Pray for the world economy

মিরাজের রাতে নবী(ﷺ) এর নিকট কতজন ফেরেশতা এসেছিলেন?

 

ইসলামবিরোধীরা দাবি করে ইসরা-মিরাজ সংক্রান্ত হাদিসগুলোতে ইসরার সূচনায় নবী মুহাম্মাদ() এর নিকট কতজন ফেরেশতা এসেছিলেন সে ব্যাপারে পরস্পরবিরোধিতা আছে। এই দাবির স্বপক্ষে তারা যেসব হাদিস পেশ করে সেগুলো নিম্নরূপ—

 

একজন ফেরেশতাঃ

কিছু হাদিসে এই প্রসঙ্গে একজন ফেরেশতার উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমনঃ

 

أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ " فُرِجَ عَنْ سَقْفِ بَيْتِي وَأَنَا بِمَكَّةَ، فَنَزَلَ جِبْرِيلُ فَفَرَجَ صَدْرِي،

অর্থঃ “…রাসূলুল্লাহ থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেছেনঃ আমার ঘরের ছাদ খুলে দেয়া হল। তখন আমি মক্কায় ছিলাম। তারপর জিবরীল (আঃ) এসে আমার বক্ষ বিদীর্ণ করলেন…” [1]

 

أَنَّ نَبِيَّ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم حَدَّثَهُمْ عَنْ لَيْلَةَ أُسْرِيَ بِهِ " بَيْنَمَا أَنَا فِي الْحَطِيمِ ـ وَرُبَّمَا قَالَ فِي الْحِجْرِ ـ مُضْطَجِعًا، إِذْ أَتَانِي آتٍ فَقَدَّ ـ قَالَ وَسَمِعْتُهُ يَقُولُ فَشَقَّ ـ مَا بَيْنَ هَذِهِ إِلَى هَذِهِ ـ

অর্থঃ "…আল্লাহর নবী কে যে রাতে তাঁকে ভ্রমণ করানো হয়েছে সে রাতের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, একদা আমি কাবা ঘরের হাতিমের অংশে ছিলাম। কখনো কখনো রাবী (কাতাদা) বলেছেন, হিজরে শুয়েছিলাম। হঠাৎ একজন আগন্তুক আমার নিকট এলেন এবং আমার এ স্থান থেকে সে স্থানের মধ্যবর্তী অংশটি চিরে ফেললেন।…"  [2]

 

এই হাদিস দেখিয়ে ইসলামবিরোধীদেরকে এমন অভিযোগও করতে দেখা যায় যে, কিন্তু জিব্রাঈল(আ.)কে নবী() আগে থেকেই চিনে থাকলে এখানে কেন তাঁকে ‘আগন্তুক’ বলা হল। অথচ এটা একটা সাধারণ ভাষাগত ব্যবহার যে অনেক সময় পরিচিত ব্যক্তিকেও ‘আগন্তুক’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এর মানে এই না যে সেই ব্যক্তির ব্যাপারে বর্ণনাকারী জানেন না। ঐ হাদিসেই কিছুক্ষণ পরে ‘আগন্তুক’কে জিব্রাঈল(আ.) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে ‘আগন্তুক’কে না চেনার কোনো ব্যাপারই নেই। এখানে ইসলামবিরোধীরা অনর্থক সংশয় সৃষ্টির চেষ্টা করে। ---

 

ثُمَّ أُوتِيتُ بِدَابَّةٍ دُونَ الْبَغْلِ وَفَوْقَ الْحِمَارِ أَبْيَضَ "‏‏. ـ فَقَالَ لَهُ الْجَارُودُ هُوَ الْبُرَاقُ يَا أَبَا حَمْزَةَ قَالَ أَنَسٌ نَعَمْ، يَضَعُ خَطْوَهُ عِنْدَ أَقْصَى طَرْفِهِ ـ " فَحُمِلْتُ عَلَيْهِ، فَانْطَلَقَ بِي جِبْرِيلُ حَتَّى أَتَى السَّمَاءَ الدُّنْيَا فَاسْتَفْتَحَ، فَقِيلَ مَنْ هَذَا قَالَ جِبْرِيلُ‏.

