Pray for the world economy

ফাতিমা(রা.) কি আবু বকর(রা.) এর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন?

 

 

أَنَّ عَائِشَةَ أُمَّ الْمُؤْمِنِينَ ـ رضى الله عنها ـ أَخْبَرَتْهُ أَنَّ فَاطِمَةَ ـ عَلَيْهَا السَّلاَمُ ـ ابْنَةَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم سَأَلَتْ أَبَا بَكْرٍ الصِّدِّيقَ بَعْدَ وَفَاةِ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَنْ يَقْسِمَ لَهَا مِيرَاثَهَا، مَا تَرَكَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مِمَّا أَفَاءَ اللَّهُ عَلَيْهِ‏.‏ فَقَالَ لَهَا أَبُو بَكْرٍ إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏ "‏ لاَ نُورَثُ مَا تَرَكْنَا صَدَقَةٌ ‏"‏‏.‏ فَغَضِبَتْ فَاطِمَةُ بِنْتُ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَهَجَرَتْ أَبَا بَكْرٍ، فَلَمْ تَزَلْ مُهَاجِرَتَهُ حَتَّى تُوُفِّيَتْ وَعَاشَتْ بَعْدَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم سِتَّةَ أَشْهُرٍ‏.‏ قَالَتْ وَكَانَتْ فَاطِمَةُ تَسْأَلُ أَبَا بَكْرٍ نَصِيبَهَا مِمَّا تَرَكَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مِنْ خَيْبَرَ وَفَدَكٍ وَصَدَقَتِهِ بِالْمَدِينَةِ، فَأَبَى أَبُو بَكْرٍ عَلَيْهَا ذَلِكَ، وَقَالَ لَسْتُ تَارِكًا شَيْئًا كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَعْمَلُ بِهِ إِلاَّ عَمِلْتُ بِهِ، فَإِنِّي أَخْشَى إِنْ تَرَكْتُ شَيْئًا مِنْ أَمْرِهِ أَنْ أَزِيغَ‏.‏ فَأَمَّا صَدَقَتُهُ بِالْمَدِينَةِ فَدَفَعَهَا عُمَرُ إِلَى عَلِيٍّ وَعَبَّاسٍ، فَأَمَّا خَيْبَرُ وَفَدَكٌ فَأَمْسَكَهَا عُمَرُ وَقَالَ هُمَا صَدَقَةُ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم كَانَتَا لِحُقُوقِهِ الَّتِي تَعْرُوهُ وَنَوَائِبِهِ، وَأَمْرُهُمَا إِلَى مَنْ وَلِيَ الأَمْرَ‏.‏ قَالَ فَهُمَا عَلَى ذَلِكَ إِلَى الْيَوْمِ‏.‏ قَالَ أَبُو عَبْد اللَّهِ اعْتَرَاكَ افْتَعَلْتَ مِنْ عَرَوْتُهُ فَأَصَبْتُهُ وَمِنْهُ يَعْرُوهُ وَاعْتَرَانِي

অর্থঃ উম্মুল মুমিনীন আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ফাতিমা বিনতে রাসুলুল্লাহ() আবু বকর সিদ্দীক(রা.) এর নিকট রাসুলুল্লাহ () এর ইন্তেকালের পর তাঁর মিরাস বন্টনের দাবী করেন। যা রাসুলুল্লাহ () ফায় (বিনা যুদ্ধে লব্ধ সম্পদ) হিসাবে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক তাঁকে প্রদত্ত সম্পদ থেকে রেখে গেছেন। তখন আবু বকর(রা.) তাঁকে বললেন, রাসুলুল্লাহ()  বলেছেন, ‘আমাদের পরিত্যাক্ত সম্পদ বণ্টিত হবে না আমরা যা ছেড়ে যাই, তা সাদকা রূপে গণ্য হয়।’ এতে ফাতিমা বিনতে রাসুলুল্লাহ () অসন্তুষ্ট হলেন এবং আবু বকর(রা.) সিদ্দীক এর সঙ্গে কথাবার্তা বলা ছেড়ে দিলেন। এ অবস্থা তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত বহাল ছিল। রাসুলুল্লাহ()  এর ওফাতের পর ফাতিমা (রা.) ছয় মাস জীবিত ছিলেন।

