Pray for the world economy

হাদিসে কি নোংরা পানিকে পবিত্র বলা হয়েছে?

 

ইসলামবিরোধীরা একটি হাদিস দেখিয়ে দাবি করে ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী নোংরা-ময়লাপূর্ণ কূপের পানিও নাকি পবিত্র। আর নোংরা পানি দ্বারা ওযু করতে বলে ইসলামে নাকি অবৈজ্ঞানিক ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিধান দেয়া হয়েছে। তারা আরো দাবি করে নবী এর সাহাবীরা কূপের পানিতে আবর্জনা ফেলে নোংরা করে আবার সেই পানিই ব্যবহার করতেন!

এহেন দাবির স্বপক্ষে তারা নিম্নের হাদিসটি পেশ করে—

 

عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ، أَنَّهُ قِيلَ لِرَسُولِ اللهِ صلي الله عليه وسلم أَنَتَوَضَّأُ مِنْ بِئْرِ بُضَاعَةَ وَهِيَ بِئْرٌ يُطْرَحُ فِيهَا الْحِيَضُ وَلَحْمُ الْكِلَابِ وَالنَّتْنُ فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم " الْمَاءُ طَهُورٌ لَا يُنَجِّسُهُ شَىْءٌ "

অর্থঃ “আবূ সাঈদ আল খুদরী (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। একদা রাসূলুল্লাহ -কে জিজ্ঞেস করা হলো, ’আমরা কি (মদীনার) ’বুযাআহ’ নামক কূপের পানি দিয়ে অযু করতে পারি? কূপটির মধ্যে মেয়েলোকের হায়িযের নেকড়া, কুকুরের মাংস ও যাবতীয় দুর্গন্ধযুক্ত জিনিস নিক্ষেপ করা হত। রাসূলুল্লাহ বললেনঃ পানি পবিত্র, কোন কিছু একে অপবিত্র করতে পারে না[1]

 

ইসলামবিরোধীদের এহেন দাবির জবাবে আমরা শুরুতেই যা উল্লেখ করবঃ

 নবী বলেছেন –

 

الطُّهُورُ شَطْرُ الْإِيمَانِ

অর্থঃ "পাক-পবিত্রতা হলো ঈমানের অর্ধেক।" [2]

 

এটি একটা আম বা সাধারণ বক্তব্য। এর দ্বারা সার্বিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার নির্দেশ পাওয়া যায়। ইসলামে পাক-পবিত্রতাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ইসলামে ফিকহের বইগুলোর সূচনাই হয় ‘কিতাবুত ত্বাহারাহ’ (كتاب الطهارة) বা ‘পাক-পবিত্রতা অধ্যায়’ দিয়ে। বহু হাদিস গ্রন্থেও আলাদাভাবে পবিত্রতা অধ্যায় রাখা রয়েছে যেখানে এই সংক্রান্ত হাদিসগুলো একত্রিত করা হয়েছে। ইসলামে এতভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে জোর দেয়া হয়েছে যা নিয়ে দীর্ঘ কলেবরে আলোচনা সম্ভব। [3] ইসলামের বিরুদ্ধে যারা অপরিচ্ছন্নতা ও নোংরামীর অভিযোগ আনে, তারা মূলত সত্যের অপলাপ করে।

 

আবদ্ধ পানি নোংরা করা বা নির্বিচারে যে কোনো স্থানকে নোংরা করা নবী এর আদর্শ না। তিনি তাঁর সাহাবীদেরকে আবদ্ধ স্থানের পানিকে নোংরা করতে নিষেধ করতেন। আবদ্ধ স্থানের পানিতে মূত্রত্যাগের ন্যায় কাজ করে সেই পানি দিয়ে গোসল করতে নিষেধ করতেন।

 

عَنْ جَابِرٍ، عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَنَّهُ نَهَى أَنْ يُبَالَ فِي الْمَاءِ الرَّاكِدِ .

অর্থঃ "জাবির (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ জমা পানিতে প্রস্রাব করতে নিষেধ করেছেন।" [4]

 

هَذَا مَا حَدَّثَنَا أَبُو هُرَيْرَةَ، عَنْ مُحَمَّدٍ، رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم . فَذَكَرَ أَحَادِيثَ مِنْهَا وَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " لاَ تَبُلْ فِي الْمَاءِ الدَّائِمِ الَّذِي لاَ يَجْرِي ثُمَّ تَغْتَسِلُ مِنْهُ " .

