ইসলামবিরোধীরা কিছু আয়াত এবং হাদিস দেখিয়ে অভিযোগ উত্থাপন করে, নবী মুহাম্মাদ(ﷺ) এর কোনো কিছু আকাঙ্খা হলেই এর সমর্থনে নাকি ওহী আসতো, আর তা দেখে স্বয়ং আয়িশা(রা.) নাকি তাঁর নবুয়তে সন্দেহ পোষণ করতেন (নাউযুবিল্লাহ)। তারা সেই সাথে নবী করিম(ﷺ) এর ব্যাপারে আরো কিছু অমার্জিত ও অশালীন অভিযোগও করে থাকে (নাউযুবিল্লাহ)। নবীজি(ﷺ) এর শানে এমন গোস্তাখীপূর্ণ অভিযোগের কথা লিখতে গিয়েও বাধছিল। কিন্তু ইসলামের শত্রুদের অপপ্রচারের খণ্ডন এবং মানুষের সংশয় নিরসনের জন্য এই বিষয়গুলো নিয়ে লিখতেই হল। আল্লাহ তা’আলাই আশ্রয়স্থল।
ইসলামবিরোধীরা তাদের অভিযোগের স্বপক্ষে যেসব হাদিস দেখিয়ে থাকে--
حَدَّثَنَا هِشَامٌ، عَنْ أَبِيهِ، قَالَ كَانَتْ خَوْلَةُ بِنْتُ حَكِيمٍ مِنَ اللاَّئِي وَهَبْنَ أَنْفُسَهُنَّ لِلنَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَتْ عَائِشَةُ أَمَا تَسْتَحِي الْمَرْأَةُ أَنْ تَهَبَ نَفْسَهَا لِلرَّجُلِ فَلَمَّا نَزَلَتْ (تُرْجِئُ مَنْ تَشَاءُ مِنْهُنَّ) قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ مَا أَرَى رَبَّكَ إِلاَّ يُسَارِعُ فِي هَوَاكَ.
অর্থঃ “হিশামের পিতা ’উরওয়াহ (রহ.) হতে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, যে সব মহিলা নিজেদেরকে নবী(ﷺ)-এর নিকট সমর্পণ করেছিলেন, খাওলা বিনতে হাকীম তাদেরই একজন ছিলেন। ’আয়িশাহ (রাঃ) বলেন, মহিলাদের কি লজ্জা হয় না যে, নিজেদেরকে পুরুষের কাছে সমর্পণ করছে? কিন্তু যখন কুরআনের এ আয়াত অবতীর্ণ হল- ’’হে মুহাম্মাদ! তোমাকে অধিকার দেয়া হল যে, নিজ স্ত্রীগণের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছে আলাদা রাখতে পার....।’’ (আল-আহযাবঃ ৫১) ’আয়িশাহ (রাঃ) বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার মনে হয়, আপনার রব আপনার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করার ত্বরিৎ ব্যবস্থা নিচ্ছেন।” [1]
عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ كُنْتُ أَغَارُ عَلَى اللَّاتِيْ وَهَبْنَ أَنْفُسَهُنَّ لِرَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَأَقُوْلُ أَتَهَبُ الْمَرْأَةُ نَفْسَهَا فَلَمَّا أَنْزَلَ اللهُ (تَعَالَى تُرْجِئُ مَنْ تَشَاءُ مِنْهُنَّ وَتُؤْوِيْ إِلَيْكَ مَنْ تَشَاءُ وَمَنْ ابْتَغَيْتَ مِمَّنْ عَزَلْتَ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْكَ) قُلْتُ مَا أُرَى رَبَّكَ إِلَّا يُسَارِعُ فِيْ هَوَاكَ.
অর্থঃ ’আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, যেসব মহিলা নিজেকে রাসূলূল্লাহ্ ﷺ -এর কাছে হেবাস্বরূপ ন্যস্ত করে দেন, তাদের আমি ঘৃণা করতাম। আমি (মনে মনে) বলতাম, মহিলারা কি নিজেকে ন্যস্ত করতে পারে? এরপর যখন আল্লাহ্ তা’আলা এ আয়াত অবতীর্ণ করেনঃ ’’আপনি তাদের মধ্য থেকে যাকে ইচ্ছা আপনার নিকট হতে দূরে রাখতে পারেন এবং যাকে ইচ্ছা আপনার নিকট স্থান দিতে পারেন। আর আপনি যাকে দূরে রেখেছেন, তাকে কামনা করলে আপনার কোন অপরাধ নেই।’’ তখন আমি বললাম, আমি দেখছি যে, আপনি যা ইচ্ছা করেন আপনার রব, তা-ই শীঘ্র পূর্ণ করে দেন। [2]
কিছু নারী কর্তৃক নিজেদেরকে নবী(ﷺ) এর নিকট সমর্পণ করার অর্থ এবং অভিযোগের অপনোদনঃ
আমরা উপরে উল্লেখিত হাদিসগুলোতে দেখতে পাচ্ছি কিছু নারী নিজেদেরকে নবী(ﷺ) এর কাছে হেবাস্বরূপ ন্যাস্ত করেছেন বা নিজেদেরকে নবী(ﷺ)-এর নিকট সমর্পণ করেছিলেন। অনেকের প্রশ্ন জাগতে পারে এই কথার অর্থ কী। এ প্রসঙ্গে শায়খ মুহাম্মাদ সালিহ আল মুনাজ্জিদ (হাফি.) পরিচালিত islamqa ওয়েবসাইটে এক ফতোয়ায় উল্লেখ করা হয়েছে,
“এর অর্থ হল তিনি তাকে বিয়ে করবেন কিন্তু এতে তাঁর কোনো দেনমোহর লাগবে না। এই বিষয়টি শুধুমাত্র নবী ﷺ এর জন্য নির্দিষ্ট ছিল। তাঁর উম্মতের অন্য কারো জন্য নয়।” [3]
এই বিষয়টি কোনোক্রমেই বিয়ে ব্যতিত কোনো সম্পর্কের প্রস্তাব ছিল না (নাউযুবিল্লাহ)। আল্লাহর রাসুলের(ﷺ) নিকট বিয়ে ব্যতিত স্থাপনের প্রস্তান কোনো নারী দিতে পারে, এমন ভাবনা চরম উন্মাদ বাদে কারো মাথায় আসতে পারে না। অথচ কিছু ইসলামবিরোধী এমন নোংরা অভিযোগই নবী(ﷺ) এর বিরুদ্ধে করে থাকে।
ইসলামবিরোধীরা তাদের নোংরা অভিযোগ প্রমাণের জন্য তাফসির ইবন কাসিরের বাংলা অনুবাদ থেকে একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত তাফসির ইবন কাসিরে সুরা আহযাবের ৫১ নং আয়াতের তাফসিরের এক স্থানে উল্লেখ আছেঃ
“আমের শাবী تُرۡجِیۡ مَنۡ تَشَآءُ مِنۡهُنَّ এর তাফসীর প্রসংগে বলেন, কতিপয় মহিলা রাসূলুল্লাহ (সা) এর খিদমতে আসিয়া নিজকে মোহত ব্যতীত সমর্পণ করিলে তিনি তাহাদের কতকের সহিত মিলিত হইলেন এবং কতককে দূরে রাখিলেন। তাহাদের সহিত তাহার বিবাহ সংঘটিত হয়নাই। উম্মে শরীক তাহাদেরই একজন।” [4]
এই উদ্ধৃতি দেখিয়ে ইসলামের শত্রুরা দাবি করে নবী(ﷺ) এসব নারীদের কারো কারো মিলিত হয়েছেন যাদের সাথে নাকি তাঁর বিয়ে হয়নি! আর এমন নারীদের একজন উম্মে শরীক (নাউযুবিল্লাহ)। তাদের এই অভিযোগের জবাব আমরা কয়েক ধাপে দিতে পারি।
প্রথমত,
এখানে অনুবাদটি ভালো করলে পড়লে এটি বোঝা যায় যে এখানে বিবাহ ব্যতিত মিলিত হওয়া বা সহবাসের কথা বলা হচ্ছে না। “তাহাদের সহিত তাহার বিবাহ সংঘটিত হয়নাই” এই বাক্যটির ঠিক আগেই বলা হয়েছে “এবং কতককে দূরে রাখিলেন”। অর্থাৎ তিনি যাদেরকে দূরে রেখেছিলেন, তাদের সাথে তাঁর বিবাহ হয়নি।
দ্বিতীয়ত,
তাফসির ইবন কাসিরের মূল আরবি রেওয়ায়েত দেখলে এই বিষয়টি আরো পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়। আমরা মূল আরবি তাফসির ইবন কাসির থেকে আলোচ্য অংশের পূর্ণ বর্ণনা উল্লেখ করছি—
قَالَ عَامِرٌ الشَّعْبِيُّ فِي قَوْلِهِ تَعَالَى { تُرْجِى مَن تَشَآءُ مِنْهُنَّ } الآيَةَ، كُنَّ نِسَاءً وَهَبْنَ أَنْفُسَهُنَّ لِلنَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيهِ وَسَلَّمَ فَدَخَلَ بِبَعْضِهِنَّ، وَأَرْجَأَ بَعْضُهُنَّ لَمْ يُنْكحن بَعْدَهُ، مِنْهُنَّ أُمُّ شَرِيكٍ. [5]
এখানে মূল আরবিতে আমরা স্পষ্টত দেখতে পাচ্ছি “فَدَخَلَ بِبَعْضِهِنَّ” (তিনি তাহাদের কতকের সহিত মিলিত হইলেন) এই বাক্যটির পরে কমা (،) চিহ্ন আছে, এরপরে একবারে এই বাক্যটি দেয়া হয়েছে “وَأَرْجَأَ بَعْضُهُنَّ لَمْ يُنْكحن بَعْدَهُ،” (এবং কতককে দূরে রাখিলেন, তাহাদের সহিত তাহার বিবাহ সংঘটিত হয়নাই)। এ থেকে আরো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে বিয়ে না হবার বিষয়টি শুধু তাদের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে যাদেরকে তিনি দূরে রেখেছেন। যাদের সাথে মিলিত হয়েছেন তাদের ব্যাপারে না।
তৃতীয়ত,
উম্মে শারিক সম্পর্কিত এই ঘটনা প্রসঙ্গে সুবিখ্যাত ফতোয়ার ওয়েবসাইট islamweb এও এটি উল্লেখ করা হয়েছে উম্মে শারিক নবী ﷺ এর নিকট নিজেকে যে সমর্পণ করেছিলেন তা ছিল বিয়ের জন্য। [6] বিয়ে ব্যতিত কোনো বিষয় এখানে নেই, নাউযুবিল্লাহ।
চতুর্থত,
ইসলামবিরোধীরা এরপরেও যদি অনুবাদের ব্যাপারে তাদের অপব্যাখ্যায় অটল থাকে তাহলে আমরা বলব – এই বর্ণনায় বাস্তবেও যদি তাদের দাবি অনুযায়ী এমন কিছু বলা থাকতো, তাহলেও নবী ﷺ এর শানে মন্দ কিছু প্রমাণিত হতো না। কেননা আলোচ্য বর্ণনা কোনো সহীহ বর্ণনা নয়। এ প্রসঙ্গে ইমাম ইবনুল আসির(র.) উল্লেখ করেছেন—
قِيلَ: إِنّهَا الَّتِي وَهَبَتْ نَفْسهَا لِلنَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَّيْهِ وَسَلَّمَ وَقِيلَ: إِنّ الَّتِي وَهَبَتْ نَفْسهَا غَيْرَهَا .
