Pray for the world economy

রাসূল (ﷺ) কি বিভ্রমে ভুগছিলেন?

 

মুহাম্মাদের () নবুয়তের দাবি পর্যালোচনা করার ক্ষেত্রে দুটো বিষয় দেখা জরুরী—তাঁর মানসিক কোনো রোগ ছিলো কী-না অথবা তিনি কোনোভাবে বিভ্রমে ভুগছিলেন কী-না। বিভ্রম বলতে মূলত কী বোঝাচ্ছি? বিভ্রম বলতে বোঝাচ্ছি— তাঁর মনে হতো তিনি নবী, তাঁর কাছে ঐশী বাণী আসে। অধিকাংশ ওরিয়েন্টালিস্ট (উদাহরণ- উইলিয়াম মন্টগমেরি ওয়াট) ‘মুহাম্মাদ () মিথ্যা বলেছিলেন’—এই সম্ভাবনাটা উড়িয়ে দিয়েছেন। কারণ, তাঁর জীবনী পর্যালোচনা করে তাঁরা দেখেছেন, তিনি তাঁর নবুয়তে দৃঢ় বিশ্বাস রাখতেন। তাঁর আচরণে কোনোরকম ভণ্ডামি কিংবা মিথ্যাবাদিতার ছাপ ছিলো না। এজন্য যারা মুহাম্মাদের () নবুয়তকে অস্বীকার করতে চান, তারা দ্বিতীয় যুক্তিটির আশ্রয় নেন—তিনি বিভ্রমে ভুগছিলেন। তাঁর ওপর মানসিক রোগে ভোগার অভিযোগও তোলা হয়। কেউ বলেন তিনি এপিলেপ্সিতে ভুগছিলেন, কেউ বলেন তিনি সিজোফ্রেনিয়ায় ভুগছিলেন। রোগগুলো নিয়ে আমরা নাহয় পরে আলোচনা করবো। তার আগে আমরা তাঁর জীবন থেকে দেখে দুটো নমুনা দেখে আসি, যা প্রমাণ করে তিনি আসলে বিভ্রমে ভুগছিলেন না।

 

পুত্র ইব্রাহিমের মৃত্যু:

মুগীরা ইব্‌নু শু’বাহ (রা:) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, “আল্লাহ্‌র রসূল () এর সময় যে দিন (তাঁর পুত্র) ইবরাহীম (রা:) ইন্তিকাল করেন, সেদিন সূর্যগ্রহণ হয়েছিল। লোকেরা তখন বলতে লাগল, ইব্‌রাহীম (রা:) এর মৃত্যুর কারণেই সূর্যগ্রহণ হয়েছে। তখন আল্লাহ্‌র রসূল () বললেনঃ কারো মৃত্যু অথবা জন্মের কারণে সূর্য বা চন্দ্রগ্রহণ হয় না। তোমরা যখন তা দেখবে, তখন সালাত আদায় করবে এবং আল্লাহ্‌র নিকট দু’আ করবে  [1]

 

এই ঘটনাটি খেয়াল করুন। একজন মানুষ যিনি তাঁর নবুয়ত নিয়ে বিভ্রমে ভুগছেন, তিনি তো যে কোনো অতিপ্রাকৃতিক ঘটনাকে তাঁর নবুয়তের সাথে সম্পর্কিত ভাবার কথা। তিনি ভাবতেই পারতেন তাঁর পুত্রের মৃত্যুর দিনেই সূর্যগ্রহণ হওয়াটা কোনো কাকতালীয় ঘটনা হতে পারে না, বরং এটা তাঁর নবুয়তেরই নিদর্শন। কিন্তু তিনি এমনটা ভাবেননি। বরং তিনি সূর্যগ্রহুণকে আল্লাহর নিদর্শন বলে উল্লেখ করেছেন। [2] এটা দ্বারাই তো বোঝা যায় তিনি বিভ্রমে ভুগছিলেন না বরং তাঁর জীবনে যা কিছু ঘটছিলো প্রত্যেকটি বিষয় সম্পর্কেই সচেতন ছিলেন। তিনি নবুয়তের গণ্ডি বুঝতেন, রুবুবিয়াতের (রবের ক্ষমতা) গণ্ডি বুঝতেন। তাহলে বিভ্রমের অভিযোগ মানায়?

 

মানুষরূপে জীব্রিল (আ):

মুহাম্মাদের () ওপর বিভ্রমের অভিযোগ যারা আনে, তাদের একটা কমন যুক্তি হলোতাঁর হ্যালুসিনেশন হয়েছিলো তিনি যে কুরআন শুনতেন কিংবা জীব্রিলকে () দেখতেন, সেগুলো ছিলো তাঁর দৃষ্টি ও শ্রুতি বিভ্রম ঠিকাছে, মেনে নিলাম কিন্তু বিপত্তি বাঁধে অন্য জায়গায় জীব্রিলকে () মুহাম্মাদ () একাই দেখেছিলেন এমন না সাহাবীরাও জীব্রিলকে দেখেছেন হাদীসে জীব্রিল নামে একটি বিখ্যাত হাদীস আছে যা সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের কিতাবুল ঈমান অধ্যায়ে আছে জীব্রিল () মানুষরূপে মুহাম্মাদের () মজলিসে এসেছিলেন এসে তিনি ঈমান ও কিয়ামত বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেন। মুহাম্মাদ () সেগুলো উত্তর দেন। তিনি চলে যাওয়ার পর মুহাম্মাদ () তাঁকে জীব্রিল () বলে সাহাবীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন [3] সাহাবীগণ তাঁকে আগে কখনো দেখেননি। মুসলিমে এসেছে, উমর ইবনু খাত্তাব (রাঃ) হাদীস শুনিয়েছেন যে, “একদা আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর খিদমতে ছিলাম। এমন সময় একজন লোক আমাদের কাছে এসে হাযির হলেন। তাঁর পরিধানের কাপড় ছিল সা’দা ধবধবে, মাথার কেশ ছিল কালো কুচকুচে। তাঁর মধ্যে সফরের কোন চিহ্ন ছিল না। আমরা কেউ তাঁকে চিনি না [4] এইযে সাহাবীগণ জীব্রিলকে (আ) দেখলেন, এ দ্বারা কী বোঝা যায়? জীব্রিল (আ) যদি কেবলই মুহাম্মাদের () ভ্রম হতো, তবে সাহাবীগণ তাঁকে কীভাবে দেখলেন? জীব্রিল (আ) আসার এই ঘটনাটি মুহাম্মাদ () বিভ্রমে ভুগছিলেন এই কথার বিপরীতে কাজ করে। এখানে বলা যেতে পারে, মুহাম্মাদ () জীব্রিল (আ) হিসেবে কাউকে সাজিয়ে এনেছিলেন। যদি সচেতনভাবে কাউকে সাজিয়ে এনে থাকেন, তবে তো মুহাম্মাদ () বিভ্রমে ভুগছিলেন অভিযোগ বাদ পড়ে যায়। এটা মূলত তিনি ভণ্ড ছিলেন বলে যেই অভিযোগ করা হয় (নাউযুবিল্লাহ)—সেই ক্যাটাগরিতে পড়ে যায়আর সেই সংক্রান্ত অভিযোগ আমি আগের পরিচ্ছেদে খন্ডন করেছি। এমনকি এই হাদীসে সাহাবাগণই সেই অভিযোগ খণ্ডন করেছেন সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, সাহাবাগণ এখানে ফিলোসফিকাল রিজনিং করেছেন।

এই লোকটি যদি জীব্রিল (আ:) না হন তবে—

 

১। তিনি আমাদের এখানকার পরিচিত কেউ হবেন।

২। দূরবর্তী কোনো স্থান থেকে সফর করে আসবেন।

 

এরপর তাঁরা দেখলেন, লোকটি তাঁদের চেনার মধ্যে কেউ ছিলো না। এরপর তাঁরা বের করার চেষ্টা করলেন, এই লোকটি দূরবর্তী কোনো জায়গা থেকে এসেছে কী-না। এরপর তাঁরা লোকটির পোশাক-আশাক দেখলেন। দেখা গেলো তার পোশাক সাদা ধবধবে, মরুভূমির দীর্ঘ ভ্রমণে ধূলিমলিন হয়নি। এমনকি তার মধ্যে সফরের কোনো চিহ্ন—চেহারায় ধূলিমলিন ভাব কিংবা ক্লান্তি—ছিলো না। এই রিজনিং এর মাধ্যমে তাঁরা নিশ্চিত হলেন এর অন্য কোনো ব্যাখ্যা আছে। আর সেই ব্যাখ্যা দিলেন মুহাম্মাদ ()তিনি বললেন, এই লোকটি হলো জীব্রিল।

 

আর এছাড়াও, আরেকটি দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টিকে দেখা যায়। মদীনার ইহুদীরা, মুনাফিকরা মুহাম্মাদের () শত্রু ছিলো। তারা শুধু সুযোগ সন্ধানে থাকতো। আয়িশার (রা:) ওপর অপবাদ দেয়ার ঘটনাটি এটাই প্রমাণ করে যে, তারা কেমন ওঁৎ পেতে থাকতো মুহাম্মাদের () বদনাম করার জন্য। কোনোভাবে যদি তাঁর নবুয়তের ওপর প্রশ্ন তোলা যেতো, সেটা করতে তাদের একমূহুর্তও দেরি করার কথা নয়। একটা লোক জীব্রিল (আ) দাবি করে মুহাম্মাদের () সাহাবীগণের কাছে এসেছে, আর ফিরে যাওয়ার সময় তাকে আটকাবে না, মারধোর করে সত্য বের করে নেবে না, এটা হতেই পারে না। কিন্তু এমন কিছু ঘটেনি। এ থেকেও বোঝা যায় লোকটি জীব্রিল-ই (আ) ছিলেন।

 

যাহোক, এই লোকটি জীব্রিল (আ) ছিলেন কী-না তা মোটেই আমাদের আলাপের মূল বিষয়বস্তু নাআমাদের আলাপের মূল বিষয়বস্তু হলো মুহাম্মাদ () একাই—নিজের বিভ্রমে, হ্যালুসিনেশনে—জীব্রিলকে (আ) দেখতেন বলে যেই ধারণাটি সেটিকে খণ্ডন করা।

 

এপিলেপ্সি (Epilepsy)

মূল যে দুটি বিষয়ে আলোচনায় আসতে চাইছি তার মধ্যে একটি হলো এপিলেপ্সি মুহাম্মাদের () ওপর যে কয়েকটি মানসিক রোগের অভিযোগ করা হয়, তার একটি হলো এই রোগটি এপিলেপ্সি কী? এটা মূলত মস্তিষ্কের একটা রোগ যা শরীরে খিঁচুনির কারণ হতে পারে। International League Against Epilepsy (ILAE) তাদের প্রকাশিত অফিশিয়াল জার্নালে এপিলেপ্সির সংজ্ঞা দিয়েছে এভাবে

 

Epilepsy is a disorder of the brain characterized by an enduring predisposition

to generate epileptic seizures, and by the neurobiologic, cognitive,

psychological, and social consequences of this condition. [5]

 

এই জার্নালে আরো বলা হয় এপিলেপ্সি হতে হলে— অন্তত ২৪ ঘণ্টার বেশি ব্যবধানের মধ্যে দু’বার খিঁচুনি (seizure) হতে হবে, যা ২০০৫ রিপোর্টের সংজ্ঞায় আবশ্যক লক্ষণ বলা হয়। কিন্তু, ২০১৪ সালের রিপোর্টে এই সংজ্ঞাকে একটু সংশোধন করা হয়। বলা হয় একটি খিঁচুনি হলেও এপিলেপ্সি হতে পারে যদি অন্যান্য ফ্যাক্টর—স্ট্রোক, উচ্চ রিকারেন্স রিস্ক(৬০% এর অধিক)—থাকে। বোঝার বিষয় হলো এই খিঁচুনি কিন্তু provoked হতে পারবেনা অর্থাৎ, কোনো একটা প্রোভোকেটিভ ফ্যাক্টরেরমদ পরিত্যাগ পরবর্তী পরিস্থিতি কিংবা রক্তে সুগার কমে যাওয়াফলাফল হিসেবে হতে পারবে না এপিলেপ্সি হতে হলে সেটাকে হতে হবে unprovoked seizure. এপিলেপ্সির অফিশিয়াল ওয়েবসাইটেও একই কথাগুলোর প্রতিধ্বনি হচ্ছে

 

A person is diagnosed with epilepsy if they have two unprovoked seizures (or one unprovoked seizure with the likelihood of more) that were not caused by some known and reversible medical condition like alcohol withdrawal or extremely low blood sugar.[6]

 

এপিলেপ্সির খিঁচুনি দেখে শারিরিক রোগ মনে হলেও এর উৎপত্তি মূলত মস্তিষ্কে। এই খিঁচুনি হয় মস্তিষ্কে ইলেকট্রিকাল ডিসচার্জের কারণে। [7] একটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরী। বাংলায় এপিলেপ্সিকে মৃগীরোগ বলা হলেও এটি খাসভাবে মৃগীরোগ নয় এপিলেপ্সি আরো বৃহৎ অর্থে ব্যবহৃত হয়

 

মূল আলোচনায় প্রবেশ করা যাক। মুহাম্মাদের () ওপর এপিলেপ্সিতে ভোগার যে অভিযোগ করা হয়, তা সর্বপ্রথম করেন বাইজেন্টাইনের খ্রিষ্টান ঐতিহাসিক থিওফেনস অষ্টম শতকে। টেমকিন তার The Falling Sicknessবইয়ে থিওফেনস থেকে শুরু করে গ্রীক বিভিন্ন ঐতিহাসিকের মতামত উল্লেখ করেছেন যারা মনে করতো মুহাম্মাদ () এপিলেপ্সি আক্রান্ত। [8] এছাড়া খ্রিষ্টান পাদ্রী হামফ্রে প্রিডাও, ওরিয়েন্টালিস্ট উইলিয়াম মুইর, এরা দাবি করেছেন মুহাম্মাদ () শুধু এপিলেপ্সিতে আক্রান্তই ছিলেন না বরং তিনি তাঁর এপিলেপ্সির লক্ষণগুলোকে ফেরেশতার ওহী নিয়ে আগমন বলে চালিয়েছেন পূর্ববর্তীদের এসব আলোচনার ভিত্তিতে নিউরোলজিস্ট লেনক্স এবং ফ্রিমন নিজ নিজ মেডিকেল রিসার্চ প্রকাশ করেন, যেখানে তারা মুহাম্মাদকে () এপিলেপ্টিক দাবি করেন[9]  [10]

অবশ্য গিবন, কার্লাইল এবং অন্যরা কিছু কিছু দাবি খন্ডনও করেন।  [11] [12]

 

