স্ববিরোধিতার অভিযোগঃ
কুরআনে মুসা(আ.) এর আগুন দেখা ও আল্লাহর সাথে কথা বলবার ঘটনাটি বিভিন্ন সুরায় বিভিন্নভাবে আছে। যেমন, সুরা কাসাসে (সূরা ২৮:৩০) বলা হয়েছে মুসা নবী সেই ঘটনায় এ আওয়াজ শুনেছেনঃ “হে মূসা! আমি আল্লাহ, বিশ্ব পালনকর্তা। ” আবার সুরা ত্ব-হা’য় (সূরা ২০:১১-১২) বলা হয়েছে, তিনি এই আওয়াজ শুনেছেনঃ “হে মূসা, আমিই তোমার পালনকর্তা, অতএব তুমি জুতা খুলে ফেল, তুমি পবিত্র উপত্যকা তুয়ায় রয়েছ।” আবার সুরা নামলে (সূরা ২৭:৮) বলা হয়েছে তিনি শুনেছেন, “ধন্য তিনি, যিনি আগুনের স্থানে আছেন এবং যারা আগুনের আশেপাশে আছেন। বিশ্ব জাহানের পালনকর্তা আল্লাহ পবিত্র ও মহিমান্বিত। ”
মুসা নবীকে আল্লাহ কোন কথাটা বলেছিলেন?
জবাবঃ
নবী মুসা(আ.) এর আগুন দেখা, আল্লাহ তা’আলার সহিত কথোপকথন ও নবুয়তপ্রাপ্তির মহিমান্বিত ঘটনাটি আল কুরআনের বিভিন্ন সুরায় আলোচিত হয়েছে। যথাঃ
( 8 ) فَلَمَّا جَاءَهَا نُودِيَ أَن بُورِكَ مَن فِي النَّارِ وَمَنْ حَوْلَهَا وَسُبْحَانَ اللَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
( 9 ) يَا مُوسَىٰ إِنَّهُ أَنَا اللَّهُ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ
অতঃপর যখন তিনি আগুনের কাছে আসলেন তখন আওয়াজ হল ধন্য তিনি, যিনি আগুনের স্থানে আছেন এবং যারা আগুনের আশেপাশে আছেন। বিশ্ব জাহানের পালনকর্তা আল্লাহ পবিত্র ও মহিমান্বিত। হে মূসা, আমি আল্লাহ, প্রবল পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।
(আল কুরআন, নামল ২৭:৮-৯)
( 11 ) فَلَمَّا أَتَاهَا نُودِيَ يَا مُوسَىٰ
( 12 ) إِنِّي أَنَا رَبُّكَ فَاخْلَعْ نَعْلَيْكَ ۖ إِنَّكَ بِالْوَادِ الْمُقَدَّسِ طُوًى
( 13 ) وَأَنَا اخْتَرْتُكَ فَاسْتَمِعْ لِمَا يُوحَىٰ
( 14 ) إِنَّنِي أَنَا اللَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدْنِي وَأَقِمِ الصَّلَاةَ لِذِكْرِي
অতঃপর যখন তিনি আগুনের কাছে পৌছলেন, তখন আওয়াজ আসল হে মূসা, আমিই তোমার পালনকর্তা, অতএব তুমি জুতা খুলে ফেল, তুমি পবিত্র উপত্যকা তুয়ায় রয়েছ। এবং আমি তোমাকে মনোনীত করেছি, অতএব যা প্রত্যাদেশ করা হচ্ছে, তা শুনতে থাক। আমিই আল্লাহ আমি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই। অতএব আমার এবাদত কর এবং আমার স্মরণার্থে নামায কায়েম কর।
(আল কুরআন, ত্ব-হা ২০:১১-১৪)
فَلَمَّا أَتَاهَا نُودِيَ مِن شَاطِئِ الْوَادِ الْأَيْمَنِ فِي الْبُقْعَةِ الْمُبَارَكَةِ مِنَ الشَّجَرَةِ أَن يَا مُوسَىٰ إِنِّي أَنَا اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ
যখন সে তার কাছে পৌছল, তখন পবিত্র ভূমিতে অবস্থিত উপত্যকার ডান প্রান্তের বৃক্ষ থেকে তাকে আওয়াজ দেয়া হল, হে মূসা! আমি আল্লাহ, বিশ্ব পালনকর্তা।
(আল কুরআন, কাসাস ২৮:৩০)
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে এই ঘটনায় মুসা(আ.) সে বৃক্ষের আগুনের কাছ থেকে যে আওয়াজ শুনেছেন সে বিষয়ে একেক সুরায় একেক তথ্য আছে বা স্ববিরোধিতা আছে। কিন্তু প্রকৃত বিষয় মোটেও তা নয়। মুসা(আ.)-এর আগুন দেখা এবং সেখান থেকে আগত আওয়াজের স্বরূপ সম্পর্কে তাফসির মাআরিফুল কুরআনে বলা হয়েছে,