وَقِيلَ ذَلِك عَن عِدَّةٍ مِن النِّسَاءِ ذَكَرْنَاهُنَّ فِي مَوَاضِعِهِنَّ مِن الْكِتَابِ ، وَذَكَرَهَا بَعْضُهُمْ فِي أَزْوَاجِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَّيْهِ وَسَلَّمَ ولَا يُصِحُّ مِن ذَلِك شَيْءٍ ، لِكَثْرَةَ الْاِضْطِرَابِ فِيهِ.
অর্থঃ “বলা হয়ে থাকে তিনি [উম্মে শারীক] নিজেকে নবী ﷺ এর নিকট সমর্পণ করেছিলেন। আরো বলা হয় তিনি নিজেকে যার প্রতি সমর্পণ করেছিলেন তিনি অন্য কেউ। বেশ কিছু নারীর ব্যাপারে এরূপ বলা হয় এবং এই গ্রন্থে উপযুক্ত স্থানে আমরা তাদের কথা উল্লেখ করেছি। আবার কেউ কেউ তাকে নবী ﷺ এর স্ত্রীদের অন্তর্ভুক্ত বলেও উল্লেখ করে। কিন্তু এর কোনোটিই (বর্ণনা) সহীহ নয়। কেননা এগুলোর মাঝে প্রচুর ইযতিরাব (অসঙ্গতি/গরমিল) রয়েছে।” [7]
শুধু তাই না, এই বর্ণনা প্রমাণিত অন্য বর্ণনার সাথে সাংঘর্ষিক। কেননা হাসান সনদে প্রমাণিত বর্ণনায় উল্লেখ আছে যে সব মহিলারা নিজেদেরকে তাঁর নিকট সমর্পণ করেছিলেন নবী ﷺ এদের কারো সঙ্গে মিলিত হননি। এ প্রসঙ্গে ইমাম ইবন হাজার আসকালানী(র.) তাঁর সুবিখ্যাত ফাতহুল বারী গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন,
عَنْ عِكْرِمَةَ عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ لَمْ يَكُنْ عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ امْرَأَةٌ وَهَبَتْ نَفْسَهَا لَهُ أَخْرَجَهُ الطَّبَرِيُّ وَإِسْنَادُهُ حَسَنٌ، وَالْمُرَادُ أَنَّهُ لَمْ يَدْخُلْ بِوَاحِدَةٍ مِمَّنْ وَهَبَتْ نَفْسَهَا لَهُ وَإِنْ كَانَ مُبَاحًا لَهُ لِأَنَّهُ رَاجِعٌ إِلَى إِرَادَتِهِ لِقَوْلِهِ تَعَالَى: ﴿إِنْ أَرَادَ النَّبِيُّ أَنْ يَسْتَنْكِحَهَا﴾،
... ... ...
وَأَخْرَجَ الطَّبَرِيُّ أَيْضًا عَنِ الشَّعْبِيِّ فِي قَوْلِهِ: ﴿تُرْجِي مَنْ تَشَاءُ مِنْهُنَّ﴾ قَالَ: كُنَّ نِسَاءً وَهَبْنَ أَنْفُسَهُنَّ لِلنَّبِيِّ ﷺ فَدَخَلَ بِبَعْضِهِنَّ وَأَرْجَأَ بَعْضَهُنَّ لَمْ يَنْكِحْهُنَّ، وَهَذَا شَاذٌّ، وَالْمَحْفُوظُ أَنَّهُ لَمْ يَدْخُلْ بِأَحَدٍ مِنَ الْوَاهِبَاتِ كَمَا تَقَدَّمَ.
অর্থঃ “ইবন আব্বাস(রা.) সূত্রে ইকরিমাহ(র.) বর্ণনা করেন, “রাসুলুল্লাহ ﷺ এর নিকট এমন কোনো স্ত্রী যে সব মহিলারা নিজেদেরকে তাঁর নিকট সমর্পণ করেছিলেন।” এটি তাবারী(র.) বর্ণনা করেছেন এবং এর সনদ হাসান। এর অর্থ হল, যে সব মহিলারা নিজেদেরকে তাঁর নিকট সমর্পণ করেছিলেন তিনি [নবী ﷺ] এদের কারো সঙ্গে মিলিত হননি (সহবাস করেননি) যদিও তাঁর জন্য এটি বৈধ ছিল। এটি তাঁর ইচ্ছাধীন ছিল আল্লাহ তা’আলার এই বাণীর জন্য { নবী তাকে বিয়ে করতে চাইলে সেও তার জন্য বৈধ…} (সুরা আহযাব ৫০)।
… … …
{আপনি তাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা...} (সুরা আহযাব ৫১) এই আয়াত প্রসঙ্গে শা’বী(র.) সূত্রে তাবারী(র.) থেকে আরো বর্ণিত আছে, “যেসব মহিলা যারা নিজেদেরকে নবী ﷺ এর নিকট সমর্পণ করেছিলেন, তিনি তাদের কারো কারো সঙ্গে মিলিত হন আবার কাউকে কাউকে দূরে রাখেন যাদেরকে তিনি বিয়ে করেননি।” এবং এই বর্ণনাটি শায। বরং প্রমাণিত বিষয় হল, যারা নিজেদেরকে তাঁর [নবী ﷺ] নিকট সমর্পণ করেছিলেন, তিনি তাদের কারো সঙ্গে মিলিত হননি, যেমনটি পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।” [8]
অনুমতি থাকা সত্ত্বেও নবী(ﷺ) তাঁর প্রতি নিজেদের সমর্পণকারী নারীদের একজনকেও নিজের জন্য স্ত্রীরূপে গ্রহণ করেননি। ইসলামবিরোধীরা যেই ইস্যুকে কেন্দ্র করে নবী ﷺ কে নারীলোভী প্রমাণ করতে চায়, সেই ইস্যুতে প্রমাণিত হাদিসগুলো থেকে এর ঠিক উল্টো বিষয় প্রমাণিত হচ্ছে, সুবহানাল্লাহ! ইসলামবিরোধীদের অভিযোগগুলোর বাস্তব অবস্থা এরূপ।
আমরা এই অভিযোগ খণ্ডনের উপসংহারে বলতে পারিঃ
১। ইসলামবিরোধীরা বাংলা অনুবাদ নিয়ে অপব্যাখ্যা করে নবী(ﷺ) এর ব্যাপারে অশালীন অভিযোগ করে। তাফসির ইবন কাসিরের মূল আরবি দেখলেই তাদের অভিযোগের অসারতা আরো স্পষ্ট করে বোঝা যায়।
২। যে বর্ণনা উদ্ধৃত করে নবী(ﷺ) এর ব্যাপারে এই অমার্জিত অভিযোগ আনা হয় তা কোনো বিশুদ্ধ বা প্রমাণিত বর্ণনা না বরং তা প্রমাণিত বর্ণনার সাথে সাংঘর্ষিক।
৩। আমরা প্রমাণিত বর্ণনা থেকে দেখলাম নবী(ﷺ) এর জন্য বৈধ হওয়া সত্ত্বেও তিনি তাঁর নিকট সমর্পণকারী কোনো নারীকে বিবাহ করেননি। অথচ ইসলামবিরোধীরা নবী(ﷺ)কে নারীলোভী বলে অভিযুক্ত করে! (নাউযুবিল্লাহ)
৪। ইসলামবিরোধীরা বলতে চায় নবী(ﷺ) নারীদের জন্য বা দুনিয়াবী আকর্ষণের জন্য লালায়িত ছিলেন, অথচ বাস্তবতা হল নেককার নারীরাই স্বেচ্ছায় আল্লাহর রাসুল(ﷺ) এঁর স্ত্রী হবার জন্য পরমভাবে আকাঙ্খা করতো।
আয়িশা(রা.) এর উক্তি এবং নবী(ﷺ) এর ব্যাপারে নিজ ইচ্ছামত আয়াত নাজিলের (নাউযুবিল্লাহ) অভিযোগের জবাবঃ
এবার আমরা আম্মাজান আয়িশা(রা.) এর উক্তি এবং তিনি মুহাম্মাদ(ﷺ) এর নবুয়তে সংশয় পোষণ করতেন কিনা এই অভিযোগ নিয়ে আলোচনা করব। ইসলামবিরোধীরা নবী করিম(ﷺ)কে একজন কামনা-বাসনার অনুসারী হিসেবে এবং যা ইচ্ছা তাই নাজিলের দাবিকারী হিসেবে তাদের বিভিন্ন ব্লগ এবং লাইভস্ট্রিমে লাগাতার অপপ্রচার চালায় (নাউযুবিল্লাহ)। সমাজের বহু মুসলিম রাসুল(ﷺ) এর জীবনী সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার জন্য খুব সহজেই তাদের এহেন মিথ্যাচারে প্রভাবিত হয়ে যায় এবং সংশয়ে পড়ে। আমরা তাই এই অভিযোগের খণ্ডনে একটু বিস্তারিত আলোচনা করব এবং নবী(ﷺ) এর জীবনী থেকে প্রচুর পরিমাণে বিশুদ্ধ বর্ণনা নিয়ে আসব যার দরুণ সকলের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যাবে ইসলামবিরোধীদের এহেন অভিযোগ কী মিথ্যার উপর দাঁড়িয়ে আছে এবং বাস্তবতা তাদের দাবি থেকে কতো দূরে অবস্থান করছে। আল্লাহ তা’আলাই তাওফিকদাতা।
আয়িশা(রা.) এর আলোচ্য উক্তির ব্যাখ্যাঃ
আয়িশা(রা.) যে হাদিসে নবী(ﷺ) প্রসঙ্গে এই উক্তি করেছেনঃ “হে আল্লাহর রাসূল! আমার মনে হয়, আপনার রব আপনার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করার ত্বরিৎ ব্যবস্থা নিচ্ছেন” – সেই হাদিসের ব্যাখ্যায় প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইমাম ইবন বাত্তাল(র.) বলেছেন,
وفيه أن الغيرة للنساء مسموح لهن فيها وغير منكر من أخلاقهن، ولا معاقب عليها ولا على مثلها لصبر النبى، عليه السلام، لسماع مثل هذا من قولها، ألا ترى قولها له: أرى ربك يسارع فى هواك، ولم يرد ذلك عليها ولا زجرها، وعذرها لما جعل الله فى فطرتها من شدة الغيرة.
