নাস্তিক প্রশ্নঃ
মক্কায় জীবনকালে মুহাম্মাদ(ﷺ) শান্তিপূর্ণ উপায়ে ইসলাম প্রচার করেছেন। কিন্তু মদীনায় গিয়েই তার চরিত্র বদলে যায়। তিনি সেখানে গিয়ে ক্ষমতা হাতে পেয়েই মক্কাবাসীর উপর আক্রমণ শুরু করেন। মক্কাবাসীর বাণিজ্যিক কাফেলা আক্রমণ ও লুট করা শুরু করেন। লুট করা সম্পদকে গনিমত আখ্যা দিয়ে একে হালাল ঘোষণা করেন। যে ব্যক্তি কাফেলা আক্রমণের মতো কাজ করতেন, তিনি কী করে সকলের অনুকরণীয় ব্যক্তি হন?
উত্তরঃ
যে কোনো ঘটনা বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেই প্রেক্ষাপট একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। প্রেক্ষাপট তথা “ঘটনার আগের ঘটনা” আলোচনা না করে মাঝখান থেকে হঠাৎ করে কোনো প্রসঙ্গের অবতারণা করে যে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকেই খারাপভাবে চিত্রিত করা যায়।
একটা উদাহরণ দিচ্ছি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মোটামুটিভাবে বাংলাদেশের সবাই জানে। ধরা যাক মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গে কেউ বললোঃ ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ থেকে বাঙালীরা পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর উপর আক্রমণ শুরু করে। তারা মুক্তিবাহিনী গঠন করে পাকিস্তানী সৈনিকদের ক্যাম্পের উপর হামলা করে হত্যা করতে শুরু করে। পাকিস্তানী বাহিনীর খাদ্য ও রসদবাহী গাড়ির উপর আক্রমণ করতে থাকে, পাকিস্তানী বাহিনীর চলাচলের ব্রিজগুলোকে পর্যন্ত বোমা মেরে উড়িয়ে দিতে থাকে। দুর্ধর্ষ মুক্তিবাহিনীর প্রবল আক্রমণে অসহায় হয়ে টিকতে না পেরে ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানী বাহিনী হার মানে এবং ধীরে ধীরে বাংলাদেশ থেকে ক্যাম্প গুটিয়ে চলে যায়।
উপরে যা বলা হলো সেগুলো তথ্য হিসেবে সত্য। কিন্তু এখানে কোনো প্রেক্ষাপট উল্লেখ করা হয়নি। ২৬শে মার্চের আগের ঘটনা উল্লেখ করা হয়নি, কী কারণে ও কোন পরিস্থিতিতে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর সাথে যুদ্ধ শুরু করেছিলো তা উল্লেখ করা হয়নি। এখন প্রেক্ষাপটবিহীন এই ‘সত্য’ তথ্যগুলো উল্লেখ করে যদি কেউ বলতে চায়ঃ- “মুক্তিযোদ্ধারা কতো খারাপ! তারা ‘নিরীহ’ (!) পাকিস্তানী বাহিনীকে হামলা করেছে, মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে!” – তাহলে যে কেউ তাকে মিথ্যাবাদী বলবে। কেননা এই ব্যক্তি প্রেক্ষাপট উল্লেখ না করেই মাঝখান থেকে তথ্য উল্লেখ করেছে। সে উল্লেখ করেনি পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী কিভাবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক ও নানা দিক দিয়ে শোষণ করতো এবং কিভাবে তারা ১৯৭১ সালে ২৬শে মার্চ ঘুমন্ত মানুষের উপর নিকৃষ্ট উপায়ে সামরিক বাহিনী দিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যুদ্ধের সূচনা করেছিলো। যার জবাবে মুক্তিযোদ্ধারা জালিমের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলো। প্রেক্ষাপট উল্লেখ ব্যতিত ‘সত্য’ কথাও অনেক সময়ে মানুষকে ভুল বার্তা দেয় এবং নিদারুণ মিথ্যা হিসেবে বিবেচিত হয়।
আল্লাহর রাসুল(ﷺ) এর ব্যাপারেও অনেক ক্ষেত্রেই প্রসঙ্গবিহীন নানা ঘটনার রেফারেন্স উল্লেখ করে তাঁকে দুর্বৃত্ত হিসেবে চিত্রিত করতে চায় নাস্তিক-মুক্তমনারা। আমরা যদি ঘটনাগুলোর আগাগোড়া প্রেক্ষাপট সহকারে হাদিস ও সিরাত গ্রন্থগুলো থেকে যাচাই করে দেখি, তাহলেই তাদের অপপ্রচারের অসারতা স্পষ্ট হয়ে যায়। তারা মদীনায় হিজরতের পর রাসুলুল্লাহ(ﷺ) কর্তৃক মক্কাবাসীর বাণিজ্যিক কাফেলা আক্রমণের নির্দেশের ব্যাপারটি উল্লেখ করে তাঁর ব্যাপারে নানা কটু কথা বলে। তাঁকে “দস্যু” ও এ জাতীয় নানা অভিধায় ভূষিত করার চেষ্টা করে (নাউযুবিল্লাহ)। যদি প্রশ্ন করা হয়ঃ মুহাম্মাদ(ﷺ) কি মদীনা যাবার পরে মক্কাবাসীর বাণিজ্যিক কাফেলা আক্রমণের নির্দেশ দিতেন? এক কথায় এর উত্তর হবেঃ হ্যাঁ। কিন্তু ব্যাপার হচ্ছে, এটাই সম্পূর্ণ ইতিহাস নয়। এর গোড়ায় আরো ইতিহাস আছে। যে ইতিহাস গোপন করে মহানবী(ﷺ)কে বাজেভাবে চিত্রিত করে ইসলামের সমালোচকরা।
প্রেক্ষাপটঃ
রাসুলুল্লাহ(ﷺ) এর উপর নির্যাতনঃ
নবুয়ত পাবার পর প্রথমে গোপনে ও পরে প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার করতেন রাসুলুল্লাহ(ﷺ)। মক্কার জীবনে ইসলাম প্রচার সময়টিতে রাসুলুল্লাহ(ﷺ) ও তাঁর সাহাবীদের উপর অত্যাচার ও নির্যাতনের পাহাড় নেমে এসেছিলো। বিভিন্ন সময়ে রাসুলুল্লাহ(ﷺ)কে নানাভাবে নির্যাতন করা হয়েছে এমনকি হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে।
আব্দুল্লাহ ইবন মাস‘ঊদ (রা.) বলেন, একদিন রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বায়তুল্লাহর পাশে সলাত আদায় করছিলেন। আবু জাহল ও তার সাথীরা অদূরে বসেছিল। কিছুক্ষণ পর তার নির্দেশে উটের ভুঁড়ি এনে সিজদারত রাসূলের ﷺ দুই কাঁধের মাঝখানে চাপিয়ে দিল, যাতে ঐ বিরাট ভুঁড়ির চাপে ও দুর্গন্ধে দম বন্ধ হয়ে তিনি মারা যান।
ইবন মাস‘ঊদ(রা.) বলেন, আমি সব দেখছিলাম। কিন্তু এই অবস্থায় আমার কিছুই করার ক্ষমতা ছিল না। অন্যদিকে শত্রুরা দানবীয় উল্লাসে ফেটে পড়ছিল। এই সময় কিভাবে এই দুঃসংবাদ ফাতিমার(রা.) কানে পৌঁছল। তিনি দৌঁড়ে এসে ভুঁড়িটি সরিয়ে দিয়ে পিতাকে [রাসুলুল্লাহ(ﷺ)] কষ্টকর অবস্থা থেকে রক্ষা করেন। ... [1]
উরওয়াহ ইবন যুবাইর(রা.) বলেন, একদিন আমি আবদুল্লাহ ইবন আমরকে(রা.) জিজ্ঞেস করলাম, মুশরিকরা রাসুলুল্লাহ(ﷺ) এর সাথে কী ধরণের কঠোর আচরণ করেছে?
তিনি জবাব দিলেন, “একদিন আমি দেখলাম রাসুলুল্লাহ(ﷺ) কাবা শরীফে নামাজ পড়ছিলেন। এমন সময় উকবা বিন আবু মুআইত সেখানে এসে নিজের চাদর দিয়ে রাসুলুল্লাহ(ﷺ) এর গলা এমনভাবে পেঁচিয়ে ধরলো যে তাঁর শ্বাস রুদ্ধ হওয়ার উপক্রম হলো। তৎক্ষণাৎ আবু বকর(রা.) সেখানে গিয়ে উকবাকে কাঁধে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন এবং বললেন, “তোমরা কি একজন ব্যক্তিকে শুধু এ কারণে হত্যা করতে চাও যে তিনি বলেন আমার প্রভু হলেন আল্লাহ? অথচ তিনি তোমাদের কাছে তোমাদের প্রভুর নিকট থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণ নিয়ে এসেছেন।” [2]
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, একদিন মক্কার মুশরিকরা রাসুলুল্লাহ(ﷺ)কে এমন নির্মমভাবে মারধর করলো যে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। এ সময় আবু বকর(রা.) দ্রুত সেখানে এসে পৌঁছালেন এবং মুশরিকদের উদ্যেশ্য করে বললেন, “ওরে হতভাগার দল! তোমরা কি একজন ব্যক্তিকে শুধু এ কারণে হত্যা করতে চাও যে তিনি বলেন আমার প্রভু হলেন আল্লাহ।”
লোকেরা পেছনে ফিরে বললো, “এ কে?”
