Pray for the world economy

"কিসরার (পারস্য সম্রাট) পর আর কোনো কিসরা নেই" - হাদিসটির পর্যালোচনা

 

নাস্তিক প্রশ্নঃ

নবী মুহাম্মাদের () বলেছেন পারস্যের সম্রাট কিসরার পর তাদের সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যাবে। অথচ পারস্য সাম্রাজ্য ধ্বংস হয় নবী মুহাম্মাদের () মৃত্যুরও বেশ পরে। নবী মুহাম্মাদের () সময়কার পারস্য সম্রাটের মৃত্যুর সাথেই সাথেই তার সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়নি। এর দ্বারা কি হাদিসে ভুল ভবিষ্যতবাণী করা হল না?

 

 

জবাবঃ

আলোচ্য হাদিসটির রেফারেন্সঃ সুনানে তিরমিজী, কিতাবুল ফিতান, হাদীস নং ২২১৬

এর বাংলা অনুবাদঃ-

আবু হুরায়রা(রা.) হতে বর্ণিত আছে, রাসুল (ﷺ) বলেছেনঃ- "যখন কিসরা ধ্বংস হয়ে যাবে তার পর থেকে আর কোনো কিসরা থাকবে না এবং যখন কায়সার ধ্বংস হয়ে যাবে তার পর থেকে আর কোনো কায়সার থাকবে না। শপথ সেই সত্তার যার হাতে আমার প্রাণ, অচিরেই তোমরা এ দুই সাম্রাজ্যের সম্পদ আল্লাহ'র রাস্তায় ব্যয় করবে।"

(হাদীসের মানঃ সহীহ)।


সম্পর্কিত তথ্যঃ-

তিরমিজী শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ "তুহফাতুল আহওয়াযী" কিতাবে হাদিস সংশ্লিষ্ট একটি প্রশ্নোত্তর (আরবি ভাষায়) নিম্নরূপঃ- 
ﻗﺎﻝ ﺍﻟﺤﺎﻓﻆ ﻓﻲ ﺷﺮﺡ ﻫﺬﺍ ﺍﻟﺤﺪﻳﺚ : ﻗﺪ ﺍﺳﺘﺸﻜﻞ ﻫﺬﺍ ﻣﻊ ﺑﻘﺎﺀ ﻣﻤﻠﻜﺔ
ﺍﻟﻔﺮﺱ ﻷﻥ ﺁﺧﺮﻫﻢ ﻗﺘﻞ ﻓﻲ ﺯﻣﺎﻥ ﻋﺜﻤﺎﻥ ، ﻭﺍﺳﺘﺸﻜﻞ ﺃﻳﻀﺎ ﻣﻊ ﺑﻘﺎﺀ ﻣﻤﻠﻜﺔ
ﺍﻟﺮﻭﻡ ﻭﺃﺟﻴﺐ ﻋﻦ ﺫﻟﻚ ﺑﺄﻥ ﺍﻟﻤﺮﺍﺩ ﻻ ﻳﺒﻘﻰ ﻛﺴﺮﻯ ﺑﺎﻟﻌﺮﺍﻕ ﻭﻻ ﻗﻴﺼﺮ ﺑﺎﻟﺸﺎﻡ
ﻭﻫﺬﺍ ﻣﻨﻘﻮﻝ ﻋﻦ ﺍﻟﺸﺎﻓﻌﻲ ، ﻗﺎﻝ ﻭﺳﺒﺐ ﺍﻟﺤﺪﻳﺚ ﺃﻥ ﻗﺮﻳﺸﺎ ﻛﺎﻧﻮﺍ ﻳﺄﺗﻮﻥ
ﺍﻟﺸﺎﻡ ﻭﺍﻟﻌﺮﺍﻕ ﺗﺠﺎﺭﺍ ، ﻓﻠﻤﺎ ﺃﺳﻠﻤﻮﺍ ﺧﺎﻓﻮﺍ ﺍﻧﻘﻄﺎﻉ ﺳﻔﺮﻫﻢ ﺇﻟﻴﻬﻤﺎ ﻟﺪﺧﻮﻟﻬﻢ ﻓﻲ ﺍﻹﺳﻼﻡ ﻓﻘﺎﻝ ﺍﻟﻨﺒﻲ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﺫﻟﻚ ﻟﻬﻢ ﺗﻄﻴﻴﺒﺎ ﻟﻘﻠﻮﺑﻬﻢ ﻭﺗﺒﺸﻴﺮﺍ ﻟﻬﻢ ﺑﺄﻥ ﻣﻠﻜﻬﻤﺎ ﺳﻴﺰﻭﻝ ﻋﻦ ﺍﻹﻗﻠﻴﻤﻴﻦ ﺍﻟﻤﺬﻛﻮﺭﻳﻦ 

অর্থঃ- সহীহ বুখারীর ব্যাখ্যাকারক ইমাম হাফেজ ইবন হাজার(র.) স্বীয় কিতাবে হাদিসটির ব্যাখ্যায় বলেন, পারস্য সাম্রাজ্য বাকি থাকাতে একটি প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে। যেহেতু পারস্যের শেষ অধিপতি নিহত হয় উসমান(রা.)-এর যুগে। আবার রোমান সাম্রাজ্য বহাল থাকাতেও প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে।

 

আমি [ইবন হাজার(র.)] তার জবাবে বলি, এই ভবিষ্যৎবাণী থেকে উদ্দেশ্য হচ্ছে ইরাক থেকে পারস্য অধিপতির ক্ষমতা খর্ব হয়ে যাওয়া এবং শাম (বৃহত্তর সিরিয় অঞ্চল) থেকে রোমান অধিপতির ক্ষমতা খর্ব হয়ে যাওয়া। ইমাম শাফিঈ(র.) থেকে এভাবে উদ্ধৃত হয়েছে।

