অভিযোগঃ
হাদিসে উল্লেখ আছে, সকালবেলা ৭টি আজওয়া খেজুর কেউ খেলে সেদিন জাদু বা বিষ তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। ইসলামবিরোধীরা প্রশ্ন উত্থাপন করে - তাহলে কেউ যদি ৭টি আজওয়া খেজুর খায়, তাহলে পটাশিয়াম সায়ানাইড বা অনুরূপ অন্য কোনো বিষ খেলেও কি তার কোনো ক্ষতি হবে না? ইসলামবিরোধীরা হাদিসের এই দাবিকে অবৈজ্ঞানিক বলে আখ্যা দেয়। তারা আরো বলে, কোনো মুসলিম কি এই হাদিসকে সত্য মেনে নিজেরা বিষ খেয়ে হাদিসের সত্যতা প্রমাণের জন্য রাজি হবে?
জবাবঃ
আমরা শুরুতেই দেখে নিই এ ব্যাপারে হাদিসে কী বলা হয়েছে—
سَمِعْتُ سَعْدًا يَقُوْلُ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلميَقُوْلُ مَنْ تَصَبَّحَ سَبْعَ تَمَرَاتٍ عَجْوَةً لَمْ يَضُرَّه“ ذ‘لِكَ الْيَوْمَ سُمٌّ وَلاَ سِحْرٌ.
অর্থঃ "সা’দ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে বলতে শুনেছিঃ যে ব্যক্তি সকালবেলায় সাতটি আজ্ওয়া মাদ্বীনায় উৎপন্ন উৎকৃষ্ট খুরমা) খেজুর খাবে, সে দিন কোন বিষ বা যাদু তার কোন ক্ষতি করবে না।" [1]
এটি সহীহ বুখারীর হাদিস এবং নিঃসন্দেহে বিশুদ্ধ হাদিস। এই প্রসঙ্গে আরো কিছু হাদিস রয়েছে যা প্রথমোক্ত হাদিসের বক্তব্যকে নির্দিষ্ট করে।
عَنْ عَائِشَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ " إِنَّ فِي عَجْوَةِ الْعَالِيَةِ شِفَاءً أَوْ إِنَّهَا تِرْيَاقٌ أَوَّلَ الْبُكْرَةِ " .
অর্থঃ আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ মদিনার আলিয়া অঞ্চলের (উঁচু ভূমির) আজওয়া খেজুরে শেফা (রোগমুক্তি) রয়েছে। অথবা তিনি বলেছেনঃ প্রতিদিন সকালের এর আহার বিষনাশক (ঔষধের কাজ করে)। [2]
আমরা দেখলাম এই হাদিসে নবী ﷺ স্পষ্ট করেছেন যে, মদিনার আলিয়া নামক এক বিশেষ অঞ্চলের আজওয়া খেজুর দ্বারাই শুধুমাত্র এই ফজিলত লাভ সম্ভব। এই হাদিসের আলোকে মুহাদ্দিসগণ অভিমত পোষণ করেছেন যে, সব আজওয়া খেজুরে না বরং এই নির্দিষ্ট অঞ্চলে উৎপাদিত আজওয়া খেজুরের ব্যপারে জাদু ও বিষের প্রতিষেধকের কথা বলা হয়েছে। মুহাদ্দিসগণ এটিও উল্লেখ করেছেন এই বিষয়টি মূলত মদিনাবাসী এবং এর আশপাশের অঞ্চলের জন্য প্রযোজ্য। পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের জন্য না। ইবনু মুফলিহ(র.) আলোচ্য হাদিস প্রসঙ্গে বলেছেন—
وَقَالَ بَعْضُ أَصْحَابِنَا: هَذَا الْحَدِيثُ أُرِيدَ بِهِ أَهْلُ الْمَدِينَةِ، وَمَنْ جَاوَرَهُمْ، كَذَا قَالَ.
