظَنَّ أَن لَّن نَّقۡدِرَ عَلَيۡهِ فَنَادَىٰ فِى ٱلظُّلُمَـٰتِ أَن لَّآ إِلَـٰهَ إِلَّآ أَنتَ سُبۡحَـٰنَكَ إِنِّى ڪُنتُ مِنَ ٱلظَّـٰلِمِينَ (٨٧)
অর্থঃ “আর স্মরণ কর মাছওয়ালার [ইউনুস(আ.)] কথা, যখন সে রাগান্বিত অবস্থায় চলে গিয়েছিল এবং মনে করেছিল যে, আমি তার উপর ক্ষমতা প্রয়োগ করব না। তারপর সে অন্ধকার থেকে ডেকে বলেছিল, “আপনি ছাড়া কোন (সত্য) ইলাহ নেই। আপনি পবিত্র মহান। নিশ্চয় আমি ছিলাম যালিম।” ” [8]
সহীহ বুখারীতে ইব্রাহিম(আ.) কর্তৃক তাঁর বড় ছেলে ইসমাঈল(আ.)কে মক্কার মরুভূমিতে রেখে আসার ঘটনাটি বর্ণনা করা হয়েছে।
আবদুল্লাহ ইবনু মুহাম্মদ (র.) ... সাঈদ ইবনু জুবায়র (রা.) থেকে বর্ণিত ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, নারী জাতি সর্বপ্রথম কোমরবন্দ বানানো শিখেছে ইসমাঈল(আ.) এর মায়ের (হাযেরা) নিকট থেকে। হাযেরা(আ.) কোমরবন্দ লাগাতেন সারাহ(আ.) থেকে নিজের মর্যাদা গোপন রাখার জন্য। তারপর (আল্লাহর হুকুমে) ইব্রাহিম (আ.) হাযেরা (আ.) এবং তাঁর শিশু ছেলে ইসমাঈল (আ.)কে সাথে নিয়ে বের হলেন, এ অবস্থায় যে, হাযেরা (আ.) শিশুকে দুধ পান করাতেন। অবশেষে যেখানে কাবা ঘর অবস্থিত, ইব্রাহিম (আ.)তাঁদের উভয়কে সেখানে নিয়ে এসে মসজিদের [মসজিদুল হারাম] উঁচু অংশে যমযম কূপের উপরে অবস্থিত একটি বিরাট গাছের নিচে তাদেরকে রাখলেন। তখন মক্কায় না ছিল কোন মানুষ না ছিল কোনরূপ পানির ব্যবস্থা। পরে তিনি তাদেরকে সেখানেই রেখে গেলেন। আর এছাড়া তিনি তাদের কাছে রেখে গেলেন একটি থলের মধ্যে কিছু খেজুর এবং একটি মশকে কিছু পরিমাণ পানি।
এরপর ইব্রাহিম (আ.) ফিরে চললেন। তখন ইসমাঈল (আ.) এর মা পিছু পিছু ছুটে আসলেন এবং বলতে লাগলেন, হে ইব্রাহিম! আপনি কোথায় চলে যাচ্ছেন? আমাদেরকে এমন এক ময়দানে রেখে যাচ্ছেন, যেখানে না আছে কোন সাহায্যকারী আর না আছে (পানাহারের) ব্যবস্থা। তিনি একথা তাকে বারবার বললেন। কিন্তু ইব্রাহিম (আ.) তাঁর দিকে তাকালেন না। তখন হাযেরা (আ.) তাঁকে বললেন, এ (নির্বাসনের) আদেশ কি আপনাকে আল্লাহ দিয়েছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। হাযেরা (আ.) বললেন, তাহলে আল্লাহ আমাদেরকে ধ্বংস করবেন না। তারপর তিনি ফিরে আসলেন। আর ইব্রাহিম (আ.) ও সামনে চললেন। চলতে চলতে যখন তিনি গিরিপথের বাঁকে পৌছলেন, যেখানে স্ত্রী ও সন্তান তাঁকে আর দেখতে পাচ্ছেন না, তখন কা’বার দিকে মুখ করে দাঁড়ালেন।