অর্থঃ আবূ হুরাইরাহ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ বলেনঃ তুমি এমনটি করো না যে, চলন্ত নয় এমন জমা পানিতে প্রস্রাব করবে তারপর আবার তা থেকে গোসল করবে। [5]

 

এ থেকে প্রমাণ হল যে, জনস্বাস্থ্যের কল্যাণের এই দিকটি ইসলামে মোটেও উপেক্ষিত হয়নি। জনসাধারণের ব্যবহার্য স্থান নোংরা করা নবী এর আদর্শ না। হাদিসে উল্লেখ আছে—

 

 وَعَنْ أَبيْ هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللهِ قَالَ اِتَّقُوا اللاَّعَنيْنِ قَالُوْا : وَمَا اللاَّعَنانِ ؟ قَالَ الَّذِي يَتَخَلَّى فِي طَرِيقِ النَّاسِ أَوْ فِي ظِلِّهِمْ

অর্থঃ  আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ বলেছেন, দু’টি অভিসম্পাত আনয়নকারী কর্ম থেকে দূরে থাক। সাহাবাগণ জিজ্ঞাসা করলেন, দু’টি অভিসম্পাত আনয়নকারী কর্ম কী কী? তিনি (উত্তরে) বললেন, যে ব্যক্তি মানুষের রাস্তায় এবং তাদের ছায়ার স্থলে পায়খানা করে (তার এ দু’টি কাজ অভিসম্পাতের কারণ)[6]

 

মানুষের ব্যবহার্য এই স্থানগুলোতে মলত্যাগ করে অপবিত্র করা ইসলামের দৃষ্টিতে এমন ধৃষ্টতাপূর্ণ কর্ম যাকে “অভিশম্পাত আনয়নকারী কর্ম” বলে অভিহীত করা হয়েছে। আরেকটি হাদিসে প্রায় অনুরূপ কথা উল্লেখ আছে—

 

عَن مُعَاذِ بْنِ جَبَلٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ اتَّقُوا الْمَلاَعَن الثَّلاَثَ الْبَرَازَ فِى الْمَوَارِدِ وَقَارِعَةِ الطَّرِيقِ وَالظِّلِّ

অর্থঃ মুআয বিন জাবাল (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসূল বলেছেন, তোমরা তিনটি অভিশাপ আনয়নকারী কর্ম থেকে বাঁচ; আর তা হল, ঘাটে, মাঝ-রাস্তায় এবং ছায়ায় পায়খানা করা। [7]

 

যে নবীজি আবদ্ধ পানিতে মূত্রত্যাগ বা জনসাধারণের ব্যবহারের স্থানে মলত্যাগের মতো কাজকে অনুমোদন করতেন না, তিনি কী করে সাহাবী(রা.)দের দ্বারা বুযাআহ কূপে চরম নোংরা জিনিসপত্র নিক্ষেপ করা অনুমোদন করেন?

অপরদিকে হাদিসে এটাও দেখা যাচ্ছে যে, বুযাআহ কূপের পানিতে হায়িযের নেকড়া, কুকুরের মাংস ও বিভিন্ন দুর্গন্ধযুক্ত জিনিস নিক্ষেপ করা হত। তাহলে এগুলো কে নিক্ষেপ করতো বা কিভাবে নিক্ষিপ্ত হতো?

প্রাচীন মুহাদ্দিসগণ এর জবাব প্রদান করেছেন। এই প্রসঙ্গে যাকারিয়া আল আনসারী(র.) উল্লেখ করেছেন—

 

قَالَ صَاحِبُ الشَّامِلِ: وَيَجُوزُ أَنْ يَكُونَ مِنَ الْمُنَافِقِينَ

অর্থঃ "আশ-শামিল গ্রন্থের লেখক বলেনঃ "আর এটা সম্ভব যে, মুনাফিকরা [ষড়যন্ত্রমূলকভাবে] এমনটি করেছিল" [8]

 

মুহাম্মাদ বিন আব্দিল হাদি আস সিনদি(র.) উল্লেখ করেছেন—

 