ফ্রীমনের প্রকাশিত রিসার্চটিকে আমরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বের সাথে পর্যালোচনা করবো, কেননা তিনি এই বিষয়ক পূর্ববর্তী সবার আলোচনাকে এক স্থানে সন্নিবেশিত করেছেন এবং তিনি একজন নিউরোলজিস্ট ছিলেনজবাব দেয়ার ক্ষেত্রে আমরা দুটো এপ্রোচ নেবো। ঐতিহাসিক দাবিগুলো ইতিহাসের বই ও একাডেমিকদের পর্যালোচনার আলোকে খন্ডন করবো। আর নিউরোলজিস্টদের দাবিগুলো খন্ডনের জন্য নির্ভর করবো বর্তমান সময়ের নিউরোলজিস্টদের ওপরে। এপিলেপ্সির লক্ষণ কী কী আর মুহাম্মাদকে () এপিলেপ্সির রোগী বলা যায় কী-না এই বিষয়ে কিছু রিসার্চ হয়েছে। তার মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো পাকিস্তানের ন্যাশনাল এপিলেপ্সি সেন্টারের রিসার্চটি। [13] তাঁদের মতামত আমি উদ্ধৃত করবো। অথোরিটি বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। নিউরোলজিস্টদের বক্তব্যের প্রত্যুত্তর করবেন আরেকজন নিউরোলজিস্ট। এটাই নিয়ম। আমি আরো উদ্ধৃত করবো আরেকজন এপিলেপ্টোলজিস্ট ড. আবদুল রহমানকে। তিনি যেহেতু এই বিষয়ের একজন এক্সপার্ট এবং একাডেমিক, তাই আমি তাঁর ব্যাখ্যাগুলোই উদ্বৃত করার চেষ্টা করবো মেডিকেলের বিষয়গুলোতে। [14]

 

থিওফেন্স (Theophanes)

টেমকিন তার বইয়ে অষ্টম শতকের খ্রিষ্টান পাদ্রী ও ঐতিহাসিক থিওফেন্সের লেখা উদ্বৃত করেন থিওফেন্স তার লেখায় বলেন, মুহাম্মাদ () ব্যবসা করতে গিয়ে ইহুদী ও খ্রিষ্টান পাদ্রীগণের কাছ থেকে কিছু বিষয়াদি শিখেছিলেন এবং সেগুলোই পরবর্তীতে প্রচার করা শুরু করেন তিনি বলেন, মুহাম্মাদ () বাকপটুতা দিয়ে খাদিজাকে (রা) বিয়ে করেন তাঁর সম্পদের জন্য। তিনি আরো বলেন,

 

He had an epileptic seizure, and when his wife noticed this she became very distressed, for she was noble and had now been joined to a man who was not only helpless but epileptic as well. He turned to conciliating her, saying, “I see a vision of the angel known as Gabriel, and faint and fall because I cannot bear up under the sight of him.” Khadija consulted an exiled monk who confirmed, “He has spoken the truth, for this angel is sent to all prophets.” [15]

 

এই অনুচ্ছেদে থিওফেন্স মুহাম্মাদের () প্রথম ওহী পাওয়ার ঘটনাকে এপিলেপ্সি বলে চালিয়েছেন তিনি এও বলেছেন যে খাদিজা (রা) তাঁর রোগ সম্পর্কে জানতেন এবং এ নিয়ে দুঃখ পেতেন। তার এই বর্ণনা কোনোরকম যাচাই-বাছাই ব্যতিরেকে পরবর্তীতে ওরিয়েন্টালিস্টরা অবলীলায় ব্যবহার করেছেন তাদের লেখায়।

 

প্রথমেই আসি, বাণিজ্য করতে গিয়ে খ্রিষ্টান ও ইহুদী পাদ্রীদের কাছে ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞানলাভের ব্যাপারে। এই ব্যাপারে মুহাম্মাদের () জীবনে দুটি ঘটনা পাওয়া যায়। একটি হলো আবু তালিবের সাথে বাণিজ্য করতে গিয়ে পাদ্রী বাহিরার ঘটনা। আর অন্যটি হলো খাদিজার (রা) কাফেলার দায়িত্ব নিয়ে বাণিজ্য করতে যাওয়ার ঘটনা।

 

পাদ্রী বাহিরার ঘটনাটি হলো এরূপ যে, মুহাম্মাদ () নয় কিংবা বারো বছর বয়সে চাচা আবু তালিবের সঙ্গে সিরিয়ায় বাণিজ্য করতে যাচ্ছিলেন। মাঝে বসরা শহরে তারা বিশ্রামের জন্য বসেন। এই সময় মুহাম্মাদকে () দেখে বাহিরা নামক একজন পাদ্রী গির্জা থেকে বেরিয়ে আসেন এবং তাঁকে ভালোমতো দেখতে থাকেন। কথিত আছে, এর আগে সেই পাদ্রী কখনোই গির্জা থেকে বের হতো না। বাহিরা মুহাম্মাদকে () আখেরী নবী বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, আসার পথে সব গাছ এবং পাথরকে তিনি মুহাম্মাদকে () সিজদা করতে দেখেছেন। এছাড়াও তাঁর কাঁধের নবুয়তের সীলমোহর দেখে তিনি এই বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন। বাহিরা মুহাম্মাদের () নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে তাঁকে সিরিয়ায় না নিয়ে গিয়ে মক্কায় পাঠিয়ে দেয়ার জন্য বলেন এবং তা-ই করা হয়।

 

এই বর্ণনাকে ব্যবহার করে কিছু ওরিয়েন্টালিস্ট দাবি করেন, বাহিরার সঙ্গে এই সাক্ষাতেই মুহাম্মাদ () ইহুদী ও খ্রিষ্টান ধর্ম সম্পর্কে জেনেছিলেন এবং কুরআন রচনা করেছিলেন সেই জ্ঞান দিয়ে। এই বর্ণনা নিয়ে সীরাত রচয়িতা ও মুহাদ্দিসিনগণের মধ্যে বিরোধ আছে। শাইখুল হাদিস আল্লামা সফিউর রহমান মোবারকপুরী রহ. বলেছেন পাদ্রী বাহিরার বর্ণনা সন্দেহযুক্ত। [16] শাইখ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. লিখেছেন, “আল্লামা শিবলী নুমানী “সীরাতুন্নবী”-তে লিখেছেন, ঈমাম তিরমিযী এই হাদীসকে হাসান গরীব বলেছেন। হাদীসের রাবীদের মধ্যে আবদুর রহমান ইবনে গাযওয়ানের নাম পাওয়া যায়, যাঁর সম্পর্কে আপত্তি উত্থাপিত হয়েছে। ইমাম যাহাবী বলেন, সে মুনকার হাদীস বর্ণনা করে থাকে। আর তার মধ্যে সবচেয়ে মুনকার হাদীস সেটি যেটিতে বাহিরার কিসসা বর্ণিত হয়েছে।” [17]

 

তবে ঘটনাটি প্রমিনেন্ট সীরাতের কিতাব ইবনে হিশামে এসেছে। মোখতাসারুস সীরাতেও বর্ণনা এসেছে। তাই, এটিকে আমরা বিশুদ্ধ বর্ণনা ধরে নিয়ে থিওফেন্স এবং ওরিয়েন্টালিস্টদের অভিযোগ পর্যালোচনা করবো। প্রথমত, তখন মুহাম্মাদের () বয়স নয় কিংবা বারো যা-ই ধরি না কেন, সেটিকে যথেষ্ট মনে করা যায় না ইহুদী এবং খ্রিষ্টান ধর্ম সম্পর্কে শিখে ফেলা অথবা বাইবেল-তাওরাত শুনে শিখে ফেলার মতো। আচ্ছা ধরলাম, ঐ বয়সে শেখা সম্ভব। কিন্তু কতোটুকু সময়ে? ঘণ্টাখানেক? ঘণ্টাখানেক সময়ের মধ্যেই বিশাল কুরআন রচনা ও হাদীস বর্ণনার জন্য প্রয়োজনীয় সব শিখে ফেলা সম্ভব? নিতান্তই শিশু কিংবা বিকৃতমস্তিষ্ক ছাড়া কেউ বলবে না এটা সম্ভব। আরেকটি বিষয় হলো, তখনও বাইবেল ও তাওরাত আরবিতে অনূদিত হয়নি। তা ছিলো হিব্রুতে। আর মুহাম্মাদ () হিব্রু তো দূর, আরবিও তখনো লিখতে-পড়তে জানতেন না। [18] তাহলে তিনি বাহিরার কাছ থেকে কীভাবে শিখলেন? আর সেই শিক্ষা তিনি প্রায় তিশ বছর পর বলা শুরু করেন। এতদিন তার স্মরণ থাকার কথা কি? আচ্ছা ধরলাম, স্মরণ রেখেছেন। তাহলে ইহুদী-খ্রিষ্টানদের আকীদা-বিশ্বাস হুবহু কি তুলে ধরার কথা নয়? তিনি সেগুলোকে কীভাবে বাতিল আকীদা হিসেবে উপস্থাপন করলেন এবং সহীহ আকীদার দাওয়াত দিতে লাগলেন যেই সহীহ আকীদার খোঁজ বের করতেও বছরের পর বছর সময় লাগার কথা। ধরে নিলাম তিনি বাইবেল আর তাওরাত দেখে কুরআন বানিয়েছেন, তাহলে বাইবেলের সাথে কুরআনের এত অমিল কেন? [19] সেইসাথে সেই বারো বছরের বালকটি অল্প কিছু সময়ে যা-কিছু বাহিরার কাছে শিখেছিলো, সেগুলোকে কীভাবে তিনি সংশোধন করলেন? [20] শুধু আকীদা নয়, ঐতিহাসিক এবং বৈজ্ঞানিক বিষয়াদিতেও কুরআন বাইবেলের চেয়ে অনেক এগিয়ে এবং অনেকক্ষেত্রে বাইবেলকে সংশোধন করেছে [21]  কুরআনের অলৌকিক বিষয়াদি নিয়ে তৃতীয় অধ্যায়ে বিশদ আলোচনা করবো

 

সুতরাং, এসকল প্রমানাদি সামনে রেখে কোনোভাবেই বলা যায় না, মুহাম্মাদ () বাহিরার কাছ থেকে এসব বিষয়াদি শিখেছিলেন এছাড়া যারা বাহিরার ঘটনাটি উদ্বৃত করেন, তারাবাহিরা যে মুহাম্মাদকে () আখেরী নবী বলেছিলেনএটি সচেতনভাবে এড়িয়ে যান কেন? একই বর্ণনার কিছু অংশ নিয়ে যেই নবুয়তকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে, অপর অংশ নিয়ে সেই নবুয়তের দাবিকে তো মজবুতও করা যায়!

 

দ্বিতীয় ঘটনাটি হলো খাদিজার (রা) বাণিজ্য কাফেলা নিয়ে মুহাম্মাদের () সিরিয়ায় গমনের ঘটনাটি সিরিয়ায় গমনের সময় খাদিজার (রা) দাসী মায়সারা মুহাম্মাদের () সাথে ছিলো। ইবনে ইসহাক বিনা সনদে একটি বর্ণনা উল্লেখ করেছেন। সিরিয়ার পথে এক জায়গায় মুহাম্মাদ () একটি গাছের নিচে বিশ্রাম করছিলেন। তখন এক পাদ্রী এসে মায়সারাকে তাঁর পরিচয় জিজ্ঞেস করলে সে বলে, তিনি হারামের অধিবাসী কুরাইশ বংশের একজন ব্যক্তি। পাদ্রী তাকে বলে, “এই গাছের নিচে নবী ছাড়া কেউ কখনো বসেনি।” [22] এই ঘটনাটিকে সীরাতুর রাসূল (ছাঃ) বইয়ে মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল গালিব ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেছেন। [23] ভিত্তিহীন না হলেও, এই বর্ণনা থেকে কী প্রমাণিত হয়? সেই পাদ্রীর সাথে তো মায়সারার কথোপকথন হয়েছে, মুহাম্মাদের () তো হয়নি। তাহলে এই বর্ণনাটি নিয়ে তো আর প্রশ্ন থাকার কথা না।

 

এর বাইরে আর কাদের থেকে জানা সম্ভব? মদীনার ইহুদিদের থেকে? কিন্তু মদীনায় যাওয়ার আগে তেরো বছর যাবত কুরআন কীভাবে তিলাওয়াত করতেন তিনি? মক্কায় তো কোনো ইহুদী ছিলো না। খিষ্টান ছিলো খুবই নগণ্যসংখ্যক। স্কলার পর্যায়ের ধরলে ওয়ারাকা বিন নওফেলের কথা বলা যায়। কেউ কেউ মুহাম্মাদ () ওয়ারাকা থেকে এসব শিখেছেন বলেও বলে থাকেন। অথচ প্রথম নবুয়ত পাওয়ার পর ওয়ারাকার কাছে যখন খাদিজা (রা) মুহাম্মাদকে () নিয়ে যান, তখনকার ঘটনা পড়লে এই দাবি ভিত্তিহীন মনে হবে। সেদিন ওয়ারাকা তাঁকে নবী হিসেবে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। এবং তাঁর কাছে আসা ফেরেশতা জীব্রিল (আ) যে অন্যান্য নবীগণের নিকট এসেছিলেন, সেটাও জানান। তিনি এও বলেছিলেন, মক্কার লোকেরা তাঁকে বের করে দেবে। সেদিন থাকতে পারলে তিনি মুহাম্মাদকে () সহায়তা করতেন বলেও বলেনকিন্তু ওয়ারাকা এসময় হয়ে গিয়েছিলেন বৃদ্ধ ও অন্ধ। [24] এই লোকটি মুহাম্মাদকে () কিছু শেখানোর পরিস্থিতিতে ছিলেন কী-না তা সচেতন পাঠক মাত্রই বুঝবেন। আর তাছাড়া ওয়ারাকা নিজেই মুহাম্মাদকে () নবী বলে মনে করতেন, তাহলে তিনি একজন নবীকে কী শিক্ষা দেবেন? এমনকি ওয়ারাকা বেশি সময়ও পান নি। প্রকাশ্যে দাওয়াত শুরু হওয়ার আগেই ওয়ারাকা মৃত্যুবরণ করেন। তাই মুহাম্মাদ () ওয়ারাকার কাছ থেকে কিছু শেখার সুযোগ পেয়েছিলেন এই দাবি অবান্তর। [25]

 

এবার আসি, থিওফেন্সের দ্বিতীয় দাবিটিতে। তিনি বলেন, মুহাম্মাদ () দরিদ্র ও অনাথ ছিলেন বলে খাদিজাকে (রা) বাকপটুতা দিয়ে মুগ্ধ করে বিয়ে করে তাঁর সম্পদের মালিক হন। এটা ইতিহাস নিয়ে সুস্পষ্ট মিথ্যাচার। আর একজন খ্রিষ্টান পাদ্রী ইসলামের বিরোধিতা করতে গিয়ে মিথ্যাচার করবেন এটাই স্বাভাবিক। প্রথমত, মুহাম্মাদ () হতদরিদ্র ছিলেন না। তিনি ব্যবসা করতেন এবং উচ্চবংশীয় ছিলেন। পাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন হাজারে এক। দ্বিতীয়ত, খাদিজাকে (রা) তিনি বাকপটুতা দিয়ে মুগ্ধ করেননি বরং আমানতদারিতা দিয়ে মুগ্ধ করেছেন। তৃতীয়ত, খাদিজাকে (রা) তিনি বিয়ের প্রস্তাব দেন নি। খাদিজা (রা) বরং তাঁর বান্ধবীর মাধ্যমে মুহাম্মাদকে () প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। তাই, থিওফেন্সের করা এই দাবি মিথ্যাচার এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

 

থিওফেন্সের তৃতীয় দাবিটি ছিলো, মুহাম্মাদের () এপিলেপ্সির কারণে খিঁচুনি হয়েছিলো এবং খাদিজা (রা) এটা দেখলেন এবং দুঃখিত হলেন এই বর্ণনার রেফারেন্স কী? কোন উৎস্য থেকে তিনি এটা জেনেছেন? আর কী দেখেই বা তিনি বললেন মুহাম্মাদের () এপিলেপ্সির খিঁচুনি হয়েছিলো? আসলে এটা একটা সচেতন মিথ্যাচার। মুহাম্মাদের () কাছে ফেরেশতা এসেছিলেন হেরা গুহায়, সেখানে খাদিজা (রা) ছিলেন না আর সেখানে তাঁর খিঁচুনিও হয়নি খাদিজার (রা) কাছে যখন তিনি ফিরে আসেন, তখন তিনি কাঁপছিলেন থিওফেন্স সাহেব বোধহয় খিঁচুনি আর কাঁপুনি এই দুয়ের মাঝে তফাৎ জানতেন না। যাহোক, এই বর্ণনায় থিওফেন্স বলেছেন—খাদিজা (রা) বুঝে গিয়েছিলেন যে মুহাম্মাদ () এপিলেপ্টিক। কিন্তু এর ইমিডিয়েট অনুচ্ছেদে তিনি কী বললেন জানেন?