তারপর তিনি দু’হাত তুলে এ দু’আ করলেন, আর বললেন, "হে আমার প্রভু! আমি আমার পরিবারের কতকে আপনার সম্মানিত ঘরের নিকট এক অনুর্বর উপত্যকায় ... ... ... যাতে আপনার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। (সুরা ইব্রাহিম ১৪:৩৭) (এ দু’আ করে ইব্রাহিম (আ.) চলে গেলেন) আর ইসমাঈলের মা ইসমাঈলকে স্বীয় স্তন্যের দুধ পান করাতেন এবং নিজে ঐ মশক থেকে পানি পান করতেন। অবশেষে মশকে যা পানি ছিল তা ফুরিয়ে গেল। তিনি নিজে পিপাসিত হলেন, এবং তাঁর (বুকের দুধ শুকিয়ে যাওয়ায়) শিশু পুত্রটি পিপাসায় কাতর হয়ে পড়ল। তিনি শিশুটির প্রতি দেখতে লাগলেন। পিপাসায় তার বুক ধরফড় করেছে অথবা রাবী বলেন, সে মাটিতে পড়ে ছটফট করছে। শিশুপুত্রের এ করুন অবস্থার প্রতি তাকানো অসহনীয় হয়ে পড়ায় তিনি সরে গেলেন আর তাঁর অবস্থানের সংলগ্ন পর্বত ‘সাফা’ কে একমাত্র তাঁর নিকটমত পর্বত হিসাবে পেলেন। এরপর তিনি তার উপর উঠে দাঁড়ালেন আর ময়দানের দিকে তাকালেন। এদিকে সেদিকে তাকিয়ে দেখলেন, কোথাও কাউকে দেখা যায় না? কিন্তু তিনি কাউকে দেখতে পেলেন না।
তখন ‘সাফা’ পর্বত থেকে নেমে পড়লেন। এমন কি যখন তিনি নিচু ময়দান পর্যন্ত পৌছলেন, তখন তিনি তাঁর কামিজের এক প্রান্ত তুলে ধরে একজন শ্রান্ত-ক্লান্ত মানুষের ন্যায় ছুটে চললেন। অবশেষে ময়দানে অতিক্রম করে ‘মারওয়া’ পাহাড়ের নিকট এসে তার উপর উঠে দাঁড়ালেন। তারপর এদিকে সেদিকে তাকালেন, কাউকে দেখতে পান কিনা? কিন্তু কাউকেই দেখতে পেলেন না। এমনিভাবে সাতবার দৌড়াদৌড়ি করলেন। ইবন আব্বাস (রা.) বলেন, নবী(ﷺ) বলেছেন, এজন্যই মানুষ (হজের বা উমরার সময়) এ পাহাড়দ্বয়ের মধ্যে সায়ী করে থাকে। এরপর এরপর তিনি যখন মারওয়া পাহাড়ে উঠলেন, তখন একটি শব্দ শুনতে পেলেন এবং তিনি নিজেকেই নিজে বললেন, একটু অপেক্ষা কর। (মনোযোগ দিয়ে শুনি।) তিনি একাগ্রচিত্তে শুনলেন। তখন তিনি বললেন, তুমি তো তোমার শব্দ শুনিয়েছ, আর আমিও শুনেছি)। যদি তোমার কাছে কোন সাহায্যকারী থাকে (তাহলে আমাকে সাহায্য কর)।হঠাৎ যেখানে যমযম কূপ অবস্থিত সেখানে তিনি একজন ফেরেশতা দেখতে পেলেন। সেই ফেরেশতা আপন পায়ের গোড়ালি দ্বারা আঘাত করলেন অথবা তিনি বলছেন, আপন ডানা দ্বারা আঘাত করলেন। ফলে পানি বের হতে লাগল। তখন হাযেরা (আ.) এর চারপাশে নিজ হাতে বাঁধা দিয়ে এক হাউযের ন্যায় করে দিলেন এবং হাতের কোষ ভরে তাঁর মশকটিতে পানি ভরতে লাগলেন। তখনো পানি উপচে উঠতে থাকলো। ইবন আব্বাস (রা.) বলেন, নবী(ﷺ) বলেছেন, ইসমাঈলের মা’কে আল্লাহ রহম করুন। যদি তিনি বাঁধ না দিয়ে যমযমকে এভাবে ছেড়ে দিতেন কিংবা বলেছেন, যদি কোষে ভরে পানি মশকে জমা না করতেন, তাহলে যমযম একটি কূপ না হয়ে একটি প্রবাহমান ঝর্ণায় পরিণত হতো।
