বিদেশি নাস্তিক এবং খ্রিষ্টান ইভানজেলিস্টদের দেখা যায় আল কুরআনের সংরক্ষণ ও অবিকৃত থাকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে প্রচুর ভিডিও বানায়। কুরআনের নাকি কোন কোন প্রাচীন পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেছে যার কিছু অংশ নাকি এখনকার কুরআন থেকে ভিন্ন! ওরিয়েন্টালিস্টদের নানা রকম বইপত্রে পড়ে প্রভাবিত কোনো কোনো পশ্চিমা দাঈ থেকেও কখনো কখনো এ প্রসঙ্গে বিভ্রান্তিকর বক্তব্য পাওয়া যায়। ইসলামবিরোধীরা এর সদ্বব্যবহার করতে কসুর করে না। দেশিয় ইসলামবিরোধীদেরকেও এদের মুখের ঝাল খেতে দেখা যায়।
প্রথমেই বলে নিইঃ আপনার হাতে থাকা কুরআনের কপিটি থেকে ভিন্ন প্রাচীন কুরআনের পাণ্ডুলিপি (Manuscripts) পাওয়া খুবই সম্ভব এবং খুবই স্বাভাবিক একটি ব্যাপার। এতে বিচলিত হবার কিছুই নেই। এতে কুরআনের সংরক্ষণ মোটেই প্রশ্নবিদ্ধ হয় না।
অবাক হচ্ছেন?
অবাক হবার কিছুই নেই।
আল কুরআনের নাজিল সম্পর্কে বিস্তারিত ইতিহাস জানা থাকলে মুসলিম উম্মাহর কেউ এটা নিয়ে বিচলিত হতো না। আল কুরআনকে আল্লাহ তা'আলা ৭টি হারফ (বহুবচনে আহরুফ) বা ধরণে নাজিল করেছেন। প্রথম প্রথম কুরআন নাজিল শুরু হয়েছিলো ১টি হারফে। রাসুল(ﷺ) তাঁর উম্মাহর সহজ করার জন্য এবং ইসলাম প্রচারের সুবিধার্থে আল্লাহ তা'আলার নিকট আরো হারফে কুরআন নাজিলের অনুরোধ করলে আল্লাহ তা'আলা সর্বমোট ৭টি আরবি আহরুফে কুরআন নাজিল করেন। এ প্রসঙ্গে হাদিসের অনেক বিবরণ রয়েছে। [1] এই ৭টি আহরুফের মাঝে আছে ইসম, ফি’ল, ই’রাব, শব্দের কম-বেশি হওয়া, তাকদিম-তা’খির, বদল এবং উচ্চারণের সুর-ভঙ্গী সংক্রান্ত বিভিন্নতা। [2] এই ৭টি আহরুফ বা ধরণের জন্য ভিন্ন ভিন্ন শব্দের কিরাত বা পঠনপদ্ধতি এসেছিলো, যার ফলে অনেক বাক্যও ভিন্ন হয়ে গিয়েছিলো। এতে ভিন্ন শব্দ থাকলেও অর্থ ভিন্ন হয় না অথবা অর্থ কিছুটা ভিন্ন হলেও সাংঘর্ষিক বা বিপরীত কিছু হয় না। আহরুফগুলোর জন্য কুরআনকে অনেক রকম কিরাত বা পঠনপদ্ধতিতে পড়া যেতো। এই সকল আহরুফ এবং কিরাতের জ্ঞান সাহাবীদের মাঝে ছিলো।
রাসুল(ﷺ) এর ওফাতের পরে আবু বকর(রা.) সমগ্র কুরআন একত্রে লিখিতভাবে সংকলনের ব্যবস্থা করেন। আস্তে আস্তে ইসলামী খিলাফাহ তৎকালীন পরিচিত পৃথিবীর প্রায় অর্ধেকটা অংশে ছড়িয়ে যায়। বিভিন্ন অঞ্চলে দেখা যায় কুরআন বিভিন্ন কিরাতে পঠন হচ্ছে। সব আহরুফ ও কিরাতের ব্যাপারে সকলের সম্যক ধারণা ছিলো না। ফলে উসমান(রা.) এর সময়ে দেখা গেলো একে অন্যের সম্পূর্ণ সঠিক তিলাওয়াতকেও ভুল বলে সাব্যস্ত করতে শুরু করলো। অনারবরা তো বটেই - এমনকি আরবিভাষীদের মধ্যেও এ ব্যাপারে বিভ্রান্তি দেখা গেলো। কারণ সবাই তো সব কিরাত জানতো না। আবার অনেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কুরআন লিপিবদ্ধ করছিলো। লিখবার সময়ে কুরআনে কিছু জায়গায় ভুল হচ্ছিলো, কেউ কেউ এর মধ্যে নোট করে ব্যাখ্যাও লিখছিলো সেগুলোও মূল কুরআনের সাথে মিশ্রিত হবার আশঙ্কা দেখা দিলো। এহেন পরিস্থিতিতে উসমান(রা.) মদীনার সাহাবীদের সাথে পরামর্শ করলেন। সকলে ইজমা বা ঐক্যমতে উপনিত হলেন এবং সে অনুযায়ী কুরআন সংকলন ও সংরক্ষণে কিছু পদক্ষেপ নিলেনঃ