 

She was the first to accept the false abbot’s statement; she believed in Muhammad and told other women of her tribe that he was a prophet.”

 

খাদিজা (রা) জানতেন মুহাম্মাদ () এপিলেপ্টিক এটা জেনে তিনি দুঃখ পেলেন আবার তিনি এই এপিলেপ্টিক মানুষটার ফেরেশতা দেখার গল্প বিশ্বাস করে মুসলিম হয়ে সেই গল্প প্রচারে লেগে গেলেন? কীসব সাংঘর্ষিক কথাবার্তা! আসলে মানুষ যখন মিথ্যাচার করে, তখন সে পরস্পর সাংঘর্ষিক কথাবার্তা বলে ফেলে এই পর্যন্ত আলোচনা থেকে এটা মূলত স্পষ্ট যে, থিওফেন্স ইসলামের প্রতি বিদ্বেষের জায়গা থেকে ইতিহাস নিয়ে মিথ্যাচার করেছেন, সত্য-মিথ্যা মিশিয়েছেন, মনগড়া অভিযোগ এনেছেন। এগুলোর আসলে যৌক্তিক এবং ঐতিহাসিক কোনো ভিত্তি নেই।

 

হামফ্রে প্রিডাও (Humphrey Prideaux)

প্রিডাও ছিলেন একজন খ্রিষ্টান পাদ্রী, নরউইচের প্রধান গির্জার ডীন ছিলেন তিনি। তিনি একজন ওরিয়েন্টালিস্টও ছিলেন। তিনি তার বইয়ে ৪৪ পৃষ্ঠায় লিখেছেন

 

“And whereas he was subject to the falling sickness, whenever the Fit was upon him, he pretended it to be a Trance, and that then the Angel Gabriel was come from God with some new revelations.” [26]

 

প্রিডাও তার লেখায় রেফারেন্স টেনেছেন বাইজেন্টাইন ঐতিহাসিক এবং খ্রিষ্টান পাদ্রী থিওফেন্স, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের প্রধান বিচারক এবং সম্রাটের ব্যক্তিগত সেক্রেটারী জন জোনারাস এবং চার্চ ঐতিহাসিক এবং খ্রিষ্টান জোহান হেনরি হটিংগার প্রমুখ ব্যক্তিত্বের।

 

মুহাম্মাদের () ফিট হয়ে পড়ে যাওয়ার ঘটনা কোনো হাদীস কিংবা সীরাতের বইয়ে আসে নি। প্রিডাও নিজেও কোনো আরব বা মুসলিম লেখকের রেফারেন্স টানতে পারেননি। ওহী নাযিল হওয়ার সময় উক্ত বর্ণনার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ কিছু শারিরিক ঘটনা ঘটেছে বৈকি (সেগুলোর মেডিকেল এনালাইসিস সামনে আসছে), কিন্তু সেটাকে ‘ফিট’ আখ্যা দিয়ে প্রিডাও কী অর্জন করতে চাইছেন?

 

লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, প্রিডাও যাদের রেফারেন্স টেনেছেন তার মাঝে প্রথম দুজন সরাসরি বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের উচ্চপদস্থ মানুষ। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সাথে মুসলিম সাম্রাজ্যের তৎকালীন সংঘর্ষের কথা কারো অজানা নয়। আর তাই, তাদের লেখায় মুহাম্মাদ-বিরোধিতা থাকবে এবং সেই বিরোধিতার ক্ষেত্রে তারা কোনো রেফারেন্সের তোয়াক্কা না করে মিথ্যা তথ্য সংযোজন করবেন, এটা অস্বাভাবিক নয়। থিওফেন্সের মিথ্যাচার আর মনগড়া বর্ণনা তো আমরা আগেই দেখিয়েছি।

 

উক্ত ঐতিহাসিকগণ ইতিহাস নিয়ে মিথ্যাচার করেছেন কিংবা বায়াজড আচরণ করেছেন, এই কথা যে কেবল আমি বলছি তা নয়। বিখ্যাত ইংরেজ ঐতিহাসিক ও পার্লামেন্ট মেম্বার এডওয়ার্ড গিবন (যিনি নিজেই খ্রিষ্টান ছিলেন) তাঁর অমর কীর্তি The history of the decline and fall of the Roman Empire বইয়ে এসব ঐতিহাসিকের অসততার তীব্র সমালোচনা করে বলেন,

 

“The epilepsy or falling sickness of Mahomet, is asserted by Theophanes, Zonaras and the rest of the Greeks; and is greedily swallowed by the gross bigotry of Hottinger (Hist. Orient. P 10, 11), Prideaux (Life of Mahomet p 12), and Maracci (tom ii, Alcoran, p 762, 763). The titles (the wrapped up, the covered) of two chapters of the koran (73, 74) can hardly be strained to such an interpretation: the silence, the ignorance of the Mahometan Commentators, is more conclusive than the most preemptory denial.” [27]

 

থিওফেন্স, জোনারাস এবং অন্যান্য গ্রিকদের রেফারেন্সবিহীন মনগড়া বিবৃতিকে হটিংগার, প্রিডাও প্রমুখের নিজেদের বইয়ে তুলে ধরাকে গোঁড়ামি এবং ধর্মান্ধতা হিসেবে চিত্রিত করেছেন গিবন অন্যদিকে মুসলিম ঐতিহাসিকদের এসব অভিযোগে চুপ থাকা কিংবা এসব অভিযোগ সম্পর্কে আদৌ না জানাকে তিনি প্রামান্য ও অকাট্য বলে অভিহিত করেছেন এসব অভিযোগ যদি গুরুতর হতো, তবে মুসলিমগণ এসব অভিযোগের বিরুদ্ধে অনেক বেশি লেখালিখি করার কথা, যা আদতে হয়নি এমনকি অনেক ক্ষেত্রে মুসলিমরা এসব অভিযোগ সম্পর্কে ভালোমতো জ্ঞাতই নন, যা প্রমাণ করে এই অভিযোগের বিশেষ কোনো শক্ত ভিত্তি নেই এখন অনেকে বলতে পারেন, মুসলিমরা এসব ইচ্ছে করে চেপে যেতে পারেন হ্যাঁ পারেন, কিন্তু সেই একই মুসলিমরা কেন স্যাটানিক ভার্স এর হাদীস বর্ণনা করবেন, আয়িশা (রা) ও জাইনাব (রা) এর সাথে বিয়ের হাদীস কিন্তু এই ঐতিহাসিকরাই বর্ণনা করেছেন লুকোচুরি করার হলে তো তারা এসবও লুকোতে পারতেন, তাইনা?

 

অমুসলিম ঐতিহাসিক এবং গবেষকরা গ্রিক এবং রোমানদের এসব মিথ্যাচার ও প্রোপাগাণ্ডাকে নিন্দা করেছেন এবং কঠিন সমালোচনা করেছেন। টমাস কার্লাইল বলেন,

“The lies, which well-meaning zeal has heaped round this man, are disgraceful to ourselves only.” [28]

 

বিখ্যাত ওরিয়েন্টালিস্ট উইলিয়াম মন্টগমেরি ওয়াট বলছেন,

 

“On some occasions at least, there were some physical accompaniments. He would be gripped by a feeling of pain, and in his ears, there would be a noise like the reverberation of a bell. Even on a very cold day the bystanders would see great pearls of sweat on his forehead as the revelation descended upon him. Such accounts led some Western critics to suggest that he had epilepsy, but there are no real grounds for such a view. Epilepsy leads to physical and mental degeneration, and there are no signs of that in Muhammad; on the contrary, he was in full possession of his faculties to the very end of life.” [29]

 

সতেরো শতকের খ্রিষ্টান পাদ্রী জন ডেভেনপোর্ট বলেন,

“The assertion, so often repeated that Mohammed was subject to epileptic fits, is a base invention of the Greeks, who would seem to impute that the morbid affection of the apostle of a novel creed as a stain upon his moral character deserving the reprobation and abhorrence of the Christian world. Surely those malignant bigots might have reflected that if Mohammed had really been afflicted with the dreadful malady Christian charity ought to have commanded them to pity his misfortune rather than rejoice over it or affect to regard it in the light of a sign of Divine wrath.” [30]

 

এমনকি টেমকিন—যিনি তাঁর The Falling Sickness বইয়ে সবার অভিযোগকে একত্রিত করেছেন—মন্তব্য করেন,

 

“As is to be expected, the positive bias of Islam was countered by an opposite bias in the Christian world. As to the origin of the diagnosis ‘epilepsy’, everything points to Christian Byzantium, an empire that was not only hostile to Islam but at frequent wars with the Arabs. Less than 200 years after Mohammed's death, the Byzantine historian Theophanes (died about 817) told a story which was bound to make Mohammed appear a fraud and to discredit the belief in his divine mission.”

 

টেমকিন আরো বলেন,

 

“This is the story which was accepted by western historian, theologians, and physician. The story has all the earmarks of religious and political propaganda. Hence, repudiated by Gibbon as an absurd calumny of the Greeks” [31]

 

এসকল ঐতিহাসিকগণের—এডওয়ার্ড গিবন, কার্লাইল, ডেভেনপর্ট, মন্টগমেরি—বক্তব্য দেখলে এটা মোটামুটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এপিলেপ্সির যে উল্লেখ তৎকালীন কিছু গ্রিক ও রোমানদের লেখায় পাওয়া যায়, তা মূলত রেফারেন্সবিহীন, প্রমাণবিহীন এবং হিংসা ও শত্রুতার বহিঃপ্রকাশ বৈ কিছুই না!

 

উইলিয়াম মুইর (William Muir)

উইলিয়াম মুইরের একাধিক পরিচয় আছেতিনি একজন ওরিয়েন্টালিস্ট, এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রিন্সিপাল, উত্তর-পশ্চিম ব্রিটিশ ভারতের লেফটেন্যান্ট গভর্ণর ছিলেন। মুইর একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ও একাডেমিক ছিলেন। তাই তার বক্তব্য পরবর্তীতে অনেক নিউরোলজিস্ট এবং ঐতিহাসিক গ্রহণ করেছিলেন। মুইর তার লেখা মুহাম্মাদের () বায়োগ্রাফি “The life of Mahomet”-এ লিখেন,

 

When another two years were ended, some strange event occurred to the boy which greatly alarmed his nurse. It was probably a fit of epilepsy; but Mehomatan legends have invested it with so many marvelous features that it is difficult to discover the real fact*.” [32]

 

এটার টীকায় তিনি মুসলিম ঐতিহাসিক ওয়াক্বিদিকে উদ্বৃত করেন। ওয়াক্বিদি মুহাম্মাদের () সীনা চাকের ঘটনাটি উল্লেখ করেছিলেন। এমনকি মুইর তার সম্পূর্ণ বইয়ে ওয়াক্বিদিকে গুরুত্ব দিয়েছেন, অথচ আহলুস সুন্নাহর আলিমগণ ওয়াক্বিদিকে নির্ভরযোগ্যই মনে করেন না। [33] ঘটনাটি হলো চার কিংবা পাঁচ বছর বয়সে মুহাম্মাদ () এর নিকট দুজন ফেরেশতা আসেন এবং তার বক্ষ চিরে কালো রক্তপিন্ড ফেলে দেন এবং জমজমের পানিতে তাঁর হৃৎপিন্ড ধুয়ে ফেলেন। এরপর বক্ষকে পুনরায় সেলাই করে দিয়ে তারা চলে যান। এই ঘটনা দেখে মুহাম্মাদের () দুধভাইয়েরা তাদের মা হালিমাকে বিষয়টা জানায়। হালিমা এবং তাঁর স্বামী এসে দেখেন মুহাম্মাদ () ভীতসন্ত্রস্ত চেহারা নিয়ে বসে আছেন। এই ঘটনা প্রায় প্রত্যেকটি সীরাত গ্রন্থে এসেছে। এমনকি সহীহ মুসলিমে আনাস (রা.) এর বর্ণনায় এ নিয়ে একটি স্বতন্ত্র অধ্যায়ও রয়েছে। মুইর টীকায় ইবনে হিশামকেও উদ্বৃত করেন এবং বলেন,

 

Hishami and other writers add that her husband concluded that “he had a fit”— اٗميب(omeeb)—and advised his wife to return him to his mother.”

 

এখানে একটি বিষয় বলে নেয়া ভালো। সীনা চাকের এই ঘটনাটি হালিমার মুখ থেকে যেমন পাওয়া যায়। তেমনি পাওয়া যায় কথিত রোগী মুহাম্মাদের () মুখ থেকেও [34] তিনি তাঁর সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাটির পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করেছেন। একজন এপিলেপ্সির রোগী তার ফিট হয়ে যাওয়ার বা খিঁচুনি হওয়ার ব্যাপারটি কি বর্ণনা করতে পারেন? রোগী তার আশেপাশে কী ঘটছে তা-ই বলতে পারেন না, কিংবা বলতে পারলেও সেটা স্পষ্ট ব্যাখ্যা করতে পারেন না। কিন্তু মুহাম্মাদ () তাঁর সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন। এটি ম্যুরের এভিডেন্সের কাউন্টার বলে ম্যুর বর্ণনাটি সন্তর্পণে এড়িয়ে গেছেন।

 

দ্বিতীয় বিষয়টি হলো হালিমার স্বামীর বক্তব্য। ইবনে হিশামের বরাত দিয়ে মুইর সাহেব যেই শব্দটি (اٗميب) তার বইয়ে এনেছেন, আরবীতে এমন কোনো শব্দ নেই। আসলে শব্দটি হলো (اٗصيب) এই اٗصيب শব্দের অর্থ হচ্ছে আক্রান্ত (affected) হওয়া, আঘাত পাওয়া, সংস্পর্শে আসা ইত্যাদি। স্যার সৈয়দ আহমদ খান তাঁর Essays on the Life of Muhammad বইয়ে উইলিয়াম মুইরের সব বিভ্রান্তিগুলোর চমৎকার জবাব দেন। তিনি اٗصيب শব্দটার পরিবর্তে ভুল করে اٗميب এর ব্যবহারের কথা সর্বপ্রথম তুলে ধরেন। তিনি এও দেখান যে, اٗصيب শব্দটার মূলত ভুল অনুবাদ করেছেন মুইর। এটি দ্বারা ফিট হওয়া বোঝায় নাবরং, যেকোনো ধরণের আক্রান্ত হওয়া, আঘাত পাওয়া বোঝায়। ইবনে হিশামের ঐ অংশের আরবি উদ্বৃতি তুলে ধরে প্রকৃত অনুবাদ করেন তিনি।

“Halima says, she was told by his (prophet’s) foster-father that, ‘O Halima! I fear that the infant has received an evil spirit—that is, is under the influence of evil spirit—therefore let him be sent back to his family’.”