রাবী বলেন, তারপর হাযেরা (আ.) পানি পান করলেন, আর শিশু পুত্রকেও দুধ পান করালেন, তখন ফেরেশতা তাঁকে বললেন, আপনি ধ্বংসের কোন আশংকা করবেন না। কেননা এখানেই আল্লাহর ঘর রয়েছে। এ শিশুটি এবং তাঁর পিতা দু’জনে এখানে ঘর নির্মাণ করবে এবং আল্লাহ তাঁর আপনজনকে কখনও ধ্বংস করেন না। ঐ সময় আল্লাহর ঘরের স্থানটি যমীন থেকে টিলার ন্যায় উঁচু ছিল। বন্যা আসার ফলে তাঁর ডানে বামে ভেঙ্গে যাচ্ছিল। এরপর হাযেরা (আ.) এভাবেই দিন যাপন করছিলেন। ... [9]
এবার আমরা ইহুদি-খ্রিষ্টানদের গ্রন্থ থেকে ঘটনাটি বিশ্লেষণ করব। সহীহ বুখারীর হাদিস এবং বাইবেলের আদিপুস্তক(Genesis) এ ব্যাপারে একমত যে—ইসমাঈল(আ.)কে যখন মরুভূমিতে রেখে আসা হয়, তখন তিনি ছিলেন ছোট শিশু।
ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের ধর্মগ্রন্থে ঘটনাটি যেভাবে আছে----
[ঈশ্বর বললেন] “আমি দাসীর ছেলেটিকেও এক মহা জাতিতে পরিণত করব কারণ সে তোমার বংশধর।” পরদিন সকালে আব্রাহাম[ইব্রাহিম(আ.)] কিছু খাবার এবং চামড়ার থলেতে পানি নিলেন এবং হাগারকে(বিবি হাযেরা) দিলেন। তিনি বাচ্চাটিসহ সেগুলো তার কাঁধে তুলে দিলেন এবং তাকে পাঠিয়ে দিলেন। তিনি[হাগার/বিবি হাযেরা] চলে গেলেন এবং বেরশেবার মরুভূমিতে ঘুরতে লাগলেন। চামড়ার থলের পানি যখন শেষ হয়ে গেল, তিনি বাচ্চাটিকে ঝোঁপের নিচে রাখলেন। তিনি উঠে গেলেন এবং কাছেই তীর ছোড়ার দূরত্বে গিয়ে বসে পড়লেন। কারণ তিনি ভাবছিলেন, “আমি বাচ্চাটার মরণ দেখতে পারব না।” তিনি কাছে বসে ছিলেন এবং বাচ্চাটি কাঁদতে শুরু করল। ঈশ্বর ছেলেটির কান্না শুনলেন। ঈশ্বরের স্বর্গদূত স্বর্গ থেকে হাগারকে আহ্বান করলেন, “কী হয়েছে হাগার? ভয় পেয়ো না। ছেলেটি যে স্থানে শুয়ে আছে ঈশ্বর সেখান থেকে ওর কান্না শুনেছেন। ছেলেটিকে তুলে নাও এবং ধরে রাখো, কারণ আমি তাকে এক মহান জাতিতে পরিনত করব।”
অতঃপর ঈশ্বর তাঁর চোখ খুলে দিলেন এবং তিনি পানির এক কূপ [জমজম কূপ] দেখতে পেলেন। তিনি সেদিকে গেলেন, চামড়ার থলে পানি দিয়ে ভর্তি করলেন এবং ছেলেটিকে পানি খাওয়ালেন।”
” And I (God) will make a nation of the son of the slave woman (Hagar) also, because he is your offspring.” So Abraham rose early in the morning, and took bread and a skin of water, and gave it to Hagar, putting it on her shoulder, along with the child, and sent her away. And she departed, and wandered in the wilderness of Beer-sheba.