অর্থঃ “আর আমাদের কিছু সাথী বলেছেনঃ “এই হাদিসের বক্তব্যটি মদিনার অধিবাসী ও তাদের আশপাশের লোকদের জন্য বোঝানো হয়েছে।” বিষয়টি এভাবেই বলা হয়েছে।” [3]
শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া(র.) এর বিখ্যাত শিষ্য ইমাম ইবনুল কাইয়িম জাওযিয়্যাহ(র.) থেকেও আলোচ্য হাদিস প্রসঙ্গে অনুরূপ অভিমত বর্ণিত আছে।
وَهَذَا الْحَدِيثُ مِنَ الْخِطَابِ الَّذِي أُرِيدَ بِهِ الْخَاصُّ، كَأَهْلِ الْمَدِينَةِ وَمَنْ جَاوَرَهُمْ،
অর্থঃ “এবং এই হাদিসটি সেই ধরণের বক্তব্যের অন্তর্ভুক্ত, যা নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, যেমন মদিনাবাসী ও তাদের আশেপাশের লোকেরা।” [4]
মুহাদ্দিসগণের এই ব্যাখ্যার কারণ হল, নবী(ﷺ) নিজ হাতে আজওয়া খেজুর গাছ রোপন করেছেন, তিনি মদিনার ফলসহ মদিনার বিভিন্ন বিষয়ের বরকতের জন্য দোয়া করেছেন। মদিনার বরকতের জন্য দোয়া করে নবী(ﷺ) বলেন,
اَللَّهمَّ بَارِكْ لَنَا فِيْ ثَمَرِنا، وَبَارِكْ لَنَا فِيْ مَدِيْنَتِنَا، وَبَارِكْ لَنَا فِيْ صَاعِنَا، وَبَارِكْ لَنَا فِي مُدِّنَا
অর্থঃ "হে আল্লাহ, তুমি আমাদের ফল-ফলাদিতে বরকত দাও। আমাদের এ মদীনায় বরকত দাও। আমাদের সা’তে বরকত দাও এবং আমাদের মুদ-এ বরকত দাও।" [মুসলিম : ১৩৭৩]
মদিনা শহরের বিশেষ বরকতের উল্লেখ করে বহু হাদিস এসেছে। [5] এ কারণে মুহাদ্দিসগণ উল্লেখ করেছেন আজওয়া খেজুরের এই গুণ শুধুমাত্র মদিনা ও এর আশপাশের এলাকার মানুষের জন্য; আজওয়া খেজুরের আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য নেই যার দ্বারা এটি জাদু বা বিষের প্রতিষেধক হবে। বরং আজওয়া খেজুরের এই উপকারিতার একমাত্র কারণ হল নবী(ﷺ) এর দোয়া এবং বরকত। আর এই কারণেই হাদিসে ৭টি আজওয়া খেজুরের কথা উল্লেখ আছে; কারণ আজওয়া খেজুরের যদি নিজস্ব বিষ প্রতিরোধী ক্ষমতা থাকতো, তাহলে সংখ্যা নির্দিষ্ট করে বলার দরকার ছিল না বরং প্রয়োজনীয় যে কোনো পরিমাণে তা খেলেই বিষ প্রতিরোধের জন্য যথেষ্ট হতো। আর খেজুরের ৭ সংখ্যা নির্দিষ্ট করা বিভিন্ন ইবাদতের মাঝে নির্দিষ্ট করা সংখ্যার ন্যায়, যেমনঃ নামাজের রাকাত সংখ্যা, যাকাতের নিসাব ইত্যাদি। [6] কোনো কোনো মুহাদ্দিস এ কারণে এই ব্যাখ্যাও করেছেন যে, ঐ বিশেষ আজওয়া খেজুর নবী(ﷺ) এর সময়ে ছিল কিন্তু এখন আর নেই। আজওয়া খেজুর দ্বারা বিষ ও জাদুর প্রতিষেধকের এই বিষয়টি শুধুমাত্র নবী(ﷺ) এর সময়ের জন্য, পরবর্তী সময়ের জন্য না। যদিও এই ব্যাপারে মুহাদ্দিসদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে।
আল্লামা বদরুদ্দিন আল আইনী (র.) আলোচ্য হাদিসের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেছেন—
الأوَّلُ: قُيِّدَ بِقَوْلِهِ: اصْطَبَحَ، لِأَنَّ المُرَادَ تَنَاوُلُهُ بُكْرَةَ النَّهَارِ حَتَّى إِذَا تَعَشَّى بِتَمَرَاتٍ لَا تَحْصُلُ الْفَائِدَةُ الْمَذْكُورَةُ، هَذَا تَقْيِيدٌ بِالزَّمَانِ، وَجَاءَ فِي رِوَايَةِ أَبِي ضَمْرَةَ التَّقْيِيدُ بِالْمَكَانِ أَيْضًا، وَلَفْظُهُ: مَنْ تَصَبَّحَ بِسَبْعِ تَمَرَاتٍ عَجْوَةٍ مِنْ تَمْرِ الْعَالِيَةِ، وَالْعَالِيَةُ الْقُرَى الَّتِي فِي جِهَةِ الْعَالِيَةِ مِنَ الْمَدِينَةِ، وَهِيَ جِهَةُ نَجْدٍ، وَلَهُ شَاهِدٌ عِنْدَ مُسْلِمٍ مِنْ طَرِيقِ ابْنِ أَبِي مُلَيْكَةَ عَنْ عَائِشَةَ بِاللَّفْظِ: فِي عَجْوَةِ الْعَالِيَةِ شِفَاءٌ فِي أَوَّلِ الْبُكْرَةِ.