The fact that Halima's husband did not mean to infer, by these words, that the infant Was suffering from any actual disease, is also verified by the following remarks of Amina, made by her on the occasion of Halimah's returning the infant to her.Ah exclaimed she, didst thou fear that he was under the influence of evil spirits?” [35]

 

শয়তান দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার যেই শঙ্কা হালিমার স্বামী প্রকাশ করেছিলেন, সেটিকে মুইরফিটবলে চালিয়ে দিলেন এমনকি যেই আরবি শব্দটি তিনি অনুবাদ করেছেন বলে দাবি করেছেন, সেটি পর্যন্ত ভুল লিখেছেন মজার ব্যাপার হচ্ছে, স্যার সৈয়দ আহমদ খান মুইরের এই ভুলটি ধরিয়ে দিলে তিনি পরবর্তী সংস্করণে ফুটনোট থেকে আরবি শব্দটি সরিয়ে নেন কিন্তু, শব্দটির ভুল অনুবাদ করে মুহাম্মাদের () এপিলেপ্সিতে ভোগার যেই উপসংহারে তিনি এসেছিলেন, সেটা বদলাননি [36] কেমন অসাধুতা! তার এই অসাধুতার জন্যই স্যার সৈয়দ আহমদ খান তাঁর বইয়ের ভূমিকায় আফসোস করে লিখেছেন,

 

“মুইরের রচনাটি নিয়ে জনমনে একটা উত্তেজনা ছিলো। কিন্তু যখনি দেখা গেলো লেখক নিজের পূর্বঅনুমান ও পূর্ববিচারের ভিত্তিতে মুহাম্মাদের () জীবনের প্লেইন এবং সিম্পল ফ্যাক্টগুলো পর্যন্ত পেঁচিয়েছেন এবং বিকৃত করেছেন, তখনই বইপ্রকাশের ঘোষণার পর যেই আগ্রহটা তৈরি হয়েছিলো—তা শূন্যের কোঠায় নেমে এলো।” [37]

 

এরপর স্যার সৈয়দ আহমদ খান ওরিয়েন্টালিস্ট এবং খ্রিষ্টান লেখকদের ক্রমাগত ‘এপিলেপ্সি’ অভিযোগের মূল কোথায় তা অনুসন্ধানে লেগে পড়েন। পরে তিনি বের করেন, প্রথমত গ্রিকদের কুসংস্কার এবং মনগড়া বর্ণনা থেকে এর উৎপত্তি—যা ছিলো মূলত ইসলামবিদ্বেষী প্রোপাগান্ডা। এই প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে জবাব হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন বিখ্যাত লেখক জন ডেভেনপোর্ট [38] এবং এডওয়ার্ড গিবনের বক্তব্য (পূর্বে আলোচনা করেছি)দ্বিতীয়ত, হামফ্রে প্রিডাও এর বই থেকেও (যার ব্যাপারে পূর্বে আলোচিত হয়েছে) এই এপিলেপ্সি অভিযোগ আরো উস্কানি পায়কিন্তু প্রিডাও-ও তার বইয়ে আরবি শব্দের অনুবাদ নিয়ে গোলমাল পাকিয়েছেন বলে অভিযোগ তোলেন স্যার সৈয়দ আহমদ খান। আরবি থেকে ল্যাটিনে অনুবাদ করার সময়ই ভুলটা করেছিলেন তিনি। একই ভুল করেছেন ড. রিচার্ড পোকক ঐতিহাসিক আবুল ফেদার লেখা অনুবাদ করতে গিয়ে। স্যার সৈয়দ আহমদ খান আরবি, ল্যাটিন ও ইংরেজি, তিনটি ভাষায়ই হালিমার স্বামীর বক্তব্যের অংশটি উদ্বৃত করেন এবং দেখান কীভাবে শুধুমাত্র অনুবাদ গ্রামাটিকালি অসংগত মনে হওয়ায় পোকক ‘contracted’ শব্দটিকে ‘Hypochondriacal’ বানিয়ে দিয়েছেন। তার শয়তানের সংস্পর্শ লেগেছেএই কথাটিকে (আশংকা) তিনি বানিয়ে দিয়েছেন ‘তার হাইপোকন্ড্রিয়াক রোগ হয়েছে’। আর পোককের উদ্ভাবিত এই নতুন শব্দটিই একটি রোগের ধারণা প্রাচ্যবিদদের মধ্যে তৈরি করেছে। এছাড়াও তিনি আরবদের প্রচলিত ভাষায় কথাটি দ্বারা মূলত কী বোঝানো হয়েছে এবং তা যে এপিলেপ্সির ধারণা হতে যোজন যোজন দূরবর্তী তা আলোচনা করেছেন। [39]

 

ফ্র্যাঙ্ক আর. ফ্রিমন (Frank R. Freemon)

আমেরিকান নিউরোলজিস্ট ফ্রিমন ১৯৭৬ সালে “A Differential Diagnosis of the Inspirational Spells of Muhammad, the Prophet of Islam” নামে একটি রিসার্চ পেপার প্রকাশ করেন। [40]

 

এই পেপারে তিনি মুহাম্মাদের () ওহী প্রাপ্তির বিভিন্ন ঘটনা মেডিকেল সাইন্সের আলোকে পর্যালোচনা করেন, পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি স্থাপন করেন এবং মন্তব্য করেন যে, মুহাম্মাদের () সবচেয়ে সম্ভাব্য যে রোগটি হতে পারে তা হলো—টেম্পোরাল লোব এপিলেপ্সি।

 

ফ্রিমন যেসব রোগের সম্ভাবনা বাতিল করেছেন তা হলো—

·       সিজোফ্রেনিক হ্যালুসিনেশনঃ এটিকে ফ্রিমন বাতিল করেছেন এই যুক্তিতে যে, সাহাবারা—যাঁরা মুহাম্মাদের () মৃত্যুর পর বিশাল সাম্রাজ্য জয় করেছিলো—তাঁরা সিজোফ্রেনিক হ্যালুসিনেশনের রোগী দ্বারা কনভিন্সড হওয়ার কথা নয়। তিনি আরো বলেন সিজোফ্রেনিক ডিজঅর্ডার থাকলে একটা মানুষ সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দিতে পারবেনা। এছাড়া তিনি তৎকালীন কাফিরগোষ্ঠীর অভিযোগও পর্যালোচনা করেন। তারা কুরআনকে তাঁর বানানো বলে উল্লেখ করতেন, কিন্তু মানসিক রোগের অভিযোগ তাদের কাছ থেকে পাওয়া যায় না। এই প্রসঙ্গে সীরাত থেকে একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। মক্কায় হজযাত্রীগণ আসলে মুহাম্মদ () যদি তাদের ইসলামের দাওয়াত দিতে যায়, এই ভয়ে কাফিররা ওয়ালীদ বিন মুগীরার কাছে সমবেত হয়। তারা ওয়ালীদকে জিজ্ঞেস করে মুহাম্মাদকে () কী ট্যাগ দেয়া যায়? ওয়ালীদ তাদের সাজেশন চাইলে তারা একে একে বিভিন্ন প্রস্তাবনা পেশ করে। একজন বলে, আমরা বলবো—‘তিনি পাগল’। উত্তরে ওয়ালীদ বলেন, ‘না তিনি তো পাগল নন, আমরা পাগল দেখেছি এবং আমরা তাঁর রকম-সকম সম্পর্কে জানি। এ লোকের মধ্যে পাগলাদের মধ্যে দম বন্ধ করে থাকা, অস্বাভাবিক কোনো কাজকর্ম করা, অসংলগ্ন কথাবার্তা বলা কিংবা অনুরূপ কিছুই তো দেখি না’। [41] এছাড়াও যদি মুহাম্মাদ () হ্যালুসিনেশনে ভুগতেন, তবে সাহাবারা জীব্রিলকে (আ) দেখার কথা নয়। কিন্তু সাহাবারা জীব্রিলকে দেখেছেন যা আমরা শুরুতেই হাদীসে জীব্রিলে দেখেছি

·       ড্রাগ-জনিত পরিবর্তনঃ কোনো গাছের পাতা বা ফল খাওয়ার কারণে সেটায় থাকা কোনো উপাদান অনেক সময় মানসিক পরিবর্তনের কারণ হতে পারে। কিন্তু তাৎক্ষণিক ওহী আসা, দ্রুততম সময়ের মধ্যে সবকিছু ঘটে যাওয়া, এই অপশনটাকেও বাদ দিতে বাধ্য করে ফ্রিমনকে।

·       হাইপোগ্লাইসেমিয়াঃ লম্বা সময় যাবত একই ঘটনা ঘটতে থাকা (ওহী আসার সময় শারিরিক অবস্থা), কিন্তু তারপরও শারিরিক অবস্থা খারাপ না হওয়া এবং paroxysmal onset পর্যালোচনা করে ফ্রিমন হাইপোগ্লাইসেমিয়াকেও বাদ দেন।

·       ল্যাবিরিন্থিটিস, মেনিয়ের্স ডিজিজ, ইনার ইয়ার ম্যালাডিজঃ ভার্টিগো বা ঘূর্ণিরোগের অনুপস্থিতির কারণে ফ্রিমন এই তিনটি রোগই বাতিল করে দেন।

 

এই সবগুলো রোগের সম্ভাবনা বাতিল করার পর ফ্রিমন Psychomotor Seizures এর উপস্থিতি লক্ষ্য করে টেম্পোরাল লোব এপিলেপ্সি (Temporal Lobe Epilepsy) যার অন্যনাম কমপ্লেক্স পার্শিয়াল সিজার (Complex Partial Seizure), হতে পারে এমন সম্ভাবনা ব্যক্ত করেন। ফ্রিমন বলেন, “যদিও TLE হওয়ার আদর্শ বয়স বয়ঃসন্ধির শেষদিক থেকে বিশ বছর অবধি, তাও ৪০ বছর বয়সে হওয়াটাও সম্ভব এবং অযৌক্তিক না (tenable) ফ্রিমন যেসব লক্ষণ দেখে এই রোগের সম্ভাবনা ব্যক্ত করেন, তা হলো—

 

§  অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যাওয়া।

§  Paroxysmal onset.

§  হ্যালুসিনেশন।

§  Autonomic dysfunction.  

 

এই লক্ষণগুলো নিয়ে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করবো একটু পরেই।

ফ্রিমন এই রোগ না হওয়ার পক্ষেও কিছু যুক্তি তুলে ধরেন। সেগুলো হল—

 

§  বয়স।

§  সমসাময়িকগণ এটিকে খিঁচুনি হিসেবে চিহ্নিত না করা।

§  খিঁচুনির ঠিক পরমূহুর্তেই সাজানো-গোছানো কাব্যিক আয়াত পড়ে শোনানো।

 

এপিলেপ্সি সাধারণত কিশোরদের মধ্যে দেখা যায়। কিন্তু ৪০ বছর বয়সের পর মুহাম্মাদের () এপিলেপ্সি হওয়াটা ফ্রিমনের কাছে অসম্ভব মনে না হলেও, এটা নিয়ে তিনি বেশ অস্বস্তিতেই ছিলেন বলা যায়। তাই, তিনি এটাকে এপিলেপ্সির সম্ভাবনার বিপক্ষে দাঁড় করিয়েছেন।

 

তবে তিনি সবচেয়ে বেশি যেই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছেন, তা হলো—তৎকালীন আরবদের মধ্যে কেউই এপিলেপ্সির অভিযোগ না তোলা। তিনি লিখেছেন,

 

On the other hand Arab physicians were familiar with the manifestations of epilepsy, but none of Muhammad’s contemporary opponents mentioned this possible diagnosis.

 

এপিলেপ্সি সম্পর্কে আরবরা অবগত ছিলো। এটাকে (صرع) বলা হতো। এমনকি হাদীসেও এই রোগের রোগীর কথা এসেছে।

 

আত্বা ইবনু আবূ রাবাহ্ (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) আমাকে বললেনঃ আমি কি তোমাকে একজন জান্নাতী মহিলা দেখাব না? আমি বললামঃ অবশ্যই। তখন তিনি বললেনঃ এই কালো রঙের মহিলাটি, সে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসেছিল। তারপর সে বললঃ আমি মৃগী [42] রোগে আক্রান্ত হই এবং এ অবস্থায় আমার লজ্জাস্থান খুলে যায়। সুতরাং আপনি আমার জন্য আল্লাহর কাছে দু‘আ করুন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ তুমি যদি চাও, ধৈর্য ধারণ করতে পার। তোমার জন্য আছে জান্নাত। আর তুমি যদি চাও, তাহলে আমি আল্লাহর কাছে দু‘আ করি, যেন তোমাকে অরোগ্য করেন। স্ত্রীলোকটি বললঃ আমি ধৈর্য ধারণ করব। সে বললঃ ঐ অবস্থায় আমার লজ্জাস্থান খুলে যায়, কাজেই আল্লাহর নিকট দু‘আ করুন যেন আমার লজ্জাস্থান খুলে না যায়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জন্য দু‘আ করলেন। [43]

 

এটা প্রমাণ যে, এপিলেপ্সি রোগ সম্পর্কে তৎকালীন আরবরা জানতো। মুহাম্মাদের () মাঝে এই রোগের লক্ষণ থাকলে তবে অবশ্যই সেটা কারো না কারো বর্ণনায় আসতো, সাহাবীদের থেকে না হলেও অন্তত তাঁর শত্রুদের থেকেআর সেটাই ফ্রিমন বলতে চেয়েছেন।

 

এছাড়াও এপিলেপ্সির ফলাফল হিসেবে কীভাবে এত সাজানো-গোছানো, ধর্মীয় ও সামাজিক বিধিবিধান, রাষ্ট্রীয় আইন-কানুন সম্বলিত কুরআন আসতে পারে, তা ফ্রিমন ভেবে পাননি। টেমকিনকে উদ্বৃত করে তিনি লেখেন,

 

Temkin (1971) points out:

It is hard to imagine that the Koran, a body of religious, legal, and social instruction should largely be the product of a succession of hallucinatory epileptic attacks.

 

আচ্ছা যদি এটা এপিলেপ্সি না হয়, তবে ওহী নাযিলের সময় মুহাম্মাদের () শারিরিক অবস্থা এমন হয়ে যেতো কেন? এটার উত্তরও ফ্রিমন দিয়েছেন।

 

তিনি বলেন, “এটাও সম্ভব যে এই অস্বাভাবিক মানসিক অবস্থা স্রষ্টার সাথে যোগাযোগের কারণে হয়েছে।”  আর এই ক্ষেত্রে ফ্রিমন উদ্বৃত করেন উইলিয়াম জেমসকে,

 

it is logically conceivable that if there be higher spiritual agencies that can directly touch us, the psychological condition of their doing so might be our possession of a subconscious region which alone should yield access to them.