When the water in the skin was gone, she cast the child under one of the bushes. Then she went, and sat down over against him a good way off, about the distance of a bowshot; for she said, “Let me not look upon the death of the child.” And as she sat over against him, the child lifted up his voice and wept. And God heard the voice of the lad; and the angel of God called to Hagar from heaven, and said to her, “What troubles you, Hagar? Fear not; for God has heard the voice of the lad where he is. Arise, lift up the lad, and hold him fast with your hand; for I will make him a great nation.” Then God opened her eyes, and she saw a well of water; and she went, and filled the skin with water, and gave the lad a drink. [RSV] [10]
কিন্তু এখানে ইহুদি-খ্রিষ্টানদের আদিপুস্তক(Genesis) গ্রন্থের বর্ণনায় একটা বড়সড় সমস্যা আছে। ২১নং অধ্যায়ে পরিষ্কার বলা হচ্ছে যে ইসমাঈল(আ.)কে মরুভূমিতে রেখে আসার সময়ে তিনি এক ছোট শিশু ছিলেন। ঠিক যেভাবে রাসুল(ﷺ) এর হাদিসে বলা হয়েছে।
কিন্ত, একটু আগেই, ঐ একই অধ্যায়ে[আদিপুস্তক ২১:৫-১১] বলা হচ্ছে—ইসমাঈল(আ.)কে নির্বাসন দেবার কারণ ছিল তিনি ইসহাক(আ.)কে ব্যাঙ্গ করছিলেন! এ কী করে সম্ভব, যে ছেলে একটা কাউকে ব্যাঙ্গ করার মত বড়, এক অধ্যায় পরেই সেই ছেলেটি একটি দুধের শিশুতে পরিনত হয় যে পানির জন্য কাঁদে?? যাকে তাঁর মা তুলতে পারেন?
“ইসহাকের যখন জন্ম হয়, তখন আব্রাহামের[ইব্রাহিম(আ.)] বয়স ১০০ বছর। সারা বললেন, “ঈশ্বর আমার মুখে হাসি ফিরিয়ে দিলেন। আর যে এ খবর শুনবে, সেও হাসবে।” তিনি আরো বললেন, “আব্রাহামকে কেই বা বলতে পেরেছিল যে সারা একসময় বাচ্চা লালনপালন করবে? তারপরেও আমি বৃদ্ধা বয়সে তাঁকে একটা সন্তান এনে দিলাম।” বাচ্চাটি বড় হল এবং দুধ খাওয়া ছাড়ল। আর যেদিন ইসহাক দুধ খাওয়া ছাড়ল, সেদিন আব্রাহাম এক বিশাল ভোজের আয়োজন করলেন। কিন্তু সারা লক্ষ্য করলেন যে, আব্রাহামের মিশরীয় দাসীর ছেলেটি[ইসমাঈল(আ.)] ব্যাঙ্গ করছিলো। সারা আব্রাহামকে বললেন, “ঐ দাসী আর তার ছেলেটাকে বের করে দাও। কারণ দাসীর ছেলে আমার ছেলে ইসহাকের উত্তরাধিকারের অংশীদার হতে পারে না।”
“Abraham was a hundred years old when his son Isaac was born to him. Sarah said, “God has brought me laughter, and everyone who hears about this will laugh with me.” And she added, “Who would have said to Abraham that Sarah would nurse children? Yet I have borne him a son in his old age.” The child grew and was weaned, and on the day Isaac was weaned Abraham held a great feast. But Sarah saw that the son whom Hagar the Egyptian had borne to Abraham was mocking, 10 and she said to Abraham, “Get rid of that slave woman and her son, for that woman’s son will never share in the inheritance with my son Isaac.” [NIV]” [11]
বাইবেলের বর্ণনামতে ইসমাঈল(আ.) ছিলেন ছোট ভাই ইসহাক(আ.) এর চেয়ে ১৪ বছরের বড়। [12] ইসহাক(আ.)এর দুধ ছাড়াতে ২ বছর লাগার কথা। সেই হিসাবে ইসহাক(আ.) এর দুধ ছাড়ানোর ভোজসভার সময়ে ইসমাঈল(আ.) এর বয়স ছিল ১৪+২=১৬ বছর। বাইবেলের বর্ণনামতে, ১৬ বছরের ছেলেটিকে ব্যাঙ্গ করার জন্য তার মা-সহ ইব্রাহিম(আ.) বের করে দিয়েছিলেন। অথচ বের করে দেবার পরেই আদিপুস্তক(Genesis) ২১:১৩-২১ এর বর্ণনায় ইসমাঈল(আ.) দুধের শিশু হয়ে গেলেন!!!