قِيلَ: عَادَةُ النَّاسِ دَائِمًا فِي الْإِسْلَامِ وَالْجَاهِلِيَّةِ تَنْزِيهُ الْمِيَاهِ وَصَوْنُهَا عَنِ النَّجَاسَاتِ، فَلَا يَتَوَهَّمُ أَنَّ الصَّحَابَةَوَهُمْ أَطْهَرُ النَّاسِ وَأَنْزَهُهُمْكَانُوا عَمْدًا يَفْعَلُونَ ذَلِكَ مَعَ عِزَّةِ الْمَاءِ فِيهِمْ، وَإِنَّمَا كَانَ ذَلِكَ مِنْ أَجْلِ أَنَّ هَذِهِ الْبِئْرَ كَانَتْ فِي الْأَرْضِ الْمُنْخَفِضَةِ، وَكَانَتِ السُّيُولُ تَحْمِلُ الْأَقْذَارَ مِنَ الطُّرُقِ وَتُلْقِيهَا فِيهَا.

وَقِيلَ: كَانَتِ الرِّيحُ تُلْقِي ذَلِكَ، وَيَجُوزُ أَنْ يَكُونَ السَّيْلُ وَالرِّيحُ يُلْقِيَانِ جَمِيعًا.

وَقِيلَ: يَجُوزُ أَنْ الْمُنَافِقِينَ كَانُوا يَفْعَلُونَ ذَلِكَ.

অর্থঃ “বলা হয়েছে, ইসলামী যুগ ও জাহেলী যুগ সব সময়েই সবসময় মানুষের রীতি ছিল পানিকে নাপাকি থেকে পবিত্র রাখা ও সংরক্ষণ করা। তাই এটা ভাবা ঠিক নয় যে সাহাবায়ে কেরাম, যারা ছিলেন সর্বাধিক পবিত্র ও নির্মল চরিত্রের মানুষ তাঁরা ইচ্ছাকৃতভাবে এমন কাজ [কূপের পানিতে ময়লা নিক্ষেপ] করবেন। বিশেষ করে যখন [সেই মরুময় অঞ্চলে] তাঁদের কাছে পানির এত মূল্য ছিল। বরং এটা হয়েছে এই কারণে যে, এই কূপটি নিচু ভূমিতে অবস্থিত ছিল এবং বন্যার পানি রাস্তা থেকে ময়লা-আবর্জনা বয়ে এনে এতে ফেলত।

আরো বলা হয়েছে, বাতাসও এগুলো কূপে নিক্ষেপ করতে পারে। আবার এটাও সম্ভব যে, বন্যার পানি ও বাতাস উভয়ই এসব এনে ফেলত। অন্য একটি মত হলো, মুনাফিকরা এমন কাজ [কূপের পানিতে ময়লা নিক্ষেপ]  করত।" [9]

 

এই মতগুলো ইমাম নববী(র.)ও উল্লেখ করেছেন। [10]

ইমাম খাত্তাবী(র.) [মৃত্যু ৩৮৮ হিজরী (৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দ)] উল্লেখ করেছেনঃ

 

قَدْ يَتَوَهَّمُ كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ إِذَا سَمِعَ هَذَا الْحَدِيثَ أَنَّ هَذَا كَانَ مِنْهُمْ عَادَةً وَأَنَّهُمْ كَانُوا يَأْتُونَ هَذَا الْفِعْلَ قَصْدًا وَتَعَمُّدًا، وَهَذَا مَا لَا يَجُوزُ أَنْ يُظَنَّ بِذِمِّيٍّ بَلْ بِوَثَنِيٍّ، فَضْلًا عَنْ مُسْلِمٍ، وَلَمْ يَزَلْ مِنْ عَادَةِ النَّاسِ قَدِيمًا وَحَدِيثًا، مُسْلِمِهِمْ وَكَافِرِهِمْ، تَنْزِيهُ الْمِيَاهِ وَصَوْنُهَا عَنِ النَّجَاسَاتِ، فَكَيْفَ يُظَنُّ بِأَهْلِ ذَٰلِكَ الزَّمَانِ وَهُمْ أَعْلَى طَبَقَاتِ أَهْلِ الدِّينِ وَأَفْضَلُ جَمَاعَةِ الْمُسْلِمِينَ.

