স্ববিরোধিতার অভিযোগঃ
দোজখের খাবার কি হবে ? – শুধুই বিষাক্ত কাটাগাছ (Quran 88:6), শুধুই পুঁজ (Quran 69:36) নাকি বিস্বাদ যাকুম ফল (Quran 37:66) !
জবাবঃ
মূলত প্রসঙ্গ ছাড়া উদ্ধৃত করবার ফলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে উল্লেখিত আয়াতগুলোতে স্ববিরোধিতা আছে। কিন্তু প্রসঙ্গসহ পড়লে বোঝা যায় এখানে কোনোই স্ববিরোধিতা নেই।
আল কুরআনে সুরা আস সফফাতে বলা হয়েছেঃ
( 52 ) সে বলত, তুমি কি বিশ্বাস কর যে,
( 53 ) আমরা যখন মরে যাব এবং মাটি ও হাড়ে পরিণত হব, তখনও কি আমরা প্রতিফল প্রাপ্ত হব?
( 54 ) আল্লাহ বলবেন, তোমরা কি তাকে উকি দিয়ে দেখতে চাও?
( 55 ) অপর সে উকি দিয়ে দেখবে এবং তাকে জাহান্নামের মাঝখানে দেখতে পাবে।
( 56 ) সে বলবে, আল্লাহর কসম, তুমি তো আমাকে প্রায় ধ্বংসই করে দিয়েছিলে।
( 57 ) আমার পালনকর্তার অনুগ্রহ না হলে আমিও যে গ্রেফতারকৃতদের সাথেই উপস্থিত হতাম।
( 58 ) এখন আমাদের আর মৃত্যু হবে না।
( 59 ) আমাদের প্রথম মৃত্যু ছাড়া এবং আমরা শাস্তি প্রাপ্তও হব না।
( 60 ) নিশ্চয় এই মহা সাফল্য।
( 61 ) এমন সাফল্যের জন্যে পরিশ্রমীদের পরিশ্রম করা উচিত।
( 62 ) এই কি উত্তম আপ্যায়ন, না যাক্কুম বৃক্ষ?
( 63 ) আমি যালেমদের জন্যে একে বিপদ করেছি।
[আল কুরআন, আস সফফাত ৩৭ : ৫২-৬৩]
মৃত্যুর পরে কবরে মিশে যাবার পরেও আল্লাহ তা’আলা একদিন সবাইকে পুনরায় উত্থিত করে প্রতিফল দান করবেন। এই সত্যকে যেসকল কাফির অস্বীকার করে দম্ভোক্তি করে, পরকালে তাদেরকে জাহান্নামে যাক্কুম বৃক্ষের ফল দ্বারা আপ্যায়ন করা হবে। উপরের আয়াতগুলোতে এটিই উল্লেখ করা হয়েছে। বিষয়টি আরো স্পষ্ট করে উল্লেখ আছে সুরা ওয়াকিয়াহতেঃ
( 46 ) তারা সদাসর্বদা ঘোরতর পাপকর্মে ডুবে থাকত।
( 47 ) তারা বলতঃ আমরা যখন মরে অস্থি ও মৃত্তিকায় পরিণত হয়ে যাব, তখনও কি পুনরুত্থিত হব?
( 48 ) এবং আমাদের পূর্বপুরুষগণও!