الثَّانِي: قُيِّدَ التَّمَرَاتُ بِالْعَجْوَةِ لِأَنَّ السِّرَّ فِيهَا أَنَّهَا مِنْ غَرْسِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، كَمَا ذَكَرْنَا، وَوَقَعَ فِي رِوَايَةِ النَّسَائِيِّ مِنْ حَدِيثِ جَابِرٍ رَفَعَهُ: "الْعَجْوَةُ مِنَ الْجَنَّةِ، وَهِيَ شِفَاءٌ مِنَ السُّمِّ"، وَقَالَ الْخَطَّابِيُّ: كَوْنُ الْعَجْوَةِ تَنْفَعُ مِنَ السُّمِّ وَالسِّحْرِ إِنَّمَا هُوَ بِبَرَكَةِ دَعْوَةِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِتَمْرِ الْمَدِينَةِ، لَا لِخَاصِّيَّةٍ فِي التَّمْرِ، وَقَالَ ابْنُ التِّينِ: يَحْتَمِلُ أَنْ يَكُونَ نَخْلًا خَاصًّا مِنَ الْمَدِينَةِ لَا يُعْرَفُ الْآنَ.
অর্থঃ “প্রথমতঃ "اصطبح" (সকালে গ্রহণ করা) শব্দ দ্বারা শর্ত আরোপ করা হয়েছে, কারণ এখানে উদ্দেশ্য হল সকালবেলায় এটি গ্রহণ করা। যদি কেউ রাতের খাবারে খেজুর খায়, তাহলে উল্লিখিত উপকারিতা প্রাপ্ত হবে না। এটি সময়গত শর্ত। আবু দ্বমরাহ-এর বর্ণনায় স্থানগত শর্তও উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁর (বর্ণনার) শব্দাবলিঃ "যে ব্যক্তি সকালে 'আলিয়া অঞ্চলের আজওয়া খেজুর থেকে সাতটি খেজুর গ্রহণ করবে..."।'আলিয়া হল মদিনার উচ্চভূমির গ্রামসমূহ, যা নাজদের দিকের অংশ। এর সমর্থনে সহীহ মুসলিমে একটি হাদিস পাওয়া যায়, যা ইবনে আবি মুলাইকা হতে আয়িশা (রা.) কর্তৃক বর্ণিতঃ " 'আলিয়া অঞ্চলের আজওয়া খেজুর সকালে গ্রহণ করলে তাতে রয়েছে রোগের আরোগ্য।"
দ্বিতীয়তঃ এখানে বিশেষভাবে আজওয়া খেজুরের উল্লেখ করা হয়েছে, কারণ এর বিশেষত্ব এই যে, এটি রাসুলﷺ নিজ হাতে রোপণ করেছিলেন, যেমনটি আমরা (পূর্বে) উল্লেখ করেছি। নাসাঈ-এর একটি হাদিসে উল্লেখ আছে, যা জাবির (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলﷺ বলেছেনঃ "আজওয়া খেজুর জান্নাত থেকে এসেছে, এবং এটি বিষের প্রতিকার।" আল-খাত্তাবী(র.) বলেছেনঃ "আজওয়া খেজুর বিষ ও জাদুর প্রতিরোধ করে মূলত রাসুলﷺ-এর দোয়ার বরকতের কারণে, মদিনার খেজুরের কোনো স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের কারণে নয়।" ইবনুত তিন(র.) বলেছেনঃ "হতে পারে মদিনায় এমন বিশেষ খেজুর গাছ ছিল, যা বর্তমানে আর পাওয়া যায় না।" ” [7]
ইবন মুলাক্কিন(র.) আলোচ্য হাদিসের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেছেন—
قالَ ابْنُ التِّينِ: أَي: أَكْلُهُنَّ فِي الصَّبَاحِ قَبْلَ أَنْ يَأْكُلَ شَيْئًا. قُلْتُ: تُؤَيِّدُهُ رِوَايَةُ ابْنِ نُمَيْرٍ عَنْ هِشَامٍ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ عَائِشَةَ - رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا - أَنَّهَا كَانَتْ تَأْمُرُ فِي الدَّوَاءِ بِسَبْعِ تَمَرَاتٍ عَجْوَةٍ غُدْوَاتٍ عَلَى الرِّيقِ.