এর অর্থ হচ্ছে—ইসমাঈল(আ.) কর্তৃক ব্যাঙ্গ করার ঘটনাটি একটি বানোয়াট ঘটনা। এই ঘটনার কারণেই বাইবেলে এত বড় স্ববিরোধিতা দেখা দিচ্ছে।
রাসুলুল্লাহ(ﷺ) এর হাদিস এবং আদিপুস্তক(Genesis) ২১:১৩-২১ উভয়ের বর্ণনা অনুযায়ী বের করে দেবার সময়ে ইসমাঈল(আ.) ছিলেন শিশু। কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী—ইসহাক(আ.) এর জন্মের সুসংবাদ দেওয়ারও আগে ইসমাঈল(আ.)কে কুরবানী দিতে নিয়ে যাবার ঘটনা ঘটেছিল। [13] এর মানে ইসমাঈল(আ.)কে মরুভূমিতে রেখে আসার ঘটনাটাও ঘটেছিল ইসহাক(আ.) এর জন্মেরও বহু আগে। কাজেই ইসমাঈল(আ.) কর্তৃক ইসহাক(আ.) এর ভোজসভায় ব্যাঙ্গ করার ঘটনা ঘটবার প্রশ্নই আসে না। অতএব কুরবানীর জন্য একমাত্র বড় ছেলে ইসমাঈল(আ.)কেই বাছাই করা সম্ভব।
বাইবেলের বর্ণনায়ও দেখা যায় যে ইব্রাহিম(আ.)কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল তাঁর একমাত্র পুত্রকে কুরবানী দিতে নিয়ে যাবার জন্য, অথচ নামের জায়গায় ইসহাক(আ.) এর নাম।
“এই সমস্ত কিছুর পরে ঈশ্বর ঠিক করলেন য়ে তিনি অব্রাহামের বিশ্বাস পরীক্ষা করবেন। তাই ঈশ্বর ডাকলেন, “অব্রাহাম [ইব্রাহিম(আ.)]!” এবং অব্রাহাম সাড়া দিলেন, “বলুন!” তখন ঈশ্বর বললেন, “তোমার একমাত্র পুত্র ইসহাক যাকে তুমি ভালবাসো, তাকে মোরিয়া অঞ্চলে নিয়ে যাও। সেখানে পর্বতগুলির মধ্যে একটির ওপরে তাকে আমার উদ্দেশ্যে বলি দাও। আমি তোমাকে বলব কোন পর্বতের ওপর তুমি তাকে বলি দেবে।
...
দূত বললেন, “তোমার পুত্রকে হত্যা কোরো না, তাকে কোন রকম আঘাত দিও না। এখন আমি দেখতে পাচ্ছি, তুমি ঈশ্বরকে ভক্তি করো এবং তাঁর আজ্ঞা পালন করো। প্রভুর জন্যে তুমি তোমার একমাত্র পুত্রকে পর্যন্ত বলি দিতে প্রস্তুত।”
…
“আমার জন্যে তুমি তোমার একমাত্র পুত্রকেও বলি দিতে প্রস্তুত ছিলে। আমার জন্যে তুমি এত বড় কাজ করেছ বলে আমি তোমার কাছে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি; আমি, প্রভু নিজেরই দিব্য করে প্রতিশ্রুতি করছি ,””
“ After these things God tested Abraham, and said to him, “Abraham!” And he said, “Here am I.” He said, “Take your son, your only son Isaac, whom you love, and go to the land of Mori′ah, and offer him there as a burnt offering upon one of the mountains of which I shall tell you.”
…
He said, “Do not lay your hand on the lad or do anything to him; for now I know that you fear God, seeing you have not withheld your son, your only son, from me.”
