☛ মূলঃ শায়খ মুহাম্মাদ সালিহ আল মুনাজ্জিদ
☛ অনুবাদঃ মুহাম্মাদ মুশফিকুর রহমান মিনার
অনুবাদকের ভূমিকাঃ কিছু হাদিসের অর্থ সঠিকভাবে বুঝতে না পেরে তাকদিরের জটিল বিষয়টি নিয়ে অনেকে ভুল ধারণ পোষণ করেন। যেমন, একটি হাদিসের সরল অনুবাদ দেখে কেউ কেউ ভুল ধারণা করেনঃ একজন মানুষ হয়তো জান্নাতীদের আমল করছে, কিন্তু বিনা দোষে শুধুমাত্র তাকদিরের লিখনের জন্য তাকে জাহান্নামী বানিয়ে দেয়া হয়! কখনো কখনো ইসলামের শত্রুরাও এই হাদিসগুলো দেখিয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে নানা বিষোদগার করে। অথচ এসব ক্ষেত্রে তারা যে ধারণা পোষণ করে তা জাহমিয়া এবং জাবরিয়াদের বিভ্রান্ত আকিদা। তাদের আকিদা ছিলোঃ একজন বান্দার তার আমলের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। তাকদিরের লিখন অনুযায়ী তাকে দিয়ে জোর করে আমল করানো হয়। বান্দার অবস্থা ঠিক এক টুকরো পালকের মতো, যা বাতাসে উড়ে যায়। বাতাস যেদিকে উড়িয়ে নেবে সেও সেদিকে যাবে, তার নিজের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। অথচ এমন আকিদা কুরআন সুন্নাহ থেকে প্রাপ্ত আকিদার সাথে সাংঘর্ষিক। রাসুলুল্লাহ্(ﷺ) এর সাহাবীদের দল আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহর আকিদা হলোঃ আল্লাহর নির্ধারণ (তাকদির) এর প্রভাব সত্য, মানুষের সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতাও সত্য। মানুষকে জোর করে খারাপ আমল করিয়ে জাহান্নামী বানানো হয় না। এটাই কুরআন সুন্নাহ থেকে প্রাপ্ত আকিদা। [1]
তাকদির সংক্রান্ত একটি হাদিসের ব্যাপারে এখানে বিস্তারিত ইলমী আলোচনা করা হবে।
ফতোয়া নং ৯৬৯৮৯ : “(তাকদিরের) লিখন সামনে চলে আসে, অতঃপর সে জাহান্নামবাসীদের মত আমল করে” – এই হাদিসের ব্যাখ্যা
প্রশ্নঃ
আপনাদের কাছে এই হাদিসটির ব্যাখ্যা চাচ্ছিঃ
আবূ আব্দির রহমান আব্দুল্লাহ্ ইবনু মাসউদ(রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন— রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ)— যিনি সত্যবাদী ও যার কথাকে সত্য বলে মেনে নেয়া হয়— তিনি আমাদেরকে বলেছেন:
‘‘তোমাদের কারো সৃষ্টি তার মাতৃগর্ভে প্রথমে চল্লিশ দিন বীর্য আকারে সঞ্চিত থাকে। পরবর্তীতে একইভাবে তা জমাট রক্তে পরিণত হয়। এরপর একইভাবে তা মাংসপিণ্ডে রূপান্তরিত হয়। অতঃপর আল্লাহ্ তা’আলা একজন ফেরেশতা পাঠান। সে এতে রূহ ফুঁকে দেয়। এসময় তাকে চারটি বিষয় লেখার নির্দেশ দেয়া হয়ঃ সে কী পরিমাণ জীবিকা অর্জন করবে, বয়স কত হবে, কর্ম কী হবে এবং পরিণামে সে ভাগ্যবান হবে না হতভাগ্য। শপথ সেই আল্লাহর যিনি ব্যতিত প্রকৃত কোন উপাস্য নেই, তোমাদের মধ্যে একজন জান্নাতবাসীদের আমল করতে থাকে, এমনকি তার মাঝে এবং এর (জান্নাতের) মাঝে মাত্র এক হাতের দূরত্ব অবশিষ্ট থাকে, এমন সময় (তাকদিরের) লিখন সামনে চলে আসে। অতঃপর সে জাহান্নামবাসীদের মত আমল করে এবং জাহান্নামে প্রবেশ করে। এমনিভাবে একজন জাহান্নামবাসীদের মত আমল করতে থাকে, এমনকি তার মাঝে এবং এর (জাহান্নামের) মাঝে মাত্র এক হাতের দূরত্ব অবশিষ্ট থাকে, এমন সময় (তাকদিরের) লিখন সামনে চলে আসে। অতঃপর সে জান্নাতবাসীদের মত আমল করে এবং জান্নাতে প্রবেশ করে।
[ইমাম বুখারী বর্ণনা করেছেন]
সত্যি কথা বলতে মাঝে মাঝে এটা ভেবে আমার খারাপ লাগে যে আমি হয়তো জান্নাতীদের মতো (ভালো) কাজ করতে থাকবো কিন্তু আমার (তাকদিরের) লিখন হচ্ছে আমি জাহান্নামী! অনুগ্রহ করে আমাকে এই উত্তরটি দেবেন। আপনাদের সকল প্রয়াসের জন্য অনেক শুকরিয়া। আল্লাহ একে আপনাদের নেকির পাল্লায় অন্তর্ভুক্ত করুন।
উত্তরঃ
আলহামদুলিল্লাহ্।
ইবনুল কাইয়িম(র.) বলেছেন, “যারা আল্লাহ, তার নাম এবং সিফাতসমূহের ব্যাপারে অজ্ঞ তারাই সঠিক অর্থ থেকে অপব্যাখ্যা করে। এরা নিজের অজান্তেই আল্লাহর প্রতি তাঁর বান্দাদের মনে ঘৃণা সৃষ্টি করে, আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার ও অনুরাগের রাস্তাকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
আমরা এ ব্যাপারে কিছু উদাহরণ আলোচনা করবোঃ তারা দুর্বল ঈমানের লোকদেরকে বোঝাতে চেষ্টা করে যে, আল্লাহর শত আনুগত্য করেও কোনো লাভ নেই। এমনকি বহুকাল ধরে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য উভয়ভাবে ইবাদত করেও তার জন্য আল্লাহর পরিকল্পনা থেকে বাঁচার কোনো নিশ্চয়তা নেই! বরং আল্লাহর অনুগত ও মুত্তাকী বান্দারা মসজিদের মিহরাব থেকে পতিতালয়ের দিকে ছুটে যাবে, তাওহিদ থেকে শির্ক ও বাঁশি-বাদ্যের দিকে ছুটে যাবে। আল্লাহ তাদের অন্তরগুলোকে খালিস ঈমান থেকে কুফরের দিকে নিয়ে যাবেন! এমনকি তারা সহীহ বর্ণনা উল্লেখ করেও এইসমস্ত জিনিস প্রমাণ করতে চেষ্টা করে কিন্তু তারা নিজেরাও সেগুলো ঠিকভাবে বোঝে না। তারা মিথ্যা বর্ণনাও উল্লেখ যেগুলো আসলে গুনাহহীন মানুষটির [নবী(ﷺ)] মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয়নি। তারা মানুষকে বোঝাতে চায় এগুলোই সত্যিকারের তাওহিদ!”