وَالْمَاءُ فِي بِلَادِهِمْ أَعَزُّ، وَالْحَاجَةُ إِلَيْهِ أَمَسُّ، أَنْ يَكُونَ هَذَا صَنِيعَهُمْ بِالْمَاءِ وَامْتِهَانُهُ لَهُ، وَقَدْ لَعَنَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَنْ تَغَوَّطَ فِي مَوَارِدِ الْمَاءِ وَمَشَارِعِهِ، فَكَيْفَ مَنْ اتَّخَذَ عُيُونَ الْمَاءِ وَمَنَابِعَهُ رَصَدًا لِأَنْجَاسٍ وَمَطْرَحًا لِلْأَقْذَارِ، هَذَا مَا لَا يَلِيقُ بِحَالِهِمْ.

وَإِنَّمَا كَانَ هَذَا مِنْ أَجْلِ أَنَّ هَذِهِ الْبِئْرَ مَوْضِعُهَا فِي حَدُورٍ مِنَ الْأَرْضِ، وَأَنَّ السُّيُولَ كَانَتْ تَكْسَحُ هَذِهِ الْأَقْذَارَ مِنَ الطُّرُقِ وَالْأَفْنِيَةِ وَتَحْمِلُهَا فَتُلْقِيهَا فِيهَا، وَكَانَ الْمَاءُ لِكَثْرَتِهِ لَا يُؤَثِّرُ فِيهِ وُقُوعُ هَذِهِ الْأَشْيَاءِ وَلَا يُغَيِّرُهُ.

فَسَأَلُوا رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنْ شَأْنِهَا لِيَعْلَمُوا حُكْمَهَا فِي الطَّهَارَةِ وَالنَّجَاسَةِ، فَكَانَ مِنْ جَوَابِهِ لَهُمْ أَنَّ الْمَاءَ لَا يُنَجِّسُهُ شَيْءٌ، يُرِيدُ الْكَثِيرَ مِنْهُ، الَّذِي صِفَتُهُ صِفَةُ مَاءِ هَذِهِ الْبِئْرِ فِي غَزَارَتِهِ وَكَثْرَةِ جِمَامِهِ، لِأَنَّ السُّؤَالَ إِنَّمَا وَقَعَ عَنْهَا بِعَيْنِهَا فَخَرَجَ الْجَوَابُ عَلَيْهَا، وَهَذَا لَا يُخَالِفُ حَدِيثَ الْقُلَّتَيْنِ، إِذْ كَانَ مَعْلُومًا أَنَّ الْمَاءَ فِي بِئْرِ بُضَاعَةَ يَبْلُغُ الْقُلَّتَيْنِ، فَأَحَدُ الْحَدِيثَيْنِ يُوَافِقُ الْآخَرَ وَلَا يُنَاقِضُهُ، وَالْخَاصُّ يَقْضِي عَلَى الْعَامِّ وَيُبَيِّنُهُ وَلَا يَنْسَخُهُ.