 

আয়িশা (রা.) বলেন, ফাতিমা (রা.) আবু বকর সিদ্দীক (রা.)-এর নিকট রাসুল() কর্তৃক ত্যাজ্য খায়বার ও ফাদাকের ভূমি এবং মদিনার সাদকাতে তাঁর অংশ দাবী করেছিলেন। আবু বকর(রা.) তাঁকে তা প্রদানে অস্বীকৃতি জানান এবং তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ()  যা আমল করতেন, আমি তাই আমল করব। আমি তাঁর কোন কিছুই ছেড়ে দিতে পারি না। কেননা, আমি আশঙ্কা করি যে, তাঁর কোন কথা ছেড়ে দিয়ে আমি পথভ্রষ্ট হয়ে না যাই। অবশ্য রাসুলুল্লাহ () এর মদিনার সাদকাকে উমার (রা.) তা আলী ও আব্বাস (রা.) কে হস্তান্তর করেন। আর খায়বার ও ফাদাকের ভূমিকে পূর্ববৎ রেখে দেন।

 

উমার (রা.) এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এ সম্পত্তি দু’টিকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জরুরী প্রয়োজন পূরণ ও বিপথকালীন সময়ে ব্যায়ের জন্য রেখেছিলেন। সুতরাং এ সম্পত্তি দু’টি তারই দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবে, যিনি মুসলমানদের শাসন ক্ষমতার অধিকারী খলিফা হবেন।’ যুহরী (রহঃ) বলেন, এ সম্পত্তি দু’টির ব্যবস্থাপনা অদ্যবধি সেরূপই রয়েছে। [1]

 

এ প্রসঙ্গে আমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. আহমদ আলীর ‘খালিফাতু রাসূলিল্লাহ আবু বকর আছছিদ্দীক রাদিআল্লাহু ‘আনহু’ বইয়ের ২৫২ থেকে ২৫৮ পৃষ্ঠা থেকে “ফাতিমা আয-যাহরা (রা.) কি আবু বকর (রা.)-এর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন?” সম্পূর্ণ পরিচ্ছেদটি উল্লেখ করছি। আলোচ্য হাদিস থেকে ইসলামের শত্রুরা যেসব অভিযোগ তুলতে চায় তার খণ্ডন এখানে রয়েছে।

 

ফাতিমা আয-যাহরা (রা.) কি আবু বকর (রা.)-এর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন? [ড. আহমদ আলী]

 