বক্তব্য সমাপ্ত।
[আল ফাওয়াইদ (পৃষ্ঠা ১৫৯)]
তিনি [ইবনুল কাইয়িম(র.)] আরো বলেন, “এরপর সেই বেচারা বিশ্বাসের দিক থেকে এমন দেওলিয়া হয়ে যায় যে সে তার আমল ভালো নাকি খারাপ তা আর বুঝতে পারে না। ভালো কাজ করলে তার আর ভালো লাগে না, খারাপ কাজ করলেও তার এ জন্য খারাপ অনুভূতি হয় না। মানুষকে আল্লাহ থেকে দূরে সরিয়ে দেবার জন্য এবং তাঁর প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করার জন্য এর থেকে কার্যকর আর কিছু কি হতে পারে? বাতিল আকিদার সব লোক মিলে যদি মানুষের মনে ধর্মের ব্যাপারে ঘৃণা সৃষ্টি করা এবং আল্লাহ থেকে দূরে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতো, তাহলে এর থেকে খারাপ আর কিছু করতে পারতো না।
যারা এই পন্থা অবলম্বন করে, তারা মনে করে যে তারা তাওহিদ এবং তাকদিরের আকিদার পক্ষে কাজ করছে। বিদআতীদের খণ্ডন করছে, দ্বীনকে জয়ী করছে। কিন্তু আল্লাহর শপথ, একজন জ্ঞানী শত্রুও একজন জাহেল বন্ধুর থেকে কম ক্ষতিকর। আল্লাহর নাজিলকৃত সকল কিতাব এবং সকল রাসুল এইসব (বাতিল আকিদার লোকদের) বিরুদ্ধে সাক্ষ্য। বিশেষত আল কুরআন। আল্লাহ ও তাঁর রাসুল(ﷺ) যে মাসলাক দেখিয়েছেন, দাঈরা যদি এর উপরে থেকে মানুষকে দাওয়াহ দিতেন, তাহলে পৃথিবী এমনভাবে বদলে যেতো যে এতে কোনো ফাসাদ অবশিষ্ট থাকতো না।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা আমাদেরকে অবহিত করেছেন যে তিনি সত্যবাদী এবং তিনি তাঁর ওয়াদা পূর্ণ করেন। তিনি মানুষকে তাদের কর্মের ভিত্তিতে বিচার করেন। তাদের কর্মের বদলা প্রদান করেন। যে ব্যক্তি প্রকৃতই নেককার, তার জন্য কোনো প্রকারের জুলুম বা অবিচারের ভয় নেই। তার এমন ভয় পাবার কোনো কারণ নেই যে তার আমল হারিয়ে যাবে বা তার উপর কোনো বোঝা চাপিয়ে দেয়া হবে। নেককারের আমল কখনো হারিয়ে যায় না। কোনো বান্দার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আমলও বৃথা যায় না। তার উপরে কোনো জুলুম করা হবে না।
وَإِن تَكُ حَسَنَةً يُضَاعِفْهَا وَيُؤْتِ مِن لَّدُنْهُ أَجْرًا عَظِيمًا
অর্থঃ আর কোন পূণ্য কাজ হলে আল্লাহ সেটাকে বহুগুণ বর্ধিত করেন এবং আল্লাহ তার কাছ থেকে মহাপুরস্কার প্রদান করেন।
[আল কুরআন, নিসা ৪ : ৪০]
কারো ভালো আমল যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয়, তিনি এর প্রতিদান দেবেন। এই আমলকে হারিয়ে যেতে দেবেন না। খারাপ আমলের ক্ষেত্রেও একই কথা। আর সে খারাপ আমলকে তিনি দূর করে দেন যদি সে তওবা করে, অনুশোচনা করে, ইস্তিগফার করে, ভালো আমল করে অথবা তার উপর যদি কোনো মুসিবত আপতিত হয়। শুধু তাই না, তিনি ভালো আমলকে ১০ গুণ থেকে ৭০০ গুণ অথবা আরো বর্ধিত করে দেন। তিনি ফাসাদ সৃষ্টিকারীদেরকে সংশোধণ করেন, যাদের অন্তর তাঁর থেকে দূরে চলে যেতে চায় তিনি তাঁদেরকেও কাছে টেনে আনেন। তিনি গুনাহগারের তওবা কবুল করেন, পথভ্রষ্টদেরকে সুপথে আনেন। যারা ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে তিনি তাদের রক্ষা করেন, অজ্ঞ-জাহেলদেরকে তিনিই শিক্ষা দান করেন। তিনি বিভ্রান্তদেরকে সঠিক রাস্তা দেখান, গাফেলদেরকে স্মরণ করান। পথহারাদেরকে তিনিই আশ্রয় দেন। আর তিনি তখনই শাস্তি দেন যখন অবাধ্যতার মাত্রা প্রবল হয়। এবং কেউ একগুঁয়েমী করে তাঁর থেকে দূরে সরে। আর সেই পাপীকে যদি এর আগেই আল্লাহর দিকে ফিরবার জন্য দাওয়াত দেয়া হয়ে থাকে। ...”