অর্থঃ "... তারপর সাদা রং এর একটি জন্তু আমার নিকট আনা হল। যা আকারে খচ্চর থেকে ছোট ও গাধা থেকে বড় ছিল? জারূদ তাকে বলেন, হে আবূ হামযা, ইহাই কি বুরাক? আনাস (রাঃ) বললেন, হাঁ। সে একেক কদম রাখে দৃষ্টির শেষ প্রান্তে। আমাকে তার উপর সাওয়ার করানো হল। তারপর আমাকে নিয়ে জিবরীল (আলাইহিস সালাম) চললেন, প্রথম আসমানে নিয়ে এসে দরজা খুলে দিতে বললেন, জিজ্ঞেস করা হল, ইনি কে? তিনি বললেন জিবরীল। আবার জিজ্ঞেস করা হল, আপনার সঙ্গে কে? তিনি বললেন, মুহাম্মাদ ()। আবার জিজ্ঞেস করা হল, তাঁকে কি ডেকে পাঠানো হয়েছে? তিনি বললেন, হাঁ। তখন বলা হল, তার জন্য খোশ-আমদেদ, উত্তম আগমনকারীর আগমন হয়েছে। তারপর আসমানের দরজা খুলে দেওয়া হল।

আমি যখন পোঁছালাম, তখন তথায় আদম (আলাইহিস সালাম) এর সাক্ষাত পেলাম। জিবরীল (আলাইহিস সালাম) বললেন, ইনি আপনার আদি পিতা আদম (আলাইহিস সালাম) তাঁকে সালাম করুন। আমি তাঁকে সালাম দিলাম। তিনি সালামের জবাব দিলেন এবং বললেন, নেক্‌কার পুত্র ও নেক্‌কার নবীর প্রতি খোশ-আমদেদ। তারপর উপরের দিকে চলে দ্বিতীয় আসমানে পৌঁছে দরজা খুলে দিতে বললেন, জিজ্ঞেস করা হল কে? তিনি বললেন জিবরীল। ..."

 

দুইজন ফেরেশতাঃ

ইসলামবিরোধীরা এই প্রসঙ্গে কিছু হাদিস দেখিয়ে দাবি করে যে এগুলো মিরাজ সংক্রান্ত হাদিস এবং এখানে নাকি দুইজন ফেরেশতার উল্লেখ আছে। যেমনঃ

 

قَالَ كَانَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم إِذَا صَلَّى صَلاَةً أَقْبَلَ عَلَيْنَا بِوَجْهِهِ فَقَالَ " مَنْ رَأَى مِنْكُمُ اللَّيْلَةَ رُؤْيَا "‏‏. قَالَ فَإِنْ رَأَى أَحَدٌ قَصَّهَا، فَيَقُولُ مَا شَاءَ اللَّهُ، فَسَأَلَنَا يَوْمًا، فَقَالَ " هَلْ رَأَى أَحَدٌ مِنْكُمْ رُؤْيَا "‏‏. قُلْنَا لاَ‏. قَالَ " لَكِنِّي رَأَيْتُ اللَّيْلَةَ رَجُلَيْنِ أَتَيَانِي فَأَخَذَا بِيَدِي، فَأَخْرَجَانِي إِلَى الأَرْضِ الْمُقَدَّسَةِ،

অর্থঃ "... নবী (ফজর) সালাত (নামায/নামাজ) শেষে আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসতেন এবং জিজ্ঞাসা করতেন, তোমাদের কেউ গত রাতে কোন স্বপ্ন দেখেছ কি? (বর্ণনাকারী) বলেন, কেউ স্বপ্ন দেখে থাকলে তিনি তা বিবৃত করতেন। তিনি তখন আল্লাহর মর্জি মুতাবিক তা’বীর বলতেন। একদিন আমাদেরকে প্রশ্ন করলেন, তোমাদের কেউ কি কোন স্বপ্ন দেখেছ? আমরা বললাম, জী না।

নবী বললেনঃ গত রাতে আমি দেখলাম, দু’জন লোক এসে আমার দু’হাত ধরে আমাকে পবিত্র ভূমির দিকে নিয়ে চললো। ..." [3]

 