অর্থঃ “এ থেকে প্রমাণ হয় যে নারীদের জন্য ঈর্ষা (অর্থাৎ, স্বামী সম্পর্কে সংবেদনশীল হওয়া) তাদের বৈশিষ্ট্যের অংশ হিসেবে অনুমোদিত এবং এটি নিন্দনীয় নয়। এ ধরনের আচরণের জন্য তাদেরকে কোনো শাস্তি দেওয়া হবে না। কেননা নবী (ﷺ) ধৈর্যের সঙ্গে তাঁর [আয়িশা(রা.)] কাছ থেকে এমন কথা শুনেছিলেন। যেমন তিনি বলেছিলেনঃ " আমার মনে হয়, আপনার রব আপনার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করার ত্বরিৎ ব্যবস্থা নিচ্ছেন।" কিন্তু তিনি এ কথার জন্য তাঁকে কোনো জবাব দেননি কিংবা বকাও দেননি। বরং তিনি তাঁর জন্য ওযর দিয়েছিলেন কারণ আল্লাহ নারীদের প্রকৃতির মাঝেই [স্বামীর জন্য] তীব্র [ভালোবাসাময়] ঈর্ষার বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করেছেন।” [9]
ইমাম ইবন হাজার আসকালানী(র.) তাঁর সুবিখ্যাত ফাতহুল বারী গ্রন্থে এ সংক্রান্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেছেন,
قَالَ الْقُرْطُبِيُّ: هَذَا قَوْلٌ أَبْرَزَهُ الدَّلَالُ وَالْغَيْرَةُ، وَهُوَ مِنْ نَوْعِ قَوْلِهَا مَا أَحْمَدُكُمَا وَلَا أَحْمَدُ إِلَّا اللَّهَ، وَإِلَّا فَإِضَافَةُ الْهَوَى إِلَى النَّبِيِّ ﷺ لَا تُحْمَلُ عَلَى ظَاهِرِهِ؛ لِأَنَّهُ لَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى وَلَا يَفْعَلُ بِالْهَوَى، وَلَوْ قَالَتْ إِلَى مَرْضَاتِكَ لَكَانَ أَلْيَقَ، وَلَكِنَّ الْغَيْرَةَ يُغْتَفَرُ لِأَجْلِهَا إِطْلَاقُ مِثْلِ ذَلِكَ.
অর্থঃ আল কুরতুবী(র.) বলেছেনঃ “এই বক্তব্যটি এমন যার মাঝে আবেগ ও ঈর্ষার প্রকাশ ঘটেছে। এটি সেই ধরণের কথার অন্তর্ভুক্ত, যেমন তিনি [ইফকের ঘটনায় অপবাদমুক্ত হবার পরে আবেগভরে] বলেছিলেন, “আমি তোমাদের কারও প্রশংসা করি না, আমি শুধুমাত্র আল্লাহর প্রশংসা করি।” তাছাড়া, নবী ﷺ-এর প্রতি ‘হাওয়া’ (ইচ্ছা বা প্রবৃত্তি) আরোপ করাকে এর প্রকৃত অর্থে নেওয়া যাবে না; কারণ তিনি প্রবৃত্তি থেকে কথা বলেন না [সুরা নাজম ৫৩ : ৩] এবং কোনো কাজও প্রবৃত্তি থেকে করেন না। যদি [এর পরিবর্তে] তিনি বলতেন, “আপনাকে সন্তুষ্ট করার জন্য…” তবে এটি আরও উপযুক্ত হতো। কিন্তু [স্বামীর প্রতি] ঈর্ষার তীব্রতার কারণে এমন কথা বলার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে এবং এটি ক্ষমাযোগ্য।” [10]
অর্থাৎ আম্মাজান আয়িশা(রা.) এর উক্তিটি ছিল স্বামীর প্রতি ভালোবাসাবশত একটি অভিমান ও ঈর্ষামূলক উক্তি। আল্লাহ তা’আলা নারীদেরকে এভাবেই সৃষ্টি করেছেন এবং ইসলামে এই বিষয়টি নিন্দনীয় কিছু নয়। আয়িশা(রা.) যদি আক্ষরিক অর্থেই মুহাম্মাদ(ﷺ) এর নবুয়তে সংশয় পোষণ করে এমন উক্তি করতেন তাহলে তা শাতম হিসেবে গণ্য হতো এবং তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হতো। কিন্তু বাস্তবিক এমন কিছু হয়নি। আল্লাহ তা’আলা নারীদেরকে বিশেষ স্বভাবের দ্বারা বৈশিষ্ট্য দান করেছেন। নারীরা তাদের স্বভাবসুলভ অভিমানের দ্বারা অনেক সময় স্বামীকে অনেক কথা বলে থাকে যা আক্ষরিক অর্থে নেবার কিছু নেই। যেমন কোনো স্ত্রী তার স্বামীকে বললঃ “তুমি আমাকে আর আগের মতো ভালোবাসো না, আমি তোমার সাথে আর থাকতে চাই না, আমি বাপের বাড়ি চলে যাবো। আমাকে আর নিতে আসবে না।”
“তুমি আমাকে আর আগের মতো ভালোবাসো না” এহেন উক্তির দ্বারা এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে ঐ স্বামী আর তার স্ত্রীকে ভালোবাসে না আর “আমি তোমার সাথে আর থাকতে চাই না” এর দ্বারাও আক্ষরিকভাবে এটা ভাবার কারণ নেই ঐ স্ত্রীটি আর তার স্বামীর সাথে থাকতে চাচ্ছে না। ঐ স্ত্রী এমন উক্তিগুলো করেছে ভালোবাসাময় ঈর্ষার দ্বারা, যাতে তার স্বামী তাকে আরো ভালোবাসে। “আমাকে আর নিতে আসবে না” – এই উক্তিকে আক্ষরিকভাবে নিয়ে এটা ভাবারও কারণ নেই ঐ স্ত্রী চাচ্ছে না যে তার স্বামী তাকে বাপের বাড়ি থেকে নিতে আসুক। আসলে সে ঠিকই চাচ্ছে স্বামী তাকে ভালোবাসার সহিত বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে যাক। কিন্তু অভিমান থেকে এই কথা বলা। ইসলামে স্বামীর জন্য নারীদের এই ভালোবাসাকে প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে এবং তাদের ঈর্ষা ও অভিমানমূলক উক্তিকে দোষনীয় বলা হয়নি। আম্মাজান আয়িশা(রা.) এর উক্তিও এর বাইরের কিছু না। কিন্তু ইসলামবিরোধীরা হাদিসের অপব্যাখ্যা করে তিল থেকে তাল বানায়।
আমরা ইতিমধ্যেই আলোচনা করেছি, আল্লাহ তা’আলা নবী ﷺ কে অনুমতি দেয়া সত্ত্বেও তাঁর নিকট যেসব নারী নিজেদের সমর্পণ করেছিল তাদের একজনকেও বিয়ে করেননি। এ থেকে এটাও প্রমাণিত হয় আম্মাজান আয়িশা(রা.) আল্লাহ তা’আলা কর্তৃক নবী(ﷺ) এর মনোবাঞ্ছা পূরণের ব্যাপারে নেহায়েতই অভিমান এবং ঈর্ষা থেকে যে উক্তি করেছিলেন, বাস্তবে আক্ষরিকভাবে এমন কিছুই ঘটেনি।
শুধু তাই না, স্বয়ং আয়িশা(রা.) থেকে বর্ণিত আরো অনেক হাদিস এবং কর্ম দ্বারাই এটি প্রমাণিত হয় যে নবী(ﷺ) এর মনোবাঞ্ছা অনুসারে সব বিধান নাজিল হতো না এবং তিনি কোনোক্রমেই মুহাম্মাদ(ﷺ) এর নবুয়তে সংশয় পোষণ করতেন না।
আয়িশা(রা.) এর নিজ বর্ণনা থেকেই প্রমাণিত হয় নবী(ﷺ) এর মনোবাঞ্ছা অনুসারে সব বিধান নাজিল হতো নাঃ
আল কুরআনে নবী(ﷺ) এর প্রতি তাহাজ্জুদের আদেশ করে বলা হয়েছে—
وَ مِنَ الَّیۡلِ فَتَهَجَّدۡ بِهٖ نَافِلَۃً لَّكَ عَسٰۤی اَنۡ یَّبۡعَثَكَ رَبُّكَ مَقَامًا مَّحۡمُوۡدًا
অর্থঃ "আর রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ কায়েম করবে; এটা তোমার এক অতিরিক্ত কর্তব্য; আশা করা যায় তোমার রাব্ব তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করবেন প্রশংসিত স্থানে।" [11]
এই আদেশের ভিত্তিতে নবী(ﷺ) কিভাবে তাহাজ্জুদের সলাত কায়েম করেছেন, এ প্রসঙ্গে আয়িশা(রা.) থেকে বর্ণিত অনেক সহীহ হাদিস রয়েছে। আয়িশা(রা.) থেকে বিশুদ্ধ সনদে উল্লেখ আছে রাসুলুল্লাহ ﷺ এই সলাত কোনো সময় পরিত্যাগ করতেন না। যখন তিনি অসুস্থ হতেন অথবা আলস্য বোধ করতেন তখন তিনি তা বসে আদায় করতেন। [12]
আমরা জানি রাতের বেলা ঘুম থেকে উঠে তাহাজ্জুদের সলাত আদায় করা কী কঠিন কাজ। মুহাম্মাদ(ﷺ) যদি একজন ভণ্ড নবী হতেন এবং নিজের মনের কামনা-বাসনা অনুসারেই যদি সকল বিধান নাজিলের ভান করতেন (নাউযুবিল্লাহ) – তাহলে কেন তিনি নিজেই নিজের প্রতি এমন কঠিন বিধান নাজিল করবেন? কেন তিনি কখনো তাহাজ্জুদের সলাতের ন্যায় কঠিন আমল কখনো পরিত্যাগ করতেন না? এটা কি কোনো ভণ্ড বা মিথ্যাবাদীর চরিত্র নাকি সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত মানুষের চরিত্র?
আয়িশা(রা.) থেকে আরো বর্ণিত আছে—
عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِذَا صَلَّى قَامَ حَتَّى تَفَطَّرَ رِجْلاَهُ قَالَتْ عَائِشَةُ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَتَصْنَعُ هَذَا وَقَدْ غُفِرَ لَكَ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ فَقَالَ " يَا عَائِشَةُ أَفَلاَ أَكُونُ عَبْدًا شَكُورًا " .