বক্তব্য সমাপ্ত।
[আল ফাওয়াইদ (পৃষ্ঠা ১৬১)]
আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ(রা.) থেকে এই গুরুত্বপূর্ণ হাদিসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম বুখারী(র.) [৩২০৮] ও ইমাম মুসলিম(র.) [২৬৪৩]। কেউ কেউ নবী(ﷺ) এর এই বাণী বুঝতে না পেরে বিভ্রান্তিতে পড়েঃ
"তোমাদের মধ্যে একজন জান্নাতবাসীদের আমল করতে থাকে, এমনকি তার মাঝে এবং এর (জান্নাতের) মাঝে মাত্র এক হাতের দূরত্ব অবশিষ্ট থাকে, এমন সময় (তাকদিরের) লিখন সামনে চলে আসে। অতঃপর সে জাহান্নামবাসীদের মত আমল করে এবং জাহান্নামে প্রবেশ করে। এমনিভাবে একজন জাহান্নামবাসীদের মত আমল করতে থাকে, এমনকি তার মাঝে এবং এর (জাহান্নামের) মাঝে মাত্র এক হাতের দূরত্ব অবশিষ্ট থাকে, এমন সময় (তাকদিরের) লিখন সামনে চলে আসে। অতঃপর সে জান্নাতবাসীদের মত আমল করে এবং জান্নাতে প্রবেশ করে। ”
যেসব সহীহ বিবরণকে মানুষ ভুল বোঝে এর মধ্যে এটি একটি। ইবনুল কাইয়িম(র.) যেসব উদাহরণ দিয়েছেন এর মধ্যে এটিও আছে।
(এই সংশয়ের) জবাব হলো, এই হাদিসের বক্তব্য তাদের জন্য প্রযোজ্য যারা ঈমান ও ইখলাস সহকারে আমল করে না। বরং বাইরে থেকে দেখে তাদের আমল জান্নাতীদের আমল বলে মনে হয়। যেমনটি বুখারী (৪২০৭) এবং মুসলিমেরই (১১২) অন্য একটিও হাদিসে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
সাহ্ল (ইব্নু সা'দ) (রা.) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, কোন এক যুদ্ধে রাসুলুল্লাহ(ﷺ) এবং মুশরিকরা মুখোমুখী হলেন। তাদের মধ্যে তুমুল লড়াই হল। (শেষে) সকলেই আপন আপন সেনা ছাউনীতে ফিরে গেল। মুসলিম সৈন্যদের মধ্যে এমন এক ব্যক্তি ছিল, যে মুশরিকদের কোন একাকী কিংবা দলবদ্ধ কোন শত্রুকেই রেহাই দেয়নি বরং তাড়িয়ে নিয়ে তরবারি দ্বারা হত্যা করেছে। তখন বলা হল "হে আল্লাহ্র রাসুল! অমুক লোক আজ যতটা 'আমাল করেছে অন্য কেউ ততটা করতে পারেনি। রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বললেন, সে ব্যক্তি জাহান্নামী। তারা বলল, তা হলে আমাদের মধ্যে আর কে জান্নাতী হবে যদি এ ব্যক্তিই জাহান্নামী হয়? তখন কাফেলার মধ্য থেকে একজন বলল, অবশ্যই আমি তাকে অনুসরণ করে দেখব (তিনি বলেন) লোকটির দ্রুত গতিতে বা ধীর গতিতে আমি তার সঙ্গে থাকতাম। শেষে, লোকটি আঘাতপ্রাপ্ত হলে যন্ত্রণার চোটে সে দ্রুত মৃত্যু কামনা করে তার তরবারির বাঁট মাটিতে রাখলো এবং ধারালো দিক নিজের বুকের মাঝে রেখে এর উপর সজোরে চেপে ধরে আত্মহত্যা করল। তখন (অনুসরণকারী) সহাবী নবী(ﷺ)-এর কাছে এসে বললেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, নিশ্চয়ই আপনি আল্লাহ্র রাসুল। তিনি [নবী(ﷺ)]জিজ্ঞেস করলেন,কী ব্যাপার? তিনি তখন নবী(ﷺ)-কে সব ঘটনা জানালেন। তখন নবী(ﷺ) বললেন, কেউ কেউ জান্নাতবাসীদের মতো 'আমাল করতে থাকে আর লোকজন তাকে তেমনই মনে করে থাকে অথচ সে জাহান্নামী। আবার কেউ কেউ জাহান্নামীর মতো 'আমাল করে থাকে আর লোকজনও তাকে তাই মনে করে অথচ সে জান্নাতী।”
যারা সত্যিকার অর্থেই ঈমান ও ইখলাসের সাথে জান্নাতীদের আমল করে, আল্লাহ তাঁদের প্রতি অত্যন্ত ইনসাফকারী, দয়ালু ও ঔদার্যবান। তিনি তাঁদের জীবন সায়াহ্নে (সকল নেক আমল নষ্ট করে) তাদেরকে বরবাদীর মাঝে ফেলেন না। বরং এরা তো ঐসব ব্যক্তি যাদেরকে তাওফিক দেয়া হয়েছে, পথ বাতলানো হয়েছে এবং যারা (সৎপথে) অটল থেকেছে। যেমনটি আল্লাহ তা’আলা বলেছেন,
يُثَبِّتُ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا بِالْقَوْلِ الثَّابِتِ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآخِرَةِ وَيُضِلُّ اللَّهُ الظَّالِمِينَ وَيَفْعَلُ اللَّهُ مَا يَشَاءُ
অর্থঃ “যারা শাশ্বত বাণীতে বিশ্বাসী তাদেরকে ইহজীবনে ও পরজীবনে আল্লাহ সুপ্রতিষ্ঠিত রাখবেন এবং যারা যালিম, আল্লাহ তাদেরকে বিভ্রান্তিতে রাখবেন; আল্লাহ যা ইচ্ছা তা করেন।”
