অভিযোগঃ
একজন মুসলিমের জন্য রোজা ফরজ করা হয়েছে (Quran 2:183, 2:184, 2:187, Sahih Bukhari 1:2:7, 6:60:40 Sahih Muslim 1:9) যা সূর্য উদয়-অস্তের সাথে সম্পর্কিত (24 hour cycle)! কিন্তু আল্লাহ্ উত্তর এবং দক্ষিণ মেরুর বাসিন্দাদের ব্যাপারে কিছু ভেবে দেখেন নি! আপনার কি মনে হয় না যে এটা তখনই সম্ভব যখন তিনি মনে করবেন পৃথিবীর সর্বত্র একই সময়ে দিন-রাত্রি ঘটে (অর্থাৎ পৃথিবী সমতল)?
একই জাতীয় প্রশ্ন:
কুরআন বলে যে একজন মুসলিমকে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোজা পালন করতে হবে (Quran 2:187)! আবার প্রার্থনার ব্যাপারটাও সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের সাথে সম্পর্কিত (Quran 17:78)! কিন্তু সমগ্র মানুষের এই জীবন বিধানে Eskimo-দের ব্যাপারে কোন নির্দেশনা নেই! এটা কি কুরআন রচয়িতার অজ্ঞতা নয়?
একই জাতীয় প্রশ্ন:
মেরুর বাসিন্দারা নামায পড়বে কিভাবে যেহেতু সেখানে ৬ মাস পর পর দিন-রাতের পরিবর্তন হয়?
উত্তর:
নাস্তিকদের করা খুবই বিখ্যাত প্রশ্নগুলোর মধ্যে এটি একটি। এই প্রশ্নের উদ্ভাবক Wikiislam খুব চমৎকারভাবে(!) ‘Ramadan Pole Paradox’ শিরোনামের লেখা দিয়ে বহু মানুষকে অত্যন্ত সফলতার সাথে বিভ্রান্ত করেছে। আজকে উপরিউক্ত প্রশ্নের সাথে তাদের এই প্যারাডক্সেরও সমাধান করা হবে ইন শা আল্লাহ্। তাহলে চলুন একেক করে তাদের দাবিগুলো খণ্ডন করি।
দাবি ১:
মুসলিমরা রোজা রাখে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত, অথচ মেরুতে ৬ মাস পর পর দিন-রাত্রির পরিবর্তন হয়। তাই মেরুতে রোজা রাখতে গেলে তো মুসলিমরা না খেয়েই মারা যাবে!
খণ্ডন:
গোটা পৃথিবীতে মানুষ আছে প্রায় ৮০০ কোটি। [1] সেখানে উত্তর আর দক্ষিণ মেরু মিলিয়ে মানুষের সংখ্যা কত? সংখ্যাটা পাঁচ অঙ্ক পার হয় না। উত্তর মেরুতে প্রকৃত পক্ষে কোন মানুষই বাস করে না। না, ভাই! Eskimo বা Inuit-রা উত্তর মেরুতে না, উত্তর মেরুর কাছাকাছি বাস করে।[2] আর দক্ষিণ মেরুতেও কোন স্থায়ী বাসিন্দা নেই। এখানে দুই ধরনের মানুষ আসে- গবেষক এবং পর্যটক। গ্রীষ্মকালে জনসংখ্যা থাকে ৪০০০, শীতকালে যেটা এসে দাঁড়ায় মাত্র ১০০০-এ। [3] এখন আপনার কি মনে হয় এত বিশাল জনসংখ্যার হিসেবে তাদের কথা আলাদাভাবে বলা খুব গুরুত্বপূর্ণ? এবার দাজ্জাল সংক্রান্ত একটা বড় হাদিসের কিছু অংশ উল্লেখ করছি।