“...মুসা (আ)-র এই ঘটনা কোরআন পাকের অনেক সূরায় বিভিন্ন ভঙ্গিতে বর্ণিত হয়েছে। সূরা নামলের আলোচ্য আয়াতসমূহে এ সম্পর্কিত দুইটি বাক্য চিন্তা
সাপেক্ষ—প্রথম بُورِكَ مَن فِي النَّارِ এবং দ্বিতীয় إِنَّهُ أَنَا اللَّهُ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ।
সূরা তোয়াহায় এই ঘটনা সম্পর্কে এরূপ বলা হয়েছে; إِذْ رَأَىٰ نَارًا থেকে
- إِنَّنِي أَنَا اللَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدْنِي - وَأَنَا اخْتَرْتُكَ فَاسْتَمِعْ لِمَا يُوحَىٰ - إِنِّي أَنَا رَبُّكَ فَاخْلَعْ نَعْلَيْكَ ۖ إِنَّكَ بِالْوَادِ الْمُقَدَّسِ طُوًى - نُودِيَ يَا مُوسَىٰ
এসব অয়িতেও দুইটি বাক্য বিশেষভাবে চিন্তা সাপেক্ষ প্রথম إِنِّي أَنَا رَبُّكَ ।
এবং দ্বিতীয় إِنَّنِي أَنَا اللَّهُ ।
সূরা কাসাসে এই ঘটনা সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ
نُودِيَ مِن شَاطِئِ الْوَادِ الْأَيْمَنِ فِي الْبُقْعَةِ الْمُبَارَكَةِ مِنَ الشَّجَرَةِ أَن يَا مُوسَىٰ إِنِّي أَنَا اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ
এই সুরাত্রয়ে বর্ণনাভঙ্গি বিভিন্ন রূপ হলেও বিষয়বস্তু প্রায় একই। তা এই যে, সে রাত্রিতে একাধিক কারণে হযরত মূসা (আ)-র অগ্নি প্রয়োজন ছিল। আল্লাহ তা'আলা তুর পাহাড়ের এক বৃক্ষে তাঁকে অগ্নি দেখালেন। সেই অগ্নি বা বৃক্ষ থেকে এ আওয়াজ শুনা গেল—
- إِنَّنِي أَنَا اللَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا أَنَا - إِنِّي أَنَا اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ - إِنِّي أَنَا رَبُّكَ - إِنَّهُ أَنَا اللَّهُ الْعَزِيزُ الْحَكِيم
এটা সম্ভবপর যে, এই আওয়াজ বারবার হয়েছে—একবার এক শব্দে এবং অন্যবার অন্য শব্দে। ” [1]
এ আলোচনা থেকে বোঝা গেলো যে মুসা(আ.) এর নিকট বিভিন্ন বাক্যের আওয়াজ আসছিলো। আওয়াজটি বিভিন্ন শব্দে হচ্ছিলো। একেক সুরায় একেক আওয়াজের কথা উল্লেখ হয়েছে। আল্লাহ তা’আলা নিজ পরিচয় বলতে গিয়ে পুনর্বার বলেছেনঃ
- إِنَّنِي أَنَا اللَّهُ لَا إِلَٰهَ إِلَّا أَنَا - إِنِّي أَنَا اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ - إِنِّي أَنَا رَبُّكَ - إِنَّهُ أَنَا اللَّهُ الْعَزِيزُ الْحَكِيم
[নিশ্চয় আমিই আল্লাহ আমি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই - আমি আল্লাহ, বিশ্ব পালনকর্তা - আমিই তোমার পালনকর্তা - আমি আল্লাহ, প্রবল পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়]
সেই সাথে আরো কিছু কথা বলেছেন যার বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন সুরায় উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তা’আলার পূর্ণ বক্তব্যকেই বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে কয়েকটি সুরায় তুলে ধরা হয়েছে। একেক সুরায় কাহিনীর একেক অংশকে জোর দেয়া হয়েছে। এখানে মোটেও কোনো স্ববিরোধী তথ্য নেই।
আল কুরআনে মুসা(আ.) ও তাঁর সম্প্রদায়ের কাহিনী বিভিন্ন সুরায় বার বার উল্লেখ প্রসঙ্গে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবন তাইমিয়া(র.) বলেছেন,