( 49 ) বলুনঃ পূর্ববর্তী ও পরবর্তীগণ,
( 50 ) সবাই একত্রিত হবে এক নির্দিষ্ট দিনের নির্দিষ্ট সময়ে।
( 51 ) অতঃপর হে পথভ্রষ্ট, মিথ্যারোপকারীগণ।
( 52 ) তোমরা অবশ্যই ভক্ষণ করবে যাক্কুম বৃক্ষ থেকে,
( 53 ) অতঃপর তা দ্বারা উদর পূর্ণ করবে,
[আল কুরআন, ওয়াকিয়াহ ৫৬ : ৪৬-৫৩]
এ আয়াতগুলো থেকে এটি স্পষ্ট হলো যে, যেসকল কাফির এই জাতীয় কথা বলতোঃ “আমরা যখন মরে যাব এবং মাটি ও হাড়ে পরিণত হব, তখনও কি আমরা প্রতিফল প্রাপ্ত হব?” – কুরআনে তাদের ক্ষেত্রে শাস্তি হিসাবে যাক্কুম বৃক্ষ থেকে ভক্ষণ করানোর কথা বলা আছে। সকল জাহান্নামীর ক্ষেত্রেই যে এই খাদ্য থাকবে বিষয়টি এমন নয়। কুরআনে নির্দিষ্ট অপরাধের জন্য যাক্কুম বৃক্ষ থেকে ভক্ষণ করানোর কথা বলা হয়েছে।
আল কুরআনে সুরা হাককাহতে বলা হয়েছে—
( 33 ) নিশ্চয় সে মহান আল্লাহতে বিশ্বাসী ছিল না।
( 34 ) এবং মিসকীনকে আহার্য দিতে উৎসাহিত করত না।
( 35 ) অতএব, আজকের দিন এখানে তার কোন সুহৃদ নাই।
( 36 ) এবং কোন খাদ্য নাই, ক্ষত-নিঃসৃত পুঁজ ব্যতীত।
[আল কুরআন, হাককাহ ৬৯ : ৩৩-৩৬]
উপরের আয়াতগুলো থেকে বোঝা গেলো যে কাফিরেরা মিসকীনকে আহার্য দিতে উৎসাহিত করত না, তাদের জন্য শাস্তি হিসাবে ক্ষত-নিঃসৃত পুঁজ ব্যতিত খাদ্য থাকবে না। এই ধরণের পাপীদের জন্য শাস্তি এটি।
আল কুরআনে সুরা গাশিয়াহতে বলা হয়েছে—
( 2 ) অনেক মুখমন্ডল সেদিন হবে লাঞ্ছিত,
( 3 ) ক্লিষ্ট, ক্লান্ত।
( 4 ) তারা জ্বলন্ত আগুনে পতিত হবে।
( 5 ) তাদেরকে ফুটন্ত নহর থেকে পান করানো হবে।
( 6 ) কন্টকপূর্ণ ঝাড় ব্যতীত তাদের জন্যে কোন খাদ্য নেই।
( 7 ) এটা তাদেরকে পুষ্ট করবে না এবং ক্ষুধায়ও উপকার করবে না।
[আল কুরআন, গাশিয়াহ ৮৮ : ২-৭]
শুরুতেই দেখা যাচ্ছে বলা হচ্ছেঃ “অনেক মুখমন্ডল সেদিন হবে লাঞ্ছিত”। অর্থাৎ এখানে সকল ব্যক্তি কথা বলা হচ্ছে না বরং কিছু ব্যক্তি কথা বলা হচ্ছে। এখানে কাদের কথা বলা হচ্ছে? এর তাফসিরে সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনু ‘আব্বাস (রা.) বলেন, " عَامِلَةٌ نَّاصِبَةٌ (ক্লিষ্ট-ক্লান্ত) বলে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়কে বোঝানো হয়েছে।” [1]
এ আয়াতগুলোর উদ্যেশ্য হচ্ছে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়। সকল জাহান্নামী নয়। এ মর্মে উমার(রা.) থেকেও একটি ঘটনা বর্ণিত আছে। হাসান বসরী(র.) বর্ণনা করেন, খলিফা উমার ফারুক(রা.) যখন শাম সফর করেন তখন জনৈক খ্রিষ্টান বৃদ্ধ পাদ্ৰী তাঁর কাছ দিয়ে যেতে দেখলেন। সে তাঁর ধর্মীয় ইবাদত সাধনা ও মোজাহাদায় এত বেশি আত্মনিয়োগ করেছিল যে, অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে চেহারা বিকৃত এবং দেহ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। তার পোশাকের মধ্যেও কোন শ্ৰী ছিল না। খলীফা তাকে দেখে অশ্রু সংবরণ করতে পারলেন না। ক্ৰন্দনের কারণ জিজ্ঞাসিত হলে তিনি বললেনঃ এই বৃদ্ধের করুণ অবস্থা দেখে আমি ক্ৰন্দন করতে বাধ্য হয়েছি। বেচারা স্বীয় লক্ষ্য অজর্নের জন্যে জীবনপণ পরিশ্রম ও সাধনা করেছে কিন্তু সে তার লক্ষ্য অজর্নে ব্যর্থ হয়েছে এবং আল্লাহর সন্তুটি অর্জন করতে পারেনি। তারপর তিনি এ আয়াত তিলাওয়াত করলেন। [2]