 

একই কথা কিন্তু মুসলিম চিন্তাবিদগণও বলেছেন। ইবনে খালদুন তাঁর মুকাদ্দামায় লিখেছেন,

 

“Above the human world there is a spiritual world and that the human soul must be prepared to exchange humanity for angelicality, in order actually to become part of the angelic species at any time, in a single instant. It will afterwards resume its humanity” [44]

 

যদিও এটা ইবনে খালদুনের একান্ত নিজস্ব অভিমত। ওহী নাযিলের সময়কার শারিরিক অবস্থা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। অর্থাৎ, শারিরিক কোনো রোগ ছাড়াও এরকম শারিরিক অবস্থা তৈরি হতে পারে আধ্যাত্মিক জগতের সাথে যোগাযোগ তৈরির ক্ষেত্রে।

 

সবশেষে ফ্রিমন বলেছেন, “ব্রেইন ফিজিওলজি অনুসারে Psychomotor Seizure হলো সবচেয়ে বেশি সম্ভবপর ব্যাখ্যা। স্বীকার করছি এটা প্রমাণিত হয়নি এবং কখনো প্রমাণ করা সম্ভবও না।”

 

মেডিকেল ডায়াগনসিস

ফ্রিমন যেসব লক্ষণ বলেছেন সেগুলোর ভিত্তিতে কি আসলেই বলা যায় মুহাম্মাদ () এপিলেপ্সিতে ভুগছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন গবেষক হাসান আজিজ, পাকিস্তান ন্যাশনাল এপিলেপ্সি সেন্টারের কয়েকজন নিউরোলজিস্টের সহায়তায়তিনি মুহাম্মাদের () জীবনের ১০টি ঘটনা চিহ্নিত করেন। সেগুলোর নাম তিনি দেন Pre Revelation Episodes (PRE). এই PRE-গুলোর মেডিকেল ডায়াগনসিস করেন তিনি। সেগুলো আমি কিছুটা এখানে আলোচনার চেষ্টা করবো।

 

PRE-1: “এমনিভাবে হেরা গুহায় অবস্থানকালে একদিন তাঁর কাছে ওহী এলো। তাঁর কাছে ফিরিশতা এসে বললেন, পড়ুন’। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ “আমি বললাম, আমি পড়িনা’। তিনি বলেনঃ তারপর তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে এমন ভাবে চাপ দিলেন যে, আমার অত্যন্ত কষ্ট হল। তারপর তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, পড়ুনআমি বললামঃ আমি তো পড়ি না। তিনি দ্বিতীয়বার আমাকে জড়িয়ে ধরে এমন ভাবে চাপ দিলেন যে, আমার অত্যন্ত কষ্ট হল। এরপর তিনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললেনঃ পড়ুনআমি জবাব দিলাম, আমিতো পড়িনারাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তারপর তৃতীয়বার তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে চাপ দিলেন। এরপর ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘পড়ুন আপনার রবের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে আলাক থেকে। পড়ুন আর আপনার রব্ মহামহিমান্বিত’

 

তারপর তিনি কাঁপতে কাঁপতে স্ত্রী খাদিজার (রা) কাছে উপস্থিত হন এবং তাঁকে চাদরাবৃত করতে বলেন। খাদিজা (রা) তাঁকে সান্ত্বণা দেন এবং চাচাতো ভাই ওয়ারাকার কাছে নিয়ে যান। ওয়ারাকার কাছে মুহাম্মাদ () সবকিছু খুলে বলেন এবং ওয়ারাকা তাঁকে নিশ্চিত করেন যে, তাঁর কাছে যেই ফেরেশতা এসেছেন সেই ফেরেশতা মূসার (আ) কাছেও আসতেন। এই পুরো ঘটনাটি ঘটার সময় মুহাম্মাদ () পুরোপুরি সচেতন ছিলেন। [45]

 

PRE-2: আবূ বাকর ইবনু আবূ শাইবাহ্ (রহঃ) ... ‘আয়িশাহ্ (রাঃঃ) হতে বর্ণিত যে, হারিস ইবনু হিশাম (রাযিঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার নিকট ওয়াহী নাযিল হয় কীভাবে? তিনি বললেনঃ কখনো তা আসে ঘণ্টার ধ্বনির মতো শব্দ করে আর তা আমার জন্য অনেক কষ্টকর হয়। এরপর ওয়াহী থেমে যায়, আর আমি মুখস্থ করে নেই। আবার কখনো (ওয়াহী নিয়ে) পুরুষের ছদ্মবেশে একজন ফেরেশতা আসেন এবং তিনি যা বলেন আমি তা মুখস্থ করে নেই। [46]

 

PRE-3: আবূ কুরায়ব মুহাম্মাদ ইবনু ‘আলা (রহঃ) ..... আয়িশাহ (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, শীতের দিনে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর ওয়াহী অবতীর্ণ হত আর তার কপাল বেয়ে ঘাম পড়তো। [47]

 

PRE-4: মুহাম্মাদ ইবনুল মুসান্না (রহঃ) ... উবাদাহ্ ইবনু সামিত (রাযিঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর যখন ওয়াহী অবতীর্ণ হতো তখন তার খুব কষ্ট হত এবং তার মুখায়ব কেমন যেন শুকিয়ে যেত। [48]

 

PRE-5: ওহী আসার সময় সেটার চাপ এবং তীব্রতা এত বেশি হতো যে, যেই জন্তুর বাহনে মুহাম্মাদ () আরোহণ করতেন, তা বসে পড়তো। [49] একবার তিনি এক সাহাবীর কোলে শুয়ে ছিলেন, তখন ওহী নাযিল হওয়া শুরু হলো। সেটার ওজন এত বেশি ছিলো যে, সেই সাহাবীর ঊরু ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হলো। [50]

 

PRE-6: উমার (রা) ওহী নাযিলের সময় হওয়া শব্দকে মৌমাছির আওয়াজের সাথেও তুলনা করেছেন। [51]

 

PRE-7: জীব্রিল (আ) কখনো কখনো মানুষরূপে [52] আসতেন, আবার কখনো ফেরেশতারূপে [53] আসতেন। আবার মুহাম্মাদের () অনুরোধেও জীব্রিল (আ) তাঁর প্রকৃত রূপ প্রকাশ করেছিলেন।

 

PRE-8: কখনো এমনও হতো, জীব্রিল (আ) মুহাম্মাদের () হৃদয়ে ওহী গেঁথে দিতেন[54]

 

PRE-9: আবু হুরায়রা (রা) বলেছেন, ওহী নাযিলের সময় কখনো কখনো মুহাম্মাদের () কাঁপুনি হতো। [55]

 

PRE-10: ইয়ালা (রাঃ) বলতেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উপর ওহী নাযিল হওয়া অবস্থায় যদি আমি তাঁকে দেখতে পেতাম! উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) বললেন, ওহী নাযিল হওয়ার মুহূর্তে তুমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে দেখার আগ্রহ রাখ কি? ইয়ালা (রাঃ) বলেন, এরপর উমর (রাঃ) কাপড়ের এক কোণ উন্মুক্ত করলেন এবং আমি তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম যে, তাঁর মুখ দিয়ে যুবা (উঠতি বয়সের) উটের আওয়াজের মত আওয়াজ বের হচ্ছে। [56]

 

এই দশটি PRE-এর কয়েকটি করে নিয়ে কম্বিনেশন করে গবেষক ৪টি গ্রুপ তৈরি করেছেন। তারপর তিনি দেখিয়েছেন, আসলেই এগুলো এপিলেপ্সি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে কী-না!

 

গ্রুপ ১ (Predominantly Phobic States):  

PRE-সমূহ যথাক্রমে 1, 3, 4 এবং 9 এই চারটিকে এই গ্রুপের অন্তর্ভূক্ত করা হচ্ছে। এগুলো একটি ভীতিকর পরিস্থিতিকে (phobic state) নির্দেশ করে—যা অনুভূতির বিভিন্ন ধরণের পরিবর্তন ঘটিয়েছেএকই সাথে autonomic dysfunction (ফ্রিমনের উল্লেখিত একটি লক্ষণ) যেমন—দুঃশ্চিন্তা, ধড়ফড়, ঘেমে যাওয়া, কাঁপুনি এসবও ঘটিয়েছেফ্রিমন autonomic dysfunction এর কারণ হিসেবে epilepsy­-কে সন্দেহ করেছেন। কিন্তু এই গবেষণা বলছে, এটি ভীতির কারণে হয়েছে। আসমান থেকে জমিন পর্যন্ত বিস্তৃত একজন ফেরেশতাকে হঠাৎ দেখলে যে কেউ এই ভীতিকর পরিস্থিতিতে পড়বে এবং তার মাঝে এইসব লক্ষণ দেখা যাওয়া স্বাভাবিক। একই ধরণের ভীতির কথা তাওরাতেও এসেছে। স্রষ্টা যখন মূসার (আ) সাথে কথা বলছিলেন, তখন তিনি ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। [57]

 

গ্রুপ ২ (subjective visual/auditory hallucinatory symptoms):

PRE-সমূহ যথাক্রমে 1, 2, 7 এবং 8 এই গ্রুপের অন্তর্গত। লক্ষণসমূহ হচ্ছে—সাব্জেক্টিভ ভিজুয়াল, অডিটোরি, সেন্সরি এবং টেকটাইল হ্যালুসিনেশন। PRE-1 এ সুদীর্ঘ সময় ধরে তিনি দৃশ্যটি দেখেছেন, পুনঃপুনঃ দ্বিপাক্ষিক মৌখিক কথোপকোথন করেছেন এবং স্পর্শানুভুতিও (জীব্রিল যখন তাঁকে জড়িয়ে ধরে চাপ দেয়, তখন তিনি বুকে ব্যাথা পান) পেয়েছেন। PRE-2 এ তিনি পেয়েছেন ঘণ্টার মতন শব্দ। PRE-7 এ তিনি ফেরেশতাকে দেখেছেন এবং ফেরেশতা তাঁর অনুরোধে প্রকৃতিও পরিবর্তন করেছেন। এপিলেপ্সিতে এমন ‘সিলেকশন’ এর সুযোগ থাকেনা। এছাড়া দ্বিপাক্ষিক যোগাযোগের অনুভূতিও (বিশেষত কথোপকথন) এপিলেপ্সি হতে পারে না। ঘণ্টার বিষয়টি টেম্পোরাল লোবের ল্যাটারাল পার্টে হয়। যা হওয়ার পর ইমিডিয়েটলি খিঁচুনি হয়। কিন্তু খিঁচুনি কোথায়? হৃদয়ে ফুঁ দিয়ে ওহী প্রবেশ করানোর ঘটনাটিকে (PRE-8) ‘পার্শিয়াল সেন্সরি সিজার’ হিসেবে গণনা করা যেতে পারে। কিন্তু এই ঘটনার সাথে পরবর্তীতে আরেকটু ডেফিনিটিভ চিহ্ন বা লক্ষণ প্রকাশ পেলে সেক্ষেত্রে এটিকে বিবেচনায় রাখা যেত।  

 

গ্রুপ ৩ (objective visual/auditory perceptions):

PRE-সমূহ যথাক্রমে ৪, ৫, ৬ এবং ৯ এই গ্রুপের অন্তর্ভূক্ত। মুহাম্মাদের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো তাঁর একক সাব্জেক্টিভ অনুভূতি ছিলো এমন না। এটার অবজেক্টিভ দর্শনও ঘটেছে। ৫ নং ঘটনায় জন্তুর বসে পড়ার ব্যাপারটি অন্যরা প্রত্যক্ষ করেছে যা অবজেক্টিভ। একই ঘটনায় একজন সাহাবীর উরু ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলো যা অবজেক্টিভ না হলেও মুহাম্মাদের () ব্যক্তিগত (সাব্জেটিভ) অনুভূতির বাইরে ঘটেছে। ৬ নং ঘটনায় মৌমাছির শব্দের মত শব্দ উমার (রা) শুনেছিলেন যা মুহাম্মাদের () ব্যক্তিগত (সাব্জেক্টিভ) অনুভূতির বাইরে ঘটেছে। ৯ নং ঘটনায় কাঁপুনি পরিলক্ষিত হয়েছে অন্যদের দ্বারা যা মুহাম্মাদের () ব্যক্তিগত (সাব্জেক্টিভ) অনুভূতির বাইরে ঘটেছে। বলে রাখা ভালো, কাঁপুনি এপিলেপ্সির লক্ষণ নয়।

 

গ্রুপ ৪ (symptoms mimicking generalized seizures):

১০ নং ঘটনায় মুহাম্মাদের () মাটিতে শুয়ে থাকা অবস্থায় উটের মত শব্দ করার ব্যাপারটিকে গবেষক হাসান আজিজ এপিলেপ্সির সবচেয়ে নিকটতম একমাত্র ঘটনা বলে উল্লেখ করেছেন। তবে তিনি এর স্বতন্ত্র ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। তিনি বলেন—

 

“It is possible that The Prophet had a simple fainting episode but was helped and prevented from lying flat on the ground by his companions thus a simple syncope changed into a complex one similar to Phone Booth Syncope.”

অর্থাৎ, মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল কমে যাওয়ার দরুণ মানুষ যেমন মাথা ঘুরে পড়ে যায়, এটা সেরকম পড়ে যাওয়াও হতে পারে! জরুরী না যে এই পড়ে যাওয়া এপিলেপ্সির কারণেই হয়েছে। কেননা খিঁচুনির কোনো আভাস এই বর্ণনা থেকে পাওয়া যায় না।

 

আর তাছাড়া এপিলেপ্সি হতে গেলে একবার খিঁচুনি মোটেই যথেষ্ট নয়। ILAE ২০১৪ রিপোর্ট অনুযায়ী ২৪ ঘণ্টার বেশি ব্যবধানের মধ্যে দুবার খিঁচুনি হয় অথবা একবার খিঁচুনি এবং সাথে অন্যান্য ফ্যাক্টর (স্ট্রোক, উচ্চ রিকারেন্স রিস্ক) থাকে। কিন্তু মুহাম্মাদের () ক্ষেত্রে এই ‘অন্যান্য ফ্যাক্টর’ এর উপস্থিতি ছিলো না। এবং প্রত্যেকটা PRE এর লক্ষণগুলো প্রায় একটি আরেকটি থেকে আলাদা ছিলো (ভীতির কারণে যেগুলো হয়েছিলো সেগুলোকে কমন লক্ষণ ধরে)। আর তাই এই লক্ষণগুলোকে এক ছকে বেঁধে এপিলেপ্সি বলা যায় না।

 

উপসংহারে এসে হাসান আজিজ বলেছেন,

“১০ নং বাদে বাকি কোনো ঘটনাই এপিলেপ্সির নিউরোলজিকাল চিহ্ন বা লক্ষণের প্রতিনিধিত্ব করে না। এই ঘটনাগুলোর সাথে কুরআন নাযিল হওয়া সংশ্লিষ্ট। সাধারণত এপিলেপ্টিক এটাকের সাথে নিশ্চলতা, কনফিউশন এবং অ্যামনেশিয়া দেখা যায়, যা এই ঘটনাগুলোর ফলাফল হিসেবে ৬২৩৬টি আয়াত আসার সাথে সাংঘর্ষিক ফলস্বরূপ এপিলেপ্সির সম্ভাবনাকে নাকচ করে

 

ডা. আবদুল রহমানের মূল্যায়ন

এপিলেপ্সি সংক্রান্ত অভিযোগ মূল্যায়ন করেছেন নিউরোলজিস্ট ডা. আবদুল রহমান। তিনি শুরুতেই বলেন, কেউ এপিলেপ্সিতে ভুগছে কী-না সেটা তাকে শারিরিকভাবে পরীক্ষা করা ছাড়া বলা সম্ভব নয়তিনি বলেন, এটাই মেডিকেল এপ্রোচ। সাক্ষ্যের ভিত্তিতে কারো এপিলেপ্সি আছে কী-না তা নির্ণয় সম্ভব কী-না এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন—সম্ভব নয়, শুধুমাত্র অনুমান করা যেতে পারে এবং এপিলেপ্সির রিস্ক ফ্যাক্টর জানা যেতে পারে এক্ষেত্রে তিনি শুরুতেই ঐতিহাসিক এবং স্কলার ফরিদ বাহরাইনিকে কিছু প্রশ্ন করেন। পাঠকের বোঝার স্বার্থে সেগুলো হুবহু তুলে ধরছি।

 

ডাক্তার: মুহাম্মাদ () এর জন্মের সময় আমিনার কি কোনো ইনফেকশন হয়েছিলো? কোনো ট্রমা? জন্মদানের সময় কিংবা গর্ভধারণের সময়?