তাদের মধ্য থেকে একজন জবাব দি্লো, “এ হলো আবু কুহাফার পাগল ছেলে [আবু বকর(রা.)]।” [3]
রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বলেন, “আমাকে আল্লাহর পথে যেভাবে ভীত করা হয়েছে এমনটি কাউকে করা হয়নি। আমি আল্লাহর পথে যেভাবে নির্যাতিত হয়েছি, এমনটি কেউ হয়নি। মাসের ত্রিশটি দিন ও রাত আমার ও আমার পরিবারের কোন খাদ্য জোটেনি। বিলালের বগলে যতটুকু লুকানো সম্ভব ততটুকু খাদ্য ব্যতিত' (অর্থাৎ খুবই সামান্য)।” [4]
ইসলাম প্রচারের কারণে মক্কার জীবনব্যাপি রাসুলুল্লাহ(ﷺ) এর উপর যে রোমহর্ষক অত্যাচার করা হয়েছে এর বিষদ বিবরণ দিতে গেলে লেখার কলেবর অনেক বিশাল হয়ে যেতে পারে। [5]
সাধারণ মুসলিমদের উপর নির্যাতনঃ
রাসুলুল্লাহ(ﷺ) এর সাহাবীদের উপরেও অমানুষিক নির্যাতন চলছিলো। হোক সে ধনী বা সম্ভ্রান্ত পরিবারের লোক, হোক সে দরিদ্র বা কৃতদাস – ইসলাম গ্রহণ করলেই তাঁর উপর মক্কাবাসীর নির্যাতন ও নিষ্পেষণের খড়গ নেমে আসতো। কোনো সম্ভ্রান্ত ও সম্মানিত মানুষের ইসলাম গ্রহণের কথা শুনলে মক্কার কুরাঈশ নেতা আবু জাহল তাঁকে গালমন্দ ও অপমান করতো। সামাজিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকেও ক্ষতিগ্রস্ত করার হুমকি দিতো। কোনো দুর্বল মানুষ ইসলাম গ্রহণ করলে তাঁকে ধরে প্রহার করতো এবং অন্যদেরও প্রহার করতে। অন্যদের উৎসাহিত করতো। [6]
উসমান ইবন আফফান (রা.) ইসলাম গ্রহণের পর তাঁর চাচা তাঁকে খেজুরের চাটাইয়ের মধ্যে জড়িয়ে ধোঁয়া দিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে তাঁকে কষ্ট দিতেন। [7] মুসয়াব ইবন উমায়ের (রা.)-এর মা তাঁর ইসলাম গ্রহণের খবর শোনার পর পুত্রের পানাহার বন্ধ করে দেন এবং তাকে ঘর থেকে বের করে দেযন। পরিস্থিতির কারণে তিনি এমন অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলেন যে তাঁর গায়ের চামড়া খোলস ছাড়ানো সাপের গায়ের মতো হয়ে গিয়েছিলো। [8] বিলাল(রা.) ছিলেন উমাইয়া ইবন খালফের ক্রীতদাস। ইসলাম গ্রহণের পর উমাইয়া বিলাল (রা.)-কে গলায় দড়ি বেঁধে উচ্ছল বালকদের হাতে তুলে দিত। উমাইয়া নিজেও তাঁকে বেঁধে নির্মম প্রহারে জর্জরিত করতো। এরপর উত্তপ্ত বালির ওপর জোর করে শুইয়ে রাখতো। এ সময়ে তাকে অনাহারে রাখা হতো, পানাহার কিছুই দেয়া হতো না। কখনো কখনো দুপুরের রোদে মরু বালুকার ওপর শুইয়ে বুকের ওপর ভারি পাথর চাপা দিয়ে রাখতো। এ সময় বলতো, “তোমার মৃত্যু হওয়া পর্যন্ত এভাবে ফেলে রাখা হবে। বাঁচতে চাইলে মুহাম্মাদের(ﷺ) পথ ছাড়ো!” কিন্তু তিনি এমনি কষ্টকর অবস্থাতেও বলতেন ‘আহাদ, আহাদ' [(আল্লাহ) এক]। [9]
আম্মার ইবন ইয়াসের (রা.) ছিলেন বনু মাখযুমের ক্রীতদাস। তিনি এবং তাঁর পিতামাতা ইসলাম গ্রহণের পর তাঁদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন শুরু করা হলো। আবু জাহলের নের্তৃত্বে পৌত্তলিকরা তাঁদেরকে উত্তপ্ত রোদে বালুকাময় প্রান্তরে শুইয়ে কষ্ট দিতো। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে তাঁর পিতা ইয়াসের (রা.) ইন্তেকাল করেন। তাঁর স্ত্রী আম্মারের(রা.) মা সুমাইয়া (রা.)-এর লজ্জাস্থানে দুর্বৃত্ত আবু জাহেল বর্শা নিক্ষেপ করে। এতে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। তিনি ছিলেন ইসলামের প্রথম শহীদ। আম্মারের(রা.) ওপর তখনো অব্যাহতভাবে অত্যাচার চালানো হতো। তাঁকে কখনো উত্তপ্ত বালুকার ওপর শুইয়ে রাখা হতো, কখনো বুকের ওপর ভারি পাথর চাপা দেয়া হতো, কখনো পানিতে চেপে ধরা হতো। [10]
খাব্বাব ইবন আরত (রা.) খোজায়া গোত্রের উম্মে আনসার নামে এক মহিলার ক্রীতদাস ছিলেন। পৌত্তলিকরা তাঁর ওপর নানাভাবে নির্যাতন চালাতো। তাঁকে মাটির ওপর টানতো। [11] তাঁর মাথার চুল ধরে টানতো এবং ঘাড় মটকে দিতো। কয়েকবার জ্বলন্ত কয়লার ওপরে তাঁকে শুইয়ে বুকে পাথর চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিলো, যাতে তিনি উঠতে না পারেন। [12]
যিন্নীরাহ নাহদিয়া এবং তাদের কন্যা এবং উম্মে উবাইস ছিলেন ক্রীতদাসী। এরা ইসলাম গ্রহণ করে পৌত্তলিকদের হাতে কঠোর শাস্তি ভোগ করেন। পৌত্তলিকরা বীভৎস উপায়েও ইসলাম গ্রহণকারীদের শাস্তি দিতো। তারা কোনো কোনো সাহাবীকে উট এবং গাভীর কাঁচা চামড়ার ভেতর জড়িয়ে বেঁধে রোদে ফেলে রাখতো। কাউকে লোহার বর্ম পরিয়ে তপ্ত পাথরের ওপর শুইয়ে রাখতো। কারো ইসলাম গ্রহণের খবর পেলেই দুবৃত্ত পৌত্তলিকরা নানা উপায়ে তাঁর ওপর অত্যাচার এবং নির্যাতন চালাতো।
ইসলামের প্রাথমিক যুগের মুসলিমদের এই সমস্ত নির্যাতনের বিবরণ নেয়া হয়েছে সুবিখ্যাত সিরাত গ্রন্থ ‘আর রাহিকুল মাখতুম’ থেকে। [13] এখানে খুব সংক্ষিপ্তভাবে বিবরণগুলো দেয়া হয়েছে। অন্যান্য সিরাত গ্রন্থেও এই ঘটনাগুলো আছে। [14]
মক্কার জীবনের সুদীর্ঘ ১৩ বছরে রাসুলুল্লাহ(ﷺ) ও সাহাবীদের উপর এমন বহুমুখী ভয়াবহ অত্যাচার-নির্যাতনের পরেও তাঁরা কোনো যুদ্ধ বা জিহাদ করেননি। কেননা আল্লাহর পক্ষ থেকে তখনও এমন বিধান নাজিল হয়নি। আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁদেরকে সংযত থাকার আদেশ দেয়া হয়েছিলো, সলাত কায়েম ও দরিদ্রদেরকে দান করার আদেশ দেয়া হয়েছিলো।
كُفُّوا أَيْدِيَكُمْ وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ
অর্থঃ তোমাদের হস্ত সংযত রাখো এবং সলাত আদায় করো ও যাকাত প্রদান করো [15]
এই অত্যাচার ও নির্যাতন থেকে দ্বীন এবং প্রাণ রক্ষা করতে নবী(ﷺ) এর নির্দেশে কিছু সংখ্যক সাহাবী উত্তর আফ্রিকার আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন। [16] মুশরিক কুরাঈশদের অত্যাচার-নির্যাতন এতো কিছুর পরেও বন্ধ হয় না।
কুরাঈশ নেতাদের লোভ প্রদর্শন এবং ইসলামবিরোধীদের অভিযোগের অসারতাঃ
এতো কিছু করার পরেও মানুষের ইসলাম গ্রহণ বন্ধ করতে না পেরে মক্কার কুরাঈশরা নবী করিম(ﷺ)কে লোভ দেখানোর পথ বেছে নেয়। তারা তাঁর সামনে প্রস্তাব দেয় –
“...তুমি কিছু অর্থ-সম্পদের মালিক হতে চাও— তা হলে আমাদের সম্পদ থেকে তোমার জন্য এত অর্থ সংগ্রহ করবো, যাতে তুমি আমাদের মাঝে সবাইতে অধিক সম্পদের মালিক হবে।
আর যদি তুমি এ দিয়ে আমাদের মাঝে শ্রেষ্ঠ পদমর্যাদা লাভ করতে চাও, তা হলে আমরা তোমাকে আমাদের নেতা বানিয়ে নেবো।
আর যদি রাজত্ব চাও, তবে তোমাকে আমাদের রাজা বানিয়ে নেবো। ...” [17]
“যদি বিয়ের প্রয়োজন বোধ করো, তাহলে কুরাঈশ নারীদের যাকে ইচ্ছা পছন্দ করো; আমরা তোমার কাছে ১০ জনকে বিয়ে দিয়ে দেবো!” [18]
একবার নয় বরং একাধিক বার তারা নবী(ﷺ)কে এইসব জিনিসের লোভ দেখায়। প্রথমবার কুরাঈশ নেতা উতবা একাকী এসে এসব জিনিস দিতে চায়। পরের বার মক্কার সকল কুরাঈশ নেতারা কা’বা ঘরের নিকট একত্রিত হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মুহাম্মাদ(ﷺ)কে এই সকল জিনিস দেবার প্রস্তাব দেয়। [19]
নবী(ﷺ) তাদেরকে কী উত্তর দিলেন?