“… আমরা জিজ্ঞেস করলাম, ‘হে আল্লাহ্র রাসূল! যে দিনটি এক বছরের সমান হবে তাতে একদিনের নামাজ পড়লেই কি তা আমাদের জন্য যথেষ্ট হবে?’ তিনি বললেন, ‘তোমরা সে দিনের সঠিক অনুমান করে নিবে এবং তদনুযায়ী নামাজ পড়বে (দিন রাতের ২৪ ঘণ্টা হিসেবে)।’” [4]
ইসলামি স্কলারগণ এই হাদিসের উপর ভিত্তি দুইটি ব্যাপারে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। প্রথমত, নামাজের ব্যাপারে— এখানে স্পষ্টভাবেই নির্দেশ দেয়া আছে মেরুতে কিভাবে নামাজ পড়তে হবে। দ্বিতীয়ত, রোজার ব্যাপারে— যেহেতু, নামাজের মতো রোজাও সূর্য উদয়-অস্তের সাথে সম্পর্কিত, তাই এই হাদিসে নিশ্চিতভাবেই আমাদের জন্য পথনির্দেশ রয়েছে।
যদি কোন মুসলিম মেরুতে থাকা অবস্থায় রমযান পায়, তাহলে সে নিকটবর্তী কোন দেশ, যে দেশে দিন এবং রাতের পার্থক্য করা যায়- সেই দেশের সময়সূচী অনুসরণ করে রোজা রাখবে। একইকথা, নামাজের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। [5] [6]
তাই মুসলিমরা মেরুতে রোজা রাখতে পারবে না, এই কুযুক্তি ধোপে টিকলো না।
দাবি ২:
এখানে তারা নরওয়ে, আলাস্কা এবং আইসল্যান্ডের রোজার সময়কাল হিসাব করে দেখিয়েছে যে সেখানে একজন মুসলিমকে প্রায় সারাদিনই রোজা রাখতে হয়!
খণ্ডন:
২০১৭ সালে সবচেয়ে দীর্ঘ রোজার সময়কাল হল ২১ ঘণ্টা, গ্রিনল্যান্ড এবং আইসল্যান্ডে। [7] (২০২১ সালে এটি ১৮ ঘণ্টা) অস্বীকার করছি না যে, এত লম্বা সময় ধরে রোজা রাখা আসলেই কষ্টসাধ্য ব্যাপার, কিন্তু অসম্ভব না। ফিনল্যান্ডের এক মুসলিমের সাক্ষাৎকার দেখুন- তারা কিন্তু ভালোভাবেই সাওম পালন করে আসছে। [8]
আমরা জানি, কোনো নির্দিষ্ট সময়ে পৃথিবীর সর্বত্র দিন-রাত্রি সমান নয়, ঋতু পরিবর্তনও আলাদা। উত্তর গোলার্ধে যখন গ্রীষ্মকাল, দক্ষিণ গোলার্ধে তখন শীতকাল। ২১শে জুন উত্তর গোলার্ধে দীর্ঘতম দিন (ক্ষুদ্রতম রাত), ২২শে ডিসেম্বর ক্ষুদ্রতম দিন (দীর্ঘতম রাত)। দক্ষিণ গোলার্ধে ঠিক তার উল্টো, অর্থাৎ ২১শে জুন ক্ষুদ্রতম দিন এবং ২২শে ডিসেম্বর দীর্ঘতম দিন হয়। তবে মজার ব্যাপার হলো, সারাবছরের গড় হিসাবে পৃথিবীর সর্বত্র দিনরাত্রির পরিমাণ প্রায় সমান।