ইতঃপূর্বে বর্ণিত ফাতিমা (রা.)-এর মীরাছের আবেদনজ্ঞাপক হাদীস থেকে কেউ কেউ এ কথা ধারণা করে নিয়েছে যে, মীরাছের ঘটনায় ফাতিমা (রা.) আবু বকর (রা.)-এর ওপর এত বেশি ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন যে, তাঁর সাথে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত যোগাযোগ ও কথাবার্তাই বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আমি মনে করি, রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর স্নেহধন্যা মেয়ে ফাতিমা (রা.) সম্পর্কে এরূপ ধারণা সম্পূর্ণ অবান্তর ও অযাচিত। বলাই বাহুল্য যে, রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর পরিত্যক্ত স্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে আবু বকর (রা.) যে ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন, তা কোনো ক্রমেই তাঁর নিজের ইজতিহাদ ছিল না; বরং তিনি সে ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর নির্দেশকেই পুরোপুরি বাস্তবায়ন করেছিলেন। [2] আবু বকর (রা.), যিনি ধর্ম-বর্ণ এবং দুর্বল ও সবল নির্বিশেষে সকলের পূর্ণ অধিকার রক্ষা করতেন, তাঁর বেলায় এটা কি করে কল্পনা করা যায় যে, তিনি তাঁর প্রিয়তম রাসুলের কন্যাকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করবেন! প্রকৃতপক্ষে এ সংক্রান্ত হাদীসটি ফাতিমা (রা.)-এর জানা না থাকার কারণে প্রথমে যদিও তিনি আবু বকর (রা.)-এর নিকট মীরাছের দাবি পেশ করেছিলেন; কিন্তু যখন আবু বকর (রা.) তদসংক্রান্ত রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর নির্দেশ তাঁকে শুনান, তখন তিনি দাবি উত্থাপন থেকে বিরত হন। [3] আবু বকর (রা.) রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর নির্দেশ কার্যকর করবেন আর এ কারণে ফাতিমা (রা.) তাঁর ওপর ক্ষেপে যাবেন! এ রূপ ধারণা করা ফাতিমা (রা.)-এর প্রতি অবিচার নয় কি? রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর সুস্পষ্ট বাণী শোনার পর এর বিরুদ্ধে নিজের দাবির ওপর অটল থাকাটা একজন নিম্নস্তরের মুসলিমের ক্ষেত্রেও চিন্তা করা কঠিন। এমতাবস্থায় সাইয়িদাতুন নিসা ফাতিমাতুয যাহরা (রা.), যিনি রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর কলিজার টুকরো ছিলেন, কখনো ধন-সম্পদের দিকে চোখ তুলে তাকাননি, দারিদ্র ছিল যার জীবনের মহান বৈশিষ্ট্য, তাঁর পক্ষে এটা কি করে সম্ভব যে, মীরাছের সামান্য অংশের জন্য তিনি এতো মর্মাহত হবেন। আবুত তুফাইল (রা.) বলেন, মীরাছ সংক্রান্ত রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর নির্দেশনা শুনার পর ফাতিমা (রা.) বললেন,

فانت وما سمعت من رسول الله ﷺ اعلم

রসুলুল্লাহ() থেকে যা শুনেছেন সে সম্পর্কে আপনিই অধিক পরিজ্ঞাত। [4]

 

এ হাদীস থেকে স্পষ্ট জানা যায় যে, শেষ পর্যন্ত মীরাছের ব্যাপারে ফাতিমা (রা.)-এর অন্তরে আবু বকর (রা.)-এর প্রতি কোনো দুঃখ ছিল না। হাফিয ইবনু কাছীর (রা.) বলেন,

وهذا هو الصواب والمظنون بها واللائق بأمرها وسيادتها وعلمها ودينها

“এটিই সঠিক ও ধারণাযোগ্য অভিমত এবং তা তাঁর শান, আভিজাত্য, জ্ঞান ও দীনদারির সাথে সামঞ্জস্যশীল। [5]

 

কাদী ইয়াদ (রাহ.) বলেন,

أنها لما بلغها الحديث وبين لها التأويل تركت رأيها ، ثم لم يكن منها ولا من ذريتها بعد ذلك طلب ميراث ، ثم ولي علي الخلافة فلم يعدل بها عما فعله أبو بكر وعمر - رضي الله عنهما -

-“হাদীসটি যখন ফাতিমা (রা.)-এর নিকট পৌছে এবং আবু বকর (রা.) এর কারণও তাঁকে ব্যাখ্যা করে বললেন, তখনি তিনি তাঁর দাবি ছেড়ে দেন। এরপর তাঁর পক্ষ থেকে এবং তাঁর ওফাতের পর তাঁর সন্তান-সন্ততির পক্ষ থেকেও এ মীরাছের দাবি আর উত্থাপিত হয়নি। অতঃপর ‘আলী (রা.) যখন খালীফা হন, তখনও তিনি এ সম্পদের ক্ষেত্রে আবু বকর ও “উমার (রা.)-এর গৃহীত পদক্ষেপ থেকে কিছুমাত্র সরে আসেননি।” [6]

 