তখন রাসুলুল্লাহ্(ﷺ) তাদের বললেন : “তোমরা যা যা বলছো, তার কোনোটিই আমার মধ্যে নেই। আমি তোমাদের কাছে যে দাওয়াত নিয়ে এসেছি, তার বিনিময়ে আমি তোমাদের অর্থ-সম্পদ, নের্তৃত্ব, রাজত্ব কোনোটাই চাই না। আমাকে তো আল্লাহ্ তোমাদের কাছে রাসুল হিসাবে পাঠিয়েছেন। আমার উপর একটি কিতাব নাযিল করেছেন এবং তোমাদের জন্য সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা হওয়ার জন্য আমাকে আদেশ দিয়েছেন। সুতরাং আমি আমার রবের বাণী তোমাদের কাছে পৌছিয়ে দিয়েছি এবং তোমাদের সদুপদেশ দিয়েছি। তোমরা যদি আমার আনীত দাওয়াত গ্রহণ করো, তবে তা তোমাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতের সৌভাগ্যের কারণ হবে। আর যদি তোমরা তা প্রত্যাখ্যান করো, তা হলে আমি আল্লাহর সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় ততক্ষণ ধৈর্য ধারণ করবো, যতক্ষণ না তিনি আমার ও তোমাদের বিবাদের নিষ্পত্তি করে দেন। [20]
আমরা দেখলাম, ৭ম শতাব্দীর একজন আরব পুরুষ যা যা চাইতে পারে এর প্রায় সকল কিছুই মক্কার পৌত্তলিক নেতারা নবী(ﷺ)কে দিতে চেয়েছিলো। তিনি তাঁর নবুয়তী জীবনের শুরুর ভাগে একদম বিনা যুদ্ধেই এগুলো পেতে পারতেন। কিন্তু তিনি এ সকল প্রস্তাবকে নির্দ্বিধায় ফিরিয়ে দিয়ে তাদের নিকট শুধুমাত্র আল্লাহর দ্বীনকে পেশ করেছিলেন। যেসব ইসলামবিরোধীরা নবী মুহাম্মাদ(ﷺ) এর শানে অপবাদ দিয়ে তাঁকে দস্যুদের সাথে তুলনা দিতে চান (নাউযুবিল্লাহ), তাদের অপবাদের অসারতা এখানেই প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে।
অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে সর্বাত্মক বয়কটঃ
এ সকল লোভ দেখানোতেও যখন কাজ হলো না, তখন মক্কার মুশরিকরা মুসলিমদেরকে সর্বাত্মকভাবে বয়কট করার সিদ্ধান্ত নিলো। তাদের সাথে ক্রয় বিক্রয়, সামাজিক কার্যকলাপ, অর্থনৈতিক আদান-প্রদান, কুশল বিনিময় ইত্যাদি সবকিছুই বন্ধ রাখা হবে। তাদের সঙ্গে ওঠাবসা, কথোপকথন মেলামেশা, বাড়িতে যাতায়াত ইত্যাদি কোনো কিছুই করা চলবে না। হত্যার জন্য রাসুলুল্লাহ(ﷺ)-কে যতদিন তাদের হাতে সমর্পণ না করা হবে, ততদিন পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে।
তাঁদের জন্য খাদ্য-শস্য এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রী আমদানী ও পানীয় সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। কারণ, খাদ্য-শস্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রী যা মক্কায় আসতো মুশরিকগণ তা তাড়াহুড়া করে ক্রয় করে নিতো। এ কারণে তাঁদের অবস্থা অত্যন্ত করুণ হয়ে পড়লো। খাদ্যাভাবে তাঁরা গাছের পাতা, চামড়া ইত্যাদি খেতে বাধ্য হলো। কোনো কোনো সময় তাদের উপবাসেও থাকতে হতো। উপবাসের অবস্থা এরূপ হয়ে যখন মর্মবিদারক কণ্ঠে ক্রন্দন করতে থাকতো তখন গিরি সংকটে তাদের নিকট জিনিসপত্র পৌছানো প্রায় অসম্ভব পড়েছিল, যা পৌঁছাতো তাও অতি সঙ্গোপনে। হারাম মাসগুলো ছাড়া অন্য কোনো সময়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁরা বাইরে যেতে পারতেন না। অবশ্য যে সকল কাফেলা মক্কার বাইরে থেকে আগমন করতো তাদের নিকট থেকে তারা জিনিসপত্র ক্রয় করতে পারতেন। কিন্তু মক্কার ব্যবসায়ীগণ এবং লোকজনেরা সে সব জিনিসের দাম এতই বৃদ্ধি করে দিতো যে, গিরিসংকটবাসীগণের ধরা ছোঁয়ার বাইরেই তা থেকে যেতো। [21] এভাবে প্রায় তিন বছর তাঁদেরকে ভয়াবহ কষ্ট ও মানবেতর জীবন-যাপনে বাধ্য করা হয়। এরপরেও মুসলিমরা মক্কার পৌত্তলিকদের বিরুদ্ধে কোনো যুদ্ধ করেনি, হামলা করেনি।
মক্কার পৌত্তলিকদের লাগামহীন অত্যাচারের কারণে নবী(ﷺ) এর অনুমতিক্রমে মুসলিমরা মদীনায় হিজরত করা আরম্ভ করলেন। এবং এই হিজরতের পথেও পৌত্তলিকরা নানাভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছিলো। [22] এতোকিছুর পরেও ইসলামের অগ্রযাত্রাকে দমাতে না পেরে কুরাঈশ নেতারা একজোট হয়ে তাদের দেব-দেবীর নামে শপথ নেয় - মুহাম্মাদ(ﷺ)কে হত্যা করে এরপর তারা ক্ষান্ত হবে। এর প্রেক্ষিতে আল্লাহ তা’আলা তাঁকে হিজরতের অনুমতি প্রদান করেন। তাঁর সাহাবীদের প্রায় সবাই পূর্বেই হিজরত করে মদীনায় চলে গিয়েছিলেন। তাঁদেরকে আগে নিরাপদ গন্তব্যে পাঠিয়ে দিয়ে এরপরেই হিজরতে যান উম্মতের কাণ্ডারী মুহাম্মাদ(ﷺ)। সাথে ছিলেন বিশ্বস্ত সহচর আবু বকর(রা.)। [23]
ইসলাম প্রচারের জন্য দীর্ঘকাল কষ্ট, নির্যাতন ও দুর্ভোগের পর সেই হিজরত হয়েছিলো। সুদীর্ঘ ১৩ বছর এতো ভয়াবহ কষ্ট ও নির্যাতনের পরেও রাসুল(ﷺ) মক্কাবাসীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের আদেশ দেননি।
মদীনায় আগমন করেই কি নবী(ﷺ) মক্কাবাসীর বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করেন? :
রাসুল(ﷺ) তাঁর সাহাবীদের নিয়ে মদীনায় এলেন। কিন্তু সেখানে এসেই কি তিনি মক্কাবাসীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন? উত্তর হচ্ছেঃ না। সিরাত গ্রন্থগুলোতে আমরা পাই যে, মদীনায় এসে নবী(ﷺ) নতুন এক সমাজ রূপায়নে আত্মনিয়োগ করেন। মক্কা থেকে হিজরতকারী (মুহাজির) সাহাবীদের সাথে মদীনায় সাহায্যকারী (আনসার) সাহাবীদের মধ্যে ভ্রার্তৃত্বের বন্ধন স্থাপন করেন। তাঁদেরকে সর্বপ্রকার জুলুম থেকে বিরত থাকা, পরস্পর দয়া করা, দান-সদকা করা ইত্যাদির শিক্ষা প্রদান করেন। আল্লাহর নবী(ﷺ) এর দাওয়াতে এক সময়ের যুদ্ধপ্রবন মদীনায় সাধিত হয় বৈপ্লবিক পরিবর্তন, সেখানে তৈরি হয় শান্তি-সুখের নতুন এক সমাজ। [24] মদীনায় বসবাসরত অমুসলিম গোষ্ঠী ছিলো কিছু ইহুদি গোত্র। নবী(ﷺ) তাদের সাথেও একটি চুক্তি সম্পাদন করেন যেটি ইতিহাসে “মদীনা সনদ” নামে বিখ্যাত। এই সনদে ইহুদিদেরকেও মুসলিমদের সাথে অন্যদের মোকাবিলায় একটি সাধারণ জাতি হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়, অত্যাচারের বিরুদ্ধ তাদেরকে সর্বাত্মক সাহায্য প্রদানের নিশ্চয়তা দেয়া হয়। তাদের ধর্ম পালনের স্বাধীনতা প্রদান করা হয়। [25] এভাবে কুরআন-সুন্নাহর আইনের ভিত্তিতে মদীনায় শান্তি ও স্বস্তির এক রাষ্ট্র স্থাপন করা হয়। মদীনায় হিজরত করার অব্যাবহিত পরে এইসব ঘটনার বিবরণই সিরাত গ্রন্থগুলোতে পাওয়া যায়। অথচ ইসলামবিরোধীরা বলতে চায় মদীনায় এসেই নাকি নবী(ﷺ) মক্কাবাসীর বিরুদ্ধে হামলা করতে শুরু করেন!