[আল কুরআন, ইব্রাহিম ১৪ : ২৭]
وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا وَإِنَّ اللَّهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِينَ
অর্থঃ “আর যারা আমার পথে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালায়, তাদেরকে আমি অবশ্যই আমার পথে পরিচালিত করব। আর নিশ্চয় আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সাথেই আছেন।”
[আল কুরআন, আনকাবুত ২৯ : ৬৯]
إِنَّهُ مَنْ يَتَّقِ وَيَصْبِرْ فَإِنَّ اللَّهَ لَا يُضِيعُ أَجْرَ الْمُحْسِنِينَ
অর্থঃ “যে ব্যক্তি তাকওয়া অবলম্বন করে আর ধৈর্যধারণ করে এমন সৎকর্মশীলদের কর্মফল আল্লাহ কক্ষনো বিনষ্ট করেন না।”
[আল কুরআন, ইউসুফ ১২ : ৯০]
يَسْتَبْشِرُونَ بِنِعْمَةٍ مِنَ اللَّهِ وَفَضْلٍ وَأَنَّ اللَّهَ لَا يُضِيعُ أَجْرَ الْمُؤْمِنِينَ
অর্থঃ “আল্লাহর (অনন্ত) নিয়ামত ও অনুগ্রহের জন্য তারা (বিশ্বাসীগণ) আনন্দ প্রকাশ করে। আর নিশ্চয় আল্লাহ বিশ্বাসীদের শ্রমফল নষ্ট করেন না।”
[আল কুরআন, আলি ইমরান ৩ : ১৭১]
আল ফাওয়াইদ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা ১৬৩) ইবনুল কাইয়িম(র.) বলেছেন, “একজন জান্নাতবাসীদের আমল করতে থাকে, এমনকি তার মাঝে এবং এর (জান্নাতের) মাঝে মাত্র এক হাতের দূরত্ব অবশিষ্ট থাকে, এমন সময় (তকদীরের) লিখন সামনে চলে আসে” – এখানে তাদের কথা বলা হচ্ছে বাইরে থেকে দেখে মানুষের কাছে যাদের আমল জান্নাতীদের আমল বলে মনে হয়। কোনো সৎ কাজ যদি আল্লাহর কাছে কবুল হয় তাহলে আল্লাহ একে ভালোবাসেন, এর উপর সন্তুষ্ট হন এবং একে নষ্ট করে দেন না। তবুও কেউ কেউ “তার মাঝে এবং জান্নাতের মাঝে মাত্র এক হাতের দূরত্ব অবশিষ্ট থাকে” – এই হাদিসের ব্যাপারে আমাদের ব্যাখ্যা নিয়ে সংশয় পোষণ করতে পারে। তাদেরকে আমরা বলবোঃ সমাপ্তি কেমন হয়েছে এই অনুসারে যদি কোনো আমলকে বিবেচনা করা হয় সেক্ষেত্রে ধরা যাক কোনো ব্যক্তির তার আমল যথাযথভাবে সম্পাদনের জন্য পর্যাপ্ত ধৈর্য ছিলো না। বরং তার আমল ত্রুটিপূর্ণ ছিলো এবং এর মাঝে কোনো সমস্যা লুকিয়ে ছিলো যার দরুন জীবনের শেষভাগে এসে সে বরবাদ হয়ে গেলো। সেই লুকায়িত এবং মারাত্মক ত্রুটিটির জন্যই প্রয়োজনের সময়ে বরবাদী তাকে গ্রাস করলো। ঐ অনুযায়ী সে অগ্রসর হলো এবং যা আমল করার করে ফেললো। তার যদি কোনো ত্রুটি বা কপটতা না-ই থাকতো, আল্লাহ কখনোই তার ঈমানকে বদলে যেতে দিতেন না। ... আল্লাহ সবার ব্যাপারে এতো ভালোভাবে অবগত আছেন যে তারা নিজেরাও একে অপরের ব্যাপারে সেভাবে অবগত নেই।”
বক্তব্য সমাপ্ত।
ইবন রজব(র.) বলেছেন,
“আর লোকজন তাকে তেমনই মনে করে থাকে” – (হাদিসের) এই কথাগুলোর দ্বারাই এটা বোঝা যাচ্ছে যে সে আমলের বাহ্যিক অবস্থা আর ভেতরের অবস্থা এক নয়। আর এই খারাপ সমাপ্তির কারণ হলো সে ব্যক্তির অভ্যন্তরে যে সমস্যা (অর্থাৎ নিয়তে সমস্যা) লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিলো। (বাহ্যিকভাবে) সেটা খারাপ আমল বা এই জাতীয় কিছু হোক না কেন, এর অভ্যন্তরের ত্রুটির জন্য মৃত্যুর সময় তা খারাপ পরিনতির কারণ হয়।
একইভাবে কোনো ব্যক্তি হয়তো (বাহ্যিকভাবে) জাহান্নামীদের মতো আমল করছে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার ভালো কিছু উদ্যেশ্য ছিলো। আর এটা তার জীবনের শেষ পর্যন্ত অব্যাহত ছিলো। এর ফলে তার জীবনের সমাপ্তিটা হয় ভালোভাবে। আব্দুল আযিয ইবন আবু রাওয়াদ(র.) বলেছেন, “আমি এক ব্যক্তির মৃত্যুশয্যার সময় উপস্থিত ছিলাম। তাকে তখন শাহাদাহ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পড়তে বলা হচ্ছিলো। কিন্তু (লোকটি তা বলতে সক্ষম হলো না এবং) শেষ কথা হিসাবে যা বলেছিল তা হলোঃ তারা যে শাহাদাহ বলছে, এর উপরে সে বিশ্বাস করে না। এ অবস্থাতেই সে মারা গিয়েছিলো!