১।
কুরআনের ব্যাপারে আলেম সাহাবীদের দ্বারা আবু বকর(রা.) এর সময়ে সংকলিত সহিফার সাহায্যে কুরআনের কিছু মুসহাফ [3] তৈরি করা হবে।
২।
এই মুসহাফগুলোকে ইসলামী সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরণ করা হবে। সাহাবীদের সম্মিলিতভাবে প্রস্তুতকৃত সেই মুসহাফ থেকে কপি করে সকলে নির্ভুল মুসহাফ তৈরি করবে।
৩।
ব্যক্তিগত উদ্যোগে কুরআনের যেসব কপি তৈরি করা হয়েছিলো এর সবগুলোকে আলেম সাহাবীদের দ্বারা যাচাই করা অসম্ভব ছিলো। কাজেই এর কোনোটির মধ্যে কোন জায়গায় ভুল ছিলো তা সূক্ষ্মভাবে যাচাই কোনোক্রমেই সম্ভব ছিলো না। এসব কপিতে সামান্যতম ভুলও যদি রয়ে যায়, তবে তা পরবর্তীকালের জন্য ভয়াবহ সমস্যা তৈরি করবে। কাজেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে তৈরি সকল কপি পুড়িয়ে দেবার সিদ্ধান্ত হলো। তবে পোড়াবার পূর্বে পৃষ্ঠাগুলো ধুয়ে নেয়া হয়েছিলো। [4]
কুরআন সংরক্ষণের গৃহিত এই ব্যবস্থা সকল সাহাবীর ঐক্যমতের ভিত্তিতে ছিলো। তবে মদীনা থেকে দূরে অবস্থানরত কোনো কোনো সাহাবী যেমন আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ(রা.) এই ব্যবস্থার সকল দিক সম্পর্কে অবহিত না থাকায় নেক নিয়তেই প্রথম প্রথম এর বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে সকল দিক অবহিত হয়ে তাঁরাও এ ব্যাপারে একমত হয়ে যান বলে বিবরণ রয়েছে। অর্থাৎ কুরআন সংকলনের এই ব্যাবস্থা সকল সাহাবীর ইজমার উপরে প্রতিষ্ঠিত ছিলো।
এভাবে সাহাবীগণ ইজমায় উপনিত হয়ে আল কুরআন সংকলন করেন। সাহাবীরা ব্যাপক যাচাই করে নির্ভুল অনেকগুলো কপি তৈরি করেন। সেই কপিগুলো মুসলিম উম্মাহর বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরণ করা হয়। সেই কপিগুলো দিয়ে ইসলামী খিলাফাহর বিভিন্ন প্রদেশে কুরআনের অজস্র কপি তৈরি করা হয়। আমরা আজকে যে কুরআন পড়ি তা সেই উসমানী মুসহাফের কপিগুলোরই উত্তরাধিকার। এটাই হুবহু সেই কুরআন যা রাসুল(ﷺ) উম্মাহর জন্য রেখে গিয়েছিলেন। এই কুরআনকে বিভিন্ন পঠন পদ্ধতি বা কিরাতে পড়া যায় যা ইতিমধ্যেই আলোচনা করা হয়েছে। বিভিন্ন ইমাম সহীহ ও মুতাওয়াতির সনদে এই কিরাতগুলো বর্ণনা করেছেন, সেই বর্ণনাকারী ইমামদের নামানুসারে কিরাতগুলোকে চিহ্নিত করা হয়। যেমনঃ হাফস, ওয়ারশ, ক্বালুন ইত্যাদি। এই পঠন পদ্ধতিগুলো সাহাবীদের আমল থেকেই প্রচলিত ছিলো। এখনও আছে। বিশ্বের বেশিরভাগ জায়গাতে হাফস কিরাতটিই পড়া হয়। তবে অন্য কিরাতগুলোও স্বল্প আকারে প্রচলিত আছে।