“আল্লাহ এই কাহিনীকে কুরআনের বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করেছেন। আর একেক স্থানে তিনি একেক রকমের চিন্তাধারা ও সিদ্ধান্তের দিকে জোর দিয়েছেন। যেমন, আল্লাহ, তাঁর রাসুল(ﷺ) ও তাঁর কিতাবকে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়েছে। একটি নাম দ্বারা এমন একটি অর্থের দিকে ইঙ্গিত করা হয় যা আবার অন্য কোনো নাম দ্বারা করা হয় না। এটা আসলে পুনরাবৃত্তি নয়, বরং একে বলা যেতে পারে বৈচিত্র্য। উদাহরণস্বরূপ, নবী(ﷺ)কে মুহাম্মাদ, আহমাদ, হাশির, আকিব, মুক্বাফফা, দয়ার নবী, তাওবার নবী ইত্যাদি নামে ডাকা হয়। এখানে প্রতিটি নাম এমন একটি অর্থ ইঙ্গিত করে যা অন্য নামের ক্ষেত্রে হয় না। তিনি একই ব্যক্তি, কিন্তু তাঁর বৈশিষ্ট্য অনেক।
একই কথা কুরআনের ক্ষেত্রেও সত্য। যাকে একই সাথে ফুরকান (সত্য-মিত্যার প্রভেদকারী), বায়ান (সুস্পষ্ট বক্তব্য), হুদা (পথনির্দেশ), বাসাইর (সুস্পষ্ট প্রমাণ), শিফা (নিরাময়), নুর (আলো) এবং রাহমাহ (দয়া) বলা হয়। একেকটি নাম এমন একটি অর্থ ইঙ্গিত করে যা অন্য নাম করে না। একই কথা আমাদের প্রতিপালকের নামের ক্ষেত্রেও সত্য। তাঁকে মালিক (অধিপতি), কুদ্দুস (মহাপবিত্র), সালাম (শান্তি / ত্রুটিমুক্ত), মু’মিন (নিরাপত্তা বিধায়ক), মুহাইমিন (রক্ষক), আজিজ (মহাপরাক্রমশালী), জাব্বার (মহাপ্রতাপশালী), মুতাকাব্বির (অতীব মহিমান্বিত), খালিক (সৃষ্টিকর্তা), বারী (সব কিছুর উদ্ভাবক), মুসাওয়ির (আকৃতি দানকারী) ইত্যাদি নামে ডাকা হয়। এখানে প্রতিটি নাম এমন একটি অর্থ ইঙ্গিত করে যা অন্য নামের ক্ষেত্রে হয় না। সারাংশ একই কিন্তু বৈশিষ্ট্য অনেক।
এই কথা (কুরআনের) পূর্ণাঙ্গ বাক্যগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কাহিনীটি এক স্থানে এমনভাবে বর্ণিত হয়েছে যেখানে একটি বিষয়ের দিকে জোর দেয়া হয়েছে। আবার এই একই কাহিনীকে অন্য স্থানে এমনভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যেখানে অন্য একটি বিষয়ের দিকে জোর দেয়া হয়েছে। মূল কাহিনী একই কিন্তু (বিভিন্ন স্থানে) এর বৈশিষ্ট্য অনেক। বাক্যগুলো এক স্থানে এমন একটি অর্থ ইঙ্গিত করে যা অন্য বাক্যের ক্ষেত্রে হয় না। ”
[মাজমু’ আল ফাতাওয়া – ইবন তাইমিয়া ১৯/১৬৭,১৬৮] [2]
উপরের আলোচনা থেকে এটি স্পষ্ট হলো আল কুরআনে নবী মুসা(আ.) এর আগুন দেখা, আল্লাহ তা’আলার সহিত কথোপকথন ও নবুয়তপ্রাপ্তির মহিমান্বিত ঘটনাটিতে কোনো স্ববিরোধী তথ্য নেই। পূর্ণ কাহিনীটির বিভিন্ন অংশ ও বিভিন্ন বক্তব্য একেক সুরায় উল্লেখ করা হয়েছে। এটি তো মহাগ্রন্থ আল কুরআনের অনন্য বৈশিষ্ট্য যে একই কাহিনীর একেকটি দিককে একেক সুরায় জোর দেয়া হয়েছে। ছিদ্রান্বেষীরা এখান থেকে ‘স্ববিরোধিতা’ (!) খুঁজে পেলেও সত্য সন্ধানীরা এখান থেকে খুঁজে পাবে ভাষাগত নৈপুণ্য।
আরো পড়ুনঃ
"কুরআন যদি অসামঞ্জস্যতামুক্তই হয়ে থাকে, তাহলে একই কথার পুনরাবৃত্তি কেন?"
তথ্যসূত্রঃ
[1] তাফসির মাআরিফুল কুরআন, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ৬১৭-৬১৮; সুরা নামলের ৭-১৪ নং আয়াতের তাফসির,
[2] শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া(র.) এর মাজমু’ ফাতাওয়া থেকে আলোচ্য অংশটি দেখুন এই লিঙ্ক থেকেঃ