➫ মূলঃ শায়খ মুহাম্মাদ সালিহ আল মুনাজ্জিদ
➫ অনুবাদঃ মুহাম্মাদ মুশফিকুর রহমান মিনার
অনুবাদকের ভূমিকাঃ আল কুরআনে বলা হয়েছে নিকটতম আসমানকে প্রদীপপুঞ্জ দ্বারা সাজানো হয়েছে এবং শয়তানের প্রতি নিক্ষেপের বস্তু বানানো হয়েছে। এই আয়াত দেখিয়ে অনেক ইসলামবিরোধী দাবি করে কুরআনে নাকি বৈজ্ঞানিক ভুল (?) আছে। মহাজাগতিক প্রস্তরখণ্ড পৃথিবীতে আছড়ে পড়ার সময়ে বায়ুমণ্ডলের ঘর্ষণে জ্বলে ওঠে। যা দেখে আপাতদৃষ্টিতে তারা বলে মনে হয়। ইসলামবিরোধীদের দাবি কুরআনে নক্ষত্র আর উল্কাকে মিলিয়ে ফেলা হয়েছে এবং কুরআনের লেখক নাকি জানতেন না যে নক্ষত্র আর উল্কা এক নয় (নাউযুবিল্লাহ)। তাদের এহেন ভ্রান্ত দাবির অন্যতম কারণ হচ্ছে আল কুরআনের ভাষা আরবির ব্যাপারে অজ্ঞতা।
ফতোয়া নং ২৪৩৮৭১: উল্কা এবং বিভিন্ন মহাজাগতিক বস্তুকে আরবিতে ‘নুজুম’ (তারা) এবং ‘কাওয়াকিব’ (জ্যোতিষ্ক) বলা যায়
প্রশ্নঃ
সুরা মুলকের ৫ নং আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেছেন, “আমি নিকটবর্তী আসমানকে প্রদীপপুঞ্জ দ্বারা সুশোভিত করেছি এবং সেগুলোকে শয়তানদের প্রতি নিক্ষেপের বস্তু বানিয়েছি। আর তাদের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছি জ্বলন্ত আগুনের আযাব।” ইবন কাসির(র.) তাঁর তাফসিরে বলেছেন, এখানে উল্কাকে বোঝানো হচ্ছে, এগুলো এর দ্বারাই গঠিত। কিন্তু বিজ্ঞানের কল্যাণে এখন আমরা জানি যে, উল্কার সাথে নক্ষত্রের কোনো সম্পর্কই নেই। আমি জানি বিজ্ঞান দ্বারা কুরআনকে বিবেচনা করা ঠিক নয় কারণ বিজ্ঞান প্রতিনিয়তই পরিবর্তিত হচ্ছে। কিন্তু আমি মনে করি এখানে একটি যৌক্তিক প্রশ্ন আছে। কোনো কিছু সঠিক কিনা তা হয়তো বিজ্ঞান আমাদেরকে ১০০% ক্ষেত্রেই জানাতে পারে না। কিন্তু ১০০% ক্ষেত্রেই বিজ্ঞান আমাদেরকে জানাতে পারে কোনো কিছু ভুল কিনা। যেমনঃ পৃথিবী সমতল নয়। আমরা ১০০% নিশ্চিতভাবে জানি যে এটি সমতল নয় কিন্তু ১০০% নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না পৃথিবী পুরোপুরিভাবে গোল কিনা।
এই ব্যাপারে সঠিক ব্যাখ্যা কী হতে পারে? অমুসলিমরা ইসলামের বিরুদ্ধে যেসব যুক্তি দেখায়, আমি মনে এর মধ্যে এটি খণ্ডন করা সব থেকে কঠিন।
উত্তরঃ
যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর।
আমরা মনে করি এখানে ইসলামের ব্যাপারে সংশয় কিংবা সমালোচনার কোনো ভিত্তি নেই। আর আমরা মনে করি এখানে এই কথা বলাও সঠিক নয় যে, “অমুসলিমরা ইসলামের বিরুদ্ধে যেসব যুক্তি দেখায়, … এটি খণ্ডন করা সব থেকে কঠিন।” এখানে একটা সরল এবং স্পষ্ট ব্যাপার রয়েছে যা নিয়ে কারো তর্ক করার সুযোগ নেই। আর তা হলোঃ আরবি ভাষায় "النجم" (“আন নাজম”; আভিধানিক অর্থঃ নক্ষত্র/তারা) শব্দটি সকল প্রকার জ্যোতিষ্ককে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। কাজেই, কোনো জ্বলন্ত উল্কা ‘নাজম’ হতে পারে, কোনো মহাজাগতিক প্রস্তরখণ্ড ‘নাজম’ হতে পারে, আবার কোনো গ্রহও ‘নাজম’ হতে পারে।
সীমিত অর্থে ‘নাজম’ (বহুবচন 'নুজুম') বিশেষ্যটি দ্বারা সুবিশাল জ্যোতিষ্ককে বোঝানো যেতে পারে যার মহাকাশে নির্দিষ্ট কক্ষপথ আছে, যেগুলো জ্বলছে এবং যেগুলোর নিজস্ব আলো আছে। যেমনঃ সূর্য। আর ‘كوكب’ (কাওকাব) বিশেষ্য (বহুচন 'কাওয়াকিব') দ্বারা কঠিন জ্যোতিষ্ককে বোঝায় যেগুলো জ্বলন্ত নয় (বা নিজস্ব আলো নেই)। যেমনঃ সৌরজগতের গ্রহগুলো। এগুলো আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের পরিভাষা। এই সকল পরিভাষা ব্যবহার মোটেও ভুল কোনো কাজ নয়। এই পরিভাষাগুলোও ভুল নয়। কিন্তু ভুল তখন হয় যখন এই সকল পরবর্তীকালে উদ্ভাবিত পরিভাষা ব্যবহার করে কুরআন কারিমের ভাষাকে বিচার করা হয়। কুরআন কারিমকে (এর নাজিলকালীন) আরবি ভাষার আলোকে বোঝার চেষ্টা করা উচিত। কেননা এই ভাষাতে একে নাজিল করা হয়েছে।
এর সাথে আপত্তিকারীদের অবস্থা তো তাদের মতো, যারা সুরা ইউসুফের ১৯ নং আয়াতের [وَجَاءَتْ سَيَّارَةٌ فَأَرْسَلُوا وَارِدَهُمْ - "সেখানে একটা কাফেলা (سيارة) আসলো। তারা তাদের পানি সংগ্রহকারীকে পাঠালো"] سيارة শব্দের দ্বারা যন্ত্রচালিত সেই যানবাহনকে বোঝে যাতে চড়ে আজকের দিনে মানুষ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণ করে (আধুনিক আরবিতে سيارة শব্দের অর্থ "মোটরগাড়ি")। এরপর কুরআনের 'ভুল' (!) ধরে প্রশ্ন তোলে, "ইউসুফ(আ.) এর যুগে তো মোটরগাড়ি আবিষ্কার হয়নি। তাহলে এই জায়গায় মোটরগাড়ির কথা এলো কী করে?!"
