লিখেছেনঃ মুহাম্মাদ আব্দুল মাবুদ
এখানে আমি কিছুটা বিস্তারিতভাবে মূল হাদিসটিই উল্লেখ করছি।
أَنَّهُ سَمِعَ أَبَا هُرَيْرَةَ، يَقُولُ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " اشْتَكَتِ النَّارُ إِلَى رَبِّهَا فَقَالَتْ يَا رَبِّ أَكَلَ بَعْضِي بَعْضًا . فَأَذِنَ لَهَا بِنَفَسَيْنِ نَفَسٍ فِي الشِّتَاءِ وَنَفَسٍ فِي الصَّيْفِ فَهُوَ أَشَدُّ مَا تَجِدُونَ مِنَ الْحَرِّ وَأَشَدُّ مَا تَجِدُونَ مِنَ الزَّمْهَرِيرِ
অর্থঃ আবূ হুরায়রা(রা)কে বলতে শুনেছি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, "জাহান্নাম তার রবের কাছে অভিযোগ করল “হে রব, আমার কিছু অংশ কিছু অংশকে খেয়ে ফেলছে। অতঃপর তাকে অনুমতি দিলেন দুটি নিঃশ্বাসের ব্যাপারে একটি নিঃশ্বাস শীতে আর একটি নিঃশ্বাস গ্রীষ্মে। অতঃপর সেটা হল গরম থেকে যে তীব্রতা অনুভব কর আর শীত থেকে যে তীব্রতা তোমরা অনুভব কর। [1]
১।
জাহান্নামের নিঃশ্বাস, কথা বলা এগুলো কি সম্ভব?
এই প্রশ্নের উত্তর আল কুরআনের শুরুতেই দেওয়া হয়েছে
الَّذِينَ يُؤْمِنُونَ بِالْغَيْبِ
অর্থঃ “যারা ‘গায়েব’ এ বিশ্বাস করে...” [2]
‘গায়েব’ এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে যা আমাদের কাছে অদৃশ্য বা অনুপস্থিত।
ইসলামের পরিভাষায় ‘গায়েব’ বলা হয় যা শুধুমাত্র আল্লাহ তায়ালাই জানে। কেউ নিজে থেকে জ্ঞানবুদ্ধি খাটিয়ে তা জানতে পারে না যতক্ষণ না আল্লাহ তায়ালা "ওহী "ইত্যাদির মাধ্যমে তার সংবাদ জানিয়ে দেন।
আবূ ইসহাক(র) আয়াতের ব্যাপারে বলেন,
"তারা ঈমান আনে ‘গায়েব’ এর ব্যাপারে যার ব্যাপারে রাসূল(ﷺ) সংবাদ দিয়েছেন যেমন জান্নাত,জাহান্নাম,পুনরুথান ইত্যাদি"। [3]
একইভাবে, “‘গায়েব’ দ্বারা উদ্দেশ্য জান্নাত, জাহান্নাম ইত্যাদি” - বলেছেন আল্লামা সূয়ুতী(র)। [4]
অনেকের ভুল ধারণা ‘গায়েব’ মানে যা জ্ঞানবুদ্ধির বিপরীত।
কিন্তু ‘গায়েব’ এর শাব্দিক অর্থ, পারিভাষিক অর্থ এবং সালাফদের বক্তব্য থেকে প্রমাণিত হয় ‘গায়েব’ মানে সুস্থ জ্ঞানবুদ্ধির বিপরীত নয় বরং জ্ঞানবুদ্ধির উর্ধ্বের বিষয়।
"খেলাফুল আকলিস সালিম" নয় বরং তা হল "ফাওকাল আকল"।
সুস্থ জ্ঞানবুদ্ধির বিপরীত বিষয়ের উদাহরণ হল ১=০ অথবা ১+১+১=১ ইত্যাদি বলা।
আর জ্ঞানবুদ্ধির উর্ধ্বে এমন বিষয়ের উদাহরণ হল 'ক্লাস টু'র ছাত্রের কাছে উচ্চতর গণিত এর অংকের মত।
ইসলামে এমন অনেক বিষয় আছে যা "ফাওকাল আকল" বা "লা য়ুদরিকুহুল আকল" অর্থাৎ জ্ঞানবুদ্ধি যা আয়ত্ত্বে আনতে পারে না কিন্তু এমন একটি বিষয়ও নেই যা 'খিলাফুল আকলিস সালিম ' তথা সুস্থ জ্ঞানবুদ্ধির বিপরীত।