কেউ ভালো করে পড়লেই বুঝতে পারবেন যে এখানে আদৌ ইসরা-মিরাজের কথা বলা হয়নি। বরং নবী() এখানে সাহাবী(রা.)দের নিকট স্বপ্নের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছেন। এরপর নিজ স্বপ্নের কথা তাঁদের নিকট ব্যক্ত করেছেন। আর সেই স্বপ্নে তিনি দুইজন ব্যক্তি তথা মানবরূপী দুইজন ফেরেশতাকে দেখেছেন। এই একই হাদিস ‘মিশকাত’ গ্রন্থেও আছে। হাদীস একাডেমী থেকে প্রকাশিত ‘তাহক্বীক মিশকাতুল মাসাবীহ’ মিশকাতের প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘মিরক্বাতুল মাফাতীহ’ এর বরাতে আলোচ্য হাদিসের ব্যাখ্যায় উল্লেখ আছে,

 

অত্র হাদীস দ্বারা জানা যায় যে, রসূলুল্লাহ -এর অভ্যাস ছিল প্রতিদিন ফজরের সালাতের পর সাহাবীদের সংবাদ নেয়া। বিশেষভাবে তাদের স্বপ্নের বিষয়ে খবর শুনতেন। অতঃপর স্বপ্নের ব্যাখ্যা করতেন। রসূল ভালো-মন্দ উভয়টি দেখেছেন আল্লাহ তাআলা রসূল -কে জিবরীল (আ.) এবং মীকাঈল (আ.)-এর সাথে মিথ্যা কথা বলার শাস্তি, যিনা করার শাস্তি ও সুদ খাওয়ার শাস্তি দেখিয়েছেন। কারণ শেষ যামানায় এগুলো অধিক পরিমাণে বৃদ্ধি পারে। এজন্য যে, মানুষ যেন এগুলো থেকে দূরে থাকে। আবার জান্নাতের অবস্থাও দেখিয়েছেন যাতে করে মানুষ আগ্রহের সাথে জান্নাতে যাওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ) [4]

 

শুধু তাই না, ‘মিশকাত’ গ্রন্থে এই হাদিসকে রাখা হয়েছে ‘স্বপ্ন’ (كتاب الرؤيا) শীর্ষক অধ্যায়ে। এখানে এটি স্পষ্ট যে এই হাদিস ইসরা-মিরাজ প্রসঙ্গে না বরং স্বপ্ন প্রসঙ্গে। কিছু কিছু ইসলামবিরোধী এক্টিভিস্ট প্রতারণামূলকভাবে ভিন্ন প্রসঙ্গের হাদিস নিয়ে এসে একে ইসরা-মিরাজের হাদিসে মধ্যকার পরস্পরবিরোধিতা হিসেবে দেখানোর অপচেষ্টা করে।

 

তিনজন ফেরেশতাঃ

কিছু হাদিসে এই প্রসঙ্গে তিনজন ফেরেশতার উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমনঃ

 

يَقُولُ لَيْلَةَ أُسْرِيَ بِرَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مِنْ مَسْجِدِ الْكَعْبَةِ أَنَّهُ جَاءَهُ ثَلاَثَةُ نَفَرٍ قَبْلَ أَنْ يُوحَى إِلَيْهِ وَهْوَ نَائِمٌ فِي الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ، فَقَالَ أَوَّلُهُمْ أَيُّهُمْ هُوَ فَقَالَ أَوْسَطُهُمْ هُوَ خَيْرُهُمْ‏. فَقَالَ آخِرُهُمْ خُذُوا خَيْرَهُمْ‏. فَكَانَتْ تِلْكَ اللَّيْلَةَ، فَلَمْ يَرَهُمْ حَتَّى أَتَوْهُ لَيْلَةً أُخْرَى فِيمَا يَرَى قَلْبُهُ، وَتَنَامُ عَيْنُهُ وَلاَ يَنَامُ قَلْبُهُ وَكَذَلِكَ الأَنْبِيَاءُ تَنَامُ أَعْيُنُهُمْ وَلاَ تَنَامُ قُلُوبُهُمْ، فَلَمْ يُكَلِّمُوهُ حَتَّى احْتَمَلُوهُ فَوَضَعُوهُ عِنْدَ بِئْرِ زَمْزَمَ فَتَوَلاَّهُ مِنْهُمْ جِبْرِيلُ فَشَقَّ جِبْرِيلُ مَا بَيْنَ نَحْرِهِ إِلَى لَبَّتِهِ حَتَّى فَرَغَ مِنْ صَدْرِهِ وَجَوْفِهِ، فَغَسَلَهُ مِنْ مَاءِ زَمْزَمَ بِيَدِهِ،