কুরআন সংকলনের ইতিহাস এবং এর বিভিন্ন আহরুফ-কিরাতের ব্যাপারে বিশাল আলোচনা অতি সংক্ষেপে ও সহজে উপস্থাপনের চেষ্টা করলাম। আশা করি বিষয়টি সকলের বুঝে এসেছে। বর্তমান সময়ে আমাদের হাতে থাকা কোনো একটি কুরআনের কপি থেকে ভিন্ন টেক্সটযুক্ত প্রাচীন কুরআনের পাণ্ডুলিপি আবিষ্কার হবার পেছনে যে কারণ থাকতে পারেঃ
১। হয়তো সেটি আমাদের হাতে থাকা কুরআনের চেয়ে ভিন্ন কিরাতের কোনো কপি যাতে ভিন্ন শব্দ আছে
২। অথবা সেটি হয়তো প্রাচীনকালে ব্যক্তিগত উদ্যোগে লিপিবদ্ধ করা কোনো মুসহাফ যাতে লিপিকার কিছু জায়গায় ভুল করেছেন
কাজেই এই সকল পাণ্ডুলিপি মোটেও কুরআনের সংরক্ষিত থাকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে না। কুরআনের বিভিন্ন আহরুফের কথা সহীহ সনদেই বর্ণিত আছে, আমাদের প্রাচীন উলামারা বারংবার এগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন এবং সেই একই উলামারাই কুরআন অবিকৃতভাবে সংরক্ষিত থাকবার কথা উল্লেখ করেছেন। সমস্যা হলো বর্তমান যুগে মুসলিম উম্মাহর সিংহভাগ লোকই কুরআন সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞানচর্চা করে না। ফলে তারা কুরআন সংকলনের ইতিহাস এবং এর বিভিন্ন আহরুফ-কিরাতের ব্যাপারে অজ্ঞ। তারা যখন ইসলামবিরোধীদের থেকে ভিন্ন শব্দ বা বাক্যের প্রাচীন কুরআনের পাণ্ডুলিপির কথা শোনে তখন বেশ ঘাবড়ে যায়। মূলত এখানে ঘাবড়াবার কিছুই নেই। ইসলামবিরোধীরা অতি কৌশলে প্রথম দিকে উসমানী মুসহাফের ব্যাপারে আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ(রা.) এর আপত্তি সংক্রান্ত বিবরণগুলো উল্লেখ করে বোঝাতে চায় সাহাবীদের মধ্যে বুঝি কুরআন সংকলন নিয়ে ব্যাপক মতবিরোধ (!) ছিলো। আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ(রা.) স্বয়ং যে পরবর্তীকালে উসমানী মুসহাফের ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেছিলেন ঐ বিবরণগুলোকে ইসলামবিরোধীরা বেমালুম চেপে যায়।
এতোক্ষণ যে আলোচনা করলাম এতে জটিলতা পরিহারের জন্য খুব বেশি রেফারেন্স উল্লেখ করিনি। আগ্রহীরা রেফারেন্স সহকারে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে নিচের বই/আর্টিকেলগুলো পড়তে পারেন এবং ভিডিওগুলো দেখতে পারেনঃ
■ ‘উলুমুল কুরআন’ – মুফতি তাকি উসমানী (মাকতাবাতুল হারামাইন প্রকাশনী)
https://drive.google.com/file/d/1oqlrW7caowNTvCuKHHm7AlJg13d1HMce/view
অথবা
‘An Approach To The Quranic Sciences’ By Mufti Taqi Usmani
■ The revelation of the Qur’aan in seven styles (ahruf, sing. harf) (IslamQA)
■ Who wrote the Qur’aan and how was it put together? (IslamQA)
■ The seven modes of recitation are mutawaatir and it is not permissible to cast aspersions on them (IslamQA)
http://www.islamqa.info/en/178120
অথবা https://archive.is/wip/NWyjN
■ সাত ক্বারী চৌদ্দ রাবী : একটি আলোচনা - মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক (মাসিক আল কাউসার)