এর জবাবে তাদেরকে যা বলবো - এখানে আমাদেরকে আলোচ্য বিষয় এবং পরিভাষার পার্থক্যের দিকে লক্ষ রাখতে হবে। কুরআন যে সময়কার আরবিতে নাজিল হয়েছে, আমাদেরকে সেটিকে বিবেচনায় রাখতে হবে। আরবি ভাষায় শুধুমাত্র নিজস্ব আলোবিশিষ্ট জ্যোতিষ্ককেই 'নাজম' বলে না। বরং আরবিতে 'নাজম' দ্বারা সুনির্দিষ্ট ও গতিশীল সকল প্রকার জ্যোতিষ্ককেই বোঝাতে পারে যেগুলোর নিজস্ব আলো আছে কিংবা নিজস্ব আলো নেই। কুরআনে এভাবেই শব্দটি ব্যবহার হয়েছে। সুরা মুলকের উল্লেখিত আয়াতে দুই প্রকারের 'নাজম' এর কথা আলোচনা করা হয়েছে। এক প্রকার হচ্ছেঃ মহাকাশকে আলোকিত করা প্রদীপমালা তথা উজ্জ্বল নক্ষত্রমণ্ডলী। অন্য প্রকার হচ্ছেঃ গতিশীল গাড়ির মতো; যেমনঃ সকল প্রকারের গ্রহাণু, জ্বলন্ত উল্কা, গ্রহ ইত্যাদি। আরবরা এর সবগুলোকেই 'নাজম' বলে।
কাজেই এখানে কোনো বৈজ্ঞানিক ভুল নেই। বরং এখানে শব্দের অর্থ এবং প্রয়োগের বৈচিত্র্য রয়েছে।
সুরা মুলকের আলোচ্য আয়াতে ["এবং সেগুলোকে শয়তানদের প্রতি নিক্ষেপের বস্তু বানিয়েছি" (৬৭ : ৫)] এই শব্দের দ্বারা বিভিন্ন প্রকারের 'নাজম'কে বোঝানো হয়েছে। যে কোনো প্রকারের গতিশীল জ্যোতিষ্ককে আরবিতে অনায়াসেই 'নাজম' বলা যায়। কাজেই এই আয়াতে কোনো বৈজ্ঞানিক ভুল নেই।
নিম্নে এ সম্পর্কে কিছু আরবি ভাষাশাস্ত্রের কয়েকজন ইমামের অভিমত উল্লেখ করা হলো। যাঁরা এ ভাষাটির গঠন ও ব্যবহারবিধির ব্যাপারে বড়মাপের পণ্ডিত। ---
আল ফারাহিদি(র.) বলেছেনঃ
যে কোনো প্রকারের 'কাওকাব' (গ্রহ অথবা জ্যোতিষ্ক)কে 'নাজম' বলা যায়। সব গ্রহই 'নুজুম' ('নাজম' এর বহুবচন) এর অন্তর্ভুক্ত।
[আল 'আইন ৬/১৫৪]
ইবন সাইদাহ বলেছেন,
'নাজম' হচ্ছে 'কাওকাব' (كوكب)।
[মুহকাম ওয়াল মুহিত আল আ'যাম ৭/৪৬৯]
ইবন মানজুর বলেছেন,
প্রকৃতপক্ষে 'নাজম' শব্দটি দ্বারা আকাশের যে কোনো প্রকারের 'কাওকাব'কে বোঝায়।
[লিসানুল আরব ১২/৫৭০]
ফাইরুযাবাদী বলেছেন,
'নাজম' মানে 'কাওকাব'।
[কামুস আল মুহিত পৃষ্ঠা ১১৬১]
আয যুবাইদী বলেছেনঃ
'নাজম' শব্দটির লিঙ্গ নেই। একই কথা 'কাওকাব' এর বেলাতেও প্রযোজ্য। এই শব্দ দু'টি একে অন্যের পরিপূরক।
[তাজুল 'উরুস ৪/১৫৭]
(ইসলামপূর্ব) জাহেলী যুগের কবি আমির আল মুহারিবি তাঁর একটি কবিতার মাঝে বলেছেন,
وكنا نجوما كلما انقض كوكب *** بدا زاهر منهن ليس بأقتما
নক্ষত্র (নুজুম) ছিলাম মোরা তারা (কাওকাব) ঝরার কালে,
হারাতো না আলোকধারা অন্ধকারের জালে।
[দেখুনঃ মুনতাহাত ত্বলাব মিন আশআরিল আরাব পৃষ্ঠা ১৩০]
লক্ষ করুন, এখানে 'কাওকাব' শব্দটি কিভাবে ব্যবহৃত হয়েছে ঝরে যাওয়ার ক্ষেত্রে। অর্থাৎ তা দ্রুত ও শক্তিশালীভাবে গতিশীল থাকে।
