Pray for the world economy

আল্লাহ কি মানুষের সাথে কোন মাধ্যম ছাড়া সরাসরি কথা বলেন?

স্ববিরোধিতার অভিযোগঃ আল্লাহ কি কারো সাথে সরাসরি কথা বলেন? না (Quran 42:51) এবং হ্যাঁ (Quran 53:11, 2:259, 2:36, 4:164) !

 

জবাবঃ সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলো নিচে উল্লেখ করা হল।

 

[১]

“ কোন মানুষের জন্য এমন হওয়ার নয় যে, আল্লাহ তার সাথে কথা বলবেন। কিন্তু ওহীর মাধ্যমে অথবা পর্দার অন্তরাল থেকে অথবা তিনি কোন দূত প্রেরণ করবেন, অতঃপর আল্লাহ যা চান, সে তা তাঁর অনুমতিক্রমে পৌঁছে দেবে। নিশ্চয় তিনি সর্বোচ্চ প্রজ্ঞাময়।” [1]

 

[২]

“  রসূলের অন্তর মিথ্যা বলেনি যা সে দেখেছে। তোমরা কি বিষয়ে বিতর্ক করবে যা সে দেখেছে? নিশ্চয় সে তাঁকে আরেকবার দেখেছিল।  সিদরাতুল মুন্তাহার নিকটে, [2]

 

“তুমি কি সে লোককে দেখনি যে এমন এক জনপদ দিয়ে যাচ্ছিল যার বাড়ীঘরগুলো ভেঙ্গে ছাদের উপর পড়ে ছিল? বলল, কেমন করে আল্লাহ মরনের পর একে জীবিত করবেন? অতঃপর আল্লাহ তাকে মৃত অবস্থায় রাখলেন একশ বছর। তারপর তাকে উঠালেন। বললেন, কত কাল এভাবে ছিলে? বলল আমি ছিলাম, একদিন কংবা একদিনের কিছু কম সময়। বললেন, তা নয়; বরং তুমি তো একশ বছর ছিলে। এবার চেয়ে দেখ নিজের খাবার ও পানীয়ের দিকে-সেগুলো পচে যায় নি এবং দেখ নিজের গাধাটির দিকে। আর আমি তোমাকে মানুষের জন্য দৃষ্টান্ত বানাতে চেয়েছি। আর হাড়গুলোর দিকে চেয়ে দেখ যে, আমি এগুলোকে কেমন করে জুড়ে দেই এবং সেগুলোর উপর মাংসের আবরণ পরিয়ে দেই। অতঃপর যখন তার উপর এ অবস্থা প্রকাশিত হল, তখন বলে উঠল-আমি জানি, নিঃসন্দেহে আল্লাহ সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাশীল।[3]

 

“অনন্তর শয়তান তাদের উভয়কে ওখান থেকে পদস্খলিত করেছিল। পরে তারা যে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে ছিল তা থেকে তাদেরকে বের করে দিল এবং আমি বললাম, তোমরা নেমে যাও। তোমরা পরস্পর একে অপরের শক্র হবে এবং তোমাদেরকে সেখানে কিছুকাল অবস্থান করতে হবে ও লাভ সংগ্রহ করতে হবে।” [4]

 

“এছাড়া এমন রসূল পাঠিয়েছি যাদের ইতিবৃত্ত আমি আপনাকে শুনিয়েছি ইতিপূর্বে এবং এমন রসূল পাঠিয়েছি যাদের বৃত্তান্ত আপনাকে শোনাইনি। আর আল্লাহ মূসার সাথে কথোপকথন করেছেন।” [5]

 

সুরা শুরার আলোচ্য আয়াতটি (শুরা ৪২:৫১) ইহুদিদের এক হঠকারী দাবির প্রেক্ষিতে নাজিল হয়েছিল। বাগাভী ও কুরতুবী প্রমুখ লিখেছেন যে, ইহুদিরা রাসুলুল্লাহ(ﷺ)কে বলল, “আমরা আপনার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে পারি না। কেননা আপনি মুসা(আ) এর ন্যায় আল্লাহ তা’আলাকে দেখেন না এবং তাঁর সাথে সামনাসামনি কথাবার্তাও বলেন না।”

 রাসুলুল্লাহ(ﷺ) বললেন, এ কথা সত্য নয় যে মুসা(আ) আল্লাহ তা’আলাকে দেখেছিলেন। এরই প্রেক্ষিতে আয়াতটি অবতীর্ণ হয়। এর সারমর্ম এই যে, এ দুনিয়াতে আল্লাহ তা’আলার সাথে সরাসরি ও সামনা সামনি কথা বলা কোন মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। স্বয়ং মুসা(আ)ও সামনাসামনি কথা শোনেননি বরং যবনিকার অন্তরাল থেকে আওয়াজ শুনেছেন মাত্র।

এ আয়াতে আরো বলা হয়েছে যে, মানুষের সাথে আল্লাহ তা’আলার কথা বলার ৩টি মাত্র উপায় আছে।

 এক –وَحْيًا   - অর্থাৎ কোন বিষয় অন্তরে জাগ্রত করে দেওয়া। এটা জাগ্রত অবস্থাতেও হতে পারে আবার নিদ্রাবস্থায় স্বপ্নের আকারেও হতে পারে। এ ব্যাপারে অনেক হাদিস রয়েছে।

...