এখানে একটি প্রশ্ন হতে পারে যে, আবু বকর (রা.)-এর নিকট রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর বাণী শোনার পর ফাতিমাতুয যাহরা (রা.) শান্ত হয়েছিলেন বটে; কিন্তু সহীহ বুখারী সহ বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত বহু রিওয়ায়াত থেকে জানা যায় যে, এরপরও ‘আলী ও আব্বাস (রা.) দাবির ব্যাপারে অনমনীয় ছিলেন, তার কারণ কি? তাঁরা কেনই বা সান্ত্বনা লাভ করতে পারেননি? এ প্রশ্নের জবাব হলো, খাইবার ও ফাদাকে রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর যে অংশটি ছিল তা সর্বসাধারণের জন্য ওয়াকফকৃত হবার ব্যাপারে ‘আলী ও আব্বাস (রা.)-এর কোনোরূপ সন্দেহ ছিল না। তবে খালীফাকেই এর মুতাওয়াল্লী (দেখাশোনা ও পরিচালনাকারী) হতে হবে এমন কথা তাঁরা মনে করেননি; বরং তাঁরা মনে করতেন, রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর আত্মীয়-স্বজনরাই এর মুতাওয়াল্লী হবেন। উমার (রা.)-এর খিলাফাত কালে নেতৃস্থানীয় মুহাজির ও আনসারগণের উপস্থিতিতে তাঁর এবং ‘আলী ও আব্বাস (রা.) প্রমুখের মধ্যে যে আলোচনা হয়, তাতে এ কথা প্রতীয়মান হয়ে যে, আলোচনার বিষয়বস্তু উত্তরাধিকার ছিল না; বরং মুতাওয়াল্লী হবার প্রসঙ্গটিই ছিল আলোচনার মুখ্য বিষয়। বলাই বাহুল্য যে, রাষ্ট্রীয় সম্পদের মুতাওয়াল্লী হবার অধিকার যেহেতু খালীফার ছিল এবং একজন সৎ ও ন্যায়বান লোক ইচ্ছে করলে অপর কারো জন্য নিজের এ অধিকার থেকে বিরত থাকতে পারেন,  তাই ‘উমার (রা.) আহলে বাইতের মনন্তুষ্টির জন্য খাইবার ও ফাদাকের মুতাওয়াল্লীর পদ এবং এর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ‘আলী ও আব্বাস (রা.)কে প্রদান করেন। সুতরাং উমার (রা.) যখন তাঁদেরকে এ দায়িত্ব প্রদান করেন, তখন তাঁদের নিকট থেকে সুস্পষ্টভাবে এই অঙ্গীকার গ্রহণ করেন যে, তাঁরা যেন এর উৎপন্ন আয় ঐ সকল লোকের জন্য ব্যয় করেন, যাদের জন্য রাসুলুল্লাহ (ﷺ) ব্যয় করতেন। অতঃপর তিনি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বলেন,  

فان عجزتما عنها فافعها الى فانا اكفيكماها

“যদি আপনারা এ শর্ত পূরণ করতে অপারগ হন, তা হলে জমিগুলো আমার কাছে ফেরত দিয়ে দেবেন। আপনাদের পরিবর্তে আমি একাই এ কাজের জন্য যথেষ্ট।” [7]

 

ঐতিহাসিকভাবে এটা প্রমাণিত সত্য যে, আবু বকর (রা.) তাঁর খিলাফাতকালে আহলে বাইতের সারা বছরের প্রয়োজনীয় ব্যয়ভার রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর মাদীনাস্থ ফাই এবং ফাদাক ও খাইবারের সম্পদ থেকে মেটাতেন। তিনি এ ক্ষেত্রে কেবল মীরাছের বিধানটিই কার্যকর করেননি এবং তাও রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর নির্দেশ কার্যকর করার কারণে। এটা কোনোভাবেই আহলে বাইতের প্রতি অবিচার নয়। ইমাম মুহাম্মাদ বাকির ও যায়িদ ইবনু ‘আলী (রা.) প্রমুখ থেকে বর্ণিত। তাঁরা বলেছেন,

“আবু বকর (রা.)-এর পক্ষ থেকে তাঁদের পূর্বপুরুষদের প্রতি কোনোরূপ অবিচার ও যুলম করা হয়নি।” [8]