قَالَ الدَّاوُدِيُّ: وَالْعَجْوَةُ مِنْ وَسَطِ التَّمْرِ. قَالَ الْقَزَّازُ: وَهِيَ مِمَّا غَرَسَ رَسُولُ اللَّهِ - صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ - بِالْمَدِينَةِ، وَكَذَا قَالَ ابْنُ الْأَثِيرِ: إِنَّهَا نَوْعٌ مِنْ تَمْرِ الْمَدِينَةِ أَكْبَرُ مِنَ الصَّيْحَانِيِّ يَضْرِبُ إِلَى السَّوَادِ مِنْ غَرْسِ رَسُولِ اللَّهِ - صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ -. وَقَالَ الْجَوْهَرِيُّ: إِنَّهَا ضَرْبٌ بِهَا مِنْ أَجْوَدِ التَّمْرِ، وَنَخْلُهَا يُسَمَّى لِينَةً، وَقِيلَ: هَذَا مَا لَا يُغْفَلُ مَعْنَاهُ فِي طَرِيقَةِ عِلْمِ الطِّبِّ، وَلَوْ صَحَّ أَنْ يُخْرَجَ لِمَنْفَعَةِ التَّمْرِ فِي السُّمِّ وَجْهٌ مِنْ جِهَةِ الطِّبِّ لَمْ يُقْدَرْ عَلَى إِظْهَارِ وَجْهِ الِاقْتِصَارِ فِي الْعَدَدِ عَلَى سَبْعٍ، وَلَا عَلَى الِاقْتِصَارِ عَلَى الْعَجْوَةِ، وَلَعَلَّ ذَلِكَ كَانَ لِأَهْلِ زَمَنِهِ - صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ -. وَقِيلَ: يَجْعَلُ اللَّهُ الشِّفَاءَ فِيمَا شَاءَ مِنْ عَجْوَةٍ وَعَدَدٍ، وَقِيلَ: أَرَادَ نَخْلًا بِعَيْنِهِ وَهُوَ لَا يُعْرَفُ الْآنَ، وَالسُّمُّ سِينُهُ مُثَلَّثَةٌ، وَلَمْ يَذْكُرِ ابْنُ التِّينِ الْكَسْرَ، (وَحَكَّاهَا صَاحِبُ "الْمَطَالِعِ")، وَكَوْنُهَا عُوذًا مِنَ السُّمِّ تَبَرُّكًا لِدَعْوَةٍ سَبَقَتْ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ - صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ -، لَا أَنَّ طَبْعَ التَّمْرِ ذَلِكَ، قَالَهُ الْخَطَّابِيُّ.