আমি [আব্দুল আযিয] তার ব্যাপারে জানার চেষ্টা করলাম। জানতে পারলাম লোকটি ছিলো মদে আসক্ত।”
আব্দুল আযিয প্রায়ই বলতেন, “গুনাহ থেকে সাবধান থাকো। ঐ লোকটির খারাপ পরিনতির কারণ ছিলো তার গুনাহ।”
সহজ কথায় বললে, মানুষ তার জীবনে অতীতে যা যা করতো, তার পরিনতিও ঠিক সেভাবেই হয়। আর এই সব কিছুই বহু আগে এক কিতাবে লেখা হয়ে গেছে। এ জন্যই সালাফগণ জীবনের খারাপ সমাপ্তির ব্যাপারে খুব ভয় করতেন। অতীত জীবনের গুনাহের কথা স্মরণ করে খুব চিন্তিত হতেন। সালাফদের মনগুলো তাদের জীবনের সমাপ্তি কিভাবে হবে এই চিন্তায় লেগে থাকতো। তাঁরা শুধু ভাবতেন, “আমাদের শেষটা কেমন হবে?” যাদের অন্তর সর্বদা আল্লাহর সাথে জুড়ে থাকে, তারা নিজেদের অতীতের গুনাহ নিয়ে অনবরত চিন্তা করেন। তাঁরা বলেন, “আমরা অতীতে কী কী আমল করে আসলাম?” সাহল আত তাসতারি(র.) বলেছেন, আল্লাহর পথের দিকে যারা যাত্রা শুরু করেছেন, তারা সদা আশঙ্কা করেন যে, কোনো গুনাহের কাজ করে ফেলছি না তো! আল্লাহর ব্যাপারে জ্ঞানী ব্যক্তিরা সদা ভয় করেন যে পাছে কুফরে নিপতিত হন কিনা! সাহাবী, নেককার সালাফ এবং তাঁদের পরবর্তীকালে যাঁরা আগমন করেছিলেন, তাঁরা সদা মুনাফিকিতে পতিত হবার আশঙ্কা করতেন। ভীষণ তীব্র ছিলো তাঁদের এই আশঙ্কা এবং দুশ্চিন্তা। কাজেই মুমিন বান্দা নিজের ব্যাপারে সবসময়ে এই চিন্তা করেন যে, আমি ছোটখাটো মুনাফিকিতে লিপ্ত হচ্ছি না তো! এবং আশঙ্কা করেন যে এই মুনাফিকি আমার উপর প্রবল হয়ে শেষ জীবনে আমাকে বড় মুনাফিক বানিয়ে দেবে না তো!
পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে যে অতীতের গুপ্ত নানা গুনাহ জীবনের একটা খারাপ সমাপ্তির কারণ হয়।”
বক্তব্য সমাপ্ত।
[জামিউল উলুম ওয়াল হুকাম ১/৫৭-৫৮]
শায়খ ইবন উসাঈমিন(র.) বলেছেনঃ “ইবন মাসউদ(রা.) বর্ণিত হাদিসটিতে “এমনকি তার এবং এর মাঝে মাত্র এক হাতের দূরত্ব অবশিষ্ট থাকে” -এই কথার অর্থ হলো, তার এবং জান্নাতের সাথে (এক হাতের দূরত্ব অবশিষ্ট থাকে)। এ কথার অর্থ এই নয় যে সে আমলের দ্বারা এমন অবস্থানে পৌঁছে গেছে যে জান্নাত ও তার মাঝে মাত্র এক হাতের দূরত্ব। কারণ কেউ সত্যিকার অর্থে জান্নাতীদের আমল করলে মহান আল্লাহ তাঁকে বরবাদ হতে দেন না। আল্লাহ তো তাঁর বান্দাদের চেয়েও অনেক বেশি ঔদার্যের অধিকারী। চিন্তা করুন, একজন বান্দা আল্লাহর প্রতি প্রচণ্ড অনুরক্ত, আর জান্নাত তাঁর থেকে মাত্র এক হাত দূরে আছে। আল্লাহ কি এমন ব্যক্তিকে সেই পথ থেকে তাড়িয়ে দেবেন? এটা অসম্ভব। বরং হাদিসের অর্থ হলো, মানুষের কাছে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় যে ঐ ব্যক্তি জান্নাতীদের আমল করছে। যখন তার আয়ু অল্প বাকি থাকে, তার অন্তর ঘুরে যায়। আল ইয়াযু বিল্লাহ, আমরা আল্লাহর নিকট নিরাপত্তা কামনা করি। এটাই ইবন মাসউদ(রা.) বর্ণিত হাদিসটির অর্থ। তার জীবনের আয়ু এমন শেষ দিকে চলে যায় যে “তার এবং এর (জান্নাতের) মাঝে মাত্র এক হাতের দূরত্ব অবশিষ্ট থাকে”। কিন্তু সে সত্যিকার অর্থে জান্নাতীদের আমল করছিলো না, নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক। আমরা আল্লাহর নিকট দোয়া করি আমাদের অন্তরগুলো যেন বিপথগামী না হয়। (উপরে উল্লেখিত ব্যক্তি) আমল করেছে কিন্তু তার অন্তরে লুকায়িত ছিলো শয়তানী। কাজেই মৃত্যুর সময় তার আর জান্নাতের মাঝে যখন এক হাতের মতো দূরত্ব ছিলো ঠিক তখনই সে বরবাদ হয়ে গেলো।”
বক্তব্য সমাপ্ত।
[লিক্বা আশ শাহরি ১৩/১৪]