অর্থঃ আয়িশাহ্ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ(ﷺ) যখন সালাত আদায় করতেন তখন এত বেশি দাঁড়িয়ে থাকতেন যে এতে তার দু’পা ফুলে যেত। এ দেখে আয়িশাহ্ (রাযিঃ) বললেন, হে আল্লাহর রসূল! আপনি এরূপ করছেন অথচ আপনার পূর্বাপর যাবতীয় ত্রুটি-বিচ্যুতি মাফ করে দেয়া হয়েছে। এ কথা শুনে তিনি বললেন, হে ’আয়িশাহ আমি কি শুকরগুজার বান্দা হব না? [13]
মুহাম্মাদ(ﷺ) যদি নিজের মনের কামনা বাসনা অনুসারেই যদি সকল বিধান নাজিলের ভান করতেন (নাউযুবিল্লাহ) – তাহলে কেন তিনি এভাবে রাতের পর রাত সলাতে দণ্ডায়মান থেকে নিজের পা ফুলিয়ে ফেলতেন? এটা কি নিজের কামনা চরিতার্থ করা কোনো ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য?
আয়িশা(রা.) থেকে আরো বর্ণিত আছে—
عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ إِنْ كُنَّا آلَ مُحَمَّدٍ ـ صلى الله عليه وسلم ـ لَنَمْكُثُ شَهْرًا مَا نُوقِدُ فِيهِ بِنَارٍ مَا هُوَ إِلاَّ التَّمْرُ وَالْمَاءُ .
অর্থঃ আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা মুহাম্মাদ ﷺ -এর পরিবারবর্গ এক এক মাস এমনভাবে অতিবাহিত করতাম যে, আমাদের চুলায় আগুন জ্বালাতে পারতাম না। খেজুর ও পানিই হতো আমাদের জীবন ধারণের উপকরণ.। [14]
মুহাম্মাদ(ﷺ) যদি নিজের মনের কামনা বাসনা অনুসারেই যদি সকল বিধান নাজিলের ভান করতেন (নাউযুবিল্লাহ) – তাহলে কেন তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে এভাবে মাসের পর মাস অনাহারে অর্ধাহারে থাকতে হতো? তিনি যদি মিথ্যাবাদীই হতেন (নাউযুবিল্লাহ), তাহলে তো তিনি এমন ওহী নাজিলের কথা বলতেন যার ফলে অন্য মুসলিমরা নিজে না খেয়ে হলেও তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে খাবার সরবরাহ করতে বাধ্য হতো।
আয়িশা(রা.) থেকে আরো বর্ণিত আছে—
عَنْ عَائِشَةَ، - رضى الله عنها - قَالَتْ نَهَاهُمُ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم عَنِ الْوِصَالِ رَحْمَةً لَهُمْ . فَقَالُوا إِنَّكَ تُوَاصِلُ . قَالَ " إِنِّي لَسْتُ كَهَيْئَتِكُمْ إِنِّي يُطْعِمُنِي رَبِّي وَيَسْقِينِي " .
অর্থঃ "আয়িশাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী ﷺ দয়াবশতঃ সবাইকে সওমে বিসাল {একটানা রোযা রাখা} করতে নিষেধ করেছেন। সাহাবীগণ বললেন, আপনি তো সওমে বিসাল করেন। তিনি বললেন, আমি তো তোমাদের মতো নই। আমাকে তো আমার প্রতিপালক পানাহার করান।" [15]
এটা কি নিজের কামনা-বাসনা চরিতার্থ কোনো ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য হতে পারে যে অন্যদেরকে টানা রোযা রাখতে নিষেধ করে নিজে টানা রোযা রাখতে থাকে? নাকি এটা একজন সত্য নবীর বৈশিষ্ট্য যিনি তাঁর রবের প্রেরিত ওহীর বাইরে নিজে থেকে কিছুই বলেন না?
উপরে উল্লেখিত এই হাদিসগুলো উম্মুল মু’মিনীন আয়িশা(রা.) থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত আছে যার দ্বারা স্পষ্ট হয়ে যায় মুহাম্মাদ(ﷺ) সত্যবাদী ও সত্য নবী, তিনি আদৌ কামনা-বাসনার অনুসারী না। ইসলামবিরোধীরা এই হাদিসগুলো সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে যায়।
রাসুল(ﷺ) এর ওফাতের পর আয়িশা(রা.) এর ভূমিকা প্রমাণ করে তিনি তাঁর নবুয়তে সন্দেহ করতেন নাঃ
আয়িশা(রা.) ছিলেন অন্যতম সর্বোচ্চ হাদিস বর্ণনাকারী সাহাবী। তাঁর বর্ণিত হাদিস সংখ্যা ২২১০। মাত্র ৭জন সাহাবী ছিলেন যারা হাজারের উপর হাদিস বর্ণনা করেছেন। আয়িশা(রা.) ছিলেন তাঁদের ১জন। [16] তিনি ছিলেন উম্মাহর শিক্ষিকা। বড় বড় সাহাবী(রা.)গণও আয়িশা(রা.) এর কাছ থেকে হাদিস শিখতেন। আয়িশা(রা.) ইন্তিকাল করেন ৬৭৮ খ্রিষ্টাব্দে, ৫৮ হিজরী সনে। [17] নবী(ﷺ) এর ওফাতের পর ৪০ বছরেরও অধিক সময় ধরে তিনি উম্মতের জন্য হাদিস বর্ণনা করেছেন এবং হাদিসের শিক্ষা প্রদান করেছেন। তাঁর এই দীর্ঘকাল হাদিস বর্ণনা দ্বারা অল্প বয়সে নবী(ﷺ) এর সহিত তাঁর বিবাহের অনেকগুলো হিকমাহর একটি হিকমাহ অনুধাবন করা যায়। যদিও এই প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয় নয় বিধায় আমরা এ আলোচনা এখানে আনছি না। আয়িশা(রা.) যদি মুহাম্মাদ(ﷺ) এর নবুয়তে সংশয় পোষণ করতেন এবং তাঁকে একজন মিথ্যা নবীই মনে করতেন (নাউযুবিল্লাহ), তাহলে দীর্ঘ ৪ দশকেরও বেশি সময় ধরে কেন তিনি এই পরিমাণে হাদিস বর্ণনা করলেন এবং হাদিস শিক্ষা প্রদানে আত্মনিয়োগ করলেন?
কোনো কোনো ইসলামবিরোধীকে আমরা এই যুক্তি দিতে দেখি - আয়িশার(রা.) সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না, তিনি যদি প্রকাশ্যে নিজের মনের সংশয় ব্যক্ত করে মুহাম্মাদ(ﷺ) এর নবুয়ত অস্বীকার করতেন, তাহলে তো মুর্তাদ হিসেবে ইসলামী আইনে তাঁর মৃত্যুদণ্ড হয়ে যেতো। কাজেই “অভিনয়” করে যাওয়া ছাড়া তাঁর আর উপায় ছিল না। কাজেই জীবনভর তিনি মুসলিম সেজে অভিনয় করে গেছেন (নাউযুবিল্লাহ)।
তর্কের খাতিরে এই ভয়াবহ (অপ) যুক্তিকে যদি আমরা বিবেচনাও করি, তাহলেও আসলে এর কোনো অর্থ হবে না। কেননা ‘অভিনয়’ যদি করতেই হতো, তাহলে হাজার হাজার হাদিস বর্ণনা করার মানে কী? তাঁর অন্তরে আসলেই যদি সংশয় আর ধর্মত্যাগ থাকতো, তাহলে তো তিনি চুপচাপ “অভিনয়” করে যেতেন। এত কষ্ট করে আর হাজার হাজার হাদিস বর্ণনা করতেন না, এত সাহাবী(রা.)কে হাদিসের শিক্ষা দেবার কোনো প্রয়োজনও ছিল না। তিনি যদি একটা হাদিসও বর্ণনা না করতেন, তবু উম্মুল মুমিনীন হিসেবে তিনি যথেষ্ট সম্মান ও মর্যাদা সকলের কাছ থেকে পেতেন। তাঁর অন্তরে যদি ইসলামের ব্যাপারে অবিশ্বাস থাকতো, তাহলে তো এই বিপুল পরিমাণ হাদিস বর্ণনা করে যাবার কোনো প্রয়োজন ছিল না। আয়িশা(রা.) শুধু হাদিসের বর্ণনাকারীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন ফকিহ ও মুফতি। রাসুল(ﷺ) এর ওফাতের পরে ফিকহের ক্ষেত্রে তিনি বিশাল অবদান রাখেন এবং এইজন্য কঠোর পরিশ্রম করেন। [18] শুধু তাই না, তিনি ছিলেন সাহাবীদের শিক্ষাদাত্রী। বিপুল পরিমাণে সাহাবী এবং তাবিঈ ছিলেন যাঁরা আয়িশার(রা.) এর থেকে হাদিস ও ফিকহের জ্ঞান অর্জন করেছেন এবং মুসলিম উম্মাহর জন্য আলোকবর্তিকা হয়েছিলেন। এমন সাহাবী-তাবিঈদের তালিকা বিশাল। [19] কারো অন্তরে যদি কোনো ধর্ম নিয়ে সংশয় আর অবিশ্বাস থাকে, তাহলে কি কেউ এমন কাজ করে? আয়িশা(রা.) এর জীবনী কেউ যদি ঠাণ্ডা মাথায় অধ্যায়ন করে তাহলে কারো ঘুণাক্ষরেও মনে হবে না এই মানুষটি কখনো মুহাম্মাদ(ﷺ) এর নবুয়তে সংশয় পোষণ করতেন।
মূলত ইসলামবিরোধীদের অভিযোগগুলো অপযুক্তি আর উদ্ভট ব্যাখ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত। তারা আয়িশার(রা.) পুরো জীবনকাহিনী এড়িয়ে যায় আর ২-১টি হাদিস নিয়ে এসে অপব্যাখ্যা করে সংশয় সৃষ্টির অপচেষ্টা করে। আয়িশা(রা.) সম্পর্কে আমরা যেসকল তথ্য পাই এতে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় এই উম্মুল মু’মিনীন কস্মিনকালেও মুহাম্মাদ(ﷺ) এর নবুয়তে সন্দেহ পোষণ করেননি বরং আজীবন বিশ্বস্ততার সাথে তাঁর স্বামী রাসুলুল্লাহ(ﷺ) এর দ্বীনের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন।
অন্যান্য সাহাবী(রা.)দের বর্ণনা থেকেও প্রমাণ হয় নবী(ﷺ) নিজ কামনা-বাসনার অনুসারী ছিলেন নাঃ
সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) উল্লেখ করেছেন রাসুলুল্লাহ ﷺ এর ওপর তাহাজ্জুদ নামাজ ফরয ছিল। আরো অনেক উলামা থেকে অনুরূপ বক্তব্য পাওয়া যায়। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ইমাম শাফিঈ (র.) এবং বহু মালিকি ফকিহ থেকেও এর উল্লেখ আছে। ইমাম তাবারী(র.) তাঁর তাফসিরে এই মতকে প্রাধান্য দিয়েছেন। [20] এটা শুধুমাত্র রাসুলুল্লাহ ﷺ এর জন্য বিশেষ বিধান ছিল, উম্মতের অন্যদের জন্য তাহাজ্জুদের সলাত আবশ্যক কিছু না।