উদাহরণ হিসেবে আমরা ভিন্ন ভিন্ন গোলার্ধের কয়েকটি শহরের ২০২০ সালের দিনের ব্যাপ্তি দেখবো। ঢাকা দিয়েই শুরু করি। ২১শে জুন ঢাকাতে সূর্যোদয় ৫:১৩ এবং সূর্যাস্ত ৬:৪৭, মোট সময়কাল ১৩ ঘণ্টা ৩৩ মিনিট। ২২শে ডিসেম্বর সূর্যোদয় ৬:৩৭ এবং সূর্যাস্ত ৫:১৬, মোট সময়কাল ১০ ঘণ্টা ৩৮ মিনিট। সারা বছরে দিনের গড় সময় ১২ ঘণ্টা ৬ মিনিট। [9]
একইভাবে লন্ডনের সারাবছরে দিনের গড় সময় ১২ ঘণ্টা ১১ মিনিট, নিউইয়র্কে ১২ ঘণ্টা ৮ মিনিট, কেপটাউনে ১২ ঘণ্টা ৭ মিনিট, নরওয়ের অসলোতে ১২ ঘণ্টা ১৯ মিনিট। আমরা দেখতে পাচ্ছি, পৃথিবীর সব জায়গার দিনের গড় ব্যাপ্তি প্রায় সমান (নিরক্ষরেখায় সামান্য বেশি)। তারমানে পৃথিবীর সব জায়গাতেই একজন ব্যক্তির জীবদ্দশার হিসেবে প্রায় সমান পরিমাণের রোজাই রাখা হচ্ছে। ২০১৭ তে আইসল্যান্ডের যে ব্যক্তি ২০-২১ ঘণ্টা রোজা রেখেছেন, ২০৩০ সালে এসে তিনি রাখবেন ৫-৭ ঘণ্টা রোজা। সেসময় আমরা রোজা রাখবো ১১ ঘণ্টা।
সাওমের মূল উদ্দেশ্য হলো তাকওয়া অর্জন। আল্লাহর কথা স্মরণ করে নিজেকে অন্যায় থেকে দূরে রাখা। আল্লাহ্ বলেছেন-
“হে ঈমানদারগণ! তোমাদের প্রতি রোজা ফরয করা হয়েছে, যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।” [10]
তাই কে কত ঘণ্টা রোজা রাখলো, সেটি মুখ্য বিষয় না। যে বেশি সময় ধরে সাওম পালন করছে আল্লাহ্ তার তাকওয়া দেখবেন। এটা তার জন্য একটা পরীক্ষা। আর কারও পক্ষে যদি এত দীর্ঘ সময়ব্যাপী রমজান মাসে সাওম পালন করা কষ্টকর হয়, তাহলে সে অন্য সময় কাযা আদায় করে নিবে। এই ‘অন্য সময়’ হতে পারে বছরের সব থেকে ছোট দিনগুলো- তাতেও কোন সমস্যা নেই। [11] আল্লাহ্ তো সে ঘোষণাও কুরআনেই দিয়ে দেখেছেন-
“রোজা নির্দিষ্ট কিছু দিন। তাই তোমাদের মধ্যে কেউ যদি অসুস্থ থাকে, বা সফরে থাকে, তাহলে পরে একই সংখ্যক দিন পূরণ করবে। আর যাদের জন্য রোজা রাখা ভীষণ কষ্টের, তাদের জন্য উপায় রয়েছে — তারা একই সংখ্যক দিন একজন গরিব মানুষকে খাওয়াবে। আর যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাড়তি ভালো কাজ করে, সেটা তার জন্যই কল্যাণ হবে। রোজা রাখাটাই তোমাদের জন্যই ভালো, যদি তোমরা জানতে।” [12]
“…আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজটাই চান, তিনি তোমাদের জন্য কঠিনটা চান না।…” [13]
দাবি ৩:
তারপরেও প্রশ্ন থেকে যায়। কেন একজনকে অন্য দেশের সময়সূচী অনুসরণ করতে হবে? এটা তো কোন যৌক্তিক সমাধান হতে পারে না!