কোনো কোনো আলেমের মতে হাদিসে উল্লেখিত ব্যক্তি হয়তো সত্যি সত্যি জান্নাতীদের মতো আমল করে। কিন্তু যখন তার আয়ু ফুরিয়ে আসে, শেষটা খারাপভাবে হয়। সে কুফর বা গুনাহের উপরে মৃত্যুবরণ করে। তবে এমনটি হওয়া খুবই বিরল। আর এরও কারণ হিসাবে থাকে কোনো গুপ্ত অথবা মারাত্মক অনিষ্টকর গুণ, যার উপরে ঐ ব্যক্তি অটল ছিলো। যেমনঃ খারাপ আকিদা অথবা ভয়াবহ কবিরা গুনাহ, যেগুলোর জন্য তার জীবনের শেষটা খুব খারাপভাবে হয়। আমরা আল্লাহর নিকট নিরাপত্তা কামনা করি। কাজেই আলোচ্য হাদিসটি আমাদের জন্য এমন একটি সতর্কবার্তা হতে পারে যে, আমরা যেন নিজ আমলের দ্বারা (আত্মতৃপ্তিতে ভুগে) ধোঁকায় পড়ে না যাই। আমরা যেন মৃত্যু পর্যন্ত (নেক আমলের উপর) অটল থাকার জন্য আল্লাহর নিকট সর্বদা দোয়া করি। কারণ আমাদের অন্তরগুলো পরম দয়াময় আল্লাহর দুই আঙুলের মাঝে। তিনি যেভাবে চান, সেভাবেই একে বদলে দিতে পারেন।
ইমাম নববী(র.) তাঁর শারহ মুসলিমে বলেছেন, “আলোচ্য হাদিসে “এক হাতের দূরত্ব” দ্বারা বোঝানো হয়েছে ঐ ব্যক্তি তার মৃত্যুর এবং সর্বশেষ ঠাঁইয়ের (জান্নাত অথবা জাহান্নাম) কতো কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। সে আর তার সর্বশেষ আবাসের মাঝে মাত্র এক হাতের দূরত্ব অবশিষ্ট আছে ঠিক যেমনটি পৃথিবীতে তার আর তার গন্তব্যের মাঝে থাকতো। হাদিসে যা বোঝানো হয়েছে, এমনটি কালেভদ্র কারো কারো ক্ষেত্রে ঘটতে পারে। সবার ক্ষেত্রেই যে এমনটি হয় তা নয়। সেই সাথে এটাও আল্লাহর স্নেহ ও দয়ার নিদর্শন যে, বহুক্ষেত্রেই মানুষ মন্দ থেকে ভালোর দিকে ফিরতে পারে। আর শেষকালে কারো ভালো থেকে মন্দের দিকে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারটি খুব কম ক্ষেত্রেই ঘটে। এখানে আল্লাহর এই বাণী (হাদিসে কুদসি) উল্লেখ করা যায়, { إِنَّ رَحْمَتِي سَبَقَتْ غَضَبِي وَغَلَبَتْ غَضَبِي } “আমার ক্রোধের উপর আমার দয়া অগ্রগামী রয়েছে এবং জয়ী হয়েছে”। এর (আল্লাহর দয়া) মাঝে তারাও শামিল হবে যারা কুফরী এবং পাপের দ্বারা জাহান্নামীদের আমলের দিকে ধাবিত হয়েছে। তবে আলেমরা ইখতিলাফ করেছেন যে এরা সেখানে চিরস্থায়ী হবে কি হবে না। কাফিররা জাহান্নামে চিরস্থায়ী হবে। তবে যে সকল পাপী তাওহিদে বিশ্বাস সহকারে মৃত্যুবরণ করেছে, তারা জাহান্নামে চিরস্থায়ী হবে না। যা ইতিমধ্যেই উল্লেখ করা হয়েছে। আলোচ্য হাদিসে সুস্পষ্টভাবে তাকদিরকে সত্যায়ন করা হয়েছে। তওবা পূর্বের সকল পাপকে মুছে দেয়। একজন মানুষ ভালো বা খারাপ যে অবস্থায় মারা যাবে, সে অনুযায়ী তার বিচার করা হবে। কিন্তু যে ব্যক্তি কুফরী ব্যতিত অন্য গুনাহ করে, তার ব্যাপারটি আল্লাহর ইচ্ছাধীন।”
বক্তব্য সমাপ্ত।
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়, যে হাদিসটি থেকে আপনি (প্রশ্নকারী) সংশয়ে পতিত হয়েছেন, সেই হাদিসের মাঝেই সংশয়ের জবাব রয়েছে। কারণ এ হাদিসে শুধুমাত্র তাকদিরকে, আল্লাহ তা’আলা কর্তৃক তাঁর সৃষ্টির ব্যাপারে আগে থেকেই ইলম রাখা এবং তাদের আমলগুলো আগে থেকেই লিখে রাখা - এ ব্যাপারগুলোকে সত্যায়ন করেই থেমে যাওয়া হয়নি। বরং এই একই হাদিসের পাঠের মধ্যে আল্লাহ তা’আলার আদেশ-নিষেধেরও সত্যায়ন রয়েছে। আল্লাহ যে সৃষ্টির ব্যাপারে তাঁর পূর্ব ইলমের জন্য তাদেরকে পুরষ্কার বা শাস্তি দেন না বরং তারা যে কর্ম করেছে এবং যা অর্জন করেছে এর ভিত্তিতেই এগুলো দেন – এর সত্যায়নও রয়েছে।
শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া(র.) বলেছেন,
“এই হাদিসটি এবং এ জাতীয় অন্য বর্ণনাগুলো থেকে দুইটি ধারণা লাভ করা যায়ঃ
প্রথমতঃ
পূর্ব থেকেই নির্ধারিত তাকদির। অর্থাৎ মহান আল্লাহ যে কারো কোনো ধরণের আমল করবার পূর্ব থেকেই জানেন যে কারা জান্নাতী এবং কারা জাহান্নামী। এটি সত্য এবং এর উপর অবশ্যই ঈমান রাখতে হবে। যারা এর উপর ঈমান রাখে না, তাদেরকে ইমামগণ যেমন মালিক(র.), শাফিঈ(র.) এবং আহমাদ(র.) নিশ্চিতভাবেই কাফির বলেছেন। আমাদেরকে অবশ্যই এ ব্যাপারে ঈমান রাখতে হবে যে, কোনো কিছু ঘটবার পূর্ব থেকেই আল্লাহ এ ব্যাপারে পূর্ণ জ্ঞান রাখেন। আল্লাহ যা নির্ধারণ করেছেন তা ঘটবেই এবং তিনি পূর্বেই আমাদেরকে এ ব্যাপারে যা জানিয়েছেন এর উপর আমাদেরকে অবশ্যই ঈমান রাখতে হবে। ...