অর্থঃ “ইবনুত্ তিন(র.) বলেনঃ অর্থাৎ সকালে কোনো কিছু খাওয়ার আগেই এগুলো (আজওয়া খেজুর) খেতে হবে। আমি [ইবন মুলাক্কিন] বলিঃ এটি ইবনু নুমাইর হিশাম হতে, তার পিতা থেকে, আয়িশা(রা.) হতে বর্ণিত রেওয়ায়েত দ্বারা সমর্থিত, যেখানে তিনি চিকিৎসার জন্য সকালে খালি পেটে সাতটি আজওয়া খেজুর খাওয়ার নির্দেশ দিতেন।
দাউদী(র.) বলেনঃ "আজওয়া হলো মাঝারী আকৃতির খেজুর।" কাজ্জায(র.) বলেনঃ "এটি মদিনায় রাসুলুল্লাহ (ﷺ) নিজ হাতে রোপণ করেছিলেন।" একইভাবে ইবনুল আছির(র.) বলেনঃ "এটি মদিনার একটি বিশেষ খেজুরের প্রকার, যা সাইহানি খেজুরের তুলনায় বড় এবং কিছুটা কালো বর্ণের, যা রাসুলুল্লাহ (ﷺ) নিজ হাতে রোপণ করেছিলেন।" জাওহারী(র.) বলেনঃ "এটি উৎকৃষ্ট মানের খেজুরের একটি ধরণ, এবং এর খেজুর গাছকে 'লিনাহ' বলা হয়।" কেউ কেউ বলেনঃ "এটি এমন একটি বিষয়, যা চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা করা সহজ নয়। যদি চিকিৎসার দৃষ্টিকোণ থেকে খেজুরের বিষনাশী গুণের কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যেত, এরপরেও কেন (খেজুরের) সংখ্যা সাতটি নির্দিষ্ট করা হলো বা কেন শুধুমাত্র আজওয়া খেজুরের কথা বলা হলো — তা বোঝা সম্ভব হতো না।
সম্ভবত এটি রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর যুগের মানুষের জন্য বিশেষ এক ব্যাপার ছিল। আবার কেউ কেউ বলেনঃ "আল্লাহ যেকোনো জিনিসে আরোগ্য স্থাপন করতে পারেন — তা আজওয়া হোক বা নির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা।" আরেকটি অভিমত হলোঃ এটি বিশেষ কোনো খেজুর গাছের প্রতি ইঙ্গিত, যা এখন আর পরিচিত নেই। "السم" (বিষ) শব্দটির "س" (সীন) তিন নুকতাযুক্ত "ث" (ছা)-এর মতো উচ্চারিত হতে পারে, তবে ইবনুত্ তিন এর কসরা (যের) উচ্চারণ উল্লেখ করেননি, (যদিও আল-মাতালি’ গ্রন্থের লেখক এটি উল্লেখ করেছেন)। আজওয়া খেজুরের বিষ থেকে সুরক্ষা পাওয়াকে রাসুলুল্লাহ(ﷺ)-এর দোয়ার বরকত হিসেবে গণ্য করা হয়েছে, এটি খেজুরের স্বাভাবিক গুণ নয়, যেমনটি খাত্তাবী(র.) উল্লেখ করেছেন।” [8]
আজওয়া খেজুরের এই গুণ শুধুমাত্র নবী(ﷺ)- এর সময়ের জন্য প্রযোজ্য হবে নাকি এখনও প্রযোজ্য হবে, এই প্রসঙ্গে ইমাম কুরতুবী(র.) থেকে কিছু আলোচনা পাওয়া যায়। তিনি উল্লেখ করেছেনঃ
وَظَاهِرُ هَذِهِ الْأَحَادِيثِ: خُصُوصِيَّةُ عَجْوَةِ الْمَدِينَةِ بِدَفْعِ السُّمِّ، وَإِبْطَالِ السِّحْرِ. وَهَذَا: كَمَا تُوجَدُ بَعْضُ الْأَدْوِيَةِ مَخْصُوصَةً بِبَعْضِ الْمَوَاضِعِ، وَبِبَعْضِ الْأَزْمَانِ. وَهَلْ هَذَا مِنْ بَابِ الْخَوَاصِّ الَّتِي لَا تُدْرَكُ بِقِيَاسٍ طِبِّيٍّ، أَوْ هُوَ مِمَّا يَرْجِعُ إِلَى قِيَاسٍ طِبِّيٍّ؛ ٱخْتَلَفَ عُلَمَاؤُنَا فِيهِ، فَمِنْهُمْ مَنْ تَكَلَّفَهُ وَقَالَ: إِنَّ السُّمُومَ إِنَّمَا تَقْتُلُ لِإِفْرَاطِ بُرُودَتِهَا، فَإِذَا دَامَ عَلَى التَّصَبُّحِ بِالْعَجْوَةِ تَحَكَّمَتْ فِيهِ الْحَرَارَةُ، وَٱسْتَعَانَتْ بِهَا الْحَرَارَةُ الْغَرِيزِيَّةُ، فَقَابَلَ ذَلِكَ بُرُودَةَ السُّمِّ مَا لَمْ يَسْتَحْكِمْ، فَبَرَأَ صَاحِبُهُ بِإِذْنِ اللَّهِ تَعَالَى.