খণ্ডন:
এবার আমাদের নাস্তিক-মিশনারি বন্ধুগণদের কাছে ইসলামী সমস্যার সমাধানের জন্য দ্বারস্থ হতে হবে!! যে সমাধান আমাদের রাসূল (সা)-এর হাদিসের আলোকে করা হয়েছে সেখানে তাদের আপত্তি! আচ্ছা ভাই, একটা দেশ কি সবকিছুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ? তার যে সমস্ত জিনিসের ঘাটতি আছে, সে অন্য দেশ থেকে সেটা আমদানি করে পূরণ করে। একইভাবে মেরু অঞ্চলে সময়ের কিছুটা অসুবিধা, তাই নিকটস্থ দেশের সাথে সামঞ্জস্য করে নেয়া।
মেরুর বাসিন্দাদের ব্যাপারে নির্দেশনা না দেয়া থেকে কুরআন পৃথিবীকে সমতল বলছে এই সিদ্ধান্তটা নিতান্তই হাস্যকর। আমি যদি কোনো বক্তৃতায় বলি, ‘আমরা তো সবাই কথা বলতে পারি, নাকি?’ কথাটা কিন্তু ভুল হবে না (যদিও বা পৃথিবীতে অনেক মানুষ আছেন যারা কথা বলতে পারে না)। কারণ কথাটা সাধারণভাবে বলা এবং অধিকাংশ মানুষের বাকশক্তি আছে সেই প্রেক্ষিতে উল্লেখ করা। একইভাবে আল্লাহ্ শুধু সাওম পালনের কিছু নীতিমালার কথা বলেছেন, কোনো জটিলতা করেন নি। কুরআন যে পৃথিবীকে সমতল বলছে না এব্যাপারে বিস্তারিত জানতে পড়ুন- https://goo.gl/WuKkoI
প্রাসঙ্গিক আরও একটি বিষয় উল্লেখ করি। আমরা মুসলিমরা রোজা রাখি হিজরি বর্ষপঞ্জি অর্থাৎ চান্দ্র বছর অনুযায়ী। এটি সৌরবছর থেকে ১১ দিন কম (৩৫৪ দিন)। যদি আমাদের সৌরবছরের কোনো নির্দিষ্ট মাসে রোজা রাখার নির্দেশ দেয়া হত, তাহলে কিছু অঞ্চলের মানুষকে সারাজীবন গ্রীষ্মকাল আবার কিছু অঞ্চলের মানুষকে সারাজীবন শীতকালেই রোজা রাখতে হত। চান্দ্র বছর হিসাব করার কারণে প্রতিবছর এই রমজানের সময়টা ১১ দিন করে এগিয়ে আসে। এতে সুবিধা যেটা হয় একই অঞ্চলের মানুষ ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে সাওম পালনের সুযোগ পায়। এভাবে করে কেউ যদি (একই অঞ্চলে) ৩৩ বছর রোজা রাখে, তাহলে সে সব ঋতুতেই অন্তত একবার রোজা রাখতে পারে, যেটা সৌরবছরে সম্ভব ছিল না।
আশা করি এতক্ষণের আলোচনা থেকে এটি স্পষ্ট যে, মেরু অঞ্চলে মুসলিমদের সালাত এবং সাওম পালনের সময়সূচী নিয়ে কোনো প্রকার বিভ্রান্তি নেই। আল্লাহ্ আমাদের সকলকে সঠিক পথে থাকার তাওফিক দান করুক।
তথ্যসূত্র:
[4] জামে’ তিরমিজি ২২৪০, সুনানে ইবেন মাজাহ ৪০৭৫, হাদিসে কুদসি ১৬২
[8] http://www.independent.co.uk/news/world/europe/ramadan-2017-how-muslims-fast-in-countries-where-the-sun-never-sets-a7070871.html
[10] সূরা আল-বাকারাহ ২:১৮৩
[11] ফাসিঃ মুসনিদ ৮১পৃঃ
[12] সূরা আল-বাকারাহ ২:১৮৪
[13] সূরা আল-বাকারাহ ২:১৮৫