 

যায়িদ ইবনু ‘আলী (রা.) বলেন –

اما  انا فلو كنت مكان ابي بكر لحكمت بما حكم به ابو بكر  في فدك

“আমি যদি আবু বকর (রা.)-এর জায়গায় হতাম, তবে আমি অবশ্যই ফাদাকের তা-ই ফায়সালা করতাম যা আবু বকর (রা.) করেছিলেন।” [9]

 

যে সকল রাবী আবু বকর (রা.)-এর প্রতি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ফাতিমা (রা.)-এর অসন্তুষ্ট থাকার কথা বর্ণনা করেছেন, তা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা—

 

 ক)  

শা'বী থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন আবু বকর (রা.) ফাতিমা (রা.) এর অসুস্থতার সময় তাকে দেখতে যান। এ সময় ‘আলী (রা.) ফাতিমা (রা.)কে বললেন,

هذا ابو بكر يستاذن عليك

ফাতিমা! আবু বকর (রা.) তোমাকে দেখতে এসেছেন। তিনি তোমার নিকট প্রবেশের অনুমতি প্রার্থনা করছেন।” ফাতিমা (রা.) বললেন, “তুমি কি পছন্দ কর যে, আমি তাঁকে অনুমতি দিই।” ‘আলী (রা.) বললেন, “অবশ্যই”। এরপর ফাতিমা (রা.) তাঁকে প্রবেশের অনুমতি দেন। অতঃপর আবু বকর (রা.) তাঁর কাছে প্রবেশ করেন এবং কথাবার্তা বলে তাঁকে সন্তুষ্ট করলেন। [10]

 

ইমাম আওযাঈ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমার নিকট এ মর্মে খবর পৌছেছে যে, একবার ফাতিমা (রা.) আবু বকর (রা.)-এর প্রতি ক্ষুব্ধ হন। এ কথা জানতে পেরে আবু বকর এক প্রচণ্ড গরমের দিনে তাঁর ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন, তারপর বললেন,  

لا ابرح مكاني حتى ترضى عني بنت رسول الله ﷺ

আমি এ জায়গা ছেড়ে যাবো না,  যে যাবত না রাসুলুল্লাহ ()-এর মেয়ে আমার ওপর সন্তুষ্ট হন।” এরপর তিনি ফাতিমা (রা.)-এর নিকট প্রবেশ করলেন এবং তাঁর সাথে প্রসন্ন মনে কথা বললেন। অবশেষে ফাতিমা (রা.) তাঁর ওপর খুশি হয়ে যান[11]

 

 এ হাদীসগুলো  থেকে জানা যায় যে, ফাতিমা (রা.) জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আবু বকর (রা.)-এর প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন বলে যে কথা বলা হয়, তা সঠিক নয়। তা কি করে সম্ভব হতে পারে যেহেতু আবু বকর (রা.) এ কথা শপথ করে বলেছেন যে,  “আমার নিজের আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহার করার চাইতেও রাসুলুল্লাহ ()-এর আত্মীয়-স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহার করা আমার কাছে অধিক প্রিয়।" [12]

 