সুতরাং জাহান্নামের ব্যাপারে যাবতীয় সংবাদ যেহেতু ‘গায়েব’ এর অন্তর্ভুক্ত তাই বলতে পারি এগুলো আমাদের জ্ঞানবুদ্ধির আয়ত্ত্বে এখনো না আসলেও এগুলো যে সুস্থ জ্ঞানবুদ্ধির বিপরীত তা বলা অযৌক্তিক। তাই আমরা "আন নাবিউস সাদিক" সত্যবাদী নবী এর দেওয়া সংবাদ অনুসারে এসব ‘গায়েব’ সংশ্লিষ্ট বিষয় এর উপর ঈমান এনে থাকি।
তবে জাহান্নামের কথা বলা, নিঃশ্বাস নেওয়া যে জ্ঞানবুদ্ধির বিপরীত নয় তা আমরা সহজেই বুঝতে পারি।
যেমন আধুনিক যুগে এসে মানুষ আবিষ্কার করছে বিভিন্ন পশুপাখি জীবজন্তু একে অপরের সাথে কথা বলে,গাছপালাও শ্বাসপ্রশ্বাস গ্রহণ করে তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে। [5]
এখন কেউ যদি প্রশ্ন করে “এই পশুপাখি কিভাবে কথা বলতে পারে, গাছপালা কিভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস ফেলতে পারে এটি তো জ্ঞানবুদ্ধির বিপরীত দাবী” - তখন তাকে বলা হবে পশুপাখি মানুষের মত কথা বলেনা তারা তাদের মত করে কথা বলে। গাছপালা মানুষের মত নিঃশ্বাস নেয় না তারা তাদের মত করে নেয়।
এখানেও ঠিক তেমনি কেউ যদি প্রশ্ন করে জাহান্নাম কিভাবে কথা বলে, কিভাবে নিঃশ্বাস ফেলে, তাহলে তাকে বলা হবে জাহান্নাম জাহান্নামের মেকানিজম অনুযায়ী কথা বলে, নিঃশ্বাস ফেলে। মানুষের মত দুই ঠোট, দুই ছিদ্রবিশিষ্ট নাকের মত বায়োলজিক্যাল অর্গান দিয়ে নয়।
২।
হাদিসে কি শীত-গ্রীষ্ম জাহান্নামের নিঃশ্বাসের কারণে হয় বলা হয়েছে?
হাদিসটি একটু ভালভাবে লক্ষ করলেই এর উত্তর পেয়ে যাবেন।
হাদিসে বলা হচ্ছে জাহান্নামের আগুন বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে জাহান্নামকে দু’টো নিঃশ্বাসের অনুমতি দেওয়া হয়েছে একটি শীতকালে আরেকটি গ্রীষ্মে। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে শীত-গ্রীষ্ম এগুলো তখনো ছিল যখন নিঃশ্বাসের অনুমতি দেওয়া হয়নি। নিঃশ্বাসের কারণে যে শীত গ্রীষ্ম হয় না তা এতেই স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়।
মনে করুন আপনি খুবই বড় একটা কোম্পানির বড় কোন পদে আছেন।
সারা বছরের প্রতিদিনই আপনাকে কাজ করতে হয়। কিন্তু দু’-এক বছর পর আপনি খুবই মানসিক সমস্যায় ভোগা শুরু করেছেন কারণ আপনার কোনদিনই ছুটি নেই, খুব টেনশনে থাকতে হয়। তাই আপনি কোম্পানির কাছে অনুমতি চাইলেন বছরে দু’বার যেন আপনাকে ১৫ দিনের ছুটি দেওয়া হয় যাতে আপনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারেন।
কোম্পানিও আপনাকে অনুমতি দিল আপনি শীতকালে যে কোন ১৫ দিন এবং গ্রীষ্মকালে যে কোন ১৫ দিন ছুটি কাটাতে পারবেন।