অর্থঃ “ এই হাদিস শুনে অনেক মানুষ এমন ধারণা করতে পারে যে, এটা তাঁদের অভ্যাস ছিল এবং তাঁরা স্বেচ্ছায় বা ইচ্ছাকৃতভাবে এমন কাজ করত! কিন্তু এমন ধারণা করা কোনো মুসলিমের ক্ষেত্রে তো দূরের কথা, কোনো যিম্মি বা বিধর্মীর ব্যাপারেও জায়েজ নয়। প্রাচীন ও আধুনিক যুগে সর্বদাই মুসলিম-অমুসলিম সকল মানুষের অভ্যাস ছিল পানিকে অপবিত্রতা থেকে পবিত্র রাখা ও সংরক্ষণ করা। তাহলে কিভাবে সে যুগের লোকদের সম্পর্কে এমন ধারণা করা যায়, যারা ছিলেন ধর্মীয় দিক থেকে সর্বোচ্চ স্তরের এবং মুসলিম উম্মাহর সর্বশ্রেষ্ঠ সম্প্রদায়? তাঁদের দেশে পানি ছিল খুবই দুষ্প্রাপ্য এবং এর প্রয়োজন ছিল অত্যন্ত বেশি। তাহলে এটা কী করে সম্ভব যে তাঁরা পানির প্রতি এমন অবজ্ঞাপূর্ণ আচরণ করবেন? রাসুলুল্লাহ তো পানির উৎস ও পানির প্রবাহপথে মলত্যাগকারীকে অভিশাপ দিয়েছেন। তাহলে যিনি পানির উৎস এবং ঝরনাগুলিকে অপবিত্রতার স্থান ও ময়লা-আবর্জনা ফেলার জায়গা বানায়, তার অবস্থা কত নিকৃষ্ট হতে পারে! এটা তাদের অবস্থার সাথে মোটেও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বরং বাস্তবতা ছিল এই যে - এই কূপটি ছিল ভূমির নিচু অংশে অবস্থিত এবং বন্যার পানি রাস্তা ও উঠান থেকে এসব ময়লা-আবর্জনা ধুয়ে এনে এতে নিক্ষেপ করত। কিন্তু এতে পানির পরিমাণ এত বেশি ছিল যে, এসব জিনিস পড়লে তা পানিকে প্রভাবিত করত না এবং তার গুণাবলী পরিবর্তন করত না। তাই লোকেরা রাসুলুল্লাহ -কে এ কূপের পবিত্রতা ও অপবিত্রতা সম্পর্কিত বিধান জিজ্ঞাসা করেছিল। তিনি তাদের জবাব দিয়েছিলেন, কোনো কিছুই [এই] পানিকে অপবিত্র করতে পারে না। তিনি এখানে সেই অধিক পরিমাণ পানি উদ্দেশ্য নিয়েছিলেন, যার বৈশিষ্ট্য ছিল এই কূপের পানির মতই বিপুল ও অধিক পরিমাণে থাকা। কারণ প্রশ্নটি ছিল সরাসরি এই কূপ সম্পর্কে, তাই উত্তরও এটির প্রসঙ্গেই দেওয়া হয়েছে। এটি "কুল্লাতাইন" (দুই কুল্লা) সংক্রান্ত হাদিসের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। কারণ এটি জ্ঞাত বিষয় যে, বুযাআহ কূপের পানির পরিমাণ দুই কুল্লায় পৌঁছেছিল। সুতরাং হাদিসদ্বয় একে অন্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, পরস্পরবিরোধী নয়। বিশেষ (খাস) বিধান সাধারণ (আম) বিধানের উপর প্রাধান্য পায়, তাকে ব্যাখ্যা করে, কিন্তু রহিত করে না।[11]

 

আরো অনেক মুহাদ্দিস থেকে এই মত বর্ণিত আছে। [12]

 

 

অতএব আমরা দেখলাম, নবী এর সাহাবীরা কূপের পানিতে আবর্জনা ফেলে নোংরা করতেন – এই অভিযোগ আদৌ সঠিক নয়।

এবার আমরা পানিকে “পবিত্র” বলা সংক্রান্ত অভিযোগ প্রসঙ্গে আসি। আলোচ্য হাদিসের ব্যাখ্যায় ‘তুহফাতুল আহওয়াযী’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে—

 

(إِنَّ الْمَاءَ طَهُورٌ)

أَيْ طَاهِرٌ مُطَهِّرٌ، قَالَ الْقَارِئُ فِي الْمِرْقَاةِ: قِيلَ الْأَلِفُ وَاللَّامُ لِلْعَهْدِ الْخَارِجِيِّ، فَتَأْوِيلُهُ: إِنَّ الْمَاءَ الَّذِي تَسْأَلُونَ عَنْهُ وَهُوَ مَاءُ بِئْرِ بُضَاعَةَ، فَالْجَوَابُ مُطَابِقٌ لَا عُمُومٌ كُلِّيٌّ كَمَا قَالَهُ الْإِمَامُ مَالِكٌ، انْتَهَى.

وَإِنْ كَانَ الْأَلِفُ وَاللَّامُ لِلْجِنْسِ فَالْحَدِيثُ مَخْصُوصٌ بِالِاتِّفَاقِ كَمَا سَتَقِفُ.

(لَا يُنَجِّسُهُ شَيْءٌ)

 لِكَثْرَتِهِ، فَإِنَّ بِئْرَ بُضَاعَةَ كَانَتْ بِئْرًا كَثِيرَ الْمَاءِ، يَكُونُ مَاؤُهَا أَضْعَافَ قُلَّتَيْنِ، لَا يَتَغَيَّرُ بِوُقُوعِ هَذِهِ الْأَشْيَاءِ، وَالْمَاءُ الْكَثِيرُ لَا يُنَجِّسُهُ شَيْءٌ مَا لَمْ يَتَغَيَّرْ.