২য় উপায়-- أَوْ مِن وَرَاءِ حِجَابٍ  --অর্থাৎ জাগ্রত অবস্থায় যবনিকার অন্তরাল থেকে কোন কথা শোনা। মুসা(আ) তুর পর্বতে এভাবেই আল্লাহ তা’আলার কথা শুনেছিলেন। কিন্তু তিনি আল্লাহ তা’আলার সাক্ষাত লাভ করেননি।

...

৩য় উপায়--أَوْ يُرْسِلَ رَسُولًا  --অর্থাৎ জিব্রাঈল(আ) প্রমুখ কোন ফেরেশতাকে কালাম দিয়ে প্রেরণ করা এবং নবীকে তার পাঠ করে শোনানো। এটাই ছিল সাধারণ পন্থা।

... ... ...

আলোচ্য আয়াতে বর্ণিত এ নীতি দুনিয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। দুনিয়াতে কোন মানুষ আল্লাহ তা’আলার সাথে সামনা সামনি কথা বলতে পারে না।  [6]

 

সহীহ হাদিসে রয়েছে যে, রাসুলুল্লাহ(ﷺ) জাবির ইবন আব্দুল্লাহ(রা)কে বলেন, “আল্লাহ পর্দার অন্তরাল ছাড়া কারো সাথে কথা বলেননি, কিন্তু তোমার পিতার সাথে তিনি সামনা সামনি হয়ে কথা বলেছেন।” (তিরমিযি ৮/৩৬০) আব্দুল্লাহ(রা) উহুদের যুদ্ধে কাফিরদের হাতে শহীদ হয়েছিলেন। কিন্তু এটা স্মরণ রাখা দরকার যে, এটা ছিল আলমে বারযাখের কথা আর এই আয়াতে (শুরা ৪২:৫১) যে কালামের কথা বলা হয়েছে তা হল ভূ-পৃষ্ঠের উপরের কালাম। [7]

 

সুরা নাজমে আল্লাহর সঙ্গে রাসুলুল্লাহ(ﷺ) এর সরাসরি/সামনাসামনি দেখা হবার বা কথা বলবার কোন বিবরণ নেই।

 

সুরা নাজম ৫৩:১১-১৪ আয়াতগুলোর ব্যাখ্যায় জামি’ তিরমিযিতে একটি হাদিস আছে।

 

মাসরূক(র) আয়িশা(রা)কে জিজ্ঞেস করেনঃ “হে উম্মুল মু’মিনীন! মুহাম্মাদ(ﷺ) কি তাঁর মহিমান্বিত রবকে দেখেছেন?”

উত্তরে আয়িশা(রা) বলেনঃ “সুবহানাল্লাহ! তোমার কথা শুনে আমার শরীরের রোম খাড়া হয়ে গেছে!”

আমি[মাসরূক(র)] বললামঃ তাহলে—“নিশ্চয়ই সে তার পালনকর্তার মহান নিদর্শনাবলী অবলোকন করেছে” (সুরা নাজম ৫৩:১৮) এ আয়াতের কী অর্থ করবেন?

তিনি[আয়িশা(রা)] বললেনঃ জেনে রেখো যে এই ৩টি কথা তোমাকে বলে, সে মিথ্যা বলে।–

 

১। যে তোমাকে বলে যে মুহাম্মাদ(ﷺ) তাঁর রবকে দেখেছেন সে মিথ্যা বলে।

২।যে বলে যে রাসুল(ﷺ) ওহীর কোন অংশ গোপন করেছেন সে মিথ্যা বলেছে। এবং

৩।যে বলে তিনি ঐ ৫টি বিষয় জানতেন যা একমাত্র আল্লাহ জানেন। অতঃপর তিনি পাঠ করেন---

“নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছেই কেয়ামতের জ্ঞান রয়েছে। তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং গর্ভাশয়ে যা থাকে, তিনি তা জানেন। কেউ জানে না আগামীকল্য সে কি উপার্জন করবে এবং কেউ জানে না কোন দেশে সে মৃত্যুবরণ করবে। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, সর্ববিষয়ে সম্যক জ্ঞাত।” (সুরা লুকমান, ৩৪নং আয়াত)

এরপর তিনি বলেন, “তবে হ্যাঁ, তিনি জিব্রাঈল(আ)কে তাঁর আসল আকৃতিতে ২ বার দেখেছেন। একবার তিনি দেখেছেন সিদরাতুল মুনতাহায় এবং অন্যবার দেখেছেন মক্কার ‘আযইয়াদ’এ। যখন জিব্রাঈল(আ) আগমন করেন তখন তাঁর ৬০০ ডানা দিগন্ত বিস্তৃত হয়ে ছড়িয়ে ছিল।”

(তিরমিযি ৯/১৬৭)

 

এ প্রসঙ্গে আর একটি হাদিস রয়েছে---

“আবু যার(রা) বলেছেনঃ আমি রাসুল(ﷺ)কে জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কি আল্লাহকে দেখেছেন?”