কেউ যদি নিজের কামনা-বাসনার অনুসারী হয়ে থাকে আর নিজ ইচ্ছানুযায়ী ওহী নাজিলের ভান করে, তাহলে কি সে রাতের বেলায় উঠে তাহাজ্জুদের সলাত আদায়ের মতো কঠিন কাজকে নিজের জন্য আবশ্যক করে আর অন্য সবার জন্য ঐচ্ছিক করে দেয়? নাকি ঠিক এর উল্টো কাজ করে? কথিত মুক্তমনাদের নিকট এই প্রশ্ন তোলা থাকলো। তারা যদি জীবনেও শীতের রাতে ঠাণ্ডা পানি দিয়ে ওযু করে তাহাজ্জুদের সলাত আদায় করে থাকতো তাহলে আমার এই প্রশ্নের হাকিকত তারা ধরতে পারতো।
নবী মুহাম্মাদ(ﷺ) ছিলেন একজন মহান সাধক। তিনি গ্রীষ্ম-শীত কখনো তাহাজ্জুদ পরিত্যাগ করতেন না। এমনকি যুদ্ধের মতো বিপজ্জনক পরিস্থিতিতেও অন্য সবাই যখন নিদ্রামগ্ন থাকতো, তিনি একাকী তাহাজ্জুদের সলাতে দণ্ডায়মান থাকতেন। একান্তভাবে তাঁর মহান রবের নিকট নিজ আকুতি ও প্রার্থনায় রত থাকতেন।
عَنْ عَلِيٍّ، قَالَ: مَا كَانَ فِينَا فَارِسٌ يَوْمَ بَدْرٍ غَيْرُ الْمِقْدَادِ " وَلَقَدْ رَأَيْتُنَا وَمَا فِينَا إِلا نَائِمٌ، إِلَّا رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تَحْتَ شَجَرَةٍ يُصَلِّي، وَيَبْكِي، حَتَّى أَصْبَحَ "
অর্থঃ আলি(রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, "বদরের দিনে আমাদের মধ্যে কোনো অশ্বারোহী ছিল না, একমাত্র মিকদাদ(রা.) ছাড়া। আমি দেখেছি, আমাদের মধ্যে [রাতের বেলা] কেউই জাগ্রত ছিল না, শুধু রাসুলুল্লাহ ﷺ ছাড়া। তিনি একটি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করছিলেন এবং কাঁদছিলেন, এমনকি সকাল হয়ে যায়।" [21]
বহু সাহাবী(রা.) থেকে বিশুদ্ধভাবে নবী(ﷺ) এর সেই রাতের সলাতগুলোর বিভিন্ন বিবরণ পাওয়া যায়। তাঁর সলাতগুলো কোনো দায়সারা গোছের সংক্ষিপ্ত সলাত ছিল না। বরং তা ছিল অতি দীর্ঘ সলাত।
عَنْ حُذَيْفَةَ، قال: صَلَّيْتُ مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَيْلَةً فَافْتَتَحَ الْبَقَرَةَ، فَقُلْتُ: يَرْكَعُ عِنْدَ الْمِائَةِ فَمَضَى، فَقُلْتُ: يَرْكَعُ عِنْدَ الْمِائَتَيْنِ فَمَضَى فَقُلْتُ: يُصَلِّي بِهَا فِي رَكْعَةٍ فَمَضَى، فَافْتَتَحَ النِّسَاءَ فَقَرَأَهَا، ثُمَّ افْتَتَحَ آلَ عِمْرَانَ فَقَرَأَهَا، يَقْرَأُ مُتَرَسِّلًا إِذَا مَرَّ بِآيَةٍ فِيهَا تَسْبِيحٌ سَبَّحَ، وَإِذَا مَرَّ بِسُؤَالٍ سَأَلَ، وَإِذَا مَرَّ بِتَعَوُّذٍ تَعَوَّذَ،
অর্থঃ “হুযায়ফাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি একরাতে নবী ﷺ -এর সাথে সালাত আদায় করলাম। তিনি সূরা বাক্বারাহ্ শুরু করলেন, আমি মনে মনে বললাম যে, হয়তো তিনি একশত আয়াত পরিমাণ পাঠ করে রুকূতে যাবেন। কিন্তু তিনি তিলাওয়াত চালিয়ে যেতে থাকলেন, আমি মনে মনে বললাম, হয়তো তিনি দু' শত আয়াত পরিমাণ পাঠ করে রুকূতে যাবেন, কিন্তু তিনি পাঠ চালিয়ে যেতে থাকলেন। আমি মনে মনে বললাম, হয়তো তিনি পূর্ণ সূরাহ্ এক রাক'আতেই পাঠ করে ফেলবেন। কিন্তু তিনি তিলাওয়াত চালিয়েই যেতে থাকলেন এবং সূরাহ্ আন্ নিসা শুরু করে তাও পাঠ করে ফেললেন। তারপর আ-লি ইমরান শুরু করে তাও তিলাওয়াত করে ফেললেন। তিনি ধীরে ধীরে পাঠ করতেন। যদি তিনি এমন কোন আয়াত পাঠ করতেন যাতে কোন তাসবীহ রয়েছে তবে তাসবীহ পড়তেন, যদি কোন যাচ্ঞা (প্রার্থনা, চাওয়া) করার আয়াত পাঠ করতেন তবে যাচ্ঞা করতেন। যদি বিতাড়িত শয়তান হতে আশ্রয় প্রার্থনার কোন আয়াত পাঠ করতেন, তবে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। … …” [22]
যারা ইসলাম সম্পর্কে সামান্যতম ধারণাও রাখে তারা এটা জানে যে সুরা বাকারাহ, সুরা আলে ইমরান, সুরা নিসা এগুলো কী বিশাল আকৃতির সুরা। যে ব্যক্তি নিজের কামনা-বাসনা চরিতার্থ করতে ওহী নাজিলের ভান করে, সে কি কখনো নিজের উপর তাহাজ্জুদের বিধান জারি করে এবং বিশাল আকৃতির সুরা দ্বারা নামাজ আদায় করে সাধকের জীবন যাপন করে? নাকি এর ঠিক উল্টো কাজ করে?
নবী(ﷺ) এর রাতের সলাত এতই দীর্ঘ হতো যে অন্য সাহাবীরাও তাঁর সাথে তাল মেলাতে পারতেন না। কোনো সাধারণ মানুষের পক্ষে এমন সাধকের জীবন যাপন সম্ভব না যে জীবন যাপন করতেন নবী(ﷺ)।
قَالَ عَبْدُ اللَّهِ صَلَّيْتُ مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَأَطَالَ حَتَّى هَمَمْتُ بِأَمْرِ سَوْءٍ قَالَ قِيلَ وَمَا هَمَمْتَ بِهِ قَالَ هَمَمْتُ أَنْ أَجْلِسَ وَأَدَعَهُ
অর্থঃ “আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন আমি রসূলুল্লাহ ﷺ এর সাথে সালাত আদায় করলাম। এ সালাতে তিনি কিরআত এত দীর্ঘায়িত করলেন যে, আমি একটি মন্দ ইচ্ছা করে বসলাম। আবূ ওয়ায়িল বলেছেন তাকে (আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদকে) জিজ্ঞেস করা হ’ল, আপনি কী ধরনের মন্দ ইচ্ছা করেছিলেন? জবাবে তিনি বললেনঃ আমি বসে পড়ার এবং তার পিছনে এ সালাত পরিত্যাগ করার ইচ্ছা করেছিলাম।” [23]
আফসোসের বিষয় হল এমন একজন ব্যক্তিকে নাস্তিক-মুক্তমনারা প্রবৃত্তির অনুসারী বলে অভিযোগ করে আর কিছু অজ্ঞ মুসলিম এর দ্বারা সংশয়েও পড়ে। আল্লাহ তা’আলার নিকট আমরা শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।
নবী(ﷺ) এবং তাঁর পরিবার দিনের পর দিন কিভাবে অনাহারে ও অর্ধাহারে জীবন যাপন করেছেন এ সম্পর্কে বহু বিশুদ্ধ বর্ণনা রয়েছে। যেমন—
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّهُ قَالَ وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ مَا شَبِعَ نَبِيُّ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ ثَلاَثَةَ أَيَّامٍ تِبَاعًا مِنْ خُبْزِ الْحِنْطَةِ حَتَّى تَوَفَّاهُ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ .
অর্থঃ আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, সেই মহান সত্তার শপথ যাঁর হাতে আমার প্রাণ! আল্লাহর নবী ﷺ কখনও পরপর তিন দিন গমের রুটি পেট ভরে খেতে পাননি, এ অবস্থায় মহামহিম আল্লাহ তাঁকে তুলে নেন (ইনতিকাল করেন)। [24]
عَنِ النُّعْمَانِ بْنِ بَشِيرٍ، قَالَ سَمِعْتُ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ، يَقُولُ رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ يَلْتَوِي فِي الْيَوْمِ مِنَ الْجُوعِ مَا يَجِدُ مِنَ الدَّقَلِ مَا يَمْلأُ بِهِ بَطْنَهُ .
অর্থঃ নোমান ইবনে বশীর (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) কে বলতে শুনেছি, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ -কে দিনের বেলা ক্ষুধার তাড়নায় পার্শ্ব পরিবর্তন করতে দেখেছি। তিনি তাঁর উদর পূর্তির জন্য এমনকি রদ্দি খেজুরও পেতেন না। [25]
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ " مَا أَصْبَحَ فِي آلِ مُحَمَّدٍ إِلاَّ مُدٌّ مِنْ طَعَامٍ " . أَوْ " مَا أَصْبَحَ فِي آلِ مُحَمَّدٍ مُدٌّ مِنْ طَعَامٍ " .
অর্থঃ আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ মুহাম্মাদের (ﷺ) পরিবারবর্গ এমন অবস্থায় সকালে উপনীত হতো যে, তাদের নিকট এক মুদ্দ পরিমাণ খাদ্যশস্যও থাকতো না। [26]
مِنْ، خَالِدِ بْنِ عُمَيْرٍ قَالَ خَطَبَنَا عُتْبَةُ بْنُ غَزْوَانَ عَلَى الْمِنْبَرِ فَقَالَ لَقَدْ رَأَيْتُنِي سَابِعَ سَبْعَةٍ مَعَ رَسُولِ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ مَا لَنَا طَعَامٌ نَأْكُلُهُ إِلاَّ وَرَقُ الشَّجَرِ حَتَّى قَرِحَتْ أَشْدَاقُنَا .