উপরের আলোচনার প্রমাণস্বরূপ আমরা কুরআন বিশ্লেষণ করে এর থেকে যতো জায়গায় 'নাজম' এবং 'কাওকাব' শব্দগুলো এসেছে সবগুলো উদ্ধৃত করবো। যার ফলে সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হবে যে সেই শব্দগুলো কিভাবে সমার্থকরূপে ব্যবহৃত হয়। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন মহাজাগতিক বস্তু যেমনঃ জ্বলন্ত উল্কা (শিহাব) কিংবা মহাজাগতিক প্রস্তর খণ্ড (নায়াযাক) এগুলোকেও আরবি ভাষায় 'নাজম' ও 'কাওকাব' বলে অভিহীত করা যায়।
وَالنَّجْمِ إِذَا هَوَى
অর্থঃ শপথ নক্ষত্রের, যখন তা অস্ত যায় (বা অদৃশ্য হয়)।
(সুরা নাজম ৫৩ : ১)
وَالسَّمَاءِ وَالطَّارِقِ. وَمَا أَدْرَاكَ مَا الطَّارِقُ. النَّجْمُ الثَّاقِبُ
অর্থঃ শপথ আসমানের ও রাতে আগমনকারীর। তুমি কি জানো যা রাতে আসে তা কী? তা এক দীপ্তিমান নক্ষত্র (নাজমুস সাকিব)।
(সুরা তারিক ৮৬ : ১-৩)
إِنَّا زَيَّنَّا السَّمَاءَ الدُّنْيَا بِزِينَةٍ الْكَوَاكِبِ. وَحِفْظًا مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ مَارِدٍ. لَا يَسَّمَّعُونَ إِلَى الْمَلَإِ الْأَعْلَى
وَيُقْذَفُونَ مِنْ كُلِّ جَانِبٍ. دُحُورًا وَلَهُمْ عَذَابٌ وَاصِبٌ. إِلَّا مَنْ خَطِفَ الْخَطْفَةَ فَأَتْبَعَهُ شِهَابٌ ثَاقِبٌ
অর্থঃ আমি নিকটবর্তী আসমানকে নক্ষত্ররাজির [কাওয়াকিব (কাওকাব এর বহুবচন)] সুষমা দ্বারা সুশোভিত করেছি। আর প্রত্যেক বিদ্রোহী শয়তান থেকে হিফাযত করেছি। তারা ঊর্ধ্বজগতের কিছু শুনতে পারে না, কারণ প্রত্যেক দিক থেকে তাদের দিকে নিক্ষেপ করা হয় (উল্কাপিণ্ড)। (তাদেরকে) তাড়ানোর জন্য। তাদের জন্য আছে বিরামহীন শাস্তি। তবে কেউ সন্তর্পণে কিছু শুনে নিলে তাকে পিছু তাড়া করে জ্বলন্ত উল্কাপিণ্ড (শিহাবুন সাকিব)।
(সুরা আস সফফাত ৩৭ : ৬-১০)
وَلَقَدْ جَعَلْنَا فِي السَّمَاءِ بُرُوجًا وَزَيَّنَّاهَا لِلنَّاظِرِينَ. وَحَفِظْنَاهَا مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ رَجِيمٍ. إِلَّا مَنِ اسْتَرَقَ
السَّمْعَ فَأَتْبَعَهُ شِهَابٌ مُبِينٌ
অর্থঃ আসমানে আমি গ্রহ-নক্ষত্র (বুরুজ) সৃষ্টি করেছি এবং ওকে করেছি সুশোভিত, দর্শকদের জন্য। আর প্রত্যেক অভিশপ্ত শয়তান থেকে সেগুলোকে সুরক্ষিত করে দিয়েছি। কিন্তু কেউ চুরি করে (খবর) শুনতে চাইলে উজ্জ্বল অগ্নিশিখা (শিহাবুম মুবিন) তার পশ্চাদ্ধাবণ করে।
(সুরা হিজর ১৫ : ১৬-১৮)
وَأَنَّا لَمَسْنَا السَّمَاءَ فَوَجَدْنَاهَا مُلِئَتْ حَرَسًا شَدِيدًا وَشُهُبًا. وَأَنَّا كُنَّا نَقْعُدُ مِنْهَا مَقَاعِدَ لِلسَّمْعِ فَمَنْ
يَسْتَمِعِ الْآنَ يَجِدْ لَهُ شِهَابًا رَصَدًا .