অর্থঃ "... রাসুলুল্লাহ কে এক রাতে কাবার মসজিদ থেকে সফর করানো হল। বিবরণটি হচ্ছে, নবী এর কাছে এ বিষয়ে ওহী প্রেরণের পুর্বে তার কাছে তিনজন ফেরেশতার একটি জামাআতে আসল। অথচ তখন তিনি মসজিদুল হারামে ঘুমন্ত ছিলেন। এদের প্রথমজন বলল, তিনি কে? মধ্যের জন বলল, তিনি এদের উত্তম ব্যাক্তি। সর্বশেষ জন বলল, তা হলে তাদের উত্তম ব্যাক্তিকেই নিয়ে চল। সে রাতটির ঘটনা এটুকুই। এ জন্য তিনি আর তাদেরকে দেখেননি। অবশেষে তারা অন্য এক রাতে আগমন করলেন যা তিনি অন্তর দ্বারা দেখছিলেন। তার চোখ ঘুমন্ত, অন্তর ঘুমায় না। অনুরূপ অন্য নবীগণেরও চোখ ঘুমিয়ে থাকে, অন্তর ঘুমায় না।

এ রাতে তারা তার সাথে কোন কথা না বলে তাকে উঠিয়ে নিয়ে যমযম কূপের কাছে রাখলেন। জিবরীল (আলাইহিস সালাম) তার সাথীদের থেকে নবী এর দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। জিবরীল (আলাইহিস সালাম) তার গলার নিচ হতে বক্ষস্থল পর্যন্ত ছেদন করলেন এবং তার বক্ষ ও পেট থেকে সবকিছু নেড়েচেড়ে যমযমের পানি দ্বারা নিজ হাতে ধৌত করেন। ..." [5]

 

এই হাদিসে মিরাজের রাতের ঘটনায় স্পষ্টত তিনজন ফেরেশতার উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে। পূর্বে উল্লেখিত মিরাজের হাদিসগুলোতে শুধুমাত্র একজন ফেরেশতা জিব্রাঈল(আ.) এবং তাঁর কর্মের উল্লেখ আছে; যিনি নবী() এর বক্ষ বিদীর্ণ করেছিলেন এবং তাঁকে নিয়ে যাত্রা করেছিলেন। এই হাদিস কি তবে পূর্বের হাদিসগুলোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক?

 

এ প্রসঙ্গে আরেকটি হাদিস দেখলে বোঝা যায় যে এই হাদিসগুলো আদৌ পরস্পরের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। 

 

أَنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ " بَيْنَا أَنَا عِنْدَ الْبَيْتِ بَيْنَ النَّائِمِ وَالْيَقْظَانِ إِذْ أَقْبَلَ أَحَدُ الثَّلاَثَةِ بَيْنَ الرَّجُلَيْنِ فَأُتِيتُ بِطَسْتٍ مِنْ ذَهَبٍ مَلآنَ حِكْمَةً وَإِيمَانًا فَشَقَّ مِنَ النَّحْرِ إِلَى مَرَاقِّ الْبَطْنِ فَغَسَلَ الْقَلْبَ بِمَاءِ زَمْزَمَ ثُمَّ مُلِئَ حِكْمَةً وَإِيمَانًا ثُمَّ أُتِيتُ بِدَابَّةٍ دُونَ الْبَغْلِ وَفَوْقَ الْحِمَارِ ثُمَّ انْطَلَقْتُ مَعَ جِبْرِيلَ عَلَيْهِ السَّلاَمُ فَأَتَيْنَا السَّمَاءَ الدُّنْيَا فَقِيلَ مَنْ هَذَا قَالَ جِبْرِيلُ .

অর্থঃ "... নবী বলেছেনঃ আমি কা’বার নিকট তন্দ্রাচ্ছন্নাবস্থায় ছিলাম। হঠাৎ দেখতে পেলাম, তিনজনের একটি দলের মধ্যবর্তী ব্যাক্তিটি এগিয়ে আসল। আমার নিকট হিকমত ও ঈমানে পরিপূর্ণ একটি স্বর্ণের পাত্র আনা হল। তারপর ঐ ব্যাক্তি আমার সিনার অগ্রভাগ থেকে নাভি পর্যন্ত বিদীর্ণ করলো। তারপর যমযমের পানি দ্বারা ’কল্‌ব’ ধৌত করলো। তারপর হিকমত ও ঈমান দ্বারা তা ভরে দেয়া হল। পরে আমার নিকট আকারে খচ্চরের চেয়ে ছোট এবং গাধার চেয়ে বড় এরূপ একটি জন্তু আনা হল। আমি জিবরীল (আলাইহিস সালাম)-এর সাথে চলতে থাকি। পরে আমরা দুনিয়ার (নিকটবর্তী) আকাশ পর্যন্ত পৌঁছি। তখন বলা হল, কে? জিবরীল (আলাইহিস সালাম) বললেন, (আমি) জিবরীল। ..." [6]

