প্রখ্যাত পরিব্রাজক ও ঐতিহাসিক ইবন যুবাইর(র.) দ্বাদশ শতকে মক্কায় মসজিদুল হারামে কুব্বাতুল ইয়াহুদিয়্যাহ বা ইহুদিদের গম্বুজ স্বচক্ষে দেখেছেন। এবং নিজ ‘রিহলাহ’তে তা উল্লেখ করেছেন। তিনি তাঁর ‘রিহলাহ' গ্রন্থে ১১৮৪ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদুল হারাম ভ্রমণ করে নিচ চোখে দেখা বিবরণ পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে উল্লেখ করেছেন। তিনি সে সময়ের মসজিদুল হারামের বর্ণনায় উল্লেখ করেছেনঃ
“...আব্বাসের গম্বুজ এবং ইহুদিদের গম্বুজ উত্তর দিকে মুখ করে আছে। গম্বুজটির এক পাশের কোণের নাম ইহুদিদের নামে দেয়া হয়েছে যেটি প্রাচীন গৃহের (কা’বা) দিকে মুখ করে আছে। যেটি পূর্বমুখী আব্বাসের দেয়ালের পেছনভাগের বাম কোণা পর্যন্ত পৌঁছে।” [1]
সে সময়ে ইহুদিদের নামে গম্বুজ থাকলেও এখন আর তা নেই। মসজিদুল হারামে ইহুদিদের নামে গম্বুজের নামকরণের অর্থ কী?
নবী করিম (ﷺ) এর শরিয়তে মসজিদুল হারামে ইহুদি বা খ্রিষ্টান কারো প্রবেশের অনুমতি নেই। সন্দেহাতীতভাবে নবী(ﷺ) এর মক্কা বিজয়ের পর কখনো সেখানে ইহুদি বা খ্রিষ্টানরা ইবাদত করেনি। সে সময়ের পরে নতুন করে সেখানে ইহুদিদের নামে গম্বুজ বানানোর প্রশ্নই আসে না। দ্বাদশ শতকে মসজিদুল হারামে ইহুদিদের গম্বুজ থাকার অর্থ হলো সেটা সেখানে প্রাচীনকাল থেকেই ছিলো। অর্থাৎ সুপ্রাচীনকালে ইহুদিরা মক্কায় মসজিদুল হারামে ইবাদত করতে আসতো। যখন তারা নবীদের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়নি। এ কারণে সেখানে তাদের নামে গম্বুজ ছিলো। যেভাবে বিভিন্ন নামে অন্য আরো কিছু প্রসিদ্ধ গম্বুজ ছিলো।
কুরবানী ও হজের মৌসুম এলেই ইসলামবিরোধী ফেসবুকার ও ইউটিউবারদের বলতে শুনবেনঃ কা’বায় কখনো ইহুদিরা ইবাদত করেনি, এটা শুধুই আরব পৌত্তলিকদের বানানো একটা মন্দির। কা’বা যদি ইব্রাহিমই বানাতেন, তাহলে ইহুদিরা অবশ্যই প্রাচীনকালে এখানে আসতো। ইব্রাহিম ও ইসমাঈল মক্কায় এসেছেন এটা শুধুই মুসলিমদের দাবি, Abrahamic অন্য কোনো ট্রেডিশনে এর উল্লেখ নেই। ঐতিহাসিক ইবন যুবাইর(র.) এর নিজ চোখে দেখে উল্লেখ করা বিবরণ তাদের এই দাবিকে অসার প্রমাণ করে।
কা’বায় প্রাচীন নবী-রাসুলরাও এসেছেন এবং হজ করেছেন এ মর্মে অনেক সহীহ হাদিস আছে। [2]
ইমাম তাবারী(র.), ইবন হিশাম(র.) প্রমুখ উল্লেখ করেছেন, মদীনার ইহুদিরা বহু প্রাচীনকালে, নবী(ﷺ) এর জন্মেরও বহু কাল আগে কা’বাকে ইব্রাহিম(আ.) এর নির্মাণ করা আল্লাহর ঘর বলে বিশ্বাস করতো এবং ভক্তি করতো। যদিও তারা সেখানে তাওয়াফ করতো না কেননা কা’বা তখন ছিলো মূর্তিতে ভরপুর। তাঁরা মক্কা থেকে শেষ নবীর আবির্ভাবের ভবিষ্যতবাণী করতো। তাদের দাওয়াতে ইয়েমেনের বাদশাহ তুব্বান ভবিষ্যতে যে শেষ নবী মক্কা থেকে আসবেন তাঁর প্রতি ঈমান আনেন এবং ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি কা’বা ঘরে গিলাফ লাগিয়ে দেন। সেই থেকে কা’বায় গিলাফ লাগানোর সূচনা। [3]
সীরাতুন নবী(সা.)-ইবন হিশাম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), ১ম খণ্ড