উল্লেখ্য, যে সকল বিশুদ্ধ হাদীস থেকে বাহ্যত তাঁদের মধ্যে সম্পর্কহানির কথা জানা যায়, তা ব্যাখ্যাসাপেক্ষ। ইমাম নাবাবী (রাহ.) বলেন, “এতদসংক্রান্ত বর্ণিত হাদীসের মধ্যে উল্লেখিত هجران (সম্পর্কত্যাগ) দ্বারা উদ্দেশ্য এ নয় যে, ফাতিমা (রা.) আবু বকর (রা.)-এর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন এবং এ কারণে তিনি সাক্ষাতের সময় তাঁকে সালাম করতেন না এবং কথাবার্তা বলতেন না। এভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করা ইসলামের দৃষ্টিতেও হারাম, যা ফাতিমা (রা.)-এর ব্যাপারে কল্পনা করাও অসম্ভব । বরং তা দ্বারা উদ্দেশ্য হলো অপ্রসন্ন ভাব। অর্থাৎ আবু বকর (রা.)-এর সাথে সাক্ষাতের সময় ফাতিমা (রা.) নিজের মধ্যে অপ্রসন্ন ভাব অনুভব করতেন। এ অপ্রসন্নতা মীরাছের দাবি করার কারণে স্বভাবগতভাবেই তাঁর মধ্যে জন্ম নিয়েছিল। এ রূপ অপ্রসন্নতাকে স্বভাবগত সঙ্কোচ বলা হয়, যা কোনোক্রমে দোষণীয় নয়। অনুরূপভাবে হাদীসের মধ্যে (فلم تكلم) দ্বারা উদ্দেশ্য এ নয় যে, ফাতিমা (রা.) ইচ্ছাকৃতভাবে আবু বকর (রা.)-এর সাথে যে কোনো কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছিলেন; বরং এর উদ্দেশ্য হলো, মীরাছের দাবি নিয়ে ফাতিমা (রা.) আর কখনো আবু বকর (রা.)-এর সাথে কথা বলেননি অথবা মানবীয় সঙ্কোচে কারণে তাঁর নিজের অন্য কোনো প্রয়োজন পূরণের জন্যও তার নিকট আবেদন করেননি এবং এ উদ্দেশ্যে তাঁর সাথে সাক্ষাত করে কথা বলেননি। এ রূপ কোনো রিওয়ায়াত দেখা যায় না যে, এ ঘটনার পর তাঁরা দু'জনে মিলিত হয়েছেন অথচ ফাতিমা (রা.) তাকে সালাম করেননি এবং কথা বলেননি।” [13]

 

খ)  

রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর ওফাতের পর একদিকে ফাতিমা (রা.) অত্যন্ত মর্মাহত হন, অপর দিকে তিনি ভীষণ অসুস্থও হয়ে পড়েন। তা ছাড়া তিনি রাসুলুল্লাহ (ﷺ) থেকে জানতে পেরেছিলেন যে, রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর পর দ্রুত তাঁর ওফাত হবে। বলাই বাহুল্য, যে ব্যক্তি নিশ্চিত জানতে পারে যে, তার মৃত্যু অত্যাসন্ন, তার অন্তরে দুনিয়ার ভাবনা খুব কমই জাগ্রত হয়। এ সকল কারণে ফাতিমা (রা.) একান্ত প্রয়োজন দেখা না দিলে কোনো কাজে সহজে বাইরে বের হতেন না। সারাক্ষণ বাড়িতেই থাকতেন। আর আবু বকর (রা.)কে রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ড পরিচালনা ও যুদ্ধবিগ্রহের মধ্যে দারুন ব্যস্ত সময় কাটাতে হয়। ফলে দু'জনের মধ্যে সাক্ষাত হবার কোনো সুযোগই তৈরি হয়নি। বিশিষ্ট মুহাদ্দিস আল-মুহাল্লাব (রাহ.) বলেন, “দু'জনের সাক্ষাত হয়েছিল এবং একজন অপর জনকে সালাম করেননি কোনো রাবীই এরূপ কথা বলেননি। বরং ফাতিমা (রা.) সারাক্ষণ বাড়িতেই থাকতেন। তাই রাবী একেই هجران (সম্পর্কত্যাগ) বলে উল্লেখ করেছেন। [14]

 

বস্তুতপক্ষে যে সকল রাবী বলেছেন যে, ফাতিমা (রা.) জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আবু বকর (রা.)-এর সাথে কথা বলেননি, তারা তা নিজেদের ধারণা অনুযায়ী বলেছেন। তা ছাড়া তাদের মধ্যে এমনও কেউ কেউ আছেন যে, যাদের প্রতি শী'আ মত পোষণের অভিযোগ রয়েছে। হাফিয ইবনু কাছীর (রা.) বলেন,