অর্থঃ “{নিশ্চয়ই পানি পবিত্র (ত্বহুর)} — অর্থাৎ, তা নিজে পবিত্র এবং অন্যকে পবিত্র করে। [মোল্লা আলি] ক্বারী(র.) ‘মিরকাত’-এ বলেনঃ বলা হয়েছে যে, এখানে “আলিফ-লাম” হচ্ছে বাহ্যিক নির্দিষ্টতার জন্য, সুতরাং এর ব্যাখ্যা হবেঃ “তোমরা যে পানির ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করছো”, অর্থাৎ “বুযাআহ (বুদ্বাআহ) কূপের পানি” — সুতরাং এই উত্তরটি একটি বিশেষ ঘটনার সাথে সম্পর্কিত, এটি কোনো সাধারণ বা সার্বিক বিধান নয়, যেমনটি ইমাম মালিক(র.) বলেছেন। উক্তি সমাপ্ত। আর যদি “আলিফ-লাম” কে জাতিগত বা সাধারণ শ্রেণী অর্থে বোঝায়, তাহলে হাদিসটি সকলের ঐকমত্যে খাস (নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে প্রযোজ্য), যেমনটি আপনি পরে দেখতে পাবেন {কোনো কিছুই একে অপবিত্র করে না}, কারণ বুযাআহ কূপে বিপুল পরিমাণে পানি ছিল। এর পানি ছিল দুই কুল্লা থেকে অনেকগুণ বেশি, তাই তাতে নাপাক জিনিস পড়লেও তার গুণ পরিবর্তন হতো না। আর পানির পরিমাণ বিপুল হলে কোনো কিছু দ্বারা তা নাপাক হয় না, যতক্ষণ না তার গুণ পরিবর্তিত হয়।[13]

 

আমরা দেখলাম, এখানে নির্দিষ্টভাবে বুযাআহ কূপের পানির ব্যাপারে এটি বলা হচ্ছে। যে কোনো স্থানের পানি কোনোভাবেই অপবিত্র হবে না – এমন কিছু এখানে বলা হয়নি।

 

বুযাআহ কূপের ব্যাপারে কেন এটি বলা হচ্ছে? মুহাদ্দিসদের মতে এর কারণ হল সেই কূপে বিপুল পরিমাণে পানি ছিল। এর ফলে কিছু ময়লা-আবর্জনা সেখানে নিক্ষিপ্ত হলেও সার্বিকভাবে তা সেই কূপের পানির গুণাগুণকে পরিবর্তন করেনি। যেমনটি সাধারণত বড় জলাশয়ে হয়ে থাকে। এই ব্যাপারে ইজমা রয়েছে যেঃ পানিতে কোনো কিছু পড়লে এর পরেও স্বাদ, গন্ধ বা রং যদি অপরিবর্তিত থাকে, তাহলে সেই পানি ‘পবিত্র’ থাকে, অর্থাৎ তা দ্বারা ওযু-গোসল জায়েজ।  

 

قال بن الْمُنْذِرِ أَجْمَعَ الْعُلَمَاءُ عَلَى أَنَّ الْمَاءَ الْقَلِيلَ وَالْكَثِيرَ إِذَا وَقَعَتْ فِيهِ نَجَاسَةٌ فَغَيَّرَ لَهُ طَعْمًا أَوْ لَوْنًا أَوْ رِيحًا فَهُوَ نَجَسٌ

অর্থঃ ইবনুল মুনযির (র.) বলেছেনঃ “আলেমগণ ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, অল্প হোক বা বেশিপানিতে যদি কোনো অপবিত্র বস্তু পড়ে এবং তা যদি পানির স্বাদ, রং বা গন্ধ পরিবর্তন করে, তাহলে ঐ পানি নাপাক (নাজাস) হয়ে যায়। [14]

 

এখন কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারে – একটা বদ্ধ কূপে কী করে বিপুল পরিমাণে পানি থাকে? আর কিভাবে তাতে আবর্জনা পড়া সত্ত্বেও এতে বিদ্যমান পানির স্বাদ, গন্ধ বা রং অপরিবর্তিত থাকতে পারে?