দ্বিতীয়তঃ
প্রত্যেকটি জিনিস যে অবস্থাতে আছে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা ঠিক সেইভাবেই এর ব্যাপারে জানেন। এবং তিনি বিভিন্ন মাধ্যম সৃষ্টি করেছেন যা এগুলো ঘটবার কারণ। তিনি জানেন কোনো কিছু কোন মাধ্যমের দ্বারা ঘটবে। যেমন ধরা যাক, তিনি জানেন একজন লোক একজন নারীর সাথে সহবাস করে তাকে গর্ভবতী করার মাধ্যমে সন্তান লাভ করতে পারেন। এখন সেই লোক যদি বলে, “আল্লাহ জানেন যে আমার একটা সন্তান হবে কাজেই আমার আর সহবাস করার কোনো প্রয়োজন নেই!” – তাহলে সে বোকামীর পরিচয় দেবে। কারণ আল্লাহ জানেন যে তিনি এই ঘটনা ঘটবার যে মাধ্যম নির্ধারণ করেছেন, সেই মাধ্যম অর্থাৎ সহবাসের দ্বারা এটি ঘটবে। অনুরূপভাবে, একজন লোক জানে যে সে যেভাবে বীজ বপন করেছে এবং পানিসেচ দিয়েছে সে অনুযায়ী তার ক্ষেতের ফসল ফলবে। কিন্তু যদি সে বলে, “আল্লাহ তো জানেনই যে এটা ঘটবে (ফসল ফলবে), কাজেই আমার আর বীজ বপনের দরকার নেই!” – তাহলে বুঝতে হবে যে ঐ ব্যক্তি অজ্ঞতা এবং বিভ্রান্তির মধ্যে আছে। কারণ আল্লাহ জানেন যে এটি কোন মাধ্যমের দ্বারা ঘটবে। ...
একইভাবে বলা যায়, যখন আল্লাহ জানেন যে আখিরাতে কারা সৌভাগ্যবান হবে এবং কারা ধ্বংস হবে, আমরা বলিঃ এর কারণ হচ্ছে এরা ধ্বংস হবার মতো কাজ করেছে, তাই আল্লাহ জানেন যে সে তার আমলের জন্য ধ্বংস হবে। “সে কোনো কিছু না করলেও ধ্বংস হবে” – এমনটি বলা হলে তা হবে মিথ্যা। কারণ গুনাহ করা ব্যতিত আল্লাহ কাউকে জাহান্নামে পাঠান না। যেমনটি আল্লাহ তা’আলা বলেছেন,
لَأَمْلَأَنَّ جَهَنَّمَ مِنْكَ وَمِمَّنْ تَبِعَكَ مِنْهُمْ أَجْمَعِينَ
অর্থঃ “অবশ্যই তোমার (ইবলিস) দ্বারা ও তাদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করবে তাদের সবার দ্বারা আমি জাহান্নাম পূর্ণ করবো।”
[আল কুরআন, ছোয়াদ ৩৮ : ৮৫]
তিনি ইবলিস ও তার অনুসারীদের দ্বারা জাহান্নাম পূর্ণ করার শপথ করেছেন। যারা ইবলিসের অনুসরণ করে, তারা আল্লাহ তা’আলার অবাধ্য হয়। কিন্তু আল্লাহ তাঁর বান্দার ব্যাপারে আগে থেকেই যা জানেন এর উপর ভিত্তি করে শাস্তি দেন না বরং বান্দা তা (গুনাহ) করবার পরেই তিনি এ জন্য শাস্তি দেন। ...