ولعله رى بمعنى ما فهمه عض الرواة وفيهم من فيه تشيع فليعم ذلك

-“সম্ভবত কোনো কোনো বর্ণনাকারী নিজে যা বুঝেছেন, তা-ই বর্ণনা করেছেন। এটাও জেনে নেয়া প্রয়োজন যে, এ বর্ণনাকারীগণের মধ্যে এমন কেউ রয়েছেন, যার মধ্যে শী'আ মতের প্রভাব ছিল। [15]

 

 কোনো কোনো রিওয়ায়াত থেকে এও জানা যায় যে, আবু বকর (রা.)ই ফাতিমা (রা.)-এর জানাযার নামায পড়ান। আলী ইবনুল হুসাইন (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ফাতিমা (রা.) মাগরিবের পর ইশার আগে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর খবর শুনে আবু বকর, উমার, উছমান, যুবাইর ও আবদুর রাহমান ইবনু আওফ (রা.) প্রমুখ বিশিষ্ট সাহাবীগণ তাঁর নিকট উপস্থিত হন। যখন নামাযের জন্য তাঁকে রাখা হয়, তখন ‘আলী (রা.) বললেন, تقدم يا ابا بكر  “হে আবু বকর, আসুন (অর্থাৎ আপনি নামায পড়ান)!”  আবু বকর (রা.) বলেন,  و انت شاهد يا ابا الحسن؟  “হে আবুল হাসান, আপনি উপস্থিত থাকতে আমি নামায পড়াবো?” ‘আলী (রা.) বললেন,

نعم تقدم فوالله لا يصلي عليها غيرك  

“হ্যাঁ, আপনি আসুন, আল্লাহর কাসাম, আপনি ছাড়া আর কেউ তার নামাযে পড়াবে না।” এরপর আবু বকর (রা.) তাঁর নামায পড়ান, অতঃপর রাতেই তাঁকে দাফন করা হয়। [16]

 

ঐতিহাসিক ইবনু সা'দ (রাহ.) বর্ণনা করেন, আবু বকর (রা) ফাতিমা (রা.)-এর জানাযার নামাযে ইমামতি করেন এবং তিনি নামাযে চারটি তাকবীর বললেন। [17] তা ছাড়া কোনো কোনো রিওয়ায়াত থেকে এও জানা যায় যে, ফাতিমা (রা.)-এর মুমূর্ষ অবস্থায় আবু বকর (রা.)-এর স্ত্রী আসমা' বিনতু উমাইস (রা.) তাঁর সেবা-শুশ্রষায় রত ছিলেন এবং মৃত্যুর পর ফাতিমা (রা.)কে যে দু'জন মহিলা গোসল দেন তাঁদের একজন হলেন আবু বকর (রা.)-এর স্ত্রী আসমা বিনতু উমাইস (রা.) এবং অপরজন হলেন রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর গোলাম আবু রাফি (রা.)-এর স্ত্রী সালমা (রা.)। 'আলী (রা.) কেবল তাদের সহযোগিতাই করেন। [18]

 

এ রিওয়ায়তগুলোই অধিকতর যুক্তিযুক্ত ও বাস্তবসম্মত মনে হয়। উল্লেখ্য, শী'আ আলিমগণও গোসলের এ ঘটনাটি স্বীকার করেন। এ রিওয়ায়াতগুলো থেকে প্রমাণিত হয় যে, ফাতিমা (রা.)-এর সাথে আবু বকর (রা.)-এর সম্পর্ক ভালো ছিল না আর এ কারণে তাঁকে না জানিয়ে ‘আলী (রা.) নিজে রাতেই তার জানাযার নামায পড়েন— কথাটি সঠিক নয়; বরং তাঁদের মধ্যে সুসম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। এটা কিভাবে বিশ্বাস করা যায় যে, রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর কলিজার টুকরো ফাতিমা (রা.) মৃত্যুবরণ করেছেন, অথচ রাসুলুল্লাহ (ﷺ)-এর খালীফা এ ব্যাপারে অবগত ছিলেন না এবং তাঁর জানাযায়ও অংশ গ্রহণ করেননি। আমরা এ সম্পর্কে পরে আরো আলোচনা করবো, ইনশা আল্লাহ। প্রকৃতপক্ষে ‘আলী ও ফাতিমা (রা.) সম্পর্কে কোনো কথা নির্বিচারে গ্রহণ করা আমাদের উচিত নয়। শী'আ-সুন্নীর দ্বন্দ্বের অন্তরালে আসল সত্য হয়তো এখানে চাপা পড়ে আছে।