 

প্রথমত, বুযাআহ ছিল বেশ বৃহৎ আকৃতির এক কূপ। ইমাম আবু দাউদ(র.) থেকে বর্ণিত আছে বুযাআহ কূপ ছিল সাড়ে ৩ মিটারেরও অধিক চওড়া। [15] অর্থাৎ তা ছিল বেশ বৃহৎ আকৃতির।

দ্বিতীয়ত, কূপের পানি কোথা থেকে আসে? উত্তর হল - বৃষ্টি, ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগের বিভিন্ন স্থান এবং ভূগর্ভ থেকে আসে। তবে এর পানির মূল উৎস হল ভূগর্ভ। ভূগর্ভস্থ সিক্ত শিলাস্তর (Aquifer) এর মাধ্যমে কূপের অধিকাংশ পানি আসে। ভূগর্ভে বিপুল পরিমাণ পানি মজুদ থাকে, আর সেই পানির সামান্য কিছু অংশ কূপে দৃশ্যমান হয়। আর ভূগর্ভের এই বিপুল পরিমাণ পানির সাথে সংযোগ থাকার ফলে কূপে কিছু আবর্জনা পড়লেও তা সার্বিকভাবে এর পানির গুণাগুণ পরিবর্তন করে না। 

 

সূত্রঃ U.S. Geological Survey ওয়েবসাইট [16]

 

এমন একটি উৎসের পানি থেকে ওযু করার ব্যাপারে নবী অনুমতি প্রদান করেছেন। কোনো নোংরা পানি থেকে ওযু করার ব্যাপারে অনুমতি দেননি।

 

এখানে আরেকটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে, কোনো পানিকে ফিকহের পরিভাষায় ‘পবিত্র’ বা ‘পাক’ বলার অর্থ হল এই পানি দ্বারা ওযু বা গোসল জায়েজ। ফিকহের পরিভাষায় কোনো কিছুকে ‘পবিত্র’ বা ‘পাক’ বলা হলে এর দ্বারা নিশ্চিতভাবে এটা বোঝা যায় না যে ঐ বস্তু একদম শতভাগ জীবাণুমুক্ত বা এর মাঝে কোনো প্রকার অণুজীবের অস্তিত্বই নেই।

যেমন ধরা যাক, একজন ব্যক্তি মসজিদে যাবার পথে আছাড় খেয়ে পড়ে গেল, তার পোশাকে কাদা লেগে গেল। খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে যে তার পোশাকে ময়লা লেগে গেছে। কিন্তু ফিকহের পরিভাষায় ঐ ব্যক্তির পোশাক নাপাক বা অপবিত্র হয়ে যায়নি বরং তার পোশাক তখনও পাক বা পবিত্র আছে। অর্থাৎ ঐ পোশাক সলাত আদায়ের জন্য জায়েজ অবস্থায় আছে। তবে যদি সে পরিষ্কার পোশাকে আসতে পারে তাহলে তার জন্য সেটাই করা উচিত। [17] একইভাবে কোনো পানিকে ‘পবিত্র’ বলার দ্বারা বোঝা যায় যে, সেই পানি ওযু বা গোসলের জরুরত আদায়ের জন্য ন্যুনতমভাবে জায়েজ পর্যায়ে আছে। এখানে নিশ্চিতভাবে এটি বোঝা যায় না যে ঐ পানি সর্বপ্রকার জীবাণু থেকে মুক্ত আছে। কেউ যদি পান করা বা ওযু-গোসলের জন্য আরো পরিষ্কার পানি পায় তবে সে সেই পানিই ব্যবহার করবে। নবী করিম এবং সাহাবী(রা.)গণ এমন এক অঞ্চলে বাস করতেন যেই অঞ্চল ছিল মরুময় এবং যেখানে পানির প্রাপ্যতা ছিল কম। সেখানে বুযাআহ কূপটি বাদে আর খুব বেশি পানির উৎস ছিল না। বুযাআহ কূপের পানি ন্যুনতমভাবে ওযুর জন্য জায়েজ পর্যায়ে ছিল বলেই হাদিস থেকে বোঝা যায়। এই পানিকে ইসলামবিরোধীরা যেভাবে “নোংরা” বলে অভিহীত করে তা বাস্তবতার নিরিখে সঠিক নয়।

 

 

তথ্যসূত্রঃ

[1] সুনান আবু দাউদ, হাদিস নং : ৬৬ (সহীহ)