কারণ হাদিসটির একটা প্রেক্ষাপট আছে। তা হচ্ছে কুরাইশরা ব্যবসার উদ্দেশ্যে ইরাক এবং শাম দেশে আসা যাওয়া করতো। কুরাইশরা যখন ইসলাম কবুল করল তখন তারা ইরাক আর শামের দিকে তাদের ভ্রমণ চিরতরে বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশংকা বোধ করলো। রাসুল (ﷺ) তখন তাদের মানসিক প্রশান্তি দিতে ও সুসংবাদ দিতে বললেন, অচিরেই উল্লিখিত দুটো অঞ্চল (ইরাক ও শাম) থেকে ওই দুই সাম্রাজ্যবাদীর ক্ষমতা খর্ব হয়ে যাবে।"

(অনুবাদ সমাপ্ত হল)।


উল্লেখ্য, পারস্য আর রোমান সাম্রাজ্যের অধিপতিরা যথাক্রমে 'কিসরা' এবং 'কায়সার' উপাধিপ্রাপ্ত।

কুরাইশরা যে পেক্ষাপটে প্রশ্নটি করেছিল, সে প্রেক্ষাপট অনুযায়ী হাদিসটির ভবিষ্যতবাণী একদম সঠিক। সেই কায়সার ও কিসরার পরে আর কোনো কায়সার বা কিসরা ছিল না যারা আরব কুরাইশ বণিকদের ব্যাবসার পথ রুদ্ধ করতে পারে। তাদের ব্যাবসা রোখার জন্য শাম ও পারস্যের আর কোনো কায়সার বা কিসরা ছিল না। রাসুল(ﷺ) এর মৃত্যুর কিছুকাল পরে খলিফা আবু বকর(রা.) এর আমলেই শাম ও পারস্য সাম্রাজ্যের মূল ভুখণ্ডে মুসলিমদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হয়ে যায়।

 

হাদিসটিকে প্রেক্ষাপটের বিচারে অনুধাবন করাও অপরিহার্য। প্রেক্ষাপটের বিচারে বোঝা যাচ্ছে যে, রাসুল(ﷺ) ঢালাওভাবে এটা বোঝাতে চাননি যে, নিজপুত্র শিরাওয়াই (شيرويه) কর্তৃক ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে যেই পারস্য সম্রাট দ্বিতীয় খসরু ( কিসরা) নিহত হয়েছিল তার পরপরই পারস্য সাম্রাজের বিলুপ্তি ঘটবে। বরং পারস্য এবং রোমান সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সর্বপ্রথম যথাক্রমে ইরাক আর শামে তাদের ক্ষমতা হারাবে মর্মে তিনি ভবিষ্যৎবাণী দিয়েছিলেন। কেননা হাদিসটির শেষেই রাসুল(ﷺ) এটাও বলেছেনঃ- “শপথ সেই সত্তার যার হাতে আমার প্রাণ - অচিরেই তোমরা এ দুই সাম্রাজ্যের সম্পদ আল্লাহ'র রাস্তায় ব্যয় করবে।”  রাসুল(ﷺ) পারস্য আর রোমান সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সম্পদ (অর্জিত গণিমত) আল্লাহ'র রাস্তায় অচিরেই ব্যয় করার আগাম ভবিষ্যৎবাণী দিয়েছেন। যেই ভবিষ্যৎবাণীটা ছিল আগাম ও অনির্দিষ্ট সময়ের সাথে সম্পর্কিত। যার পূর্ণতা লাভ করে ইসলামের তৃতীয়তম খলিফাতুল মুসলিমীন হযরত উসমান(রা.)-এর খেলাফত আমলে। (রেফারেন্স - তুহফাতুল আহওয়াযী দেখুন)।

 

ইতিহাস সাক্ষী যে, তৃতীয় ইয়াজদিগার্দ ছিলেন পারস্যের সাসানীয় সাম্রাজ্যের অষ্টাত্রিংশ ও শেষ জরথুষ্ট্রীয় সম্রাট। তিনি ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৬৫১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পারস্য সাম্রাজ্যের সম্রাট ছিলেন। সম্রাট তৃতীয় ইয়াজদিগার্দের শাসনামলে পারস্য সাম্রাজ্য অনেক দুর্বল হয়ে উঠে। তার সিংহাসন আরোহণের এক বছর পর পারস্য সাম্রাজ্যে মুসলিম আরবরা খলিফা আবু বকর(রা.)-এর অধীনে সামরিক অভিযান চালায়। ৬৫১ খ্রিষ্টাব্দে খলিফা উসমান ইবন আফফান (রা.)-এর শাসনামলে ও তাঁর খেলাফতের ৭ম বর্ষে এই শেষ জরথুষ্ট্রীয় সম্রাটের পতন হয়, যার ফলে পারস্য সাম্রাজ্য ইসলামী খিলাফতের অধীনে আসে। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত পারস্য সাম্রাজ্য ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়নি, আর কখনোই পূর্ণ এলাকাগুলো একত্র করে প্রাচীন পারস্য সাম্রাজ্যের ন্যায় সাম্রাজ্য হয়নি। সুতরাং “কিসরার পর আর কিসরা হবে না” -- রাসুল(ﷺ)-এর এ ভবিষ্যৎবাণীও সত্য প্রমাণিত হল।