 

এই হাদিসে দেখা যাচ্ছে মোট আগমনকারী ফেরেশতা ছিলেন তিনজন। কিন্তু তাঁদের মধ্যে নবী() এর নিকট এগিয়ে আসেন তাঁদের মধ্যে মধ্যবর্তী ব্যক্তি - অর্থাৎ একজন। এবং সেই একজন ছিলেন জিব্রাঈল(আ.)। তিনিই নবী() এর নিকট এসে তাঁর বক্ষ বিদীর্ণ ও কলব ধৌতকরণ করেন, এরপর তাঁর সঙ্গে যাত্রা করেন। বক্ষ বিদীর্ণকরণ ও মিরাজের যাত্রায় তাঁর সঙ্গে অন্য ফেরেশতারা ছিলেন না, শুধু জিব্রাঈল(আ.)ই ছিলেন। পূর্বের হাদিসগুলোতে বর্ণনাকারীরা জিব্রাঈল(আ.) কর্তৃক নবী() এর নিকট আসার পরের ঘটনা বর্ণনা করেছেন। আর কিছু হাদিসে পূর্ণ ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। ফলে আপাতদৃষ্টিতে হাদিসগুলো পরস্পরবিরোধী মনে হচ্ছে, কিন্তু বাস্তবিক এগুলো পরস্পরবিরোধী নয়।

 

প্রখ্যাত মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ বিন আলি আল আছিয়ুবী(র.) তাঁর সুনান নাসায়ীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ 'দাখিরাতুল উকবা ফি শারহিল মুজতাবা' তে আলোচ্য হাদিসগুলোর ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেছেন,

 

"إذ أقبل أحد الثلاثة بين الرجلين" ورواية البخاري في "المعراج" "إذ أتاني آت" وهو جبريل، كما في رواية له في الصلاة،

فرواية المصنف تفيد أن الذين أقبلوا إليه، وهم الملائكة كانوا ثلاثة، ...

وأما رواية "إذ أتاني آت" فلا تنافي هذا، لأن المراد: الملك الذي أقبل إليه من بين الثلاثة.

অর্থঃ  “{ إِذْ أَقْبَلَ أَحَدُ الثَّلاَثَةِ بَيْنَ الرَّجُلَيْنِ } “তিনজনের একটি দলের মধ্যবর্তী ব্যাক্তিটি এগিয়ে আসল”, এবং বুখারীর ‘মিরাজ’ অংশের বর্ণনা { إِذْ أَتَانِي آتٍ} “হঠাৎ একজন আগন্তুক আমার নিকট এলেন”, আর তিনি ছিলেন জিব্রাঈল(আ.), যেমনটি সলাত অংশের বর্ণনায় উল্লেখ আছে। …

মুসান্নাফের বর্ণনা থেকে এই ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, যারা তাঁর নিকটে এসেছিলেন তাঁরা ছিলেন তিন জন ফেরেশতা।

… { إِذْ أَتَانِي آتٍ} “হঠাৎ একজন আগন্তুক আমার নিকট এলেন” এই বর্ণনা এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। কারণ এর দ্বারা তিন ফেরেশতার মধ্য থেকে সেই ফেরেশতাকে বোঝানো হচ্ছে যিনি তাঁর নিকটে এসেছিলেন।[7]

 

প্রখ্যাত মুহাদ্দিস মুহাম্মাদ মুখতার আশ-শানকিতি(র.) তাঁর সুনান নাসায়ীর ব্যাখ্যাগ্রন্থে উল্লেখ করেছেন,

 