অর্থঃ আর নিশ্চয় আমরা আকাশ স্পর্শ করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমরা সেটাকে পেলাম যে, তা কঠোর প্রহরী এবং জ্বলন্ত শিখা (শুহুব) দ্বারা পরিপূর্ণ। আমরা (আগে) সংবাদ শোনার জন্য আকাশের বিভিন্ন ঘাঁটিতে বসতাম, কিন্তু এখন কেউ সংবাদ শুনতে চাইলে তার উপর নিক্ষেপের জন্য সে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডকে (শিহাবার রাসাদা) লুকিয়ে থাকতে দেখে।
(সুরা জিন ৭২ : ৮-৯)
আরো একটি উদাহরণ পাওয়া যায় সহীহ মুসলিমে (হাদিস নং ২২০) হুসাইন ইবন আব্দুর রহমান(র.) এর বর্ণনায়, যিনি বলেনঃ "আমি সাঈদ ইবনু আবদুর রহমানের কাছে উপস্থিত ছিলাম। তখন তিনি প্রশ্ন করলেন,
أَيُّكُمْ رَأَى الْكَوْكَبَ الَّذِي انْقَضَّ الْبَارِحَةَ
গতকাল রাতে যে কাওকাবটি বিচ্যুত হয়েছিল (অথবা তারা খসেছিলো/উল্কাপাত হয়েছিলো) তা তোমরা কেউ দেখছো কি?"
তিনি একে 'কাওকাব' বলেছেন, যদিও এটি গতিশীল এবং ভূমির দিকে পতিত হচ্ছিলো।
কাজেই এটি পরিষ্কার যে, শিহাব (জ্বলন্ত উল্কা) এবং নায়াযাক (মহাজাগতিক প্রস্তর খণ্ড) এগুলোকেও সাধারণভাবে আরবদের ভাষারীতি অনুযায়ী 'কাওকাব' কিংবা 'নাজম' বলে অভিহীত করা যায়।
তবে সব 'কাওকাব' কিংবা 'নাজম'কেই যে 'শিহাব' অথবা 'নায়াযাক' বলে অভিহীত করা যায় তা কিন্তু নয়। এর সমর্থনে সেই আয়াতগুলো দেখানো যায় যেগুলোতে বলা হয়েছে এদেরকে আসমানের শোভা হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে, পথ নির্দেশের এবং মানবজাতির বিভিন্ন কল্যাণের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। এদের সবাইকেই 'নাজম' বা 'কাওকাব' বলা যায়। যেমনঃ
وَعَلَامَاتٍ وَبِالنَّجْمِ هُمْ يَهْتَدُونَ
অর্থঃ আর পথ নির্ণায়ক চিহ্নসমূহও; এবং নক্ষত্রের (নাজম) সাহায্যেও মানুষ পথের নির্দেশ পায়।
(সুরা নাহল ১৬ : ১৬)
وَهُوَ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ النُّجُومَ لِتَهْتَدُوا بِهَا فِي ظُلُمَاتِ الْبَرِّ وَالْبَحْرِ قَدْ فَصَّلْنَا الْآيَاتِ لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ
অর্থঃ আর তিনিই তোমাদের জন্য নক্ষত্ররাজিকে সৃষ্টি করেছেন, যেন তোমরা ওগুলোর সাহায্যে অন্ধকারে পথের সন্ধান পেতে পারো স্থল ভাগে এবং সমুদ্রে। নিশ্চয়ই আমি প্রমাণসমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করে দিয়েছি ঐ সমস্ত লোকের জন্য যারা জ্ঞান রাখে।
(সুরা আন'আম ৬ : ৯৭)
وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ وَالنُّجُومَ مُسَخَّرَاتٍ بِأَمْرِهِ
অর্থঃ সূর্য, চাঁদ ও নক্ষত্ররাজি সবই তাঁর হুকুমের অনুগত।
(সুরা আ'রাফ ৭ : ৫৪)
وَسَخَّرَ لَكُمُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ وَالنُّجُومُ مُسَخَّرَاتٌ بِأَمْرِهِ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَعْقِلُونَ
অর্থঃ তিনিই তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন রাত্রি, দিন, সূর্য এবং চাঁদকে। আর নক্ষত্ররাজিও অধীন হয়েছে তাঁরই আদেশে; অবশ্যই এতে বোধশক্তিসম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে নিদর্শন।
(সুরা নাহল ১৬ : ১২)
أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللَّهَ يَسْجُدُ لَهُ مَنْ فِي السَّمَاوَاتِ وَمَنْ فِي الْأَرْضِ وَالشَّمْسُ وَالْقَمَرُ وَالنُّجُومُ وَالْجِبَالُ وَالشَّجَرُ وَالدَّوَابُّ وَكَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ وَكَثِيرٌ حَقَّ عَلَيْهِ الْعَذَابُ وَمَنْ يُهِنِ اللَّهُ فَمَا لَهُ مِنْ مُكْرِمٍ إِنَّ اللَّهَ يَفْعَلُ مَا يَشَاءُ
অর্থঃ তুমি কি দেখো না যে, আল্লাহকে সিজদাহ করে যা কিছু আছে আকাশমনণ্ডলীতে ও পৃথিবীতে - সূর্য, চাঁদ, নক্ষত্রমণ্ডলী, পবর্তরাজি, বৃক্ষলতা, জীব-জন্তু এবং সিজদাহ করে মানুষের মধ্যে অনেকে? আবার অনেকের প্রতি অবধারিত হয়েছে শাস্তি। আল্লাহ যাকে হেয় করেন তার সম্মানদাতা কেউই নেই। আল্লাহ যা ইচ্ছা তা করেন।
(সুরা হজ ২২ : ১৮)
فَنَظَرَ نَظْرَةً فِي النُّجُومِ
অর্থঃ অতঃপর তারকারাজির দিকে সে একবার তাঁকালো (অর্থাৎ চিন্তা-ভাবনা করলো)।
(সুরা আস সফফাত ৩৭ : ৮৮)
وَمِنَ اللَّيْلِ فَسَبِّحْهُ وَإِدْبَارَ النُّجُومِ
অর্থঃ এবং তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করো রাতে ও তারকার অস্ত গমনের পর।
(সুরা তুর ৫২ : ৪৯)
فَلَا أُقْسِمُ بِمَوَاقِعِ النُّجُوم
অর্থঃ আমি শপথ করছি নক্ষত্ররাজির অস্তাচলের।
(সুরা ওয়াকিয়াহ ৫৬ : ৭৫)
فَإِذَا النُّجُومُ طُمِسَتْ
অর্থঃ যখন নক্ষত্ররাজির আলো নির্বাপিত হবে,
(সুরা মুরসালাত ৭৭ : ৮)
إِذَا الشَّمْسُ كُوِّرَتْ. وَإِذَا النُّجُومُ انْكَدَرَتْ
অর্থঃ সূর্য যখন নিষ্প্রভ হবে, আর নক্ষত্ররাজি যখন পতিত হবে।
(সুরা তাকওয়ির ৮১ : ১-২)
فَلَمَّا جَنَّ عَلَيْهِ اللَّيْلُ رَأَى كَوْكَبًا قَالَ هَذَا رَبِّي فَلَمَّا أَفَلَ قَالَ لَا أُحِبُّ الْآفِلِينَ