তিনি বললেনঃ “আমি কিভাবে দেখব, তিনি তো নুর।””

(মুসলিম ১/১৬১) [8]

 

অতএব সুরা নাজমে রাসুলুল্লাহ(ﷺ) আল্লাহর সঙ্গে সরাসরি দেখা করেননি কিংবা সরাসরি কথা বলেননি। আলোচ্য আয়াতে জিব্রাঈল(আ)কে সরাসরি দেখার কথা বলা হয়েছে।

 

মুফাসসিরগণের মতে সুরা বাকারাহ ২:২৫৯ নং আয়াতে উজাইরের কথা বলা হয়েছে। সেখানেও এই কথোপকথন  সামনাসামনি বা সরাসরি ছিল না। ইবন কাসির(র) আয়াতের তাফসিরে উল্লেখ করেছেনঃ

“...অতঃপর যখন ফুঁ দিয়ে সারা দেহে আত্মা প্রবেশ করানো হয় তখন আল্লাহ তা’আলা মালাক(ফেরেশতা) এর মাধ্যমে তাকে জিজ্ঞেস করেনঃ   كَمْ لَبِثْتَ ۖ قَالَ لَبِثْتُ يَوْمًا أَوْ بَعْضَ يَوْمٍ ۖ  “তুমি কতদিন ধরে এভাবে(মরে) ছিলে?”

উত্তরে তিনি বলেনঃ “এখনও তো একদিন পুরা হয়নি।” ... ” [9]

 

দুনিয়াতে মানুষের সাথে আল্লাহ তা’আলার বাক্যালাপের মাধ্যম হিসাবে ফেরেশতাগণের কথা পূর্বে সুরা শুরার ৫১ নং আয়াতের আলোচনায় উল্লেখ করা হয়েছে।

 

সুরা বাকারাহ ২:৩৬ নং আয়াতে আদম(আ) এর উদ্যেশ্যে আল্লাহ তা’আলার আদেশের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে এই কথোপকথনের স্বরূপ বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়নি। এটি যদি সরাসরিও হয়ে থাকে সেটিও সুরা শুরার ৫১নং আয়াতের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। কেননা আদম(আ)এর সাথে আল্লাহ তা’আলা যে কথা বলেছেন তা দুনিয়াতে নয় বরং জান্নাতে। সুরা শুরার ৫১নং আয়াতটি ভূপৃষ্ঠে মানূষের সাথে বাক্যালাপের ব্যাপারে নাজিল হয়েছে যা পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। সুরা বাকারাহর ৩৮ নং আয়াতে এটাও বলা হয়েছে যে পৃথিবীতে নেমে যাবার পর আল্লাহর নিকট থেকে হেদায়েত তথা ওহী পৌঁছাবে।

 

সুরা নিসা ৪:১৬৪ নং আয়াতে মুসা(আ) এর সঙ্গে আল্লাহ তা’আলার কথোপকথনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই কথোপকথনের ব্যাপারে পূর্বেই সুরা শুরার ৪২:৫১ নং আয়াতের আলোচনায় আলোকপাত করা হয়েছে। মুসা(আ) আল্লাহর সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলেননি বরং যবনিকার অন্তরাল থেকে আওয়াজ শুনেছেন।

 

উপসংহারে বলা যায় যে—আল্লাহ তা’আলা ভূপৃষ্ঠে মানুষের সঙ্গে সামনাসামনি বা সরাসরি কথা বলেন না যা সুরা শুরার ৫১ নং আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআনের অন্যান্য আয়াতগুলোর তথ্যের সাথে এই আয়াতের তথ্যের কোন বিরোধ বা বৈপরিত্য নেই।

 

তথ্যসূত্রঃ

[1]  আল কুরআন, শুরা ৪২:৫১

[2]  আল কুরআন, নাজম ৫৩:১১-১৪

[3]  আল কুরআন, বাকারাহ ২:২৫৯

[4]  আল কুরআন, বাকারাহ ২:৩৬

[5]  আল কুরআন, নিসা ৪:১৬৪

[6]  তাফসির মা’আরিফুল কুরআন(বিস্তারিত), সুরা শুরার ৫১ নং আয়াতের তাফসির, খণ্ড ৭, পৃষ্ঠা ৭০১-৭০২

[7]  তাফসির ইবন কাসির ৭ম খণ্ড(হুসাইন আল মাদানী প্রকাশনী), সুরা শুরার ৫১নং আয়াতের তাফসির, পৃষ্ঠা ৫৮০

[8]  তাফসির ইবন কাসির, সুরা নাজমের ১১-১৮ নং আয়াতের তাফসির দ্রষ্টব্য

[9]  তাফসির ইবন কাসির ১ম খণ্ড (হুসাইন আল মাদানী প্রকাশনী), সুরা বাকারাহর ২৫৯ নং আয়াতের তাফসির, পৃষ্ঠা ৬৫৫