وفي الحديث الأول، والمعنى أن أحد النفر الثلاثة وهم الملائكة الذين أتوه في صورة البشر، وأل في الثلاثة للعهد الحضوري ولم يتقدم ذكر لهم في هذه الرواية، ولعله - صلى الله عليه وسلم - كان قد ذكرهم للصحابة قبل التحديث بالقصة أو أثناءها واختصر ذلك بعض الرواة،  وعلى فرض أنه ذكرهم وأل تكون للعهد الذكري،  وعن مسلم (أحد الثلاثة بين الرجلين) وفيه: فسمعت قائلًا يقول: أحد الثلاثة. . . إلخ. وفيه: من رواية أبي ذر: فرج سقف بيتي وأنا بمكة، وكذا من رواية أبي ذر عند البخاري: فنزل جبريل، فيحتمل أنه المراد بقوله بين الرجلين جواب الملك لأحد الملائكة،

...

 وفي رواية أبي ذر عنده وعند البخاري وغيرهما: "فرج سقف بيتي وأنا بمكة فنزل جبريل"، فبيّنت هذه الرواية أن الذي أقبل إليه من الملائكة هو جبريل، كما جاء في بعض الروايات التصريح بأن معه: ميكائيل، وأنه الذي ناوله الطست، ولم يرد تعيين الثالث من الملائكة فيما وقفت عليه.

অর্থঃ “প্রথম হাদিসে বোঝানো হয়েছে তিনি ছিলেন তিন জনের মধ্যে একজন অর্থাৎ তিনজন ফেরেশতা, যারা তাঁর নিকটে মানুষের রূপে এসেছিলেন। এই তিনজনের দ্বারা [হাদিসের বর্ণনাকারীর নিকট] আগে থেকেই পরিচিত ব্যক্তিদের কথা বোঝানো হচ্ছে এবং এই বর্ণনায় তাঁদের কোনো পরিচয় ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়নি। সম্ভবত নবী এই ঘটনা সাহাবীদের নিকট বলার সময়ে অথবা এরও পূর্বে তাঁদের পরিচয় সাহাবীদের নিকট উল্লেখ করেছিলেন। এবং কোনো কোনো বর্ণনাকারী সে অংশটি সংক্ষেপ করেছেন। যদি ধরে নেওয়া হয় { أل } ‘আল’ ব্যবহার করা হয় এমন কিছুর জন্য যে ব্যাপারে আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, তাহলে তিনি এই [ফেরেশতাদের] ব্যাপারে আগেই তাঁদেরকে [সাহাবীদেরকে] অবহিত করেছেন। সহীহ মুসলিমের বর্ণনা { أَحَدُ الثَّلاَثَةِ بَيْنَ الرَّجُلَيْنِ } “তিন ব্যক্তির মধ্যবর্তী একজন”, [8] সেখানে আরো আছেঃ আমি একজন কথককে বলতে শুনলাম, "তিন ব্যক্তির মধ্যবর্তী একজন..." ইত্যাদি। এর মধ্যে আবু যার(রা.) এর বর্ণনায় আছে, { فُرِجَ عَنْ سَقْفِ بَيْتِي وَأَنَا بِمَكَّةَ} "আমার ঘরের ছাদ খুলে দেয়া হল। তখন আমি মক্কায় ছিলাম।" [9] এভাবে আবু যার(রা.) এর বর্ণনায় বুখারীতে আরো আছে, {فَنَزَلَ جِبْرِيلُ} "তারপর জিব্রাঈল(আ.) অবতরণ করলেন"। এমন হওয়া সম্ভব যে, “তিন ব্যক্তির মধ্যবর্তী একজন” শীর্ষক কথার মানে হচ্ছে একজন ফেরেশতা অন্য ফেরেশতাকে [উক্ত কথা বলার মাধ্যমে] জবাব দিয়েছেন।

আবু যার(রা.) থেকে বুখারী(র.) এবং অন্যরা যে বর্ণনা উল্লেখ করেছেন, {فُرِجَ عَنْ سَقْفِ بَيْتِي وَأَنَا بِمَكَّةَ، فَنَزَلَ جِبْرِيلُ} "আমার ঘরের ছাদ খুলে দেয়া হল। তখন আমি মক্কায় ছিলাম। তারপর জিবরীল (আঃ) অবতরণ করলেন" – এই হাদিস থেকে এটি পরিষ্কার হয় যে, ফেরেশতাদের মাঝে যিনি [নবী() এর নিকট] অগ্রসর হয়েছিলেন তিনি জিব্রাঈল(আ.)। কোনো কোনো বর্ণনায় এই উল্লেখও আছে যে তাঁর সঙ্গে মিকাঈল(আ.) ছিলেন। আর তিনিই তাঁর [জিব্রাঈল(আ.)] নিকট [স্বর্ণের] পাত্রটি এগিয়ে দিয়েছিলেন [নবী() এর বক্ষ বিদারণের জন্য]। আমার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী তৃতীয় ফেরেশতার পরিচয় কী তা নির্দিষ্ট করে বর্ণিত হয়নি।[10]