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=57384

[2] মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস নং : ২৮১ (সহীহ)

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=54840

[4] সহীহ মুসলিম, হাদিস নং : ৫৪২

https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=47300

[5] সহীহ মুসলিম, হাদিস নং : ৫৪৪

 https://www.hadithbd.com/hadith/link/?id=47302

[6] মুসলিম ৬৪১, আবূ দাউদ ২৫; হাদীস সম্ভার ৫৩৪

https://www.hadithbd.net/hadith/link/?id=64053

[7] আবূ দাউদ ২৬, ইবনে মাজাহ ৩২৮, সহীহ তারগীব ১৪১; হাদীস সম্ভার ৫৩৫

 https://www.hadithbd.net/hadith/link/?id=64054

[8] ফাতহুল 'আল্লামি বি শারহিল ই'লামি বি আহাদিসিল আহকাম - যাকারিয়া আল আনসারী, পৃষ্ঠা ৫২

https://shamela.ws/book/20590/49

অথবা https://web.archive.org/web/20250426160928/https://shamela.ws/book/20590/49 (আর্কাইভকৃত)

[9] ফাতহুল ওয়াদুদি ফি শারহি সুনানি আবি দাউদ – মুহাম্মাদ বিন আব্দিল হাদি আস সিনদি, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৬১ 

https://shamela.ws/book/20591/59

অথবা https://web.archive.org/web/20250426161331/https://shamela.ws/book/20591/59 (আর্কাইভকৃত)

[10] দেখুনঃ আল ইজাযু ফি শারহি সুনান আবি দাউদ - ইয়াহইয়া বিন শারাফ আন নববী, পৃষ্ঠা ২৯৩

https://shamela.ws/book/5064/288

অথবা https://web.archive.org/web/20250426161303/https://shamela.ws/book/5064/288 (আর্কাইভকৃত)

[11] মা’আলিমুস সুনান - আবু সুলাইমান হামদ বিন মুহাম্মাদ আল খাত্তাবী, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৩৭-৩৮ 

https://shamela.ws/book/1442/36

https://shamela.ws/book/1442/37

অথবা (আর্কাইভকৃত)

https://archive.is/wip/JD7yf

https://archive.is/wip/obrbF

[12] দেখুনঃ

তুহফাতুল আহওয়াযী – আব্দুর রহমান মুবারকপুরী, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১৭০

https://shamela.ws/book/21662/168

মিরক্বাতুল মাফাতিহ – মোল্লা আলি ক্বারী, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৪৫১

https://shamela.ws/book/8176/807

শারহু সুনানি আবি দাউদ – বদরুদ্দিন আল আইনী, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১৯৮

https://shamela.ws/book/8540/195

অথবা (আর্কাইভকৃত)

https://archive.is/wip/RmxzQ

https://web.archive.org/web/20250426162323/https://shamela.ws/book/8176/807 https://web.archive.org/web/20250426162233/https://shamela.ws/book/8540/195

[13] তুহফাতুল আহওয়াযী – আব্দুর রহমান মুবারকপুরী, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ১৭০

https://shamela.ws/book/21662/168

অথবা https://archive.is/wip/RmxzQ (আর্কাইভকৃত)

[14] ‘আওনুল মা’বুদ ওয়া হাশিয়াতু ইবনিল ক্বাইয়িম – শারাফুল হক আল আযিম আবাদী, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৯১

https://shamela.ws/book/5760/83

অথবা https://archive.is/wip/yGO27 (আর্কাইভকৃত)

[15] “Water of the well of Budhaaah” (Islamweb)

https://www.islamweb.net/en/fatwa/116317/water-of-the-well-of-budhaaah

অথবা https://archive.is/wip/NoWkc (আর্কাইভকৃত)

[16] Aquifers and Groundwater _ U.S. Geological Survey

https://www.usgs.gov/special-topics/water-science-school/science/aquifers-and-groundwater

 অথবা https://archive.is/wip/K0Tes (আর্কাইভকৃত)

[17] সলাত আদায়কারীর পোশাকের ব্যাপারে বিস্ত্যারিত নীতিমালার জন্য দেখুনঃ

"নামাযীর লেবাস"; বইঃ স্বালাতে মুবাশ্‌শির, লেখকঃ আবদুল হামীদ ফাইযী

https://www.hadithbd.com/books/detail/?book=19&section=221