…
and said, “By myself I have sworn, says the Lord, because you have done this, and have not withheld your son, your only son, ” [RSV] [14]
ইসহাক(আ.) কখনোই ইব্রাহিম(আ.) এর একমাত্র পুত্র ছিলেন না কারণ তিনি ছিলেন তাঁর ২য় ছেলে। কেবলমাত্র বড় ছেলে ইসমাঈল(আ.) এরই ইব্রাহিম(আ.) এর “একমাত্র পুত্র” হওয়া সম্ভব। ইসহাক(আ.) এর জন্মের আগ পর্যন্ত ১৪ বছর ধরে তিনিই ছিলেন ইব্রাহিম(আ.) এর “একমাত্র পুত্র”।
প্রকৃতপক্ষে ঝামেলাটা আছে ইহুদি-খ্রিষ্টানদের গ্রন্থে। বাইবেলের পুরাতন নিয়ম(Old Testament) অংশের লেখক হচ্ছে ইহুদিরা। তারা একে Tanakh বলে। ইহুদিরা এই ঘটনায় ইসমাঈল(আ.) ও ইসহাক(আ.) এর নাম অদলবদল করতে গিয়ে ফ্যাকরাটা বাঁধিয়েছে। ইহুদিরা চেয়েছিল কুরবানীর ঘটনায় ইসমাঈল(আ.) এর নাম বদলে ইসহাক(আ.) এর নাম বসাতে, কারণ ইসহাক(আ.) তাদের পূর্বপুরুষ। [15] এই কুকাজটা করতে গিয়ে তাদের কিতাবে এই হাস্যকর বৈপরিত্য বা স্ববিরোধিতা দেখা দিয়েছে।
কাজেই আমরা দেখতে পাচ্ছি যে—কুরআন ও হাদিসের বর্ণনায় কোন বৈপরিত্য বা ঝামেলা নেই। বরং ইহুদি-খ্রিষ্টানদের ধর্মগ্রন্থ তানাখ(Tanakh) ও বাইবেলে ইসমাঈল(আ.) ও ইসহাক(আ.) এর নাম অদল-বদল করে ইসমাঈল(আ.)কে কুরবানীর ঘটনা থেকে সরানো এবং ইসমাঈল(আ.) এর নামে একটি বানোয়াট ঘটনা অন্তর্ভুক্ত করবার কারণেই তাদের গ্রন্থে এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। কুরআন ও হাদিসের বর্ণনা মেনে নিলে আর এই সমস্যা থাকে না বরং ব্যাপারগুলো খাপে খাপে বসে যায়। অথচ নাস্তিক-মুক্তমনারা অন্ধভাবে ইহুদি-খ্রিষ্টানদের গ্রন্থের বিবরণের উপরেই নির্ভর করে, শুধুমাত্র ইসলামকে ভুল প্রমাণ করার জন্য। অথচ এ দ্বারা তাদের নিজেদের ভুল অবস্থান তো প্রমাণ হলই, ইহুদি-খ্রিষ্টানদের ধর্মগ্রন্থের বিকৃতিও প্রমাণ হল। আমরা মুসলিমগণ আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ নবী-রাসুলদের মধ্যে পার্থক্য করি না [16], আমরা সকল নবী-রাসুলকেই বিশ্বাস করি ও ভালোবাসি। কুরআন-হাদিসে যদি বলা হত ইসহাক(আ.) জবিহুল্লাহ, তাহলে আমরা নির্দ্বিধায় তা মেনে নিতাম। ইসমাঈল(আ.) ও ইসহাক(আ.) উভয়কেই আমরা ভালোবাসি। কিন্তু ব্যাপার হচ্ছে কুরআন-সুন্নাহ এবং বাইবেল সকল সূত্র থেকেই এটা প্রমাণিত যে ইসমাঈল(আ.)ই জবিহুল্লাহ। আল্লাহ মুসলিম উম্মাহকে ষড়যন্ত্রমূলক অপপ্রচার থেকে রক্ষা করুন।
আরো পড়ুনঃ
"ইসমাঈল(আ.) কি 'দাসীর পুত্র' ছিলেন বা কম মর্যাদাবান ছিলেন?"