অর্থঃ রাতের আঁধার যখন তাকে আচ্ছন্ন করলো তখন সে একটা নক্ষত্র (কাওকাব) দেখতে পেলো, (তখন) বললো, এটাই হচ্ছে আমার প্রতিপালক। কিন্তু যখন তা অস্তমিত হলো, সে বললোঃ যা অস্তমিত হয়ে যায় তার প্রতি আমার কোনো অনুরাগ নেই।
(সুরা আন'আম ৬ : ৭৬)
إِذْ قَالَ يُوسُفُ لِأَبِيهِ يَا أَبَتِ إِنِّي رَأَيْتُ أَحَدَ عَشَرَ كَوْكَبًا وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ رَأَيْتُهُمْ لِي سَاجِدِينَ
অর্থঃ স্মরণ করো, ইউসুফ যখন তাঁর পিতাকে বলেছিল, "হে আব্বাজান! আমি (স্বপ্নে) দেখেছি এগারটি তারকা আর সূর্য ও চন্দ্র; দেখলাম তারা আমাকে সিজদাহ করছে।"
(সুরা ইউসুফ ১২ : ৪)
إِذَا السَّمَاءُ انْفَطَرَتْ. وَإِذَا الْكَوَاكِبُ انْتَثَرَتْ
অর্থঃ যখন আসমান বিদীর্ণ হবে। যখন তারকাগুলো বিক্ষিপ্ত হয়ে (ঝরে) পড়বে।
(সুরা ইনফিতার ৮২ : ১-২)
এর দ্বারা কুরআন কারিমের একজন পাঠকের নিকট এটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে, আরবি ভাষায় 'নাজম' শব্দটি এমনভাবে ব্যবহৃত হয় যে এর দ্বারা মহাকাশের সকল প্রকারের জ্যোতিষ্ককে বোঝায়। আমরা অস্বীকার করছি না যে, কোনো কোনো ভাষাবিদ 'নাজম' এবং 'কাওকাব' শব্দগুলোর মধ্যে কিছু পার্থক্য করেছেন। কিন্তু এই পার্থক্যকরণের মানদণ্ড হচ্ছে এদের আকার, গতিশীলতা এবং অন্যান্য বিষয়াবলি। এর কারণ আধুনিক যুগে আবিষ্কার হওয়া তথ্যগুলো নয়; যেমনঃ এগুলোর নিজস্ব আলো আছে কি নেই। সেই সাথে এটিও বলা যায়ঃ এই পার্থক্যকরণের মানে কোনোভাবেই এই নয় যে, 'নাজম' এবং 'কাওকাব' শব্দদ্বয় দ্বারা গতিশীল জ্যোতিষ্ককে নির্দেশ করা যাবে না।
আল আসকারী(র.) বলেছেনঃ
" 'কাওকাব' দ্বারা বড় আকৃতির নক্ষত্রকে বোঝায়। কোনো কিছুর 'কাওকাব' মানে হচ্ছে এর অধিকাংশ অংশ।
'নাজম' দ্বারা সাধারণভাবে ছোট-বড় সকল প্রকার নক্ষত্রকে বোঝায়। এটা বলা যেতে পারে যে, 'কাওকাব' দ্বারা স্থির জ্যোতিষ্ককে বোঝায়। আর এখান থেকেই বলা হয়ঃ "সোনা ও রূপার নক্ষত্র"। কারণ এগুলো স্থির, কখনো অদৃশ্য হয় না। আর 'নাজম' দ্বারা সেগুলোকে বোঝায় যেগুলো উদয় ও অস্ত যায়।
একারণেই জ্যোতিষীদেরকে আরবিতে 'মুনাজ্জিম' বলে। কারণ তারা নক্ষত্রের উদয় ও অস্তের দিকে লক্ষ রাখে। তাদেরকে 'মুকাওকিব' বলা হয় না।"
[আল ফুরুকুল লুগাওয়িয়্যাহ, পৃষ্ঠা ৩০১]
আমরা আশা করছি এ আলোচনার দ্বারা প্রশ্নকারীর সংশয় খুব সহজ এবং স্পষ্টভাবে নিরসন হয়েছে।
এবং আল্লাহই সর্বোত্তম জ্ঞাত।
মূল ফতোয়ার লিঙ্কঃ
আরবিঃ https://islamqa.info/ar/243871/
ইংরেজিঃ https://islamqa.info/en/243871/