তাফসির ইবন কাসিরেও অনুরূপ ঘটনা উল্লেখ আছে। সেই সাথে এটিও উল্লেখ আছে, কোনো কোনো মুফাসসির যেমন সাইদ ইবন জুবায়র(র.) এর মতে আলোচ্য আয়াতের কণ্টকপূর্ণ ঝাড় (ضَرِيعٍ) এবং যাক্কুম একই বস্তু। [3]
আল কুরআনের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন অপরাধের জন্য ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীর মানুষকে জাহান্নামে নানা প্রকারের খাদ্য দ্বারা শাস্তি দেবার উল্লেখ আছে। এ প্রসঙ্গে তাফসির কুরতুবীর উদ্ধৃতি দিয়ে তাফসির জাকারিয়াতে উল্লেখ আছেঃ
“কুরআন মজীদে কোথাও বলা হয়েছে, জাহান্নামের অধিবাসীদের খাবার জন্য “যাক্কুম” দেয়া হবে। কোথাও বলা হয়েছে, “গিস্লীন” (ক্ষতস্থান থেকে ঝরে পড়া তরল পদাৰ্থ) ছাড়া তাদের আর কোন খাবার থাকবে না। আর এখানে বলা হচ্ছে, তারা খাবার জন্য কাঁটাওয়ালা শুকনো ঘাস ছাড়া আর কিছুই পাবে না। এ বর্ণনাগুলোর মধ্যে মূলত কোন বৈপরীত্য নেই। এর অর্থ এও হতে পারে যে, জাহান্নামের অনেকগুলো পর্যায় থাকবে। বিভিন্ন অপরাধীকে তাদের অপরাধ অনুযায়ী সেই সব পর্যায়ে রাখা হবে। তাদেরকে বিভিন্ন ধরনের আযাব দেয়া হবে। ...” [4]
অতএব উপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম—
১। যে সকল কাফির মৃত্যু ও কবরের মাটিতে মিশে যাবার পরে পুনরুত্থিত হওয়া এবং প্রতিফল লাভের বিষয়টি অস্বীকার করে বক্তব্য দেয় – তাদেরকে যাক্কুম বৃক্ষ থেকে ভক্ষণ করতে দেয়া হবে।
২। যে কাফিরেরা মিসকীনকে আহার্য দিতে উৎসাহিত করে না, তাদের জন্য শাস্তি হিসাবে ক্ষত-নিঃসৃত পুঁজ খেতে দেয়া হবে।
৩। বাতিল ধর্মের উপর আমল করে ক্লিষ্ট, ক্লান্ত খ্রিষ্টানদেরকে কণ্টকপূর্ণ ঝাড় ভক্ষণ করতে দেয়া হবে। কোনো কোনো মুফাসসিরের মতে এটি আর যাক্কুম একই বস্তু।
মোট কথা কুরআনের আলোচ্য আয়াতগুলোতে ভিন্ন ভিন্ন পাপের জন্য জাহান্নামের বিভিন্ন স্তরে এই বিভিন্ন খাদ্য শাস্তি হিসাবে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। আয়াতগুলোতে সকল জাহান্নামীর কথা একযোগে বলা হয়নি। কাজেই এখানে কোনো স্ববিরোধিতা নেই।
তথ্যসূত্রঃ
[1] সহীহ বুখারী, তাফসির অধ্যায়, হাদিস নং : ৪৫৭৮
https://hadithbd.com/hadith/link/?id=4884
[2] তাফসির মাআরিফুল কুরআন, খণ্ড ৮, পৃষ্ঠা ৭৬২-৭৬৩; সুরা গাশিয়াহর তাফসির,
[3] তাফসির ইবন কাসির (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), খণ্ড ১১, পৃষ্ঠা ৪৮৪; সুরা গাশিয়াহর তাফসির,
[4] তাফসির জাকারিয়া, সুরা গাশিয়াহর ৬ নং আয়াতের তাফসির