অর্থঃ খালিদ ইবনে উমাইর (রাঃ) বলেন, উতবা ইবনে গায্ওয়ান (রাঃ) মিম্বারে দাঁড়িয়ে আমাদের উদ্দেশে ভাষণ দিলেন। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর সাথে সাতজনের মধ্যে সপ্তমজন ছিলাম। গাছের পাতা ছাড়া আমাদের আহারের জন্য আমাদের সাথে আর কিছু ছিলো না। শেষে আমাদের মাড়ির ছাল উঠে গিয়েছিলো। [27]
حَدَّثَنِي عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ، قَالَ دَخَلْتُ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ وَهُوَ عَلَى حَصِيرٍ قَالَ فَجَلَسْتُ فَإِذَا عَلَيْهِ إِزَارٌ وَلَيْسَ عَلَيْهِ غَيْرُهُ وَإِذَا الْحَصِيرُ قَدْ أَثَّرَ فِي جَنْبِهِ وَإِذَا أَنَا بِقَبْضَةٍ مِنْ شَعِيرٍ نَحْوَ الصَّاعِ وَقَرَظٍ فِي نَاحِيةٍ فِي الْغُرْفَةِ وَإِذَا إِهَابٌ مُعَلَّقٌ فَابْتَدَرَتْ عَيْنَاىَ فَقَالَ " مَا يُبْكِيكَ يَا ابْنَ الْخَطَّابِ " . فَقُلْتُ يَا نَبِيَّ اللَّهِ وَمَا لِيَ لاَ أَبْكِي وَهَذَا الْحَصِيرُ قَدْ أَثَّرَ فِي جَنْبِكَ وَهَذِهِ خِزَانَتُكَ لاَ أَرَى فِيهَا إِلاَّ مَا أَرَى وَذَلِكَ كِسْرَى وَقَيْصَرُ فِي الثِّمَارِ وَالأَنْهَارِ وَأَنْتَ نَبِيُّ اللَّهِ وَصَفْوَتُهُ وَهَذِهِ خِزَانَتُكَ . قَالَ " يَا ابْنَ الْخَطَّابِ أَلاَ تَرْضَى أَنْ تَكُونَ لَنَا الآخِرَةُ وَلَهُمُ الدُّنْيَا " . قُلْتُ بَلَى .
অর্থঃ উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নিকট প্রবেশ করলাম। তিনি তখন খেজুর পাতার চাটাইয়ের উপর শোয়া ছিলেন। আমি বসে পড়লাম। তাঁর পরিধানে ছিলো একটি লুঙ্গি। এ ছাড়া আর কোন বস্ত্র তাঁর পরিধানে ছিলো না। তাঁর পাঁজরে চাটাইয়ের দাগ বসে গিয়েছিলো। আমি দেখলাম যে, তাঁর ঘরের এক কোণে ছিলো প্রায় একসা গম, বাবলা গাছের কিছু পাতা এবং ঝুলন্ত একটি পানির মশক। এ অবস্থা দেখে আমার দু’চোখে অশ্রু প্রবাহিত হলো। তিনি জিজ্ঞেস করলেনঃ হে কাত্তাবের পুত্র! তুমি কাঁদছো কেন? আমি বললাম, হে আল্লাহর নবী! আমি কেন কাঁদবো না! এই চাটাই আপনার পাঁজরে দাগ কেটে দিয়েছে, আর এই হচ্ছে আপনার ধনভান্ডার, এতে যা আছে তা তো দেখতেই পাচ্ছি। এই কিসরা (পারস্যরাজ) ও কায়সার (রোম সম্রাট) বিরাট বিরাট উদ্যান ও ঝর্ণা সমৃদ্ধ অট্টালিকায় বিলাস-বসনে জীবন-যাপন করছে। আর আপনি হলেন আল্লাহর নবী এবং তাঁর মনোনীত প্রিয় বান্দা। আর আপনার ধনভান্ডারের অবস্থা এই। তিনি বলেনঃ হে খাত্তাবের পুত্র! তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, আমাদের জন্য রয়েছে আখেরাতের স্থায়ী সুখ-শান্তি এবং ওদের জন্য রয়েছে পার্থিব ভোগবিলাস? আমি বললাম, হ্যাঁ। [28]
আমরা দেখলাম নবী(ﷺ) কেমন নিদারুণ দারিদ্র্য এবং অনাহারের মধ্যে জীবন কাটিয়ে গেছেন। পরপর তিনটা দিন পেট ভরে গমের রুটি খেতে পাননি। আমাদের দেখা সমাজের দরিদ্রতম ব্যক্তিটিও কি নবী(ﷺ) এর ন্যায় এমন কষ্টের জীবন যাপন করে? তিনি যদি নিজের মনের ইচ্ছা পূরণ করে ওহী নাজিলের অভিনয় করে থাকতেন (নাউযুবিল্লাহ) তাহলে তো তিনি চাইলেই তাঁকে খাদ্য এবং জীবনের অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহের হুকুম জারি করে ওহীর দাবি করতে পারতেন।
অথচ বাস্তবে ঘটেছে এর ঠিক উল্টো। নবী(ﷺ) এবং তাঁর পরিবারের জন্য সদাকাহর মাল হারাম ছিল। ইসলামে দরিদ্রদের জন্য সদাকাহর ব্যবস্থা রয়েছে। অথচ চরমতম দরিদ্র হওয়া সত্ত্বেও নবী(ﷺ) এবং তাঁর পরিবারের জন্য ছিল ভিন্ন বিধান। তাঁরা কারো কাছ থেকে সদাকাহ নিতে পারতেন না। শিশুকালে হাসান(রা.) ক্ষুধার তাড়নায় সদাকাহর একটি খেজুর মুখে নিয়ে ফেললেও তিনি প্রিয় দৌহিত্রকে মুখ থেকে সেই খেজুর ফেলে দিতে আদেশ করেন কেননা নবী পরিবারের জন্য সদাকাহর মাল হারাম।
جَاءَ سَلْمَانُ الْفَارِسِيُّ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ , حِينَ قَدِمَ الْمَدِينَةَ بِمَائِدَةٍ عَلَيْهَا رُطَبٌ , فَوَضَعَهَا بَيْنَ يَدَيْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، فَقَالَ : " يَا سَلْمَانُ مَا هَذَا ؟ " فَقَالَ : صَدَقَةٌ عَلَيْكَ , وَعَلَى أَصْحَابِكَ ، فَقَالَ : " ارْفَعْهَا ، فَإِنَّا لا نَأْكُلُ الصَّدَقَةَ "
অর্থঃ “রাসূলুল্লাহ ﷺ এর মদিনায় হিজরতের পর একবার সালমান ফারসী (রাঃ) একটি পাত্রে কিছু কাঁচা খেজুর নিয়ে এলেন এবং তিনি তা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর সামনে রাখলেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, হে সালমান! এগুলো কিসের খেজুর? (অর্থাৎ হাদিয়া না সাদাকা?) তিনি বললেন, এগুলো আপনার ও আপনার সার্থীদের জন্য সাদাকা। রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, এগুলো তুলে নাও। আমরা সাদাকা খাই না। … …” [29]
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ـ رضى الله عنه أَنَّ الْحَسَنَ بْنَ عَلِيٍّ، أَخَذَ تَمْرَةً مِنْ تَمْرِ الصَّدَقَةِ، فَجَعَلَهَا فِي فِيهِ، فَقَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم بِالْفَارِسِيَّةِ " كَخٍ كَخٍ، أَمَا تَعْرِفُ أَنَّا لاَ نَأْكُلُ الصَّدَقَةَ ".