ফরিদ: আমার জানামতে, না।

ডাক্তার: মুহাম্মাদ () কি অপরিপক্ব জন্মগ্রহণ করেছিলেন?

ফরিদ: আমার জানামতে এমন কিছু হয় নি।

ডাক্তার: ছোটোবেলায় কি তাঁর খিঁচুনির কোনো বর্ণনা পাওয়া যায়?

ফরিদ: এমন কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না।

ডাক্তার: তাঁর কি সিএনএস ইনফেকশন বা মেনিনজেস ইনফেকশন (লক্ষণ- তীব্র মাথাব্যাথা, খিঁচুনি, কোমর ব্যাথা, জ্বর, প্যারালাইসিস) ছিলো?

ফরিদ: এরকম কোনোকিছু পাওয়া যায় না।

ডাক্তার: মাথায় কোনো ট্রমার কারণে জ্ঞান হারানো কিংবা কনফিউজড হয়ে যাওয়া এমন কিছু?

ফরিদ: না।

ডাক্তার: তাঁর কি কোনো স্ট্রোক হয়েছিলো? কিংবা মাথায় টিউমার?

ফরিদ: না।

ডাক্তার: তাঁর পরিবারে কিংবা কুরাইশে কারো এপিলেপ্সি ছিলো?

ফরিদ: এমন কিছু পাওয়া যায় না ইতিহাসে।

ডাক্তার: তাহলে তাঁর এপিলেপ্সির রিস্ক ফ্যাক্টর ছিলো না।

 

তিনি বলেন, এপিলেপ্সির রিস্ক ফ্যাক্টর না থাকা একজন ব্যক্তির হুট করে এপিলেপ্সিতে আক্রান্ত হওয়া অস্বাভাবিক। একজন একাডেমিক এই বিষয়টা ভালো বুঝতে পারেন। তারপর তিনি ব্যাখ্যা করেন কেন মুহাম্মাদ () এপিলেপ্সিতে ভুগতে পারেন না।

 

v টেম্পোরাল লোব এপিলেপ্সিতে ভোগা একজন রোগীর কোনো বক্তব্য বুঝতে সমস্যা হয়। কিন্তু মুহাম্মাদের () এরকম কোনো সমস্যাই ছিলো না। এছাড়া, ২৩ বছর যাবত তাঁর কাছে কুরআন এসেছিলো, যার অর্থ দাঁড়ায়—প্রায় কয়েকশতবার তাঁর ওহী নাযিল সংক্রান্ত শারিরিক অবস্থা হয়েছে। যদি এটা এপিলেপ্সি হতো, তবে তাঁর মস্তিষ্ক সম্পূর্ন বিকৃত হয়ে যেত এত অধিক সংখ্যক এপিলেপ্টিক এটাকের কারণে।

v টেম্পোরাল লোব এপিলেপ্সিতে ভোগা রোগীকে যদি নিয়ন্ত্রণ এবং মেডিকেশনে রাখা না হয়, তবে সে সাধারণ জীবনযাপনও করতে পারে না। মুহাম্মদ () কোনো নিয়ন্ত্রণাধীন অথবা মেডিকেশনে ছিলেন না। তারপরও তিনি সাধারণ জীবনযাপন করেছেন, যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন এমনকি রাষ্ট্রও পরিচালনা করেছেন। এই রোগের রোগীকে তো গাড়িই চালাতে দেয়া হয় না, তারা কী রাষ্ট্র চালাবে!

v সিজার বা খিঁচুনি হওয়ার একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো—এটা ঘটার পরবর্তী বেশ খানিকটা সময় মানুষ স্বাভাবিক রকমের তৎপর কিংবা শার্প থাকতে পারে না যদি খিঁচুনিটার উৎপত্তি টেম্পোরাল লোবের বামপাশে হয়, যেখান থেকে ভাষার ডোমিন্যান্স থাকে, তাহলে রোগী খিঁচুনির পর ঠিকমতো কথাও বলতে পারে না। এছাড়া রোগী খিঁচুনিকালীন সময়ে আশেপাশে কী ঘটছিলো তা স্মরণ করতে পারে না ফোকাল এওয়ার সিজারের ক্ষেত্রে রোগী আশেপাশের কী ঘটছে তা কিছুটা আঁচ করতে পারলেও পরিষ্কার সেটা বলতে পারে না। অথচ, মুহাম্মাদের () ক্ষেত্রে আমরা দেখি, তিনি ওহী নাযিল শেষ হলে সাথে সাথেই স্পষ্ট ভাষায় কথা বলতে পারতেন। আশেপাশে কী ঘটছিলো তাও সহসা বলে দিতে পারেন। তাই, তার ওহীকালীন পরিস্থিতিকে এপিলেপ্সি সিজার বলা যায় না।

v উটের মত শব্দ করার হাদীসটির ক্ষেত্রে শব্দের অর্থ অনুবাদে বিভ্রান্তি আছে। আরবিতে শব্দটি হলো غَطِيطٌ যার অর্থ হলো ঘন নিঃশ্বাস নেয়া কিংবা নাক ডাকা। কিন্তু কেউ কেউ শব্দটির অনুবাদ করেছেন চিঁহিহি করা (Snorting)এটা নাক দিয়ে করা এক ধরণের বিকট শব্দ। ডাক্তার আবদুল রহমান বলেন, Snorting হলে সেটা জেনারালাইজড টনিক ক্লোনিক সিজার হতে পারে অর্থাৎ, কনভালশন। কিন্তু, অস্বাভাবিক শারিরিক নড়াচড়া বা খিঁচুনি এই হাদীসের বর্ণনায় পাওয়া যায় না। শুধু আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিলো যা স্বাভাবিক নাক ডাকার মতন আওয়াজ, আর সেটা কিছুতেই এপিলেপ্সি না।

v একটি গুরুত্বপূর্ন পয়েন্ট হলো—কোনো ঘটনায়ই খিঁচুনি হওয়ার ব্যাপারে কিছু আসে নি। অথচ আরবের লোকেরা খিঁচুনি, এপিলেপ্সি এসবের ব্যাপারে জানতো। এছাড়া টেম্পোরাল লোব এপিলেপ্সি বলে দেয়াই যথেষ্ট না। স্পেসিফাই করতে হবে সেটা কি ডান নাকি বাম টেম্পোরাল লোব এপিলেপ্সি? কোনো লোব সংযুক্ত ছিলো কী-না যেমন প্যারাইটাল লোব অথবা ফ্রন্টাল লোব। বলতে হবে মেসিয়াল নাকি নিওকর্টিকাল? জেনারালাইজড করে টেম্পোরাল লোব এপিলেপ্সি বলে দেয়াই যথেষ্ট না। এগুলোর স্বতন্ত্র লক্ষণ আছে যা ভালোমতো ডায়াগনজ করে দেখতে হয়। মুহাম্মাদের () ডায়াগনসিস থেকে যেই লক্ষণগুলো পাওয়া যায় সেগুলো বিক্ষিপ্ত এবং এপিলেপ্সি প্রমাণের উপযোগী না। প্রত্যেকটির স্বতন্ত্র ব্যাখ্যা দাঁড় করানো যায়। এপিলেপ্সির সবচেয়ে বড় যেই লক্ষণ—খিঁচুনি—অনুপস্থিত হওয়ায় মোটামুটি এপিলেপ্সির সম্ভাবনা বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

 

প্রায় পঞ্চাশ মিনিটের এই আলোচনায় নিউরোলজিস্ট ডা. আবদুল রহমান জ্ঞানগর্ভ একাডেমিক আলোচনা করেন। তাঁর আলোচনা এতোটাই স্বয়ংসম্পূর্ন ছিলো যে, একজন র‍্যাশনাল মানুষ সহজেই কনভিন্সড হতে পারেন। [58]

 

এই লম্বা আলোচনার সারকথা হলো এই যে—মুহাম্মাদের () শৈশবে এপিলেপ্সির রিস্ক ফ্যাক্টর না থাকা, খিঁচুনি না হওয়া, অন্যান্য ফ্যাক্টর না থাকা, আরবরা এপিলেপ্সির অভিযোগ না করা, তাঁর হ্যালুসিনেশন ব্যক্তিগত না হয়ে বরং সাহাবায়ে কেরামসহ প্রত্যক্ষ করা (জীব্রিলকে আ. দেখা এবং ওহীকালীন তাঁর শারিরিক ও পারিপার্শ্বিক বিষয়াদি দেখা), এইসব ঘটনাগুলো সন্দেহাতিতভাবে প্রমাণ করে তিনি এপিলেপ্সিতে ভুগছিলেন না। আর এই বিষয়টি প্রমাণ করার ক্ষেত্রে আমি ঐতিহাসিক ক্লেইমগুলো ঐতিহাসিক ও একাডেমিকদের দ্বারা খন্ডন করেছি। নিউরোলজিস্টদের ক্লেইম নিউরোলজিস্টদের বক্তব্য দিয়ে খন্ডন করেছি। আশা করি, পাঠকের জন্য বিষয়টি সহজ হবে।

 

সিজোফ্রেনিয়া

সিজোফ্রেনিয়া হলো এক ধরণের মানসিক অসুস্থতা। আমেরিকার National Institute of Mental Health (NIMH) বলছে,

 

Schizophrenia is a serious mental illness that affects how a person thinks, feels, and behaves. People with schizophrenia may seem like they have lost touch with reality, which causes significant distress for the individual, their family members, and friends.[59]

অর্থাৎ, সিজোফ্রেনিয়া মানুষের চিন্তা, অনুভূতি এবং ব্যবহারকে প্রভাবিত করে। তারা বাস্তবতার ছোঁয়া হারিয়ে ফেলে।

 

সিজোফ্রেনিয়ার কাদের মধ্যে দেখা যায়? NIMH তাদের রিপোর্টে বলছে, পুরুষদের বয়ঃসন্ধির শেষ থেকে বিশের দশকের শুরুর দিক পর্যন্ত এই রোগে আক্রান্ত হতে দেখা যায়। আর নারীদের বিশের দশকের শুরু থেকে ত্রিশের দশকের শুরু পর্যন্ত সময়ে এই রোগ দেখা যায়। [60] একই কথা বলছে American Psychiatric Association (APA). [61] WHO তাদের রিপোর্টে বলছে, বর্তমানে পৃথিবীতে প্রায় ২০ মিলিয়ন সিজোফ্রেনিয়ার রোগী আছে। [62]

এই সিজোফ্রেনিয়া রোগের লক্ষণগুলো কী কী? American Psychiatric Association (APA) বলছে লক্ষণগুলো তিন ধরণের। [63]

এক—কিছু অস্বাভাবিক বিষয়ের উপস্থিতি। যেমন: হ্যালুসিনেশন—এমন কিছু দেখা বা শোনা যার অস্তিত্ব নেই।

দুই—কিছু স্বাভাবিক বিষয়ের অনুপস্থিতিযেমন: ঠিকঠাক পরিকল্পনা সাজানো, কথা বলা, অনুভূতি প্রকাশ করতে পারার সক্ষমতা অনুপস্থিত থাকা।

তিন—অসংলগ্নতা। যেমন: চিন্তা ও কথাবার্তার অসংলগ্নতা, এলোমেলো ও অস্বাভাবিক আচরণ।

NIMH ও তাদের রিপোর্টে সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণগুলোকে তিনভাগে ভাগ করেছে—সাইকোটিক, নেগেটিভ এবং কগনিটিভ সিম্পটমস। [64]

 

সাইকোটিক সিম্পটমস (Psychotic Symptoms):

হ্যালুসিনেশন—এমন কিছু দেখা বা শোনা যার বাস্তব অস্তিত্ব নাই। ডিলুশন—অবজেক্টিভ ফ্যাক্টবিরোধী বিশ্বাস (প্যারানয়া বা অজানা শক্তির হাতে মৃত্যুর ভয় এটার অন্তর্ভূক্ত)চিন্তার অসংলগ্নতা—অসংগত চিন্তাভাবনা ও এলোমেলো কথা বলা।

 

নেগেটিভ সিম্পটমস (Negative Symptoms):

কথাবার্তা, কাজকর্ম, পরিকল্পনা সবকিছুতে প্রেরণা হারিয়ে ফেলা। অনুভূতি প্রকাশের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলা বিশেষত চেহারার ভঙ্গিতে। বিমর্ষ ও চুপ হয়ে যাওয়া। অসামাজিক হয়ে যাওয়া।

 

কগনিটিভ সিম্পটমস (Cognitive Symptoms):

কথাবার্তা বুঝতে সময় লাগা। তথ্য প্রসেসিং করতে সমস্যা হওয়া। মনে রাখতে না পারা। মনোযোগ ধরে রাখতে না পারা।

 

WHO বলছে [65] সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ চারটি—

·       হ্যালুসিনেশন

·       ডিলুশন

·       অস্বাভাবিক ব্যবহার (লক্ষ্যহীন বসে থাকা, নিজে নিজে হাসা, নিজের ব্যাপারে ঔদাসিন্য)

·       অসংলগ্ন কথাবার্তা

·       অনুভূতি প্রকাশে অসুবিধা

 

তাহলে মোটামুটি সিজোফ্রেনিয়া নিয়ে আমাদের কিছুটা ধারণা হলো। এখন আমরা এই লক্ষণগুলো মুহাম্মাদের () সাথে মেলাতে চেষ্টা করবো।

 

সিজোফ্রেনিয়া পুরুষদের হয় বয়ঃসন্ধির শেষ থেকে বিশের দশকের শুরুর কয়েক বছর পর্যন্ত। অথচ, মুহাম্মাদের () নবুয়ত শুরুই হয়েছিলো ৪০ বছর বয়সে! প্রশ্ন আসে, তাঁর যদি আগে থেকেই সিজোফ্রেনিয়া থেকে থাকে? কিন্তু নবুয়তের আগের জীবন সম্পর্কেও ইতিহাসে যা পাওয়া যায়, তাতে তাঁর কোনো ধরণের কোনো মানসিক রোগের আলাপ পাওয়া যায় না যদি তাঁর কোনো মানসিক রোগ তখন থেকে থাকতো, তবে তাঁর বিরোধিতাকারীদের জন্য তাকে প্রত্যাখ্যান করা সহজ হয়ে যেতো তারা বলতে পারতোএই লোক তো এমনিই পাগল, তার কথা আর কী শুনবো!

 

এবার চলুন বাকি লক্ষণগুলোর দিকে নজর দেয়া যাক!