সিরাতের বিবরণ থেকে আমরা জানতে পারি, ইহুদিরা অবশ্যই মূর্তি থাকা অবস্থায় কা'বায় ইবাদত করতো না। সেক্ষেত্রে কা'বায় তাদের ইবাদত সংঘটিত হতো সেখানে মূর্তি আমদানীর আগে। যখন সেখানে পূর্ণ ইব্রাহিমি রীতিতে ইবাদত চলতো। অর্থাৎ জাহেলি যুগ সৃষ্টির আগে।
ইহুদিদের একটি ফির্কা [4] সামেরিদের (Samaritans) নিকট তাওরাত ছাড়াও ‘আসাতির’ গ্রন্থটি স্বীকৃত। তাদের নিকট এটি Oral Tradition এর সংকলন। [5] তাদের নিকট এটা অনেকটা ‘হাদিস’ এর মতো। তারা একে Secret Book of Moses বলে। এই গ্রন্থে সরাসরি উল্লেখ আছে,
““And after the death of Abraham, Ishmael reigned twenty seven years. And all the children of Nebaot [ইসমাঈল(আ.) এর পুত্র] ruled for one year in the lifetime of Ishmael, And for thirty years after his death from the river of Egypt to the river Euphrates; and they built Mecca.” ” [6]
অর্থাৎ ইসমাঈল(আ.) এর বংশধরেরা তাঁর জীবদ্দশাতেই রাজত্ব করা শুরু করে। তাঁরা মক্কা নগরী নির্মাণ করেছে।
ঐ বইতেই প্রখ্যাত ইহুদি ঐতিহাসিক যোসেফাস (৩৭ খ্রি.-১০০ খ্রি.) এর উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে:
Josephus I. 12. 3. 221: "These inhabited all the countries from Euphrates to the Red Sea, and called it Nabatene." Gen. 25. 18. Pal.Targ.: "And they dwelled from Hindikia (Indian Ocean) to Palusa (Pelusiumt which is before Egypt as thou goest to Atur (Assyria). In Kebra Ch. 83: many countries are enumerated over which Ishmael ruled. "Built Mecca."
প্রখ্যাত গ্রিক ভূগোলবিদ টলেমির (১০০ খ্রি.-১৭০খ্রি.) উদ্ধৃতি দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে,
Already known to Ptolemy as Makoraba. Pitron has preserved the original reading באכה (ibid) Which they read Baka and took it to meana local name. Hence מכה (Maka/Makkah)into which it was afterwards changed. [7]
অর্থাৎ যোসেফাস এর মতে ইসমায়েলীয়রা মক্কা নির্মাণ করেছিল। টলেমির কাছে নগরটি ‘মাকোরাবা’ নামে পরিচিত ছিল। এই নগরীর একটি স্থানীয় নাম ছিল ‘বাকা’(বাক্কা)।
বিকৃত হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও আহলে কিতাবদের নানা গ্রন্থ এখনো ইসলামের পক্ষে সাক্ষ্য দেয় এবং ইসলামবিরোধীদের নানা তত্ত্বকে অসার প্রমাণ করে।
তথ্যসূত্রঃ
[1] রিহলাহ – ইবন যুবাইর, পৃষ্ঠা ৫৯
[2] এ সংক্রান্ত হাদিসগুলো বিস্তারিত দেখুন এখান থেকেঃ
“Is it proven that all the Prophets (peace be upon them) performed Hajj to the Ka‘bah?” –islamQA(Shaykh Muhammad Saalih al-Munajjid)
https://islamqa.info/en/200581
[3] সীরাতুন নবী(সা.)-ইবন হিশাম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৪-৫৭ .
[4] তারা যদিও নিজেদেরকে ইহুদিদের সাথে নিজেদের সংশ্লিষ্ট করে না। তারা নিজেদেরকে বনী ইস্রাঈলের সত্য ধর্মের অনুসারী দাবি করে। তারা নিজেদেরকে ইস্রাঈলী সামেরি বা Israelite Samaritan বলে।
[5] “The Asatir - Wikipedia”
https://en.wikipedia.org/wiki/The_Asatir
[6] The Asatir – The Samaritan Book of The “Secret of Moses; page 262
[7] প্রাগুক্ত