তো এখন কোন বোকা যদি মনে করে আপনি ছুটি কাটানোর কারণেই শীত গ্রীষ্ম হচ্ছে তাহলে এটি চরম ভুল অনুমান। ঠিক তেমনি হাদিস থেকে এটা বোঝাও ভুল যে - শুধুমাত্র জাহান্নামের নিঃশ্বাসের কারণে শীত গ্রীষ্ম হয়, সূর্য থেকে পৃথিবীর উপর আলোর তীর্যক বা খাড়াভাবে পতিত হওয়ার কারণে হয় না।
তাই আমরা বলতে পারি জাহান্নামের নিঃশ্বাস গ্রীষ্মকাল নয় বরং গ্রীষ্মকালে জাহান্নাম নিঃশ্বাস নেয়। শীতকাল জাহান্নামের নিঃশ্বাস নয় বরং শীতকালে জাহান্নাম নিঃশ্বাস নেয়।
ইমাম ইবনু আব্দিল বার(র.) তার তামহীদ গ্রন্থে এই হাদিসের ব্যাখ্যায় এটি সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন।
قال ابن عبد البر رحمه الله :
"وأما قوله : (فأذن لها بنفسين : نفسٍ في الشتاء ، ونفس في الصيف) : فيدل على أن نفَسها في الشتاء : غير الشتاء ، ونفَسها في الصيف : غير الصيف" انتهى .
" التمهيد " ( 5 / 8 )
অর্থঃ এটি থেকে বোঝা যায় যে জাহান্নামের নিঃশ্বাস শীতকালে ঘটে। নিঃশ্বাস শীতকাল নয়। জাহান্নামের নিঃশ্বাস গ্রীষ্মকালে ঘটে। নিঃশ্বাস গ্রীষ্মকাল নয়। [6]
৩।
শীতকালে শীতের তীব্রতা আর গরমকালে গরমের তীব্রতা কি জাহান্নামের নিঃশ্বাসের কারণে হওয়া সম্ভব?
উল্লেখিত হাদিসের ২য় অংশ থেকে কেউ আবার আপত্তি তুলতে পারে যে, শীতকাল-গ্রীষ্মকাল জাহান্নামের নিঃশ্বাসের কারণে হয় না ঠিক আছে কিন্তু শীতকালে শীতের তীব্রতা আর গরমকালের গরমের তীব্রতা বৃদ্ধি পায় জাহান্নামের নিঃশ্বাসের কারণে - এটা তো হাদিস থেকে সুস্পষ্ট।
কোন ধরনের রূপক অর্থে না গিয়ে চলুন দেখি শীত এবং গরমের তীব্রতার কারণ কিভাবে জাহান্নামের নিঃশ্বাস হয়।
আমরা জানি কোন ইফেক্টের জন্য কখনো কখনো প্রত্যক্ষ কারণের পাশাপাশি পরোক্ষ কারণও কাজ করে। যেমন ধরুন মেরুর বরফ গলা এই ইফেক্টের প্রত্যক্ষ কারণ হল ওজোন স্তরের ক্ষয়, গ্রীন হাউজ ইফেক্ট ইত্যাদি। আর পরোক্ষ কারণ হল মানুষের অনিয়ন্ত্রিত গ্যাস ব্যবহার,পলিথিন পোড়ানো,গাছপালা কেটে ফেলা ইত্যাদি। [7]
তো অনেক সময় মানুষ পরোক্ষ কারণকেই ইফেক্টের কারণ বলে উল্লেখ করে প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখে। প্রত্যক্ষ কারণকে উল্লেখ করে না অপ্রয়োজনীয় হওয়াই।
যেমন আমরা বলে থাকি গাছপালা কাটার কারণেই মেরুর বরফ গলছে। এখন যারা বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী তারা এ কথা দ্বারা অবশ্যই বুঝে নেবে যে এখানে পরোক্ষ কারণকেই উল্লেখ করা হয়েছে। গাছ কাটা কখনো বরফ গলার প্রত্যক্ষ কারণ হতে পারে না। এটা চাক্ষুষ প্রমাণের বিরোধী। আর আমরা বলার সময় প্রত্যক্ষ কারণ অর্থাৎ ওজোন স্তরের ক্ষয় ইত্যাদি উল্লেখ না করে শুধু পরোক্ষ কারণ গাছপালা কাটা ইত্যাদি এজন্যই উল্লেখ করি যাতে গাছপালা কাটা থেকে মানুষ বিরত হয় এটাই মূল উদ্দেশ্য, এটাই প্রয়োজন।