 

হ্যালুসিনেশন/ডিলুশন:

এমন কিছু জিনিস দেখা বা শোনা যা বাস্তবে নেই। অথবা অবজেক্টিভ ফ্যাক্ট এর বিপরীত কোনো কিছু কিংবা জাগতিক ব্যাখ্যা দেয়া যায় না এমন কিছু এক্সপেরিয়েন্স করা। কোনো ঘটনার জাগতিক ব্যাখ্যা না দেয়া গেলেই সেটা ঘটেনি—এমনটা বলা যায় কী-না তা আমরা তৃতীয় অধ্যায়ে আলোচনা করবো। তাও ছোট করে বলি, বিজ্ঞান সুপারন্যাচারাল বিষয়ে চুপ থাকে আছে কিংবা নেই, এরকম কোনো মন্তব্য করে না এটা হলো মেথোডোলজিকাল ন্যাচারালিজম অর্থাৎ, বিজ্ঞান প্রতিটি ঘটনার জাগতিক ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করে কিন্তু, সুপারন্যাচারাল বলতে কিছুই নেই, ন্যাচারই সব, এর বাইরে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই এমনটা বলাফিলোসফিকাল ন্যাচারালিজম যা একটি দার্শনিক অবস্থান, বৈজ্ঞানিক নয় তাই, কেউ সুপারন্যাচারালে বিশ্বাস করলেই সেটা ডিলুশন হবে, এমনটা বলা যায় না সেক্ষেত্রে ধর্মে বিশ্বাসী পৃথিবীর কয়েক বিলিয়ন মানুষকেই সিজোফ্রেনিয়ার রোগী বলতে হবে যাহোক, আপাতত দেখা যাক, মুহাম্মাদ () কি একাই সবকিছু হ্যালুসিনেট করছিলেন কী-না। কয়েকটি ঘটনার দিকে তাকালে মনে হয়—জীব্রিল (আ), ওহী আসা, মিরাজে যাওয়া—এই সবই বুঝি তাঁর হ্যালুসিনেশন! কিন্তু আরো কিছু ঘটনা আমাদেরকে এমন উপসংহারে আসতে বাধা দেয়। তার প্রথমটি হলো বিখ্যাত হাদীসে জীব্রিল। [66] যদি জীব্রিল (আ) কেবলমাত্র মুহাম্মাদের () একার হ্যালুসিনেশনই হবেন, তবে সাহাবাগণ তাঁকে কীভাবে দেখলেন? এছাড়াও পূর্বে উল্লেখিত Pre Revelation Episode (PRE) গুলো খেয়াল করলে দেখবো ৩, ৪, ৫, ৬, ৯, ১০ এই ঘটনাগুলোয় স্বয়ং সাহাবায়ে কেরাম প্রত্যক্ষ করছিলেন ওহী নাযিলের সময় উদ্ভুত বিভিন্ন পরিস্থিতি। ওহী নাযিলের সময় ওহীর ভারে জন্তুগুলো বসে পড়া, ওহীর ভারে সাহাবীর উরু ভেঙে যাওয়ার উপক্রম, চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়া প্রত্যক্ষ করা, গাছের কান্না প্রত্যক্ষ করা—এই ঘটনাগুলো  কিন্তু সাহাবারা প্রত্যক্ষ করেছেন। এগুলো কিন্তু মুহাম্মাদের () সাবজেক্টিভ অভিজ্ঞতা না। তাই, যদি বলতে হয় তাঁর হ্যালুসিনেশন হয়েছিলো, তবে বলতে হবে এইসব সাহাবাগণেরও হ্যালুসিনেশন হয়েছিলো। একজন দুজন সাহাবী না কিন্তু, অসংখ্য সাহাবীর সাক্ষ্য আছে। কিন্তু, এর চেয়ে সহজ হলো—এই সহজ কথাটি স্বীকার করে নেয়া যে মুহাম্মাদের () হ্যালুসিনেশন হয় নি।   

 

অস্বাভাবিক কর্মকান্ড:

উপরে উল্লিখিত সবগুলো রিপোর্টকে একত্র করলে অস্বাভাবিক কর্মকান্ডের যেই লিস্ট পাওয়া যায় তা হলো—

·       পরিকল্পনা মাফিক কাজ করতে না পারা।

·       অসংলগ্ন কথাবার্তা বলা।

·       নিজে নিজে হাসা, ঔদাসিন্য ও লক্ষ্যহীন বসে থাকা

 

যারা মুহাম্মাদকে () নিয়ে মোটামুটি পড়াশোনা করেছে, তারা খুব ভালো করেই জানবেন—তাঁর মধ্যে এসব লক্ষণ অনুপস্থিত ছিলো। পাঠকের সুবিধার্থে আমরা প্রতিটি লক্ষণই যাচাই করে দেখবো।

পরিকল্পনা মাফিক কাজ তিনি করতে পারতেন কী-না তা তো তাঁর যুদ্ধ পরিচালনা এবং রাষ্ট্র পরিচালনা দেখেই বোঝা যায়। আবিসিনিয়ায় হিজরত, মদীনার সনদ, আহযাবের যুদ্ধ কৌশল, হুদায়বিয়ার সন্ধি, রাজাদের কাছে পত্রপ্রেরণ ইত্যাদি তাঁর যুদ্ধকৌশল এবং ডিপ্লোম্যাসির অনন্য উদাহরণ। এমনকি তাঁর যুদ্ধকৌশল বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন আধুনিক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনগুলোও ব্যবহার করছে। [67] নেতা হিসেবে তিনি যে অনন্য ছিলেন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। American Research Institute for Policy Development ২০১৯ সালে একটি জার্নাল প্রকাশ করে “An Analysis of Strategic Leadership Effectiveness of Prophet Muhammad (PBUH) Based on Dave Ulrich Leadership Code” নামে। এই রিসার্চে তারা মুহাম্মাদের জীবনের ২৬টি ঘটনা পর্যালোচনা করে এবং দেখতে পায় ডেইভ আলরিচের লিডারশীপ কোডের ৫টি শর্তই তিনি পূরণ করেন। যার ফলে তারা এই উপসংহারে আসতে বাধ্য হয় যে, তিনি একজন কৌশলী এবং দক্ষ নেতা ছিলেন। [68] প্রাচ্যবিদ উইলিয়াম মন্টগমেরি ওয়াট তার বইয়ে মুহাম্মাদকে () দূরদর্শী, প্রজ্ঞাবান রাষ্ট্রনায়ক এবং দক্ষ প্রশাসক বলেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর মুসলিমদের তেরোশত বছর শাসন করাকেও তিনি মুহাম্মাদের () কুরআন এবং হাদীস শিক্ষাদানের ফসল বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, কুরআন এবং হাদীস ফ্রেমওয়ার্ক দিয়েছে যা অনুসরণ করে মুসলমানরা এত বছর শাসন করেছে। [69] জন এল. এসপসিতো তার Islam: The Straight Path বইয়ে মুহাম্মাদকে () “বিচক্ষণ সমর কুশলী” বলেছেন। [70] আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী, শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী লেখক মাইকেল এইচ. হার্ট তার বিখ্যাত “The 100: A Ranking Of The Most Influential Persons In History” বইয়ে ইতিহাসের সবচেয়ে প্রভাব বেশি প্রভাববিস্তারকারী মানুষদের র‍্যাংকিং করেছেন এবং এক নম্বরে রেখেছেন মুহাম্মাদকে ()[71] রাষ্ট্রপ্রধান ও রাজনীতিবিদ হিসেবে মুহাম্মাদ () কতোটা দক্ষ ছিলেন তা নিয়ে রিসার্চও আছে। যেমন— Universiti Sains Islam Malaysia এর MAM Nizah এবং অন্যরা Prophet Muhammad (PBUH): The Savvy Politician নামে একটি পেপার পাবলিশ করেন ২০১২ সালে। এই পেপারে একজন রাজনীতিবিদ, সমরবিদ ও রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে মুহাম্মাদের () অনন্যতা তুলে ধরা হয়। [72] পরিকল্পনা মাফিক কাজে তিনি দক্ষ ছিলেন এর আরেকটা উদাহরণ হলো—তিনি একটা নিয়মমাফিক জীবনযাপন করতেন। রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমোতেন, ভোররাতে উঠে সালাত আদায় করতেন, ফজরের পর বেরিয়ে যেতেন, দুপুরে খাওয়ার পর হালকা বিশ্রাম নিতেন, সাহাবাদের নিয়ে বসতেন, দ্বীন নিয়ে আলাপ করতেন, স্ত্রীদের সময় দিতেন। এভাবে তাঁর প্রতিটি কাজই ছিলো নিয়মমাফিক।

 

তাঁর কথাবার্তা মোটেই অসংলগ্ন ছিলো না। তিনি অপ্রয়োজনে কথা বলতেন না এবং অপ্রয়োজনীয় কথা বলতে নিরুৎসাহিত করেছেন। তিনি ছিলেন বাকপটু। তাঁর কথা শুনে মুগ্ধ হয়ে অমুসলিমরা ইসলাম গ্রহণ করতো। ২০১৯ সালে English Language and Literature International Conference (ELLIC) একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। এটিতে মুহাম্মাদের () ৩৪টি বক্তব্যের ওপর গবেষণা করা হয়। গবেষণায় দেখা যায়, তিনি যখন অমুসলিমদের সাথে কথা বলতেন, তিনি Negative politeness এবং off-record politeness এই দুইটি ধরণ ফলো করতেন। এই কথা বলার ধরণ অমুসলিমদের ইসলাম গ্রহণে সহায়ক হতো। তারা রিপোর্টে বলেন,

 

“Those are the pattern of Prophet Muhammad's speech and the choice of politeness strategies used by the Prophet Muhammad, so that Islamic preaching can spread throughout the world. This proves that the Prophet Muhammad's communication strategy was very good.” [73]

 

প্রায় একই রকম আরেকটি গবেষণা করে Universiti Sains Islam Malaysia এর Islamic Science Institute. তারা মুহাম্মাদের () কথার মাঝে মাঝে চুপ থাকার বিষয়টি গবেষণা করে এবং দেখায় যে, এটাও একটা কমিউনিকেশন স্ট্রাটেজি ছিলো। [74] আরেকটি রিসার্চে তাঁর কথোপকথনের প্যারালিঙ্গুইস্টিক ফিচারগুলোকে বিশ্লেষন করা হয়। দেখা যায় তিনি ফিচারগুলো দারুণভাবে ব্যবহার করতেন। তিনি খুব বিনয়ীভাবে কথা বলতেন, গলার স্বর নিচু ও নরম রাখতেন, ধীরে ধীরে কথা বলতেন যাতে কথা বোঝা যায় ও স্মরণ রাখা যায়। তিনি গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো তিনবার করে উচ্চারণ করতেন যাতে সেগুলোর গুরুত্ব বোঝা যায় এবং শ্রোতার হৃদয়ে গেঁথে যায়। তিনি যেখানে প্রয়োজন সেখানে হাত নেড়ে বোঝাতেন। নিজের কথার ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ ছিলো। অপ্রয়োজনে কথা বলতেন না। কথা বলার সময় হাসিমুখে কথা বলতেন। কেউ কথা বললে তাকে মনোযোগ দিয়ে শুনতেন ও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতেন। কথা বলার সময় অল্প কয়েকজন শ্রোতার দিকে না তাকিয়ে সবার দিকে তাকাতেন। কেউ রূঢ় কথা বললে ধৈর্য, নিরবতা ও হাসির মাধ্যমে প্রত্যুত্তর করতেন। [75] এছাড়া তাঁর বিদায় হজ্বের ভাষণ সুসংগঠিত কথা বলতে পারার এক উজ্জ্বল প্রমাণ।

 

নিজে নিজে হাসা বিষয়টি মুহাম্মাদের () মাঝে ছিলো না। এরকম কোনো বর্ণনা হাদীসে বা ইতিহাসে পাওয়া যায় না। আর ঔদাসিন্য তো তাঁর মাঝে আরো অনুপস্থিত ছিলো। এই ঔদাসিন্য অনেকটা উদাস হয়ে বসে থাকা, স্থান-কাল-পাত্রের হিসেব না থাকা, খাওয়া-ঘুম ইত্যাদির খেয়াল না থাকা, এসবকে বোঝায়। কিন্তু মুহাম্মাদ () একেবারেই এমন ছিলেন না। তিনি উদাস হয়ে বসে থাকতেন না কখনোই। বরং তিনি ছিলেন সক্রিয় একজন মানুষ। তিনি অলসতা অপছন্দ করতেন। এটিকে একটি রোগ হিসেবে চিহ্নিত করতেন এবং এর থেকে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতেন। [76] একজন উদাসীন মানুষ যুদ্ধ পরিচালনা, রাষ্ট্র পরিচালনা, বিচারকের দায়িত্ব পালন, স্ত্রীদের অধিকার আদায়, প্রতিবেশি ও আত্মীয়স্বজনের খেয়াল রাখা, এইসব কাজ করতে পারেন না। উদাসীন একজন মানুষ মদীনায় টিকে থাকতে পারতেন না চারপাশে শত্রুদের রেখে। একদিকে কুরাইশ, অন্যদিকে ইহুদীরা। এই পরিস্থিতিতে তিনি নিয়মিত অভিযান প্রেরণ করতেন, কুরাইশদের খোঁজ রাখতেন, ইহুদীদের ষড়যন্ত্রের খবরও রাখতেন। সবকিছু মাথায় রেখে পরিকল্পনা সাজাতেন। উদাসীন মানুষ এসব পারবেনা। এছাড়া একজন উদাসীন মানুষ ৬০০০ এর অধিক কুরআনের আয়াত ব্যাখ্যা ও প্রয়োগক্ষেত্র সহ মনে রাখতে পারেন না।

 

অনুভূতি প্রকাশে অক্ষমতা:

সিজোফ্রেনিয়ার রোগীদের একটি বৈশিষ্ট্য হলো তারা ঠিকঠাক অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে না। বিশেষ করে তাদের চেহারায় অনুভূতি প্রকাশ পায় না। অথচ, মুহাম্মাদ () ছিলেন অনুভূতির আধার।

 

হাসি: আবদুল্লাহ বিন হারেস (রা.) বলেন, “আমি রাসূল (সা.) অপেক্ষা অধিক মুচকি হাসতে আর কাউকে দেখিনি।” [77]  জারির বিন আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, “আমি ইসলাম গ্রহণ করার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর গৃহে প্রবেশ করতে কোনদিন আমাকে বাঁধা প্রদান করেন নি এবং যখনই আমাকে দেখেছেন মুচকি হাসি দিয়েছেন[78] আয়িশা (রা.) বলেন, “তিনি মুচকি হাসতেন।” [79]

 

কান্না:

আবদুল্লাহ্ ইবনু মাস‘ঊদ (রা.) হতে বর্ণিত, “একদিন নবী (সা.) বললেন তুমি কুরআন পাঠ করো...যখন আমি এই আয়াত পর্যন্ত আসলাম... নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আপাততঃ যথেষ্ট হয়েছে। আমি তাঁর চেহারার দিকে তাকালাম, দেখলাম, তাঁর চোখ থেকে অশ্রু ঝরছে[80] ইবনে মাসঊদ (রা.) বর্ণনা করেন, “রাসূল (সা.) হামযা বিন আবদুল মুত্তালিবের জন্য যেভাবে কেঁদেছেন, তার চেয়ে বেশি কাঁদতে আমরা তাঁকে কখনো দেখিনি।” [81]

 

রাগ:

আবূ মাস‘ঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, “এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে বললেনঃ অমুক ব্যক্তি সালাত দীর্ঘ করে। যে কারণে আমি ফজরের সালাত থেকে পিছনে থাকি। বর্ণনাকারী বলেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে কোন ওয়াজের মধ্যে সেদিনের চেয়ে অধিক রাগান্বিত হতে দেখিনি[82] যায়দ ইবনু খালিদ আল-জুহানী (রাযি.) হতে বর্ণিত, “....এ কথা শুনে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন রাগ করলেন যে, তাঁর গাল দু’টো লাল হয়ে গেল। অথবা বর্ণণাকারী বলেন, তাঁর মুখমন্ডল লাল হয়ে গেল[83]

 

এছাড়াও বিমর্ষ হওয়া, আশ্চর্য হওয়া, চেহারা মলিন হওয়া এসব অনুভূতিও তাঁর চেহারায় প্রকাশ পেতো যা বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। অর্থাৎ, অনুভবশূন্যতা কিংবা অনুভূতি প্রকাশে অক্ষমতা তাঁর ছিলো না।

 

সিজোফ্রেনিয়ার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন খোদ মুহাম্মাদের () বিরুদ্ধে এপিলেপ্সির অভিযোগ আনা নিউরোলজিস্ট ফ্রিমন। তিনি তার পেপারে লিখেছেন,

 

“...it is unlikely that the dull effect of the schizophrenic would have inspired the tenacious loyalty of the early followers. It is also unlikely that a person with loose associations and other elements of schizophrenic thought disorder could guide the political and military fortunes of the early Islamic state.[84]

 

এ তো স্রেফ খণ্ডিত আলোচনা, ছোট আলোচনায় সম্পূর্ন জীবন তুলে আনা যায় না। যদি যেতো, তবে হয়তো অভিযোগ সুস্পষ্টরূপে খণ্ডন করা যেতো। আমার বিশ্বাস, সীরাত তথা মুহাম্মাদের () জীবনী পড়লে পাঠকগণ কিংবা যেকোনো সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ এপিলেপ্সি আর সিজোফ্রেনিয়ার অভিযোগ নিজে নিজেই খণ্ডন করতে পারবেন। সেজন্য প্রয়োজন হবেনা কোনো নিউরোলজিস্ট, প্রয়োজন হবে না কোনো এক্সপার্ট, প্রয়োজন হবে কেবল আন্তরিকতা।

 

এ ব্যাপারে আরো দেখুনঃ

 

রাসূল (সা:) এর মানসিক সুস্থতা নিয়ে অপপ্রচারকারীদের অভিযোগ খণ্ডন - আসিফ মাহমুদ

https://youtu.be/yBxEz1vlAVs

 

 

তথ্যসূত্রঃ


[1] সহিহ বুখারী, সূর্যগ্রহণ অধ্যায়, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, হাদিস নং ১০৪৩।

[2] সহিহ বুখারী, সূর্যগ্রহণ অধ্যায়, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, হাদিস নং ১০৪১।

[3] সহীহ বুখারী, ঈমান অধ্যায়, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, হাদিস নং ৫০।

[4] সহীহ মুসলিম, ঈমান অধ্যায়, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদিস নং ১।

[8] Temkin, O., 1994. The falling sickness: a history of epilepsy from the Greeks to the beginnings of modern neurology (Vol. 4). JHU Press.

[9] Lennox WG, Lennox-Buchthal MA. Epilepsy and related disorders. Little, Brown; 1960.

[10] Freemon FR. A differential diagnosis of the inspirational spells of Muhammad the Prophet of Islam. Epilepsia 1976; [17:4237]  [ https://cutt.ly/Cb1y1EU ]

[11] Gibbon E, Milman D, Guizot M, Smith W, editors. The history of the decline and fall of the Roman Empire. 8th ed. London: John Murray; 1887. p. 259.  Available from: https://cutt.ly/Lb9XPdz

[12] Carlyle T. Heroes, Hero worship and the Heroic in history.

[13] Aziz H. Did Prophet Mohammad (PBUH) have epilepsy? A neurological analysis. Epilepsy & Behavior. 2020 Feb 1;103:106654. Available from: https://cutt.ly/Sb1QAAq

[14] Neurologist debunks ex-Muslim! [Epilepsy Argument Deflated] Watch on: https://cutt.ly/Tb9XYpM

[15] Theophanes. Anni Mundi 60956305, A.D. 602813 (The Middle Ages) Trans Turtledove H., The chronicle of Theophanes. Philadelphia: University of Pennsylvania Press; 1982; 345. https://bit.ly/2S6Uxfo

[16] আর রাহিকুল মাখতুম, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, পৃঃ ৮৬।

[17] নবীয়ে রহমত, সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. , মুহাম্মদ ব্রাদার্স পাবলিকেশন্স, পৃঃ ১১৫।

[18] সীরাতুর রাসূল (ছাঃ), মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল গালিব, হাদীছ ফাউন্ডেশন, পৃঃ ৭১।

[19]  Is Quran Copied from Bible? https://cutt.ly/yb0k1dH

[20] 200+ way the Quran corrects the Bible: How Islam Unites Judaism and Christianity by Mohammed Ghounem. https://cutt.ly/1b0kV9y

[21] The Bible, the Qu'ran and Science: The Holy Scriptures Examined in the Light of Modern Knowledge by Dr. Maurice Bucaille.

[22] সীরাতুন নবী (স.) (ইবনে হিশামের অনুবাদ), ইসলামিক ফাউন্ডেশন, প্রথম খন্ড, পৃঃ ১৭৭। 

[23] সীরাতুর রাসূল (ছাঃ), মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল গালিব, হাদীছ ফাউন্ডেশন, পৃঃ ৭৬।

[24] আর রাহিকুল মাখতুম, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, পৃঃ ৯৬।

[25] মুহাম্মাদ () কি ওয়ারাকার কাছ থেকে সব শিখেছিলেন? https://cutt.ly/ib4hhAO

[26] Prideaux H. The true nature of imposture fully displayed in the life of Mahomet. London: Printed for E. Curll, J. Hooke,W. Mears and F. Clay; 1723:16. Available from: https://bit.ly/3tY31mw

[27] Gibbon E, Milman D, Guizot M, Smith W, editors. The history of the decline and fall of the Roman Empire. 8th ed. London: John Murray; 1887. p. 259.  Available from: https://cutt.ly/Lb9XPdz

[28] Carlyle T. Heroes and hero worship and the heroic in history. , vol. 61 Philadelphia: Henry Altemus; 1899. Available from: https://archive.org/stream/heroesheroworshi99carl?ref=ol#page/60/mode/2up

[29] 'Muhammad: Prophet and Statesman' By William Montgomery Watt, Page 18

https://is.gd/K3phBS

[30] Davenport J. An apology for Mohammed and the Koran. , vol. 14London: J. Davy and sons; 1869. Available from

https://archive.org/details/anapologyformoh01davegoog/page/n23

[31] Temkin, O., 1994. The falling sickness: a history of epilepsy from the Greeks to the beginnings of modern neurology (Vol. 4). JHU Press.

[32] Muir W. The life of Mahomet. With introductory chapters on the original sources for the biography of Mahomet, and on the pre-islamite history of Arabia. Vol 1 London: Smith, Elder and Co; 1861; 203. Available from: https://cutt.ly/7b9Xjs7  

[33] দলীল ১: ইমাম বুখারি রাহ লিখেছেন, ইমাম মালিক ও মা'মার (রাহ) ওয়াকিদীর ব্যাপারে নিরব ছিলেন, আর ইমাম আহমাদ ও ইবন মুনির (রাহ) তাঁকে পরিত্যাগ করেছিলেন (তার বর্ণনা)- আত তারিখুল কাবির: ১/৫০২

ইবারাত : عَنْ مَعمَرٍ، ومالكٍ(1).سَكَتوا عنه.تَرَكه أحمدُ، وابنُ نُمَيرٍ

এই নীরবতার মানেও পরিত্যাগ করাই।

দলীল ২: ইমাম বুখারি অন্যত্র বলেন - محمد بن عمر ‌الواقدي: قاضي بغداد، عن مالك، ومعمر، متروك الحديث،

মুহাম্মাদ বিন উমার আল ওয়াকিদী, বাগদাদের কাযি ছিলেন। ইমাম মালিক ও মা'মার হতে বর্ণিত আছে যে তিনি মাতরুকুল হাদিস বা হাদিস বর্ণনায় পরিত্যাজ্য ছিলেন.” -কিতাবুত দু'আফা, পৃ: ১২৩

ইমাম শাফিঈ (রাহ) বলেছেন , كتب الواقدي كذب

আল ওয়াকিদী মিথ্যা লিখেছেন।” [ইমাম ইবন আবি হাতিম, আল জাররহ ওয়াত তা'দিল ৮/২১]

দলীল ৩: ইমাম ইয়াহইয়া বিন মাঈন (রাহ) বলেন, لا يكتب حديث الواقدي

আল ওয়াকিদির হাদিস লেখা হবেনা.” [প্রাগুক্ত]

দলীল ৪: ইমাম আলী ইবনুল মাদিনী (রাহ) বলেছেন, : متروك

সে পরিত্যাজ্য।” [প্রাগুক্ত]

দলীল ৫: ইমাম আহমাদ (রাহ) বলেন, هو كذاب، يقلب الأحاديث

সে মিথ্যবাদী ছিল, হাদিস গুলিয়ে ফেলত।

[ইমাম যাহাবী, মিযানুল ই'তিদাল: ৩/৬৬৩]

দলীল সরবরাহে: উস্তাদ মনযুরুল করীম (হাফি.)

[34] সীরাতুন নবী (স.) (ইবনে হিশামের অনুবাদ), ইসলামিক ফাউন্ডেশন, প্রথম খন্ড, পৃঃ ১৬১।

[35] Syed Ahmed Khan, Essays On the Life of Muhammad. পৃঃ ৪৯৩।  Available from: https://bit.ly/3ytoerR

[36]  Muhammed Mohar Ali, Sirat Al Nabi and the Orientalists, পৃঃ ১৫৭।

[37] Syed Ahmed Khan, Essays On the Life of Muhammad, PREFACE.

[38] John Davenport, Apology for Mohammed and the Koran.

[39] Syed Ahmed Khan, Essays On the Life of Muhammad. পৃঃ ৪৯৬।

[40] Freemon FR. A differential diagnosis of the inspirational spells of Muhammad the Prophet of Islam. Epilepsia 1976; [17:4237]  https://cutt.ly/Cb1y1EU

[41] আর রাহিকুল মাখতুম, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, পৃঃ ১০৮।

[42] বাংলায় অনুবাদের সময় এপিলেপ্সীকে মৃগী হিসেবে উল্লেখ করা হয়, যদিও এটি মৃগী নয়। বরং এটি আরো বৃহদার্থে ব্যবহৃত হয়।

[43] সহীহ বুখারী, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, ৫৬৫২।

[44]  Khaldûn Ibn. In: Rosenthal F, Dawood NJ, Lawrence BB, editors. The Muqaddimah: an introduction to history. Trans. Princeton: Princeton University Press; 2005.

[45] সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদীস নং ৩।

[46] সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদীস নং ৫৮৫১।

[47] সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদীস নং ৫৮৫০।

[48] সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদীস নং ৫৮৫২।

[49] যাদুল মাআদ – ইবনুল কাইয়িম জাওযিয়্যাহ(র.), পৃষ্ঠা ৪৭ http://tiny.cc/u7kwtz

[50] সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদীস নং ২৬৩৩।

[51] আল ফাতহুর রাব্বানী ২০/২১২;

উলুমুল কুরআন – মুফতি তাকি উসমানী (মাকতাবাতুল হারামাইন), পৃষ্ঠা ৪৮

[52] সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদীস নং, ১;

 যাদুল মাআদ – ইবনুল কাইয়িম জাওযিয়্যাহ(র.), পৃষ্ঠা ৪৭ http://tiny.cc/u7kwtz

[53] যাদুল মাআদ – ইবনুল কাইয়িম জাওযিয়্যাহ(র.), পৃষ্ঠা ৪৭ http://tiny.cc/u7kwtz

[54] আল ইতকান ১/৪৬;

উলুমুল কুরআন – মুফতি তাকি উসমানী (মাকতাবাতুল হারামাইন), পৃষ্ঠা ৫১

[55] আহমাদ ১/৩৪

[56] সহীহ মুসলিম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদীস নং ২৬৬৯।

[57] Bible, Pentateuch (Torah), Exodus 3:6.

[58] Neurologist debunks ex-Muslim! [Epilepsy Argument Deflated] Watch on: https://cutt.ly/Tb9XYpM 

[59] Schizophrenia Report by NIMH, May 2020. https://cutt.ly/7nhTwae

[60] প্রাগুক্ত।

[65] Schizophrenia Report by NIMH, May 2020. https://cutt.ly/7nhTwae

[66] সহীহ বুখারী, ঈমান অধ্যায়, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, হাদিস নং ৫০।

[67] Zandi G, Joupari NZ, Aslam A. The Strategies in the Battles and Struggles of Prophet Muhammad: How It Can Be Applied in Modern Business. International Business Research.  Available from: https://cutt.ly/Fnk2bXM

[68] Ahmed, Gouher, and Nabeel Al Amiri. “An analysis of strategic leadership effectiveness of prophet muhammad (pbuh) based on dave ulrich leadership code.” Journal of Islamic Studies and Culture 7.1 (2019): 11-27. Available from: https://cutt.ly/tnzjixY

[69] William Montgomery Watt, Muhammad: Prophet and Statesman, page– 237.

[70] Islam: The Straight Path, John L. Esposito, page – 33.

[71] Michael H. Hart, The 100: A Ranking Of The Most Influential Persons In History.

[72] Nizah, Mohd Azmir Mohd, et al. "Prophet Muhammad (PBUH): The Savvy Politician." (2012). Available from: https://cutt.ly/KnlrWB5

[73] Alhamidi, Wilda Zaki, Dwi Purnanto, and Djatmika Djatmika. "SPEECH ACT AND POLITENESS STRATEGY OF RASULULLAH MUHAMMAD SAW ON THE BOOK OF HADITH BUKHARI." English Language and Literature International Conference (ELLiC) Proceedings. Vol. 3. 2021. Available from: https://cutt.ly/Onzf4Cm

[74] Jamilin, A.K. & Kasmani, Faizal & Hashim, N. & Mohd Ghazali, Norzulaili & Muhamad, Nurul & Jaafar, Nur. (2017). Prophetic approaches in communication: A pilot analysis of hadith prophet muhammad. Advanced Science Letters. 23. 4872-4876. 10.1166/asl.2017.8934. Available from: https://cutt.ly/nnzlysU

[75] Ali, Syed Shujaat, Muhammad Ishtiaq, and Munir Khan. "Conversation Analysis of Muhammad (PBUH) for exploring his Effective Use of Nonverbal Communication including Paralinguistic Features." Rahatul quloob 3.2 (2) (2019): 75-86. Available from: https://cutt.ly/MnzbfPM

[76] সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদীস নং ২৬৯১।

[77] মুসনাদে আহমাদ, ১৭৭৪০।

[78] সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদীস নং ৩৫৪৯।

[79] সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদীস নং ৫৫৪৯।

[80] সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদীস নং ৪৬৮১।

[81] আর রাহিকূল মাখতুম, তাওহীদ পাবলিকেশন্স, পৃ: ৩২৩।

[82] সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদীস নং ৫৫৬৭।

[83] সহীহ বুখারী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, হাদীস নং ৯১।

[84] Freemon FR. A differential diagnosis of the inspirational spells of Muhammad the Prophet of Islam. Epilepsia 1976; [17:4237]  https://cutt.ly/Cb1y1EU