মক্কাবাসী কর্তৃক যুদ্ধ ঘোষণাঃ
নবী করিম(ﷺ) যখন মদীনায় এক নতুন সমাজ গঠনে যখন আত্মনিয়োগ করছেন, সেই সময়ে মক্কাবাসী পৌত্তলিকরা হিংসার আগুনে প্রজ্জ্বলিত হয়ে মদীনাবাসীর নিকট যুদ্ধের পয়গাম প্রেরণ করে। নবী(ﷺ) মদীনায় হিজরত করার পূর্বে সেখানকার নেতা ছিলো আব্দুল্লাহ ইবন উবাই। মক্কাবাসীর বিকট মদিনার স্বীকৃত নেতা ছিলো সে। তার নিকট মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বার্তা দিয়ে মক্কাবাসী একটি চিঠি লেখে। চিঠিতে বলা ছিলো—
“তোমরা আমাদের কিছু সংখ্যক বিপথগামী লোককে আশ্রয় দিয়েছো, এজন্য আমরা আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি যে, হয় তোমরা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে তোমাদের দেশ থেকে তাদেরকে বহিষ্কার করে দেবে, অন্যথায় সদলবলে তোমাদের উপর ভীষণভাবে আক্রমণ পরিচালিত করে তোমাদের যোদ্ধাদের হত্যা এবং মহিলাদের মানহানি করবো।” [26]
চিঠিটি আব্দুল্লাহ ইবন উবাই ও তার সাথীদের নিকট পৌঁছালে তারা রাসুলুল্লাহর(ﷺ) বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ঐক্যবদ্ধ হলো। রাসুলুল্লাহর(ﷺ) এর মদীনা আগমনের জন্য সে মদীনার নের্তৃত্ব হারিয়েছিলো। এ জন্য সে আগে থকেই হিংসায় জ্বলছিলো। মক্কাবাসীর বার্তা পেয়ে সে কালবিলম্ব না করে যুদ্ধের জন্য লোকজনদের একত্রিত করলো।
এ সংবাদ অবগত হয়ে রাসুলুল্লাহ(ﷺ) স্বয়ং তাদের নিকট আগমন করলেন এবং তাদের সম্বোধন করে বললেন, “আমি দেখছি যে, কুরাঈশদের হুমকি তোমাদের অন্তরে গভীরভাবে রেখাপাত করেছে। কিন্তু এটা তোমাদের অনুধাবন করা উচিত যে, তোমরা নিজেরাই নিজেদেরকে যে পরিমাণ ক্ষতির মুখে ঠেলে দিতে যাচ্ছো কুরাঈশরা কোনক্রমেই তোমাদের সেই পরিমাণ ক্ষতি করতে সক্ষম হবে না। তোমরা কি তোমাদের পুত্র ও ভ্রাতাদের সঙ্গে নিজেরাই যুদ্ধ করতে চাও?” [27]
নবী করিম(ﷺ)-এর এ কথা শ্রবণ করে তারা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। কাজেই, আব্দুল্লাহ ইবন উবাইকে তার প্রতিহিংসাজনিত যুদ্ধের সংকল্প থেকে তখনকার মতো বিরত থাকতে হয়। কারণ, রাসুলুল্লাহ(ﷺ)-এর কথায় তার সঙ্গী সাথীদের যুদ্ধস্পৃহা স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও কুরাঈশদের সঙ্গে তার গোপন যোগাযোগ চলতে থাকে। কারণ, মুসলিম ও কাফিরদের মধ্যে বিবাদ বিসম্বাদ বাধিয়ে দেয়ার কোনো সুযোগ হাতছাড়া করার ইচ্ছে তার আদৌ ছিল না। তাছাড়া ইহুদিদের সঙ্গেও সে যোগাযোগ রাখতে থাকে যাতে প্রয়োজন হলে তাদের কাছ থেকেও সাহায্য লাভ সম্ভব হয়। কিন্তু রাসুলুল্লাহ(ﷺ) এর সময়োচিত ও বিজ্ঞোচিত ব্যবস্থাপনার ফলে ঝগড়া-বিবাদের প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখা ক্রমান্বয়ে প্রশমিত হতে থাকে। [28]
যুদ্ধের হুমকি দিয়েই মক্কাবাসীরা ক্ষান্ত হয় না। তারা মসজিদুল হারামকেও মুসলিমদের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। [29]
মদীনার মিত্র মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ ইবন উবাইকে যুদ্ধের চিঠি দেয়া ছাড়াও রাসুলুল্লাহ(ﷺ) এর সহচরদেরকেও কুরাঈশরা আলাদাভাবে হুমকি দিয়ে বার্তা পাঠায়---
“মক্কা হতে তোমরা নিরাপদে ইয়াসরিবে (মদীনায়) পালিয়ে যেতে পেরেছো বলে অহংকারে ফেটে পড়ো না যেন। এটুকু জেনে রেখো যে, ইয়াসরিবে চড়াও হয়েই তোমাদের ধ্বংস করে ফেলার ক্ষমতা আমাদের রয়েছে।” [30]
তাদের এ ধমক শুধু যে কথাবার্তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়, বরং এ ব্যাপারে তারা গোপনে গোপনে তৎপরও ছিল। রাসুলুল্লাহ(ﷺ) তাদের এ ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের কথা এমন এক গুরুত্বপূর্ণ সূত্র থেকে অবগত হয়েছিলেন যে, তিনি সতর্কতা অবলম্বন না করে পারেন নি। নিরাপত্তার খাতিরে তিনি জাগ্রত অবস্থায় রাত্রি যাপন করতেন। তাঁর জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করা হয়েছিলো। [31] তবে কিছুদিন পর স্বয়ং আল্লাহ তা’আলা তাঁর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন।
وَاللَّهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ ۗ
অর্থঃ (হে রাসুল!) মানুষ হতে আল্লাহই তোমাকে রক্ষা করবেন। [32]
তখন রাসুলুল্লাহ(ﷺ) ঘর থেকে মাথা বের করে বললেন,
“হে জনমণ্ডলী! তোমরা ফিরে যাও। মহামহিমান্বিত প্রভু পরওয়ার দেগার আল্লাহ আমাকে নিরাপত্তা দান করেছেন।” [33]
আরব মুশরিকদের শত্রুতাজনিত এ বিপদ শুধুমাত্র রাসুলুল্লাহ(ﷺ) পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তা মুসলিম সমাজের সকল সদস্য পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। উবাই ইবনে কা'ব (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, নবী(ﷺ) এবং তাঁর সাহাবারা মদীনায় আসার পর আনসাররা তাঁদের আশ্রয় প্রদান করেন। এতে সমগ্র আরব তাঁদের বিরুদ্ধে ক্ষেপে যায়। ফলে মদীনার আনসাররা অস্ত্র ছাড়া রাত্রি যাপন করতেন না এবং খুব সকালেও তাঁদের কাছে অস্ত্র থাকতো। [34]
অবশেষে যুদ্ধ করার অনুমতিঃ
মদীনার মুসলিমদের অস্তিত্বের জন্যে অমুসলিমদের পক্ষ থেকে নিরাপত্তাহীনতা ছিলো বিশেষ হুমকি। এটা ছিলো তাদের টিকে থাকা না থাকার জন্যে বিরাট চ্যালেঞ্জ। কুরাঈশরা মুসলিমদের ক্ষতি করার জন্যে সংকল্প থেকে কোনোক্রমেই বিরত হচ্ছিলো না। সকল ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছিলো। অবশেষে আল্লাহ রব্বুল আলামীন মুসলিমদের যুদ্ধ করার অনুমতি দিলেন। এই সময়ে আল্লাহ তা’আলা কুরআনের এই আয়াত নাযিল করেন, “যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হল তাদেরকে, যাদেরকে আক্রমণ করা হচ্ছে। কারণ তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছে। নিশ্চয় আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য / বিজয় দানে সক্ষম।”
এই আয়াতের প্রেক্ষিতে এরপর আরো কয়েকটি আয়াত নাযিল হয়েছিলো। এ সকল আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছিলো যে, যুদ্ধ করার এই অনুমতি নিছক যুদ্ধের জন্যে যুদ্ধ নয় বরং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে বাতিল বা মিথ্যার মূল উৎপাটন এবং সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা। [35]
أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوا ۚ وَإِنَّ اللَّهَ عَلَىٰ نَصْرِهِمْ لَقَدِيرٌ
الَّذِينَ أُخْرِجُوا مِن دِيَارِهِم بِغَيْرِ حَقٍّ إِلَّا أَن يَقُولُوا رَبُّنَا اللَّهُ ۗ وَلَوْلَا دَفْعُ اللَّهِ النَّاسَ بَعْضَهُم بِبَعْضٍ لَّهُدِّمَتْ صَوَامِعُ وَبِيَعٌ وَصَلَوَاتٌ وَمَسَاجِدُ يُذْكَرُ فِيهَا اسْمُ اللَّهِ كَثِيرًا ۗ وَلَيَنصُرَنَّ اللَّهُ مَن يَنصُرُهُ ۗ إِنَّ اللَّهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ
الَّذِينَ إِن مَّكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنكَرِ ۗ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُورِ
অর্থঃ “যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হল তাদেরকে, যাদেরকে আক্রমণ করা হচ্ছে। কারণ তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছে। নিশ্চয় আল্লাহ তাদেরকে বিজয় দানে সক্ষম। যাদেরকে তাদের নিজ বাড়ী-ঘর থেকে অন্যায়ভাবে শুধু এ কারণে বের করে দেয়া হয়েছে যে, তারা বলে, “আমাদের রব আল্লাহ”। আর আল্লাহ যদি মানবজাতির একদলকে অপর দল দ্বারা দমন না করতেন, তবে বিধ্বস্ত হয়ে যেতো খ্রিষ্টান সন্ন্যাসীদের আশ্রম, গির্জা, ইহুদিদের উপাসনালয় এবং মসজিদসমূহ - যেখানে আল্লাহর নাম অধিক স্মরণ করা হয়। আর আল্লাহ অবশ্যই তাকে সাহায্য করেন, যে তাকে সাহায্য করে। নিশ্চয় আল্লাহ শক্তিমান, পরাক্রমশালী। তারা এমন যাদেরকে আমি যমীনে ক্ষমতা দান করলে তারা সালাত কায়েম করবে, যাকাত দেবে এবং সৎকাজের আদেশ দেবে ও অসৎকাজ থেকে নিষেধ করবে; আর সব কাজের পরিণাম আল্লাহরই অধিকারে।” [36]
এর প্রেক্ষিতে রাসুল(ﷺ) মুসলিমদেরকে কুরাঈশদের প্রতিহত করার নির্দেশ দেন। আমরা দেখলাম এর কারণ ও প্রেক্ষাপট কী ছিলো। এগুলো মোটেও “লুটপাট” ছিলো না যেমনটি ইসলামবিরোধীরা বলে থাকে। কুরআনের আয়াতে স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে এই অনুমতি দানের কারণ ছিল যে মুসলিমরা ছিলো নির্যাতিত। এটি ছিলো রক্ষণাত্মক জিহাদের বিধান। আক্রমণাত্মক জিহাদের বিধান তখনো নাজিল হয়নি। তা নাজিল হয়েছে রাসুল(ﷺ) এর নবুয়তী জীবনের একদম শেষভাগে। [37] আক্রমণাত্মক জিহাদের মধ্যেও “লুটপাট” বা “সন্ত্রাসবাদ” এর কোনো উদ্যেশ্য থাকে না। এর একমাত্র উদ্যেশ্য থাকে আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করা। আলাদাভাবে বৃহৎ পরিসরে এ ব্যাপারে আলোচনা হতে পারে।
রাসুল(ﷺ)কে যুদ্ধের অনুমত প্রদানের ব্যাপারটিকে ইবন হিশাম(র.) এর ‘সীরাতুন নবী(সা.)’ গ্রন্থে এভাবে চিত্রিত করা হয়েছে—
আবু মুহাম্মদ আবদুল মালিক ইবন হিশাম-যিয়াদ ইবন আবদুল্লাহ আল-বুকায়ী মুহাম্মদ ইবন ইসহাক মুত্তালিবী সূত্রে বর্ণনা করেন, ‘আকাবার বায়'আতের পূর্বে রাসুলুল্লাহ(ﷺ)-কে যুদ্ধের অনুমতি প্রদান করা হয়নি এবং তাঁর জন্যে রক্তপাত বৈধ করা হয়নি। আল্লাহর দিকে দাওয়াত প্রদান, দুঃখ-কষ্টে ধৈর্য ধারণ এবং অজ্ঞদের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শনের জন্যই তখন তিনি আদিষ্ট হতেন। কুরাঈশরা তাঁর অনুসারী মুহাজিরদেরকে অতিষ্ঠ করে তোলে। তারা তাঁদেরকে তাদের ধর্মীয় ক্ষেত্রে সংকটের সম্মুখীন করে তোলে এবং তাঁদেরকে তাঁদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়। মোটকথা, এদের কেউ কেউ দ্বীনের জন্যে চরম কষ্ট ভোগ করছিলেন। কেউ কেউ তাদের হাতে শাস্তি ভোগ করছিলেন। আর কেউ কেউ তাদের নির্যাতন থেকে আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে নানা দেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। এদের কেউ আবিসিনিয়ায়, কেউ মদীনায় আবার কেউ অন্য কোথাও। কুরাঈশরা যখন আল্লাহর নাফরমানীতে লিপ্ত হল এবং তাদের জন্যে আল্লাহ্ সম্মানপ্রাপ্তির যে সুযোগ দিয়েছিলেন তা প্রত্যাখ্যান করল এবং আল্লাহর নবীর প্রতি মিথ্যা আরোপ করলো এবং এক আল্লাহর ইবাদতকারী, একত্ববাদের অনুসারী তাঁর নবীকে মান্যকারী এবং তাঁর দ্বীনকে অবলম্বনকারীদেরকে নিগ্রহ, নির্যাতন ও দেশছাড়া করল, তখন আল্লাহ তা'আলা তাঁর রাসুলকে যুদ্ধ ও অত্যাচারের প্রতিশোধ গ্রহণের অনুমতি প্রদান করলেন। [38]
কু্রাঈশদের আগ্রাসন মোকাবিলায় মুসলিমদের গৃহিত পদক্ষেপঃ
সে সময়ে পরিস্থিতি ছিলো কুরাঈশদের অনুকূলে । এ কারণে মুসলিমদের কিছু কৌশলের প্রয়োজন দেখা দেয়। মুসলিমরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণের সীমানা কুরাঈশদের বাণিজ্য কাফেলা পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। মক্কা থেকে সিরিয়ার মধ্যবর্তী পথ ছিলো এই সীমানা। মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণ সীমানা বিস্তৃত করার জন্যে সুদক্ষ কাণ্ডারী মুহাম্মাদ(ﷺ) দু’টি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
১) মক্কা থেকে সিরিয়া ও মদীনার যাতায়াতকারী বাণিজ্য কাফেলার পথের পাশে যেসব গোত্রের বাস, তাদের সাথে অনাক্রমণ চুক্তি
২) সেই পথে টহলদানকারী কাফেলা প্রেরণ
একটি অনাক্রমণ চুক্তি জুহাইনা গোত্রের সাথেও সম্পাদিত হয়। এ গোত্র মদীনা থেকে তিন মনযিল অর্থাৎ ৫০ মাইল দূরে বাস করতো। এছাড়া আরো কয়েকটি গোত্রের সাথেও নবী(ﷺ) চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। [39]
ইসলামের সমালোচকরা রাসুল(ﷺ)কে একজন আক্রমণকারী ও দস্যু হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করে (নাউযুবিল্লাহ)। অথচ আমরা দেখলাম তিনি শুরুতেই কিছু গোত্রের সাথে অনাক্রমণ চুক্তি করেছেন। কেননা তারা মুসলিমদের আক্রমণ করেনি। ইসলামবিরোধীদের উদ্যেশ্যে প্রশ্ন রাখবোঃ “দস্যু”দের কাজ কি অনাক্রমণ চুক্তি করা? নাকি বাছ-বিচার না করে যে কাউকে আক্রমণ করে লুটপাট করা?
কুরাঈশদের আগ্রাসন মোকাবিলার জন্য রাসুল(ﷺ) মক্কা থেকে সিরিয়া ও মদীনার যাতায়াতকারী বাণিজ্য কাফেলার পথে টহলদানকারী কাফেলা প্রেরণ করেছেন। পবিত্র কুরআনের আয়াতে যুদ্ধের অনুমতি প্রদানের পর উল্লিখিত উভয় পরিকল্পনার বাস্তবায়নের জন্যে মুসলিমদের পর্যায়ক্রমিক অভিযান শুরু হয়। অস্ত্র সজ্জিত কাফেলা টহল দিতে থাকে। এর উদ্দেশ্য ছিলো মদীনার আশেপাশের রাস্তায় সাধারণভাবে এবং মক্কার আশেপাশের রাস্তায় বিশেষভাবে লক্ষ্য রেখে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে। একই সাথে সেসব রাস্তার আশেপাশে বসতি স্থাপনকারী গোত্রসমূহের সাথে অনাক্রমণ চুক্তি সম্পাদন করতে হবে। এর ফলে মদীনার পৌত্তলিক, ইহুদি এবং আশেপাশের বেদুইনদের মনে এ বিশ্বাস স্থাপন করা সম্ভব হবে যে, বর্তমানে মুসলিমরা যথেষ্ট শক্তিশালী। অতীতের দুর্বলতা ও শক্তিহীনতা তারা কাটিয়ে উঠেছে। উপরন্তু এর মাধ্যমে কুরাঈশদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ সাহসিকতা সম্পর্কে তাদের ভীত করে দেয়া সম্ভব হবে। তাদের অর্থনীতিকে হুমকির সম্মুখীন দেখে সন্ধি-সমঝোতার প্রতি তারা ঝুঁকে পড়বে। মুসলিমদের ঘরে প্রবেশ করে তাদের নিঃশেষ করা, আল্লাহর পথে বাধা সৃষ্টি করা এবং দুর্বল মুসলিমদের উপর অত্যাচার করার যেসব সঙ্কল্প তারা মনে মনে পোষণ করছে, সেসব থেকে বিরত থাকবে। এর ফলে জাযিরাতুল আরবে তাওহিদের দাওয়াতের কাজ মুসলিমরা সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে করতে পারবে। [40] রাসুল(ﷺ) এর সাহাবীরা তাঁদের ঘরবাড়ী সব মক্কায় ফেলে রেখে মদীনায় হিজরত করেছিলেন। তাঁদের সেইসব বাড়ী-ঘর ও সম্পদ কুরাঈশরা অন্যায়ভাবে দখল করেছিলো। এর পরবর্তীকালে মদীনাতেও কুরাঈশরা তাঁদেরকে শান্তিতে থাকতে না দিয়ে যুদ্ধের দামামা বাজাচ্ছিলো। এহেন পরিস্থিতিতে মদীনার বাইরে কুরাঈশদের যাত্রাপথে সেনা টহল ও তাদের অর্থনীতির চালিকাশক্তি কাফেলায় আক্রমণ শুরু হয়। এর উদ্যেশ্যের সাথে দস্যুদের লুণ্ঠনকে মেলানো সম্পূর্ণরূপে সত্যের অপলাপ। মদীনার জীবনে মুসলিমরা কুরাঈশদের কাফেলায় আক্রমণ করেছে, গনিমতও গ্রহণ করেছে। কাফেলা আক্রমণগুলোর পূর্বে রাসুল(ﷺ) কখনো কখনো গনিমতের বিষয়টিও উল্লেখ করতেন। কিন্তু কী পরিস্থিতিতে এবং কী প্রেক্ষাপটে এগুলো হয়েছে তা বিবেচনা করা উচিত।