قُلْتُ: وَهَذَا يَرْفَعُ خُصُوصِيَّةَ عَجْوَةِ الْمَدِينَةِ، بَلْ خُصُوصِيَّةَ الْعَجْوَةِ مُطْلَقًا، بَلْ خُصُوصِيَّةَ التَّمْرِ، فَإِنَّ هُنَاكَ مِنَ الْأَدْوِيَةِ الْحَارَّةِ مَا هُوَ أَوْلَى بِذَلِكَ مِنْهُ، كَمَا هُوَ مَعْرُوفٌ عِنْدَ أَهْلِهِ. وَالَّذِي يَنْبَغِي أَنْ يُقَالَ: إِنَّ ذَلِكَ خَاصَّةُ عَجْوَةِ الْمَدِينَةِ كَمَا أَخْبَرَ بِهِ الصَّادِقُ - صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ -.
ثُمَّ هَلْ ذَلِكَ مَخْصُوصٌ بِزَمَانِ نُطْقِهِ - صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ - أَوْ هُوَ فِي كُلِّ زَمَانٍ؟ كُلُّ ذَلِكَ مُحْتَمَلٌ، وَالَّذِي يَرْفَعُ هَذَا الِٱحْتِمَالَ التَّجْرِبَةُ الْمُتَكَرِّرَةُ، فَإِنْ وَجَدْنَا ذَلِكَ كَذَلِكَ فِي هَذَا الزَّمَانِ؛ عَلِمْنَا أَنَّهَا خَاصَّةٌ دَائِمَةٌ، وَإِنْ لَمْ نَجِدْهُ مَعَ كَثْرَةِ التَّجْرِبَةِ؛ عَلِمْنَا أَنَّ ذَلِكَ مَخْصُوصٌ بِزَمَانِ ذَلِكَ الْقَوْلِ. وَاللَّهُ تَعَالَى أَعْلَمُ.
অর্থঃ “এই হাদিসগুলোর প্রকাশ্য অর্থ হলো, মদিনার আজওয়া খেজুরের বিশেষত্ব রয়েছে যা বিষ প্রতিরোধ করে এবং জাদু নষ্ট করে। এটি ঠিক তেমন, যেমনিভাবে কিছু ওষুধ নির্দিষ্ট স্থান ও নির্দিষ্ট সময়ে বিশেষভাবে কার্যকর হয়ে থাকে।
এটি কি এমন বিশেষ গুণের অন্তর্ভুক্ত যা চিকিৎসা-সংক্রান্ত বিশ্লেষণে ধরা যায় না, নাকি এটি চিকিৎসাগত ব্যাখ্যার মধ্যে পড়ে — এ বিষয়ে আমাদের আলেমগণ মতপার্থক্য করেছেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন এবং বলেছেনঃ বিষ মূলত অতিরিক্ত শীতলতার কারণে মানুষকে হত্যা করে। তাই যদি কেউ নিয়মিত সকালে আজওয়া খেজুর খায়, তাহলে তার দেহে তাপের প্রভাব বৃদ্ধি পায় এবং প্রাকৃতিক তাপ শক্তি লাভ করে, ফলে বিষের শীতলতা পুরোপুরি কাজ করার আগেই তা প্রতিরোধ হয় এবং সে ব্যক্তি আল্লাহর অনুমতিতে সুস্থ হয়ে যায়।
আমি [ইমাম কুরতুবী] বলিঃ এই ব্যাখ্যা মদিনার আজওয়া খেজুরের বিশেষত্বকে নাকচ করে দেয়, বরং আজওয়া খেজুরের সাধারণ বিশেষত্বকেও বাতিল করে দেয়, এমনকি খেজুরের বিশেষত্বকেও অস্বীকার করে। কেননা এমন অনেক উত্তপ্ত প্রকৃতির ওষুধ রয়েছে, যা এই ক্ষেত্রে আরও উপযোগী হতে পারে, যেমন এ বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা জানেন। প্রকৃতপক্ষে যা বলা উচিত তা হলো— এটি মদিনার আজওয়া খেজুরের বিশেষ গুণ, যেমনটি সত্যবাদী নবী ﷺ আমাদের জানিয়েছেন।
এরপর প্রশ্ন ওঠে, এই বিশেষত্ব কি শুধুমাত্র নবী ﷺ-এর সময়ের জন্য নির্দিষ্ট, নাকি এটি সর্বকালের জন্য প্রযোজ্য? উভয় দিকের সম্ভাবনা রয়েছে। এই অনিশ্চয়তা দূর করতে হলে বারবার পরীক্ষার প্রয়োজন। যদি বর্তমান সময়েও আমরা এর একই প্রভাব দেখতে পাই, তাহলে বুঝবো যে এটি একটি স্থায়ী বৈশিষ্ট্য। কিন্তু যদি বহু পরীক্ষার পরও এর কার্যকারিতা না পাওয়া যায়, তাহলে বুঝবো যে এটি কেবল নবী ﷺ-এর সময়ের জন্য সীমাবদ্ধ ছিল। আর আল্লাহই সর্বজ্ঞ।” [9]