 

এখানে আরেকটি প্রশ্ন আসতে পারে যে, নবী() এর সঙ্গে জিব্রাঈল(আ.) এর সাক্ষাৎ এবং বক্ষ বিদারণ কোথায় হয়েছিল? নবী() এর ঘরে, নাকি মসজিদুল হারামে? একটি হাদিস দেখে মনে হয় এই বিষয়টি নবী() এর ঘরে হয়েছে [এই প্রবন্ধে উল্লেখিত সর্বপ্রথম হাদিস], আবার দীর্ঘ বর্ণনার হাদিসগুলো দেখে বোঝা যায় এই বিষয়টি মসজিদুল হারামে ঘটেছে। এর উত্তর একাধিকভাবে দেয়া যায়। মুহাদ্দিসগণ সকল হাদিস সমন্বয় করে উল্লেখ করেছেন যে - নবী মক্কায় তাঁর ঘরে ছিলেন, সেখান থেকে জিব্রাঈল(আ.) তাঁকে কাবার হাতিম বা হিজরে নিয়ে যান। এরপর সেখান থেকে তাঁকে [মসজিদুল আকসার উদ্দেশ্যে] ভ্রমণ করানো হয়। [11] ইমাম ইবন হাজার আসকালানী(র.) উল্লেখ করেছেন যে, এই হাদিসের বর্ণনায় কিছু সংক্ষেপণ ঘটেছে বা কিছু বিষয় উহ্য আছে। [12] যদি মিরাজ একবার ঘটে থাকে, তাহলে এর ব্যাখ্যা হবে, প্রথমে জিব্রাঈল(আ.) এর সঙ্গে নবী() এর সাক্ষাৎ তাঁর গৃহেই হয়েছে, তিনি এরপর তাঁকে মসজিদুল হারামে নিয়ে যান এবং বক্ষ বিদারণ করেন। কিছু বিষয় উহ্য থাকার জন্য প্রথম হাদিসে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে যে এই বক্ষবিদারণ তাঁর ঘরেই হয়েছিল, কিন্তু বাস্তবিক তা হয়েছে মসজিদুল হারামে, যা দীর্ঘ বর্ণনাগুলো থেকে স্পষ্ট।

 

আবার কোনো কোনো মুহাদ্দিসের মতে মিরাজ একাধিকবার হয়েছিল। প্রখ্যাত মুহাদ্দিস যাকারিয়া আল আনসারী(র.) তাঁর সহীহ বুখারীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘মিনহাতুল বারীতে উল্লেখ করেছেন,

 

وجمع بينه وبين قوله فيما مَرَّ في كتاب الصلاة: "فرج عن سقف بيتي" (١) فإن له - صلى الله عليه وسلم - معراجين: أحدهما: من بيته، والآخر: من البيت الحرام،

অর্থঃ “এই হাদিসগুলোর সমন্বয় হচ্ছেঃ তাঁর [নবী()] যে বক্তব্য [সহীহ বুখারীর] সলাত অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে, “আমার ঘরের ছাদ খুলে দেয়া হল”, এর কারণ হচ্ছে,  তাঁর দুইবার মিরাজ হয়েছিল। একবার হয়েছে তাঁর বাড়ি থেকে, অন্যবার হয়েছে বাইতুল হারাম [মসজিদুল হারাম] থেকে।” [13]

 

 এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী একাধিক মিরাজে একাধিক স্থানে নবী() এর সঙ্গে জিব্রাঈল(আ.) এর সাক্ষাৎ এবং বক্ষ বিদারণ হয়েছিল। আমরা উলামাদের যে ব্যাখ্যাটিকেই গ্রহণ করি না কেন, উভয় পন্থাতেই হাদিসগুলোর সমন্বয় সাধন করা যায় এবং আর পরস্পরবিরোধিতা পরিলক্ষিত হয় না।

 

 