অর্থঃ আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, হাসান ইবনু ’আলী (রাঃ) সাদাকার খেজুর হতে একটি খেজুর নিয়ে তা তাঁর মুখে দেন। তখন নবী ﷺ কাখ্-খাখ্ বললেন, তুমি কি জান না যে, আমরা সদা্কাহ খাই না। [30]
নবী(ﷺ) এর ইচ্ছানুযায়ী ওহী আসতো নাঃ
আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী নাজিল হওয়া নবী ﷺ এর ইচ্ছাধীন ছিল না। নবী ﷺ ও তাঁর সাহাবীগণ সর্বক্ষণ ওহীর অপেক্ষা করতেন। এর সাহায্যে তাঁরা নিজেদের পথের দিশা পেতেন এবং মানসিক প্রশান্তি ও সান্ত্বনাও লাভ করতেন। ওহীর আগমনে যতই বিলম্ব হতো ততই তাদের অস্থিরতা বেড়ে যেতো। হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ ﷺ জিবরীলকে (আ.) বললেনঃ আপনি আমাদের নিকট আরো অধিকহারে আসতে বাধা কোথায়? তখন এ আয়াত নাযিল হয় ৷ [বুখারী: ৪৭৫৫] [31] --
وَ مَا نَتَنَزَّلُ اِلَّا بِاَمۡرِ رَبِّكَ ۚ لَهٗ مَا بَیۡنَ اَیۡدِیۡنَا وَ مَا خَلۡفَنَا وَ مَا بَیۡنَ ذٰلِكَ ۚ وَ مَا كَانَ رَبُّكَ نَسِیًّا
অর্থঃ (জিবরীল বলল,) ‘আমরা আপনার প্রতিপালকের আদেশ ব্যতিরেকে অবতরণ করি না; আমাদের সম্মুখে ও পশ্চাতে যা আছে ও এই দু-এর অন্তর্বর্তী যা আছে তা তাঁরই। আর আপনার প্রতিপালক ভুলবার নন।’[32]
নবী(ﷺ) এর সকল প্রার্থনাও কবুল হতো নাঃ
নবী ﷺ কিভাবে রাতের তাহাজ্জুদে আল্লাহর নিকট কাতরভাবে প্রার্থনা করতেন এবং কী কী প্রার্থনা করতেন এর বর্ণনা দিয়ে বিভিন্ন হাদিস রয়েছে। যেমন—
عَنْ أَبِي ذَرٍّ، قَالَ: صَلَّى رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَيْلَةً فَقَرَأَ بِآيَةٍ حَتَّى أَصْبَحَ، يَرْكَعُ بِهَا وَيَسْجُدُ بِهَا: {إِنْ تُعَذِّبْهُمْ فَإِنَّهُمْ عِبَادُكَ وَإِنْ تَغْفِرْ لَهُمْ فَإِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ} [المائدة: ١١٨] ، فَلَمَّا أَصْبَحَ، قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ، مَا زِلْتَ تَقْرَأُ هَذِهِ الْآيَةَ حَتَّى أَصْبَحْتَ، تَرْكَعُ بِهَا وَتَسْجُدُ بِهَا قَالَ: "إِنِّي سَأَلْتُ رَبِّي الشَّفَاعَةَ لِأُمَّتِي فَأَعْطَانِيهَا، وَهِيَ نَائِلَةٌ إِنْ شَاءَ اللهُ لِمَنْ لَا يُشْرِكُ بِاللهِ شَيْئًا "
অর্থঃ “আবু যার(রা.) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ ﷺ এক রাতে নামাজ আদায় করছিলেন এবং সকাল পর্যন্ত একটি আয়াত বারবার পড়তে থাকলে্ন। তিনি এর দ্বারা রুকু-সিজদাও করছিলেন। [আয়াতটি হলঃ]
"যদি তুমি তাদের শাস্তি দাও, তবে তারা তো তোমার বান্দা। আর যদি তুমি তাদের ক্ষমা করে দাও, তবে নিশ্চয়ই তুমি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।" (সূরা মায়িদাহ ১১৮)
যখন সকাল হলো, আমি বললামঃ "হে আল্লাহর রাসুল, আপনি সকাল পর্যন্ত এই একটি আয়াতই বারবার পড়লেন এবং এর সাথেই রুকু ও সিজদা করলেন।"
তিনি বললেনঃ "আমি আমার রবের কাছে আমার উম্মতের জন্য শাফায়াত করার অনুমতি চেয়েছি, আর তিনি তা আমাকে দিয়েছেন। এই শাফায়াত ইন শা আল্লাহ সেই ব্যক্তিদের জন্য হবে যারা আল্লাহর সাথে কোনো কিছুকে শরিক করে না।" [33]
এই হাদিসে আমরা দেখলাম দয়াল নবী ﷺ রাতব্যপি কাতরভাবে প্রার্থনা করে গেছেন যাতে তিনি উম্মতের জন্য শাফায়াত করতে পারেন। প্রিয় পাঠক, কল্পনা করুন একজন মানুষের আন্তরিকতার গভীরতা কী পরিমাণ হলে সে রাত থেকে সকাল পর্যন্ত একটি আয়াত দিয়ে প্রার্থনা করে যেতে পারে। আল্লাহ তা’আলা তাঁর এই প্রার্থনা মঞ্জুর করেছেন। কিন্তু তাঁর কিছু প্রার্থনা তিনি মঞ্জুর করেননি এমন উল্লেখও রয়েছে। যেমন—
وَعَنْ سَعْدٍ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَرَّ بِمَسْجِدِ بَنِي مُعَاوِيَةَ دَخَلَ فَرَكَعَ فِيهِ رَكْعَتَيْنِ وَصَلَّيْنَا مَعَهُ وَدَعَا رَبَّهُ طَوِيلًا ثُمَّ انْصَرَفَ فَقَالَ: «سَأَلْتُ رَبِّي ثَلَاثًا فَأَعْطَانِي ثِنْتَيْنِ وَمَنَعَنِي وَاحِدَةً سَأَلْتُ رَبِّي أَنْ لَا يُهْلِكَ أُمَّتِي بِالسَّنَةِ فَأَعْطَانِيهَا وَسَأَلْتُهُ أَنْ لَا يُهْلِكَ أُمَّتِي بِالْغَرَقِ فَأَعْطَانِيهَا وَسَأَلْتُهُ أَنْ لَا يَجْعَلَ بأسهم بَينهم فَمَنَعَنِيهَا»
অর্থঃ “সা’দ (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ বানূ মু’আবিয়ার মসজিদের কাছে দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তাতে প্রবেশ করে দুই রাকআত সালাত আদায় করলেন এবং তাঁর সাথে আমরাও সালাত আদায় করলাম। সালাত শেষে তিনি ﷺ এক দীর্ঘ দু’আ করলেন, অতঃপর আমাদের দিকে ফিরে বললেন, আমি আমার প্রভুর কাছে তিনটি বিষয়ে ফরিয়াদ করেছিলাম। তিনি আমার দুটি দু’আ কবুল করেছেন এবং একটি প্রত্যাখ্যান করেছেন। ১. আমি আমার প্রভুর কাছে চেয়েছিলাম, ব্যাপক দুর্ভিক্ষ দ্বারা যেন আমার উম্মাতকে ধ্বংস না করা হয়। আমার এ দু’আটি তিনি গ্রহণ করেছেন। ২. আমি আমার প্রভুর কাছে এটাও চেয়েছিলাম যেন আমার উম্মাতকে পানিতে ডুবিয়ে ধ্বংস না করা হয়। তিনি আমার এ দু’আও গ্রহণ করেছেন, এবং ৩. আমি তার কাছে চেয়েছিলাম যেন আমার উম্মতের একে অপরের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ না হয়। কিন্তু তিনি তা আমাকে দান করেননি।” [34]
এই হাদিসে আমরা দেখলাম নবী ﷺ এর একটি প্রার্থনা আল্লাহ তা’আলা মঞ্জুর করেননি। এবং এই বিষয়টিও অকপটে উল্লেখ করেছেন সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত নবী ﷺ । এ থেকে প্রমাণ হয় দোয়া কবুল হওয়া নবী(ﷺ) এর ইচ্ছাধীন ছিল না।
কখনো কখনো ওহীর মাধ্যমে নবী করিম(ﷺ)কে তিরস্কার ও সংশোধণ করা হয়েছেঃ
নবী করিম(ﷺ) সর্বশেষ্ঠ ও সব থেকে সম্মানিত মানব। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেখা যায় আল কুরআনে কিছু জায়গায় তাঁকে তিরস্কার করা হয়েছে এবং শুধরে দেয়া হয়েছে। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জায়গাতেও তাঁকে ছাড় দেয়া হয়নি, এবং সাধারণ মানুষের জন্য যেসব জিনিস মূলত কোনো ভুল না, সেসব জায়গাতেও তাঁকে শুধরে দেয়া হয়েছে। এটা মুহাম্মাদ(ﷺ) এর সত্যবাদিতা এবং সত্য নবী হবার প্রমাণ। তিনি যদি মিথ্যাবাদীই হতেন এবং নিজে নিজে ইচ্ছামত ওহী নাজিলের ভান করতেন (নাউযুবিল্লাহ), তাহলে কখনোই এমনটি হতো না।
নবী করিম(ﷺ) একবার মক্কার কিছু বড় নেতাকে ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছিলেন। এর মাঝখানে অন্ধ সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবন উম্মে মাকতুম(রা.) এসে পড়েন এবং নবী করিম(ﷺ) এর নিকট ধর্মোপদেশ চাইতে শুরু করেন। তিনি অন্ধ হবার কারণে বুঝতে পারেননি নবী করিম(ﷺ) সেই মুহূর্তে কী গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যাস্ত ছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ এই কাজের মাঝে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে নবী করিম(ﷺ) সামান্য ভ্রুকুঞ্চিত করে মুখ ফিরিয়ে পূর্বের কাজ চালিয়ে গেলেন। যদিও তিনি ইবন উম্মে মাকতুম(রা.)কে ভৎর্সনা করেননি বা বকাও দেননি। বরং তাঁর ইজতিহাদ ছিল যে, মক্কার এই নেতারা কুফর ও শির্কে লিপ্ত আছে এবং অধিক ক্ষতির মাঝে আছে; আর ইবন উম্মে মাকতুম(রা.) তো শাখাগত এবং ছোট একটা বিষয়ে প্রশ্ন করছেন। তাছাড়া তিনি তাঁর সহচর হওয়ায় তাঁকে তো পরেও ধর্মোপদেশ দেয়া যাবে, আপাতত এই বড় নেতাদেরকে দাওয়াহ দেবার কাজটা শেষ হোক। কিন্তু নবী করিম(ﷺ) এর এই ইজতিহাদকে আল্লাহ তা’আলা অনুমোদন করেননি এবং তাঁর এই সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ভুলকেও তিরস্কার করে ও শুধরে দিয়ে আল্লাহ তা’আলা ওহী নাজিল করেছেন। যা কিয়ামত অবধি কুরআনের মাঝে পঠিত হবে। [35] আয়াতগুলো হল –
( 1 ) عَبَسَ وَتَوَلَّىٰ
( 2 ) أَن جَاءَهُ الْأَعْمَىٰ
( 3 ) وَمَا يُدْرِيكَ لَعَلَّهُ يَزَّكَّىٰ
( 4 ) أَوْ يَذَّكَّرُ فَتَنفَعَهُ الذِّكْرَىٰ
( 5 ) أَمَّا مَنِ اسْتَغْنَىٰ
( 6 ) فَأَنتَ لَهُ تَصَدَّىٰ
( 7 ) وَمَا عَلَيْكَ أَلَّا يَزَّكَّىٰ
( 8 ) وَأَمَّا مَن جَاءَكَ يَسْعَىٰ
( 9 ) وَهُوَ يَخْشَىٰ
( 10 ) فَأَنتَ عَنْهُ تَلَهَّىٰ
( 11 ) كَلَّا إِنَّهَا تَذْكِرَةٌ
অর্থঃ “ তিনি ভ্রূকুঞ্চিত করলেন এবং মুখ ফিরিয়ে নিলেন। কারণ, তাঁর কাছে এক অন্ধ আগমন করল। আপনি কি জানেন, সে হয়তো পরিশুদ্ধ হত, অথবা উপদেশ গ্রহণ করতো এবং উপদেশ তার উপকার হত। পরন্তু যে বেপরোয়া, আপনি তার চিন্তায় মশগুল। সে শুদ্ধ না হলে আপনার কোন দোষ নেই। যে আপনার কাছে দৌড়ে আসলো, এমতাবস্থায় যে, সে ভয় করে, আপনি তাকে অবজ্ঞা করলেন। কখনও এরূপ করবেন না, এটা উপদেশবানী।” [36]
তাফসির মাযহারীতে উল্লেখ আছে, এরপর থেকে রাসুল(ﷺ) ইবন উম্মে মাকতুম(রা.)কে স্নেহার্দ্র দৃষ্টিতে দেখতেন। দেখা হলেই তাঁকে সমাদর করতেন। বলতেনঃ “অভিনন্দন ওই ব্যক্তির জন্য, যার কারণে আমার প্রিয়তম পালনকর্তা আমাকে ভৎর্সনা করেছেন।” তাঁকে দেখলেই বলতেন, “বৎস, কিছু বলতে চাও?” নিজ অনুপস্থিতিতে মদিনায় ইবন উম্মে মাকতুম(রা.)কে শাসক হিসেবেও নিযুক্ত করতেন। [37]
এভাবে নিজেকে করা তিরস্কার উল্লেখ করা এবং বিনয়াবনত হওয়া কি এমন ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য হতে পারে যে নিজে থেকে বানিয়ে বানিয়ে ওহী নাজিলের দাবি করে? নাকি এটা সত্যবাদী এবং বিশ্বস্ত মানুষের বৈশিষ্ট্য?