আর বিষ খেয়ে নাস্তিকদের চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে আসি। বিষ হারামের অন্তর্গত। হারাম জিনিস ভক্ষণ করে কারো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা ইসলামে অনুমোদিত কিছু নয়। আর ইসলামকে প্রমাণের জন্য বিষ খাবার কোনো প্রয়োজন নেই বরং আরো বহু পন্থা আছে। এ সংক্রান্ত একটি ফতোয়ায় শায়খ মাজহার মাহমুদ উল্লেখ করেছেনঃ
“ইসলামে ইচ্ছাকৃতভাবে বিষ বা এমন কোনও উপাদান গ্রহণ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ যা কারও জীবন, নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পরিণতি ডেকে আনে। ইসলামের সুন্দর বিশ্বাসের বৈধতা দায়িত্বজ্ঞানহীন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রমাণ করার প্রয়োজন নেই। অযৌক্তিক চরমপন্থায় লিপ্ত হওয়ার পরিবর্তে পেশাদার, সুসভ্য, শান্তিপূর্ণ এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সংলাপের মাধ্যমে ইসলামের প্রতিরক্ষার জন্য সচেষ্ট হওয়া উচিত।” [10]
অতএব সমগ্র আলোচনার উপসংহার হিসেবে আমরা বলতে পারি—
১। আজওয়া খেজুরের বিষ প্রতিরোধের যে বিষয়ের কথা হাদিসে উল্লেখ আছে, তা শুধুমাত্র মদিনার এক বিশেষ অঞ্চলে উৎপাদিত খেজুর প্রসঙ্গে। সব আজওয়া খেজুরের ব্যাপারে না।
২। আজওয়া খেজুরের এই বিষয়টির কারণ নবী ﷺ-এর বরকত। নবী ﷺ নিজ হাতে আজওয়া খেজুর গাছ রোপন করেছিলেন। এই ব্যাপারে আজওয়া খেজুরের আলাদা আর কোনো ক্ষমতা বা বৈশিষ্ট্য নেই।
৩। আজওয়া খেজুরের বিষ প্রতিরোধের গুণ শুধুমাত্র নবী ﷺ-এর সময়ের জন্য বা তাঁর রোপনকৃত বরকতপূর্ণ আজওয়া খেজুর গাছের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ হবার সম্ভাবনা আছে। আবার পরবর্তীকালের আজওয়া খেজুরের ক্ষেত্রেও তা সত্য হতে পারে। আজওয়া খেজুরের জাদু ও বিষ প্রতিরোধের বিষয়টি সহীহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। কিন্তু তা শুধুমাত্র নবী ﷺ-এর সময়ের জন্য নাকি বিষয়টি পরবর্তীকালের আজওয়া খেজুরের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে তা নিয়ে মতপার্থক্য আছে।
৪। বিষ বা কোনো হারাম জিনিস ভক্ষণ করে কারো চ্যালেঞ্জ গ্রহণ ইসলামে অনুমোদিত নয়। আর এমনটি করা কোনো আবশ্যকীয় বিষয়ও নয়। ইসলামের সত্যতা প্রমাণের জন্য বহু পন্থা আছে।
এ প্রসঙ্গে আরো দেখতে পারেনঃ
Sapient Thoughts #22: Understanding the hadith of 7 dates and poison | Mohammed Hijab
তথ্যসূত্রঃ
[1] সহীহ বুখারী , হাদিস নং : ৫৭৬৯
https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=30356
আরো দেখুনঃ মিশকাতুল মাসাবীহ, হাদিস নং : ৪১৯০
[2] সহীহ মুসলিম , হাদিস নং : ৫১৬৮
https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=15038
আরো দেখুনঃ মিশকাতুল মাসাবীহ, হাদিস নং : ৪১৯১
