Pray for the world economy

সুরা মায়িদাহর ৬৯ নং আয়াতে কি ভুল আছে?

 

নাস্তিকরা কুরআনে বেশ কিছু ব্যাকরণগত ভুল আছে বলে উল্লেখ করার চেষ্টা করে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য আয়াত হলো,

 

 إِنَّ ٱلَّذِینَ ءَامَنُوا۟ وَٱلَّذِینَ هَادُوا۟ وَٱلصَّـٰبِـُٔونَ وَٱلنَّصَـٰرَىٰ مَنۡ ءَامَنَ بِٱللَّهِ وَٱلۡیَوۡمِ ٱلۡـَٔاخِرِ وَعَمِلَ صَـٰلِحا فَلَا خَوۡفٌ عَلَیۡهِمۡ وَلَا هُمۡ یَحۡزَنُونَ

{নিশ্চয় যারা ঈমান এনেছে এবং যারা ইয়াহুদী হয়েছে, আর  সাবেয়ী  ও নাসারাগণের মধ্যে যারা আল্লাহ ও শেষ দিনের উপর ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে, তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা চিন্তিতও হবে না।}

[সুরা মায়িদাহ ৫ : ৬৯]

 

আয়াতটি দিয়ে তারা যেই সংশয়-সন্দেহ তৈরি করার চেষ্টা করছে সেটা হলো, إِنَّ শব্দটি এসে তার পরের শব্দকে ‘নসব’ দেয়। এটা নাহুবিদদের কাছে প্রসিদ্ধ কায়দা। তাহলে এই কায়দার দাবি অনুযায়ী আয়াতটি এ রকম হতো, إِن الذِینَ ءَامَنوا۟ وَالذِینَ هادُوا۟ وَٱلصـابِـئينَ

অর্থাৎ, নসবের স্থানে ‘জমা’ মুযাক্কার সালিম’ ‘ইয়া’র মাধ্যমে ইরাব হয়, সে অনুযায়ী ٱلصـابِـئينَ হবে।

 

এর জবাবে কয়েকটি কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। 

 

প্রথমত, আরবি ব্যাকরণ তৈরির ইতিহাস যারা জানে তাদের কাছে এটা সুস্পষ্ট যে, আরবি ব্যাকরণ তৈরি হয়েছে সঠিকভাবে কুরআনকে পড়ার জন্য। আরবি ব্যাকরণের মূল প্রতিষ্ঠাকারীরা ব্যাকরণের নিয়মনীতি বিচার করতেন কুরআন দিয়ে, কুরআনকে ব্যাকরণ দিয়ে বিচার করতেন না।

 

দ্বিতীয়ত, এটা যদি ভুলই হতো তাহলে তখনকার বিশিষ্ট ভাষাবিদ আরবরা ভুল না ধরে চুপ থাকত না, তারা কুরআনের সমস্ত বিষয়ে মোকাবেলা করার জন্য মুখিয়ে ছিল। এজন্য একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায় এটা কোনো ভুল নয়।

 

তৃতীয়ত, উলামাগণ এই কিরাতের ব্যাকরণগত বিভিন্ন দিক উল্লেখ করেছেন। আমি শুধু একটাই উল্লেখ করব। তার আগে সহজ আরবিতে এই আয়াতটার ধরণ দেখে নেওয়া যাক। আরবিতে বাক্য হয় এরকম  إنَّ زَيْدًا وعَمْرٌو قائِمٌ؛

বাক্যে ‘আমর’ শব্দটি তারকিব করলে ‘মুবতাদা’ (উদ্দেশ্য) হবে এবং তার ‘খবর’ (বিধেয়) উহ্য থাকবে। হঠাৎ অমনোযোগী পাঠকের দৃষ্টি ফেরাবার জন্য এটা খুব উপকারী বাক্যগঠন। এতে বাক্যের রূপ দাঁড়াবে,

 إنَّ زَيْدًا قائِمٌ وعَمْرٌو قائِمٌ

অর্থাৎ, এটা আতফুল জুমলাহ আলাল জুমলাহ।

 

আয়াতের ব্যাকরণগত-ব্যাখ্যায় জারুল্লাহ জামাখশারী বলেন,

والصابئون رفع على الابتداء وخبره محذوف، والنية به التأخير عما في حيز إن من اسمها وخبرها، كأنه قيل: إن الذين آمنوا والذين هادوا والنصارى حكمهم كذا، والصابئون كذلك، وأنشد سيبويه شاهدا له:

وإلا فاعلموا أنا وأنتمبغاة ما بقينا فى شقاق

أى فاعلموا أنا بغاة وأنتم كذلك

অর্থাৎ, الصابئون শব্দটি ‘মুবতাদা’ (উদ্দেশ্য) হিসেবে ‘রফা’ হবে। এবং এর খবর (বিধেয়)টি উহ্য থাকবে। এই ক্ষেত্রে الصابئون শব্দটি إن الذين آمنوا والذين هادوا والنصارى—এই আয়াতাংশের পরে ধরে নেওয়া হবে। তখন বাক্যের রূপ হবে, إن الذين آمنوا والذين هادوا والنصارى حكمهم كذا، والصابئون كذلك

 

ইমামুন নাহু সিবাওয়াওহি এইরূপ বাক্যের দলিল হিসেবে একটি কবিতার লাইন উল্লেখ করেছেন,

 وإلا فاعلموا أنا وأنتمبغاة ما بقينا فى شقاق

 

এখানে খেয়াল করলে দেখতে পাব, মুবতাদাকে প্রথমে উল্লেখ করা হয়েছে, সেটার ওপরে আবার আতফ (সংযোগ) করে একটি শব্দ নিয়ে আসা হয়েছে। এরপরে খবর উল্লেখ করা হয়েছে, যেই খবরটা হলো প্রথমে উল্লেখিত মুবতাদার, আর তার ওপর আতফ করা শব্দটির খবর উহ্য আছে। তাতে বাক্যটি দাড়ায় এরকম,

أى فاعلموا أنا بغاة وأنتم كذلك

 

আরেকটি কবিতায় এসেছে,

نَحْنُ بِما عِنْدَنا وأنْتَ بِما ∗∗∗ عِنْدَكَ راضٍ والرَّأْيُ مُخْتَلِفُ

 

এটা মূলত এরকম হবে,

نَحْنُ بِما عِنْدَنا راضٍ وأنْتَ بِما عِنْدَكَ كذالك

 

বাক্যের এরূপ ধরণ উল্লেখ করার কারণ হিসেবে ইবনু আশুর উল্লেখ করেছেন,

“সাবেয়ীরা ইসলাম আসার পূর্বে জাহেলি যুগে ইহুদিদের থেকেও বেশি বিপথগামী ছিল। কেননা তারা তারকারাজির পূজা করত। এরপরেও আল্লাহ তাদের ব্যাপারে বলছেন, তারা নাজাত পাবে, যদি তারা ঈমান আনে এবং সৎকাজ করে। তাহলে অন্যান্যরা তো নাজাত পাওয়ার আরো বেশি হকদার। এখানে এই বিষয়টি জানাতে গিয়েই আল্লাহ তাদেরকে আলাদা বাক্যে উল্লেখ করেছে; সেখানে ‘মারফু’র অবস্থায় উল্লেখ করা হয়েছে।”

 

 আরেকটি আয়াতে যেমন এসেছে,

﴿أنَّ اللَّهَ بَرِيءٌ مِنَ المُشْرِكِينَ ورَسُولُهُ﴾ [التوبة: ٣]

 

এখানে ‘রাসুলুহু’ মুবতাদা। আর খবর উহ্য আছে। এর মূল রূপ হবে, ورَسُولُهُ كَذَلِكَ। এখানে ‘আতফুল জুমলা আলাল জুমলা’ করা হয়েছে। আল্লাহ মুশরিকদের থেকে মুক্ত। আর রাসুল মক্কার মুশরিকদেরই বংশ ধারা থেকে এসেছেন, কিন্তু তিনিও তাদের থেকে মুক্ত, যেমনভাবে আল্লাহ তাদের থেকে মুক্ত। এই বিষয়টা ভালোভাবে পাঠক যাতে বুঝতে পারে সেজন্য এটা আলাদা বাক্যে নিয়ে আসা হয়েছে।

 

এই ধরণের ব্যাকরণের নিয়ম প্রাচীন আরবি সাহিত্য ও কবিতাতেও দেখা যায়। একে যারা কুরআনের ‘ব্যাকরণগত ভুল’ বলতে চায়, তাদের নিজেদেরই আরবি ভাষাজ্ঞানে ঘাটতি আছে।

 

[আরো বিস্তারিত দেখুন, আল কাশশাফ, আল বাহরুল মুহিত, তাফসিরে আবিস সাউদ, আত তাহরির ওয়াত তানবির]

 

আরো পড়ুনঃ

উসমান(রা.) সংকলিত কুরআনের কপিতে আসলেই কি লিপিকারদের ভুল (Scribal Errors) বা ব্যাকরণগত ভুল ছিলো?