আল্লাহ জান্নাতকে সৃষ্টি করেছেন তাদের জন্য যারা ঈমান আনে এবং তাঁর আনুগত্য করে। যাদের ব্যাপারে একে নির্ধারণ করা হয়েছে, তাদের জন্য ঈমান আনা ও আনুগত্য করার পথকে সুগম করা হয়েছে। “যদি আল্লাহ জানেন যে আমি এই লোকদের একজন - তাহলে মুমিন বা কাফির যা-ই হই না কেন জান্নাতে আমি যাবোই!” – কেউ যদি এমন কথা বলে, সে আল্লাহর উপর মিথ্যারোপ করেছে। নিশ্চয়ই আল্লাহ জানেন যে, কেউ জান্নাতে দাখিল হবে তাঁর ঈমানের দ্বারা। কাজেই কারো যদি ঈমান না থাকে, সে ঐসব লোকদের অন্তর্ভুক্ত নয় যাদের ব্যাপারে আল্লাহ জানেন যে তারা জান্নাতে যাবে। সে মুমিনদের অন্তর্ভুক্ত গণ্য হবে না বরং সে কাফির গণ্য হবে। এবং আল্লাহ জানেন যে সে জাহান্নামীদের অন্তর্ভুক্ত হবে। জান্নাতীদের না।
এ জন্যই আল্লাহ মানুষকে আদেশ করেছেন দোয়া করতে এবং অন্যান্য উপায়-উপকরণ অবলম্বনের সাথে সাথে তাঁর নিকট সাহায্য চাইতে। আর যারা বলে “আমি কোনো দোয়া করি না, কিছু চাইও না; শুধু তাকদিরের উপর নির্ভর করি” – এরাও ভুলের উপর রয়েছে। কেননা দোয়া করা এবং তাঁর নিকট চাওয়া – এই জিনিসগুলোকে আল্লাহ তাঁর দয়া, ক্ষমা, হেদায়েত, সাহায্য এবং রিযিক অর্জনের মাধ্যম করেছেন। তিনি যদি কোনো বান্দার জন্য দোয়ার মাধ্যমে কল্যাণ অর্জন নির্ধারণ করে থাকেন, তাহলে সে ঐ কল্যাণ দোয়া ছাড়া অর্জন করতে পারবে না। আল্লাহ যে তাকদির নির্ধারণ করেছেন, বান্দাদের অবস্থা সম্পর্কে তিনি যে জ্ঞান রাখেন এবং যেভাবে তাদের জীবনের পরিসমাপ্তি (বা ফলাফল) ঘটবে – এর সবকিছুই নির্ধারিত হয় সেইসব মাধ্যম বা উপকরণের দ্বারা, যেগুলো সুনির্দিষ্ট কোনো ফলাফলের দিকে নিয়ে যায়। এই মাধ্যম বা উপকরণ ব্যতিত পার্থিব জীবন অথবা পরকালে কোনো কিছুই সংঘটিত হয় না। এবং আল্লাহই এইসব মাধ্যম এবং পরিসমাপ্তির স্রষ্টা।
এখানে দুই ধরণের মানুষ বিপথগামী হয়েছে। যারা তাকদিরে বিশ্বাস করেছে, কিন্তু মনে করেছে এই তাকদিরই তাদের অভিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য যথেষ্ট। কাজেই তারা নির্ধারিত মাধ্যম অবলম্বন এবং সৎকর্ম করা থেকে বিরত হয়। এবং শেষমেষ এরা আল্লাহর কিতাব, রাসুলগণ এবং দ্বীন সম্পর্কে অবিশ্বাস করতে শুরু করে দেয়!
অন্য দলটি আল্লাহর নিকট ঠিক সেভাবে প্রতিদান চায় যেভাবে একজন ভাড়া করা শ্রমিক তার নিয়োগদাতার কাছ থেকে মজুরী চায়। তারা শুধুমাত্র নিজ শক্তি, ক্ষমতা এবং কাজের উপরেই নির্ভর করে। যেমনটি মামলুক বা গোলামরা করে থাকে। এরাও অজ্ঞ এবং বিভ্রান্ত। কারণ আল্লাহ নিজের কোনো প্রয়োজনের জন্য বান্দাদেরকে আদেশ করেন না। আর তিনি বান্দাদেরকে যা নিষেধ করেন এগুলোও তাঁর কোনো কার্পণ্য থেকে নয়। তিনি বান্দাদেরকে সেসব জিনিসই আদেশ করেন যা তাদের জন্য মঙ্গলজনক। আর তিনি তাদেরকে সেসব থেকেই নিষেধ করেন যা তাদের জন্য অনিষ্টকর। যেমনটি তিনি বলেছেন, “হে আমার বান্দাগণ! তোমরা কখনোই আমার ক্ষতি করার সামর্থ্য রাখো না যে আমার ক্ষতি করবে আর তোমরা কখনোই আমার ভালো করার ক্ষমতা রাখো না যে আমার ভালো করবে।” ... [সহীহ মুসলিম ২৫৭৭]
যে আল্লাহর আদেশ, নিষেধ, প্রতিশ্রুতি এবং সতর্কবাণী থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় আর শুধুমাত্র তাকদিরের দিকে তাঁকিয়ে থাকে, সে পথভ্রষ্ট হয়েছে। আর যে আদেশ-নিষেধ মেনে চলতে চেষ্টা করেছে এবং তাকদিরকে অগ্রাহ্য করেছে সেও পথভ্রষ্ট হয়েছে। বরং প্রকৃত মুমিন তো এমনই হয় ঠিক যেমনিভাবে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন,
إيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ
অর্থঃ “আমরা শুধু আপনারই ইবাদাত করি এবং শুধু আপনারই সাহায্য প্রার্থনা করি।”
[আল কুরআন, ফাতিহা ১ : ৫]
কাজেই আমরা আল্লাহর আদেশ মেনে শুধু তাঁরই ইবাদাত করবো এবং তাকদিরের উপর ঈমান রেখে শুধু তাঁরই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করবো। ...”
বক্তব্য সমাপ্ত।
[মুক্বতাত্বাফাত মিন মাজমুউল ফাতাওয়া ৮/৬৬ এবং পরবর্তী]
এবং আল্লাহই সর্বোত্তম জানেন।
মূল ফতোয়ার লিঙ্কঃ
আরবিঃ https://islamqa.info/ar/96989/
ইংরেজিঃ https://islamqa.info/en/96989/
এ প্রসঙ্গে আরো পড়ুনঃ
জান্নাতীদের আমল করা কাউকে কি শুধুমাত্র তাকদিরের প্রভাবে জোর করে জাহান্নামী বানিয়ে দেয়া হয়?
কেউ যদি ইসলামের ভুল বার্তা পেয়ে মুসলিম না হয়েই মারা যায় তবে তার কী হবে?
তাকদির আগে থেকে নির্ধারিত হলে মানুষের বিচার হবে কেন? যাদের কাছে ইসলামের দাওয়াহ পৌঁছেনি তাদের কী হবে?
আল্লাহ যদি আগে থেকেই সব কিছু জেনে থাকেন তাহলে কেন মানুষের পরীক্ষা নেন?
যার উপর নূরের আলোকপ্রভা পড়েছে সে সৎপথ পেয়েছে যার উপর পড়েনি সে পথভ্রষ্ট হয়েছে–এই হাদিসের ব্যাখ্যা
যে মেয়েকে জীবন্ত কবর দেওয়া হয় এবং যে কবর দেয় - উভয় কি জাহান্নামী?
পাদটিকাঃ
[1] বিস্তারিত দেখুনঃ "Are We Forced or Do We Have Free Will" -Shaykh Muhammad Ibn Saalih Al Uthaymeen, Page 1-2