 

এ সংক্রান্ত ব্যাপারে আরো বিস্তারিত জানতে পড়ুনঃ

 

"ফিদাক নিয়ে ফাতিমা ও আবু বকরের মাঝে বিরোধের হাকীকত"

অনুবাদ: সানাউল্লাহ নজির আহমদ

সম্পাদনা: আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

الناشر: ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ

লিঙ্কঃ https://drive.google.com/file/d/1JBuLhgQykJDraW86-1QewNaIatMycRsl/view?usp=sharing

 

তথ্যসূত্রঃ

[1] সহীহ বুখারী, হাদিস নং : ২৮৭৪

[2] আবু বকর(রা.) এর এই পদক্ষেপ সম্পূর্ণরূপে রাসুল(ﷺ) এর নির্দেশ ও আনুগত্যের কারণেই ছিল। এ ব্যাপারে খালিফাতু রাসূলিল্লাহ আবু বকর আছছিদ্দীক রাদিআল্লাহু আনহু বইয়ের ৩৭৬ তেকে ৩৮০ পৃষ্ঠায় বিস্তারিত আলোচনা আছে। আলোচনাটি পড়তে ক্লিক করুন এখানে

[3] ইবনু কুতায়বাহ, তাভীলু মুখতালাফিল হাদীস, পৃ. ৯৩

[4] আহমাদ, আল-মুসনাদ, (মুসনাদু আবী বকর রা.), হা.নং-১৪

[5] ইবনু কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খ. ৫. পৃ.৩১০

[6] নাবাবী, শারহু সহীহ মুসলিম, খ. ৬, পৃ.২০৭

[7] বুখারী, আস-সহীহ, (কিতাবুল ই’তিসাম), হা.নং: ৬৭৬১

[8] ইবনু আবিল হাদীদ, শারহু নাহজিল বালাগাহ, ...

[9] বাইহাকী, দালায়িলুন নুবুওয়াত, (আবওয়াবু মারদি রাসূলিল্লাহ ﷺ), হা.নং: ৩২৭৮; ইবনু কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খ.৫,পৃ.৩১০

[10] বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা, খ. ৬, পৃ.৩০১ ইমাম বাইহাকী (রা.) বলেন, হাদীসটি যদিও মুরসাল; কিন্তু ভালো মানের এবং এর সনদ বিশুদ্ধ।

[11] আল-মুহিব্ব আত-তাবারী, আর-রিয়াদুন নাদিরাতু..., পৃ.৮৩

[12] বুখারী, আস-সহীহ, (কিতাবুল মানাকিব), হা.নং: ৩৪৩৫

[13] নাবাবী, শারহু সহীহ মুসলিম, খ. ৬,পৃ.২০৭

[14] ‘আয়নী, উমদাতুল কারী, খ,

[15] ইবনু কাছীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খ. ৫, পৃ. ৩১০

[16] ইবনু 'আদী, আল-কামিল, খ. ৪,পৃ.২৫৮; আলী আল-হিন্দী, কানযুল উম্মাল, হা.নং: ৩৫৬৭৭; “ইসামী, সিমতুন নুজুম... খ.১,পৃ.২২৭; আল-মুহিব্বু আত-তাবারী, আর-রিয়াদুন নাদিরাতু... পৃ.৮৩

[17] ইবনু সা'দ, আত-তাবাকাতুল কুবরা, খ.৮, পৃ.২৯

[18] ইবনু আবদিল বারর, আল-ইস্তি'আব, খ,২,পৃ.১০২; ইবনুল আছীর, উসদুল গাবাহ, খ,৫, পৃ.৪৭৮