নবী(ﷺ)কে একবার প্রশ্নের উত্তরে “ইন শা আল্লাহ” না বলার কারণে তাঁকে শুধরে দিয়ে আল্লাহ তা’আলা যে আয়াতগুলো নাজিল করেছিলেন—
( 23 ) وَلَا تَقُولَنَّ لِشَيْءٍ إِنِّي فَاعِلٌ ذَٰلِكَ غَدًا
( 24 ) إِلَّا أَن يَشَاءَ اللَّهُ ۚ وَاذْكُر رَّبَّكَ إِذَا نَسِيتَ وَقُلْ عَسَىٰ أَن يَهْدِيَنِ رَبِّي لِأَقْرَبَ مِنْ هَٰذَا رَشَدًا
অর্থঃ "কখনই তুমি কোন বিষয়ে বলো না যে, ‘আমি ওটা আগামীকাল করব’--ইন শাআল্লাহ (আল্লাহ ইচ্ছা করলে) এই কথা না বলে; যদি ভুলে যাও, তবে তোমার প্রতিপালককে স্মরণ করো ও বলো, ‘সম্ভবতঃ আমার প্রতিপালক আমাকে এ অপেক্ষা সত্যের নিকটতম পথ নির্দেশ করবেন।’’ [38]
এ প্রসঙ্গে তাফসির আহসানুল বায়ানে উল্লেখ আছে— মুফাসসিরগণ বলেন যে, ইয়াহুদীরা নবী(ﷺ)-কে তিনটি কথা জিজ্ঞাসা করেছিল। আত্মার স্বরূপ কী এবং গুহার অধিবাসী ও যুল-কারনাইন কে ছিল? … নবী (ﷺ) বললেন, আমি তোমাদেরকে আগামী কাল উত্তর দেব। কিন্তু এর পর ১৫ দিন পর্যন্ত জিবরীল (আঃ) অহী নিয়ে এলেন না। অতঃপর যখন এলেন, তখন মহান আল্লাহ ‘ইন শা-আল্লাহ’ বলার নির্দেশ দিলেন। [39]
উপসংহারঃ
ইসলামবিরোধী নাস্তিক-মুক্তমনারা এমন সব দাবি করে যেন নবী করিম(ﷺ) একজন কামনা-বাসনার অনুসারী এবং যা ইচ্ছা তাই নাজিলের দাবি করতেন (নাউযুবিল্লাহ)। কিন্তু আয়িশা(রা.) এবং অন্যান্য সাহাবীদের বর্ণনাগুলো থেকে প্রমাণিত হয় ইসলামবিরোধীদের এহেন দাবি অযৌক্তিক এবং সর্বৈব মিথ্যা। আমরা উপরের আলোচনার সারাংশ হিসেবে বলতে পারিঃ
১। ইসলামে নারীদের দ্বারা স্বামীর জন্য ঈর্ষা ও অভিমানবশত উক্তিকে নিন্দনীয় গণ্য করা হয় না। আম্মাজান আয়িশা(রা.) এর উক্তিও এর আওতায় ছিল।
২। নবী(ﷺ) এর ইন্তিকালের পরেও আয়িশা(রা.) যেভাবে হাদিস ও ফিকহ তথা দ্বীন ইসলামের জন্য জীবনভর কঠোর পরিশ্রম করে গেছেন এর দ্বারা প্রমাণিত হয় তিনি কোনোভাবেই মুহাম্মাদ(ﷺ) এর নবুয়তে সংশয় পোষণ করতেন না।
৩। ওহী নাজিল হওয়া বা দোয়া কবুল হওয়া নবী(ﷺ) এর ইচ্ছাধীন ছিল না।
৪। কুরআনে কিছু কিছু আয়াতে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কারণেও নবী(ﷺ)কে তিরস্কার করা এবং সংশোধণ করার উল্লেখ দেখা যায়।
৫। রাসুলুল্লাহ(ﷺ)কে যেভাবে তাহাজ্জুদের বিধান দেয়া হয়েছিল এবং সে অনুযায়ী যেভাবে তিনি রাতের পর রাত সলাতে দণ্ডায়মান থাকতেন, যেভাবে তিনি অনাহারে থাকতেন অথচ এরপরেও তাঁর পরিবারের জন্য সদাকাহর মাল হারাম ছিল – এর দ্বারাও প্রমাণ হয় নিঃসন্দেহে তিনি কামনা-বাসনার অধিকারী ছিলেন না এবং যারা দাবি করে তিনি নিজের ইচ্ছানুযায়ী ওহী নাজিলের ভান করতেন তাদের অভিযোগ আদৌ সত্য না।
তথ্যসূত্রঃ
[1] সহীহ বুখারী, হাদিস নং ৫১১৩
[2] সহীহ বুখারী, হাদিস নং ৪৭৮৮
[3] “What is meant by a woman offering herself to a man, and is that permissible?” - Islamqa (Shaykh Muhammad Saalih al-Munajjid)
https://islamqa.info/en/254065/
অথবা, https://archive.is/wip/5VTGX (আর্কাইভকৃত)
[4] তাফসির ইবন কাসির (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), সুরা আহযাবের ৫১ নং আয়াতের তাফসির, খণ্ড ৯, পৃষ্ঠা ১৩৭
[5] তাফসির ইবন কাসির, Altafsir.com
অথবা, https://archive.is/wip/PxrQA (আর্কাইভকৃত)
[6] The divorces of the Prophet, sallallaahu ‘alayhi wa sallam (islamweb)
https://www.islamweb.net/en/fatwa/263047/
অথবা, https://archive.is/wip/VDLnE (আর্কাইভকৃত)
[7] উসদুল গাবাহ - ইবন আসির, খণ্ড ৭, পৃষ্ঠা ৩৪০
https://shamela.ws/book/1110/3613
অথবা https://archive.is/wip/Ypfdp (আর্কাইভকৃত)
[8] ফাতহুল বারী – ইবন হাজার আসকালানী, খণ্ড ৮, পৃষ্ঠা ৫২৬
https://shamela.ws/book/1673/4873
অথবা https://archive.is/wip/M7YPB (আর্কাইভকৃত)
[9] শারহ সহীহ বুখারী – ইবন বাত্তাল, খণ্ড ৭, পৃষ্ঠা ৩৩৩
https://shamela.ws/book/10486/3566
অথবা https://archive.is/wip/CgQgp (আর্কাইভকৃত)
[10] ফাতহুল বারী – ইবন হাজার আসকালানী, খণ্ড ৯, পৃষ্ঠা ১৬৫
https://shamela.ws/book/1673/5254
অথবা https://archive.is/wip/v0Scf (আর্কাইভকৃত)
[11] আল কুরআন, বনী ইস্রাঈল ১৭ : ৭৯
[12] দেখুন, সুনান আবু দাউদ, হাদিস নং : ১৩০৭ (সহীহ)
[13] সহীহ মুসলিম, হাদিস নং : ৭০১৮
[14] সুনান ইবন মাজাহ, হাদিস নং : ৪১৬৪ (সহীহ)
[15] সহীহ মুসলিম, হাদিস নং : ২৪৬২
[16] আসহাবে রাসূলের জীবনকথা - ড. মুহাম্মদ আবদুল মা'বুদ, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৫১-১৫২
[17] সীরাতে আয়েশা রাযিআল্লাহু আনহা - সাইয়েদ সুলাইমান নদভী, পৃষ্ঠা ২২৭
[18] দেখুনঃ আসহাবে রাসূলের জীবনকথা - ড. মুহাম্মদ আবদুল মা'বুদ, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৬৬-১৭৩
[19] দেখুনঃ আসহাবে রাসূলের জীবনকথা - ড. মুহাম্মদ আবদুল মা'বুদ, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৭৩-১৮০
[20] فذهب عبد الله بن عباس إلى أن رسول الله صلى الله عليه وسلم قد اختص بافتراض قيام الليل عليه، وتابع ابن عباس على ذلك كثير من أهل العلم، منهم الشافعي في أحد قوليه، وكثير من المالكية، ورجحه الطبري في تفسيره.
https://islamqa.info/ar/296694/
অথবা https://archive.is/wip/o3hns (আর্কাইভকৃত)
[21] মুসনাদ আহমাদ, হাদিস নং : ১০২৩ (সহীহ)
https://shamela.ws/book/25794/835
অথবা https://archive.is/wip/w0xZm (আর্কাইভকৃত)
[22] দেখুন, সুনান নাসায়ী, হাদিস নং : ১৬৬৪ (সহীহ)
[23] সহীহ মুসলিম, হাদিস নং : ১৭০০
[24] সুনান ইবন মাজাহ, হাদিস নং : ৩৩৪৩ (সহীহ)
[25] সুনান ইবন মাজাহ, হাদিস নং : ৪১৪৬ (সহীহ)
[26] সুনান ইবন মাজাহ, হাদিস নং : ৪১৪৮ (সহীহ)
[27] সুনান ইবন মাজাহ, হাদিস নং : ৪১৫৬ (হাসান)
[28] সুনান ইবন মাজাহ, হাদিস নং : ৪১৫৩ (হাসান)
[29] মুসনাদে আহমাদ ২৩০৪৭, সহীহ শামায়েলে তিরমিযী ১৬ (সহীহ)
[30] সহীহ বুখারী, হাদিস নং : ৩০৭২
[31] তাফসীরে জাকারিয়া, সুরা মারইয়ামের ৬৪ নং আয়াতের তাফসির থেকে গৃহিত
[32] আল কুরআন, মারইয়াম ১৯ : ৬৪
[33] মুসনাদ আহমাদ, হাদিস নং : ২১৩২৮ (হাসান)
https://shamela.ws/book/25794/17587
https://shamela.ws/book/25794/17588
অথবা (আর্কাইভকৃত)
[34] মুসলিম ২০-(২৮৯০) মুসনাদে আহমাদ ১৫৭৪, ১২৫০৮, সিলসিলাতুস্ সহীহাহ ১৭২৪, মিশকাতুল মাসাবিহ ৫৭৫১
[35] দেখুনঃ তাফসির মাআরিফুল কুরআন (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ), সুরা আবাসার তাফসির, খণ্ড ৮, পৃষ্ঠা ৬৯৬-৬৯৭
[36] আল কুরআন, আবাসা ৮০ : ১-১১
[37] দেখুনঃ তাফসির মাযহারী, সুরা আবাসার তাফসির, খণ্ড ১২, পৃষ্ঠা ৩৫০
[38] আল কুরআন, কাহফ ১৮ : ২৩-২৪
[39] তাফসির আহসানুল বায়ান, সুরা কাহফেরর ২৪ নং আয়াতের তাফসির