এই হাদিসেও ঠিক তেমনি। শীত গ্রীষ্মের তীব্রতার জন্য প্রত্যক্ষ কারণ হল সাড়ে তেইশ ডিগ্রী কোণে হেলে থাকা পৃথিবীর উপর সূর্যের তীর্যক বা খাড়াভাবে আলো দেয়া। আর পরোক্ষ কারণ হল জাহান্নামের নিঃশ্বাস। রাসূল(ﷺ) এখানে পরোক্ষ কারণ উল্লেখ করেছেন কারণ এ প্রসঙ্গে এটিই আমাদের জানা প্রয়োজন আর তা "ওহী" ছাড়া জানার সুযোগ নেই। আর প্রত্যক্ষ কারণকে উল্লেখ করেননি অপ্রআসঙ্গিক হওয়ায়। আর সেটা তো মানুষ জ্ঞানবুদ্ধি দ্বারাই বুঝতে সক্ষম।
সুতরাং এটা সুনিশ্চিত যে পরোক্ষ কারণের উল্লেখ প্রত্যক্ষ কারণের অনুপস্থিতিকে আবশ্যক করে না।তাই শীত-গ্রীষ্মকালের তীব্রতার জন্য জাহান্নামের নিঃশ্বাসকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করা সূর্যের আলো বিভিন্ন কোণে পতিত হওয়ার তারতম্যের কারণকে বাতিল করে না। [8]
৪।
জাহান্নামের নিঃশ্বাসকে কেন শীত-গ্রীষ্মের তীব্রতার পরোক্ষ কারণ করা হয়েছে?
এখানে মনে রাখতে হবে জাহান্নামের নিঃশ্বাস শীত-গ্রীষ্মের তীব্রতার পরোক্ষ কারণ।
তবে এ'কারণ' Physical Cause নয় বরং Metaphysical Cause যা একমাত্র 'ওহী'র মাধ্যমে জানা সম্ভব।
১/ শীত-গ্রীষ্মের তীব্রতা একটি প্রাকৃতিক সমস্যা যা মানুষের জন্য কষ্টদায়ক, মুসিবত।
২/কষ্ট,বিপদাপদ ইত্যাদি দিয়ে বান্দার গুনাহ আল্লাহ মাফ করেন।
৩/ গুনাহ করলে যেমন গুনাহের বিপরীতে জাহান্নামে শাস্তির উপকরণ তথা আগুন জ্বালানো হয়। ঠিক তেমনি গুনাহ মাফ হলে তার বিপরীতে জ্বালানো আগুন নিভানো হয়।
৪/ সুতরাং শীত-গ্রীষ্মের তীব্রতার মাধ্যমে মানুষকে কষ্ট দিয়ে মানুষের গুনাহ মাফ করানোর মাধ্যমে জাহান্নামের আগুন কমানো হয়। আর উল্লেখিত হাদিসে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে জাহান্নামের নিঃশ্বাস ফেলা মূলত জাহান্নামের আগুন কমানোর জন্যই।
এ ব্যাপারে শায়খ আসিম আল হাকিমের এই আলোচনাটিও দেখা যেতে পারেঃ
Hell breathes Two breaths in a year (Extreme heat and extreme cold) - Sheikh Assim Al Hakeem
https://youtu.be/oqGvDPuc-z8
আরো পড়ুনঃ জাহান্নামের উত্তাপের কারণে কীভাবে জ্বর হতে পারে?
তথ্যসূত্রঃ
[1] বুখারী হা/৫৩৬-৫৩৭, মুসলিম হা/১৪৩২, মিশকাত হা/৫৯১, দারিমী হা/২৮৪৫
[2] আল কুরআন, বাকারাহ ২ : ৩
[3] লিসানুল আরব
[4] তাফসীরে জালালাইন, ১ম খণ্ড, সূরা বাকারাহ
[5] ■ https://en.m.wikipedia.org/wiki/Animal_language
■ http://www.saburchill.com/chapters/chap0025.html
[6] আত তামহীদ- ৮/৫