মুসলিমদের সর্বপ্রথম অভিযান ছিলো সায়ফুল বাহর এর অভিযান। হামজা বিন আব্দুল মুত্তালিব(রা.) এর নের্তৃত্বে এটি প্রেরিত হয়। এই অভিযান হয় হিজরী ১ম বর্ষের রমযান মাসে, ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে। অর্থাৎ অভিযানটি হয় মদীনায় হিজরতের ৭ মাস পরে। [41] আমরা আগেই আলোচনা করেছি মদীনায় হিজরতের পরের সময়টিতে কিভাবে নবী করিম(ﷺ) একটি শান্তিময় ও সুন্দর সমাজ বিনির্মানে আত্মনিয়োগ করছিলেন। এর পরবর্তীতে পৌত্তলিক কুরাঈশদের অব্যাহত হুমকির কারণে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার অনুমতি প্রদান করা হয়। হিজরতের দীর্ঘ ৭ মাস পরে যার সূচনা হয়। কাজেই “নবী মুহাম্মাদ(ﷺ) মদীনায় এসেই কুরাঈশদের বাণিজ্যিক কাফেলা আক্রমণ ও লুণ্ঠন শুরু করেন” – ইসলামবিরোধীদের এহেন কথার অসারতা পুনরায় প্রমাণিত হলো।
আরো একটি বিষয় লক্ষনীয় আর তা হলো – মক্কাবাসীর এলাকায় গিয়ে তাদের উপর সরাসরি কোনো আক্রমণ মদীনাবাসী সে সময়ে করেনি। শুধুমাত্র মুসলিমদের পক্ষ থেকে মক্কাবাসীর বাণিজ্যিক পথগুলোতে সেনা টহলের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। অপরদিকে সে সময়ে মদীনাবাসী মুসলিমদের উপর সরাসরি আক্রমণের সূচনা হয় মক্কার পৌত্তলিকদের পক্ষ থেকেই। মুসলিমদের সেনা অভিযানগুলোর বিবরণের পর ‘আর রাহিকুল মাখতুম’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে—
“পৌত্তলিকদের পক্ষ থেকে প্রথম হামলার ঘটনা ঘটে। কুরয ইবনে জাবের ফাহরীর নেতৃত্বে এ হামলা চালানো হয়। এর আগেও পৌত্তলিকদের পক্ষ থেকে নানা ধরনের বাড়াবাড়ি করা হয়েছিলো।” [42]
এই হামলার ব্যাপারে বিষদ বিবরণ বিভিন্ন সিরাত গ্রন্থে উল্লেখ আছে। মদীনাবাসীর চারণভূমিতে আক্রমণ করে গবাদি পশু অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। রাসুল(ﷺ) ৭০ জন সাহাবীকে নিয়ে সেই লুটেরাদের পিছু ধাওয়া করেছিলেন। এই অভিযানটি ‘গাজওয়া সাফওয়ান’, ‘১ম বদর অভিযান’ ইত্যাদি নামে খ্যাত। [43] আমরা দেখলাম যে মদীনায় ঢুকে মুসলিমদের সম্পদ লুণ্ঠন করে মক্কার পৌত্তলিকরা। কিন্তু ইসলামবিরোধী নাস্তিক-মুক্তমনারা উল্টো মুসলিমদেরকেই লুণ্ঠনকারী হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করে! ইসলামের বিরোধিতা করতে গিয়ে এভাবেই সত্যের সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে অবস্থা নেয় এই মানুষগুলো।
সমগ্র আলোচনার সারাংশ হিসেবে আমরা বলতে পারি—
১। মক্কায় সুদীর্ঘ ১৩ বছর ধরে মুসলিমদের উপর অবর্ণনীয় অত্যাচার নির্যাতন চালানো হয়। তাঁরা বয়কট, মারধোর এমনকি হত্যার শিকার হন। কিন্তু শত নিপীড়নের মাঝেও রাসুল(ﷺ) মুসলিমদেরকে পৌত্তলিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আদেশ দেননি। বরং আল্লাহর আদেশক্রমে ধৈর্য ধারণের উপদেশ দিয়েছেন।
২। পৌত্তলিকরা নির্যাতন চালিয়ে ব্যার্থ হয়ে রাসুল(ﷺ)কে সম্পদ, নের্তৃত্ব ও রাজত্বের লোভ দেখায়। কিন্তু রাসুল(ﷺ) নির্দ্বিধায় সেসব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তাদের সামনে ইসলামকে পেশ করেন।
৩। মক্কার পৌত্তলিকদের অত্যাচারে মুসলিমরা প্রথমে আবিসিনিয়ায় এবং পরে মদীনায় হিজরত করেন।
৪। মক্কাবাসী এরপর মদীনাতেও আগ্রাসন চালানোর চেষ্টা চালায়। তারা মদীনাবাসীর নিকট যুদ্ধের বার্তা প্রেরণ করে। মুসলিমগণ বাড়িঘর, ধনসম্পদ এসব মক্কায় ফেলে রেখে নিঃস্ব হয়ে মদীনায় এসেছিলেন নিরাপদে দ্বীন পালন করবেন বলে। মক্কার পৌত্তলিকরা এবার মদীনাতেও তাদের জীবনকে অতিষ্ট করে তুলবার আয়োজন করছিলো।
৫। এ পরিস্থিতিতে আল্লাহ তা’আলা মুসলিমদেরকে যুদ্ধ করবার অনুমতি প্রদান করেন। এটি ছিলো রক্ষণাত্মক জিহাদের অনুমতি।
৬। যুদ্ধের অনুমতি পাবার পর মুসলিমরা কুরাঈশদের আগ্রাসন মোকাবিলায় মদীনার বাইরে মক্কা থেকে সিরিয়ার যাত্রাপথে টহলের ব্যবস্থা করেন। আশপশের বিভিন্ন গোত্রের সাথে অনাক্রমণ চুক্তি করেন। এরপরে শুধুমাত্র কুরাঈশদের কাফেলাগুলোকে আক্রমণ করেন যারা তাঁদের উপরে আগ্রাসন চালাচ্ছিলো।
৭। মদীনার সীমানার ভেতরে মক্কার পৌত্তলিকরা আক্রমণ চালিয়েছিলো। মদীনায় ঢুকে গবাদী পশু লুট করার চেষ্টা করেছিলো। অপরদিকে মদীনার মুসলিমরা মক্কার নিকটে এসেও কোনো আক্রমণ করেননি।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি, মহানবী(ﷺ) ও তাঁ সাহবীদেরকে যারা লুটেরা ও দস্যু হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করে, তাদের অভিযোগ অসার ও ভিত্তিহীন। তাদের উপস্থাপনা অসম্পূর্ণ ও প্রসঙ্গবিহীন। আর অর্ধসত্য এসব উপস্থাপনা মূলত অসত্যেরই নামান্তর। রাসুলুল্লাহ(ﷺ) মুসলিমদেরকে এই দুনিয়ার জীবনে সম্পদের পাহাড় গড়া, ক্ষমতার জন্য যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া এসব জিনিস শেখাননি। বরং এর বিপরীত শিক্ষাই তিনি প্রদান করেছেন। তাঁর শিক্ষা ছিলো দুনিয়া-বিমুখতা (যুহদ) [44], সাধাসিধে জীবন এবং দান-সদকার শিক্ষা। রাসুলুল্লাহ(ﷺ) এবং তাঁর সাহাবীদের জীবনাদর্শ নির্মোহভাবে অধ্যায়ন করলেই বোঝা যায় যে ইসলামবিরোধীদের প্রচারণা কীরূপ মিথ্যার প্রাসাদের উপরে দাঁড়িয়ে আছে।
( 12 ) وَمَا أَدْرَاكَ مَا الْعَقَبَةُ
( 13 ) فَكُّ رَقَبَةٍ
( 14 ) أَوْ إِطْعَامٌ فِي يَوْمٍ ذِي مَسْغَبَةٍ
( 15 ) يَتِيمًا ذَا مَقْرَبَةٍ
( 16 ) أَوْ مِسْكِينًا ذَا مَتْرَبَةٍ
( 17 ) ثُمَّ كَانَ مِنَ الَّذِينَ آمَنُوا وَتَوَاصَوْا بِالصَّبْرِ وَتَوَاصَوْا بِالْمَرْحَمَةِ
( 18 ) أُولَٰئِكَ أَصْحَابُ الْمَيْمَنَةِ
অর্থঃ তুমি কি জানো, সে ঘাঁটি কী? তা হচ্ছে, দাস মুক্তকরণ। অথবা দুর্ভিক্ষের সময়ে খাদ্য দান করা। ইয়াতীম আত্মীয়-স্বজনকে। অথবা ধূলি-মলিন মিসকীনকে। অতঃপর সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়, যারা ঈমান এনেছে এবং পরস্পরকে উপদেশ দেয় ধৈর্য ধারণের, আর পরস্পরকে উপদেশ দেয় দয়া-অনুগ্রহের। তারাই সৌভাগ্যশালী। [45]
وَيُطْعِمُونَ الطَّعَامَ عَلَىٰ حُبِّهِ مِسْكِينًا وَيَتِيمًا وَأَسِيرًا
إِنَّمَا نُطْعِمُكُمْ لِوَجْهِ اللَّهِ لَا نُرِيدُ مِنكُمْ جَزَاءً وَلَا شُكُورًا
অর্থঃ তারা খাদ্যের প্রতি আসক্তি থাকা সত্ত্বেও মিসকীন, ইয়াতীম ও বন্দীকে খাদ্য দান করে। তারা বলে, ‘আমরা তো আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তোমাদেরকে খাদ্য দান করি। আমরা তোমাদের থেকে কোনো প্রতিদান চাই না এবং কোনো শোকরও না। [46]
উমার ইবনুল খাত্তাব (রা.) থেকে বর্ণিতঃ আমি রাসুলুল্লাহ(ﷺ) -এর নিকট প্রবেশ করলাম। তিনি তখন খেজুর পাতার চাটাইয়ের উপর শোয়া ছিলেন। আমি বসে পড়লাম। তাঁর পরিধানে ছিলো একটি লুঙ্গি। এছাড়া আর কোন বস্ত্র তাঁর পরিধানে ছিলো না। তাঁর পাঁজরে চাটাইয়ের দাগ বসে গিয়েছিলো। আমি দেখলাম যে তাঁর ঘরের এক কোনে ছিলো প্রায় এক সা’ গম, বাবলা গাছের কিছু পাতা এবং ঝুলন্ত একটি পানির মশক। এ অবস্থা দেখে আমার দু’চোখে অশ্রু প্রবাহিত হলো। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ হে খাত্তাবের পুত্র! তুমি কাঁদছো কেন?
আমি বললাম, হে আল্লাহর নবী! আমি কেন কাঁদবো না! এই চাটাই আপনার পাঁজরে দাগ কেটে দিয়েছে, আর এই হচ্ছে আপনার ‘ধনভাণ্ডার’। এতে যা আছে তা তো দেখতেই পাচ্ছি! কিসরা (পারস্যরাজ) ও কায়সার (রোম সম্রাট) বিরাট বিরাট উদ্যান ও ঝর্ণা সমৃদ্ধ অট্টালিকায় বিলাস-ব্যসনে জীবন-যাপন করছে। আর আপনি হলেন আল্লাহর নবী এবং তাঁর মনোনীত প্রিয় বান্দা। আর আপনার ‘ধনভাণ্ডারের’ অবস্থা এই।
তিনি বলেনঃ হে খাত্তাবের পুত্র! তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, আমাদের জন্য রয়েছে আখিরাতের স্থায়ী সুখ-শান্তি এবং ওদের জন্য রয়েছে পার্থিব ভোগবিলাস?