তথ্যসূত্রঃ


[1] সহীহ বুখারী,  হাদিস নং : ৩৪২

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=352

[2] সহীহ বুখারী,  হাদিস নং : ৩৬০৮

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=3866

[3] সহীহ বুখারী,  হাদিস নং : ১৩০৩

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=1310

[4] মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত) [হাদীস একাডেমী], খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ৩৬৯, হাদিস নং : ৪৬২১, ব্যাখ্যা অংশ

অনলাইন মিশকাত থেকে দেখুনঃ

পর্ব-২৪: স্বপ্ন (كتاب الرؤيا) - 24. Visions

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=75345

[5] সহীহ বুখারী,  হাদিস নং :  ৭০০৯

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=7752

[6] সুনান নাসায়ী,  হাদিস নং : ৪৪৯ (সহীহ)

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=9559

[7] দাখিরাতুল উকবা ফি শারহিল মুজতাবা – মুহাম্মাদ বিন আলি বিন আদাম আল আছিয়ুবী, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ২৩

https://shamela.ws/book/12888/3140

অথবা https://archive.is/wip/KB6qF (আর্কাইভকৃত)

[8] দেখুনঃ সহীহ মুসলিম,  হাদিস নং : ৩০৫ 

 https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=47062

[9] দেখুনঃ সহীহ বুখারী,  হাদিস নং : ৩৪২

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=352

[10] শারহ সুনান নাসায়ী – মুহাম্মাদ মুখতার আশ-শানকিতি, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৯৭০

https://shamela.ws/book/18222/965

অথবা https://archive.is/wip/du3cV (আর্কাইভকৃত)

[11]  “যুহরীর বর্ণনা অনুযায়ী, যার আলোচনা একটু পরেই আসছে, তাঁর [নবী ()] ঘর থেকে ইসরা [মক্কা থেকে জেরুজালেম সফর] হয়েছিল। যেখানে বলা হয়েছে, فُرِجَ عَنْ سَقْفِ بَيْتِي وَأَنَا بِمَكَّةَ، فَنَزَلَ جِبْرِيلُ { আমার ঘরের ছাদ খুলে দেয়া হল। তখন আমি মক্কায় ছিলাম। তারপর জিবরীল (আ.) অবতরণ করলেন}।  পূর্বে উল্লেখিত হাদিসগুলোর সাথে এই হাদিসের সমন্বয় হচ্ছেঃ নবী মক্কায় তাঁর ঘরে ছিলেন। সেখান থেকে তাঁকে হিজরে নিয়ে যাওয়া হয়। আর সেখান থেকেই তাঁকে [মসজিদুল আকসার উদ্দেশ্যে] ভ্রমণ করানো হয়। আর এই সমন্বয়টি হাসান [বসরী] (র.) সূত্রে একটি মুরসাল বর্ণনা দ্বারা সমর্থিত, যেটি ইবন ইসহাক উল্লেখ করেছেনঃ “জিব্রাঈল(আ.) তাঁর নিকট এলেন, তাঁকে মসজিদ [মসজিদুল হারাম] থেকে বের করে নিলেন। এরপর তাঁকে [জাগ্রত অবস্থায়] বুরাকে চড়ালেন।”

-       আহাদিছিল আকিদাতিল মুতাওয়াহহিমু ইশকালুহা ফিস সহীহাইন – ড. সুলাইমান বিন মুহাম্মাদ আদ-দুবাইখি, পৃষ্ঠা ৪৮২-৪৮৩, টীকা নং ৩।

 https://shamela.ws/book/124/472

https://shamela.ws/book/124/473

অথবা (আর্কাইভকৃত) 

https://archive.is/wip/sPEoQ

https://archive.is/wip/bxB42

[12] দেখুনঃ ফাতহুল বারী– ইবন হাজার আসকালানী, খণ্ড ১৩, পৃষ্ঠা ৪৮১-৪৮২

https://shamela.ws/book/1673/7912

https://shamela.ws/book/1673/7913

অথবা (আর্কাইভকৃত) 

https://archive.is/wip/123Zp

https://archive.is/UQ3VT

[13] মিনহাতুল বারী– যাকারিয়া আল আনসারী, খণ্ড ৬ পৃষ্ঠা ৩২১

 https://shamela.ws/book/18106/3482

অথবা https://archive.is/wip/xBuDN (আর্কাইভকৃত)