www.alkawsar.com/bn/article/2597/
অথবা https://archive.is/wip/KHQXb
■ Versions Of The Qur'an? - Islamic Awarness
www.islamic-awareness.org/quran/text/qiraat/hafs.html
■ The Qirā'āt Identified In The Qur'ānic Manuscripts - Islamic Awarness
https://www.islamic-awareness.org/quran/text/mss/qirmans
■ The Qur'anic Manuscripts - Islamic Awarness
www.islamic-awareness.org/quran/text/mss/
■ ইসলামবিরোধীদের জবাব - Response To Anti-Islam
দেখুনঃ
"কুরআনের বিভিন্ন কিরাত এবং আহরুফ কি কুরআনের ভিন্ন ভিন্ন ভার্সন?_শায়খ আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া"
"Is the Quran Preserved? Reading a Quran from the Prophet's Time - Adnan Rashid"
তথ্যসূত্র
[1] আবু হুরাইরা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ(ﷺ) বলেন, “কুরআন ৭ আহরুফে নাযিল হয়েছে। কুরআন নিয়ে ঝগড়া করা কুফরী।” তিনবার কথাটা বললেন। তারপর যোগ করলেন, “তোমরা এর মধ্যে যা জানবে, তার উপর আমল করবে, আর যা জানবে না, সে ব্যাপারে এ সম্পর্কে বিজ্ঞ ব্যক্তির কাছে ফিরে যাবে।”
[আবু দাউদ (৪৬০৩)।]
আমর ইবনুল আস (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, “কুরআন ৭ আহরুফে নাযিল হয়েছে। যে হারফে তোমরা পড়বে, সেটাই ঠিক হবে। তাই এটা নিয়ে ঝগড়া করো না। কারণ কুরআন নিয়ে ঝগড়া করা কুফরী।” আমর ইবনুল আস (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, “কুরআন ৭ আহরুফে নাযিল হয়েছে। যে হারফে তোমরা পড়বে, সেটাই ঠিক হবে। তাই এটা নিয়ে ঝগড়া করো না। কারণ কুরআন নিয়ে ঝগড়া করা কুফরী।”
[মুসনাদ আহমাদ (১৭৮১৯)]
উবাই (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ(ﷺ) ‘আহজারুল মিরা’ নামক স্থানে জিব্রাঈলের(আ.) সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাকে তিনি বলেন, “আমি এক নিরক্ষর জাতির কাছে প্রেরিত হয়েছি। তাদের মাঝে আছে গোলাম, খাদেম, বয়স্ক ও বৃদ্ধ মানুষ।” জিব্রাঈল(আ.) বললেন, ‘তাহলে তারা ৭টি হারফে কুরআন পড়ুক।’
[তাফসীরুত ত্বাবারী (২৯)]
ইবন আব্বাস (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, “জিব্রাঈল(আ.) আমাকে ১ হারফে পড়ালেন। পরে আমি তার সাথে বিষয়টা নিয়ে পুনরায় কথা বললাম। আমি তাকে বাড়াতে বলছিলাম আর তিনি বাড়িয়ে দিচ্ছিলেন। অবশেষে ৭ হারফে গিয়ে থামলাম।”
[বুখারী (৪১৯৯), মুসলিম (৮১৯)।]
[2] আহরুফের ব্যাপারে বেশ কিছু অভিমত রয়েছে। এখানে এ সংক্রান্ত সব থেকে শক্তিশালী মতটি উল্লেখ করা হয়েছে। বিস্তারিত জানতে দেখুনঃ
‘উলুমুল কুরআন’ – মুফতি তাকি উসমানী (মাকতাবাতুল হারামাইন প্রকাশনী), পৃষ্ঠা ১১৭-১২৮
[3] অর্থাৎ একই মলাটের মাঝে সম্পূর্ণ কিতাব আকারে
[4] ইবনু হাজার, ফাতহ, ৮:৬৮২