"কুরআনে কুরবানীর ঘটনায় “ইয়া বুনাইয়া” কথার দ্বারা কি ছোট ছেলে ইসহাক(আ.)কে বোঝানো হয়েছে?"
তথ্যসূত্রঃ
[1] সিলসিলা সহিহাহ ৭৫৮, সহীহ মুসলিম, তিরমিযী হাদিস নং : ২১৯৫ দ্রষ্টব্য
[2] তাফসির ইবন কাসির, সুরা আস সফফাতের ১০৩-১১৩ আয়াতের তাফসির দ্রষ্টব্য
[3] ঈসা(আ.) এর পূর্বে বনী ইস্রাঈল বংশে যে সকল নবী এসেছেন, তাঁদের নামে লেখা (বিকৃত)কিতাবগুলো্র সমষ্টিকে ইহুদিরা বলে ‘তানাখ’(Tanakh)। খ্রিষ্টানরাও এই কিতাবগুলোর উপর ঈমান রাখে। তারা এগুলোকে তাদের বাইবেলে ‘পুরাতন নিয়ম’(Old Testament) অংশে রেখেছে। ঈসা(আ.) ও তাঁর শিষ্যদের নামে লেখা (বিকৃত)কিতাবগুলোর সমষ্টিকে খ্রিষ্টানরা তাদের বাইবেলে ‘নতুন নিয়ম’(New Testament) অংশে রেখেছে। ‘পুরাতন নিয়ম’ ও ‘নতুন নিয়ম’ নিয়ে খ্রিষ্টানদের বাইবেল।
[4] আল কুরআন, সুরা আস সফফাত ৩৭:৯৯-১১২
[6] আল কুরআন, আস সফফাত ৩৭:৯৯-১১২ দ্রষ্টব্য
[7] আল কুরআন, আস সফফাত ৩৭:১১৪ দ্রষ্টব্য
[8] আল কুরআন, সুরা আম্বিয়া ২১:৮৭
[9] সহীহ বুখারী, হাদিস নং : ৩১২৫; সম্পূর্ণ হাদিসটি দেখুন এখান থেকে
[10] বাইবেল, আদিপুস্তক(Genesis) ২১:১৩-১৯
[11] বাইবেল, আদিপুস্তক(Genesis) ২১:৫-১০
[12] বাইবেল, আদিপুস্তক(Genesis) ১৬:১৬ ও ২১:৫ দ্রষ্টব্য
[13] আল কুরআন, সুরা আস সফফাত ৩৭:৯৯-১১২ দ্রষ্টব্য
[14] বাইবেল, আদিপুস্তক(Genesis) ২২:১-২, ১২, ১৬
[15] সিরিয়ায় এক ব্যক্তি থাকতেন যিনি পূর্বে একজন ইহুদি পণ্ডিত ছিলেন এবং ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে মুসলিম হয়েছিলেন। খলিফা থাকাকালীন উমার ইব্ন আবদুল আযীয(র.) তাঁকে এ বিষয়ে [জবিহুল্লাহ কে ছিলেন] জিজ্ঞেস করলেন।...তিনি তাঁকে জিজ্ঞেস করেনঃ ইব্রাহিমের(আ.) দুই ছেলের মধ্য থেকে কাকে কুরবানী করার জন্য আল্লাহ তা'আলা আদেশ করেছিলেন? ঐ পণ্ডিত ব্যক্তি বললেনঃ তিনি ছিলেন ইসমাঈল(আ.)। আল্লাহর শপথ হে আমিরুল মু'মিনীন! ইহুদিরাও এটা ভালো করেই জানে। কিন্তু শুধুমাত্র হিংসার কারণে তারা এটা স্বীকার করে না। আরবদের মূল হলেন ইব্রাহিমের(আ.) ছেলে ইসমাঈল(আ.), আর ইহুদিদের মূল এসেছে ইসহাক(আ.) থেকে। তাই হিংসার বশবর্তী হয়ে তারা ইসমাঈলকে(আ.) প্রাধান্য দিতে অস্বীকার করে। [তাবারী ২১/৮৫; তাফসির ইবন কাসির, সূরা আস সফফাতের ১০৩-১১৩ আয়াতের তাফসির দ্রষ্টব্য]