[3] আল আদাবুশ শারইয়্যাতু ওয়াল মিনহু মার’ইয়্যাহ – শামসুদ্দিন ইবন মুফলিহ, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ৬
https://shamela.ws/book/21582/922
অথবা https://archive.is/wip/gxUnm (আর্কাইভকৃত)
[4] যাদুল মা’আদ – ইবনুল কাইয়িম জাওযিয়্যাহ, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৯০
https://shamela.ws/book/21713/1601
অথবা https://archive.is/wip/xT11X (আর্কাইভকৃত)
[5] মদিনার বরকত সম্পর্কিত আরো তথ্যের জন্য দেখা যেতে পারেঃ https://www.hadithbd.com/books/link/?id=7447
[6] ইমাম নববী(র.) উল্লেখ করেছেনঃ
وَفِي هَذِهِ الْأَحَادِيثِ فَضِيلَةُ تَمْرِ الْمَدِينَةِ وَعَجْوَتِهَا وَفَضِيلَةُ التَّصَبُّحِ بِسَبْعِ تَمَرَاتٍ مِنْهُ وَتَخْصِيصُ عَجْوَةِ الْمَدِينَةِ دُونَ غَيْرِهَا وَعَدَدُ السَّبْعِ من الأمور التى علمها الشارع ولانعلم نَحْنُ حِكْمَتَهَا فَيَجِبُ الْإِيمَانُ بِهَا وَاعْتِقَادُ فَضْلِهَا وَالْحِكْمَةُ فِيهَا وَهَذَا كَأَعْدَادِ الصَّلَوَاتِ وَنُصُبِ الزَّكَاةِ وَغَيْرِهَا فَهَذَا هُوَ الصَّوَابُ فِي هَذَا الْحَدِيثِ
অর্থঃ "এই হাদিসগুলোতে মদিনার খেজুর, বিশেষ করে আজওয়া খেজুরের মর্যাদা এবং সকালে সাতটি আজওয়া খেজুর খাওয়ার ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। শুধুমাত্র মদিনার আজওয়া খেজুরকে নির্দিষ্ট করা হয়েছে, অন্য খেজুরকে নয়। আর সাত সংখ্যাটি শরিয়তের জানা বিষয়গুলোর অন্তর্ভুক্ত, যার প্রকৃত হিকমত (জ্ঞান) আমরা জানি না। তাই এ বিষয়ে ঈমান আনা, এর মর্যাদায় বিশ্বাস রাখা এবং এর অন্তর্নিহিত হিকমত স্বীকার করা আবশ্যক। এটি নামাজের রাকাত সংখ্যা, যাকাতের নিসাব ইত্যাদির মতো বিষয়গুলোর অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং, এই হাদিসের প্রকৃত ব্যাখ্যা এটাই।"
[শারহ মুসলিম - ইয়াহইয়া বিন শারাফ নববী, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ১৪
https://shamela.ws/book/1711/3040
অথবা https://archive.is/wip/QkWL2 (আর্কাইভকৃত)]
[7] উমদাতুল ক্বারী শারহ সহীহ বুখারী – বদরুদ্দিন আল আইনী, খণ্ড ২১, পৃষ্ঠা ২৮৬-২৮৭
https://shamela.ws/book/5756/6486
https://shamela.ws/book/5756/6487
অথবা (আর্কাইভকৃত)
[8] তাওদ্বিহু লি শারহিল জামি’ইস সহীহ – ইবন মুলাক্কিন, খণ্ড ২৭, পৃষ্ঠা ৫৫৩-৫৫৪
https://shamela.ws/book/13252/16621
https://shamela.ws/book/13252/16622
অথবা (আর্কাইভকৃত)
[9] আল মুফহিম লিমা আশকালা মিন তালখিছ কিতাব মুসলিম– আবুল আব্বাস আল কুরতুবী, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ৩২২
https://shamela.ws/book/132524/2976
অথবা https://archive.is/wip/F1xUA (আর্কাইভকৃত)
[10] Consuming Poison to Prove Islam in a Debate – IslamQA (Hanafi)
অথবা https://archive.is/i00BQ (আর্কাইভকৃত)