আমি [উমার(রা.)] বললাম, হ্যাঁ। [47]
রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বলেনঃ দুনিয়ার সাথে আমার সম্পর্ক কী? আমি দুনিয়াতে এমন এক মুসাফির বৈ তো কিছু নই, যে একটি গাছের ছায়ায় আশ্রয় নিলো, অতঃপর তা ত্যাগ করে গন্তব্যের পানে চলে গেলো। [48]
আবু উমামাহ আল-হারিসী(রা.), থেকে বর্ণিতঃ রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেনঃ অনাড়ম্বর জীবন যাপনই ঈমান। [49]
আবু হুরাইরাহ(রা.) থেকে বর্ণিতঃ রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেনঃ পার্থিব সম্পদের প্রাচুর্য থাকলেই ঐশ্বর্যশালী হওয়া যায় না। মনের ঐশ্বর্যই প্রকৃত ঐশ্বর্য। [50]
আবু হুরাইরাহ (রা.) থেকে বর্ণিতঃ রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেনঃ বিপুল প্রাচুর্যের মালিকরা হলো নীচু স্তরের লোক। তবে যারা বলেছে, এই দিকে ও এই দিকে বিলিয়ে দাও [অর্থাৎ দানশীল] তারা ব্যতিত। তিনি কথাটি তিনবার বলেছেন। [51]
আবু হুরাইরাহ(রা.) , থেকে বর্ণিতঃ রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেনঃ দু’টি জিনিসের ভালোবাসায় বৃদ্ধের মন যুবকই থেকে যায়। বেঁচে থাকার লালসা ও সম্পদের প্রাচুর্য। [52]
আবু হুরাইরাহ(রা.), থেকে বর্ণিতঃ রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেনঃ দরিদ্র মুমিনগণ ধনীদের তুলনায় অর্ধদিন আগে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর অর্ধ দিনের পরিমাণ হবে পাঁচশত বছর। [53]
আবু হুরাইরাহ(রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, সেই মহান সত্তার শপথ যাঁর হাতে আমার প্রাণ! আল্লাহর নবী(ﷺ) কখনও পরপর তিন দিন গমের রুটি পেট ভরে খেতে পাননি, এ অবস্থায় মহামহিম আল্লাহ তাঁকে তুলে নেন (ইনতিকাল করেন)। [54]
আয়িশা(রা.) থেকে বর্ণিতঃ আমরা মুহাম্মাদ(ﷺ) - এর পরিবারবর্গ এক এক মাস এমনভাবে আতিবাহিত করতাম যে, আমাদের চুলায় আগুন জ্বালাতে পারতাম না (কোনো খাবার না থাকার কারণে)। খেজুর ও পানিই হতো আমাদের জীবন ধারণের উপকরণ। [55]
নু’মান বিন বশীর(রা.) থেকে বর্ণিতঃ আমি উমার ইবনুল খাত্তাব(রা.)কে বলতে শুনেছি, আমি রাসুলুল্লাহ(ﷺ)-কে দিনের বেলা ক্ষুধার তাড়নায় পার্শ্ব পরিবর্তন করতে দেখেছি। তিনি তাঁর উদর পূর্তির জন্য এমনকি রদ্দি খেজুরও পেতেন না। [56]
আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিতঃ রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেন, মুহাম্মাদের পরিবারবর্গ এমন অবস্থায় সকালে উপনীত হতো যে, তাদের নিকট এক মুদ্দ পরিমাণ খাদ্যশস্যও থাকতো না। [57]
খালিদ বিন উমায়র (মাকবূল) থেকে বর্ণিতঃ উতবাহ বিন গায্ওয়ান (রা.) মিম্বারে দাঁড়িয়ে আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ(ﷺ) -এর সাথে ৭ জনের মধ্যে ৭ম জন ছিলাম। গাছের পাতা ছাড়া আমাদের আহারের জন্য আমাদের সাথে আর কিছু ছিলো না। শেষে আমাদের মাড়ির ছাল উঠে গিয়েছিলো। [58]
আবু সাঈদ আল-খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিতঃ তোমরা মিসকীনদের মহব্বত করবে। কেননা আমি রাসুলুল্লাহ(ﷺ)কে তাঁর দোয়ায় বলতে শুনেছিঃ “হে আল্লাহ! তুমি আমাকে মিসকীনরূপে জীবিত রাখো, মিসকীনরূপে মৃত্যুদান করো এবং মিসকীনদের দলভুক্ত করে হাশরের ময়দানে উত্থিত করো ”। [59]
আবু হুরাইরাহ (রা.) থেকে বর্ণিতঃ রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেনঃ তোমরা পার্থিব ব্যাপারে তোমাদের চেয়ে কম সমৃদ্ধশালী লোকেদের প্রতি দৃষ্টি দাও এবং তোমাদের চেয়ে অধিক সমৃদ্ধশালী লোকদের প্রতি তাঁকিও না। তাহলে তোমাদেরকে দেয়া আল্লাহর নিয়ামত তোমাদের নিকট তুচ্ছ মনে হবে না। [60]
আবু হুরাইরাহ(রা.) থেকে বর্ণিতঃ নবী(ﷺ) বলেনঃ নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের বাহ্যিক চেহারা ও বিত্ত-বৈভবের প্রতি লক্ষ্য করেন না, বরং তিনি তোমাদের কার্যকলাপ ও অন্তরের দিকে লক্ষ্য রাখেন। [61]
ইবনু উমার(রা.) থেকে বর্ণিতঃ আমি রাসুলুল্লাহ(ﷺ) -এর সাথে ছিলাম। এমতাবস্থায় এক আনসারী নবী(ﷺ) -এর নিকট এসে তাঁকে সালাম দিলো। অতঃপর বললো, হে আল্লাহর রাসুল! মুমিনদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উত্তম কে?
তিনি বলেনঃ স্বভাব–চরিত্রে তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি অধিক উত্তম।
সে পুনরায় জিজ্ঞেস করলো, মুমিনদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বুদ্ধিমান কে?
তিনি বলেনঃ তাদের মধ্যে যারা মৃত্যুকে অধিক স্মরণ করে এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনের জন্য উত্তমরূপে প্রস্তুতি গ্রহণ করে, তারাই সর্বাধিক বুদ্ধিমান। [62]
আনাস বিন মালিক(রা.) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেনঃ নিশ্চয় আল্লাহ আমার নিকট ওহী পাঠিয়েছেন যে, তোমরা নম্রতা অবলম্বন করো, বিনয়ী হও এবং তোমাদের কেউ যেন কারো প্রতি সীমালঙ্ঘন না করে। [63]
রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বলেছেন, তোমরা বন্দীকে মুক্ত করো, ক্ষুধার্তকে খাওয়াও এবং অসুস্থের সুশ্রুষা করো। [64]
لَنۡ تَنَالُوا الۡبِرَّ حَتّٰی تُنۡفِقُوۡا مِمَّا تُحِبُّوۡنَ ۬ؕ
তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্তু ব্যয় না করা পর্যন্ত কখনো কল্যাণ লাভ করবে না। (সুরা আলি ইমরান ৯২)
ইবনু উমার(রা.) এই আয়াত সম্পর্কে জানলে তিনি আল্লাহ তাঁকে যা যা দিয়েছেন এ ব্যাপারে ব্যাপারে গভীরভাবে চিন্তা করলেন । তখন তিনি দেখলেন তার সব চাইতে বেশি প্রিয় হচ্ছে তাঁর মারজানা নামক বাঁদী। তিনি তাকে আল্লাহর নামে মুক্ত করে দিলেন। আর তিনি তাকে আযাদ করে উক্ত বাঁদীকে বিয়ে করে উপকৃত হওয়া পছন্দ করলে তাকে বিয়ে করতে পারতেন (কেননা এটা জায়েজ ছিল এবং তাতে দানে ক্রটিও হতো না,কিন্তু এতে বাহ্যিকভাবে দান ফেরত নেওয়া দেখা যেতো) কিন্তু তিনি তাকে মুক্ত করে বিয়ে করা পছন্দ করলেন না। বরং তিনি তাঁর গোলাম নাফে'(র.) এর নিকট তাকে বিয়ে দেন।
হাদিসে এসেছে যখন এ আয়াত অবতীর্ণ হয় তখন সাহাবী আবু তালহা আনসারী(রা.) নবী(ﷺ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন: হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন: “তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্তু ব্যয় না করা পর্যন্ত কখনো কল্যাণ লাভ করবে না”। ‘বাইরুহা’ বাগানটি হল আমার কাছে সর্বাপেক্ষা প্রিয় বস্তু। সেটাকে আমি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সদাকা করলাম, আপনি যেখানে ইচ্ছা তা ব্যয় করুন।
রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বললেনঃ সে তো বড়ই উপকারী সম্পদ, এ কথা দু’বার বললেন। আমার মনে হয় ওটাকে তুমি তোমার আত্মীয়দের মাঝে বণ্টন করে দাও। তাই রাসুলুল্লাহ(ﷺ)-এর পরামর্শ অনুযায়ী তিনি সেটাকে স্বীয় আত্মীয়-স্বজন এবং চাচাতো ভাইদের মাঝে বণ্টন করে দিলেন। (সহীহ বুখারী) [65]
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিতঃ সালমান (রা.) অসুস্থ হয়ে পড়লে সা’দ (রা.) তাঁকে দেখতে যান। তিনি তাকে কাঁদতে দেখে জিজ্ঞেস করেন, হে ভাই! আপনি কাঁদছেন কেন? আপনি কি রাসুলুল্লাহ(ﷺ) এর সাহচর্য লাভ করেননি? আপনি কি এই এই (ভালো কাজ) করেননি?
সালমান (রা.) বলেন, আমি এই দু’টির কোনোটির জন্যই কাঁদছি না। আমি দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার আক্ষেপে বা আখেরাতের পরিণতির আশংকায় কাঁদছি না। রাসুলুল্লাহ(ﷺ) আমার নিকট থেকে একটি প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন, কিন্তু মনে হয় আমি তাতে সীমালঙ্ঘন করেছি।
সা’দ (রা.) বলেন, তিনি আপনার থেকে কী প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন?
সালমান(রা.) বলেন, তিনি এই প্রতিশ্রুতি নিয়েছিলেন যে, “তোমাদের যে কোনো ব্যক্তির একজন পর্যটকের সমপরিমাণ পাথেয় যথেষ্ট”। কিন্তু আমি লক্ষ্য করেছি যে, আমি সীমালঙ্ঘন করে ফেলেছি। হে ভাই সা’দ! যখন তুমি বিচার মীমাংসা করবে, ভাগ-বাঁটোয়ারা করবে এবং কোনো কাজের উদ্যোগ গ্রহন করবে তখন আল্লাহকে ভয় করবে।
সাবিত(রা.) বলেন, আমি জানতে পেরেছি যে, (মৃত্যুর সময়) সালমান(রা.) তাঁর ভরণপোষণের জন্য সঞ্চিত মাত্র বিশাধিক দিরহাম রেখে যান। [এই যৎসামান্য সম্পদকেই তিনি সীমালঙ্ঘন ভাবতেন।] [66]
তথ্যসূত্রঃ
[1] ■ মুসলিম, মিশকাত, হাদিস নং : ৫৮৪৭
■ বুখারী, ফাতহসহ হাদিস ৫২০ এর আলোচনা
■ ‘সীরাতুর রাসূল(ছাঃ)’-মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, পৃষ্ঠা ১২৭
[2] সহীহ বুখারী, (কিতাবুল মানাকিব), হদিস নং ৩৪০২, ৩৫৬৭; (কিতাবুত তাফসির), হাদিস নং : ৪৪৪১
[3] মুসতাদরাক হাকিম (কিতাবু মাআরিফাতিস সাহাবা), হাদিস নং : ৪৩৯৮; মুসনাদ আবু ইয়ালা, হাদিস নং : ৩৫৯২
[4] মুসনাদ আহমাদ হা/১২২৩৩, ১৪০৮৭; তিরমিযী হা/২৪৭২; ইবন মাজাহ হা/১৫১; সীরাহ ছহীহাহ ১/১৫৪
[5] বিজ্ঞ পাঠক বিভিন্ন সিরাত গ্রন্থে এর বিষদ বিবরণ পাবেন। এ ব্যাপারে কিছু উদাহরণের জন্য দেখুনঃ ‘সীরাতুর রাসূল(ছাঃ)’-মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, পৃষ্ঠা ১২৫-১৩৯; আর রাহিকুল মাখতুম—শফিউর রহমান মুবারকপুরী (আল কোরআন একাডেমী লন্ডন প্রকাশনী), পৃষ্ঠা ১০১-১০৬; ১১৭-১১৯
[6] ইবন হিশাম, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩২০
[7] রহমাতুল লিল আলামিন, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৭
[8] ঐ পৃষ্ঠা ৫৮
[9] রহমাতুল লিল আলামিন, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৭; তালাকিহে ফুহুম; ইবন হিশাম, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩১৮
[10] ইবন হিশাম, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩২০
[11] রহমাতুল লিল আলামিন, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৭; এ’যাতুত তানযিল পৃষ্ঠা ৫৩
[12] ঐ ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৭; তালাকিহুল ফুহুম পৃষ্ঠা ৬০
[13] আর রাহিকুল মাখতুম—শফিউর রহমান মুবারকপুরী (আল কোরআন একাডেমী লন্ডন প্রকাশনী), পৃষ্ঠা ১০৭-১০৮
[14] দেখুনঃ
■ ‘সীরাতুন নবী(সা.)’ - ইবন হিশাম [ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ], ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৮০-২৮৪
■ ’সীরাত বিশ্বকোষ’ - ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৪৭-৫৭৫
■ ‘সীরাতুর রাসূল(ছাঃ)’-মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, পৃষ্ঠা ১৪০-১৪৮
[15] আল কুরআন, নিসা ৪ : ৭৭; দেখুনঃ ‘সীরাতুর রাসূল(ছাঃ)’-মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, পৃষ্ঠা ২৬৯
[16] সীরাতুন নবী(সা.)’ - ইবন হিশাম [ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ], ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৮৪-২৯২
[17] ■ সীরাতুন নবী(সা.)’ - ইবন হিশাম [ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ], ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৬১
■ আর রাহিকুল মাখতুম—শফিউর রহমান মুবারকপুরী (তাওহীদ পাবলিকেশন্স), পৃষ্ঠা ১৪৬
[18] সীরাতুন নবি ﷺ [‘সহীহুস সীরাতিন নাবাবিয়্যাহ’ এর বাংলা অনুবাদ] – ইব্রাহিম আলি (মাকতাবাতুল বায়ান প্রকাশনী), খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১২৫
[19] ■ সীরাতুন নবী(সা.)’ - ইবন হিশাম [ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ], ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৫৮-২৬১
■ আর রাহিকুল মাখতুম—শফিউর রহমান মুবারকপুরী (তাওহীদ পাবলিকেশন্স), পৃষ্ঠা ১৪৪-১৪৬
■ আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া – ইবন কাসির [ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ], ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯৭
[20] ■ সীরাতুন নবী(সা.)’ - ইবন হিশাম [ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ], ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৬১
■ আর রাহিকুল মাখতুম—শফিউর রহমান মুবারকপুরী (তাওহীদ পাবলিকেশন্স), পৃষ্ঠা ১৪৬
■ আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া – ইবন কাসির [ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ], ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯৭
[21] ■ আর রাহিকুল মাখতুম—শফিউর রহমান মুবারকপুরী (তাওহীদ পাবলিকেশন্স), পৃষ্ঠা ১৫১
■ ‘সীরাতুর রাসূল(ছাঃ)’-মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, পৃষ্ঠা ১৭৫-১৭৬
[22] ‘সীরাতুর রাসূল(ছাঃ)’-মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, পৃষ্ঠা ২২০-২২৪
[23] ‘সীরাতুর রাসূল(ছাঃ)’-মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, পৃষ্ঠা ২২৫-২২৬
[24] আর রাহিকুল মাখতুম—শফিউর রহমান মুবারকপুরী (তাওহীদ পাবলিকেশন্স), পৃষ্ঠা ২২৮-২৩২
[25] ■ আর রাহিকুল মাখতুম—শফিউর রহমান মুবারকপুরী (তাওহীদ পাবলিকেশন্স), পৃষ্ঠা ২৩৬-২৩৭
■ সীরাতুন নবী(সা.)’ - ইবন হিশাম [ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ], ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৭৫-১৮১
[26] ■ আর রাহিকুল মাখতুম—শফিউর রহমান মুবারকপুরী (তাওহীদ পাবলিকেশন্স), পৃষ্ঠা ২৩৮
■ সুনান আবু দাউদ, হাদিস নং : ৩০০৪ (সহীহ)
[27] ঐ
[28] আর রাহিকুল মাখতুম—শফিউর রহমান মুবারকপুরী (তাওহীদ পাবলিকেশন্স), পৃষ্ঠা ২৩৮
[29] আর রাহিকুল মাখতুম—শফিউর রহমান মুবারকপুরী (তাওহীদ পাবলিকেশন্স), পৃষ্ঠা ২৩৯
[30] ঐ
[31] ঐ
[32] আল কুরআন, মায়িদাহ ৫ : ৬৭
[33] জামীউত তিরমিযী, আবওয়াবুত তাফসীর, ২য় খণ্ড, ১৩ পৃঃ
[34] আর রাহিকুল মাখতুম—শফিউর রহমান মুবারকপুরী (আল কোরআন একাডেমী লন্ডন প্রকাশনী), পৃষ্ঠা ২০৩
[35] আর রাহিকুল মাখতুম—শফিউর রহমান মুবারকপুরী (আল কোরআন একাডেমী লন্ডন প্রকাশনী), পৃষ্ঠা ২০৩
[36] আল কুরআন, হজ ২২ : ৩৯-৪১
[37] আল কুরআন, তাওবাহ ৯ : ২৯ দ্রষ্টব্য
[38] সীরাতুন নবী(সা.)’ - ইবন হিশাম [ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ], ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৩৫-১৩৬
[39] আর রাহিকুল মাখতুম—শফিউর রহমান মুবারকপুরী (আল কোরআন একাডেমী লন্ডন প্রকাশনী), পৃষ্ঠা ২০৩-২০৪
[40] আর রাহিকুল মাখতুম—শফিউর রহমান মুবারকপুরী (আল কোরআন একাডেমী লন্ডন প্রকাশনী), পৃষ্ঠা ২০৩-২০৪
[41] ■ সীরাতুল মুস্তফা সা. – ইদরীস কান্ধলবী [ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ], ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৩
■আর রাহিকুল মাখতুম—শফিউর রহমান মুবারকপুরী (আল কোরআন একাডেমী লন্ডন প্রকাশনী), পৃষ্ঠা ২০৪
[42] আর রাহিকুল মাখতুম—শফিউর রহমান মুবারকপুরী (আল কোরআন একাডেমী লন্ডন প্রকাশনী), পৃষ্ঠা ২০৮
[43] ■ সীরাতুন নবী(সা.)’ - ইবন হিশাম [ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ], ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৯২-২৯৩
■ আর রাহিকুল মাখতুম—শফিউর রহমান মুবারকপুরী (তাওহীদ পাবলিকেশন্স), পৃষ্ঠা ২০৬
[44] শুধুমাত্র এই বিষয়ের উপরেই প্রাচীন যুগের মুসলিম আলেমরা বহু কিতাব রচনা করেছেন। যেমনঃ ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল(র.) এর ‘কিতাবুয যুহদ’ [‘রাসূলের চোখে দুনিয়া’ শিরোনামে মাকতাবাতুল বায়ান প্রকাশনী থেকে বাংলায় অনূদিত]
[45] আল কুরআন, বালাদ ৯০ : ১২-১৮
[46] আল কুরআন, দাহর ৭৬ : ৮-৯
[47] সুনান ইবন মাজাহ ৪১৫৩ (হাসান)
[48] সুনান ইবন মাজাহ ৪১০৯ (সহীহ)
[49] সহীহাহ ৩৪১, তাখরাজুল ঈমান লি ইবনুস সালাম ২৫; সুনান আবু দাউদ ৪১৬১ (সহীহ)
[50] সহীহ বুখারী ৬৪৪৬; সহীহ মুসলিম ১০৫১; তিরমিযী ২৩৭৩; মুসনাদ আহমাদ ৭২৭৪, ৭৫০২, ৯৩৬৪, ৯৪২৫, ১০৫৭৫, ১০৫৮২; সহীহ আত তারগীব ওয়াত তারহীব ৮১৮; তাখরীজুল মুশকিলাহ ১৬
[51] ইবন মাজাহ ৪১৩১, মুসনাদ আহমাদ ৮২৭৭ (হাসান সহীহ)
[52] সহীহ বুখারী ৬৪২০, ১০৪৬, তিরমিযী ২৩৩৮, মুসনাদ আহমাদ ৮২১৭, ৮২৫১, ৮২৬৭; আত-তা’লীকুর রাগীব ৩/১০, সহীহাহ ১৯০৬
[53] তিরমিযী ২৩৫৩ (হাসান সহীহ); তাখরাজুল মিশকাত ৫২৪৩; তালীকুর রাগীব ৪/৮৮; তাহকীকু আসতার ১০৬
[54] সুনান ইবন মাজাহ, হাদিস নং : ৩৩৪৩ (সহীহ)
[55] সহীহ বুখারী ২৫৬৭, ৬৪৫৮; সহীহ মুসলিম ২৯৭২; তিরমিযী ২৪৭১; মুসনাদ আহমাদ ২৩৭১২, ২৩৮৯৯, ২৪০৪০, ২৪২৪৭, ২৪৯৬৩, ২৫৪৭৩; মুখতাসরুশ শামাইল ১১১
[56] সহীহ মুসলিম ২৯৭৮; তিরমিযী ২৩৭২; মুসনাদ আহমাদ ১৬০; মুখতাসরুশ শামাইল ১১০; সহীহাহ ২১০৬
[57] সুনান ইবন মাজাহ, হাদিস নং : ৪১৪৮ (সহীহ)
[58] সহীহ মুসলিম ২৯৬৭; মুসনাদ আহমাদ ১৭১২৪, ২০০৮৬; মুখতাসরুশ শামাইল ১১৫
[59] সুনান ইবন মাজাহ, হাদিস নং : ৩৪৫৮ (সহীহ); সহীহাহ ৩০৮, ইরওয়া ৮৬১
[60] সহীহ মুসলিম ২৯৬৩, তিরমিযী ২৫১৩
[61] সহীহ মুসলিম ২৫৬৪; গায়তুল মারাম ৪১৫; সহীহাহ ২৬৫৬; তাহকীক রিয়াদুস সালিহীন (ভূমিকা) ১৪ নং পৃষ্ঠা
[62] সুনান ইবন মাজাহ, হাদিস নং : ৪২৫৯ (হাসান)
[63]সুনান ইবন মাজাহ, হাদিস নং : ৪২১৪
[64] সহীহ বুখারী, হাদিস নং : ৩০৪৬
[65] তাফসির ফাতহুল মাজীদ; তাফসির ইবন কাসির (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), ২য় খণ্ড, সুরা আলি ইমরানের ৯২ নং আয়াতের তাফসির, পৃষ্ঠা ৫৪১-৫৪২
[66] সুনান ইবন মাজাহ, হাদিস নং : ৪১০৪ (সহীহ)